আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৬

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৬
suraiya rafa

কক্সবাজার, বাংলাদেশ,
পরন্ত গোধূলি। নিভে আসা সূর্যের মোলায়েম আলোটুকু ঠিকরে পরছে শান্ত নিরিবিলি সমুদ্র তটে। আলোক রশ্মির সংস্পর্শে ঝলমল করছে সমুদ্রের স্বচ্ছ নোনাজল। অদূরের দিগন্ত ছাড়িয়ে ঝাঁক বেঁধে গন্তব্যে ফিরছে পরিশ্রান্ত পানকৌড়ির দল।
ইনানী আজ মানবশূন্য। সচারাচর এমনটা দেখা যায় না কখনোই, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই লোকে সরগরম হয়ে থাকে এই স্থান, অথচ আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র বিরাজমান।

সাগরের কোল ঘেঁষে নির্জন বেলাভূমির বুকে মাথা উঁচিয়ে দণ্ডায়মান এক অত্যাধুনিক ক্যাফে। খুব বেশি বড় নয়, ছিমছাম । অথচ পুরো ডেকোরেশন জুড়ে দৃশ্যমান অন্তহীন বিলাসিতার ছাপ । পুরো থিমজুড়ে রয়েছে বড়সড় একটা শঙ্খ শামুকের অবয়ব। বাহ্যিক প্রতিটি আসবাবে রয়েছে অপার্থিব সমুদ্রের ছোঁয়া, ভেতরটাও সাজানো হয়েছে একই চিত্রে ।
বড়বড় মুক্তো ঝিনুক,সাগর কোলের সূর্যাস্ত, উত্তাল তরঙ্গোচ্ছ্বাস এসবের প্রোট্রেড চিত্রকর্ম দিয়ে সজ্জিত হয়েছে অভ্যন্তরের দেওয়াল গুলো। একপাশে রয়েছে ট্রান্সপারেন্ট কাচের দেওয়াল, যার থ্রী-ডি ভিশন জুড়ে সর্বক্ষণ প্রবাহিত হয় সমুদ্রাগত নিরবচ্ছিন্ন ঢেউয়ের প্রতিচ্ছবি। সঙ্গে শাব্দিক গর্জন তো রয়েছেই। যেন বিশাল জলরাশির মধ্যে থেকে আঁজলা ভরে এক টুকরো সমুদ্র তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ডাঙায়।
কিছুটা এগিয়ে নুড়িপাথরে বেষ্টিত গেটের সম্মুখে ছোট্ট একটা নেইম-প্লেটে জ্বলজ্বল করছে তার ছোট্ট নাম,”কর্ণিয়া ক্যাফে”।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ক্যাফের ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছে ঈশানী। কাচের স্বচ্ছ দেওয়াল ভেদ করে বিরস দৃষ্টিযুগল নীল অন্তরিক্ষে নিবদ্ধ তার। অদূরে যেখানে আকাশ গিয়ে মাটিতে মিশেছে।
ওদিকে ক্যাফের দৃশ্য পুরোই আশ্চর্যজনক। পাঁচজন লোক মিলেমিশে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে সর্বক্ষণ। কেউ কফি বানাচ্ছে, কেউ সার্ভ করছে, আবার কেউ পান করছে। ঘুরেফিরে একই কাজ। আর এদিকে টাকা গুনতে গুনতে হয়রান ঈশানী, বিরক্ত ও বটে। মূলত এরা হলো এরীশ ইউভানের প্রেরণকৃত গার্ড’স । যাদের কাজ হলো সর্বক্ষণ ঈশানীকে পাহারা দেওয়া।

অরণ্য দ্বীপে ক্যাফের আবদার করেছিল ঈশানী, সেখানে যেহেতু কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, তাই ইনানীতে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু ঈশানী যে নিজ হাতে ক্যাফেটাকে পরিচালনা করতে চাইবে সেটা বোধ হয় প্রত্যাশা করেনি মাফিয়া বস । প্রথমে একবাক্যে না করে দিলেও পরবর্তীতে মেয়েটার কাকুতি -মিনতির জের ধরে খানিক নরম হয়েছে সে । কড়া আদেশে ভাটি পরেছে, টলেছে হিমালয়।
অবশেষে শর্ত সাপেক্ষে বন্দরে আসার অনুমতি পেয়েছে ঈশানী।
যেহেতু এরীশের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই, ওর গন্তব্য পুরো দুনিয়া জুড়ে, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ঈশানীকে ব্ল্যাকহোলে রেখে যাবে সে। এবং ক্যাফেতে অবস্থান কালীন পুরোটা সময় জুড়ে থাকবে গার্ড’সদের কড়া নিরাপত্তা।
ঈশানী রাজি হয়েছে বটে, কিন্তু এটা কল্পনা করেনি যে ও ক্যাফেতে বসলে পুরো ইনানী খালি করে দিবে এরীশ । এটা আবার কেমন কথা? কাস্টমার না থাকলে ক্যাফে চলবে কি করে?

মাফিয়া বসের এতোসব কারসাজিতে সকাল থেকেই ভীষণ হতাশ ছিল ঈশু। মুখ কালো করে সাগর দেখছিল চুপচাপ, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গার্ড’সরা শুরু করেছে আবার নতুন নাটক, তারা নিজেরাই কাস্টমার সেজে হুলুস্থুল বাঁধিয়েছে ক্যাফে জুড়ে। তাদের কাজ কর্ম এমনকি খাওয়ার ধরন সবকিছুই যান্ত্রিক। রোবটের মতো বিনাবাক্যে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছে সেই সকাল থেকে। যেন ব্যাটারীর সাহায্যে কেউ চালনা করছে তাদের,এবং যতক্ষণ সেই ব্যক্তি রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা নিয়ন্ত্রণ না করবে, ততক্ষণ একইভাবে চলতে থাকবে অহর্নিশ।
চারিপাশের এসব অদ্ভুত দৃশ্য চুপচাপ অবলোকন করে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছুটি করার নেই ঈশানীর। কারণ সে ভালো করেই জানে এই সবকিছুই তার মাফিয়া বরের কাজ।
কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকা প্রয়োজন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো আর কতো বসে বসে টাকা গুনবে সে? অগত্যা চোখ ঘুরিয়ে ডাকলো গার্ড গুলোকে,

— এই যে মেশিনম্যানেরা এবার দয়াকরে একটু থামুন। আপনাদের কাণ্ডে রীতিমতো মাথা ঘুরছে আমার। আপনাদের ও তো বিরক্ত লাগছে নাকি? উফফ!
ওপাশ থেকে কফি খেতে খেতে যান্ত্রিক স্বরে প্রত্যুত্তর করলো একজন,
— নো ম্যাম, উই আর পার্ফেক্টলি ফাইন।
— কচু!
চোখ মুখ কুঁচকে মৃদু স্বরে বিড়বিড়ালো ঈশানী। পরমূহুর্তে কিছু একটা ভেবে বললো,
— আপনাদের কারো কাছে ফোন হবে?
ফের ভেসে এলো একই ভঙ্গিমার প্রত্যুত্তর,
— নো ম্যাম, আপনার হাতে সব ধরনের ডিভাইস দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
— কে দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা?
— এরীশ বস।
কপাল গোছালো ঈশানী। প্রচন্ড রাগের তাড়নায় গজগজ করতে করতে কঠোর গলায় বললো,
— দরকার পরলে তার কাছ থেকে অনুমতি আনুন, আমি আমার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই, এক্ষুণি, এই মূহুর্তে।
— ইয়েস ম্যাম।
মাথা নাড়িয়ে তৎক্ষনাৎ সায় জানালো লোকটা।

সূর্য যখন ধীরস্থির নিপতিত হয়ে সমুদ্রের জলে গা ভেজালো, ঠিক তখন ইনানীতে পা রাখলো নিঝুম। মূলত ঈশানী কল দিয়ে আসতে বলেছে ওকে। এতোদিন বাদে ঈশানীর হদিস পেয়ে নিঝুম ও আর না করতে পারেনি, ছুটে এসেছে প্রিয় বান্ধবীর ডাকে।
নিঝুম আসার প্রারম্ভে দু’জন মিলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্র তটের অভিমুখে । সাগরের বিমুগ্ধ গর্জনে মুখরিত চারিপাশ, তার সঙ্গে জুড়েছে শঙ্খচিলের অনিমেষ কলতান ।
জলরাশির খুব কাছে গিয়ে স্তব্ধ হলো পদযুগল। নরম, সিক্ত বালুচরের উপর গিয়ে পদ্মাসন হয়ে বসলো ওরা দু’জন,। সমগ্র আকাশ জুড়ে চলছে তখন বেলা ফুরোবার আয়োজন, বিষাদ মাখা নয়ন মেলে সেসব এক দৃষ্টে অবলোকন করছে নিঝুম, আর ঈশানী দেখছে নিঝুমকে।
নিভে আসা সূর্যের রক্তিম আভায় ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে মেয়েটাকে, গোধূলির শেষ প্রহরের হলদেটে আলোয় চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে তার স্নিগ্ধতা। অথচ মুখের কোথাও চঞ্চলতার লেশমাত্র নেই । আছে কেবল চাপা আর্তনাদ। অদ্ভুত অদৃশ্য এক বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে মেয়েটার সমগ্র মুখশ্রী। ঈশানীর সন্দেহ হয়, এতোটা চুপচাপ, বেখেয়ালি কখনো দেখেনি ও নিঝুমকে। উদ্বিগ্নতায় ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে তার, তৎক্ষনাৎ শান্ত গলায় শুধায়,

— কি হয়েছে তোর নিঝুম?
দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় বাঁকায় নিঝুম, আনমনে জবাব দেয়,
— কই কিছু না তো।
— কিছু তো অবশ্যই হয়েছে, মুখে না বললেও তোর চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শেষ কবে রাতে ঘুমিয়েছিলি বলতো?
প্রিয় বান্ধবীর থেকে আপন সত্তা লুকিয়ে রাখা দায়। বরাবরই সে বুঝে যায় কোনো এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আড়ালে। ঈশানীর চোখ এড়ায়নি কোনোকিছুই, ফের বিরক্ত হয়ে শুধায়,
— এভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিস যে? কিসের এতো দুঃখ তোর?
এতোক্ষণে মুখ খুললো নিঝুম,শান্ত স্বরে জানালো,
— আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে ঈশু।
এক চিলতে নরম হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত হয় ঈশানীর, মেয়েটা উৎসুক কন্ঠে বলে,
— এটাতো খুশির খবর। আমার তো শুনেই আনন্দ লাগছে। তাহলে তুই এমন পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কোন দুঃখে?
“পেঁচা” শব্দটা ধ্বনিত হতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো নিঝুম, দাঁত কটমটিয়ে বললো,

— খবরদার! ওই হাড়বজ্জাতের নাম ভুলেও আমার সামনে মুখে নিবিনা তুই।
— পেঁচা যে হাড়বজ্জাত কে বলেছে তোকে? পেঁচা ও একধরনের পাখি।
— পাখি না ছাই! না আছে রূপ আর না সুর। ওটা হলো পাখি নামের কলঙ্ক, বুঝেছিস?
— কি হয়েছে বলতো তোর? এতো রেগে আছিস কার উপর?
খানিক নৈঃশব্দ্য। নিঝুম জবাব দেয় না, কিভাবে যে কথাটা খুলে বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। ঈশানী ওকে ধাতস্থ করে বলে ,
— তুই যদি কোনো কারণে বিয়েটা করতে না চাস, তাহলে বাড়িতে সরাসরি বল।
নিঝুম হাঁপিয়ে ওঠে, পরপর কয়েক দফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
— সেটা সম্ভব নয় রে ঈশু। আমি আত্মিক টানে বাঁধা পরেছি। সম্পর্কের বহুগুণ উপরে এই আত্মিক টান। তার চেয়েও বড় কথা যার জন্য এতো কষ্ট পাচ্ছি সে মানুষটাতো এই শব্দহীন অনুভূতির মানেই বোঝেনা। জানেনা সে ভালোবাসতে।

— তুই ঠিক কার কথা বলছিস?
ঈশানীর কণ্ঠে উপচে পরা কৌতুহল দ্বিধা করলো না নিঝুম, সরাসরি বললো,
— তুষারের কথা।
— মানে তুষার জাওয়াদ?
— হু।
ছোট্ট করে সম্মতি জানালো নিঝুম, তৎক্ষনাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো ঈশানীর অক্ষিযুগল। এক মূহুর্তের জন্য নিজের কান কে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না রমণী। প্রিয় বান্ধবীর অস্তিত্বের সুরক্ষায় তৎক্ষনাৎ ঘটলো ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ,
— দুনিয়ায় আর মানুষ পেলিনা? তুষার কে কতটুকু চিনিস তুই!
— চিনি তো, তুষার অরণ্যর এসিস্ট্যান্ট।
দাঁত কিড়মিড়ালো ঈশানী, সরাসরি কিছু বলতে গিয়েও বললো না, পেছনে গার্ড’স দাঁড়িয়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে আওড়ালো,

— তুষারকে তোর কোন দিক দিয়ে অরণ্যর এসিস্ট্যান্ট মনে হয় ফাজিল ? তুই কি আদৌও জানিস অরণ্য কে?
ঠোঁট উল্টে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো নিঝুম অর্থাৎ অজ্ঞাত সে । মুখে বললো,
— হবে হয়তো কোনো নামকরা কোম্পানির ডিরেক্টর ফিরেক্টর।
চেহারা জুড়ে আঁধার নেমে এলো ঈশানীর, মনে মনে আপসোস ও করলো খানিকটা, কেন যে নিঝুমের কথা সত্যি হলোনা। পরপরই কণ্ঠে দৃঢ়তা টেনে বললো,
— ভুলে যা তুষার কে। ও তোর জন্য বেস্ট চয়েজ নয়।
— একবারও আমার অনুভূতির কথা ভাবলি না ঈশু, এতো সহজে বলে দিলি?
গ্রীবাদেশ ঘুরিয়ে নিঝুমের পানে চাইলো ঈশানী। কোটর তার ভরে উঠেছে অশ্রুপ্লাবনে। টলমলে অক্ষিদ্বয়। সন্ধ্যার শেষ আলোতে চিকচিক করছে সেগুলো।
ক্রন্দিত নিঝুমকে অবলোকন করতেই শুষ্ক ঢোক গিললো মেয়েটা। অন্তর ছেয়ে গেছে তার নৈঃশব্দ্যিক হাহাকারে। একহাত বাড়িয়ে আলতো প্রলেপে নিঝুমের চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে অসহায় অপারগ স্বরে বললো,
— আমি কখনো তোর খারাপ চাইবো না নিঝুম।
প্রিয় বান্ধবীর সামান্য আস্কারায় ঠোঁট ভেঙে ডুকরে কেঁদে ওঠে নিঝুম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,

— পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন ঈশু? কেন একজনার মনে অনুভূতির জায়গা হলে অন্য জনের হয়না? নিয়ম, নীতির বেড়াজাল এতো কঠোর কেন? কেন চাইলেও সবকিছু উপেক্ষা করা যায় না? তুই তো জানিস আমি বিচ্ছেদ সইতে পারিনা, তাহলে আমিই কেন এমন একটা পর্যায়ে আঁটকে গেলাম, যেখানে বিচ্ছেদ না হয়েও বিচ্ছেদের চেয়ে হাজার গুন বেশি যন্ত্রনায় দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়টা। বিশ্বাস কর ঈশু, ভেতরটা দাবানলের মতো দাউদাউ করে পুড়ছে আমার। একটাবার, শুধু একটাবার তাকে দেখার জন্য ছটফট করছে অন্তরটা। শেষ বারের মতো তাকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছেটা কি খুব বেশি চাওয়া? তুইই বল!
নিঝুমের অনর্গল অসহায়ত্বে থমকে গেলো ঈশানী, চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা তপ্ত জল গড়ালো ওর। অন্তর্মুখী জড়তা ভেঙে তৎক্ষনাৎ বাহুডোরে জায়গা দিলো প্রিয় বান্ধবীকে। কান্না গিলে গিলে বলতে লাগলো,
— যন্ত্রণাটুকু মেনে নে নিঝুম। ভুলে যা সেই মানবের অস্তিত্ব । যেই পিছুটানে অঙ্গিকার নেই, সেই পিছুটান কখনো ভালোবার নয়, ওটা কে বলে প্রহেলিকার ফাঁদ। যে ফাঁদে একবার পা দিলে সমগ্র বাস্তবতা ভুলে চোরাবালির অতলে ডুবে যেতে হয়।
শেষ বাক্যটা বড্ড ভারী শোনালো। রমণীর বিমর্ষ কণ্ঠস্বর। যেন কথাগুলোর আড়ালে গভীর ভাবে জুড়ে আছে স্বয়ং ঈশানীর গন্তব্যহীন জীবনের ভার।

কক্সবাজার,ব্ল্যাকহোল( মাফিয়া বসের গোপনীয় রিসোর্ট/ আস্তানা)
— যত দ্রুত সম্ভব আপনার রাশিয়া ফেরা প্রয়োজন এরীশ । বেশ কয়েকটি ইম্পর্টেন্ড ডিল পোসপোন করে রাখা হয়েছে।
ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে যে বিলাসবহুল অফিস কামরাটি রয়েছে, তার সুবিস্তীর্ণ গতিতে একপাশের উরুর উপর অন্য পা তুলে আসীন স্বয়ং মাফিয়া বস। কালো শার্ট আর কালো ওয়েস্ট কোটের সঙ্গে ব্ল্যাক ভেলভেট ব্লেজারটা মানিয়েছে বেশ। আন্ডারকাটকৃত লম্বা সিল্কি চুল গুলো কপালের একপাশে ছড়িয়ে আছে নির্বিগ্নে। ঠোঁটের ফাঁকে অনর্গল ধোঁয়ার কুণ্ডলী, তবে সিগারেটের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণটা অনুপস্থিত, পরিপক্ব স্টবেরীর মৃদু একটা সুগন্ধ নিসৃত হচ্ছে ক্রমাগত।
তার এক হাতে আবদ্ধ ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের শলাকা, অন্যহাতে সিল্কি চুলের মাঝে বুলিয়ে গেলো বেখেয়ালি আঙুল। অতঃপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তুষারের পানে চেয়ে ছুড়লো রাশভারি কণ্ঠস্বর,

— খুব শীঘ্রই।
হাতে থাকা আইপ্যাড স্ক্রিনে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই তপ্তশ্বাস ছেড়ে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো যন্ত্রমানব। একই ধ্বণিতে ফের প্রশ্ন ছুড়লো মাফিয়া বস,
— আন্ডারওয়ার্ল্ডের খবর দাও। বহুদিন রাজ করা হয়না, আই ওয়ান্ট সাম থ্রীল।
কণ্ঠে তার শরীর কাঁপানো শীতলতা। তুষার জানালো,
— ডেনিয়েল রাশিয়া ফিরেছে,সঙ্গে এ্যালেক্সান্দ্রেয় ও। ক্যাসিনো ক্লাবে নতুন কিছু স্মাগলার যুক্ত হয়েছে, যদিও আমি তাদের সন্দেহের খাতায় রেখেছি, আর হ্যা, bratva এর সদস্যরা মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে,দাবানলের কারণে ক্যালিফোর্ণিয়ার সর্বত্র অরাজকতা বিরাজমান। এটাই সুযোগ, ওরা সমগ্র ক্যালিফোর্ণিয়া লুটপাটের পরিকল্পনা করছে। আই থিংক আমাদের ও একটা চান্স নেওয়া উচিত এরীশ , আফটার অল উই আর পাইথন গ্যাঙ।
দু’হাত কাউচে মেলে দিয়ে শরীরের সবটুকু ভার ছেড়ে বসলো মাফিয়া বস, অধর কোনে প্রস্ফুটিত হলো তার কপটতা মিশ্রিত হাসি। ফের ঝকঝকে দন্ত রাশি দ্বারা অধর কামড়ালো সবেগে, কাঁপন ধরানো হীমশীতল আওয়াজে বললো,

— আমি ডাকাত কিংবা পায়ারেটস নই তুষার। মানুষের বাড়িঘর লুট করা আমার কাজ নয়। আমি ত্রাস! পুরো শহর থেকে একটা মাত্র জিনিস তুলে আনবো, যার ভারে কেঁপে উঠবে পুরো ইউনাইটেড স্টেট।
— আপনি ঠিক কোন জিনিসের কথা বলছেন এরীশ?
— লস এ্যাঞ্জেলসের মেয়র ড্যানিয়েল লুরি। তার কার্জালয়ে এমন একটি হাজার বছর পুরোনো সিলমোহর রয়েছে শেয়ারমার্কেটে যার দাম কোটি কোটি টাকা। আমরা ডার্ক ওয়েভ থেকে বিক্রি করবো, অর্থাৎ লক্ষ কোটি টাকা। আশা করি বুঝতে পেরেছো?
অভিব্যক্তির খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলোনা তুষারের মাঝে, সে অত্যন্ত সাবলীল কণ্ঠে বলে উঠলো,
— ইট’স টু রিস্কি!
ফের ক্রূর হাসি খেলে গেলো এরীশের ঠোঁটের আগায়,প্রত্যুত্তর করলো,
— আই এনজয় টেকিং রিস্ক’স তুষার ।
কথা বাড়ালো না তুষার, আইপ্যাড স্ক্রল করতে থাকলো নীরবে। ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের বাষ্পটুকু ভেতরে টেনে শান্ত আওয়াজে বাক্য ছুড়লো এরীশ,
— ফ্লোরা কোথায়?
— ওকে আপাতত ইয়াকুতিয়া রেখে এসেছি, ওর দাদির কাছে।
— ইজ ইট সেইফ?
সর্বদা সাবলীল যন্ত্রমানব এবারে হতচকিত হলো কিঞ্চিৎ। জায়গাটা নিরাপদ কিনা জানতে চাইছে মাফিয়া বস, তারমানে পৃথিবীতে ঈশানী ব্যতীত আরও একজনের জন্য চিন্তা হয় হৃদয়হীন লোকটার । হোক সেটা অতিব সামান্য।
সংবিৎ ফিরে এলে নির্বিকারে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় তুষার। পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে অকস্মাৎ কণ্ঠে দৃঢ়তা টানলো সে,

— অজ্ঞাত সেই গড ফাদারের দু’টো ইনফরমেশন হাতে এসেছে।
চকিতে তীর্যক দৃষ্টে তুষারের অন্তর্ভেদ করলো এরীশ। বরফ কেটে ফেলার মতো ধারালো সে দৃষ্টি। পরপরই নিক্ষিপ্ত হলো তার রূঢ় আওয়াজ,
— ইয়েস!
তুষার বললো,
— আমাদের স্পাই টীমের লিডার জানিয়েছে সে bratva এর অন্তর্গত কোনো মাফিয়া নয়। ইভেন তার আইডেন্টিটি রাশিয়ান নয়। এ-যাবৎ কেউ তার মুখ দেখেনি, কথার একসেন্ট এ মনে হয়েছে সম্ভবত এশিয়ান কোনো কান্ট্রির।
আর দ্বিতীয় ইনফরমেশন হলো, তার টার্গেট আপনি নন, আপনার দূর্বলতা। ওরা আপনার দূর্বলতার হদিস করছে এরীশ ।
কপালের অগ্রভাগে তর্জনী বোলাতে বোলাতে সবটা শুনলো এরীশ ইউভান। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানে শক্ত হয়ে উঠলো তার চোয়ালের পেশীগুলো। উজ্জ্বলাভ ললাট জুড়ে অচিরেই ভেসে উঠলো কালচে রঙা শিরা-উপশিরা । ধূসর বাদামি গহ্বরে যেন আগ্নেয়গিরির উদ্বাসন। নৈঃশব্দ্যে দাঁতে দাঁত পিষলো মাফিয়া বস, পায়ের উপর পা ফেলে ছুড়লো কঠোর হুংকার,

— এরীশ ইউভানের দূর্বলতায় হাত কেন সামান্য আঙুল বাড়ালেও গোটা দুনিয়া থেকে সমগ্র অস্তিত্ব মুছে যাবে তার।
স্তব্ধ যন্ত্রমানব, চিরাচরিত শিথিল তার দৃষ্টিযুগল। কোনো বিষয় নিয়ে এরীশকে এতোটা সিরিয়াস হতে আগে কখনো দেখেনি তুষার। ঘোর ভালো, তবে আসক্তি নয়, নীল চোখের মেয়েটা এরীশের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিতে পরিনত হচ্ছে দিনকে দিন। এটা কি আদৌও মঙ্গলজনক? কখনোই নয়!
নিদারুণ ভাবনায় নিমজ্জিত তুষার।তৎক্ষনাৎ কর্ণগোচর হলো এরীশের রাশভারি আওয়াজ,
—- ওই মেয়েটাকে আমার চাই।
— কোন মেয়েটা?
সম্বিৎ ফিরে আসতেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো তুষার। এরীশ জানালো,
— রিয়ানা।
— পায়ারেটস লিডার রিচার্ডের গার্লফ্রেন্ড?
— ইয়েস, এই গড ফাদার রহস্যের প্রথম ধাপ ই হলো রিয়ানা।
নির্বিকারে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো তুষার,একটু সময় নিয়ে স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো,
— যা বুঝলাম, এই গদ ফাদার সাধারণ কোনো মাফিয়া নয়, হি ইজ আ মাস্টার মাইন্ড।
দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে সম্মুখে ঝুঁকলো মাফিয়া বস। শূন্য দৃষ্টি জুড়ে তার অমানিশার দীপ্তি। রহস্যের ঐন্দ্রজালিক ঘোরে আবদ্ধ সে চাহনি, মূহুর্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে ছুড়লো হিমশীতল আওয়াজ,
— ইফ হি ইজ আ মাস্টার মাইন্ড, দেন আ’ম দ্যা ওয়াইল্ডকার্ড অফ হিজ গেইম।
কক্ষজুড়ে নৈঃশব্দ্য বিরাজমান। তুষার চেয়ে আছে এরই মাঝে দরজা ভেদিয়ে ভেসে এলো রিনরিনে মেয়েলী গলার স্বর,

— ভেতরে আসবো!
মূহুর্তেই বদলে গেলো আবহ, খেই হারালো পৈশাচিক অস্তিত্ব। রক্তিম হয়ে ওঠা হিংস্র দানবীয় চোখগুলোকে এক লহমায় গ্রাস করে নিলো নমনীয়তা। এরীশের মনে হলো ওর শুকনো প্রাণহীন খরখরে অন্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বর্ষণ হলো একপশলা।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করলো তুষার,দেখতে পেলো সুতির লং স্কার্ট আর লেডিস শার্ট পরিহিত নীলাম্বরীকে। যেহেতু মূহুর্তটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত, তাই তুষার আর সময় অতিবাহিত করলো না, দ্রুত হেঁটে প্রস্থান করলো সেখান থেকে, যাওয়ার সময় ঈশানীর সঙ্গে দৃষ্টি মিলিত হলো একপল। তুষার খুব একটা খেয়াল না করলেও ঈশানীর দৃষ্টি ছিল প্রখর।
****
এরীশ এখনো তার গদিতে আসীন, তাকে লক্ষ্য করে পায়ে পায়ে সম্মুখে অগ্রসর হলো ঈশানী।
এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কক্ষের চারিদিকে একপল দৃষ্টি বোলালো সে, চারিদিকে সশস্ত্র গার্ড’সদের নিস্তব্ধ অবস্থা। প্রাইভেসীর প এর ও উপস্থিতি নেই। এরই মাঝে বেসামাল কণ্ঠে ডাকলো ওকে এরীশ,
— কাছে এসো।
আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দূরত্ব কমালো ঈশানী। পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলো এবার মাফিয়া বস, আঙুলের সাহায্যে নিজের উরুর দিকে ইশারা করে বললো,
— সিট অন মাই ল্যাপ।
মূহুর্তেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরলো ঈশানী, সরু দৃষ্টিতে এদিক ওদিক নজর বোলালো ফের। গার্ড’স গুলো তাকিয়ে আছে রোবটের মতো। দ্বিধান্বিত ঈশানীকে ভাবনার ফুরসত দিলোনা নিষ্ঠুর মানব। সামান্যতম দয়া না দেখিয়ে সরু কব্জিটাকে মুঠোবন্দি করে হ্যাঁচকা টানে বসিয়ে দিলো কোলের উপর।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গেলো ঈশানী, দু’চোখ নিভে এসেছে তার লাজুকতায়। তড়িঘড়ি করে একহাতে স্বামীর গ্রীবা জড়িয়ে, মুখ লুকালো গলার ভাঁজে, অন্য হাতের আঙুল দিয়ে ঈশারা করলো সম্মুখের গার্ড’স গুলোর পানে। ঈশানীর আঙুলকে অনুসরণ করে সামনের দিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করলো এরীশ। মাফিয়া বসের এক চোখের ইশারায় তৎক্ষনাৎ একযোগে মস্তক নমিত করলো সকলে। দৃষ্টি তাদের জমিনে আবদ্ধ।
— মাথা তোলো, কেউ দেখছে না তোমায়।
আস্বস্ত হলো ঈশানী। সহসা ধীরে ধীরে তুললো মাথাটা। মেদহীন পেলব কটিদেশের চারিপাশে অনুভূত হলো বলিষ্ঠ বাহুর আবর্তন। নিমেষেই সংকুচিত হয়ে গুটিয়ে গেলো নারী শরীর। তাতে ধ্যান নেই এরীশের। প্রেয়সীর খোলা চুলের ভাঁজে নিরুদ্বেগে মুখ ডুবিয়েছে সে। রমণীর শরীর থেকে ভেসে আসা ভ্যানিলার মিষ্টি সুগন্ধিটা মস্তিষ্ক ছাড়িয়ে দেহের প্রতিটি স্নায়ুকোষের অভ্যন্তরে গিয়ে টনিকের মতো বিঁধছে যেন। নারীদেহের মিষ্টি সুঘ্রাণে বিমত্ত হয়ে উঠেছে মাফিয়া বস। পালাক্রমে বেড়ে চলেছে অস্থিরতা, এরীশ বেসামাল হয়ে ওর গলার ভাঁজে মুখ ডোবাবে তার আগেই মানবের ওষ্ঠাধরের মাঝে আঙুল দাবালো ঈশানী।

— প্রেম আমার।
এরীশের কণ্ঠে ঘোর। না সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী, স্পষ্ট গলায় বললো,
— আমার কিছু বলার আছে এরীশ।
— সব শুনবো, কিন্তু এখন নয়।
বাক্য শেষ হতেই আপন কার্জে মত্ত হতে উদ্যত হলো এরীশ, ফের বাঁধ সাধলো ঈশানী,
— প্লিইইজ! একটু শোনো।
— শুনলে কি পাবো?
— যা চাইবে তাই।
— এই মূহুর্তে আমি ঠিক কি চাইছি সেটা তুমি ভালো করেই জানো।
শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী, মিহি কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি দিলো ভালোবাসার,
— পাবে, কিন্তু এখানে নয়।
ভেতরের বেসামাল সত্তাটাকে ধামাচাপা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো এরীশ, নিরেট কন্ঠে জানতে চাইলো,
— ঠিক আছে বলো কি বলবে?
এক মূহুর্ত দেরী করলো না রমণী,দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

— আসলে তুষার।
— তুষার!
শব্দের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে কপালো গোছালো এরীশ। এদিকে ওদিকে মাথা নাড়ালো ঈশানী, কুণ্ঠিত স্বরে বললো,
— না মানে আমার বান্ধবী নিঝুম। আগামীকাল ওর বিয়ে। বিয়ে মানে বোঝো নিশ্চয়ই!
— হোয়াট!
মাফিয়া বসের কণ্ঠে বিস্ময়। মেকি রাগের তোড়ে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে তার। ঈশানী ওর ফুলে ওঠা নাকটা টেনে দিয়ে বললো,
— হোয়াট হোয়াট করোনা তো। আমাকে বলতে দাও।
— হু।
জিভের ডগায় অধর ভেজালো ঈশানী। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর মুখের কথা কেড়ে নিলো এরীশ,

— এভাবে ঠোঁট ভিজিও না,আ’ম ম্যাডলি ক্রেভিং ফর ইউওর কিস।
চোখ ঘুরিয়ে এরীশের মুখের পানে দৃষ্টিপাত করলো ঈশানী। তৃষ্ণার্থ চোখ দু’টো তার ঈশানীর অধর মাঝে নিবিষ্ট। শুষ্ক একটা ঢোক গিললো রমণী, নিজেকে সাবলীল করে ছুড়লো স্পষ্ট বাক্য,
— নিঝুম শেষ বারের মতো তুষারের সঙ্গে দেখা করতে চায় এরীশ।
ধ্যান ভাঙলো এরীশের। এতোক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার তার নিকট, তপ্তশ্বাস ছেড়ে ভারিক্কি আওয়াজে বললো,
— আমি কি করতে পারি এখানে?
— আমি চাই নিঝুমের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হোক, প্লিজ জান না করোনা।
— জান কেন বললে? কে শিখিয়েছে তোমায়?
— কেউ না, ভেতর থেকে চলে এলো।
— আমার কথা আমাকেই ফেরত দিচ্ছো?
— দিচ্ছি, এবার বলো তুমি তুষার কে রাজি করাবে?
দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ঈশুর নমনীয় কাঁধে চিবুক ঠেকালো মাফিয়া বস। শান্ত নির্জীব কণ্ঠে বললো,

— কারোর ইমোশনে হস্তক্ষেপ করার রাইট আমার নেই ।
ঈশানী ব্যতিগ্রস্ত হলো, বায়না ধরা বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
— আমি জানি সেটা, কিন্তু তুমি বললে তুষার কখনোই না করবে এরীশ।
— এতো কনফিডেন্স আমার উপর।
— না করোনা প্লিজ, এটাই আমার শেষ আবদার।
—এ যাবত সব আবদারই তোমার শেষ আবদার ছিল।
গ্রীবা ঘুরিয়ে এরীশের মুখাবয়ব পরখ করলো ঈশানী, অধৈর্যতায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে তার, নেত্রযুগলের মিলন ঘটিয়ে ভেজা কণ্ঠে ফের মিনতি করলো মেয়েটা,
— প্লিইজ! সত্যি বলছি এটাই শেষ, আর কখনো কিছু চাইবো না।
মেয়েটার টলমলে অক্ষিদ্বয় পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাফিয়া বস। পরপরই দু’হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো রমণীর তুলতুলে নারী অস্তিত্বখানি, সুতীব্র পেষণে ভেঙেচুরে দিতে চাইলো কবুতরি দু’টো সুউচ্চ চূড়ো। আচানক চাপা শীৎকারে ককিয়ে উঠলো মেয়েটা, ধ্বনিত হলো মৃদু আওয়াজ,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৫

— আহ লাগছে!
— লাগার জন্যই ধরেছি। কাঁদার অনুমতি দিয়েছি আমি তোমায়? তাহলে চোখে পানি আনলে কোন স্পর্ধায় ? আমি ব্যথা দিচ্ছি এবার যত ইচ্ছে কাঁদো।
— সত্যিই লাগছে আমার এরীশ, তোমার নখগুলো….
ক্রন্দিত ঈশানী ফুঁপিয়ে উঠলো এবার। নিমেষেই হাতের বাঁধন ঢিলে করলো এরীশ। ক্রোধান্বিত হয়ে রমণীর নাজুক পৃষ্ঠদেশে কপাল ঘষতে ঘষতে উগড়ে দিতে লাগলো চিরন্তন অমোঘ সত্যের বাক্যবহর ,
— বারবার! সাকুরা বারবার এই চোখ দু’টো দিয়ে ঘায়েল করো তুমি আমায়। আমার মতো আগুনের ফুলকিকে বেঁধে ফেলো নিজের ঐশ্বরিক ইন্দ্রজালে। আমি জানি, আমার অনিষ্ট, আমার ধ্বংসও তোমার এই নীল চোখেই অবধারিত।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৭