আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৪

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৪
suraiya rafa

চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ প্রাণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই শীঘ্রই, সুতরাং এই গরমের অতিষ্ঠতা চলমান থাকবে বেশ কিছুদিন।
মাঝরাতে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে অফিস ফাইলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন তন্দ্রা জাওয়াদ। মনোযোগ তার গভীর। এরই মাঝে বিদ্যুৎ চলে গেলো অকস্মাৎ। ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের দরজাটা খোলা পরে আছে, যার দরুন বেলকনি গলিয়ে থেকে থেকে শীতল দমকা হাওয়া প্রবেশ করছে ভেতরে। বাতাসের প্রকোপে জানালার ভারী পাল্লা গুলো দুলছে সমানে। চারিদিকে সৌন্দর্য বর্ধক আসবাবের ছড়াছড়ি, পুরো কক্ষ জুড়ে মানি প্লান্ট’স এর অভাব নেই।

রয়েছে নানান রকম ইনডোর ক্র্যাফট। ফ্লাওয়ারভেস এ সজ্জিত প্রতিটি ফুলই তরতাজা স্নিগ্ধ। আজকেই বাগান থেকে তোলা হয়েছে বোধ হয়। ছোট ছোট ক্র্যাফট গুলো দুলছে অতর্কিতে। বাতাসের তোড়ে দু-একটা পরেছে ও বোধ হয় মেঝেতে। ওদিকে বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে ক্রমশ,কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। তবুও জানালা বন্ধ করার কোনোরূপ তোড়জোড় নেই রমণীর মাঝে । তিনি আস্তে করে উঠে এগিয়ে গেলেন বেলকনির দিকে,দু’হাত বাড়িয়ে কার্ণিশে ভর করে ছাড়লেন দীর্ঘশ্বাস। সমুদ্রাগত দমকা হাওয়ায় অচিরেই মিলিয়ে গেলো সেই ভারী বাতাসটুকু। গ্রীষ্মতপ্ত রুক্ষ প্রাণটা যেন অবশেষে ধড়ে ফিরে এলে তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— খালামনি আসবো?
খাদে নামানো মিহি কণ্ঠস্বর। পেছনে না ঘুরেই তন্দ্রা অনুমান করলেন নিঝুম এসেছে। অনুমতি সাপেক্ষে জানালেন,
— এসো।
অন্ধকার হাতরে অতি সর্তক পদযুগলে এগিয়ে এলো মেয়েটা।
— রাতে খেয়েছো?
তন্দ্রা জানতে চাইলেন নির্বিকারে।
— হুম
— তূর্য ফিরেছে?
— এখনো না।
— একটু পরে ঝড় শুরু হবে, এখনো বাড়ি ফেরেনি,কোথায় সে অবাধ্য ছেলে?
এতোক্ষণে ঘুরে তাকালেন ভদ্রমহিলা। নির্বিকার অভিব্যক্তি বিলীন হলো তার কঠোরতার অন্তরায়। মনেমনে দাঁত কিড়মিড়ালো নিঝুম, মহা বিরক্তির স্বরে আওড়ালো,
— আমি কি জানি?
অথচ মুখ ফুটে সেসব কথা উচ্চারন করার সাহস হলোনা আর। তূর্যের ব্যাপারখানা পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললো,

— আমাকে চিটাগং ফিরতে হবে খালামনি। কতগুলো দিন হলো পরে আছি এখানে, ভার্সিটির এটেনডেন্স নির্ঘাত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে এতোদিনে।। না ফিরলে ফেইল নিশ্চিত।
বুকের উপর দু’হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে নিঝুমের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করলেন ভদ্রমহিলা। দৃষ্টিতে তার প্রখর দীপ্তি, সে চোখে বেশিক্ষন তাকানো দ্বায়, অগত্যা নির্লিপ্তে চোখ নামায় নিঝুম। মেয়েটার পানে দৃষ্টি অবিচল রেখেই এবারে ভেতরের গাম্ভীর্যতাটুকু উগরে দিলেন রমণী।
— যাচ্ছো তো, বিয়েটা হয়ে গেলে তুমি আর তূর্য দুজনই চিটাগং ফিরে যাচ্ছো। আমাদের চিটাগং এর ফ্ল্যাটটা খালি পরে আছে ওখানেই থাকবে তোমরা দু’জন। তূর্য এজেন্সির চাকরী ছেড়ে অফিস সামলাবে, আর তুমি পড়াশোনা। সবকিছুই সুপরিকল্পিত। তাই আপাতত এসব নিয়ে ভেবোনা। রুমে গিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সাউন্ডস্লিপ দাও। আগামীকাল সন্ধ্যার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবেতো।

— সন্ধ্যায় কি আছে আগামীকাল ?
কৌতূহলী কন্ঠস্বর নিঝুমের।
— তোমাদের বাগদান অনুষ্ঠান। তোমার বাবা মা’কে খবর দিয়েছি তারাও আসছেন।
খালামনির শেষ কথাতে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো নিঝুমের। প্রকৃতি ছাপিয়ে কালবৈশাখীর এলোমেলো তান্ডবে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যেতে লাগলো তার অন্তঃকরণ। ভেতর ভেতর কোথাও একটা খাঁ খাঁ করছে ভীষণ। কারোর অস্তিত্বের অনুপস্থিতি পোড়াচ্ছে ওকে। হারিয়ে ফেলার বিষাদবিদূরে নীল হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। তূর্যের সঙ্গে বিয়ের আলাপ যে এর আগে হয়নি কখনো তেমনটা নয়। হয়েছে বেশ কয়েকবার। খালামনি নিজেই বলেছে ওকে। কিন্তু নিঝুম গুরুত্ব দেয়নি তেমন, বেখেয়ালি হয়ে শুনে গিয়েছে শুধু।
ভেবেছে, আমার আর চিন্তা কিসের? তূর্য ভাই যা মানুষ, তিনি দরকার পরলে বঙ্গোপসাগরে ঝাপ দিয়ে মরে যেতে রাজি হবেন, কিন্তু আমায় বিয়ে করতে না। সারাক্ষণ অমন সাপেনেউলে সম্পর্কের মাঝে বিয়ে হওয়া সম্ভব নাকি আদৌও ? দেখা যাবে বাসর ঘরে কয়েকশো হুতুম পেঁচা ছেড়ে দিয়ে তূর্য ভাই কপটতায় দাঁত কেলিয়ে বলবেন,

— হুতুম পেঁচা বলতিস না আমায়? নে এবার বাসর শুরু কর।
আর তক্ষুনি পেঁচা গুলো এসে নিঝুমের কাপড় চোপড় খুলে। ছেহ!
উদ্ভট ভাবনায় চোখমুখ কুঁচকে এলো মেয়েটার। তড়িঘড়ি করে ফিরে এলো বাস্তবতায়। নিঝুমের কুঁচকানো মুখশ্রী অবলোকন করে একই দৃঢ়তায় খালামনি বললেন,
— আমার কোনো মেয়ে নেই নিঝুম। ছেলেরা কখনোই মেয়ের মতো করে মাকে বুঝতে পারেনা। দিনশেষে আমাকে বোঝার মতোও কেউ নেই, এই একাকীত্ব বড্ড পীড়াদায়ক। আমার মনে হয়, ছেলের বউ হিসেবে আমার মেয়ে না থাকার একাকীত্বটা তোমার চাইতে ভালো আর কেউ বুঝতে পারবে না। আমি খালামনি থেকে মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত সোনা আমার।
নিঝুমের কণ্ঠনালি ধরে এলো এবার । তন্দ্রা খালামনিকে কখনো এতোটা অনুনয়ের স্বরে কথা বলতে দেখেনি ও। সত্যিই তো মানুষটা বরাবরই নিঃসঙ্গ। ছেলে তার ছন্নছাড়া বেয়ারা একটা। আরেক ছেলের নাম তো খালামনি মুখেও আনেন না কোনোদিন । সে খালামনির আগের পক্ষের, তাই হয়তো পুরোনো ব্যথায় স্মৃতি হাতড়াতে কিঞ্চিৎ শঙ্কিত মানবী। ।

— কি ভাবছো?
খালামনির ভারিক্কি প্রশ্নে ভাবনার ছেদ ঘটে অকস্মাৎ। অস্বস্তির মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে দিশেহারা নিঝুম। তুষার, ঈশানী কারোর কোনো খোঁজ নেই। মানুষ গুলো হঠাৎ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যায় কে জানে? ওদিকে খালামনি চেয়ে আছেন একই দৃষ্টে। এই দৃষ্টি যে উপেক্ষা করার নয়। নিঝুম পারলো না মুখের উপর না বলতে। ফলস্বরূপ বিষণ্নতা প্রগাঢ় হলো অন্তরে। সামান্য মাথা তুলে ভারী ইতস্তত কন্ঠে জানতে চাইলো,
— মা, বাবা রাজি হয়েছে?
হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেন খালামনি। বললেন,
— শুধু রাজি নয়। তারা অত্যন্ত খুশি এই প্রস্তাবে।
বিয়ের কার্জক্রম আটকানোর সুক্ষ্ম পন্থাটাও এবার বিলীন হলো অতর্কিতে। নিঝুমের আর বলার কিছু রইলো না। কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই বিপর্যস্ত বদনে ধীরে ধীরে কক্ষ ত্যাগ করলো মেয়েটা।

নিশ্চল পদধ্বনি, সিড়ি ঘরের জানালাটা খোলা পরে আছে, বৃষ্টির ছাট এসে থৈথৈ করছে পুরো মেঝে। নিঝুম দেখলো, তবে উদ্বিগ্ন হলোনা, নোংরা পানি ছাড়িয়ে চপচপে ভেজা পায়ে এগিয়ে গেলো সম্মুখে । ছাঁদের দরজায় দাঁড়াতেই প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় শিউড়ে উঠলো ওর শীর্ণকায় তনু খানা। তবুও নিরুদ্বেগ নিঝুম। ধরিত্রীর কোনো যাতনাই আজ ছুঁতে পারছে না ওকে। অপারগ অভিমানে দমবন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ।
সুপ্ত অনুভূতি জমে জমে পাহাড় হয়ে গেলো অথচ সে রহস্যময়ের দেখা নেই। হৃদগহীনে জমানো অনুরক্তিটুকু সবাইকে জানানো যতটা না কঠিন, একপাক্ষিক অনুভূতির অসহায়ত্ব প্রিয় পুরুষকে বোঝানো তার চেয়েও অধিকতর কঠিন।
নিজেকে অসহায় লাগছে ভীষন। নিঝুম চায় না এই বিয়েটা হোক। কাল বাগদান, অথচ ভিলেইনটাকে দেখার প্রয়াসে মরিয়া ওর দু’চোখ।

— কেন ভালোবাসলেন না আমায় তুষার? আমিতো কতবার কতভাবে নিজেকে আপনার সামনে মেলে ধরেছি। নানান ছুঁতোয় মনের অভিব্যক্তি জানিয়েছি, অথচ আপনি রহস্যই হয়েই থেকে গেলেন সবটুকু সময় । আপনার প্রস্তরকঠিন হৃদয়টাকে ছুঁয়ে দেখার সাধ্য হলোনা আমার। এখন আমি পরিনতির দারপ্রান্তে । তবুও কি আসবেন না একটাবার? শেষ বারের মতোও কি দেখা হবে না আমাদের?
উত্তাল প্রকৃতি যেন আজ নিঝুমের আকাশসম আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ। ব্যথিত দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে বৈশাখের ঘূর্ণি বাতাস। তমশাচ্ছন্ন ঝোড়ো হাওয়ার পানে দৃষ্টি ফেলে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো রমণীর নারী অবয়ব। মেয়েটা কাঁদছে খুব। এক উদ্দেশ্যহীন ভালোবাসা আজ নির্দ্বিধায় বিরহের বেদনায় ডুবিয়ে মারলো ওকে। অথচ তুষার জানতেও পারলো না, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিরহের অবিন্যস্ততায় দূরহ বুকে একতরফা ভালোবাসার মাশুল গুনছে এক অভাগা অসহায় মানবী।

— এমন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে শব্দ দূষণ করছিস কেন?
আচানক পুরুষালী আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে ওঠে নিঝুম, মূহুর্তেই থমকে যায় তার কান্নাকাটির বহর। হতচকিত নয়নে পাশ ফিরতেই দেখতে পায়, হুতুম পেঁচাটা দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছেই, ট্রাউজারের পকেটে দু’হাত গুঁজে কপাল গুছিয়ে রেখেছে তূর্য। ক্রন্দনরত ঝাপসা চোখে তূর্য ভাইকে একপল অবলোকন করে ফের দৃষ্টি ঘোরালো নিঝুম। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে, নাক টেনে কান্না আটকানোর বৃথা প্রয়াস চালালো কিয়ৎক্ষন।
— কিরে, বললি না তো?
— কি?
নিঝুমের ভঙ্গুর কণ্ঠে বিরক্তির লেশ। তূর্য কৌতুক স্বরে ফের শুধালো,
— এভাবে শব্দ দূষণ করছিস কেন?
বিরক্তির চরম শিয়রে পৌঁছালো নিঝুম। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
— ঝড়ের তোড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সব, আকাশে বাজ পড়ার বিকট গর্জন, অথচ আমার এই সামান্য কান্নার আওয়াজটুকু আপনার কাছে শব্দ দূষণ মনে হচ্ছে?
ভদ্রলোকের ন্যায় ঠোঁট উল্টে উপর নিচ মাথা নাড়ালো তূর্য।বললো,
— ওটাতো প্রকৃতির আশির্বাদ। আর তোরটা শব্দ দূষণ।
একই উদ্যমে কথার বুলেট ছুড়লো নিঝুম ,
—ছি তূর্য ভাই! সামান্য কাঁদছি বলে আপনি আমাকে শব্দ দূষণের তকমা দিচ্ছেন, বিয়ের পরে তো গোটা পরিবেশ দূষণের কলঙ্ক চাপিয়ে দিবেন।

— ঠিকই ধরেছিস। নেংটি ইদুরের কাজ তো ওটাই, পরিবেশ দূষণ।
— পরিবেশ দূষণকারী এই নেংটি ইদুরটাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন কেন খামোখা? নিজের মাকে আটকালেই পারেন।
এবারে মুখাবয়ব শক্ত করে ফেললো তূর্য। তরতরিয়ে বললো,
— সেধে সেধে গাট্টা খাওয়ার শখ নেই আমার, তোর এতো শখ থাকলে তুই গিয়ে আটকা।
তূর্যের প্রত্যুত্তর শুনে নিঝুমের চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে ছুড়লো আশ্চর্য প্রশ্ন,
— সামান্য গাট্টা খাওয়ার ভয়ে নিজের পুরো জীবনটা নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলবেন তূর্য ভাই?
ভাবলেশহীন তূর্য,কন্ঠে জোরপূর্বক গাম্ভীর্যতা টেনে বললো,
— আমার মায়ের হাতের গাট্টা খাস নি তো, তাই এভাবে বলছিস। খেলে স্বাদ মিটে যেতো।
— আমি আপনাকে বিয়ে করবো না তূর্য ভাই।

অকস্মাৎ তূর্যের হাত টেনে ধরে, শিশুসুলভ মাথা নাড়ায় নিঝুম। যেন বিয়ে নয় সামান্য হোমওয়ার্ক করার কথা বলা হচ্ছে এখানে। তৎক্ষনাৎ এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তূর্য। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বললো,
— ছাড়! ছাড়! ঢং দেখো। এমন ভাব যেনো আমি ওনাকে বিয়ে করার জন্য সিলিং ফ্যানে ঝুলে আছি। নেহাৎ ছোট বোন হোস, তাই বড় ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, নয়তো আমি তূর্য প্রিন্সেস ডায়না ডিজার্ভ করি। বুঝেছিস!
— কিন্তু সে তো আপনার জন্মের আগেই পটল তুলেছে।
তূর্যের মুখের উপর সহজ সরল বাক্যটা ছুড়ে মে’রে অবুঝের মতো ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো নিঝুম। তূর্যের বোধ হয় মানে লাগলো ভীষণ , ও কথা এড়িয়ে ধমকে উঠলো একপ্রকার,
— চুপ থাক অবলা রমণী। প্রিন্সেস ডায়নার অভাব আছে নাকি এই যুগে। তোর না হওয়া ভাবিকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি জানিস? এখন সব জলাঞ্জলি হতে চলেছে তোর জন্য।

— আমি কি স্বপ্ন দেখতে বারণ করেছি নাকি আপনাকে?
— না করিসনি, শুধু আমার বউয়ের জায়গা দখল করার জন্য ঘাপটি মে’রে আছিস।
নিঝুমের বিষণ্ণ মনটা চুপসে গেলো এবার। ভেতরের আত্নবিশ্বাসী সত্তাটা বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,
— তোকে কেউ চায় না, কেউ নাআআ।
বুক চিড়ে বেড়িয়ে এলো নৈঃশব্দ্যিক দীর্ঘশ্বাস। গাল ফুলিয়ে স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো মেয়েটা,
— বুঝে গেছি, এ বিয়ে সম্পন্ন হলে চব্বিশ ঘণ্টা ফিশফ্রাইয়ের মতো আপনি আমাকে ভেজে খাবেন তূর্য ভাই।
নিঝুমের মন খারাপে কোনোরূপ ভাবান্তর ঘটলো না তূর্যের মাঝে। দু’হাত পকেটে গুঁজে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে যেতে যেতে শীতল কন্ঠে আওড়ালো,,
— গ্যারান্টি নেই, মাথা খারাপ হলে কাঁচা ও খেয়ে ফেলতে পারি।

রয়্যাল ক্যারাভিয়ান, বাংলাদেশ।
সুদীর্ঘ এক গভীর স্বপ্নের অবসান ঘটলো সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আশেপাশে পাখির কলতান নেই, নেই কোনো অনর্থক কোলাহল। সমুদ্রপৃষ্ঠের ভয়াল গর্জন ও কমে এসেছে খানিক। বেলাভূমির আশেপাশে থাকার দরুন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে কেবল । এতো বৃহদাকার ক্রুজশীপে ঢেউয়ের দোলা উপভোগ্য নয়,অথচ কাল রাতে ঝড়ের তোড়ে মৃদুকম্পনে দুলেছে শীপটা। ফলস্বরূপ এক দিশেহারা অস্থির যুগলের প্রাপ্তির রাতটুকু হয়ে উঠেছিল দিগুণ বেসামাল। অপার্থিব এক প্রশান্তির লহমায় বিলীন হয়েছিল তাদের সর্বাঙ্গ । পালাক্রমে দু’টো শরীর মেতে উঠেছিল অবিন্যস্ততায় । দূরত্বের সকল স্তর ছাপিয়ে সমগ্র রজনী জুড়ে নীলাম্বরীর শরীরের প্রতিটি খাঁজে রাজত্ব চালিয়েছে মাফিয়া বস। মোহনীয়তায় বিমত্ত হয়ে প্রেয়শীর ফর্সা, মাখন নরম ত্বকে সীলমোহরের ন্যায় ছাপ ফেলেছে নিজের অশুভ অস্তিত্বের।

ভেঙেছে সীমাবদ্ধতার দেওয়াল। তার বেলাল্লাপনায় সংকোচের পাহাড়ে ধস নেমেছিল রমণীর। যার দরুন সে রাতে ভালোবাসার পূর্ণতায় দলিতমথিত হয়ে এক আশ্চর্যবোধক অনুভূতির শিয়র ছুঁয়েছিল অন্তর।
রাতের কথা ভাবতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় অকস্মাৎ ঝটকা খেলো ঈশানী। মুখ ডুবিয়ে রাখা ভেলভেট কুশন থেকে নিসৃত কৃত্রিম সুগন্ধির মিশেলে সৃষ্ট পুরুষালী সুঘ্রাণে শরীর শিউরে উঠলো তার । অগত্যা কোনোকিছু না ভেবেই শোয়া থেকে একলাফে উঠে বসলো বিছানায়া। শরীরে ফিনফিনে একটা সফেদ লেডিস শার্ট। যার উপর দিয়ে ওর অভ্যন্তরিন সৌন্দর্য স্পষ্ট দৃশ্যমান। পায়ের অংশটুকু ঢেকে আছে তুলতুলে কালো রঙা কম্ফোর্টারের আস্তরণে। কালো রঙটা চোখে পড়তেই, দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারিদিক অবলোকন করলো রমণী।
বিলাসবহুল মাস্টার বেডরুম, অথচ পুরো কক্ষজুড়ে কালোর সমাহার, অনেকটা রাশিয়ান পেন্ট হাউজের মতো। একপাশে লাক্সারি রেইন শাওয়ার ওয়াশরুম, যেখানটায় এরীশ কোলে করে নিয়ে এসেছিল ওকে। কাল রাতে সেভাবে খেয়াল করা হয়নি, মাত্রই চোখে পরলো দক্ষিণ পাশে রুমের সাথে সংযুক্ত রয়েছে এক বিশাল ইনফিনিটি সুইপিং পুল ।

একটা ভাসমান ক্রুজশীপের মধ্যেও যে এতো বিলাশী জীবনযাপন করা সম্ভব , তা মাফিয়া বসকে বিয়ে না করলে বোধ হয় এ জীবনে জানা হতোনা ঈশানীর। কক্ষটাকে পর্যবেক্ষন করার প্রয়াসে এবার বিছানা ছাড়লো মেয়েটা । সুক্ষ্ম নজরে এদিক ওদিকে দৃষ্টিপাত করে ভীরু কদমে এগুলো সম্মুখে। ওপাশে কিছু একটা পরার ধিম ধিম আওয়াজ হচ্ছে ভীষণ । সেদিকেই এগিয়ে চললো ঈশানী।
খানিক যেতেই দেখলো, কক্ষের সঙ্গে লাগোয়া জিম রুম। ভেতরে ক্রমাগত বক্সিং এ ব্যস্ত এরীশ। দু’হাতে বক্সিং গ্লাভস। পরনে তার ব্যাগি ডেনিম আর অলিভ গ্রীন মিশ্রিত একটা ওভার সাইজ’ড হুডি। শেষ কবে এরীশকে কালো ব্যাতীত অন্য কোনো রঙে দেখেছিল ঠিক মনে পরছে না ঈশানীর। ফলস্বরূপ, দু’হাত বুকে ভাজ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে লাগলো মাফিয়া বসটাকে। রুক্ষ, সৌষ্ঠব, যান্ত্রিক তার কার্যক্রম। অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপে দানবীয়তা সুস্পষ্ট। অথচ তার নির্জীব ধূসর বাদামি চোখ দু’টোতে কি অদ্ভুত মোহ। ঈশানীর পুরো দুনিয়া তোলপাড় করে দেওয়ার জন্য অনুভূতিহীন এই শূন্য অক্ষিদ্বয়ই যথেষ্ট। যা ওকে বাঁচিয়ে মা’রে ক্রমশ।

— কাম ইন।
নিজ কার্জে অবিরত থেকে রাশভারি আওয়াজ ছুড়লো মাফিয়া বস।
— কি করে বুঝলেন?
— সিক্স সেন্স।
এবারও ভাবলেশহীন তার কন্ঠস্বর।
নির্লিপ্ত কদমে এগিয়ে এলো ঈশানী। সন্নিকটে দাঁড়িয়ে বললো,
— মাফিয়াদের সকাল বুঝি এভাবে শুরু হয়?
এরীশ থমকালো না, একই গতিতে পরপর অজস্র ঘুষি বসাতে লাগলো পাঞ্চিং ব্যাগের গায়ে। উর্ধ্বশ্বাসে জানালো,
— মাফিয়াদের জীবনে সকাল বলে কিছু হয়না, গোটাটাই অমানিশার রাতের মতো ঘুটঘুটে।
— আপনি দুর্বোধ্য।
— ইট’স মাই ন্যাচার।

সবেগে প্রত্যুত্তর করলো এরীশ। কথা না বাড়িয়ে নির্বিকারে চারিদিকে চোখ ঘোরায় ঈশানী। জিমের আসবাব গুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সব। কক্ষের একপাশে ডিভান রাখা আছে দু’টো, সামনেই কফি টেবিলের অবস্থান, সেখানে সাদা পাউডার জাতীয় কোন বিশেষ দ্রব্য ছড়িয়ে আছে সমগ্র টেবিল জুড়ে। ঈশানীর তীক্ষ্ণ নজর এড়াতে পারলো না সেই দ্রব্য, তক্ষুনি গ্রীবাদেশ ঘুরিয়ে স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো এরীশের পানে,
— আপনি ড্রাগ নেন?
— মাঝেমধ্যে। ভেতরটা মাত্রাতিরিক্ত অস্থির হয়ে পরলে, রাইট সেন্সে নিজেকে সামলানো মুশকিল।
সোজাসাপটা উত্তর দিলো এরীশ, পরক্ষণেই ঈশানী বললো,
— তা কাল রাতে কি এমন হয়েছিল, যে আপনাকে ড্রাগ নিতে হলো?
— সেটা তো তুমি আমাকে বলবে। নিজের সৌন্দর্যে আমাকে উন্মাদ করে দিয়ে এভাবে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার মানে কি?শুধু শুধু তোমাকে অবাধ্য বলিনা আমি।
খানিক ভেবে ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেললো ঈশানী, এরীশের অভিযোগে ঘোর অসম্মতি জানিয়ে লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো,

— আমার যতদূর মনে পরে তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল।
— বাট আ’ম নট স্যাটিসফাইড। আমার হয়নি তোমাকে পাওয়া। তোমার এই দূর্বল হার্টের চক্করে ভবিষ্যতে আমাকে যে আরও কি কি স্যাক্রিফাইস করতে হবে কে জানে?
দমলো না ঈশানী, যেন কথার বহরে জিততেই হবে ওকে, তেমন করেই তরতরিয়ে বলে উঠলো,
— সেন্সলেস হয়েছিলাম কে বললো আপনাকে? আমিতো ঘুমাচ্ছিলাম।
পাঞ্চিং ব্যাগ রেখে এবার ট্রেডমিলের দিকে এগিয়ে গেলো এরীশ। সেন্সরে আঙুল চালিয়ে গতিবিধি ধীর করে চাইলো ঈশানীর পানে। নাকের পাটা ফুলিয়ে মেয়েটা এগিয়ে এলো দু’কদম । এরীশ তার পিয়ার্সড করা ভ্রুখানা উঁচিয়ে গভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো এবার,

— তাই নাকি?
— হু তাইতো।
— একটু ভেবে দেখেতো, তুমি কাল রাতে আদৌও শরীরে কিছু পরেছিলে নাকি। তাহলে এখন শার্ট কোত্থেকে এলো?
ঈশানী ভাবলো কিয়ৎক্ষন। পরপরই এরীশ বললো,
— সকাল থেকে দু’ব্যাগ স্যালাইন শেষ হয়ে গেলো অথচ তোমার ঘুমই ভাঙলো না।কি আশ্চর্য!
—কিহ!
এরীশের কথায় যেন আকাশ থেকে পরলো ঈশানী। কণ্ঠে তার অপ্রতিরোধ্য আশ্চর্যতা। এরীশ বললো,
— খেয়াল করো, বাম হাতে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো রয়েছে ।
এবারে হাতের দিকে লক্ষ্য করলো ঈশানী, সত্যি তো, আড়াআড়ি দু’টো অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। হতে পারে স্যালাইন পুশ করার কারনেই জ্ঞান ফেরার পরে কোনোরূপ ক্লান্তি আসেনি শরীরে। উল্টো মনে হয়েছে এটা ঘুম ছিল, ভীষন লম্বাআআ ঘুম। তবে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মন খারাপ হয়ে গেলো মেয়েটার । পানপাতার মতো ঢলঢলে স্নিগ্ধ চেহারাটা বিষণ্ণতায় চুপসে গেলো অকস্মাৎ। আহত স্বরে বললো,

— আমার হার্ট এতো দূর্বল কেন এরীশ?
এতোক্ষণে থমকালো মাফিয়া বস। দেখলো স্নিগ্ধ সাকুরার বদনে ঘনকালো মেঘের আস্ফালন। এই মূহুর্তে ঈশানীর মন খারাপ হোক সেটা বোধ হয় বরদাস্ত করবে না এরীশ। যার দরুন ম্যানিউপুলেটিভ পন্থায় মূহুর্তেই ঘুরিয়ে নিলো বিষয়বস্তু। ট্রেডমীল থেকে নেমে
ওর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করলো একপল, অনাবৃত মোম নরম পা দু’টোতে আলো পিছলানো দ্যুতি। শরীরে ফিনফিনে পাতলা হাঁটুসম লেডিস শার্ট। যার আবরণ কাচের মতো স্বচ্ছ। এতোটাই কোমল তার প্রলেপ, মেয়েটার ত্বকের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে যেন। শার্ট ভেদিয়ে নারীদেহের প্রতিটি স্তরে সন্তোর্পনে দৃষ্টি বোলালো এরীশ। অতঃপর তর্জণী দ্বারা সাকুরার বিউটি বোনে আলতো স্পর্শ করে হাস্কিস্বরে আওড়ালো,
— এগুলো প্রীটি লাগছে, তোমার শরীরের পার্পল স্টেইন গুলো জানান দেয় তুমি ঠিক কতটা আমার।
সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে নিজেকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা চালালো ঈশানী, আড়ষ্টতায় দৃষ্টি নমিত করে শুধালো,

— এই মশারীর মতো পাতলা শার্ট কোথায় পেয়েছেন বলুন তো? এটা অস্বস্তিদায়ক।
— স্মা’গ’লিং এর সাথে এসেছে।
— কিহ!
— ইয়েস। পাশ্চাত্যের রাণী প্রথম এলিজাবেথের পোশাক এটি, এর প্রতিটি সুতো মূল্যবান রেশম দিয়ে তৈরি। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এর মূল্য ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এতোক্ষণে চোখ কপালে উঠে গেলো ঈশানীর। কৌতুহল দমাতে না পেরে অবিশ্বাস্য কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
— কিহ! আমি রাণী এলিজাবেথের পোশাক পরে আছি? কিন্তু এটা এতো পাতলা কেন? মনে হচ্ছে কিছুই পরিনি?
নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে আনমনে প্রশ্ন ছুঁড়লো ঈশানী।
— কারণ এই ড্রেস সবসময় পরার জন্য নয়। শুধু মাত্র……
বাক্য সম্পন্ন না করেই ক্রূররতার সাথে ঠোঁট বাঁকালো এরীশ। ঈশানী জবাব দিলো,
— এভাবে তাকাবেন না। প্লিজ!
মাথার উপর হুডির আস্তিন সরিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজলো লোকটা ,

— হোয়াই!
কুণ্ঠিত স্বরে কিছু একটা প্রত্যুত্তর করতে চাইলো ঈশানী, তবে অবকাশ পেলোনা। তার আগেই ধ্বনিত হলো এরীশের গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
— কাল কতবার তুমি তুমি করে ডেকেছো। আজ হঠাৎ আপনি বলে দূরত্ব বারাচ্ছো যে ? তোমার মাঝে এখনো এমন কি রহস্য রয়েছে যা আমার দু ঠোঁট উন্মোচন করেনি?
আচানক ঈশানী অনুভব করলো ওর শরীর জমে এসেছে, প্রস্তরখন্ডের ন্যায় শক্ত হয়ে উঠেছে সর্বাঙ্গ। স্পর্শ না করা সত্বেও কানের উষ্ণতা সুস্পষ্ট। গাল দু’টোও রক্তাভ হয়ে উঠেছে বোধ হয়, জ্বলছে ভীষণ।
নির্দয় মাফিয়া বসটা বুঝতে পারেনা রমণীর লাজুকতার কারণ, কেবল উপলব্ধি করে এই চেহারায় ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে মেয়েটাকে। মুখে বলে,

— আপনি আজ্ঞে বলা বন্ধ করো, পরিপূর্ণ স্বামীর অধিকার চাই আমার।
— এতো জোর গলায় স্বামীর অধিকার চাইছেন, সংসার দিতে পারবেন?
এতোক্ষণে বুলি ফুটলো মেয়েটার। দু’জনার মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘোচাতে খানিক এগিয়ে এলো এরীশ। ঈশানীর চুলের মাঝে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ করলো গ্রীবাদেশ, সেখানটায় নিজের শক্তি ফলিয়ে ওর মুখটা টেনে নিয়ে এলো সন্নিকটে। নীলাভ মনি দু’টোর মাঝে দুনিয়ার সবটুকু মোহ নিক্ষেপ করে বললো,
— আমি এমন অনেক কিছু দিতে পারি, যা অন্য কেউ দিতে পারেনা।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। এরীশের তীক্ষ্ণ মাদকীয় দৃষ্টি ভস্ম করে দিতে চাইছে ওকে, অগত্যা দানবটাকে শান্ত করার প্রয়াসে অকস্মাৎ তার হুডির মধ্যে ঢুকে গেলো মেয়েটা। দু’হাত বাড়িয়ে আবদ্ধ করলো মরীচিকার চওড়া পুরুষালি পৃষ্ঠদেশ। ন্যানো সেকেন্ডের মাথায় ঘটে গেলো ঘটনাটি। যার আকস্মিকতায় কিঞ্চিৎ বিহ্বলিত মাফিয়া বস। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই শরীরের সংস্পর্শে অনুভূত হলো রমণীর নমনীয় তনু অস্তিত্বখানি।
— নাও দিলাম স্বামীর অধিকার। এবার হলো?

দেরী করলো না মাফিয়া বস। ঈশানীর পিঠ বরাবর আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো আলগোছে । ধনুকের মতো বাঁকানো নারীদেহের সুচারু উপত্যকা দুটো নিমেষেই পিষে গেলো পুরুষালী ইস্পাত কঠিন বক্ষভাজে। তুলতুলে কোমল অনুভূতির তুফানে শরীর শিউরে উঠলো মূহুর্তেই। আবেশে অক্ষিপুট নিভে এলো এরীশের। পরপরই ঈশানীর মাথায় সুতীব্র চুমু খেয়ে হিমশীতল কন্ঠে বললো,
— এ্যাজ আ কুইন অফ দ্যা মাফিয়া বস রীশস্কা , তোমার সকালটা আরও থ্রীলিং হওয়া প্রয়োজন। চলো উপভোগ করাই।
— মানে?
এরীশ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই খেয়াল করলো বাইরের করিডোর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে লা”শের বস্তা সরাচ্ছে গার্ড’সরা। তৎক্ষনাৎ বাহুবন্ধ ঈশানীকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো সে। অতঃপর একটানে শরীরের হুডিটা খুলে ঈশানী সমেত সোজা ঝাপিয়ে পরলো মাঝ সমুদ্রে।

উত্তাল জলস্রোতের মাঝে হাবুডুবু খেতে খেতে অবশেষে মাথা তুলে একটুখানি অক্সিজেনের হদিস পেলো ঈশানী। শ্বাসনালিতে পানি ঢুকে শুরু হয়েছে অবিরত কাশি। তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে দেখলো মাথার উপর উন্মুক্ত দিগন্ত। ঝাপসা চোখে চারিদিক অবলোকন করতেই উপলব্ধি করলো ধূ ধূ সমুদ্রের মাঝে একাই ভাসছে ও। সাঁতার তো জানা নেই, তাহলে কে ওকে তুলে রেখেছে এভাবে?অতর্কিত ভাবনায় শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখা মিললো এরীশের। দু’হাতে ওকে শূন্যে তুলে রেখেছে সে , ধড়ফড়িয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ শক্ত করে এরীশকে ঝাপটে ধরলো মেয়েটা। আতঙ্কে জান বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রকম্পিত হাতে বাঁধনের দৃঢ়তা বাড়িয়ে কেঁদে ফেললো ঈশানী, ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো,

— তুমি কি পাগল?
নিঃশব্দে হাসলো এরীশ। ঈশানী বলতে লাগলো,
— এভাবে মাঝ সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে মৃ”ত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে করতে সকাল উপভোগ করার কোনো শখ নেই আমার, এক্ষুনি নিচে নামাও।
— আমি আছি তো এখানে , ভয় কিসের ?
কথাটা বলে দু’হাতের প্রগাঢ়তায় ঈশানীকে আরও খানিকটা উপরে তুলে ফেললো এরীশ। এতোক্ষণে ওষ্ঠাগত প্রাণ, মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চ্যাঁচাতে যাবে, তার আগেই ধাতস্থ স্বরে এরীশ বললো,
—লিসেন, লিসেন টু মি, এভাবে ছটফট করোনা পরে যাবে।
এবারে হাসফাস টুকু থমকে গেলো ঈশানীর। দমবন্ধ করে পরে রইলো চুপচাপ।
— এদিক ওদিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই, সোজা উপরে তাকাও, তারপর দু’হাত মেলে ধরো শূন্যে, ইউ’ল ফিল রিল্যাক্স ভেরী সুন।
ঈশানী তাই করলো, মাঝ সমুদ্রে ভাসমান এক নির্দয় পুরুষের বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত মেলে দিলো শূন্যে। দৃষ্টি তার নীল আকাশে নিবদ্ধ। যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে উড়ন্ত সাদা মেঘের ভেলা। চোখের মাঝের আতঙ্কটুকু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো মুগ্ধতার অন্তরালে। ঠোঁটের আগায় উঁকি দিলো এক চিলতে নরম খুশি । বিশ্বস্ত হাতদুটোর উপর নিজের অস্তিত্ব তুলে দিয়ে স্বস্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। বিস্ময়কর নীল দু’চোখে ধারণ করতে লাগলো নীল আকাশের অপার বিস্তৃতি। উল্লাসে ঝুমঝুমিয়ে উঠে মুখ ফুটে আওড়ালো,

— এতো সুন্দর দৃশ্য আমি কোনোদিন দেখিনি এরীশ, কোনোদিন না!
— আমিও দেখিনি।
মাফিয়া বসের নির্লিপ্ত আওয়াজ। ঈশানী দৃষ্টি নামিয়ে শুধালো,
— কি দ্যাখোনি?
— এই নীল চোখ। যা আমার নিস্প্রাণ হৃদয়টাকে অনুভূতির জলোচ্ছ্বাসে বিদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।
নিস্প্রভ চাহনি। দৃষ্টিতে তার বেসামাল ঘোর। ঈশানী তাকিয়ে থাকতে পারলো না বেশিক্ষন, গলা খাদে নামিয়ে বললো,
— একটু নিচে নামাও।
হাতের দৃঢ়তা সামান্য কমিয়ে আনলো এরীশ, সহসা খানিক নিচে নেমে এলো মেয়েটা।
এবার ওরা মুখোমুখি। আলগোছে মাফিয়া বসের গ্রীবাদেশ আঁকড়ে ধরলো রমণী, গভীর দৃষ্টিতে পরখ করলো মানুষটাকে, পরপরই নিজেকে আস্বস্ত করার প্রয়াসে শুষ্ক এক ঢোক গিলে ঠোঁট বসালো উজ্জ্বলাভ পুরুষালি কপালে।মূহুর্তেই বিন্দু বিন্দু জলের স্পর্শে সিক্ত হয়ে উঠলো তার ওষ্ঠাধর। দু’জনার মুখে রা নেই, অথচ মোহাবিষ্ট নয়নে হাজারো কথার আদান-প্রদান।
বহুক্ষণের নৈঃশব্দ্যিক সেই ঘোর টুকু এক লহমায় ভেঙে দিলো এরীশ। নিয়ন্ত্রণহীন জলদস্যুর ন্যায় চোখ ছাপিয়ে হানা দিলো অধর ভাঁজে। রয়ে সয়ে নয়, বরং গভীর থেকে গভীরতম স্পর্শের প্রগাঢ়তায় ন্যস্ত করলো নিজেকে। এ যেন চুমু নয়, অধরের উন্মাদনায় প্রেয়শীর হৃদয় ছোঁয়ার সুক্ষ্ম কৌশল।

সবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে ক্রুজশীপখানি। এরীশ আর ঈশানী ফেরেনি এখনো । গিয়েছে উল্টো দিকে। নটিক্যাল মাইল খানিক সাঁতরে যেতেই হদিস মিলেছে বালুচরের। এটা মূলত একটা দ্বীপ। এরীশ জানতো এই দ্বীপের কথা, তাই নিয়ে এসেছে ঈশানীকে। তবে এই মূহুর্তে ঈশানীকে নিয়ে সাতার কেটে পুরোপুরি নিস্তেজ সে ।পায়ের তলায় স্থলের অস্তিত্ব অনুভূত হতেই গা এলিয়ে দিয়েছে উন্মুক্ত বালুচরে। ভীত মেয়েটা এখনো বাহুতে আবদ্ধ তার । ভেজা বালুতে মাখামাখি দু’জন। পরিশ্রান্ত হয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে এরীশ,ওদিকে কৌতুহলের অন্ত নেই ঈশানীর। জিজ্ঞেস করলো,

— এই দ্বীপটা কার?
— আমার।
মাফিয়া বসের গম্ভীর কণ্ঠস্বর। ঈশানী ভ্রু কুঁচকালো, মুখ ভেঙিয়ে বললো,
— অমনি? দেখলে আর হয়ে গেলো তোমার।
বউয়ের ছেলেমানুষী কথায় নির্বাক এরীশ ইউভান। পুলকিত কন্ঠে ঈশানী বললো,
— আচ্ছা এই দ্বীপের নাম কি?
— জানিনা।
রাগী ভুতটা এবারও নির্বিকার। ঈশানী ঠোঁট উল্টালো, খানিক ভেবেচিন্তে বলে উঠলো,
— আমার একটা নাম মাথায় এসেছে।
— কি নাম?
— অরণ্য, এই দ্বীপের নাম অরণ্য দ্বীপ ।
— ঠিক আছে।
— এই দ্বীপে যদি আমার একটা ক্যাফে থাকতো, নাম হতো কর্ণিয়া ক্যাফে। অরণ্য দ্বীপে কর্ণিয়া ক্যাফে, সুন্দর না?
এরীশ হ্যা সূচক মাথা দোলালো। বললো,
— সুন্দর।
— কিন্তু এখানে তো কোনো মানুষ নেই।
— হুম।
কাজের কথা ভাবতে গিয়ে অকস্মাৎ নিজের আসল সত্তায় ফিরে গেলো ঈশানী। নিমেষেই চিন্তিত হয়ে উঠলো তার পেলব মুখাবয়ব, সহসা এরীশের পেশিবহুল বাহু থেকে সরে এসে উঠে বসলো তরাগ করে। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে এরীশের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,
— আমি কাজে ফিরতে চাই এরীশ।
— কোন কাজে?
— বুটিক্স হাউজের।
— অসম্ভব!

কোনো প্রকার দ্বিধান্বিত না হয়ে মুখের উপর না করে দিলো মানুষটা। কন্ঠতালু ভেদিয়ে ভয়ার্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো ঈশানী, শিশুসুলভ আর্জি জানিয়ে বললো,
— প্লিজ না করোনা, আমি ফিরে আসবো আবার, কোথাও পালাবো না, সত্যি বলছি।
এতোক্ষণে ঈশানীর চোখেচোখ রাখলো এরীশ। ওকে হ্যাঁচকা টানে বুকের উপর ফেলে দিয়ে নিসৃত করলো কঠোর বাক্য ধ্বনি,
— আমার বুকের উপর থেকে সরে যাওয়ার স্পর্ধা কে দিলো তোমায়?
— এরীশ প্লিইইজ!
ঈশানীর চোখে অনুনয়। কন্ঠদীপ্ত ম্লান হয়ে এলো মাফিয়া বসের, এই চোখ দু’টোর কাছে বরাবরই পরাস্ত তার পৈশাচিক সত্তা। বললো,
— ওটা তোমার জন্য সেফ নয়।
— তাহলে আমার স্বপ্ন?
— সেটা না হয় আমার উপর ছেড়ে দাও।
খানিক আস্বস্ত হলো রমণী। সন্তোর্পনে মাথা ঠেকালো পুরুষালি প্রসস্ত বুকে। তপ্তশ্বাস ছেড়ে নরম রিনরিনে আওয়াজে বললো ,

— আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।
পুরো দুনিয়ার অগোচরে সেবেলা বালুচরে কাটিয়ে দিলো দু’জন। শান্ত প্রকৃতির নিচে নিভৃতে বিনিময় হলো অজস্র প্রতিশ্রুতির। শেষবেলায় বেলাভূমির বুকে আঁকিবুঁকি নিয়ে ব্যস্ত হলো ঈশানী। দুনিয়া ভুলে গেলো মাফিয়া বস। পুরোটা সময় জুড়ে বসে বসে দেখলো ওকে। ছন্নছাড়া হৃদয়টা আজ শান্ত, স্থির, হিমবাহের ন্যায় শীতল। নীলাম্বরীকে দেখতে দেখতেই স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো সে,
— প্রেম আমার।
ঠিক সেই মূহুর্তে পৃথিবীর কোথাও কোনো এক প্রান্তে বেজে উঠেছিল একরাশ বিমুগ্ধ সুরের মূর্ছনা,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৩

আমি যেতে পারি, হেসেই পেরোতে পারি
অনেক অনেক অতল…..
তোর কথা ওঠে, আমার কপালে জোটে
দারুণ খুশিরই দল…..
কে তুই বল…..
কে তুই বল….

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৫