আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৫
suraiya rafa
রাশিয়া,
নিশীথ নিবিড় ক্লান্ত রজনী। তুষার আচ্ছাদিত ঘুমন্ত প্রকৃতি জুড়ে নিশাচরের কলতান। রাত্রির আঁধার মেখে নৈঃশব্দ্যে ঝিমিয়ে আছে প্রকৃতি। কান্ট্রিসাইডের ছোট্ট ভিলা টিও তার সামিল।
কাঠের তৈরি চ্যালেটাকৃতির ছোট্ট দু’টি ঘর। চারিদিকে বরফের আবরণ, সম্মুখ দুয়ারের ফায়ার প্লেসটা নেভানো, ভেতরে টিমটিমিয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে হ্যাজাকের মৃদু রোশনাই।
এরূপ ঠান্ডা শীতল আবহ মনে প্রশান্তি জাগায়, স্বস্তির শিহরণে অদৃশ্য এক তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঝিমিয়ে পরে অন্তরাত্মা। চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম নামিয়ে পাহারায় অধিষ্ঠিত হয় অর্ধ চন্দ্র। তবুও নির্ঘুম তুষার। ব্যগ্র তার যান্ত্রিক অক্ষিযুগল।
মাঝরাত্তিরে আগত অপ্রত্যাশিত এক ফোন কলের প্রেক্ষিতে মাস্টার মাইন্ড খ্যাত নিখুঁত মস্তিষ্কটাও খেই হারিয়েছে এক নিমেষে।
বুকের রক্ত তোলপাড় করা ক্রুদ্ধতায় আচানক গর্জে উঠেছে সে ।
অপ্রত্যাশিত বললে খানিক ভুল হবে বৈকি। এই ফোন কলের প্রত্যাশাতেই তো এ-কদিন রুগ্ন সিংহের ন্যায় ঝিমিয়েছে সে। দূধর্ষ মস্তিষ্ক জুড়ে সাজিয়েছে একের পর এক মারণ কৌশল।
গুরুত্বপূর্ন সেই ফোনালাপ শেষ হতেই অস্থির হয়ে উঠলো যন্ত্রমানব। হিংস্রতার অনলে উবে গেলো তার সাবলীল নিস্পৃহ সত্তা। অন্তরের তাড়নায় হনহনিয়ে ছুটলো ফ্লোরার ঘরের পানে।
বাইরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ার প্রয়োজন বোধ করলো না তুষার,দরজা ঠেলে আচানক প্রবেশ করলো ভেতরে। সমস্ত আলো নেভানো কক্ষের, মাথার শিয়রে যে বেতের তৈরি ছোট্ট কফি টেবিল টা রয়েছে সেথায় টিমটিমিয়ে হ্যাজাক জ্বলছে কেবল। অস্থির চিত্তে সমগ্র ঘরে চোখ বোলালো তুষার, হ্যাজাকের হলদেটে আলোয় আবিষ্কার করতে চাইলো রুশ কন্যার তনু অস্তিত্বখানি ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
খানিক বাদেই দৃষ্টি স্থির হলো বিছানায়। পেছন ফিরে গুটিসুটি মে’রে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে মেয়েটা, পরনে তার হাটুসম মখমলের নান্দনিক ফ্রক। অক্ষিপুটে পলক ছাড়লো তুষার, তপ্তশ্বাস ছেড়ে ডাকলো ঘুমন্ত রুশকন্যাকে,
— ফ্লোরা!
নিরুদ্বেগ ফ্লোরা। কোনোরূপ হেলদোল নেই তার মাঝে। এবার ভারিক্কি আওয়াজ ছুড়লো তুষার। অনুভূতিহীন গলায় বলে উঠলো,
— আই থিংক তোমার গান ট্রেনিং এর সময় হয়ে গিয়েছে এবার। টমেটো বাস্টার্ডটা গা ঢাকা দিয়ে রাশিয়া ফিরেছে। শিকার পায়ে হেটে যমের দুয়ারে এসেছে এবার তোমার প্রতিশোধের পালা ফ্লোরা। আমি জানি তুমি পারবে।
এবারও নৈঃশব্দ্য। প্রত্যুত্তরের প্রয়াসে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে কপাল গোছালো তুষার। দু’কদম এগিয়ে এসে গলা চিঁড়ে ডাকলো ফের,
— ফ্লোরাআআ!
তন্দ্রাচ্ছন্ন মেয়েটা একটু নড়েচড়ে উঠলো এবার, যার দরুন হাঁটুসম ফ্রকের আবরণ সরে হুট করেই দৃশ্যমান হয়ে উঠলো মোম নরম ফর্সা তুলতুলে উরুখানি। সেদিকে দৃষ্টি পরতেই অজান্তে শুষ্ক ঢোক গেলে তুষার। জিভের ডগায় অধর ভিজিয়ে ছোঁড়ে কর্কশ বাক্য,
— এই মেয়ে এতো বেখেয়ালি কেন? তখন থেকে ডাকছি তাও এতো কিসের ঘুম? আশ্চর্য!
কথা বলতে বলতেই ফ্লোরার জামাটা টেনে দিতে হা বাড়ালো সে। খরখরে পুরুষালি হাতটা ত্বকের সংস্পর্শে যেতেই আচানক ঝটকা খেলো একপ্রকার ।অভিব্যক্তিতে ধরা দিলো কৌতুহল। নিজেকে আস্বস্ত করার জন্য আরও একবার হাত নিয়ে রাখলো মেয়েটার উন্মুক্ত পায়ে। হ্যা ঠিকই ধরেছে, মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা শরীরে। জ্বরের তোড়ে ঝলসে যেতে চাইছে যেন শীর্ণকায় দেহখানা। এতোক্ষণে মুখাবয়ব শক্ত হয়ে এলো তুষারের, দাঁতে দাঁত পিষে কঠোর আওয়াজ ছুড়লো সে ,
— তোমার জ্বর এসেছে, আমাকে কেন বলোনি?
নীরব বিপরীত পক্ষ। জবাবের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকলো না তুষার,টেনেটুনে উঠিয়ে বসালো মেয়েটাকে। জ্বরে ঢুলুঢুলু তার দু’নয়ন, প্রকম্পিত সর্বাঙ্গ, চেহারার গোলাপি আভায় টান পরেছে বেশ, হয়ে উঠেছে ফ্যাকাসে বর্ণ। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরে কাতরাচ্ছে মেয়েটা, ঠিক মতো বসে থাকার জো নেই, অগত্যা তাল সামলাতে না পেরে মাথাটা গিয়ে ঠেকলো তুষারের সৌষ্ঠব কাঁধের অগ্রভাগে।
ভাবাবেগে কোনোরূপ হেলদোল দেখা গেলোনা যান্ত্রিক মানবের। মানুষটা না তো বিরক্ত আর না পুলকিত, আর অন্তর্ভেদী দৃশ্য উপরওয়ালা ব্যাতীত কেবল সেই পড়তে পারে এখন ।
ফ্লোরার মাথাটা টলছে, জ্বরের তাড়নায় একাকী বিড়বিড়াচ্ছে সে। আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে ওর ভারসাম্যহীন মাথাটাকে ভালো মতো কাঁধের উপর ঠায় দিলো তুষার, ভারী দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার বুক চিঁড়ে। নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে ধ্বনিত হলো ভঙ্গুর পুরুষালি কন্ঠস্বর,
— তুমি ঠিক নেই ফ্লোরা, তোমার ভেতরটা ঠিক নেই। আমি হয়তো এতোদিন বুঝতে পারিনি, তাই বলে নিজেকে এভাবে শাস্তি দিবে?
“শাস্তি” শব্দটা শুনতেই জ্বরের ঘোরে প্রত্যুত্তর করে ফ্লোরা,
— আমি শাস্তি দিতে চাইতো ওই নরপশুটাকে। খুব খুব শাস্তি দিতে চাই। কিন্তু আমার এইটুকু মনের জোর নেই তুষার। উপরওয়ালা বোধ হয় সবাইকে সব ক্ষমতা দিয়ে পাঠায় নি পৃথিবীতে। তেমনি আমাকে মনের জোর দেইনি।
— কে বললো তোমার মনের জোর নেই?
— মন বললো।
— আমি বলেছি কখনো ? তুমি তো বলো, আমি ব্যতিত অন্য কাউকে বিশ্বাস করোনা। তাহলে আজ হঠাৎ মনের কথায় আস্বস্ত হতে গেলে কেন?
তুষারের নিরেট কন্ঠস্বর। নিজেকে সামলানোর প্রয়াসে এবার দু’হাতে মানবের বাহুখানি আঁকড়ে ধরে রমণী। অবচেতন ঘোরে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,
— নেই তো, একটুও মনের জোর নেই আমার।
সুর বদলালো কন্ঠের, পরিনত হলো ভঙ্গুরতায়। ক্রন্দন গিলে গিলে বলতে লাগলো ফ্লোরা,
— জানেন, ওই বিভৎস রাতের পর কতবার ম’রতে গিয়েছিলাম আমি?
তুষার বিস্মিত হয় বটে, তবে আপাতত নিরুদ্বেগে না সূচক মাথা নাড়ায় সে। ফ্লোরা জানায়,
— অজস্রবার। আমি অজস্রবার ম’রতে চেয়েছি তুষার, যখনই মৃ’ত্যু নিশ্চিত জেনে শেষ পরিনতির দারপ্রান্তে পৌঁছেছি, তখনই মনে হয়েছে আপনার কথা। বারবার আপনার এই সুদর্শন মুখটা ভেসে উঠেছে আমার দু’চোখের পাতায়।
কথা বলতে বলতে তনু আঙ্গুল গুলো আলগোছে ছুঁয়ে যায় যান্ত্রিক মানবের তীক্ষ্ণ চিবুক। তুষার বাঁধা দেয় না, কেবল শুনে যায়,
— মনে হয়েছে আমি না থাকলে কে এতো যত্ন নিবে আপনার? কে খেয়াল রাখবে সবকিছুর? আপনি যে বড্ড খুঁতখুঁতে। রোদে শুকানো জামাকাপড় ছাড়া একদম পড়তে পারেন না। আমি না থাকলে ওই হাঁটুসমান বরফ পেরিয়ে কে শুকাতে দিবে আপনার জামাকাপড়? আমি ছাড়া অন্য কেউ তো এতোটা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না এখানে।
রমণীর সরল মস্তিষ্কে বোকা বোকা প্রশ্নের সমাহার, অথচ এই কথাগুলো মোটেই বোকামি ঠেকলো না তুষারের নিকট, বরং এক মূহুর্তের জন্য ভাবনায় পরে গেলো সে,
— সত্যিই তো ফ্লোরা এতোটা যত্ন না নিলে কি হতো আমার?
ফের রুশকন্যার তন্দ্রাচ্ছন্ন বাক্যে ধ্যান ভাঙে তুষারের।
— জানেন তুষার! আমি তবুও ম’রে যেতাম। এই অপবিত্র শরীরটাকে জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। কিন্তু ওই যে বললাম মনের জোর নেই। আপনাকে অতো বড় সত্যির মুখোমুখি একা ফেলে রেখে আমি কি করে চলে যাই বলুন তো? সেই সাহস যে আমার নেই। এই সত্যিটা কোনোদিন ঘুনাক্ষরেও সামনে এলে আপনাকে সেদিনই জানে মে’রে দেবে এরীশ। মৃ’ত্যুকে বাজি রেখে এতোটা স্বাভাবিক আচরণ কিভাবে করেন আপনি ? এরীশ একটা ব্লাডিবিস্ট। কোনোদিন সবকিছু জানাজানি হয়ে গেলে সব ধ্বং’স করে দেবে ও।
— আটকানোর সাধ্যও তো তোমার নেই।
তুষারের কন্ঠে অনীহা। ফ্লোরা বলে ওঠে,
— আছে, আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও বাঁচাবো আপনাকে তুষার।
একচিলতে ফিচেল হাসির রেখায় ঠোঁট প্রসারিত হয় তুষারের, নিভু নিভু হ্যাজাকের নরম আলোয় বড্ড ব্যথাতুর দেখালো সেই হাসি। নিজের খরখরে পুরুষালি হাতখানি রুশকন্যার হাতে আবদ্ধ করলো সে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— তুমি ঠিকই বলেছো, উপরওয়ালা সবাইকে সবকিছু দিয়ে পাঠায় না। এই যেমন তোমার মতো সরল একটা হৃদয় দেয়নি আমাকে। দিয়েছে ধ্বংসের দাবালনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাওয়া এক বিষাক্ত কলুষিত অন্তর। এই সরলতা তোমার আশির্বাদ ফ্লোরা । আমি চাইনা তুমি বদলে যাও। নিজের মাঝের ইন্সোসেন্সি টুকু সারাজীবন ধরে রাখো, অন্তত আমার জন্য হলেও। আমি না হয় নৃ’শংস হবো। তোমার হয়ে গড়ে তুলবো প্রতিরোধ ।একাই নিয়ে নিবো সব অনর্থের প্রতিশোধ।
বেঘোরে জর্জরিত ফ্লোরা, নিজের স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে বহুদূরে তার অবস্থান। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি ক্ষীণ, তবুও তুষারের শেষ বাক্যখানা শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করতেই চোখ তুলে চাইলো সে। নিজের অবচেতন বিবেক দ্বারা অনুধাবন করতে চেষ্টা করলো কথা গুলোকে। এটাই তো সেই তুষার, যে কিনা দুনিয়ার সবটুকু ক্রোধ ফ্লোরার পানে নিক্ষিপ্ত করে বলেছিল,
— মাফিয়া পেন্টহাউজে ইনোসেন্সির কোনো স্থান নেই, এখানে থাকতে গেলে নির্দয় হতে হয়, মনুষত্ব্যকে পায়ে মারাতে হয়। নিজেকে বদলাও ফ্লোরা,ভেঙে ফেলো এসব সরলতার খোলস।
অথচ আজ নিজের দ্বায়ে এই সামান্য জিনিস টুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে লোকটা। নিজেকে স্থির করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে ফ্লোরা, কিছুতেই পারছে না সেটি, সমানে টলছে তার মাথা, অস্ফুট দৃষ্টি জুড়ে ভেসে আছে তুষারের ঝাপসা মুখাবয়ব, বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন থমথমে তার অভিব্যক্তি।
সুদর্শন মুখটার পানে দৃষ্টি স্থির রাখার চেষ্টা চালাতে চালাতেই ভেজা গলায় প্রশ্ন ছোঁড়ে মেয়েটা,
— আমরা কোনো প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ নই। তাহলে আপনি কেন আমার হয়ে প্রতিশোধ নিতে যাবেন তুষার!
— তুমি চাইলে আমি তাতেও রাজি।
মূর্তিমান তুষার। জ্বরটা বোধ হয় হু হু করে বাড়ছে এবার। যার দরুন অকারণে খিলখিলিয়ে হাসে ফ্লোরা। খানিক যেতেই আবার মুখ কালো করে ফেলে অতর্কিতে, ইন্দ্রিয়ের শেষ চেতনাটুকু ধরে রেখে স্বগোতক্তিতে আওড়ায়,
— সময় বদলে গিয়েছে তুষার, আমি আর আগের মতো নেই। এই যে সুন্দর শরীরটা দেখছেন, বাঁকানো কোমর,ধনুকের মতো তীক্ষ্ণ নারী দেহ, ঢেউ খেলানো দু’টো কামুক কবুতরি চূড়ো , সব সবকিছু কলুষিত। পুরো শরীর জুড়ে বিশ্রী স্পর্শের ছড়াছড়ি। পা থেকে মাথা অবধি পুরোটা অপবিত্র। কোন সাহসে তবে আমি আপনাকে ভালোবাসবো বলুন তো?
মেয়েটার কথা শেষ হতেই বিদ্রুপাত্তক হাসলো তুষার, যেন ফ্লোরার দুঃখের কাহিনি শুনে বেশ মজাই পেয়েছে সে, তেমন করেই বললো,
— কার সামনে তুমি নিজেকে অপবিত্র দাবি করছো ফ্লোরা? এই আমার সামনে? একটা দূধর্ষ গ্যাংস্টারের সামনে? তুমি কি আদৌও জানো আমার এই দু’টো হাতে কত শত নির্দোষের র’ক্ত লেগে আছে? হতে পারে তুমি আপাত দৃষ্টিতে কলুষিত, কিন্তু আমার পুরো অস্তিত্বটাই অনিষ্ট অপবিত্র ।
ওর বুকের কাছে মাথা ঠেকিয়ে আনমনে ঝিমাচ্ছে ফ্লোরা। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে নাস্তানাবুদ,ব্যাপারটা অনুমান করে ফের স্বগোতক্তিতে বাক্য উগড়ে দিলো তুষার, শীতল অথচ গভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
— তোমাকে তাও ভালোবাসার জন্য দাদী রয়েছে। আমার জন্য তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই ফ্লোরা।
তুষার মুখ ফুটে তাকে ভালোবাসার আর্জি জানিয়েছে, তার ভালোবাসা পেতে চাইছে, এই অবিশ্বাস্য সত্যিটা আদৌও ফ্লোরার কর্ণগোচর হলো কিনা কে জানে?
ওদিকে অজ্ঞাত তুষার, কোনোদিন হয়তো জানতেও পারবে না, শুধু মাত্র ফ্লোরা নয়, আরও একজন রয়েছে। যে কিনা পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে বসে দিনরাত ছটফট করে চলেছে তাকে একতরফা ভালোবাসার বিষণ্ন যাতনায়। তার নাম নিঝুম!
ভেতরের সুপ্ত অবিন্যস্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হুট করে এভাবে হয়ে যাবে সেটা বোধ কস্মিনকালেও প্রত্যাশা করেনি তুষার। ও তো কেবল ফ্লোরাকে ধাতস্থ করতে চেয়েছিল একটুখানি , তার ভালোবাসা তো চায়নি। তাহলে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এমন ভাবাবেগ? নিজের বাক্যে নিজেই বাকরুদ্ধ তুষার,প্রকম্পিত তার বক্ষস্থল, অগত্যা কক্ষ জুড়ে বহুক্ষণ নৈঃশব্দ্য।
ফ্লোরা মূর্ছা গিয়েছি পুরোপুরি, জ্বর তার বিপদসীমার উপরে। ওর এহেন জ্ঞান হারানো দেখে ভাবনায় লাগাম টানলো তুষার, পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় দিশেহারা হয়ে উঠলো তার শান্ত সাবলীল মস্তিষ্কটা। মেয়েটাকে আলগোছে বিছানায় শুয়িয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলতে লাগলো ,
— কতবার বারণ করেছি ঠান্ডা না লাগাতে, নিজেকে স্নোফ্লেক্স ভাবা হচ্ছে, কথা নেই বার্তা নেই যখন তখন গিয়ে বরফে ঝাপ দিচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই জ্বরে পুড়তে শান্তি লাগছে ?
নিস্তব্ধ বিপরীত প্রান্ত। দুশ্চিন্তা হটাতে চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুষার, মনেমনে ভাবতে থাকে কি করা যায় এখন। কান্ট্রিসাইডের প্রত্যন্ত এলাকা এটি। আশেপাশে ডাক্তার তো দূরে থাক কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে বসতি ও নেই কোনো। তারউপর মাঝরাত, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে তুষারপাত। ওদিকে এভাবে জ্বরে কাতরাতে থাকলে সকাল হতে হতে হাইপারথার্মিয়া এ্যাটাকে মৃ’ত্যু নিশ্চিত মেয়েটার।
এখন একমাত্র ভরসা ইন্টারনেট। সেটাই আপাতত কাজে লাগাতে চেষ্টা করলো তুষার। সার্চ করলো শরীরের তাপমাত্রা কমার উপায়,
আইপ্যাড স্ক্রিনে প্রথমেই যেই পরামর্শটা ভেসে উঠলো সেটা হলো বেশি বেশি শরীর মুছিয়ে দেওয়া। যা দেখা মাত্রই চোখ কপালে উঠে গেলো তুষারের। সুতীব্র অসন্তোষে নিঃশব্দে বিড়বিড়ালো সে,
—শীট! এটা আমি কিভাবে করবো? অসম্ভব!
বিরক্ত হয়ে আইপ্যাড বন্ধ করতেই নজর পড়লো ফ্লোরার চেতনাহীন আদুরে মুখটার পানে। পুতুলের মতো সাজানো বদনে ফ্যাকাসে বর্ণের ছাঁপ সুস্পষ্ট। চঞ্চল মেয়েটার এহেন নির্জীবতা দেখতে ভালো লাগছে না মোটেই।
মস্তিষ্কের দ্বিধাদন্দে পুরোপুরি স্তম্ভিত তুষার, সিদ্ধান্ত নিলো ও এই কাজটা করবে। অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে কমিয়ে দিলো হ্যাজাকের রোশনাই। অতঃপর কাপড় ভিজিয়ে এনে তৎপর হলো মুছিয়ে দেওয়ার কাজে। তমশাচ্ছন্ন চারিপাশ, রমণীর শীর্নকায় তনুখানি মানবের হাতের মুঠোয়, শরীরের সর্বস্থরে তার সংকুচিত বিচরণ, মাঝ ত্রিশের তাগড়া যুবক তুষার, তুলতুলে কোমল শরীরের সংস্পর্শে একটুও কি অনুভূতি প্রবণ হয়নি তার সত্তা? হয়েছিল বোধ হয়, কিন্তু সে পাত্তা দেয়নি। বরং কলুষতায় নিমজ্জিত শরীরটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার স্বকীয়তা। প্রতিটি পদে পদে বুঝিয়েছে সব স্পর্শ লালসার নয়, কিছু কিছু স্পর্শ দ্বায়িত্বের ও হয়।
রয়্যাল ক্যারাভিয়ান, বাংলাদেশ।
মাফিয়া বসের বিলাসবহুল সুবিশাল কামরায় নান্দনিক এক ফুল লেন্থ মিররের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে ভেসে উঠেছে এক অপ্সরীসম নীলনয়নার প্রতিবিম্ব। গাঢ় স্মোকি আইয়ের মাঝে দীপ্তিমান তার নীলাভ মনিজুগল। যার দরুন আগের চেয়েও বেশি জ্বলজ্বলে আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে চোখ দু’টো। সুশ্রী মুখাবয়ব জুড়ে হালকা ব্লাশের টাস-আপ।ফিনফিনে কোমল ওষ্ঠজোড়া শোভিত হয়েছে ন্যুডশেড লিপস্টিকিকের গাঢ় প্রলেপের আস্তরে ।খালি গলা, দু’টো চকচকে ক্রিস্ট্যাল পাথরের দুল পরে আছে শুধু কানে। চুলে করা হয়েছে সাইড সোয়েপ্ট কার্লসের মানানসই হেয়ারস্টাইল।
পরনে তার কালোরঙা সাটিনের অফ শোল্ডার ইভিনিং গাউন। পুরোটা জমিন জুড়ে আছে ব্ল্যাক সিকোয়েন্সের অসাধারণ কারুকাজ। কাপড়ের নমনীয়তা ভীষণ।এক লহমায় গায়ে মিশে যেতে চাইছে যেন। রমণীর নির্মেদ কোমরের বাঁক ছাড়িয়ে একপাশ তার নেমে এসেছে পায়ের পাতায়। ঠিক তার অন্যপাশে হাঁটু ছাড়িয়ে অনেকটা উপর পর্যন্ত থাই হাই-স্লিট। যার দরুন পুরোপুরি অনাবৃত হয়ে আছে উরু থেকে শুরু করে পায়ের একাংশ । রাজহংসীর ন্যায় গমরঙা ফর্সা ত্বক। মোম নরম কোমল পা জুড়ে আলো পিছলানো দ্যুতি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চার ইঞ্চিসম ব্ল্যাক স্টিলেটো, যদিও এই জুতো পড়ে আদৌও হাঁটতে পারবে কিনা সন্দিহান ঈশানী।
নিস্প্রভ দৃষ্টে আয়নার প্রতিবিম্বের সঙ্গে নিজ সত্তাকে মেলাচ্ছিল ঈশানী। এটা কি আসলেই ও। যাকে সারাজীবন ঘরকুনো, নির্জীব, ক্লোড, অপয়া ইত্যাদি উপাধি দেওয়া হতো। কই চেনা তো যাচ্ছে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী একটা আত্নবিশ্বাসী মেয়ে সেজেগুজে একেবারে অপ্সরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আয়নার সামনে।কতটা সুনিপুণ তার সর্বাঙ্গ,কতটা আকর্ষনীয় তার নারীদেহের প্রতিটি ভাঁজ, যে কেউ দেখলে ব্যাকুল চিত্তে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য।
এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে নিজের আপাদমস্তক পরখ করতে থাকে ঈশানী, তন্মধ্যে দৃষ্টি স্থাপিত হয় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষালি অবয়বটির উপর। লম্বা চওড়া পেশিবহুল যান্ত্রিক শরীরটা দাঁড়িয়ে আছে স্থির। শূন্য ধূসর বাদামী নেত্রদ্বয় তার ঈশানীতে নিবদ্ধ। দৃষ্টির প্রখরতা যেন আয়না ভেদিয়ে সোজা গিয়ে বিদ্ধ হয় রমণীর নাজুক অন্তর। মোহাবিষ্ট নয়ন দু’টি জাগ্রত করে ভোঁতা অনুভূতির। হৃদয় তোলপাড় করা অস্থিরতায় মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায় মেয়েটার। আয়না ভেদ করে সে তাকায় মরিচীকার পানে।
ব্ল্যাক সিল্ক শার্টের সঙ্গে হুগো বসের স্টাইলিশ স্যুটটাতে অবর্ণনীয় সুদর্শন লাগছে তাকে। ব্যাক ব্রাশকৃত আন্ডারকাট পলিশড চুলগুলো থেকে একগুচ্ছ এসে নির্লিপ্তে জড়ো হয়েছে চওড়া কপাল জুড়ে,একপাশে তার পিয়াসর্ড করা আইব্রো বারবেল। অধর তলার কুচকুচে কালো তিলকটাও আজ জ্বলজ্বল করছে আপন সত্তায়, যেন নির্দয় মানুষটার সৌন্দর্যে এতোটা মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্যই তার এহেন সুনির্দিষ্ট অবস্থান।
লাজে আড়ষ্ট রমণী,অথচ তার নির্লজ্জ চোখ দু’টো ঘুরেফিরে স্থির সেই ছোট্ট তিলকের ওপর। যেন অদৃশ্য এক চৌম্বকীয় আকর্ষন তাতে।
— লুকিয়ে দেখার কিছু নেই, আমি এখানেই।
সুপরিচিত রাশভারি কন্ঠস্বর ভেসে এলো পেছন থেকে । তৎক্ষনাৎ ধরা পরে যাওয়ার মতোন চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো ঈশানী। কয়েক দফা শুষ্ক ঢোক গিলে ধীরে ধীরে ঘুরলো পেছনে। এরীশ ওর থেকে বেশ লম্বা, তাই মাথাটা খানিক উঁচিয়ে শুধালো,
— কেমন লাগছে আমাকে?
নির্বিকার এরীশ ইউভান। প্রশংসা করতে জানেনা মাফিয়া বসটা। তার দু’চোখে তৃষ্ণার জোয়ার। কক্ষজুড়ে নৈঃশব্দ্য বিরাজমান, কেবল ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু আওয়াজটুকু জানান দিচ্ছে কিছু নিষিদ্ধ অনুভূতির । নীরবতা ভেঙে ঈশানী ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই আচানক ওর ওষ্ঠদ্বয়ের উপর হামলে পরে একজোড়া শুষ্ক পুরুষালি ওষ্ঠপুটের অতর্কিত আ’ক্র’মন।
গতি হারায় হৃৎস্পন্দন। নিয়ন্ত্রণহীন, বন্য, বেসামাল গভীর স্পর্শে অচিরেই শ্বাসরোধ হয়ে আসে মেয়েটার। স্পর্শের গভীরতা প্রগাঢ় হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে, কোমল ঠোঁটের নমনীয়তা ছাড়িয়ে মুখগহ্বর জুড়ে ঘটে পুরুষালি অধরের উন্মাদিত বিচরণ । যেন স্নিগ্ধ সাকুরার মাঝেই মরীচিকা খুঁজে ফেরে তার আপন অস্তিত্বকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোপুরি স্তম্ভিত ঈশানী। বরফ খন্ডের ন্যায় জমে আছে তার নাজুক অন্তর, যার দরুন লোপ পেয়েছে বাকশক্তি।
— কিস মি ব্যাক লাভ!
উন্মাদনায় মত্ত পুরুষালি কণ্ঠস্বরটা কর্ণকূহর অবধি ধ্বনিত হতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে ঈশানী। অস্থির হাতে ঠেলেঠুলে নিজের থেকে সরায় লোকটাকে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
— এটা কি করলে ? তিন তিনজন মেকআপ আর্টিস্ট মিলে সেই সকাল এতো কষ্ট করে সাজালো আমাকে, আর তুমি দু’মিনিটে সব নষ্ট করে দিলে?
ঠোঁটের চারপাশে অবিন্যস্ত লিপস্টিকের প্রলেপ। এরীশের ঠোঁটেও লেপ্টে আছে খানিক, সে বৃদ্ধাঙ্গুলির ডগা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— তোমাকে এতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, কারণ আমি নষ্ট করবো তাই।
— কিহ!
বিহ্বলিত নয়ন জোড়া কুঁচকে গেলো মেয়েটার। ফের একই উদ্যমে ধ্বনিত হলো,
— তোমার সাজগোজের উদ্দেশ্য একটাই আমার হাতে সেগুলো নষ্ট হওয়া। এর বাইরে কোনো তৃতীয় উদ্দেশ্যে সাজা প্রযোজ্য নয় তোমার।
— এটা কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয়।
— আমি যে ভদ্রলোক কে বললো তোমায়?
— জানোয়ার!
বিরক্তিকর শব্দটা উচ্চারণ করে হাফ ছাড়ে ঈশানী , মুখ কালো করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
— মেকআপ আর্টিস্ট গুলো কত কষ্ট করেছে সকাল থেকে।
— ওদের কাজই এটা, কষ্ট করে আমার জন্য তোমাকে রেডি করানো।
শেষ বাক্যটুকু উগড়ে দিয়ে এক লহমায় মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো এরীশ। সবসময়ের মতো আজ আর কাঁধে তুলে টানাহেঁচড়া করেনি সে। খানিক দয়া দেখিয়ে সন্তোর্পনে আগলে নিয়েছে বুক পাঁজরে। অতঃপর কোনোরূপ বাক্য খরচ না করেই শান্ত ধীরস্থির কদমে ঈশানী সমেত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।
ক্রুজশীপে এলিভেটরের ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও সিঁড়ি ভেঙে ঈশানীকে নিয়ে টপ ডেকে এসেছে এরীশ।
খোলা আকাশের অস্তিত্ব অনুভূত হতেই মেয়েটাকে কোল থেকে নামায় মাফিয়া বস।
নিচে নামতেই বিস্ময়ে ফেটে পড়ে ঈশানী। বিহ্বলতায় আপনাআপনি ফাঁক হয়ে যায় তার অধরযুগল, দু’হাত গিয়ে পৌঁছায় মুখের উপর। বিস্ফারিত নয়ন মেলে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে ঘুরে অবলোকন করতে থাকে সে চারিদিক। পুরো জায়গাটাকে সান ডেক নয় বরং মনে হচ্ছে কোনো চেরিব্লোসমের স্নিগ্ধ বাগান। ল্যাভেন্ডার রঙের ফুল ভর্তি গাছ আর পাপড়ি দিয়ে ভর্তি জায়গাটা। পায়ের নিচে মখমলের মতো বিছিয়ে রয়েছে অজস্র চেরিফুল। এ যেন মহাবিশ্বের উর্ধ্বে কোনো রঙিন ফুলের দুনিয়া। মৃদু সুবাসে আত্মা প্রসিদ্ধ হয়, ক্লান্ত দু’চোখ জুড়িয়ে আসে ঈশানীর।
অতৃপ্ত দৃষ্টে চারিপাশে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতেই অবিশ্বাস্য স্বরে বলে ওঠে মেয়েটা,
— এটা কিভাবে সম্ভব!
কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকায় মাফিয়া বস, স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ায়,
— মানি ইজ পাওয়ার বেইব।
বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে মেয়েটার। নিজেকে খানিক ধাতস্থ করে কিছু বলতে গিয়ে টের পায় খুশিতে গলা ধরে এসেছে ওর। তরলশূন্য কণ্ঠতালু। ফলস্বরূপ কয়েকদফা শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে স্থির করে রমণী, অতঃপর দৃষ্টিপাত করে মাফিয়া বসের পানে।
অনুভূতির ছিটেফোঁটাও নেই তার দু’চোখে। অথচ ওই ধূসর-বাদামী গহ্বরের মাঝেই হাজারো অব্যক্ত অনুভূতির ঠিকানা খুঁজে ফেরে ঈশানী। আবেগের তুফানে ভঙ্গুর হয়ে এসেছে গলার স্বর, টলমলে তার অক্ষিদ্বয়। দৃষ্টি অবিচল রেখেই নাক টেনে শুধায়,
— চেরিব্লোসমের কথা তুমি কি করে জানলে?
— আমি সব জানি।
— কিন্তু বাংলাদেশে, তাও আবার ক্রুজশীপের উপর, এটাতো অসম্ভব এরীশ!
প্যান্টের পকেটে দু’হাত আবদ্ধ করে দু’জনার মধ্যবর্তী দূরত্ব কমিয়ে আনলো এরীশ, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার পছন্দ হয়েছে?
— খুউউব।
— আজ রাতটা তোমার। তাই সবকিছু তোমার পছন্দ মতোই হবে। যা চাও তাই পাবে। এ্যানিথিং ইউ ওয়ান্ট!
আরেক দফা বিস্মিত হলো ঈশানী, অগত্যা ধ্বনিত হয় বিহ্বলিত কণ্ঠস্বর,
— আজ রাত আমার কেন?
কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলো না মাফিয়া বস। উল্টো জানালো চেরিব্লোসমের রহস্য,
— পেট্যাল(পাপড়ি) গুলো পিজার্ভ করে আনানো হয়েছে জাপান থেকে, আর বাদবাকি যা দেখছো এগুলো আর্টিফিশিয়াল।
ঈশানী আর কথা বাড়ালো না, চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে বসলো পুল ডেকের উপর। ফেইরী লাইটের মৃদু রোশনাইয়ের সাথে রাতের আধার মিশে তীর্যক আলোছায়া খেলা করছে পুলের স্বচ্ছ নীল জলের উপর। আপাতত মনোযোগ তার সেদিকে স্থির। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন, চারিদিক গুমোট, শেষ রাতে কালবৈশাখী হলেও হতে পারে।
কয়েক মূহুর্ত বাদেই নিজের সংস্পর্শে এরীশের উপস্থিতি টের পায় ঈশানী। ওর পাশ ঘেঁষে বসেছে একদম। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই প্রশ্ন ছোঁড়ে এরীশ,
— আজ থেকে বছর খানিক আগে, যখন তুমি চিটাগং এ থাকতে, সেসময় কোনো এক বৃষ্টির রাতে অজ্ঞাত এক ফোনকলে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তোমার।
মূহুর্তেই হতচকিত হয়ে ওঠে ঈশানী। তৎক্ষনাৎ ছোঁড়ে কৌতুহলি প্রশ্ন,
— তুমি কি করে জানলে?
— কারণ ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা আমিই ছিলাম।
মাফিয়া বসের নিরেট কন্ঠস্বর। নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে ঈশানী। জিজ্ঞেস করে,
—কেন কল করেছিলে?
— তোমাকে ম্যানিউপুলেট করার জন্য, আমি ভেবেছিলাম কিছুটা এফোর্ট দিলেই তুমি আমার ফাঁদে পা দিবে। কিন্তু যখন কল করলাম তখন বুঝতে পারলাম, তুমি অলরেডি আমার জন্য দিওয়ানা হয়ে আছো।
— আর তুমি সেই সুযোগটাই কাজে লাগালে, তাইতো?
নিমেষেই অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে ছেয়ে গেলো চারিপাশ। এরীশ ভাবতে চায় না ওই দিন গুলোর কথা, জাগ্রত করতে চায় না সেসব স্মৃতিগুলোকে। পেন্টহাউজের বিভৎস অতীত, যা ওরা দু’জনেই পেছনে ফেলে এসেছে।
যখন কিনা ও নিজের সাকুরাকে জানোয়ারের মতো আ’ঘাত করেছে মানসিক, শারীরিক এমনকি আত্মিক। এখন সেসব ভাবলে প্রতিমূহুর্তে অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে ওঠে পাষাণ হৃদয়।
ভবঘুরে ঈশানী ফের শুধায়,
— আচ্ছা, সেই রাতে আমি কি বলেছিলাম তোমায়?
বিস্তৃত আকাশের পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এরীশ। আকাশটা ঘুটঘুটে কালো ঠিক ওর জীবনের মতোই। প্রত্যুত্তর করে,
— বলেছিলে, ভুলতে পারছো না কিছুতেই, তুমি আমাকে আবার দেখতে চাও।
— আর তুমি কি উত্তর দিয়েছিলে ?
— আ’ম নট দ্যা প্রিন্স অফ ইউয়োর ফেইরীটেল, আ’ম দ্যা মনস্টার অফ ইউয়োর নাইটমেয়ার। এটাই।
অভিমানে বুক ভার হয়ে আসে ঈশানীর, চোখের কোটর ছাপিয়ে নিপতিত হয় একফোঁটা তপ্ত নোনাজল। হৃদয় জুড়ে উথলে ওঠে পুরোনো ব্যথারা, বেড়িয়ে আসে ক্রন্দিত কন্ঠস্বর,
— তুমি আমাকে একটা প্রস্টিটিউড বানাতে চেয়েছিল এরীশ। সেদিন যদি সত্যি সত্যি ওই বিশ্রী হাত গুলো আমাকে ছুঁয়ে ফেলতো….
— থামো!
বাক্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই ওকে জোরপূর্বক থামিয়ে দিলো এরীশ।
— প্লিজ!
মাফিয়া বসের কণ্ঠে আকুতি। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে তার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— তোমার কথাগুলো বিষাক্ত তীরের মতো বিদ্ধ করছে আমার হৃদয়টাকে। ভেতরে যে র”ক্তক্ষরণ হচ্ছে টের পাচ্ছো না?
— আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারিনি এরীশ ইউভান। এতো কিছুর পরেও মনটা বেইমানি করেছে আমার সঙ্গে, সে তোমাকে চায়। একটা অনুভূতিহীন নির্দয় লোকের জন্য সে পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন আজ।
ঈশানীর কথা শেষ হতেই অকস্মাৎ আকাশে ভেসে ওঠে বিস্ময়কর ড্রোনের কারুকাজ। অতর্কিতে চোখ ঘোরায় রমণী। দেখতে পায় একে একে জড়ো হতে থাকা অসংখ্য ড্রোনের সমাগম। অজ্ঞাত রমণীর সবটুকু মনোযোগ এক নিমেষে কেড়ে নেয় সেগুলো। যার দরুন
দু’জনার মাঝে বিরাজমান অদৃশ্য বিষন্নতাটুকু হুট করেই ধামাচাপা পরে যায় বিস্ময়ের অন্তরালে। অস্থির চিত্তে এরীশের সৌষ্ঠব পুরুষালি বাহুখানি আঁকড়ে ধরে ঈশানী। অবিশ্বাস্য কন্ঠে শুধায়,
— এটা কি হচ্ছে এরীশ!
উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হলোনা এরীশের, তার আগেই অমানিশার আকাশ জুড়ে ভেসে উঠলো জ্বলজ্বলে কিছু ইংরেজি অক্ষর,
” happy birthday
Sakura”
ঠিক তার নিচেই ঈশানীর আপাদমস্তক প্রতিবিম্ব। যেখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চুরিদার পরিহিত নৃত্যরত ঈশানীকে।
— এটা তো আমি! এরীশ এটা আমি!
অক্ষিপুট বুঁজে সায় জানালো এরীশ,
— এটা তুমিই।
— কিন্তু তুমি কি করে জানলে আজ আমার…
কথা বলতে বলতে গ্রীবা ঘোরাতেই থমকে গেলো ঈশানী। ওর চোখের সামনে একটা বড়সড় চাবির রিং বাড়িয়ে রেখেছে এরীশ। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে, হারিয়ে ফেলার অদম্য ভয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। ঈশানী আর অবাক হতে চায় না, একটু ও না। তাই মুখাবয়ব সাবলীল রেখে কিঞ্চিৎ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শুধালো,
— এটা কি এরীশ!
— তোমার স্বপ্ন, কর্ণিয়া ক্যাফে।
মাত্রা ছাড়ালো অবিশ্বাসের, কিন্তু এবার খুশি হতে চেয়েও পারলো না মেয়েটা। বেসামাল হয়ে ভেঙে পরলো অসহনীয় কান্নায়। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা, দু’চোখে তার আবেগের প্লাবন। কি করা উচিৎ, কি বলা উচিৎ সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতার বিষাদ ছাড়িয়ে এ কোনো দুনিয়ায় পা রাখলো ঈশানী? সবকিছু কেমন অকল্পনীয়। এতো আদর, এতো সুখ সইবে তো ওর কপালে?
ওদিকে ঈশানীর এহেন ব্যথাতুর কান্না দেখে মূহুর্তেই মাথায় র’ক্ত চড়ে গেলো এরীশের। দু’চোখে জড়ো হলো অতর্কিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষুব্ধতায় আচানক মেয়েটাকে হ্যাঁচকা টানে ফেলে দিলো ডেকের উপর। পরপরই শরীরের সমস্ত ভর ওর উপর ছেড়ে দিয়ে বলিষ্ঠ হাতে আবদ্ধ করলো সরু কব্জি দু’টো। দাঁতে দাঁত পিষে ছুঁড়লো ধারালো কন্ঠস্বর,
— কাঁদছিস কেন তুই? বল কাদছিস কেন? এতো কিছু করেছি আমি তোর কান্না দেখার জন্য ? হোয়াই আর ইউ ক্রাইং লাইক দিস! ফাক!
অন্তরের তাড়নায় মেয়েটাকে সমানে ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে এরীশ।ক্রন্দনরত ঈশানী মুখ খুললো এবার, এরীশকে থামানোর প্রয়াসে বললো,
— আ.. আমার ভয় করছে অরণ্য, খুব ভয় করছে। আজকের রাত, এই অকল্পনীয় মূহুর্তগুলো সবকিছু যদি মিথ্যে হয়ে যায়, তুমি যদি আবারও আমাকে ঠকাও, সবটাই যদি তোমার নতুন কোনো নৃ’শংসতার কৌশল হয়। তাহলে আমি ম:রে যাবো অরণ্য, বিশ্বাস করো সত্যিই ম’রে যাবো। বাস্তবতার এমন এক টানাপোড়েনের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছি, আমার আর ফিরে যাবার কোনো পথ খোলা নেই।
নিরুত্তর মাফিয়া বস। ঈশানীর এতো গভীর আকুতি শুনেও কোনোরূপ পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় হলো না তার নির্জীব অভিব্যক্তি জুড়ে। মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে অহর্নিশ। ওর হাঁপড়ের মতোন বুকের ক্রমাগত ওঠনামায় নাজেহাল এরীশ। তার ইস্পাত কঠিন বক্ষমাঝে পিষে রয়েছে রমণীর পেলব নারীদেহখানি।
সে নির্লিপ্তে বুক পকেট হাঁতড়ে বের করলো কিছু একটা, অতঃপর কোনোরূপ পূর্বাভাস ব্যাতিত ঢুকিয়ে দিলো ঈশানীর অনামিকা আঙুলের ভাঁজে। কান্নাকাটিতে ভাটি পরলো এবার। ঈশানী হাত উঁচিয়ে এদিক ওদিকে ঘোরাতে লাগলো আঙুলটাকে।
স্বাভাবিক আংটির তুলনায় বেশ বড়সড় একটা ক্রিস্ট্যাল, যেন অদ্ভুত কোন রহস্য ধারণ করে আছে পাথরটি, হুট করে মনে হচ্ছে এর চাকচিক্যে চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম,আবার হুট করেই কেমন ম্লান হয়ে আসছে দ্যুতি। যেন ঝলমলে রোদের মাঝে একফালি বিষাদের মেঘ। রমণীর ভাবনার মাঝেই আরেকদফা অদ্ভুত কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো এরীশ। একটা শর্ট নাইফ নিয়ে অকস্মাৎ আড়াআড়ি টান মা’রলো নিজ হাতের তালু বরাবর,মূহুর্তেই ফিনকি দিয়ে উপচে উঠলো র’ক্তস্রোত। ঈশানীর চোখ মুখ এমনকি বুকের উপরও ছিটকে পরলো রঞ্জিত তরল। শঙ্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো মেয়েটা, ব্যস্ত হাতে ওর তালুটা চেপে ধরে চ্যাঁচিয়ে উঠলো ক্ষুব্ধতায়,
— আশ্চর্য! মাথা ঠিক আছে আপনার? এটা কি করলেন?
— ওয়েট আ সেকেন্ড।
কথাটা বলেই ঈশানীর অনামিকা আঙুলের উপর নিজের র’ক্তা’ক্ত হাতটা তুলে ধরলো এরীশ। একহাত থেকে অন্য হাতে র’ক্ত গড়ালো চুয়িয়ে চুয়িয়ে। মূহুর্তেই র’ক্তে’র সংস্পর্শে ম্যাজিকের মতো বদলে গেলো পাথরের রং। ধারণ করলো টকটকে রক্তিম বর্ণ।
ঘটনার প্রেক্ষিতে চোখ কপালে উঠে গেলো ঈশানীর। অবিশ্বাস্য সুরে আওড়ালো,
— কি ছিল এটা !
— ব্লাড ডায়মন্ড। এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হলো আমায়।
বাকরুদ্ধ ঈশানী। বিস্মিত নয়নে নিজের আঙুলটাকে পরখ করতে করতে অতি কসরত করে বললো,
— এটাকে পাওয়ার জন্য তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলে এরীশ। তাহলে আমাকে কেন দিচ্ছো?
— এটা মূল্যবান তবে তোমার চেয়ে বেশি নয়।
রমণীর শরীরে আরও খানিকটা ভর ছেড়ে দৃষ্টির মিলন ঘটালো মাফিয়া বস। ঈশানী বললো,
— তাই বলে আমার হাতে?
— পাইথন লিডার রীশস্কার একমাত্র দূর্বলতা তুমি, তাহলে নিজেকে তুচ্ছ ভাবছো কোন সাহসে?
— অথচ তুমি কখনো ভালোবাসি বলোনি।
— সবার মুখে সবকিছু শোভা পায়না। এতে সীন হয়।
চোখ ছোট ছোট করে ফেললো ঈশানী, বললো,
— তুমি কলঙ্কে ভয় পাচ্ছো?
— এরীশ কখনো ভয় পায়না প্রেম আমার। আমি শুধু তোমার পবিত্র সত্তাটাকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করছি।
— তুমিই আমার সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এরীশ ।
— সেটুকু দূর করতে গেলে নিঃশেষ হতে হবে আমায়।
এক মূহুর্ত থমকালো ঈশানী। ধূসর বাদামি চোখ দু’টোতে এক আকাশসম তৃষ্ণা। রমণীর নীলাভ মনিযুগল তাতে হারিয়ে যেতে বাধ্য। নিজেকে সামলালো মেয়েটা,কণ্ঠে অভিমান টেনে বললো,
— তার মানে ভালোবাসো না।
— উহু! আমি অবসেসড।
— তোমার কাছে অবসেশনের ব্যাখা কি এরীশ ইউভান?
— শুধু তুমি।
এতোক্ষণে হার মেনে নিলো ঈশানী। দৃষ্টিতে তার প্রবল মায়া।র’ক্তা’ক্ত হাতদুটো বাড়িয়ে আলতো স্পর্শে আবদ্ধ করলো মাফিয়া বসের খরখরে পুরুষালি কপোল দু’টো । শান্ত নিবিড় অথচ মোহনীয় কন্ঠে জানতে চাইলো,
—
— আর যদি কখনো ম’রে যাই?
এক সেকেন্ড দেরী করলো না মাফিয়া বস, তৎক্ষনাৎ ধ্বনিত হলো তার হাস্কি কন্ঠস্বর,
— নো অফেন্স, আমিও ম’রে যাবো।
রাগী ভুতটা কি বলে এসব। ঈশানী হাসলো নীরবে। ঠোঁট টিপে শুধালো,
— হেয়ালি করছো।
মেয়েটার নীল চোখের মাঝে আপন অস্তিত্বের সন্ধানে মরিয়া এরীশ ইউভান। কাতর অথচ দৃঢ় স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
— এরীশ হেয়ালি করেনা প্রেম আমার।
অতঃপর নৈঃশব্দ্যে কেটে গেলো অনেকগুলো প্রহর। আঁধারের কলুষে ঢাকা ভবিতব্যের গোলকধাঁধাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, দুনিয়ার সমগ্র নিয়মনীতি ভেঙে, শুধু মাত্র অন্তরের প্রবনতায় দু’প্রান্তের দু’টো আত্মা মিলেমিশে একাকার হলো একই মোহনায়।
কেবল সময়ের গতিধারায় হৃদয়ের অতল ছাড়িয়ে বড্ড গহীনে উঁকি দিয়েছিলো সুরের পঙক্তি,
চেহরে সে চেহেরা ছুপাও….
সিনে কি ধারকান সুনাও….
সকালে ঘুম ভেঙে নিজেকে এরীশের মাস্টার বেডরুমে আবিস্কার করলো ঈশানী।পরনে তার হাটুসম কালো সিল্ক শার্ট। যেটা কাল রাতেই এরীশের পরনে ছিল। শার্ট অদল বদল হওয়ার বেসামাল, বেঘুরে মূহুর্ত গুলো মানস্পটে ভেসে উঠতেই উষ্ণতায় রক্তাভ হয়ে ওঠে রমণীর পেলব মুখশ্রী। মাফিয়া বসের প্রতিটি বন্য স্পর্শ সর্বাঙ্গ ছাপিয়ে শিহরণ তুলেছিল স্নায়ু তন্ত্রে। ফর্সা ত্বকজুড়ে অসংখ্য আদুরে যাতনার ছাপ। যেন সিলমোহর বসিয়েছে কেউ। সহসা ঠোঁট কামড়ে লাজুক হাসে ঈশানী। শিহরিত ভাবনা গুলো পাছে হটিয়ে সম্মুখে চোখ তুলতেই বড়সড় ঝটকা খায় মেয়েটা । ওর মুখ বরাবর ডিভানের উপর গা ছড়িয়ে বসে আছে মাফিয়া বস। হাতে মুঠোফোন, অনাবৃত শরীর, নির্ঘুম পরিশ্রান্ত দু’চোখ, পড়নের ঢিলেঢালা ট্রাউজারটা নেমে আছে নাভীর অগ্রভাগে। নিজের এলোমেলো চুল গুলোতে আঙুল বুলিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো সে,
— ঘুম কেমন হলো?
আড়ষ্টতায় জমে গেলো ঈশানী। মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—সেটা তো তুমিই ভালো বলতে পারবে।
— আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি।
এরীশের কথার পাছে কপাল গোছালো মেয়েটা, শুধালো,
— কেন ঘুমাতে পারোনি?
ঠোঁট উল্টালো মাফিয়া বস, বললো,
— জানিনা, তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি দেখতে লাগলাম।
— তারপর?
— তারপর আর ঘুমাতে ইচ্ছে করলো না।
এরীশের কথার ভাবার্থ উপলব্ধি করতে পেরে মৃদু হাসির রেখা প্রস্ফুটিত হয় রমণীর ঠোঁটের ডগায়। ফের ভেসে আসে রাশভারি কন্ঠস্বর,
— কাম অন, সিন অন মাই ল্যাপ।
নিজের উরুর দিকে ইশারা করে ডাকলো ওকে মাফিয়া বস।
ঈশানী গেলোনা, উল্টো প্রশ্ন করলো এরীশকে,
— আচ্ছা তোমার জন্মদিন কবে?
এক নিমেষে চেহারার রঙ পাল্টে গেলো এরীশের। সাবলীল অভিব্যক্তিটুকু উবে গিয়ে জড়ো হলো কঠোরতা। ধ্বনিত হলো রুষ্ট আওয়াজ,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৪
— আমার কোনো জন্মদিন নেই।
— জন্মদিন ছাড়া মানুষ হয় নাকি? আশ্চর্য!
এরীশকে অপ্রস্তুত দেখালো, তাড়াহুড়ো ডিভান হাতরে টিশার্ট চড়ালো শরীরে। চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললো,
— আমার অতীত ঘাটতে যেওনা, রহস্যে ডুবে যাবে।
কথা শেষ করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় সে,পেছন থেকে ঈশানী বলে,
— তুমি বলবে কি না?
বিনা প্রত্যুত্তরে কক্ষ ত্যাগ করে এরীশ। ভেসে আসে মৃদু গম্ভীর আওয়াজ,
— কোনো এক অভিশপ্ত রাতে ।