আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪২

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪২
suraiya rafa

টর্চার সেলের সবগুলো গেট উন্মুক্ত আজ। রাশিয়ান পাইথন প্যারাডাইস এটা। এই ভবনে দাঁড়িয়ে আড়ালে আবডালে খু”নখারা’পি করার অভ্যাস নেই পাইথন লিডারের। এখানে সেই একমাত্র বাদশা।নিষিদ্ধ দুনিয়ায় বুক চিতিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো মরীচিকার সম্রাট। দ্যা ব্লাডিবিস্ট রীশস্কা।
ভেতরের শুকনো জমাট র’ক্তের উৎকট গন্ধটা নাকে এসে লাগছে ভীষণ। সমগ্র মেঝেতে বীভৎস লালিমার ছড়াছড়ি। যেন নরকীয় আগ্রাসনে রনক্ষেত্র চারিপাশ। মেঝের মধ্যেখানে লুটিয়ে পরে থাকা প্রতিটি ছিন্নভিন্ন লাশ ই কেবল জানে কতটা নৃশংস ছিল তাদের এই সুদীর্ঘ দুর্বিষহ মৃত্যু যাত্রা। প্রত্যেকটা নিথর শরীরের ঘাড় থেকে মস্তিষ্ক অবধি বিধ্বস্ত রূপে কদর্য। কারোর হাত নেই, কারোর পা নেই, তো কারোর দু’ভাগকৃত বিদীর্ণ মস্তিষ্কটা উচ্ছিষ্টের ন্যায় পরে আছে দু’দিকে ,অথবা কারোর ধরের সঙ্গে মাথাটাই আর যুক্ত নেই। শক্ত মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছিন্নক মগজটা ছিটকে গিয়ে আঁচড়ে পরেছে সিমেন্ট আস্তরিত কুচকুচে কালো দেওয়ালের অগ্রভাগে । নৃ’শংস বিভীষিকা হয়ে মানবদেহের তরতাজা অস্তিত্ব গলিত মোমের ন্যায় চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে সেথায়।

যেন কোনো অশুভ দানবের তীব্র ক্রোধের সামান্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল এই অতর্কিত ধ্বংসলীলা।
আলোর উপস্থিতি নগন্য। কক্ষের এক প্রান্তে যান্ত্রিক রোবটের ন্যায় নির্লিপ্তে দণ্ডায়মান একদল সশস্ত্র মাফিয়া বাহিনী। ঠিক তার অপরপ্রান্তরে চরম বিভীষিকার ইন্ধন। তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ধরণের ফাঁ”শির মঞ্চ। একটা কিংবা দু’টো নয়, অগণিত পোক্ত বাঁধনের রশি ঝুলছে সেথায়। ঝুলছে অ’র্ধমৃ’ত প্যারাডাইস দেহরক্ষীদের ছিন্নভিন্ন র’ক্তা’ক্ত দেহাবশেষ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পায়ের তলায় মাটি নেই, গঙ্গা স্রোতের ন্যায় চুপচুপ করছে র’ক্তের প্লাবন। নিটোল পদযুগলে সেই র’ক্তস্রোত পায়ে মাড়িয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কাউচ চেয়ারটায় গিয়ে গা ছড়িয়ে বসলো এরীশ। র’ক্তস্নাত চপচপে শরীর তার। ধারালো মুখাবয়ব জুড়ে বিন্দু বিন্দু জলকনার ন্যায় জমে আছে লালাভ বিভীষিকা।
এই মূহুর্তে মৃ’ত্যুদূতের ন্যায় বিদঘুটে রকম ভয়াবহ লাগছে তার শূন্য অস্তিত্বকে। বিশাল কাউচ চেয়ারটায় নির্বিঘ্নে আসীন হয়ে,বাম হাতের র’ক্তমাংস আবর্তিত ড্যাগার নামক ধারালো মা”রণা”স্ত্রটিকে ছুঁড়ে ফেললো অদূরে। পরপরই কাঁধ সটান করে ধ্বনিত হলো মাফিয়া বসের বিকট হুংকার,

— আর কে আছে? সেদিন রাতে আর কে কে উপস্থিত ছিল এই টর্চার সেলে?
অদৃশ্য ভূকম্পন খেলে গেলো চারিপাশে, যান্ত্রিক ইঞ্জিনের ন্যায় কেঁপে উঠলো দেহরক্ষীরা। কন্ঠতালু ভেদ করে বেড়িয়ে এলো চাপা রুদ্ধশ্বাস। সকলের মধ্যে থেকে স্পাই টীমের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান লিডার মার্চেন্ট জুনিয়র মৃদু আওয়াজে প্রত্যুত্তর করতে চাইলো কিছু।তবে ফুরসত হলোনা, তার আগেই তর্জনি উঁচিয়ে কালকূটের ন্যয় শীতল বাক্য ধ্বণিত করলো মাফিয়া বস,
—আমি সেই বিশ্বাসঘাতকটাকে দেখতে চাই, যে কিনা পাইথন প্যারাডাইসে উপস্থিত থেকেই দিনের পর দিন তথ্য পাচার করেছে,
বিট্রেয়ার গেইম খেলেছে আমার সঙ্গে। ওর কলিজার পরিধি কতটুকু?
ভীতিগ্রস্ত কদম ফেলে সামনে এগুলো লোকটা। ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা পুরুষালি ত্বকে জড়ো হয়েছে তার রক্তিম আধার। চওড়া কপালের কালচে সরু শিরা-উপশিরা গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান।
লিডারের চোখে চোখ রাখার দুঃসাহস তার হলোনা, অগত্যা হুট করেই সন্নিকটে এগিয়ে একপ্রকার নতজানু হয়ে হাটু ভেঙে বসলো রক্তাক্ত মেঝেতে। কন্ঠতালু থেকে নিঃসৃত করলো বাক্যধ্বণি

— আমি কিছু বলতে চাই লিডার। গিফ মি আ সেকেন্ড চান্স। প্লিইইজ!
— ওটা আমার ডিকশিনারিতে নেই।
— মানেহ…
— ইন মাই ওয়ার্ল্ড, ইফ ইউ ফাক আপ ওয়ান্স, ইউ আর ডান, নো মোর সেকেন্ড চান্স।
শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো হীম শীতল কন্ঠস্বর। এরীশের কথার পাছে যুবকের ওষ্ঠাগত প্রাণ। তটস্থ উদগ্রীব স্বরে ব্রিটিশ যুবক মার্চেন্ট নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বলে উঠলো ,
— আমরা বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি বস, যেহেতু পাইথন প্যারাডাইসে ফ্যাক্স সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম তাই আমরা ওটাকেই বার্তা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। সেখানে নাইট ওয়াচারদের বার্তা এসেছিল, আপনার অনুপস্থিতিতে বেশ কিছু গ্যাংস্টার গ্রুপ জঙ্গলের সীমানায় বিরতিহীন হামলা চালিয়েছিল। ওরা খুব শীঘ্রই প্যারাডাইস সীমানা অতিক্রম করতো, তাই ফুরসত করিনি। অল্প সংখ্যক গার্ড’সদের প্যারাডাইস গেট আর পেন্টহাউজ পাহারায় নিয়োজিত রেখে আমরা মিশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু?

— কিন্তু?
বরফ শীতল আওয়াজ ভেদ করলো মরীচিকার কণ্ঠস্বর। সৌষ্ঠব যান্ত্রিক শরীরে কাঁপন ধরলো যুবকের । বললো,
— কিন্তু পুরোটাই ছিল গার্ডদের সরিয়ে পেন্টহাউজে প্রবেশ করার গভীর এক ষড়যন্ত্র।আর আমি নিশ্চিত টমেটো প্রিন্সের মতো গোখরা সাপের পক্ষে একা এতো বড় মিশন লিড দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়, এর পেছনে তৃতীয় পক্ষের হাত রয়েছে।
— হঠাৎ এতোবড় ষড়যন্ত্রের কারণ?
— হতে পারে ব্লাড ডায়মন্ড।
কপাল গোছালো এরীশ,র”ক্তসিক্ত তর্জনী খানা বোলালো নিজ চিবুকে। যুবক বলতে লাগলো,
— শুনেছি এই রত্নের আসল মালিক ডেনিয়েল নয়, সে অ্যামাজনের একদল অধিবাসীর থেকে চুরি করে এনেছে এই ব্লাড ডায়মন্ড।
— জানি।
মৃতের ন্যায় নির্জীব কণ্ঠস্বর।

— আমি সন্দিহান। এই প্ল্যান ডেনিয়েলের নয়, নিশ্চয়ই ব্লাড ডায়মন্ডের আসল মালিকের।
— ব্লাড ডায়মন্ডের আসল মালিক আমি, এরীশ ইউভান। এতোদিন যাদের হাতে ছিল তারা কেবলই রক্ষক, অন্যকিছু না।
— পৃথিবীতে ব্লাড ডায়মন্ড একপিস ই আছে। পাওয়ার বাসনা অনেকের, তাই মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই এই রত্নখনি হাত বদল করবে।
নির্লিপ্ত শূন্য বদনে এরীশ শুনে গেলো সবটা। অতঃপর ঠোঁটের আগায় পৈশাচিক ভাঁজ টেনে প্রশ্ন ছুড়লো,
— চোখে এতো অস্বস্তি কেন? মাফিয়ারা কখনো ঘাবড়ায় না। প্রয়োজন হলে প্রাচুর্য্যের বদলে জান দিয়ে দেয়।
মাফিয়া বসের আস্থা সংগ্রহে অবিচল থেকে লোকটা ভীতিগ্রস্ত স্বরে বলে,
— আই উইল।
— ওকে ফাইন, প্রুভ ইট!
বৃদ্ধাঙ্গুলির ভাঁজে আটকে থাকা র”ক্তসিক্ত চটচটে রিভলবারটা ছুড়ে মা’রলো মার্চেন্টের পানে। খানিক ঘাবড়ালো বিপরীত পক্ষ, বোধ হয় এতোটাও কাঠিন্যতা আশা করেনি সে।

— শ্যুট ইওর সেল্ফ!
গমগমে রূঢ় আওয়াজ ধ্বনিত হওয়ার পরপরই ভীতুগ্রস্ত হাত বাড়িয়ে রিভলবারটা তুলে নিলো মার্চেন্ট। তবে মূহুর্তেই সেই বশ্যতা পরিনত হলো চরম বিশ্বাসঘাতকতায়। চোখের পলকে ট্রিগার টেনে সেটিকে এরীশের বক্ষস্থল বরাবর তাক করলো সে ।
— হ্যান্ডস আপ মি. রীশস্কা।
ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপাত্তক হাসলো এরীশ। কি অদ্ভুত ভয়ংকর সেই নৈঃশব্দ্যিক হাসি। ঠোঁটে হাসির রেখা অথচ চক্ষুগহ্বরে দাউদাউ করছে রক্তপিপাসুর ন্যায় রক্তিম অঙ্গার। হাসি অব্যাহত রেখেই ধীর পায়ে তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেল এ ঘুরতে লাগলো সে। মার্চেন্ট ও অবিচল সেই ঘূর্ণিপাকে। একদৃষ্টে লক্ষ্য স্থির তার। পলক ফেলবার ফুরসত নেই। জিতে যাওয়ার অবকাশ ক্ষীণ, অগত্যা প্রাণপন সতর্ক সে বান্দা।
— তুমি কি জানো, ব্লাড ডায়মন্ড তার আসল মালিকের হাতে এখনো পৌঁছায়নি।
ম্যানিউপুলেট করার অভিনব কৌশল। কথা-কাজে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মার্চেন্ট জুনিয়র পা দিলো সেই ফাঁদে। জিজ্ঞেস করলো,

— হু ইজ দ্যা ওউনার?
ফের কপট হাসিতে প্রসারিত হলো ওষ্ঠাধর। লোকটার পদক্ষেপের পানে সরু দৃষ্টিপাত করে বললো,
— কে হতে পারে? গেইস ইট।
— টমেটো প্রিন্স ইনভিজিবল এক গড ফাদারের কথা উল্লেখ করেছিেল, যে bratva এর অংশ নয়।
—- হাহ,টমেটো প্রিন্স!
শব্দটা উচ্চারণ করে চূড়ান্ত পদযুগল স্থির করলো মাফিয়া বস।
ঘাবড়ালো মার্চেন্ট। তবে বন্দুক নামানোর প্রয়াস নেই। সে জানে, হয় মরণ নয় মারণ। এর মাঝে একবারও পলক ফেলার সুযোগ হয়নি তার। দাবার গুটি উল্টে যেতেও ন্যানো সেকেন্ড সময় লাগে বোধ হয়, তার চেয়েও দ্রুত গতিতে উল্টে গেলো পজিশন। বিদ্যুৎ বেগে লোকটাকে পায়ের কাছে ফেলে ওর কণ্ঠনালি বরাবর শর্টনাইফ চেপে ধরে এরীশ। নির্জীব দু’ঠোঁট এবার স্বক্রিয়। পিয়ার্সড আই ভ্রু খানা সন্তোর্পনে উঁঠে আছে কপালে, যেন মানুষ মা’রতে নয়, কোনো নামি-দামি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দিতে দাঁড়িয়ে আছেন সুপারস্টার সাহেব। ভয়ে হাঁপিয়ে উঠলো মার্চেন্ট, উন্মাদের ন্যায় বলতে লাগলো,

— টমেটো প্রিন্সের ডেসটিনেশন আমার জানা নেই, সত্যি জানা নেই। আমিতো স্রেফ তৃতীয় পক্ষ।
—এ্যালেক্সান্দ্রেয় কোথায়?
বরফ কেটে ফেলার মতোন ধারালো কন্ঠস্বর।
— আমম…
জিভ দিয়ে বাক্য উচ্চারণের আগেই, ওর গলার অগ্রভাগে চোখ বুঁজে টান মারলো এরীশ। মৃত্যর আশংকায় দুনিয়া কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো মার্চেন্ট, পরপরই টের পেলো ওর শ্বাসনালি এখনো অক্ষত রয়েছে, খানিক চামড়া কেটেছে শুধু। আতঙ্কিত মুখাবয়ব, যেন হৃদয়টা খামচে ধরেছে কেউ। ওর মরিমরি অবস্থা অবলোকন করতেই মুখের রঙ পাল্টালো মাফিয়া বস। চেহারায় উত্তাপ ঢেলে, অশুভ দানবের ন্যায় দৃষ্টি ফেললো মার্চেন্টের কর্তিত গ্রীবাদেশ পানে, অতঃপর হিমশীতল কন্ঠে আওড়ালো,
— পরের বার মুখ দিয়ে “আ” উচ্চারণের সুযোগ হবেনা আর।
ঢকাত করে শুষ্ক এক ঢোক গিললো লোকটা, জিহ্বা তার তরলশূন্য। শুষ্কতায় কণ্ঠনালি আটকে আসছে বারবার। তবুও ভয়ে তটস্থ হয়ে বলতে লাগলো সে,
—টমেটো প্রিন্স শুধু ওই মেয়েটাকে আঁটকে রেখেছিল, বাকি গার্ডসদের উদ্দেশ্য ছিল পেন্টহাউজে প্রবেশ করে অফিস কক্ষ সার্চ করা। পাইথন প্যারাসাইডের সিকিউরিটি ক্যামেরা সার্ভারও তারাই ডাউন করেছে, কিন্তু ওই কক্ষে ব্যাকআপ এনালগ সিকিউরিটি থাকায় ঢোকার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি।

— এ্যালেক্সান্দ্রেয় কোথায়?
একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলো ফের।লোকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো আতঙ্কে।
— আমি আর কিছুই জানিনা।
উদগ্রীব স্বরে বাক্যটা উচ্চারিত করে পালানোর ধান্ধায় উঠতে চাইলো বেশ কয়েকবার, কিন্তু সে সুযোগ হলোনা, যত বার মাথা তুলেছে, ঠিক ততবার নিজ হাটু দ্বারা ওর নাসারন্ধ্র থেঁতলে দিয়েছে এরীশ। মুখ তার র’ক্তে জবুথুবু, ভারী শ্বাস টেনে বললো,

— সত্যিই এর বাইরে কিচ্ছু জানিনা আমি।শুনেছি চোরাই পথে সেদিনই রাশিয়া ত্যাগ করেছে টমেটো প্রিন্স। শুধু বলে গিয়েছি, এমন এক সত্যি রয়েছে যা স্বয়ং পাইথন লিডারের অজানা, সত্যি জানতে হলে তার মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। আর এও বলেছে, এবার তাকে পাকড়াও করা দুঃস্বাধ্য। কারণ, ও জানে আপনার দূর্বলতা। একটা বাঙালি মেয়ে । যার চোখের রঙ নীল। সমুদ্রের মতো গাঢ় নীল। আর মেয়েটা…
সম্পূর্ণ বাক্যধ্বনি কণ্ঠনালি ভেদ করার আগেই এরীশের পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়লো মার্চেন্টের নিথর শরীরটা। ওর কণ্ঠনালি দুভাগ হয়ে গিয়েছে, কোনোমতে ঘাড়ের সঙ্গে আঁটকে আছে মাথাটা। র’ক্তের লালিমায় প্লাবিত চারপাশ। সেদিকে ভুলেও দৃষ্টিপাত করলো না এরীশ, মুঠোবন্দি শর্টনাইফ টা ছুড়ে ফেললো একপাশে, থমথমে নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে ঝনঝনিয়ে শব্দ হলো সেথায়। দু’হাতে র’ক্তের জোয়ার। আর যাই হোক একটা সামান্য গ্যাংস্টারের মুখে মাফিয়া বসের দূর্বলতার উক্তিটি শোভা পায়না।
— আমার দূর্বলতা নিয়ে কথা বলা মোটেই উচিৎ হয়নি তোমার।
স্বগোতক্তিকে আওড়ালো এরীশ। কন্ঠে তার বরফের ন্যায় নির্জীবতা। মেঝেতে পরে থাকা বীভৎস লাশটার পানে নিজের শূন্য দৃষ্টি স্থাপন করে ফের বলে উঠলো ,
— তোমার কথা সত্যি হোক, কিংবা মিথ্যা। টমেটো প্রিন্সের মুখোমুখি তো আমি হবোই। যেদিন হবো সেদিন ওর আত্নাটাও ভয়ে আর্তনাদ করে বলবে “এরীশ ইউভান এসেছে”।

উপস্থিত কারোর মুখে রা নেই। নৈঃশব্দ্যিক নির্জীবতা গ্রাস করেছে চারিপাশ। গার্ডস গুলো এখনো অনুমতির অপেক্ষায়। র’ক্তসিক্ত শরীর নিয়ে বেজমেন্ট ছাড়লো এরীশ , যাওয়ার আগে দৃঢ় কন্ঠে আদেশ করলো ,
— নেকড়ে প্যাকটাকে বেজমেন্টে ছেড়ে দাও,সাথে বোজোকেও। আজ ওদের ভুঁড়ি ভোজের পালা।

পেন্ট হাউজে ফিরে এসে সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেলো মাফিয়া বস। কক্ষে প্রবেশ করে র’ক্তাক্ত শরীরটাকে সর্ন্তোপনে এলিয়ে দিলো কালো রঙের রাজকীয় ডিভানে। চোখের সামনে ক্রিস্ট্যাল খচিত কফি টেবিল। তার উপরে একটা বড়সড় আওয়ারগ্লাস, অর্থাৎ বালুঘড়ি। আপাতত দুনিয়া ভুলে একদৃষ্টে সেটিকেই পর্যবেক্ষন করে চলেছে সে। চোখে তার বিতৃষ্ণা। কোন সত্যির কথা বললো মার্চেন্ট?

এরীশ ভাবলো না খুব বেশি। ওর মস্তিষ্কটা ভাবতে দিচ্ছে না কিছুই। সে ঘুরেফিরে একই জায়গায় আটকে যাচ্ছে বারবার । ঈশানী! তপ্তশ্বাস ছেড়ে মাথাটা হেডবোর্ডে এলিয়ে নির্লিপ্তে চোখ বোজে এরীশ। ডিভান হাতরে ঈশানীর ফেলে যাওয়া ওড়নাখানি এনে রাখে বুকের কাছে।
হৃদয়ের কোথাও একটা ব্যথা করছে মাফিয়া বসের। বাহ্যিক সকল ব্যথাকে এক নিমেষে ম্লান করে দেয় সেই অসহনীয় চিনচিন ব্যথাটা। জীবনে প্রথমবার নিজের পেন্টহাউজে অবস্থান করা সত্বেও অন্য কোথাও মন পরে আছে ওর। সত্যি বলতে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একটা পাপিষ্ঠ জানোয়ারকে ভালোবেসে সাকুরার পবিত্রতা শেষ অবধি অক্ষুণ্ণ থাকবে তো আদৌও? নাকি ফ্লোরার মতো…..
ব্যতিগ্রস্ত ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ হতে দিলোনা এরীশ। তার আগেই ধাক্কা হাঁকিয়ে সরিয়ে ফেললো মস্তিষ্ক থেকে।
— সাকুরা পবিত্র, ঝরনার জলের মতো স্বচ্ছ। যতবড় চ্যালেঞ্জারই আসুক না কেন, এরীশ ইউভানকে টপকে ওই পবিত্রতাকে কলুষিত করা এতো সহজ নয়।

খানিক আগের হাহাকার,আর্তনাদ, নিরুদ্বেগ বিধ্বংসী প্রলয় সবকিছুই বিলীন হয়েছে নিস্তব্ধতায়। তবুও এই মূহুর্তে উদভ্রান্ত মস্তিষ্কের তাড়নায় চোখের সামনে রণক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতেও বোধ হয় পিছপা হবেনা মাফিয়া বস। অগত্যা নিজেকে খানিক স্বস্তি দিতে সিগারেট ধরালো সে । ট্রেজার’স গোল্ড লিফ,মাত্রাতিরিক্ত দামী এই সিগারেটের ধোঁয়া যেন কুণ্ডলী পাকানো অপার্থিব এক স্বর্গীয় বাষ্প। তবুও অনুভূতিহীন হৃদযন্ত্রটা শান্ত হয়না এরীশের। দাবানলের ন্যায় জ্বলছে মস্তিষ্ক। ধূসর বাদামি গহ্বরে তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উদ্ভাসন। বুকের উপর ফেলে রাখা শিফনের ওড়নাটাকে ফের তুলে নিলো নাকের কাছে। মোহাবিষ্ট হয়ে গভীর শ্বাস টানলো। ভ্যনিলার মিষ্টি গন্ধটা এখনো অবশিষ্ট, যেন স্বয়ং ঈশানী বসে আছে ওর কোলের উপর। তেমন করেই জলন্ত শলাকার নিকোটিন টুকু বক্ষ ভেদিয়ে ভেতরে টেনে শীতল আওয়াজ উচ্চারণ করলো এরীশ ,
— দূর্বলতা কি জিনিস জানা নেই। তুমি তো আমার আকাঙ্ক্ষা, প্রলয়ের ন্যায় বিধ্বংসী আকাঙ্ক্ষা। যে আকাঙ্ক্ষার কাছে গোটা মাফিয়া টেরিটোরির একমাত্র লালসার বস্তু ব্লাড ডায়মন্ডও মূল্যহীন। পুরো দুনিয়ার বিনিময়ে চেয়ে বসে আছি আমি তোমায়। শুধু তোমায়।
বেশকিছুক্ষন নৈঃশব্দ্য। পরমূহুর্তেই একটু নড়েচড়ে স্বগতোক্তিতে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস,
— কখনোই তো কথা শোনোনা, সীমাহীন অবাধ্য রমণী। এবার ফিরে ক্রুজশীপে না পেলে খবর আছে তোমার।

মস্কো শহর থেকে প্রায় মাইল পঞ্চাশেক দূরে তুষারের কান্ট্রি সাইড ভিলার অবস্থান। বরফে ঢাকা বিপদজনক রাস্তাঘাট। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যাবস্থা ক্ষীণ। আঁকাবাকা রাস্তার বাঁক ধরে একটানা ড্রাইভ করেছে তুষার। তাও ভিলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোররাত। সুদীর্ঘ লম্বা জার্নির দরুন গাড়িতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে ফ্লোরা। তুষার আর আগ বাড়িয়ে জাগায়নি ওকে, কোলে তুলে নিয়ে এসেছে রুমে।
ফ্লোরার বিশ্রামের ব্যাবস্থা করে নিজে এসে দাড়িঁয়েছে জানালার ধারে। ট্র্যান্সপারেন্ট গ্লাসটা একপাশে সরানো, ফলস্বরূপ উদীয়মান সূর্যের সুক্ষ্ম নরম আলোটুকু এসে ঠিকরে পরছে তুষারের সৌষ্ঠবাকৃতির তামাটে বদনে। বরফাচ্ছাদিত পর্বতের চূড়োয় মাথাচাড়া দিচ্ছে একফালি মোমের মতো নরম তুলতুলে সূর্যালোক। অদূর থেকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসে। ক্ষীণ উষ্ণতায় কেমন তন্দ্রা ধরে যায় দু’চোখে। যদিও সেই নরম উষ্ণতা মোটেই ছুঁতে পারেনা তুষারের জালাময়ী অন্তরটাকে। সে নিটোল, নির্জীব। বক্ষগহ্বরে জলন্ত এক আগ্নেয়গিরির দাবানল। একদিকে ভাঙা চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয়ের ফ্লোরা, ওর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ , অন্যদিকে জন্মদাত্রী মা’কে আত্নপরিচয় না দিতে পারার হাহাকার। দু’টোতে মিলেমিশে তুষারের ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। অথচ অভিব্যক্তি তার শান্ত সাবলীল। যেন কোথাও কিচ্ছুটি হয়নি। গোটা পৃথিবী ওর অনুকূলে।

তুষার চেয়েছিল নির্নিমেষ। হাতদুটো তার ফর্মাল প্যান্টেল পকেটে আবদ্ধ। তন্মধ্যে ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম জড়ানো মেয়েলি কণ্ঠস্বর,
— আপনার শার্টে র’ক্ত লেগে আছে তুষার। এটা পাল্টাবেন না?
সচকিত বদনে পাশ ঘুরলো তুষার। দেখলো ওর দিকেই বিরস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ফ্লোরা। চেহারায় তার বিষাদের ঘনঘটা, অথচ পরনের সাদা ফ্রকটাতে কি স্নিগ্ধই না লাগছে মেয়েটাকে। কে বলবে,দুদিন আগেই এই মেয়েটার উপর দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর ঝড় বয়ে গিয়েছে। নির্বিকারে একঝলক মেয়েটাকে আগাগোড়া পরখ করলো তুষার। অতঃপর বিনা প্রত্যুত্তরে এগিয়ে এসে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো,

— ঘুম কেমন হলো?
— আপনি কখনো আমার সঙ্গে এতোটা
স্বাভাবিক আচরণ করেননা তুষার। শুনতে কেমন কানে লাগছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো যন্ত্র মানব। ফ্লোরার বিষণ্ণ হৃদয়টাকে খানিক স্বস্তি দিতে চাইলো বোধ হয়,
— তোমাকে আমি দূরে নিয়ে এসেছি, দ্যাখো এখানে কেউ নেই।
— আপনি তো আছেন।
— আমার উপস্থিতি কি খুব বেশি অস্বস্তিদায়ক?
— উহুম, একদমই না ।
ফ্লোরার এই সামান্য সম্মোহনী বাক্যে যেন প্রাণ ফিরে পেলো তুষার। সহসা এগিয়ে এসে নির্দ্বিধায় আঁকড়ে ধরলো ওর হাত, টেনে এনে বসালো কাউচে। অতঃপর নিজে গিয়ে হাঁটুভেঙে বসলো ফ্লোরার সম্মুখে। ফ্লোরা বিস্মিত, দু’চোখে তার কৌতুহলের জোয়ার, না জানি আবারও কোন অনিষ্টের দ্বায়ে বকাঝকা শুরু করে এই লোক। ফ্লোরা বিধ্বস্ত, তা জানা সত্বেও কি এমনটা করবে তুষার? মেয়েটার অযাচিত সব ভাবনাকে দূরে হটিয়ে, তুষার বলে উঠলো,
— তুমি ঠিক আছো ফ্লোরা?
প্রত্যুত্তরে নির্লিপ্তে মাথা দোলায় ফ্লোলা। পরপরই ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য।
— আমায় বিয়ে করবে? প্লিজ!

তুষারের মুখ থেকে এই কথাটা শোনার জন্য কত অপেক্ষা-ই না করেছিল মেয়েটা, কত প্রহর গুনেছিল উচাটন চিত্তে। দিন গেলো, মাস গেলো, কতগুলো বছর গেলো, এখন তো বাইরে স্নো ফল ও হয়না তেমন।অবশেষে যখন হৃদয়টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো,সর্বাঙ্গ কলুষিত হলো, ফ্লোরার অপেক্ষার প্রহর ফুরোলো, তখন কিনা তুষার এই প্রস্তাব রাখলো। কিন্তু কেন? এটা ভালোবাসা নাকি এক সম্ভ্রম হারানো অসহায় রমণীর প্রতি স্রেফ দয়া। মাফিয়ারা কি আদৌও দয়া দেখাতে সক্ষম? ভাবনার অতলে নিমজ্জিত ফ্লোরা, ওর ধ্যান ভাঙলো তুষারের ভারিক্কি আওয়াজে,
— কিছু বলছো না যে।
— কিন্তু আপনি বলেছিলেন, আপনি কখনো বিয়ে করবেন না। বিয়ে, সংসার, পরিবার এসব কিছু মাফিয়াদের জন্য নয়। তাহলে হঠাৎ এই মত বদলের কারণ কি তুষার?
রমণীর সুস্পষ্ট প্রশ্ন । তুষার ব্যতিগ্রস্ত হলোনা মোটেই, একই ভাবে বললো,
— এটা আমার সিদ্ধান্ত। বাকিটা জীবন তোমাকে আগলে রাখার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় জানা নেই আমার।
— তারমানে আপনি আমায় ভালোবাসেন না, স্রেফ দ্বায়িত্ব পালন করতে চাইছেন। কেন, আমি অপবিত্র বলে? নাকি এখন আমার জীবনটা পুরোপুরি মূল্যহীন বলে?
নির্বিকার সাবলীল অবয়বখানি শক্ত হয়ে এলো এতোক্ষণে । দাঁতে দাঁত পিষলো তুষার,চোখে তার যন্ত্রণার পাহাড়। সেই যাতনাগ্রস্ত অথচ অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফ্লোরার পানে। ছলছলে করুন অক্ষিদ্বয় মেয়েটার। চাইলেও বুঝি কান্না থামাতে পারছে না সে ।

— এবার একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলছো না?
— আমি আপনাকে বিয়ে করবো না তুষার। আপনি আদেশ করলেও না। অন্তত এবার একটু অবাধ্য হতে দিন দয়া করে। প্লিইইজ।
অশ্রুসজল চোখ জোড়া এবার সত্যিই পরাস্ত হলো অনুভূতির দাঁড়ে। বুকভাঙা কান্নার জোয়ার উগরে এলো বাইরে। শরীর কাঁপিয়ে ব্যাকুল বদনে কাঁদছে মেয়েটা। গোলাপি থেকে রক্তিম আভায় ছেয়ে গিয়েছে তার ক্রন্দনরত মুখ। সেদিকে তাকানো মাত্রই কড়াপড়া নির্জীব শক্ত হৃদয়যন্ত্রটা অকস্মাৎ ছটফট করে উঠলো তুষারের,যেন তীর বিদ্ধ এক আহত সত্তা।
তারপরেও বুকের ভেতর অবিরাম র’ক্তক্ষরণের প্রবলতা বাড়াতে বোধ হয় মোটেও কুণ্ঠিত নয় রমণী। তাইতো চকচকে ধাতব রিভলবারখানি বাড়িয়ে দিলো তুষারের পানে। বললো,

— এটা কোনো কাজেই আসেনি তুষার। শেষ অবধি নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি আমি। আর এখন পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে আপনার মুখোমুখি।
— প্লিইইজ! প্লিজ স্টপ ইট ফ্লোরা। আমি শুনতে চাইনা এসব। একদম ভুলভাল কথা বলবে না আমার সামনে। ধৈর্যের মাত্রা অতিক্রম করলে তোমাকে শ্যুট করতেও দ্বিধা করবো না আমি।
তুষারের যান্ত্রিক চোখে যেন আ’গুন ধরেছে এবার। অধর কাঁপছে ক্ষুদ্ধতায়। ফ্লোরা বললো,
— সেটাই করুন।আমার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আমি কখনো আপনার নিষেধাজ্ঞায় কর্ণপাত করিনি। চলেছি নিজের মতো। মাফিয়াদের অন্ধকার সম্রাজ্যে নিজেকে জোৎস্না ভেবে এসেছি সর্বদা, যেন কেউ আমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না । কি আশ্চর্য! কিসের এতো ভরসা আমার বলুন তো? আমি কি করে ভুলে গেলাম, এই বিধ্বংসী টেরিটোরিতে স্বয়ং পবিত্রতাও কলুষিত।
— প্লিইইজ! এবার থামো।
তুষারের চোখে এহেন অসহায়ত্ব এ জীবনে দেখেনি ফ্লোরা। তারা কষ্ট হলো তুষারের জন্য, কান্না থামিয়ে, নিজেকে খানিক স্থির করে বললো,

— আপনাকে এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নই আমি।
— তাহলে রিভলবারটা বাড়িয়ে রেখেছো কেন? এটা দিয়ে কি করবো আমি?
— আপনি নয় আমি করবো।
— মানে!
পুরোপুরি অজ্ঞাত তুষার, আরও একবার হাঁটুভেঙে তুষারের মুখোমুখি হয়ে মেঝেতে বসলো ফ্লোরা,রিভলবারটা ওর হাতের নিকট এগিয়ে দিয়ে বললো,
— হাতে নিন, বলছি।
তুষার তাই করলো,কোনোকিছু না ভেবেই তুলে নিলো সেটিকে।
— আমাকে বন্দুক চালানো শিখাবেন তুষার?
কথাটা শোনা মাত্রই হতবিহ্বলিত নয়নে ফ্লোরার পানে দৃষ্টিপাত করে তুষার। আদুরে খুকির মতো ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছে মেয়েটা। চেহারার কোথাও কাঠিন্যতার ছায়াটুকু অবধি নেই অথচ মাত্রই মেয়েটা গুলি চালনা শেখার আবদার জানালো ওর নিকট। তুষার অবশ্য আশ্চর্য হলোনা বিশেষ। শুধু শান্ত সাবলীল বাক্যে শুধালো,
— প্রতিশোধ নিতে চাইছো?
এবারও নিস্প্রভ চাহনি, হীনমন্যতার লেশমাত্র নেই। কেবল রিনরিনে কণ্ঠস্বর ভেদিয়ে ধ্বনিত হলো অনুভূতিহীন রুষ্ট আওয়াজ,
— ভয়ংকর প্রতিশোধ।

রয়্যাল ক্যারাভিয়ান, বাংলাদেশ।
মাঝসমুদ্রে ভাসমান সুবিশাল ক্রুজশীপটা গত পনেরোটা দিন ধরে একই জায়গায় স্থীর। কক্সবাজার বন্দর থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করায় খালি চোখে বালুচর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গার্ড’স গুলো সব আপন কার্জে নিয়োজিত । তারা প্রায়সই দলে দলে স্পীডবোডের সহায়তায় বন্দরের দিকে যায়। আবার ফিরেও আসে প্রয়োজন মিটিয়ে। এই যেমন মাত্রই পরপর চারখানা স্পীডবোড চলে গেলো জাহাজ ছাড়িয়ে। কেভিনের করিডোরে দাঁড়িয়ে আপাতত সেসবই পর্যবেক্ষন করছে ঈশানী। ইদানীং সময় কাটেনা ওর। মাফিয়া পেন্টহাউজের মতো এখানেও মোবাইল ব্যাবহারে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এদিকে এরীশের কঠোর আদেশ একাএকা বাইরে যাওয়া যাবে না কোনোমতেই । ঈশানী বিরক্ত ভীষণ। সমুদ্রের মাঝে সারাদিন শুয়েবসে থাকতে আর ভালো লাগছে না ওর। তাছাড়া বাইরে গেলে ক্ষতিটা কি? এটাতো আর রাশিয়া নয়, যে বের হলেই শত্রুদের কবলে পরতে হবে, তাহলে কিসের এতো রেস্ট্রিকশন?
— বোর হচ্ছো নিশ্চয়ই?

এক অযাচিত নারী কণ্ঠের আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটে ঈশানীর। হতচকিত বদনে পাশ ঘুরতেই দেখা মেলে নাতালিয়ার। সুশ্রী চেহারারা এই ব্রিটিশ ভদ্রমহিলার বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। কতইবা হবে পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেই বোধ হয়। এরীশের ব্যক্তিগত রাধুনি তিনি। স্ক্রুজশীপে অবস্থান কালে মাফিয়া বসের সকল খাবার দাবার তার তদারকিতেই তৈরি হয়। শুধু মাত্র এরীশ আর তুষারের জন্যই রান্না করেন ভদ্রমহিলা, যদিও ইদানীং ঈশানীর এসে যোগ হয়েছে তার গেস্টের তালিকায়।
— আপনি কি করে জানলেন?
মুখোমুখি দাড়িয়ে প্রত্যুত্তর করলো ঈশানী। সমুদ্রের অগাধ জলরাশির পানে নির্লিপ্ত দৃষ্টিপাত করে, ভাবলেশহীন কণ্ঠে নাতালিয়া বললেন,
— তোমার চেয়ারা দেখে মনে হচ্ছে।
বাঁধভাঙা বাতাসের তোড়ে এলোমেলো চুলের দাপট সামলানো মুশকিল । কোনোমতে চুলগুলো একটা ক্ল্যাচারে প্যাঁচিয়ে জবাব দিলো ঈশানী,
— আমি সত্যিই বোর হচ্ছি, বন্দরে যেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। আচ্ছা এখান থেকে কক্সবাজার বন্দরটা কতদূর বলুন তো?

— পালাতে চাইছো?
তীর্যক হাসির আভা খেলে গেলো ভদ্রমহিলার ঠোঁটের আগায়।
— স্বামীর কাছ থেকে কে পালায়?
কথার জোরে ঈশানীও ছক্কা হাঁকালো এবার। নাতালিয়া বললেন,
— স্বামী বলছো! ভয় করোনা ওকে?
— ভয় করিনি কোনো কালেই, বড়জোর ঘৃণা করেছি।
— ঘৃণাটুকু ভালোবাসায় রূপান্তরিত হওয়া কি এতোই সহজ?
— আমি নিজেও সন্দিহান। আমি জানি ওকে ভালোবাসা অন্যায়। কোনো স্বাভাবিক মানুষ কখনো একটা জানোয়ারকে ভালোবাসতে পারেনা, কিন্তুু আমি বেসেছি। কারণ আমার অস্তিত ওর জন্য মরিয়া। অনুভূতির কাছে পরাস্ত আমার বিবেক।
একটুখানি ফিচেল হাসলেন নাতালিয়া।

—তুমিতো প্রাপ্ত বয়স্ক, আবেগী নও বিশেষ । তোমার দুনিয়াটা জলের মতো স্বচ্ছ,সাবলীল। গোটা একটা জীবন তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অথচ তুমি এখানে একটা হৃদয়হীন বিস্টের জন্য নিজেকে মরীচিকায় ডোবাতে চাইছো?
— এরীশই আমার ভবিতব্য। ওকে বাদ দিয়ে জীবন কল্পনা করার সাধ্য আমার নেই। গোটা দুনিয়া ও যদি ওর বিপক্ষে থাকে, তাও আমি এরীশকেই চাইবো।
— কেন এতো উতলা হচ্ছো?
— জানিনা, প্রতি মূহুর্তে আমার জন্য করা ওর পাগলামি গুলো আমাকে ভাঙতে বাধ্য করেছে, ভালোতো প্রথম আমিই বেসেছিলাম, তাহলে ভুলে যাবো কি করে?
কথায় না পেরে অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ভদ্রমহিলা। বিষণ্ন মুখে ফিরে যেতে যেতে আওড়ালেন,
— এতো ভালোবেসোনা। কোনোকিছু অতিরিক্ত আগলে রাখতে চাইলে, শেষ পর্যন্ত সেই জিনিস আর অক্ষুণ্ণ থাকেনা।

কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
এডভারটাইজমেন্ট শ্যুটের কাজে আজ সদর হাসপাতালে এসেছে মাহিন। স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস এর বিশার বড় প্রজেক্ট। সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে ওদের পুরো টীম। মধ্যাহ্নের বিরতি চলছে এখন। ওপাশে সবাই মোরগ পোলাও এর বক্সে কব্জি ডুবিয়ে দিয়েছে এতোক্ষণে। মাহিন একাই শুধু এসে দাঁড়িয়েছে তিনতলার করিডোরে। আজ দুপুরে পানি ছাড়া আর কিচ্ছু খাওয়া চলবে না, পরপরই বেশ কিছু শ্যুট, তাই কড়া ডায়েট চলছে ওর।
হাসপাতালের ফ্রন্ট ইয়ার্ডের দৃশ্যটা অপরূপ। চারপাশে সবুজের সমারোহ, দেখলে অন্তর জুড়িয়ে আসে। মাহিন বিমত্ত দৃষ্টে অবলোকন করছে চারিপাশ, ঠিক তখনই ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় তূর্য। তূর্যের উপস্থিতি টের পেয়ে কপাল গোছালো মাহিন, গ্রীবা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,
— লাঞ্চ না সেরে এখানে কি করছো?
অভিমানের তোড়ে শিশু সুলভ গাল ফোলালো তূর্য। কিঞ্চিৎ কাঁধ উঁচিয়ে অসহায় স্বরে বললো,
— খেতে ইচ্ছে করছে না, মন ভালো নেই।
— তোমার মন খারাপ! ইন্টারেস্টিং তো।

মাহিনের মুখাবয়ব দেখে মনে হলো, সে ভারী মজার কথা শুনেছে। ওর হাসিহাসি মুখ দেখা মাত্রই তরতরিয়ে ডিপ্রেশন বেড়ে দিগুন মন খারাপ হয়ে গেলো তূর্যের। মহা বিরক্ত হয়ে সে বললো,
— আমার এদিকে জীবন মরণ সমস্যা,আর তুমি বলছো ইন্টারেস্টিং? শেইম অন ইউ মাহিন ব্রো।
— হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জীবন মরণ সমস্যা!জটিল কোনোকিছু? ডাক্তার দেখিয়েছো?
— আরেহ, তুমি হাইপার হয়ে অন্য জটিলতায় ঢুকে যাচ্ছো।
তপ্তশ্বাস ছাড়লো মাহিন। বিরস কন্ঠে শুধালো,
— তাহলে কি সমস্যা? নারী ঘটিত কেইস?
বামহাতে মাথা চুলকে, থমথমে মুখে জবাব দিলো তূর্য,
— ওইরকমই কিছু একটা, মা বিয়ে দিতে চাইছে।
— এতো আনন্দের কথা, বিয়ের বয়স হয়েছে তাই বিয়ে দিতে চাইছে, এখানে মন খারাপের কি হলো?
চেহারায় আধার ঘনালো তূর্যের, সে আহত স্বরে বিড়বিড়ালো,

— আনন্দ তো আমার ও হতো যদি না ওই নেংটি ইদুরের সঙ্গে বিয়েটা ঠিক করতো।
— নেংটি ইদুর!
ভ্রু উঁচালো মাহিন। তূর্য ঠোঁট উল্টে মাথা ঝাঁকালো। বললো,
— হ্যা নেংটি ইঁদুর। পৃথিবীর সবচাইতে বাজে ইঁদুর। দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়।
— বুঝেছি পাত্রী তোমার পছন্দ নয়। আন্টিকে জানানো উচিত।
মাহিনের কথার পাছে, তূর্য তরতরিয়ে বলে উঠলো,
— না না তেমন কিছুও নয়।
— তাহলে?
তূর্য এবার মুখ কাচুমাচু করে শুকনো গলায় বলে,
— আসলে ওর আমাকে পছন্দ নয়, নইলে কেউ নিজের হবু বর কে হুতুম পেঁচা ডাকে?
— কি ডেকেছে!
— হুতুম পেঁচা।

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ মাহিন। এই বিয়ে আসলেই সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে বেশ সন্দিহানও বটে।
— হুতুম পেঁচাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে, অন্য কিছু ডাকতে পারতো। এই যেমন ধরো বিলেতি প্যাঙ্গুইন। এটলিস্ট শুনতে ভালো লাগতো।
মাহিনের কথায় আগুনে যেন কেরোসিন ঢালার উপক্রম হলো, রাগে গজগজ করে উঠলো তূর্য। চেহারায় জোর পূর্বক গাম্ভীর্য টেনে এনে বললো,
—নাহ! এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমার মতো কুল হ্যান্ডসাম বয়কে বলে কিনা হুতুম পেঁচা। ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী হুতুম পেঁচা। তুমি একটু দ্যাখোতো ব্রো,কোনোদিক দিয়ে আমাকে হুতুম পেঁচা মনে হয়? আজ তোমার আগে এজেন্সির সঙ্গে আমার দেখা হলে নির্ঘাত তোমার বদলে আমাকে সুপারস্টার বানাতো।
হাসি সংবরণ করে হ্যা সূচক মাথা ঝাঁকালো মাহিন। তূর্য বলতে লাগলো,
— অথচ ওর মতো বিচ্ছিরি নেংটি ইঁদুর এই তূর্য জাওয়াদকে বলে কিনা হুতুম পেঁচা।এতো সুদর্শন হুতুম পেঁচা দেখেছে ও বাপের জন্মে?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহিন। হাত ঘড়িতে চোখ বোলালো একবার, অতঃপর তূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,
— তো এবার কি করবে? ভেবেছো কিছু?
— জানিনা, মা বোধ হয় এবার সত্যি সত্যি নেংটি ইঁদুরটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে দিবে।
তূর্যের কথায় নিঃশব্দে হাসলো মাহিন, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর কাঁধের উপর হাত রেখে বললো,
— মায়েরা কখনো আমাদের খারাপ চান না তূর্য। এই আমাকেই দেখোনা, মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে সারাজীবনের জন্য এমন একজনকে হারিয়ে ফেললাম। যাকে না পাওয়ার আপসোস এ জীবনে শেষ হবে না আমার।

মাহিনের কথাটুকু পুরোপুরি খেয়াল দিয়ে শুনতে পেলোনা তূর্য। তার আগেই ওর নজর আটকালো হসপিটাল গেটে প্রবেশকৃত কালো গাড়ির বহরে। ভেতরে প্রবেশ করে গাড়িগুলো ব্রেক কষলো একযোগে। পরপরই একখানা রোলস রয়েস এর দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো একটা লম্বা মতো সুঠামদেহী অবয়ব । কালো হুডির আস্তিন আর কালো মাস্কের অন্তরালে পুরোপুরি আবৃত তার মুখাবয়ব।চেহারা অনুসরণ করার সুযোগ পেলোনা তূর্য, ও কেবল দেখলো বড়সড় একটা রাইফেল হাতে নিয়ে হনহনিয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে লোকটা।
আশ্চর্যের চরম শিয়রে পৌঁছে, হতবিহ্বলিত কণ্ঠে একাই বলতে লাগলো তূর্য,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১

— এরকম একটা রক্ষণশীল দেশে, এভাবে বন্দুক হাতে নিয়ে জনসম্মুখে হনহনিয়ে হাঁটছে, কে এই লোক?
ওর ভাবনার মাঝেই হাসপাতালের মানুষের ভীড়ে দৃষ্টি সীমানার অগোচরে অদৃশ্য হয়ে গেলো সে ।
পাশ থেকে নির্লিপ্ত দ্বিধাহীন কন্ঠস্বর ভেসে এলো মাহিনের,
— এরীশ ইউভান, দ্যা মাফিয়া বস অব bratva।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৩