আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬
suraiya rafa
গহীন অভয়ারণ্যের মাঝে বৃহৎ সেগুন গাছের পোক্ত ডালের উপর বহু কসরত করে তৈরি করা টং ঘরের ভেতরটা ছিল নান্দনিক আর সুসজ্জিত। দু’ধারে দু’টো সরু জানালা, এককোণে বাশ দিয়ে মেরামত করে তৈরি একটা সিঙ্গেল চৌকি, একটা স্টাডি টেবিল একটা চেয়ার, টেবিলের উপর একটা অর্ধমৃত টেবিল ল্যাম্প যার জীবন আর ব্যাটারী দুটোই ফুরিয়ে এলো বলে,এছাড়া রয়েছে পানির কেতলি আর নিত্য প্রয়োজনীয় টুকটাক আসবাবপত্র, ঘরের এককোণে ছোট্ট ফায়ারপ্লেসটাতে জুতসই আ’গুন জ্বলছে, যার লালচে আভায় আলোকিত চারিপাশ।
টেবিলের পাশেই বিছানার বিপরীতে রাখা আছে পুরাতন ধাঁচের একটি সিঙ্গেল কাঁউচ,দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ঘরটি একজনের বেশি মানুষের জন্য উপযোগী নয়, আর না তো এই গাঁ ছমছমে জংলা পরিবেশে সাধারণ কোনো মানুষ টিকে থাকতে পারবে বেশিদিন ।
নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যে একটুখানি এডভেঞ্চার প্রেমী মানুষ জনের ক্যাম্পিং এ আসার চিরাচরিত ইচ্ছেকে মূল্যায়ন করার জন্যই এই টং ঘরের আবিষ্কার। সে যাই হোক ঘরটা বেশ সুন্দর, কিঞ্চিৎ ভীতিকর তাও চলে, সঙ্গ দেওয়ার জন্য মনের মতো একজন হলেই হলো, কিন্তু সরকার কতৃক নিষিদ্ধ এই জঙ্গলে ক্যাম্পিং করতে কে-ই বা আসে? প্রশ্নটা থেকেই গেলো ঈশানীর অযাচিত মস্তিষ্কে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তবে সেটাকে আর গভীরে নিয়ে ভাবতে দিলোনা ওর দু’চোখ, তার আগেই সেই নীলাম্বর আঁখি পল্লব আটকে গেলো টং ঘরের সঙ্গে এঁটে থাকা এক টুকরো টানা বারান্দায়। ল্যানটার্নের মৃদু রোশনাইয়ে আলোকিত হয়ে আছে পুরো জায়গাটা, খোলা বারান্দার ওপাশে ঝমঝমে মুখরিত আওয়াজে সুউচ্চ পর্বত ছাড়িয়ে নেমে আসছে নাম না জানা পাহাড়ি ঝর্ণার বহর। দিনের আলোতে হয়তো বা স্বর্গের মতোই অপূর্ব লাগে এই জায়গাটা, তবে শুনশান নিরিবিলি রাতে ল্যানটার্নের মৃদু রোশনাইয়েও তার সৌন্দর্য অতুলনীয়, এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে গিয়ে চোখ দু’টো ওই টানা বারান্দায় এমন ভাবে আঁটকে গিয়েছিল যে ঈশানী আর ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না এক দন্ড। কোথায় আছে, কার সাথে আছে, কি করছে সবকিছু একমূহুর্তের জন্য ভুলে গিয়ে মনের ভেতরে জাগ্রত কৌতুহল আর উৎকন্ঠার বশবর্তী হয়ে এক ছুটে চলে গেলো সেই এক টুকরো খোলা বারান্দায়।
এবারে ঝর্ণার ঝিরঝির আওয়াজ টা আরও বেশি গাঢ় হলো কর্ণকূহরে,সেই সাথে রাত জাগা বন্য প্রাণীর ঘুটঘাট আওয়াজ তো রয়েছেই। তবে ঈশানী এই মূহুর্তে দুনিয়া ভুলে গিয়েছে, এই মূহুর্তে বললে ভুল হবে, অচেনা লোকটার সান্নিধ্যে আসার পর থেকেই এই মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষনীয় পুরুষ আর তার আশেপাশের জিনিস পত্র ছাড়া আর কিছু নিয়েই ভাবতে পারছে না ও।নিশ্চয়ই কোনো এক অজানা চৌম্বকীয় শক্তিবলে ঈশানীকে টানছে সে, নয়তো অচেনা লোকটার প্রতি এতোটা আগ্রহ কেনই বা হবে ঘরকুনো একগুঁয়ে মেয়ে ঈশানীর? তাছাড়া মানুষ ঠিক কতটা আকর্ষন অনুভব করলে কোনোরূপ দ্বিধাবোধ ছাড়াই অজানা একটা লোকের হুডি পরে নির্বিগ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে? সেটাও ভাববার বিষয়। তবে সহজ সরল ঈশানী যে লোকটার নিঃস্বার্থ আন্তরিকতায় ভেতর থেকে গলে গিয়েছে সেটা ওর নিশ্চিন্ত নীল দীঘির জলের মতো টলটলে চোখ দুটো দেখলেই হলফ করে বলে দেওয়া যায়।
সমতল থেকে প্রায় দশফিট উপরে অবস্থিত এই টং ঘরের ঝুলন্ত খোলা বারান্দায় পা রাখতেই সবার আগে ঈশানীর চোখ গেলো মসৃণ পাটাতনের ঠিক মাঝ বরাবর সটান দাড় করিয়ে রাখা একটা বিশাল সাইজের দূরবীনের দিকে। দূরবীনটা জঙ্গলের মাঝের সেই পাহাড়টার দিকে তাক করানো যেটাতে হাইকিং করতে গিয়েই আজ এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে ঈশানী।যদিও রাতের বেলা বন বিছুটির ফাঁক গলিয়ে কিচ্ছুটি দেখার উপায় নেই, তবুও কৌতুহল বশত সামনে কি আছে দেখার উদ্দেশ্যে দূরবীনে চোখ রাখতে উদ্যত হলো ঈশানী। তৎক্ষনাৎ কঠোর নিষেধ ভেসে এলো ওপাশ থেকে,
—ডোন্ট টাচ্ ইট।
অকস্মাৎ রাশভারী আওয়াজে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল ঈশানী, চোখ দুটো দূরবীনের কাছাকাছি গিয়েও ফের গতি হারালো মূহুর্তেই । না বলে কয়ে অন্যের জিনিসে হাত দেওয়ার চক্ষুলজ্জায় নিশপিশ করে উঠলো ভেতরটা, তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে সরু চোখে চাইলো পেছনে, দেখলো, নিজ ওভার সাইজ কার্গো প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে ওর থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, এই জঙ্গলে নেটওয়ার্ক এর ন ও নেই,তবুও তার দু’কানে এ্যাপল খচিত এয়ার পড লাগানো,ব্যাপারটা অদ্ভুত।
অবশ্য এই লোকের সকল কর্মকান্ডই অদ্ভুত, শুধু অদ্ভুত বললে ভুল হবে, অদ্ভুত রকম আকর্ষনীয়ও বটে। তাই ঈশানী আর ভাবতে গেলো না সেসব নিয়ে উল্টো বারান্দা ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সাবলীল গলায় লোকটাকে শুধালো,
— আপনি যে বললেন এটা আপনার বাড়ি,তা না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু আপনার পরিবার কোথায়? দেখে তো মনে হয়না এখানে আর কেউ থাকে।
— আগেও বলেছি, আবারও বলছি আমাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখাবে না। আমি কাউকে কৈফিয়ত দিই না।
আবার ও সেই কাঠকাঠ তিরিক্ষি মেজাজ, ঈশানীর মনে হচ্ছে এগুলো কথা নয় বরং গলিত শীশা, যা বারবার ওর মুখের উপর ছু’ড়ে মা’রছে লোকটা, কথার পারদে সীমাহীন রুষ্টতা,যার দরুন বারবার অপমানে নীল হয়ে যাচ্ছে ঈশানীর রাজহংসীর মতো গমরঙা চেহারাখানা। নীলাম্বর চোখের কোনে টলমল করছে অশ্রুজল, ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ওকে, আর এক্ষুনি নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চাইলে অভিমানে ফেটে পড়বে ঈশানীর দু’চোখ,মন, হৃদয় সবকিছু।
তবে অচেনা লোকটার স্বভাব চরিত্রে বোধ হয় নির্দয় কথাটা একেবারে বাঁধাই করে জুড়ে দেওয়া , যার দরুন ঈশুর এমন করুন ব্যথাতুর চাহনিতেও তার মাঝে কোনোরূপ হেলদোল দেখা গেলো না। ঈশানী ও তো কম যায়না, ভেতর থেকে দূর্বল হলেও বাইরের কাঠিন্য যথাসম্ভব ঠিকই ধরে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালালো ও, লম্বা শ্বাস টেনে ঝাঁঝালো গলায় বললো,
—- ঠিকাছে তাই হবে, আপনি যেহেতু নিজের সম্পর্কে কিছুই বলবেন না, তাহলে আমিও বলবো না,দয়াকরে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসবেন না, কিন্তু একটা কথা,
লোকটা বোধহয় ক্রুর হাসলো,কালো মাস্কের আড়ালে ঠোটের আগায় খেলে যাওয়া সেই তীক্ষ্ণ হাসিটা চোখ এড়ালো না ঈশানীর, তবে ওর নজর এখনো পিয়ার্সিং করানো শূন্য এক জোড়া ধূসর বাদামী চোখে নিবদ্ধ। তার চোখ দুটোই যেন এক সমুদ্র রহস্য বহন করে, আর সেই রহস্যে ক্রমশ তলিয়ে যায় ঈশানী,
— কি কথা?
মাস্কের আড়াল থেকে আবারও সেই হাস্কি ডিপ রাশভারি পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই ভ্রম কাটে ঈশানীর, তৎক্ষনাৎ লোকটার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ও বলে,
—- আমাকে দয়া করে রিসোর্টে পৌঁছে দিন, ওখানে আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।
— এতোরাতে তোমাকে পৌঁছে দেবো, মশকরা পেয়েছো?
লোকটার কথার মাঝে নিদারুণ হেয়ালিপনা আর জিদি মনোভাব, তবে ঈশানী টললো না, উল্টো কথা ছুড়ে বললো,
— পৌছে দিতে পারবেন না, তাহলে আমাকে সেফ করছেন কেন?
—কে বললো আমি তোমায় সেফ করেছি?
তার এবারের কথাটাও হেয়ালি কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ঈশানী, তাই আশ্চর্য কন্ঠে বলে উঠলো,
—মানে?
এরপর অনেকক্ষন যাবত উত্তরের আশায় দাড়িয়ে থাকলেও ওপাশ থেকে আর কোনো প্রত্যুত্তর ভেসে এলো না ঈশানীর কানে, ফলস্বরূপ সামনের দৃশ্যপট পর্যবেক্ষন করার প্রয়াসে চট করে মাথা তুললো ঈশানী,
দেখলো লোকটা টং ঘরের দুয়ার খুলে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে লোকটার স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জিটা হাতের মুঠোয় খপ করে টেনে ধরলো ঈশানী। আবারও সেই অনাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শে ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো ওর সুপ্ত নারীসত্তা, তৎক্ষনাৎ মনের মনিকোঠায় ঘাপটি মে’রে বসে থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
— কি আছে তার মাঝে? কেন এতো আকর্ষনীয় লাগছে তাকে? আগাগোড়া সে একজন নির্দয়,তিক্তভাষী সৌবিষ্ট পুরুষ আর তো কিছু নয়, কি দরকার নিজেকে তার সামনে এমন অসহায় প্রমান করার? তুই না আত্মবিশ্বাসী?
অন্য মনটা তৎক্ষনাৎ বিদ্রোহ করে গলা ছেড়ে বেহায়ার মতো বলে উঠলো,
—- আমি বোধ হয় সত্যি সত্যিই ঝড়ের বেগে প্রেমে পড়ে গেলাম।
বিপরীত পক্ষ শুধালো,
— এভাবেও চেহারা না দেখে, নাম না জেনে, তার কথার মায়ায় না পরে, এক দর্শনে প্রেমে পড়া যায় ?
জবাবে অন্য মন লাফিয়ে উঠে বললো,
— যায় তো, খুব যায়, এই নিয়ে দুইবার বাঁচালো সে আমায়, এখন এই মূহুর্তে আমি তার হেফাজতেই সুরক্ষিত রয়েছি, এটা কি আন্তরিকতা নয়? আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় তাকে চাইছে,এতে আমার হাত কোথায়?
শরীরে একটা কোমল হাতের টান অনুভব হতেই পেছনে ঘুরলো লোকটা,পেছনে ফিরে ঈশানীর পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দুই মনের বাকবিতন্ডার ইতি ঘটে তৎক্ষনাৎ, মনের ভাবনাকে পাছে হটিয়ে মেয়েটা মুখ ফুটে বলে ওঠে,
—- ক..কোথায় যাচ্ছেন আমাকে রেখে?
ওর কথায় সংকোচ সুস্পষ্ট,হাতটা তবুও অজানা অধিকারবোধে আটকে আছে সুঠাম দেহী অচেনা লোকটার পিঠের খাঁজে।
লোকটা নিজ কানের এয়ার পড গুলো খুলে পকেটে রেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে ঈশানীর দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— চিন্তা নেই ফিরে আসবো।
ঈশানী জানে কোনো এক অজানা করনে এই মানুষটা কৈফিয়ত দেওয়া একদমই পছন্দ করে না,তবুও উপায়ন্তর না পেয়ে আরেকদফা অ’পমানিত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ও শুধালো,
—- বলছি যে এতো রাতে এই জঙ্গলে আমি একা একা থাকবো, না গেলে হয়না?
লোকটা যেতে যেতে জবাব দিলো,
— না হয়না, চুপচাপ এখানে ওয়েট করো, ভালো না লাগলে ঘুমিয়ে পরো।
লোকটার কড়া জবাবে হেলদোল হলোনা ঈশানীর, উল্টো দ্বিতীয়বার প্রশ্ন ছুড়ে বলে উঠলো,
—- আর আমাকে রিসোর্টে কখন পৌঁছে দেবেন?
— আবহাওয়া ভালো হলে আগামীকাল, মাটির রাস্তা না শুকোলে শহরের দিকে যাওয়া পসিবল নয়।
— আর আপনি…
ঈশানী বাক্যটুকু শেষ করতে গিয়েও পারলো না আর, তার আগেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে ধাপ করে টং ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো লোকটা। আর ঈশানী একা একাই পরে রইলো মাটি থেকে প্রায় দশ বারো ফিট উপরে গহীন জঙ্গলের মাঝে ওই ছোট্ট এক টুকরো ঝুলন্ত ঘরের ভেতর।বারান্দায় টাঙানো হারিকেনটা এখনো টিমটিমিয়ে আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে, পরিবেশটা রোমাঞ্চকর অথচ ঈশানীর একটুও ভয় করছে না, উল্টো ভেতর ভেতর আগ্রহের দাবানল ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, কেন যেন তাকে জানার, তাকে চেনার, এক আকাশ সম ইচ্ছে মস্তিষ্কে জড়ো হয়ে আছে, অথচ এই ঈশানীই কিনা নিজে থেকে কাউকে চেনার কিংবা জানার ইচ্ছে পোষণ করেনি কোনো কালেই।
লোকটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে চট করেই ঈশানীর মন বলে ওঠে,
—- আচ্ছা, আমি যে তাকে নিয়ে এতোকিছু ভাবছি, তার জীবনে যদি অন্য কেউ থেকে থাকে তখন কি হবে?ব্যাপারটা তো আমার জন্য ভীষণ কষ্টদায়ক হবে, কিন্তু আমি তো এমন কিছুই চেয়েছিলাম, প্রেমে পরার নিদারুণ ব্যথায় নীল হয়ে যাক আমার হৃদয়।
নিজ মনের কথায় উপহাস করে হাসলো ঈশানী,পরক্ষণেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
—-কোনোদিন প্রেমে পরিনি বলে উপর ওয়ালা বোধহয় আমার এই উইশটাই কবুল করে নিলো, নয়তো এভাবেই কেন কাউকে ভালো লাগতে হবে? কেন আমার হৃদয়টা তার দেওয়া কড়া নিষেধাজ্ঞা, দূরত্বের গন্ডি কিছুই মেনে নিতে চাইছে না? আশ্চর্য!
মনের প্রশ্ন মনেই চাপা পড়ে রইলো ঈশানীর, কারণ ইতিমধ্যে আবারও দরজা খোলার খুটখাট আওয়াজে মস্তিষ্ক সচকিত হয়ে উঠেছে ওর। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করতেই ঈশানী লক্ষ্য করে লোকটা ফিরে এসেছে, তার পড়নে আরেকটা ব্ল্যাক হুডি, হাতে দুটো ইন্সট্যান্ড রামেন নুডলস।
লোকটা ঘরে প্রবেশ করে সবার আগে মাথার ক্যাপটা খুলে সাইডে রাখলো, তৎক্ষনাৎ একঝাঁক সিল্কি আন্ডারকাট লম্বা চুল এসে কপাল ছুঁলো তার, বেখেয়ালে সেগুলো ব্যাকব্র্যাশ করতে করতেই লোকটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে কেতলিটাকে ফায়ারপ্লেসের আগুনে রেখে রামেন বানানোর ক্ষুদ্র প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
ঈশানী সেই তখন থেকে অবাক চোখে পর্যবেক্ষন করছে সবটা, এই গভীর রাতে জঙ্গলের মাঝে ইন্সট্যান্ড নুডলস কোথায় পেল সে? ভেতরে অদম্য কৌতুহল, অথচ হৃদয়ে ভালোলাগার প্লাবন, দুইদিকের টানাপোড়েনে ক্লান্ত ঈশানী, তাই চুপচাপ চৌকিটায় বসে লোকটার কাজ গুলো আড় চোখে দেখে যাচ্ছে শুধু, তার আগাগোড়া, চলনবলন, এমনকি প্রতিটা মুভমেন্ট বেশ সুক্ষ্ম নজরে পরখ করছে ঈশানী, সেই সাথে প্রতি মূহুর্তে অভিভূত হচ্ছে, না চাইতেও ভেতরে ভেতরে তার প্রতি আকর্ষন অনুভব করতে বাধ্য হচ্ছে।
ঈশানী যখন আড় চোখে এভাবে চোরের মতোন লুকিয়ে লুকিয়ে লোকটাকে একমনে পরখ করছিল, ঠিক সেসময় হুট করে লোকটা না ঘুরেই ঈশানীর উদ্দেশ্য বলে উঠলো,
— আমাকে এভাবে লুকিয়ে দেখা বন্ধ করো।
চরম অ’পরাধ করে ধরা পরে যাওয়ার মতোই হৃদয়টাকে কেউ এক থাবায় খামচে ধরলো ঈশানীর। ও তাড়াহুড়ো চোখ নামিয়ে নিজের শুষ্ক অধর ভিজিয়ে কথা ঘুরানোর প্রয়াসে অস্ফুটে বললো,
— এতো রাতে এখানে রামেন কোথায় পেলেন আপনি?
— আমাকে অযথা প্রশ্ন করোনা, উত্তর পাবে না।
কথা বলতে বলতেই লোকটা এবার রামেনের কাপ সমেত ঘুরে দাড়ালো ঈশানীর দিকে, কাপ দুটো থেকে ভুরভুর করে রান্না করা রামেনের সুস্বাদু সুবাস বেড়িয়ে আসছে,যা ঈশানীর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পাকস্থলীকে দিগুণ ক্ষুদার্থ বানিয়ে দিতে সক্ষম। রামেনের গন্ধে ঈশানী লোকটার দিক থেকে চোখ সরালো ফের। লোকটা এবার এগিয়ে গিয়ে কাপ দুটো স্টাডি টেবিলের উপর রাখলো, সঙ্গে সঙ্গে রাগ অভিমানের পাঠ চুকিয়ে ক্ষুদার্থ ঈশানী এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো চেয়ার পেতে, ঈশানী চেয়ারে বসেছে দেখে লোকটা বিছানার পাশ থেকে একটা বেতের স্টুল টেনে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলো।
ঈশানী তখনও চপস্টিক আর মুখের সাহায্যে গরম রামেনকে ঠান্ডা করার নিদারুন চেষ্টায় মত্ত , তবে মুখে তুলে খাওয়ার আগেই ওর দুনিয়া থমকে দিয়ে আচানক নিজের কালো মাস্কটা খুলে ফেললো লোকটা।
সঙ্গে সঙ্গে ঈশানী যা ভেবেছিল তার চেয়েও দিগুণ আকর্ষন খেলে গেলো ওর নীল মনিযুক্ত দু’চোখের পাতায়। এবার আর লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, অজানা ঘোরের বশে অনেকটা নিঃসংকোচে লোকটার মুখশ্রীর পানে হা করে তাকিয়ে রইলো ঈশানী।
ফায়ারপ্লেসের জলন্ত অগ্নিশিখায় একটা গম্ভীর অথচ ভীষণ সুদর্শন যুবকের ধারালো চোয়াল, তীর্যক ভ্রু জুগল ফিনফিনে পাতলা কালচে বাদামি অধর আর সবচেয়ে আকর্ষনীয় অধর তলায় কুচকুচে কালো তিলক সবকিছুই একঝলকে মুখস্ত করে নিলো ঈশানী। তবুও যেন আগ্রহ দমার নামই নেই। অথচ লোকটা কত নির্দ্বিধায় রামেনে চপস্টিক চালাচ্ছে,মনোযোগী ভঙ্গিমা তার চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে,কাজের মাঝেই ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ঝিলিক দিচ্ছে এক সারি সুগঠিত দন্তরাশি, লোকটা ক্ষনে ক্ষনে দাঁত দিয়ে তার অধর কামড়ে ধরছে, কখনো বা পিয়ার্সিং করা ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে অজান্তেই জিভ দিয়ে গাল ঠেলে ধরছে, আর এই প্রতিটি কাজ বিস্ময়ে পরখ করছে ঈশানী।
কি জানি কেন এতো ভালো লাগছে? এখন তো সন্দেহের পাল্লা আরও ভারী হয়ে উঠলো ঈশানীর।এবার ওর সত্যিই মনে হচ্ছে, এই লোক নির্ঘাত কোনো নামি-দামি সুপারস্টার। নিশ্চয়ই প্রকৃতির সঙ্গে একাকী সময় কাটাতে একটু বিশ্রাম নিতেই চুপিচুপি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে এসেছেন। ব্যাপারটা দারুণ, কারণ আজকাল পাপারাজ্জিদের জন্য সেলিব্রিটিদের কোথাও শান্তি নেই দু’দন্ড, সেদিক থেকে এই আইডিয়াটা মোটেই খারাপ নয়, ওই জন্যই হয়তো কোনোকিছু শেয়ার করায় এতো আপত্তি তার।
—- সে যাই হোক, মনের সন্দেহ আর ভয়টা তো কাটলো এতোক্ষণে, এতো সুদর্শন,আর মেইনটেইনিং মানুষটা যে সাধারণ কেউ হতেই পারেনা সে আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম, কিন্তু উনিকি সিঙ্গেল?
লোকটার মুখোমুখি বসে, তার দিকেই নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে থেকে নিজ মনের এমন নির্ভেজাল প্রশ্নে বেকুব বনে গেলো ঈশানী। পরক্ষণেই নিজের উচাটন মনকে সংবরণ করতে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো ও। ওদিকে খেতে খেতেই ঈশানীকে উদ্দেশ্য করে লোকটা বললো,
—- আমার দিকে হা করে তাকিয়ে না থেকে খাবারে মন দাও।
—কি করে বুঝলেন আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম?
ঈশানীর আচানক প্রশ্নে হুট করেই মাথা তুলে আবারও সেই শূন্য চোখ জোড়া ওর দিকে রি’ভলবার তাক করার মতোই তাক করালো লোকটা।
লোকটার এহেন তীর্যক চাহনিতে আত্মা কেঁপে উঠল ঈশানীর, ও তৎক্ষনাৎ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চোখ নামিয়ে আমতাআমতা করে বলে উঠলো ,
— না মানে, আপনি তো দেখেন নি, অথচ বলে দিলেন।
— ইট’স কল’ড সিক্স সেন্স।
খেতে খেতে জবাব দিলো লোকটা।
ঈশানী মনেমনে পিঠ চাপড়ালো তার, বললো,
— বাবাহ,সেলিব্রিটিদের বুঝি এতো মারাত্মক সিস্ক সেন্স হয়?
সে যাই হোক,লোকটা যেহেতু গম্ভীরতা ছাপিয়ে একটু খানি কথা বলেছে, তাই ঈশানী ভাবলো এই সুযোগে কথা এগোবে ও, যদি কোনোভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়, তাহলে ব্যাপারটা মন্দ হবেনা। তাই এবার নিজ উদ্যোগেই কথা ছুড়লো ঈশানী, রামেনের বাটিতে চুমুক দিয়ে বললো,
— আমি ঈশানী, আ…
কথা শুরু করার আগেই ওর মুখ থেকে বাঁজপাখির মতো ছো মে’রে কথা নিয়ে নিলো লোকটা, বললো,
—-ঈশানী তুজ কর্ণিয়া, কক্সবাজার বংশভূত চিটাগং নিবাসী। খাগড়াছড়িতে মিচুয়াল ফ্রেন্ডদের সাথে হীল হাইকিং এ এসেছো, আপাতত সেখানেই একটা স্থানীয় রিসোর্টে উঠেছো, এ্যম আই রাইট?
শেষ কথাটা বলে ঈশানীর পানে শকুনের মতো তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে তীরের ছিলার মতো এক ভ্রু উচাঁলো লোকটা।
এভাবে গরগর করে অচেনা লোকটার মুখে নিজ বায়োডাটা শুনে কিঞ্চিৎ বিব্রত হলো ঈশানী। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে চট করেই বলে উঠলো,
— এক রাতেই আপনি আমার অনেক খোঁজ খবর নিয়েছেন বোধ করি, কিন্তু আপনার সম্মন্ধে তো কিছুই জানা হলোনা, এবার না হয় আপনার সম্মন্ধে কিছু বলুন?
লোকটা নতুন উদ্যমে আরেকদফা ঈশানীকে অ’পমানের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
—- আমাকে জানতে এসো না, পরে পস্তাবে।
—- তবুও আমি জানতে চাই?
নরম হৃদয়ের মেয়েটার কন্ঠে হুট করেই কোথা থেকে যে এতো দৃঢ়তা এলো তা ঠাওর করতে পারলো না লোকটা, তবে তৎক্ষনাৎ স্টুল ছেড়ে উঠে গিয়ে অন্যদিকে ঘুরে অনুভূতিহীন গলায় সে বললো,
— আগেও বলেছি আবারও বলছি আমি কাউকে কৈফিয়ত দিই না।সো ডোন্ট টক টু মি লাইক দ্যাট।
দেখা হয়েছে থেকে ঈশনীর হৃদয়ে আবেগ জড়ানো সদ্য তৈরী হওয়া অনুভূতিগুলোকে বারবারই এভাবে মুখের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিয়ে অপ’মানিত করছে লোকটা, তবুও কোথায় যেন নিজের আত্মসংযম, আত্মসম্মান সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে ঈশানী প্রতিবারই আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য এগিয়ে গিয়েছে, কারণ ওর মন বলেছে লোকটা উপরে যা দেখায় ভেতরে একেবারেই তা নয়, হয়তোবা স্বভাবের দিক দিয়ে সেও অনেকটা ওর সাথে সদৃশ, যার কিনা উপরিভাগ শক্ত খোলসে আবৃত হলেও ভেতরটা ভীষণ নমনীয় ।
কিন্তু এবার মনে হচ্ছে ঈশানীর সব ধারণাই ভুল, লোকটা সত্যিকার অর্থেই পাষাণ আর নির্দয় প্রকৃতির। নইলে একটা মেয়ে মানুষের সাথে কিভাবে যথাযথ নিয়মে কথা বলতে হয় সেটুকু ভদ্রতা পর্যন্ত জানেনা? নাকি সেলিব্রিটি বলে মনের ভেতরে এতো অহংকার? তাইই যদি হয়, তবে ঈশানীও কম যায়না । ও এবার মনেমনে ঠিক করলো,যতই ভালোলাগা কাজ করুক না কেন, আর যতই তার প্রতি দূর্বলতা বারুক না কেন, ও নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে এই পাষাণ লোকটার সাথে আর একটা কথাও বলবে না কিছুতেই না।
যেই ভাবা সেই কাজ, মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে বসে রইলো ঈশানী। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে, থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, হয়তো বিকেলের মতো ঝড় আসবে আবারও, আর তা নাহলে মুশলধারার বর্ষন হবে নিশ্চিত । ঈশানী যখন একমনে আবহাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, এমন সময় লোকটা বারান্দায় টাঙানো কেরোসিনের ল্যানটার্ন নিভিয়ে দিতে দিতে হাস্কিটোনে বললো,
— রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।
ঈশানী তাই করলো, পরনের হুডিটা টেনেটুনে খানিকটা কাচুমাচু হয়ে চুপচাপ শুয়ে পরলো বাঁশের তৈরি একফালি সিঙ্গেল বেডের উপর।
এখন চারিদিকে পিনপতন নীরবতা, ছোট্ট ঘরটায় কোনোরূপ সাড়াশব্দ নেই আর, কাঠকয়লা জ্বলে গিয়ে আগুন নিভে এসেছে ফায়ারপ্লেসের, যার দরুন চারপাশ নিস্তব্ধ তিমিরে মোড়ানো। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝেই ঈশানী পাশ ঘুরে শুয়ে আছে, ঠিক সে সময় আকস্মিক বিজলির আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে পুরো টং ঘর, দমকা হাওয়ায় ক্ষনে ক্ষনে শাঁই শাঁই আওয়াজ তুলে খোলা বারান্দা ছাঁপিয়ে মেঘ ভেজা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় আসবাবপত্র, সেই সাথে হিমেল হাওয়ার পারদে শিরশির করে ওঠে ঈশুর সর্বাঙ্গ, রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে দাড়িঁয়ে যায় শরীরের সমস্ত লোমকূপ, আর কয়েক সেকেন্ড অন্তর সেই ক্ষনিকের বিজলির আলোতে ওর জ্বলজ্বলে নীলাম্বর চোখের সাথে মিলিত হয় আরও একজোড়া শূন্য বাদামী চোখ। যেই চোখে নেই কোনো অনুভূতি, আর নাতো আবেগ। অথচ অন্ধকারের মাঝে সেই চোখের দৃষ্টি নির্লিপ্তে নিস্প্রভ হয়ে এঁটে আছে শরতের মেঘমুক্ত আকাশের মতোই ঈশানীর গাঢ় নীল চোখে।
ঈশানী কিছুতেই পড়তে পারছে না ওই শূন্য নির্জীব চোখের ভাষা, তবে এই দৃষ্টি ওর অন্তর্স্থলে কেমন একটা ভোঁতা অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে হঠাৎ করে। যার ফলস্বরূপ অন্ধকারের মাঝেই অস্ফুটে একটা বাক্য বেড়িয়ে আসে ঈশানীর কণ্ঠনালী ভেদ করে,
—- আপনার পরিবার….
লোকটা ঈশানীর মুখোমুখি কাউচের উপর বসে ছিল, এখন তার মুখে মাস্ক আবৃত নেই, বরং বিজলির উজ্জ্বল আলোয় তার চিবুকের ওই কালো কুচকুচে তিলকটা কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর জ্বলজ্বল করে উঠছে। ঠোঁটের নিচের তিল যেন তার পৌরষবোধকে দিগুণ আর্কষনীয় করে তুলেছে, যে নারীটা কখনো পুরুষের সৌন্দর্যে আটকায় না সেও বোধহয় এই একরত্তি তিলকের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে বাধ্য, ওমন গৌড় বর্নের পুরুষালী তীক্ষ্ণ চেহারায় একেবারে জুতসই বিউটিস্পট, এমনটা কমই দেখা যায়।
বরাবরের মতোই আলো ছায়ার মাঝে লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আশ্চর্য হয় ঈশানী। যার চেহারা এতোটা সুনিপুণ আর সুদর্শন তার কথাবার্তায় এতোটা তিক্ততা এও কি মানা যায়?
ঈশানীর ভাবনার সুতো ছিড়লো লোকটার গম্ভীর গলায় বলা আরও কিছু তিক্ত কথার পারদে,
—- কতবার বলেছি আমাকে প্রশ্ন করবে না? আর করলেও উত্তর পাবেনা।
ঈশানী অবশ্য এবার আর হতবাক হয়নি, ও এটার জন্য প্রস্তুত ছিল, তাই উত্তর না পাওয়া সত্বেও চুপ হয়ে রইলো। ঈশানী চুপ থাকলেও অপর পাশ থেকে লোকটা কি ভেবে যেন গলাটা কিঞ্চিৎ খাদে নামিয়ে বললো,
— তুমি যেটা শুনতে চাইছো সেটা নেই।
এবার আর অন্ধকারের মাঝেও তাকিয়ে থাকতে পারলো না ঈশানী, ভীষণ রকম অস্বস্তিতে পরে তাড়াহুড়ো করে ঘুরে শুলো অন্যপাশে, অন্যদিকে ঘুরে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে মনে মনে ভাবলো,
— ইশ উনি কি করে বুঝলো আমি আদতে কি শুনতে চেয়েছি? তাহলে কি উনিও বুঝতে পেরেছেন যে আমি আকারে ইঙ্গিতে ওনার লাইফ পার্টনারের কথা জিজ্ঞেস করেছি? আর উনিকি এইমাত্র এটার উত্তরই দিলেন ?
অকস্মাৎ বন্ধ চোখ জোড়া খুলে গেলো ঈশানীর, তৎক্ষনাৎ ঠোঁট কামড়ে ভেতরের নিদারুণ উত্তেজনা সংবরণ করে , পুনরায় লম্বা শ্বাস টেনে স্থির করলো নিজেকে, মনের ভেতর অনেকটা অযাচিত খুশি জমিয়ে, ভেতর থেকে একটা চাঁপা কৌতূহল আর দুশ্চিন্তার অবসান ঘটতেই কখন যে নির্বিগ্নে ঘুমের দেশে পারি জমালো মেয়েটা তার আর ইয়ত্তা নেই।
এরপর যখন ঘুম ভাঙে তখন সূর্য্যি মামা পুব আকাশে অবাধে ঝুরঝুরে সোনালী রোদ ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে। আকাশ পরিষ্কার, যত্রতত্র ধূসর মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে বৈকি তবে তুলনামূলক আজকের আবহাওয়াটা বেশ ভালো। আষাঢ়িয়া বাদলা দিনের অবসান হলো তবে, ঈশানী যতক্ষণে আড়মোড়া ভেঙ্গে চারিদিকে খেয়াল করে ঠাওর করতে পারলো যে ও আসলে কোথায় আছে, ততক্ষণে পুরোদমে রেডি হয়ে কালো মাস্কের আড়ালে নিজের সুদর্শন চেহারাটাকে ঢেকেঢুকে নাম না জানা লোকটা এসে দাড়ালো ঈশানী মুখোমুখি হয়ে। এভাবে হঠাৎ করেই সামনে আসায় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো ঈশানী, ও তাড়াহুড়ো হাতে নিজের এলোমেলো চুল জামা কাপড় সব ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।লোকটার তাতে কোনোরূপ হেলদোল নেই, সে ঈশানীর সামনে দাড়িয়ে হুকুমের স্বরে বললো,
— চেঞ্জ করে নাও, তুমি ফিরে যাবে এখনই।
লোকটার কথায় ঈশানীর যেখানে খুশিতে হাফ ছেড়ে বাঁচার কথা, সেখানে কেন যেন খুশি হতে চেয়েও পারলো না মেয়েটা, উল্টো সকালের রোদের মতোই হাস্যোজ্জল মুখখানা মূহুর্তেই কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পরে গেলো ওর। এক্ষুনি হৃদয়ের ভেতরে কোথাও একটা আনচান করছে,কেন যেন মনে হচ্ছে, এটাই প্রথম আর এটাই শেষ দেখা নয়তো? তাকে কি আর কখনো খুঁজে পাবো আমি? কিছুই তো জানিনা তার সম্মন্ধে, তাহলে?
ঈশানীকে খুব বেশিক্ষণ ভাবতে দিলোনা লোকটা, ভাবনার মাঝেই তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,
— বাইরে ওয়েট করছি,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসো।
ঈশানী অপারগ, আজ এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে এই নির্দয় লোকটার সামনে নিজের অনুভূতি গুলোকে সাজিয়ে প্রকাশ করার সাধ্য সাহস কোনোটাই ওর নেই, অগত্যা নিজের হৃদয়ে হুট করে তৈরী হওয়া এই নামহীন একরাশ অনুভূতির জোয়ার কে হৃদ গহীন সাবধানে চাপা দিয়ে আবারও আপন গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো ঈশানী।
একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রাত যে কতটা দীর্ঘ হতে পারে তা আগে জানা ছিলনা জিসানের। কাল রিসোর্টে ফিরে ঈশানীকে খুঁজে না পেয়ে সারারাত স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে কাটিয়েছে জিসান, পুলিশরা মিলিটারির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও লাভ হয়নি খুব একটা, তারা কিছুতেই ওমন ঝড় বৃষ্টির রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই রেসট্রিক্টেড জঙ্গলে প্রবেশ করতে না’রাজ। অগত্যা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে জিসানকে, সকালে মিলিটারিরা ঈশানীকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বের হলে, তবেই রিসোর্টে ফিরে আসে জিসান, রিসোর্টে ফিরে লবিতে গিয়ে কাউন্টারে বসা চাকমা সম্প্রদায়ের লোকটাকে আকারে ইঙ্গিতে জিসান শুধালো,
— আচ্ছা ঈশানী কি ফিরেছে?
লোকটা কাল থেকেই এদের কাহিনী পর্যবেক্ষন করছে, কিছুটা আন্দাজ ও করেছে বটে, যার দরুন বুঝতে পেরেছে যে এদের মধ্যে কেউ একজন নিখোঁজ, তাই তিনি তৎক্ষনাৎ না সূচক মাথা নাড়িয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন,
— তিনি ঈশানীকে ফিরে আসতে দেখেন নি।
লোকটার কথায় নিরাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে গেলো জিসান। সে সময় লাউঞ্জের বিশাল মনিটরে সকালের শিরোনাম দেখানো হচ্ছিল, যেখানে একজন সুশ্রী সংবাদ পাঠিকা অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন একের পর এক এক্সক্লুসিভ সংবাদ। জিসান ও বেখেয়ালে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, তবে হুট করে একটা পর্যায়ে এসে সংবাদ পাঠিকা বলে ওঠেন,
— আশংকা মুক্ত নয় বাংলাদেশ।
কর্ণকূহরে বাক্যটা পৌঁছাতেই সচকিত হয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখলো জিসান, দেখলো কালো মাস্ক, কালো বেসবল ক্যাপ,কালো হুডি মোট কথা আগাগোড়া কালো দিয়ে আবৃত একটা মানুষের ঝাপসা অবয়ব। বিভিন্ন জায়গা থেকে গোপনে তোলা বেশ কিছু ছবি ভাসছে টিভির পর্দায়। সেগুলোকে উদ্দেশ্য করে সংবাদ পাঠিকা বলছেন,
—- এক গোপন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গিয়েছে বিশ্বের ইয়ং মাফিয়া টেরোরিস্ট গ্রুপ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভ’য়ংকর মাফিয়া ত্রাশ গ্রুপের লিডার এরীশ ইউভান বেশকিছু দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। প্রায়শই দেশের অলিতে-গলিতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে তাকে, ধারণা করা হচ্ছে কোনো গোপন মিশনকে কেন্দ্র করে তার এই হঠাৎ আগমন, যদিও এরীশ ইউভান বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তবুও তার মিশন এবং উদ্দেশ্য নিয়ে তদন্ত করছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা এন এস আই।
জিসান এটুকু দেখতে না দেখতেই ওর ফোনে কল এলো, ফোনটা রিসিভ করে কানে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে মৃণালিনী চেচিঁয়ে বলে উঠলো,
— এক্ষুনি উপরে আয় জিসান।আমরা ঠিক চিনতে পারছি না ওকে।
মৃণার কথা শুনে জলদি উপরে ছুটে গেলো জিসান, গিয়ে দেখলো পেছনের বারান্দায় উঁকি দিয়ে কি যেন দেখছে ওরা সকলে, জিসানও কৌতুহল বশত তাড়াহুড়ো এগিয়ে গেলো সেখানে, অতঃপর সবাইকে সরিয়ে নিচের দিকে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো রিসোর্টের পেছনের গেইট বরাবর জঙ্গলের রাস্তায়, যেখানে সাধারণ মানুষ যাতায়াতে সরকারের কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, ঠিক সেই রাস্তায় একটা ছাঁদ খোলা জিপ দাঁড় করানো, যেখানে বসে আছে কালো মাস্ক আর হুডি পরিহিত একটা লোক, আর ঈশানী অক্ষত অবস্থায় জিপের সামনে দাড়িয়ে কি যেন কথা বলছে লোকটার সঙ্গে। বাইরের আবহাওয়া ইতিমধ্যে বর্ষায় রূপ নিয়েছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হচ্ছে, অথচ বৃষ্টির মাঝেই কি অবলীলায় দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী।যেন এই মূহুর্তে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগানোর চেয়েও লোকটাকে সময় দেওয়া বেশি জরুরি।
এদিকে জিসান ঈশানীকে দেখলো তো ঠিকই, তবে পরমূহুর্তেই গাড়িতে বসে থাকা লোকটার পানে নজর বুলিয়ে আঁতকে উঠে অস্পষ্ট সুরে বললো,
—- এরীশ ইউভান!
রিসোর্টের সামনে জিপ থামাতেই নেমে পরে ঈশানী, যাত্রা পথে একটা কথাও আর হয়নি দুজনার, ঈশানী যদিও বা আগ বাড়িয়ে কিছু শুধিয়েছে তবে প্রতিপক্ষ থেকে বরাবরই একই প্রত্যুত্তর ভেসে এসেছে,
— আমি কাউকে কৈফিয়ত দিইনা।
কাল রাত থেকে এই একটা বাক্য কতবার যে ঈশানীর আত্মসম্মানের ভীত টলিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, তবুও যাত্রা শেষে জিপ থেকে নেমে অন্তিম বারের মতো ধরা গলায় ঈশানী বলে ওঠে,
— আমি জানি যে আমি আপনার বিশ্বাসযোগ্য নই, তবুও শেষ বারের মতো একটা আর্জি, আপনার নামটা অন্তত বলে যান।
লোকটা মাস্কের আড়াল থেকে রাশভারি আওয়াজে বলে উঠলো,
— আর কখনো মুখোমুখি হবোনা আমরা তাহলে নাম জেনে কি করবে?
এই ভয়ংকর সত্যি কথাটা খুব করে এরিয়ে যেতে চেয়েছিল ঈশানী, কিন্তু পারলো না, সামনে বসে থাকা অনুভূতিহীন পাষাণ লোকটা কত সহজেই না বলে দিলো এই নিদারুণ পীড়াদায়ক সত্যিটা। যদিও ঈশানীর চোখ দুটো জ্বলছে খুব, গলাটাও কেমন ধরে এসেছে, তবুও বহু কসরতে আওয়াজ বের করে কন্ঠনালী খাদে নামিয়ে ও বললো,
—পৃথিবীটা গোল, কখন কার সাথে কিভাবে দেখা হয়ে যায় তা কেউ আগে ভাগে বলে দিতে পারেনা, আপনিও পারবেন না।
—- তারমানে তুমি চাইছো যে তোমার সাথে আমার আবার দেখা হোক তাইতো? উইশ ফর ডে’ঞ্জার, হাহ?
বাইরে বৃষ্টির তোপ বেড়ে যেতেই ব্যাকসিট থেকে নিজের হুডিটা ঈশানীর মাথায় ছুড়ে মে’রে কথাটা বলে ওঠে সে।
লোকটা কৌশল জানে বলতে হবে, হুডিটা মেলে গিয়ে একেবারে ঈশানীর শরীর ঢেকে গিয়েছে। ঈশানী শুধু ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,শরীরে কথা বলার শক্তি অবশিষ্ট নেই,মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে এক্ষুনি, কারণ ইতিমধ্যে লোকটা নিজের আন্ডারকাট চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতেই জিপ স্টার্ট দিয়েছে।
অবশেষে ওদের একরাতের কাহিনির ইতি টেনে লোকটা চলেই যাচ্ছে, পাছে শুধু ঈশানীর জন্য রেখে যাচ্ছে এক ব্যথাতুর নীল হৃদয়,একঝাক নামহীন অসহায় অনুভূতি আর সবশেষে একসমুদ্র আবেগের প্লাবন।
—- বাই দ্য ওয়ে আমি অরন্য।
আচমকা সেই ডিপ হাস্কিস্বরটা কানে এসে লাগতেই ঝোঁকের বশে সামনে দৃষ্টিপাত করলো ঈশানী, দেখলো অরন্য ইতিমধ্যে তার জিপের ভারী চাকায় পিচ ঢালা ভেজা রাস্তার নুড়ি পাথর পিষে দিয়ে ঈশানীকে ছাড়িয়ে অনেকটা পথ চলে গিয়েছে।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫
ঈশানী শুধু নির্বাক হয়ে দেখলো, দেখতে দেখতে এতোক্ষণের বহু কষ্টে দমিয়ে রাখা অশ্রুকনা টুকু কখন যে ওই অচেনা লোকটার নামে বিসর্জন দিয়ে দিলো সে কথা বলা বাহুল্য। অশ্রু জলে যখন সামনের দৃশ্যপট আর নীলাম্বর চোখের কোটর জোড়া পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে এলো তখন আবারও নিঃশব্দে আঁখি পল্লব বুঁজে এলো ওর।
এতো সমীকরণ মিলিয়ে কি লাভ? তারচেয়ে থাকনা এমন একটু আধটু না পাওয়ার য’ন্ত্রনা। এই য’ন্ত্রনাটুকুর জন্য হলেও সে হৃদ গহীনে এক আধার রাতের তরতাজা স্মৃতি হয়ে থেকে যাক সারাজীবন।