আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৩
suraiya rafa
দুপুর গড়িয়ে গোধূলি হানা দিয়েছে ধরণী জুড়ে। অপরাহ্নের প্রথম প্রহর। এই প্রহরে সদর হাসপাতালের কেভিন গুলো হয়ে পরে শুনশান নিস্তব্ধ। চারিদিকে কেমন খাঁ খাঁ শূন্যতা। বিকেলের ম’রা রোদে তেজ নেই তেমন, মিয়িয়ে আসা সেই তেরছা রোদটুকু ঠিকরে পরছে প্রতিটি কেভিনের দাড়ে দাড়ে।
বিষণ্ণ বিকেল, চারিদিকে উৎকট মাছিদের বিরক্তিকর গুঞ্জন। ফিনাইল আর স্যাভলনের ঝাঁঝালো গন্ধটা যেন সরাসরি গিয়ে বিঁধছে মস্তিষ্কে । সবকিছু মিলিয়ে মাথা ধরার উপক্রম ঈশানীর।
তিনশো তিন নং কক্ষটি স্পেশাল কেভিন হিসেবে বিবেচিত। আই সি ইউ থেকে প্রথমে রোগীকে সরাসরি এনে শিফট করা হয় এখানে। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে এগোলে নিয়ে যাওয়া হয় নরমাল কেভিনে। আজ প্রায় দু’মাস হলো আই সিউ তে লাইফ সাপোর্টের মধ্যে থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে রিদান। তবে বেশ কিছুদিন যাবত তার শোচনীয় অবস্থার উন্নতি দেখা দিয়েছে খানিকটা। অক্সিজেন ছাড়াই শ্বাস নিতে পারে এখন। তাই দুদিন হলো ওকে কেভিনে দেওয়া হয়েছে। আর এই মূহুর্তে ওর হসপিটাল বেডের কাউচটাতে নিস্তেজ হয়ে বসে আছে ঈশানী। চোখমুখে তার ভর করেছে অপার বিষণ্ণতা। রিদান ফিরেছে ঠিকই, তবে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরন করে । ভয়াবহ রকম থেঁতলে যাওয়ার কারনে, দু’পা কেটে ফেলা হয়েছে ওর। পুরো জীবনের ভার এখন হুইলচেয়ারের উপর নিপতিত। জ্ঞান ফিরলে বোধ হয় এই বিশ্রী নিথর জীবন লাভের আফসোসে ফের ম’রে যাবে ছেলেটা।সত্যিই কি মরে যাবে? না, তবে ওর আত্নার মৃত্যু ঘটবে নিশ্চিত।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
যৌবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়ের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা টগবগে যুবক রিদান। অমন দুরন্ত ছেলের এহেন ভয়াবহ পরিনতিতে ওর পুরো পরিবারটাই যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে দূর্বোধ্য জীবনের জটিলতায়।
ঈশানী যখন কক্ষে প্রবেশ করে তখন রিদানের মা বসেছিল ছেলের শিয়রে। সময় তখন তিনটে গড়িয়ে চারের ঘর ছুঁই ছুঁই। তখন ও দুপুরের খাওয়া হয়নি ভদ্রমহিলার, সহসা ঈশানী নিজে দ্বায়িত্ব নিয়ে রিদানের মা’কে খাবার খেতে পাঠায়। রিদান আপাতত ঘুমাচ্ছে। মুখে তার অক্সিজেন মাস্ক। তাই নিশ্চিন্ত হয়ে ছোট্ট কাউচটাতে গিয়ে বসে পরে ও । ঈশানীর করার কিছু নেই, তাই কাউচের উপর ফেলে রাখা ম্যাগাজিনের বইটাতে চোখ বোলাচ্ছিল নির্লিপ্তে।
সময় বেশিক্ষণ নয়, এরই মাঝে পুরো কেভিনের চিত্র পাল্টে গেলো অকস্মাৎ। ঈশানীকে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের ন্যায় বিশাল ঝটকা দিয়ে হনহন করে প্রলয়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করে এরীশ। উদ্ভ্রান্ত চলার গতিতে পায়ের বুটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক যোগে নড়ছে তার পুরুষালি কাঁধ, সেই সঙ্গে তরঙ্গিত হচ্ছে হাতে রাখা বৃহদাকার মা’রণাস্ত্রখানি। এরীশের এহেন অতর্কিত আগমনে কাউচ ছেড়ে এক লাফে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। নির্দেশ অমান্য করার আতঙ্কে দিগুণ হয়ে আসে ওর শ্বাসপ্রশ্বাস। কোনোমতে শুষ্ক এক ঢোক গিলে স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ায়,
— হায় ঈশ্বর! এ.. এরীশ কখন ফিরলো বিডিতে?
কক্ষে প্রবেশ করে এক মূহুর্তের জন্যও এদিক ওদিকে তাকালো না সে , অপ্রতিরোধ্য কদম ফেলে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো অবচেতন রিদানের সম্মুখে,পরপরই অক্সিজেন মাস্কটা টান মে’রে খুলে ওর মুখের মধ্যে রাইফেল ঢুকিয়ে দিলো অকস্মাৎ। পুরো ঘটনাটুকু ঘটলো কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে।
লোকটার গতিবিধি বুঝতে সময় লাগলো খানিক। যখনই বুঝে এলো, এরীশের ভয়াবহ হিংস্রতায় মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো ঈশানীর। স্তম্ভিত হয়ে পরলো পদযুগল। আতঙ্কিত নজরে এদিক ওদিক চাইলো মেয়েটা। চারিদিকে শুধু কালো পোশাক ধারী গার্ড’স ছাড়া আর কারোর উপস্থিতি নেই। অগত্যা ভয়ডর সবকিছু পাছে হঠিয়ে ছুটে গেলো এরীশের নিকট।
এরীশ রেগেমেগে ট্রিগার প্রেস করতেই যাবে তক্ষুনি এক ঝটকায় স্নাইপার টাকে দূরে ফেলে দেয় ঈশানী। ক্রোধান্বিত স্বরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
— কি করছিলেন এটা? গত দু’মাস পর কালই একটু স্টেবল হয়েছে ছেলেটা, এখনো জ্ঞান অবধি ফেরেনি, ওর গোটা পরিবার বিধ্বস্ত। আর আপনি ওকে মারতে যাচ্ছিলেন আবারও?
— ওর জন্য এসেছো তুমি এখানে, ওর জন্য, তাইনা?
চোয়াল শক্ত করে, ঈশানীর পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এরীশ। ধূসর নেত্রের তীক্ষ্ণতায় ঈশানী ভস্ম হয়ে যেতে চাইছে যেন।
— ক্রুজ শীপের বাইরে এক পা ও দিতে বারন করেছিলাম আমি তোমায়।
এবারে ভড়কালো মেয়েটা, চোখ নামিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ, মরুভূমির খরখরে শুষ্কতায় ছেয়ে গেছে কণ্ঠতালু, জিভের ডগায় কথা আটকে আসছে বারংবার তবুও চেষ্টা চালালো,
— আ..আম আসলে।
বাক্য সম্পন্ন করার আগেই মাফিয়া বসের বেপরোয়া থাবায় কণ্ঠরোধ হয়ে এলো ঈশানীর। এরীশের বাহুবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই থরথরিয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ওর শীর্ণকায় শরীরটা। ঈশানীর চেয়ে অনেকটা লম্বা হওয়ার দরুন গ্রীবাদেশ বাঁকালো এরীশ, মুখের সন্নিকটে মুখ নিয়ে এসে শীতল ভরাট কণ্ঠে আওড়ালো ,
— ডোন্ট এক্সকিউজ, অবাধ্যতার একটা সীমা থাকা দরকার। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।এর পরিনাম তোমার কল্পনাতীত।
এরীশের প্রগাঢ় ক্ষুদ্ধতার মুখোমুখি হতেই আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে ওঠে ঈশানী, কুণ্ঠিত স্বরে জানায়,
— আপনি এমন কেন করছেন? একা এসেছি আমি? বাইরে দেখুন গার্ড’স দাঁড়িয়ে আছে।
এক মূহুর্তের জন্য কুঁচকানো কপাল সোজা হলো এরীশের, ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে দেখলো কেউ নেই ওখানে, তৎক্ষনাৎ হাতের বাঁধনে দৃঢ়তা টানলো দিগুণ, দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— হেয়ালিপনা বন্ধ করো, নয়তো মে’রে ফেলবো আমি তোমায়। কেউ নেই এখানে । ফিরে এসে তোমায় স্ক্রুজ শীপে না পেয়ে আমার ঠিক কি অবস্থা হয়েছিল একবারও ভাবতে পারো তুমি? বিগত কয়েক ঘন্টায় আমার মস্তিক কতটা জঘন্য পর্যায়ে চিন্তা করে ফেলেছে সেই সেন্স আছে তোমার!
শেষ কথাতে ঈশুর শরীর ঝাঁকিয়ে গর্জন করে উঠলো মাফিয়া বস।
— বিশ্বাস করুন আমি গার্ড’স নিয়ে এসেছি, ওরা এখানেই ছিল।
বড্ড কসরত করে শব্দ কটা উচ্চারণ করলো ঈশানী। এরীশ একই ভাবে গলা চেপে ধরে রেখেছে ওর। বাঁধনের তীব্রতায় দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে এতোক্ষণে, অথচ সেই টলমলে অক্ষিদ্বয় এরীশের ধূসর গহ্বরে তলিয়ে আছে অর্হনিশ । এরীশ ও এবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাইলো সে চোখে। রাগে ফোঁসফাস করতে করতে কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি ওকে কেন দেখতে এসেছো?
— ও অসুস্থ বলে।
— ও অসুস্থ তাতে তোমার কি? কই আমার জন্য তো কখনো উতলা হওনা এমন!
এরীশের শেষ কথাটা ধাক্কা দিলো ঈশানীকে। দূধর্ষ মাফিয়া বসের মুখ থেকে এরূপ কথা শোনা মাত্রই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরলো ওর অন্তর।একটু থেমে, সন্দিহান হয়ে শুধালো,
— আপনি কি জেলাস এরীশ!
জানালা গলিয়ে ছুটে আসা দমকা হাওয়ার মতোই নৈঃশব্দ্যে থমকে গেলো মূহুর্ত। নির্বাক এরীশের শূন্য দৃষ্টিযুগল অনুভূতির প্রলয় বাধিয়ে দিলো নাজুক রমণীর হৃদযন্ত্রে।
— সত্যি করে বলুন, সমস্যাটা কোথায়? আমি ক্রুজশীপ থেকে বেড়িয়েছি সেটা, নাকি রিদান কে দেখতে এসেছি সেটা?
অযৌক্তিক তুচ্ছ প্রশ্নের কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না মাফিয়া বস। কোনোরূপ দ্বিধান্বিত না হয়েই একটানে মেয়েটাকে তুলে নিলো কাঁধের উপর। তৎক্ষনাৎ গলার আওয়াজ খাদে নামিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে ঈশানী,
— আরেহ! ছাড়ুন, নামান আমাকে, মানুষ দেখে ফেলবে।
— হু কেয়ার’স?
মেজাজ চড়ে গেলো ঈশানীর, দু’হাতে এরীশকে খামচে-খুমচে নিচে নামার চেষ্টা অব্যাহত রেখে বলতে লাগলো,
— আমার পা আছে, আমি হেটে যেতে পারি। এভাবে কাঁধে তুলেছেন কেন? এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?
— আমি সভ্য ছিলাম কবে?
— জানোয়ার একটা।
এরীশের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর পাঁয়তারা যেন কমছেই না মেয়েটার। তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে এরীশের কোথায় কোথায় যে ছিঁড়েফেড়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেসবে থোড়াই কেয়ার করলো না মাফিয়া বস। জোরজবরদস্তি করে ঈশানী সমেত কেভিন থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে আওয়াজে গাম্ভীর্যতা টেনে বিড়বিড়ালো,
— দুটোতেই সমস্যা।
রয়্যাল ক্যারাভিয়ান, বাংলাদেশ।
সন্ধ্যার আকাশে চাঁদের দেখা নেই। অমানিশার বিষণ্ন রাত। ঘুটঘুটে তমশায় ঢাকা রাতে সমুদ্রের বক্ষচিঁড়ে মাথা উঁচিয়ে ছুটে চলেছে বিশালকার ক্রুজশীপটি। যেন উত্তাল সাগরের বুকে একটুকরো ভাসমান শহর। দেখতে অপার্থিব লাগছে। শুনশান নিস্তব্ধতার মাঝে আঁধার কেটে কেটে অগ্রসর হয় সে যানবাহন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত জাহাজ টি অবস্থান বদলে বিপরীত মুখী নিশানা ধরেছে আজ। লোকালয় ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে…..
ক্রোধের তাড়নায় গজরাতে গজরাতে ক্রুজশীপে ফিরেছে এরীশ। জলন্ত অঙ্গার যেন দৃষ্টিমান হয়ে আছে তার ধূসর বাদামি গহ্বরে। মাফিয়া বসের ক্ষোভের তীব্রতায় রুদ্ধশ্বাস সকলের। এরীশ দাঁড়ালো না কোথাও, কাউকে কিছু বললোও না বিশেষ। উল্টো দ্রুত পদধ্বণিতে এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে। পরপর ছয় রাউন্ড সিঁড়ি ভেঙে উপরে এসে ঈশানীর কক্ষে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মা’রলো ওকে।
— আহহহ!
তাল সামলাতে না পেরে অতর্কিতে আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটা। এরীশ ঘুরেও তাকালো না, যেভাবে এসেছে সেভাবেই ফিরতি পথে হাঁটা ধরলো ফের। তন্মধ্যে ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
— রিদানের এই অবস্থা আপনি করেছেন তাই না?
থমকালো পদযুগল। স্থির চিত্তে তৎক্ষনাৎ ভেসে এলো নিটোল প্রত্যুত্তর,
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না।
— কেন করেছেন?
বিছানা ছেড়ে এগিয়ে এসে এরীশের মুখোমুখি দাঁড়ালো ঈশানী। কণ্ঠ ঝাঁঝিয়ে বলতে লাগলো,
— নিরপরাধ ছেলেটার সাথে এতো বড় অন্যায় কেন করলেন এরীশ ? কি ক্ষতি করেছে ও আপনার? দূর্বলের জীবন নিয়ে পুতুল খেলার পৈশাচিক অভ্যাস রয়েছে বলে? কিন্তু আপনি কি আদৌও জানেন আপনার এই অভ্যাসের প্রশ্রয় আর রক্তের নেশায় কতবড় ক্ষতি করে ফেলেছেন ছেলেটার? রিদান পঙ্গু হয়ে গেছে। সারাজীবনের জন্য হুইলচেয়ারে বসে গিয়েছে ও । জানি আপনার কিছু যায় আসেনা তবুও, কি ক্ষতি করেছিল বলুন?
— আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
সবেগে বাক্য ছুড়লো মাফিয়া বস। তীরের ফলার চেয়েও তীক্ষ্ণ সে আওয়াজ। ঈশানী দমলো না একরত্তি। তেতে উঠলো আবারও ,
— আমাকে কৈফিয়ত দিতে বাঁধ্য আপনি।
— আমি কে তোমার?
— সেটা আমার চেয়ে আপনি ভালো জানেন। আপনি কে আমার।
থমকে গেলো মাফিয়া বস। ও কথা বাড়াতে চাইলো না আর, সহসা ঈশানীকে পাশ কাটিয়ে পা বাড়ালো সম্মুখে। তক্ষুনি পেছন থেকে স্বগতোক্তি বোমা ফাঁটালো রমণী,
— ভ্যাটিক্যান সিটিতে বিয়ের রেজিষ্ট্রি করানো টা কি খুব জরুরি ছিল? মাফিয়া বস রীশস্কা বুঝি ভয় পায়? সাধারণ একটা মেয়েকে হারিয়ে ফেলার ভয়!
নির্বিকার এরীশ ইউভান। এতোদিন ধরে নিজের মাঝে লুকোনো সত্যিটা অবশেষে জেনেই গেলো ঈশানী। কি প্রত্যুত্তর করবে ও?
কিছু রেজিস্ট্রি পেপার’স, একটা অজ্ঞাত সিগনেচার, আর তারপর সারাজীবনের জন্য এই নীলাম্বরীটাকে নিজের নামে খোদাই করে নেওয়া। এমনকি ডিভোর্সের ও কোনো সুযোগ রাখেনি এরীশ, কোনোদিন চাইলেও সে কাজটি করতে পারবে না ঈশানী। কারণ ভ্যাটিক্যান সিটির বৈবাহিক আইন অনুযায়ী সে দেশে ডিভোর্স নিষিদ্ধ। সুতরাং ওই দেশের নিয়মানুসারে একবার বিয়ে হয়ে গেলে ছেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপারটা খানিক স্বৈরাচারী, কিন্তু এরীশের যায় আসে না।
— এসব কিছু কে বলেছে তোমায়? তুষার নিশ্চয়ই!
পেছন ঘুরলো না এরীশ। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাকিয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো ঈশানীর পানে।
— কেন আমার জানার অধিকার নেই?
— না নেই। যেটা আমি জানায়নি, সেটা জানার অধিকার তোমার নেই।
কঠোর অভিব্যক্তি মাফিয়া বসের।
অজানা অভিমানের তোড়ে নাকের পাটা তিরতির করে ফুলে উঠলো রমণীর। কণ্ঠনালির খাদে আটকে থাকা প্রগাঢ় অশ্রু গিলে গিলে বললো,
— আপনি ব্লাকমেইল করে বিয়ে করতে পারবেন, পালিয়ে যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করার জন্য ভ্যাটিক্যান সিটিতে রেজিষ্ট্রি করতে পারবেন, দিনের পর দিন একটা মেয়ের অগোচরে তাকে চব্বিশ ঘণ্টা স্টক করতে পারবেন, তার প্রাইভেসীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার ওয়াশরুমে পর্যন্ত হিডেন ক্যামেরা সেট করতে পারবেন। আর এতো সবকিছু সেই মেয়েটা জানলেই দোষ? কেন এরীশ?
কিছুক্ষন নৈঃশব্দ্য। ভারী দীর্ঘশ্বাস ভেদ করলো মাফিয়া বসের ইস্পাত কঠিন বক্ষস্থল। খানিক সময় নিয়ে নির্লিপ্ত আওয়াজে ধ্বণিত হলো,
— কারণ তুমি আমাকে ঘৃণা করো।
এবারে শব্দ করে কান্না জুড়ে দিলো ঈশানী। পেছন থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
— হ্যা ঘৃণা করি। এই সবকিছুর জন্য ঘৃণা করি আমি আপনাকে। এতোদিনেও আমার অন্তরের অনুভূতিকে বুঝতে না পারার জন্য ঘৃণা করি আপনাকে। আপনার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, আমি আজই চলে যাবো এখান থেকে।
বাক্য ফুরোলো না, বিদ্যুৎ গতিতে তেড়ে এসে ওর বুকের কাছের জামাটা একহাতে খামচে ধরলো এরীশ। অন্য হাত আস্তরিত হলো রমণীর চুলের ভাঁজে। টেনে ধরলো সেগুলো। তীব্র যাতনায় গুঙিয়ে উঠলো মেয়েটা। তাতে ভ্রুক্ষেপ হলোনা দানবের। দাঁতে দাঁত পিষে ছুড়লো শীতল আওয়াজ,
— দ্বিতীয়বার “চলে যাবো” শব্দটা উচ্চারণ করার মতো দুঃসাহস আর দেখিও না। নয়তো আমি ভুলে যাবো যে তুমি আমার বিয়ে করা বউ।
— অবশেষে স্বীকার করলেন তাহলে?
অপ্রতিরোধ্য ঈশানী। মাফিয়া বসের নির্জীবতায় ঠাসা গভীর শূন্য চোখে চোখ রেখে করে যাচ্ছে একের পর দুঃসাহস। এইটুকু মেয়ের সাহসে ক্রোধান্বিত এরীশ। কাপছে সে থরথরিয়ে।
— লিসেন, আমি রুলস মানি না, রুলস আমাকে মানে। আর না তো এসব বিয়ে ফিয়ে রেজিষ্ট্রি, কোনোকিছুর এক পয়সাও মূল্য আছে আমার কাছে। শুধু মাত্র তোমার জন্য। হ্যা ঠিকই ধরেছো, তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি করেছি এই সব । তোমাকে বিয়ে করেছি, স্টক করেছি,তোমার প্রাইভেসী হিট করেছি, ইভেন তোমার আশেপাশের আবর্জনা গুলোকেও আমিই সরিয়েছি। ভাগ্যের জোড়ে একটা বেঁচে গিয়েছে। বিচলিত হয়ো না, ওটাকেও ছাড়বো না।
— কিহ!
— যা শুনেছ সেটাই, তোমার জন্য এরকম হাজারটা আবর্জনা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দু’মিনিট ও ভাববে না এরীশ ইউভান।
বাক্যকটা উগড়ে দিয়ে, সজোরে ধাক্কা মে’রে ঈশানীকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো এরীশ।
অতঃপর চলেই যাচ্ছিল, যাওয়ার আগে দেওয়ালে ঝুলানো কুড়াল থেকে টান মে’রে তুলে নিলো একটা। হতবিহ্বল ঈশানী, বাস্তবতা ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছে ওর কল্পনারা। নিস্প্রভ দৃষ্টে এরীশের পানে চেয়ে আছে শুধু, সেভাবেই বলে উঠলো,
— এতো হিংস্রতা, এতো র’ক্তপাত, কেন এরীশ ইউভান?
— আমি শুধু তোমাকে চাই।
যেতে যেতে স্বগোতক্তিতে জবাব দেয় মাফিয়া বস।
ঈশানী ধাপ করে বসে পরে মেঝেতে। ওর ভেতরের সত্তাটা বিদ্রুপ করে হেসে ওঠে এবার, হাসিতে গগন কাঁপিয়ে সে কৌতুক স্বরে বলে,
— চেয়েছিলিনা অবাস্তব ভালোবাসা, সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব, উপর ওয়ালা জুটিয়ে দিয়েছে। নে এবার ঠ্যালা সামলা।
রাশিয়া।
কান্ট্রিসাইডের তাপমাত্রা মস্কোর তুলনায় অনেকাংশে কম। প্রায় সারাবছরই বরফে জমে থাকে এই অঞ্চল । দু’মাস গরমের মধ্যেও বেলা শেষে রাতের তাপমাত্রা নেমে আসে মাইনাসের ঘরে। দুদিন ধরে বরফের পাশাপাশি বৃষ্টিও হচ্ছে থেকে থেকে। আবহাওয়ার অবস্থা যা তা। ফলস্বরুপ প্রচন্ড ঠান্ডা পরছে এই দুদিন।
ঘরের বাইরে এক পা ফেলার অবকাশ নেই,মাত্রারিক্ত শীতে কলিজা জমে আসতে চায় যেন। ফ্লোলা ইয়াকুতিয়া অঞ্চলের মেয়ে। ওর অভ্যাস রয়েছে এসবে। কোমর সমান বরফেও দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারে মেয়েটা। বরফের মাঝে ঘুরতে ঠান্ডার চেয়ে বেশি আনন্দই লাগে বোধ করি।
এক কামরার ছোট্ট ভিলা তুষারের, ফ্রন্ট ইয়ার্ডের এককোণে এ্যাটাচ সুইপিং পুল। পানির ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই তাতে , বরফের আস্তরে ঢেকে আছে সব। সামনের দেওয়ালটা কাঁচের হওয়ার দরুন ভেতর থেকেই উপভোগ করা যায় প্রকৃতি। আজ সকাল থেকেই মৃদু স্নোফল হচ্ছে, কাচের দেওয়ালে ভর করেছে তুষার কণা। দেওয়ালের ওপাশ থেকে সেগুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য আনচান করে উঠলো ফ্লোরার অন্তর ।ঠান্ডা লাগাতে ইচ্ছে করছে ভীষণ, হৃদয়টা প্রশমিত হওয়া জরুরি।
অগত্যা গায়ে সোয়েটার আর মাথায় বিনি হ্যাট চড়িয়ে নেমে এলো বাইরে।
বরফের আস্তর সরিয়ে গিয়ে বসলো পুলসাইডে। হেয়ালি করে পা দাবালো কনকনে ঠান্ডা বরফ আচ্ছাদিত পুলের মাঝে, তৎক্ষনাৎ ভাঙন ধরলো সেথায়,হিরহির করে বেড়িয়ে এলো হিমশীতল জলের স্রোত। যা দেখা মাত্রই মৃদু হাসির রেখা ফুঠে উঠলো রমণীর অধর কোণে।
— আজ কতগুলো দিন বাদে একটু হাসলে তুমি ফ্লোরা। আমার স্বস্তি লাগছে এখন।
পুরুষালি এক ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই পাশ ফিরলো ফ্লোরা, দেখলো তুষার দাঁড়িয়ে। ওভার কোট, গ্লাভস, কিছুই নেয়নি। কেবল একটা লেদার জ্যাকেট চড়িয়ে নেমে এসেছে বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে হতচকিত বদনে প্রশ্ন ছুড়লো ফ্লোরা,
— আপনি কখন এলেন?
— তোমার পিছু পিছু।
— ভয় পাচ্ছেন যদি সু’ইসা’ইড করি?
— আমি জানি তুমি সেটা করবে না। কারণ তুমি আত্নবিশ্বাসী।
ভেতরে ধরে রাখা নিঃশ্বাসটা এতোক্ষণে ত্যাগ করলো ফ্লোরা। বললো,
— তাহলে এখনো পেন্ট হাউজে ফিরে যাচ্ছেন না কেন? আপনি তো দু’দিনের জন্য এসেছিলেন।গ্যাংস্টাররা বুঝি এতোবেশি অকর্মা?
— ফিরে যাওয়ার চেয়েও তোমার ঠিক হওয়াটা বেশি জরুরি। আর তার চেয়েও অত্যাধিক জরুরি এই মূহুর্তে তোমার ভিলায় প্রবেশ করা।
তুষারের মুখভঙ্গিমা সাবলীল, বরাবরের মতোই যান্ত্রিক তার অভিব্যক্তি।
ওর কথায় ভ্রুকুটি করলো ফ্লোরা। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে জানালো,
— আমি স্নোফলে ভিজতে চাই। আচ্ছা, আপনি কখনো স্নোফলে ভিজেছেন তুষার? ছুঁয়ে দেখেছেন কখনো প্রকৃতির আশির্বাদ কে?
— না,আমার ঠান্ডার ধাঁচ আছে।
সোজাসাপটা উত্তর তুষারের। ফ্লোরা বললো,
— কিন্তু আপনার নাম তো তুষার।
চারিদিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে অবশেষে ফ্লোরার চোখে দৃষ্টি স্থির করলো মূর্তিমানব। অনুভূতিহীন স্বরে জানালো,
— শুনেছি, কোনো এক তুষার ঝড়ের রাতে জন্মেছিলাম বলে মা নাম রেখেছিল তুষার। আর তুষার নাম হলেই বা কি? ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঠান্ডা লাগাতে হবে? তোমার নাম ও তো স্নোফ্লেক্স।
এবারে ঠোঁট উল্টালো ফ্লোরা, এদিক ওদিকে মাথা নাড়িয়ে ভাবুক হয়ে বললো,
— নাহ, দাদী তো এই নাম রাখেনি আমার।
— দাদী রাখেনি তো কি হয়েছে? সব নামই কেন দাদীর রাখতে হবে?
ফ্লোরার কথা শেষ হতেনা হতেই তরতরিয়ে বাক্য ছুড়লো তুষার। ফের ভাবনায় ডুবলো রুশকণ্যা। খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে নিরেট স্বরে শুধালো,
— আপনি সেদিন অনেকবার এই নামে ডেকেছিলেন আমায়, বারবার বলেছিলেন আমি আপনার স্নোফ্লেক্স। আচ্ছা আপনি রাখেন নি তো?
ধরা পরে যাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো তুষার। চোখমুখ খিঁচে ভিলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— এতো আজাইরা সময় নেই আমার।
— আপনি গ্যাংস্টার বলে? আচ্ছা, আপনার মা আপনার বাবাকে ছেড়ে কেন গেলো? শুনেছি সেই মাফিয়া বসটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আপনার মা।
শেষ কথাতে থমকালো পদযুগল। উদগ্রীব হয়ে পেছনে চাইলো তুষার,
— কি বলতে চাইছো?
উঠে দাঁড়ায় ফ্লোরা। তুষারের পানে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
— এরীশ আপনার এক বছরের ছোট তাইনা?
— হঠাৎ এসব কথা কেন বলছো?
যন্ত্রমানবের সর্বদা সাবলীল অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো অকস্মাৎ। অভিব্যক্তিতে ভর করলো প্রবল দুশিন্তা, শুকনো গলায় ফের উত্তর দিলো ফ্লোরা,
— আমি বোধ হয় সত্যি টা জানি তুষার। এরীশ আসলে….
বাক্য সম্পন্ন করার আগেই জোড়ালো থাবায় ওর মুখ চেপে ধরে তুষার। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
—- চুপ্প! একদম চুপ্প! এসব কথা ভুলেও মুখে আনবেনা। যা যেনেছো ভুলে যাও।
হাতের মধ্যে থেকে কাঁইকুঁই শুরু করে দিলো ফ্লোরা, ওর কষ্ট হচ্ছে ভেবে বাঁধন খানিক হালকা করে তুষার, চোখ রাঙিয়ে বলে,
— যা বলেছি মনে থাকবে?
ফ্লোরা জোরে জোরে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যা জানালে আগের ন্যায় দূরে সরে গেলো তুষার।পরপরই ফাঁকা এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর বুক চিঁড়ে। নির্বাক রুশকন্যা, যাতনায় টলমল করছে ওর অক্ষিদ্বয়। সেই ঘোলাটে দৃষ্টি অকস্মাৎ নাঁড়িয়ে দিলো তুষারের অন্তর। কোথাও একটা অনুশোচনা হলো মানবের। অনুতাপের স্বরে শুধালো,
— আমি কি ব্যথা দিয়ে ফেললাম তোমায়?
এদিকে ওদিক মাথা নাড়িয়ে না জানায় ফ্লোরা, ক্রন্দিত স্বরে বলে,
— এতোটা ব্যথা হৃদয়ে কি করে পুষে রেখেছেন তুষার? আপনার যন্ত্রণা হয় না?
তুষার চোখ ফেরালো ফ্লোরার পানে , ঘটলো দৃষ্টির বিনিময়। শান্ত মিহি গলায় বললো,
— আমি ব্যথা পুষে না রাখলে,এর চেয়ে হাজার গুন বেশি যন্ত্রনা হতো এরীশের ।
রয়্যাল ক্যারাভিয়ান, বাংলাদেশ।
নিস্তব্ধ নিশীথ। বাইরে ঝিঁঝি পোকার প্রখর গুঞ্জন। এখনো কক্ষেই বসে আছে ঈশানী , অন্তরের তাড়নায় দিশেহারা সে। কেমন যেন থমথমে গুমোট চারিপাশ। নির্ঘুম দু’চোখ মাফিয়া বসের দর্শনের প্রয়াসে মরিয়া। মন বলছে এরীশ আজ আবারও আসবে এই কক্ষে । ঘটলো ও তাই। গভীর রাতে চপচপে ভেজা বুটের আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হলো রমণীর। তৎক্ষনাৎ উদগ্রীব পদযুগলে ছুটে গেলো দরজার দিকে।
তবে প্রথম দর্শনেই থমকে গেলো ওর পদধ্বনি। স্থবির চিত্তে দাঁড়িয়ে পরলো ঈশানী। রিক্ত বদনে দৃষ্টিপাত করলো বিপরীত প্রান্তে। রক্তস্নানে জবুথবু এরীশ। সফেদ শার্ট থেকে শুরু করে কালোপ্যান্ট, কালো বুট সকলকিছু বীভৎস লালিমায় রঞ্জিত। মুঠোবন্দি কুড়ালটা থেকে এখনো চুইয়ে চুইয়ে পরছে বিভীষিকার অস্তিত্ব। ঈশানী নির্বাক, শুষ্ক একটা ঢোক গিললো শুধু।
ওর চোখে ভয় নেই, ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই ধীর পায়ে ঈশানীর নিকট এগিয়ে এলো এরীশ। শ্বাস ফেলে ফেলে হিমশীতল আওয়াজে ধ্বনিত হলো তার ভরাট কন্ঠস্বর,
— বিকেলে তোমায় একা রেখে যে শুয়োর গুলো স্মোক করতে বাইরে গিয়েছিল, ওদের নরকে পাঠিয়ে দিয়ে এলাম।
কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলো না রমণী। নিঃশব্দে এগিয়ে এলো কয়েক কদম, সৌষ্ঠব লম্বা গড়নের এরীশকে স্বাভাবিক উচ্চতায় ছোঁয়ার সাধ্য ওর নেই, তাই দু’আঙুলের উপর ভর করে হাত বাড়ালো মরীচিকার পানে। শারীরিক দূরত্ব ঘুচে যেতেই আলতো স্পর্শে আঙুল বোলালো স্বামীর র’ক্তা’ক্ত চিবুকে। যেন কোনো বিশেষ আকর্ষনীয় বস্তু এটি। এই প্রথম এরীশের কোনোকিছুতেই রাগ হলোনা
ঈশুর, আর নাতো ঘৃণা। ভেতরের ভোঁতা অনুভূতি গুলো তীক্ষ্ণতায় ছেঁয়ে যাচ্ছে কেবল। মস্তিষ্কটা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে ওই ধূসর বাদামি গহ্বরের অতলে।
নিজের পুরুষালি হাতের সাহায্যে রমণীর নাজুক হাতের কব্জিকে আবদ্ধ করলো এরীশ। সেটির কার্জক্রম থামিয়ে দিয়ে অনুভূতিহীন নির্জীব কন্ঠে ডাকলো ওকে,
— প্রেম আমার।
দুনিয়ার সবটুকু ব্যাকুলতা ধরে রাখে তার পুরুষালি কণ্ঠস্বর। ছোট্ট এই অভিবাদন কর্ণগোচর হতেই এক নিমেষে অন্তর খেই হারায় ঈশানীর। বাড়ে অনুভূতির তুফান। বাক্যহারা হয়ে পরে সমগ্র মস্তিষ্ক। পৃথিবীতে এরীশ ব্যাতিত অন্য কারোর উপস্থিতি উপলদ্ধি করতে পারেনা সে। ফের নৈঃশব্দ্য ভেদ করে এরীশের নির্জীব কণ্ঠস্বর ,
— তুমি পবিত্র, এই ঘৃণিত র’ক্ত ছুঁয়ে কলুষিত করোনা নিজেকে।
কঠিন বাস্তবতার অতলে অবশেষে হুমড়ি খেলো ঈশানী, হৃদগহীনের কোথাও একটা শব্দ হলো বিকট। অথচ পিছপা হলোনা এক কদম। মোহাবিষ্ট নয়নে অবলোকন করতে লাগলো এরীশকে। যেন গোটা পৃথিবীর সবটুকু আকর্ষন নিহিত রয়েছে এই র’ক্তা’ক্ত মুখাবয়ব জুড়ে । তেমন করেই নয়নযুগলের মিলন ঘটিয়ে মৌহ কণ্ঠে আওড়ালো,
— এক জীবনে তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া আমি আর জেনেশুনে কোনো পাপ করিনি অরণ্য ।
রমণীর অকস্মাৎ স্বীকারোক্তি গোটা অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিলো মাফিয়া বসের। এটাই বোধ হয় জীবনে প্রথমবার। কেউ একজন জানালো,সে ওকে ভালোবাসে। এতো দিন এরীশ ঈশানীকে একজীবনে ছাড়তে চায়নি, এবার বোধ হয় সে প্রতীজ্ঞা মৃত্যু অবধি গড়াবে।
ভেতরে অবিরাম জলোচ্ছ্বাস, অথচ বাহ্যিক অভিব্যক্তি শূন্য, নির্বিকার। হেয়ালি করে বললো,
— এতো আয়োজন করে পুড়তে চাইছো?
— আপনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বলে।
— উহুম, আমি মরীচিকা। দুনিয়ার কোনো বাস্তবতা ছুঁতে পারেনা আমায়।
— তবে আমি ফেরারী হবো, আমাকেও আর ছুঁতে পারবেনা কেউ।
দ্বিধাহীন প্রত্যুত্তর রমণীর। মুঠিবদ্ধ র’ক্তসিক্ত কুড়ালখানা হাত গলিয়ে মেঝেতে পরলো এতোক্ষণে। নিজের মাঝে এক অন্য এরীশের উপস্থিত অনুভব করলো মাফিয়া বস। যার হৃদয়টা সচল। ভেতরে অনুভূতি আছে, আছে প্রণয়াসক্তি। অগত্যা ভেঙে গেলো আত্মসংযম। শূন্য অভিব্যক্তিটুকু নিমেষেই উধাও হলো ব্যাকুলতার আড়ালে।
টললো হিমালয়। প্রস্ফুটিত হলো আবেগের জোয়ার। এক লহমায় মেয়েটাকে টেনে নিয়ে এলো সন্নিকটে। প্রমত্ত হয়ে নিজের পুরুষালি দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো ওর গাল দু’টো। মুহূর্তেই রক্তের প্রলেপে রঞ্জিত হলো আদুরে চেহারা খানা।
এরীশ খেয়াল করলো না সেসব,ডুবে গেলো সাকুরার অধরের ভাঁজে। গভীর আলিঙ্গনে দলিতমথিত হতে লাগলো একজোড়া দিশেহারা ওষ্ঠাধর। এরীশের র’ক্তে মাখামাখি ঈশানী।মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সহসা দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো মানুষটার শার্টের কলার। সেটাও বোধ হয় সহ্য হলোনা মাফিয়া বসের। দ্রুত হাতে একেক করে খুলে ফেললো শার্টের সবগুলো বোতাম, অতঃপর ছুড়ে ফেললো অদূরে। উজ্জ্বলাভ সুঠাম দেহখানা স্পষ্ট দৃশ্যমান ঈশানীর চোখে। ট্যাটু আবৃত হাত ব্যাতিত সমগ্র শরীর জুড়ে তার অজস্র ক্ষতচিহ্ন। বাম দিকের এ্যাবসে অনেকটা জায়গা জুড়ে জ্বলজ্বল করছে বিশার এক কাটাদাগ। ঈশানী ছুঁয়ে দেখতে চাইলো সেখানটায়, তবে ফুরসত পেলোনা, তার আগেই ওকে কোলে তুলে নিলো এরীশ। ওষ্ঠাধরের উন্মাদনায় অবিরত সে। যেন অমৃতসুধার ইন্ধন।
আবেশে অক্ষিপুট নিভে আছে ঈশানীর, তন্মধ্যে কানে এসে হানা দিলো মাফিয়া বসের হাস্কিকণ্ঠস্বর,
— মে আই!
তরাগ করে চোখ খুলে ফেললো ঈশানী।এরীশের নেশালো অক্ষিদ্বয় ওর পানেই নিবদ্ধ। দৃষ্টিতে তার একরাশ মাদকতা। যা দেখা মাত্রই শুষ্ক ঢোক গিললো রমণী । অবুঝের মতো উচ্চারণ করলো,
— উমমম!
— তোমার রাতটুকু আমার হোক। আমি তোমার তরে আত্মবিসর্জিত হতে প্রস্তুত প্রেম আমার।
মাফিয়া বসের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, অথচ এবারও নির্বাক ঈশানী। ভয়ে জড়োসড়ো অন্তর। কণ্ঠনালি রোধ করে আছে অজানা আতঙ্ক,যার দরুন বাকরুদ্ধ সে। ফের ধ্বনিত হলো একই বাক্য,
— মে আই!
আবারও সেই ঘোর লাগানো পুরুষালি কণ্ঠস্বর । মাদকীয় শব্দটুকু কর্ণগোচর হতেই শরীর শিরশিরিয়ে উঠলে মেয়েটার।
ঈশানী কিছু বলছে না দেখে এবার অনুভূতিতে লাগাম টানলো এরীশ। ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিতে উদ্যত হয়ে বলে ওঠে,
— ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরো।
— ক..কেন?
এতোক্ষণে বুলি ফুটলো মেয়েটার। দু’হাতে শক্ত করে এরীশের গ্রীবাদশ জড়িয়ে আছে সে। তপ্তশ্বাস ছেড়ে এরীশ জানালো,
— আমি সদয় নই, আমাকে সহ্য করতে পারবে না, কষ্ট হবে তোমার।
মাত্রা ছাড়ালো আতঙ্ক। কিন্তু ঈশানী তো এরীশ কে চায়। ওকে ভালোবাসতে চায়। পুরো জীবন অতিবাহিত করতে চায় এই বেপরোয়া পুরুষের সাথে। এরীশ ওকে নামাতেই যাবে তার আগেই ঠোঁটের দূরত্ব ঘোচালো ঈশানী। এরীশকে ইতিবাচক ইঙ্গিত প্রদান করে নাজুক, মিহি কণ্ঠে ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,
— ইউ ক্যান।
ব্যাস এতটুকুর জন্যই অপেক্ষা করেছিল এরীশ। দূরত্বের শেষ আস্তরটুকু ঝরঝরিয়ে ভেঙে গেলো এবার। ফের মত্ত হলো প্রেয়সীতে। ঠোঁটের গভীরতা মাত্রা ছাড়ালো,পরিনত হলো তীক্ষ্ণ দংশনে। সেভাবেই ঈশানী সমেত হাটা ধরলো ওয়াশরুমে দিকে। মেয়েটা লেপ্টে আছে এরীশের অনাবৃত বক্ষ ভাঁজে। দু’জনার শরীর রক্তে মাখামাখি, ফ্রেশ হওয়া জরুরি। ভেতরে গিয়ে কৃত্রিম ঝরনার সেন্সরে হাত চালালো এরীশ। মূহুর্তেই তীব্র জলধারায় সিক্ত হয়ে উঠলো সর্বাঙ্গ। জলের ছোঁয়ায় রমণীর সুক্ষ্ম নারীদেহের প্রতিটি ভাঁজ সুস্পষ্ট দৃশ্যমান। সেথায় নিজের সর্বোচ্চ কতৃত্ব ফলাতে বেপরোয়া এরীশ। যেন ভেজা শরীরের ঈশানী ওর নতুন আকর্ষন।
— জান!
এরীশের অভিবাদনে চোখ তোলে ঈশানী। অস্ফুট স্বরে শুধায়,
— এই শব্দ কে শিখিয়েছে আপনাকে?
— কেউ না, ভেতর থেকে চলে এলো।
— শুনতে ভালো লাগছে আপনার মুখে।
অতর্কিতে ওর গলার ভাঁজে মুখ ডোবালো এরীশ, ফের ধ্বনিত হলো,
— জান,
— উমম!
—আ’ম এবাউট টু গো ওয়াইল্ড।
শেষ কথাতে সর্বাঙ্গে তরিৎ খেলে গেলো রমণীর, প্রকম্পিত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
— ঠি.. ঠিক আছে।
— কিন্তু তুমি কাপঁছো।
এরীশের কথায় নিজের শরীরে দৃষ্টি বোলালো ঈশানী, সত্যিই আশংকায় থরথরিয়ে কাঁপছে মেয়েটা। কপটতা খেলে গেলো এরীশের ঠোঁটের আগায়, ঈশানী কিছু বলার আগেই, ওর কানের লতিকায় অধর ছুঁয়িয়ে হিসহিসালো এরীশ,
— বাট আই কান্ট স্টপ রাইট নাও।
বাক্যটা উগরে দিয়ে একবিন্দুও দয়া দেখালো না মাফিয়া বস। হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে ছুড়ে ফেলে দিলো বিলাশবহুল বাথটবে।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪২
সে রাতে ঝড় হলো, প্রণয়ের জলোচ্ছ্বাসে ছন্নছাড়া হলো সমগ্র অস্তিত্ব। উদগ্রীব পুরুষালি হাতদুটো মশগুল হয়ে পরলো অবিন্যস্ততায়। প্রমত্ত চিত্তে আহরণ করে নিলো রমণীর শেষ সৌন্দর্যটুকু। অবশেষে রাত্রির শেষ প্রহরে মিলেমিশে একাকার হলো দু’টো প্রাণ। জাগতিক সকল ভালোবাসার উর্ধ্বে গিয়ে মরিচীকায় বিলীন হলো ঈশানী।ভালোবাসার তরে লুটিয়ে পড়লো তার বিবেক, বাস্তবতা সব। প্রেক্ষিতে পৃথিবীর নিষেধাজ্ঞা ভুলে সে রাতে রচিত হলো পাপ পুন্যের এক অপার মিলন হেতু।