আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৭
suraiya rafa
কক্সবাজার, বাংলাদেশ
সন্ধ্যাকাশে নক্ষত্রের ঝিলিক, উদয় হয়েছে রুপোলী থালার মতো মস্তবড় চাঁদ। যেন সমগ্র ধরণী জুড়ে নিরঙ্কুশ পূর্ণিমা বিলাতে সবর্দা নিয়োজিত তারা। প্রকৃতি করছে জোৎস্না স্নান। মফস্বল শহরের আশেপাশে বেড়ে ওঠা বিস্তৃত ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা নিশাচর ডাহুকের সরব কলতান জানান দিয়ে যায় শুভরাতির।
আজ রাতটা সত্যিই শুভ। কারণ আজ পূর্ণতার গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়তে চলেছে দু’টো ছন্নছাড়া প্রাণ। দু’টো ভিন্ন মানসিকতার মানুষ, যাদের লক্ষ্য, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, উদ্দীপনা সবকিছু আলাদা,তবুও আজ এই মাহেন্দ্রক্ষণে নিয়তির জোরে একীভূত তারা। সময়ের পরিক্রমায় হতে চলেছে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের।
পৃথিবীটা নিষ্ঠুর, সবসময় স্রোতের অনুকূলে বয়ে চলা তার কম্ম নয়। নিঝুমের ক্ষেত্রেও পৃথিবী তার নির্মমতা দেখাতে কার্পন্যতা করেনি বিশেষ। ও হেরে গেছে,সমাজ, পরিবার, দ্বায়িত্ববোধের তাড়নায় বির্সজন দিয়েছে নিজের সুপ্ত অনুভূতির ঠুনকো শহরকে । অবশেষে মেনে নিয়েছে নিজের ভবিতব্য। অথচ আজ এই সুসজ্জিত পরিনতির রাতেও তার নির্ঘুম,নিশাবসান ভেজা অক্ষিদ্বয় সর্বত্র খুঁজে চলেছে এক বেপরোয়া বেলাগাম মানবের অস্তিত্বকে, কিন্তু কে সে!
— এ্যাই নিঝুম জলদি বাগানে আয়।
কর্ণকূহরের সন্নিকটে অদ্ভুত স্বরে হিসহিসালো এক নারীকণ্ঠ। চকিতে পেছনে ঘুরে তাকালো নিঝুম, স্ফটিকের লাইট গুলোর আড়ালে স্টেজের একদম পেছনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চোখের ইশারায় ডাকছে ওকে ঈশানী। বান্ধবীর অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে মেয়েটা ভড়কালো কিঞ্চিৎ। ইতিউতি দৃষ্টি বুলিয়ে ফের ইশারায় জানান দিলো,
— আসছি দাঁড়া।
স্বস্তিতে হাঁফ ছাড়লো ঈশানী, তড়িঘড়ি করে অদৃশ্য হলো তমশায়। ন্যানো সেকেন্ড অতিবাহিত হলোনা, তন্মধ্যে অতর্কিত এক পুরুষালি করতলের শক্ত মুঠোয় কব্জি বন্দি হলো মেয়েটা। লোকটা হ্যাঁচকা টানে অন্ধকার থেকে ফকফকে আলোর মাঝে এনে সটান দাঁড় করালো ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ঈশানী, ঝাপসা দৃষ্টি খানিক স্পষ্ট হতেই মেজাজ হারিয়ে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে সে। ক্রোধে ফুঁসে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাক্য ছোঁড়ে বিপরীত পক্ষ,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— আর ইউ ওকে?
শান্ত নদীর মতো নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর। থমকালো রমণী, ভ্রুজুগল কুঞ্চিত করে স্বগোতক্তিতে আওড়ালো,
— মাহিন!
— ফেইরী লাইটের লাল নীল আলোয় সমগ্র বাড়ি ঝকঝক করছে, আর তুমি এখানে স্টেজের পেছনে অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছিলে? ধান্ধা কি হুম!
মাহিনের কন্ঠে কৌতুক। এদিকে বিভ্রাটে পরে গেলো ঈশানী, যার তার সাথে মশকরা করা ওর ধাঁচে নেই। অগত্যা বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো,
— বাজে কথা বলবেন না, নিঝুম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
— আচ্ছা।
অস্বস্তি আর উদ্বেগের মিশেলে হাসফাস করছে ঈশানী, পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ার মন হলোনা ওর। এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করতে লাগলো নির্লিপ্তে। ফের আগ বাড়িয়ে বাক্য ছুঁড়লো মাহিন,
— আই হোপ সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তুমি এখন ভালো আছো।
দৃষ্টি এবার সম্মুখে স্থির করলো ঈশানী। মাহিনের ঈষৎ বাদামী চুল গুলো এখন পুরোপুরি কালো। সিল্কি ভীষণ। স্ফটিকের তীর্যক রোশনাই এ চিকচিক করছে সেগুলো। সর্বদা মেইনটেইন মডেলিং ফিগারটা খানিক স্বাস্থ্যবান হয়েছে, বাঙালি বলে কথা। সুনিঁপুণ গৌড় চেহারাখানা হাস্যোজ্জ্বল সর্বদা, দৃষ্টি জুড়ে চঞ্চলতার সুগভীর ছাপ। সুদর্শন মুখাবয়বখানি এক লহমায় পরখ করে নিলো ঈশানী,পরপরই ধ্বনিত হলো তার কাটকাট মেয়েলী কণ্ঠস্বর,
— আপনি কি কোনো কারণে আমায় নিয়ে চিন্তিত মাহিন?
স্মিত হেসে মাথা নাড়ালো মাহিন, হেয়ালির স্বরে আওড়ালো,
— একটা রাশিয়ান স্মাগলারের সাথে রয়েছো, চিন্তা তো হবেই। বলা তো যায় না, সুন্দরী রমণীর পাশাপাশি দেশ থেকে আর কি কি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নেয় ডেভিল টা।
এরীশ একটা সত্যিকারের ডেভিল,নৃ’শংস ব্লাডিমনস্টার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে ভালোবেসে পাপ করেছে ঈশানী, সমাজের চোখে আখ্যায়িত হয়েছে অন্যায়কারী নামে । তবুও মাহিনের মুখে এরূপ সম্মোধন খুব একটা পছন্দ হলোনা ওর। যার দরুন অভিব্যক্তিতে রূঢ়তা টানলে মানবী, শক্ত কণ্ঠে বললো,
— স্টক করেন আমাকে?
এবারও নৈঃশব্দ্যে হাসলো মাহিন, সে হাসিতে জড়ো হলো উপচে পড়া স্নিগ্ধতা, পরপরই মলিন হয়ে এলো অভিব্যক্তি । যেন হৃদয়ের টানাপোড়েনে ভীষণ ক্লান্ত সে, তেমন করেই মিলিয়ে গেলো সেই স্নিগ্ধ হাসির রেখা, অধর ভাঁজে ধরা দিলো মেকি আড়ষ্টতা। আপসোসের স্বরে বলে উঠলো ,
— তুমি কতোটা ভালো আছো সেটা বোঝার জন্য স্টক করার প্রয়োজন পড়ে না আমার, তোমার এই আকর্ষনীয় উজ্জ্বল মুখটাই আমাকে আস্বস্ত করার জন্য যথেষ্ট। স্টক তোমার মাফিয়া বসের কাজ, আমার নয়।
— মানে?
— ইউ বিকাম মাচ মোর বিউটিফুল দ্যান বিফোর। একমাত্র ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে থাকলেই মানুষ এতোটা গ্লো করে। জানোতো নিশ্চয়ই!
ঠোঁট উল্টে অভিবাদন জানালো মাহিন। এতোক্ষণে সংবিৎ ফিরলো ঈশানীর। মেয়েটা চমকে উঠে দূরত্ব বাড়ালো দু’কদম। সমুদ্রাগত বাতাসের তোড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে কানের পাশে গুঁজতে গুঁজতে চারিপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টি বোলালো একপল।কণ্ঠে বিরোধ টেনে বললো,
— আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান মাহিন। দ্রুত!
চওড়া কপাল জুড়ে কয়েক স্তর ভাঁজ পড়লো মানবের। হতবাক হয়ে বললো,
— চলে যাবো মানে! বিয়েই তো সম্পন্ন হলো না।
— যা বলছি তাই করুন, বেঁচে থাকলে আরও অনেক বিয়ে খেতে পারবেন।
ঈশানীর কথার প্রত্যুত্তরে ঝাঁঝিয়ে উঠলো মাহিন, কঠোর স্বরে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ঈশানীর আঙুলের ভাঁজে বৃহত এক ক্রিস্ট্যালের ঝিলিকে দৃষ্টি নমনীয় হয়ে এলো ওর। পাথরের উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে ওঠার উমক্রম। চমৎকার কারুকাজ শোভিত পাথরের অভ্যন্তরে টলমল করতে থাকা একফোঁটা র’ক্তিম তরল স্পষ্ট জানান দেয় এর দুস্পাপ্যতার। কৌতূহল দমাতে পারলো না মাহিন, বিস্মিত কণ্ঠে শুধালো,
— এটা কি!
ঈশানী তৎক্ষনাৎ করতলের ভাঁজে আড়াল করে ফেললো আংটিটা। সরু গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরেকদফা প্রশ্ন ছুড়লো মাহিন,
— ডিড ইউ গাইস গেট ম্যারেড?
রমণীর দৃষ্টি পায়ে।সংকীর্ণতায় ভুগছে ভীষণ, কি থেকে কি বলবে। একটা দূধর্ষ মাফিয়া বসকে বিয়ে করা নিশ্চয়ই কোনো মানবিক কাজ নয় । ওদিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টে স্পষ্ট চেয়ে আছে মাহিন। তার আর ঈশানীর মধ্যবর্তী দূরত্বের প্রাচীরটা ঠিক কতখানি প্রগাঢ় তা জানতে ভীষণ আগ্রহী যুবক। তন্মধ্যে আচানক ওদের মধ্যে এসে হাজির হলো নিঝুম, মাহিন কে জুতসই খেয়াল না করেই ঈশানীর হাত প্যাঁচিয়ে ধরে বললো,
— চল।
হতচকিত হয়ে দৃষ্টি ঘোরালো ঈশানী, নিঝুমকে দেখে স্বস্তি পেলো খানিক। মেয়েটার হাত ধরে বিনাবাক্যে জায়গা ত্যাগ করলো তৎক্ষনাৎ, যেতে যেতে কি ভেবে যেন পেছনে তাকালো একপল। এখনও নিস্প্রভ বদনে চেয়ে আছে মাহিন, নিরুদ্বেগ নীল ব্যথায় জর্জরিত আহত দৃষ্টি তার, দেখলেই কেমন মায়া জাগ্রত হয় অন্তরে। ঈশানীর ও হলো, সহসা যেতে যেতে বাক্য ছুড়লো গলা চিঁড়ে,
— চলে যান মাহিন, দ্রুত চলে যান।
স্ফটিক সজ্জিত লোকে সরগরম বাড়িটার পেছন দিকের বাগানটা ছেয়ে আছে তমশায়। পুরোপুরি নীরব চারিপাশ, যেন অফুরন্ত আনন্দের মাঝে একটুকরো অশুভের হাতছানি। আধার মিশ্রিত জমিনে শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ স্পষ্ট জানান দেয় এক অপ্রত্যাশিত অস্তিত্বের উপস্থিতি। তৎক্ষনাৎ সচকিত হয়ে ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিলো নিশাচরের দল। ঝিঁঝিপোকার কলরব মলিন শোনাচ্ছে ভীষণ। ওরাও বোধ হয় ভীতিগ্রস্ত এখন।
আলোআঁধারির মাঝে স্থির দাঁড়িয়ে অবয়বটি, নৈঃশব্দ্য তার পদধ্বনি। কোনো এক অদৃশ্য বিনে সূতোর টানে নিস্প্রভ নিদারুন কৃষ্ণগহব্বর আঁটকে আছে তার আলো ঝলমলে তন্দ্রা ভিলার পানে।
খানিকবাদে সেখান উপস্থিত হয় আরও দু’টো নারী অস্তিত্ব। অদূর থেকে আগত একফালি নিয়ন আলোয় স্থির মানবের দৃষ্টি জুড়ে ভেসে ওঠে এক লাল টুকটুকে রাঙা বধুর মুখাবয়ব।
এতোক্ষণে অক্ষিপল ছাড়লো সে মানব। তাকে দেখা মাত্রই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো ক্রন্দিত রমণীর ভঙ্গুর কণ্ঠস্বর,
— তুষার!
কিঞ্চিৎ টললো না যন্ত্রমানব, হৃদয় তার রিক্তশূন্য, আবেগ অনুভূতিহীন নিস্প্রাণ অভিব্যক্তি। চাতকের মতো চেয়ে রইলো শুধু, ওমনি বেগতিক হয়ে ছুটে এলো নিঝুম, কাছাকাছি আসা মাত্রই খেই হারিয়ে দু’হাতে জড়ালো মানুষটিকে, অতর্কিতে মাথা ঠেকালো তার নির্জীব বক্ষে। প্রথম এবং শেষ বারের মতো।
কারোর মুখে রা নেই। উন্মাদের মতো কাঁদছে নিঝুম, তুষারের শার্টটাকে খামচে ধরে রেখেছে একহাতে, যেন ছেড়ে দিলেই উড়ে পালাবে সে মানব। অথচ মূর্তিমান তুষার। হাত দু’টো এখনো পকেটেই আবদ্ধ তার। ক্রন্দিত নিঝুমের অসহায় অনুভূতি গুলোকে ভেতর থেকে উপলব্ধি করতে পারছে না সে। পারার কথাও নয় অবশ্য, কারণ মাফিয়ারা কখনো প্রেমে পড়েনা, তারা আসক্ত হয়।
অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে অতিবাহিত হলো কিছু মূহুর্ত। অবিরত ক্রন্দনে দিশেহারা নিঝুম, এরই মাঝে ধ্বনিত হলো যান্ত্রিক মানবের রাশভারি কন্ঠস্বর,
— মানুষের চোখের জল এতো তুচ্ছ হলো কবে থেকে?
— আপনি আর আসেন নি তুষার, কোনোদিন আসেন নি।
ক্রন্দিত মানবী মুখ খুললো এতোক্ষণে। তুষার বললো,
— অপেক্ষা করতে ও বলিনি। আগেও বলেছি তোমায়, আমি ভিলেইন। বাস্তবতার উর্ধ্বে আমার বিচরণ।
আবেগের তোড়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য নিঝুম, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
— যে গল্পে আপনি ভিলেইন, সে গল্পে হিরো চাই না আমার তুষার।
— বিয়ে, ভালোবাসা, সংসার এসব আমার জন্য নয়। নিজেকে সামলাও নিঝুম, আজ এখানে এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে ভুলে যাও আমার অস্তিত্ব।
শক্ত স্থবির মুখাবয়ব। নির্দ্বিধায় বাক্য উগরে দিলো তুষার। নিঝুম ডুকরে কেঁদে উঠলো ফের,
— এতো সহজে বলে দিলেন?
— নিজের অশুভ ছায়া ফেলে কারোর জীবনে অনিষ্ট সাধন করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
— আর আমার অনুভূতির কি হবে?
— ওটা একপাক্ষিক, তাই মাটি চাপা দিয়ে দাও।
শেষ! এতোগুলো দিন ধরে এই একটা প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষাতেই দিন গুনেছিল মেয়েটা । অবশেষে মুখ খুললো যন্ত্র মানব। একাবাক্যে সুচারু তীরের ফলার মতো ক্ষ’তবি’ক্ষত করে দিলো নাজুক অন্তরটাকে। সঙ্গে সঙ্গে বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা যাতনায় কাতরে উঠলো নিঝুম। প্রবল দৃঢ়তায় খামচে ধরলো তার বুকের কাছের সিল্কি শার্টখানি, সেখানটায় ক্রমাগত কিলঘুষির বর্ষণ ছেড়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো রমণী, কান্নার তোড়ে এক লহমায় ঘেটে গেলো তার সুশ্রী বধূ সাজ। দিশেহারা চিত্তে আওড়াতে লাগলো ব্যথাতুর প্রলাপ,
— এভাবে শেষ করে দিলেন! এভাবে! আপনি নিষ্ঠুর তুষার। আপনার মতো পাষাণ আমি দু’টো দেখিনি।কত সহজেই না ফিরিয়ে দিলেন আমায়, অথচ আপনার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো ছিল ভীষণ নাজুক। আমার এক জীবনের প্রথম ভালোলাগা আপনি। কতো যত্নেই না সাজিয়েছিলাম অদৃশ্য এই মায়া কানন । ভেঙে দিলেন, আপনার এক কথায় সব শেষ হয়ে গেলো তুষার, সব শেষ।
ফের অসহায় ক্রন্দনে ভারী হয়ে এলো চারিপাশ। নিস্তব্ধ প্রকৃতি, মেয়েটার হৃদয়ছেঁড়া আকুতি মিনতি যেন প্রস্তর টলিয়ে দিতে সক্ষম, অথচ টললো না যন্ত্রমানব। বিয়ের আসর থেকে ছুটে আসা এক নববধূর শেষ আকুতিটুকু ছুঁতে পারলো তার হৃদয়, দিনশেষে একপাক্ষিক ভালোবাসার বেদনায় নীল হলো রমণী, তবুও দয়া হলোনা মানবের। পাষাণ বুঝি একেই বলে!
বাগানের শেষ মাথায় যেখানে গেইট নামক প্রাচীরের আস্তরণ ছাড়িয়ে দৃষ্টি সোজা পিচঢালা রাস্তায় গিয়ে মিলেছে সেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল ঈশানী। নিস্তব্ধতায় ঘেরা শুনশান রজনীতে প্রিয় বান্ধবীর ব্যথাতুর ক্রন্দনে হৃদয়ে র”ক্তক্ষরণ হচ্ছে ওর। ভীষণ কসরতে ঠোঁট কামড়ে কান্নার আওয়াজটুকু গিলে রেখেছে ঠিকই, তবে নয়নজোড়া তার বাধাহীন। অবিরত নোনতা জলস্রোত বইছে সেথায়, ফোপাঁতে ফোপাঁতে দিশেহারা ঈশানী,ভেতরতা অস্থির হয়ে আছে, হাসফাস লাগছে ভীষণ । কেন ভালোবাসার কাছে মানুষ এতো অসহায়? বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব এমনকি আত্মসম্মানটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই অদৃশ্য অনুভূতির পদতলে।
খুব বেশি ভাবতে পারলো না ঈশানী, ভার হয়ে এসেছে বুকটা, হৃদযন্ত্র নিয়ন্ত্রণহীন, এমতাবস্থায় জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা প্রকট, অন্তরের তাড়নায় বিচলিত হয়ে চারিদিকে দৃষ্টি বোলাতে লাগলো মেয়েটা, যেন কাউকে দেখতে পাওয়ার ক্ষুদ্র আকাঙ্খা। হলোও তাই,
পিচঢালা সরু রাস্তার শেষ প্রান্তে যে স্ট্রিট লাইটটা হলদে আলো ছড়াচ্ছে চারিপাশে, তার ঠিক নিচে সোজাসোজি দণ্ডায়মান এক দীর্ঘদেহী পুরুষালি অবয়ব। কালো হুডিতে আবৃত তার সমগ্র শরীর, আস্তিনখানাও টেনে রাখা মাথার অগ্রভাগে, যার দরুন মুখাবয়ব অস্পষ্ট তার। প্রস্তর খণ্ডের ন্যায় স্তব্ধ সে, দু’হাত পকেটে আবদ্ধ। ঝাপসা দৃষ্টে লোকটাকে পরখ করলো ঈশানী, তাকে দেখা মাত্রই মানবীর অস্থির দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো অকস্মাৎ। দেরী করলো এক মূহুর্তও, ছুট লাগালো উর্ধ্বশ্বাসে। নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে পদতলে মারিয়ে স্রোত তরঙ্গের ন্যায় আঁচড়ে পড়লো ইস্পাত কঠিন বক্ষস্থলে। গতিজড়তার ফলে ঈশানীর সংস্পর্শে কিঞ্চিৎ প্রকম্পিত হয়ে উঠলো পুরুষালি অবয়বটি। ভড়কালো না ঈশানী, দু’হাতের বাঁধনে প্রগাঢ় দৃঢ়তা টেনে আঁকড়ে ধরলো সুডৌল পৃষ্ঠদেশ। ফুঁপিয়ে উঠে আওড়ালো,
— অরণ্য, ও অরণ্য।
নিস্তব্ধ বিপরীত পক্ষ, এদিকে হাঁপড়ের মতো বেড়ে চলেছে হৃদস্পন্দন। হারানোর ভয়ে শঙ্কিত রমণী, ভেতরটা কুরকুরে খাচ্ছে অনিশ্চয়তা। ফের ধ্বনিত হলো ব্যাকুল ক্রন্দিত বাক্যবহর,
— আমি বাস্তবতা বুঝিনা, আমার তোমাকে চাই। দুনিয়ার দোহাই দিয়ে আমায় কখনো ছেড়ে দিয়োনা এরীশ,আমি সইতে পারবো না ,দ্বিতীয়বার প্রতারিত হওয়ার সাহস আর অবশিষ্ট নেই ভেতরে । বিশ্বাস করো ম’রে যাবো। আ…
বাক্য সম্পন্ন হলোনা ঈশানীর, তার আগেই ব্যগ্র থাবায় ওর সরু গ্রীবাদেশ খামচে ধরলো এরীশ। ক্ষুধার্থ সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
— এ্যাইইই! বারবার শুধু ম’রার কথা কেন বলিস! আমি একবারও বলেছি তোকে ছেড়ে দেবো? তুই ম’রে গেলে আমি বাঁচবো ভেবেছিস! কি মনে হয়?
অযাচিত কারণে মাফিয়া বসটা রেগে আছে ভীষণ, ধূসর বাদামি চোখ দু’টোতে তার দাউদাউ করছে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি,যা দেখা মাত্রই কুণ্ঠায় থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো রমণীর তনু অস্তিত্ব।
— আমাকে রেখে ম’রেও শান্তি নেই তোর, কথাটা মাথায় রাখিস।
ফের ধ্বনিত হলো রাশভারি কন্ঠস্বর। তবে সেই আওয়াজ আদৌও ঈশানীর কর্ণগোচর হলো কিনা সন্দেহ। মাত্রাতিরিক্ত অবসাদগ্রস্ততায় চেতনা হারিয়ে শরীরের সমগ্র ভার ছেড়ে দিলো মাফিয়া বসের উপর। অবচেতন ঈশানীকে বুকের মধ্যস্থলে পিষে নিলো এরীশ, চোখ বুঝে তপ্তনিঃশ্বাস ছেড়ে স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো,
— আ’ম স্যরি।
শুনশান নীরবতায় গুমোট হলো পরিবেশ। খানিক বাদে ফোনের ভ্রাইব্রেট আওয়াজে ধ্যান ভাঙে এরীশের, একহাতে ঈশানীকে সামলে, অন্যহাত দ্বারা কানে এয়ারবাড প্রবেশ করায় সে,
সেন্সরে আঙুল চালিয়ে ফোনকল রিসিভ করে অপরপ্রান্তের কথাগুলো শুনে গেলো নৈঃশব্দ্যে। পরপরই ধ্বনিত হলো তার রুষ্ট আওয়াজ,
— সন অব অ্যা বিচ!শালা কই মাছের প্রাণ।
আবারও কিছু একটা অবগত করলো বিপরীত পক্ষ, যা শোনা মাত্র ঠোঁটের কোণে কপট হাসির আলোড়ন তুললো মাফিয়া বস। দাঁতে দাঁত পিষে আওড়ালো,
— এবার হাত দু’টো গিয়েছে, পরের বার প্রাণটাও যাবে। যাস্ট টেইক আ ব্রেথ।
কল কেটে গেলো। অথচ হিংস্র অভিব্যক্তিতে লাগাম টানলো না এরীশ, হিসহিসিয়ে বলতে লাগলো,
— হার এভরি সিঙ্গেল টাচ অনলি বিলোংস টু মি। এই মেয়েটাকে শুধু আমি ছুঁবো, অন্য কেউ না!
পরমূহুর্তেই নিয়ন্ত্রণহীন ঈশানীকে আলগোছে কোলে তুলে নিলো সে। নির্ঝঞ্ঝাট নিবিড়, নীলাচল ধরে এগোতে এগোতে দৃষ্টিপাত করলো রমণীর সুশ্রী বদনে। জোৎস্না জড়ানো চাঁদের আলোটুকু ঠিকরে পরছে চেহারায়, যেন স্নিগ্ধ এক সদ্য অঙ্কুরিত ফুলের কুড়ি। পেলব গমরঙা মুখখানি থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে অদ্ভুত মায়া, শরীরে মিষ্টি সুঘ্রাণ। তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় সেই মায়াটুকু দৃষ্টি দিয়ে গ্রাস করে মাফিয়া বস। হাঁটতে হাঁটতে একাই বিড়বিড়ায়,
— তোমার দূর্বল হৃদয়ের প্রতিটি হৃদস্পন্দন শুধুমাত্র আমার নামে হোক, আর যদি তা না হয়, তবে আমার হাতেই তোমার মৃ’ত্যু হোক। প্রেম আমার!
প্রাণহীন নির্জীব দৃষ্টি, গন্তব্যহীন পদধ্বনি, অথচ হৃদয়ের কোণে ঝঙ্কার তুলেছে অদ্ভুত প্রণয়ের শিহরণ ,
রাতদিন,
চেনা তুমি ছিলে অচেনা।
অন্তহীন,
মনে হতো মিষ্টি যন্ত্রণা।
সেই ব্যথা উঠলো সেরে চোখেরই চাওয়ায়….
আমি শুধু চেয়েছি তোমায়
আমি শুধু চেয়েছি তোমায়।…..
— রাতে খেয়ে যেও।
নিঝুম চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তুষার দাঁড়িয়ে ছিল নির্লিপ্তে, একমনে মিলিয়ে যাচ্ছিল হাজারটা অসমাপ্ত সমীকরণ। অবশেষে যখন সমাধান মিললো না, তখন নিরাস চিত্তে হাঁটা ধরলো ফিরতি পথে। তন্মধ্যে এক চেনা নারীকণ্ঠস্বর বজ্রের মতো কানে বাজলো তুষারের, অকস্মাৎ থমকালো পদধ্বনি। জন্ম থেকেই মেশিনের মতো যান্ত্রিক তুষার, ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রের ন্যায় গন্তব্যহীন ছুটছে অবিরত, অথচ এই প্রথমবার গতিবেগে টান পড়লো যেন। শরীরের প্রতিটি ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পরলো মানবের। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সম্মুখে এগোতে পারছে সে, অগত্যা গ্রীবাদেশ বাঁকিয়ে ঘুরলো পেছনে।
আলোআঁধারি দৃশ্যজুড়ে ভেসে উঠলো কালো পাড়ের সাদা জামদানী পরিহিত এক অভিজাত্য মধ্যবয়স্কা রমণীর মুখাবয়ব। থমথমে গুমোট তার অভিব্যক্তি। কণ্ঠনালি ধরে এসেছে তুষারের, জিহ্বা হয়ে পরেছে অসার, কেবল রমণীর পানে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যালিয়ে, অপ্রত্যাশিত ভাবে চোখদুটো টলমল করছে তার, যেন এদিকওদিক হলেই গড়িয়ে পড়বে তপ্ত নোনাজল। তুষার চায় না এহেন অনিষ্ট হোক, তাই দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে জুতসই সামলে রেখেছে নিজেকে। একই উদ্যমে ফের ভেসে এলো বাক্য,
— রাতে খেয়ে যেও।
— খে…খেয়েছি।
ছোট্ট করে উত্তর দিলো তুষার। আপন সত্তা লুকানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস। ভদ্রমহিলা নির্বিকার, যেন আর কিছুই বলার নেই তার। প্রস্থান করার প্রয়াসে বিনাবাক্যে হাঁটা ধরলো তুষার তখনই পেছন থেকে আরেক দফা কথার ফোয়ারা ছুড়লেন রমণী,
— পাপ কখনো বাপকেও ছাড়েনা।
অতর্কিতে পেছনে ঘুরলো তুষার, কপাল কুঁচকে আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠলো,
— কি বলতে চাইছেন?
—তোমাকে যাতে কখনো আমার বউমার আশেপাশে না দেখতে পাই।
— আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আসলে….
জিভে কথা আঁটকে গেলো তুষারের,ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,
—ওই যে বললাম, পাপ বাপকেও ছাড়েনা, আমাকেও ছাড়েনি।
কথা বাড়ানোর ইচ্ছে ছিলনা মোটেই, তবুও অজ্ঞাত তুষার দমাতে পারলো না নিজের কৌতূহল। বলে উঠলো,
— কি পাপ করেছেন আপনি?
— তোমার বাবার মতো একটা নিকৃষ্ট দানবকে বিয়ে করার চাইতে বড় পাপ আর কি হতে পারে?
আকাশে মেঘ হলোনা, বিদ্যুৎ চমকালো না, অথচ অদূরে ভাঙন ধরলো কিছু একটা। যার প্রকাণ্ড শব্দধ্বনি স্তম্ভিত করে তুললো যান্ত্রিক মানবের শ্রবনেন্দ্রিয়,মস্তিষ্ক ছাপিয়ে শরীরের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে বিষক্রিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়লো কথাগুলো, অবশেষে অভ্যন্তরে গিয়ে ফাটল ধরালো প্রস্তর কঠিন হৃদয়ে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আচানক, বড্ড কসরত করে কয়েকটা শব্দ উগড়ে দিলো তুষার,
— আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন তাহলে!
প্রত্যুত্তর করলো না তন্দ্রা। সে মুসলিম পরিবারের মেয়ে, পরবর্তী বিয়েও করেছেন একই ধর্মানুসারী পরিবারের অধীনে,সহসা নিজের ভালোবাসার ফসলকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে শোনালেন দ্বায়িত্বের বাণী,
— আমার ব্লাড ক্যা’ন্সার,থার্ড স্টেইজ চলমান, আমি চলে গেলে পৃথিবীতে আমার ছেলেটা পুরোপুরি একা, আপন বলে আর কেউ থাকবে না ওর। তাই মা হিসেবে আমি কখনোই চাইবো না সূদুর রাশিয়ায় ফেলে আসা আমার অনিষ্ট অতীতের অশুভ ছায়া কখনো তার উপর পড়ুক।
আরেকদফা হোঁচট খেলো তুষার, যতটা না অবাক হলো তন্দ্রার অসুখের কথা শুনে তার চেয়েও বিস্মিত হলো মায়ের মুখে “ছেলেটা” শব্দ শুনে। তারমানে কি মা জলজ্যান্ত তুষারের অস্তিত্বকে সরাসরি অস্বীকার করলো? কিন্তু কেন! শুধু মাত্র ভানিয়া মিকাইলের ছেলে বলে? কিন্তু এই বর্বর দুনিয়ায় জন্মগ্রহণের পেছনে তার তো কোনো হাত ছিলনা, তাহলে শাস্তি কেন সে পাচ্ছে? এ কেমন অবিচার!
ভেতর ভেতর জ্ব’লেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে অন্তঃকরণ।অথচ বাহ্যিক অভিব্যক্তি তার নির্জীব, শূন্য। ঠিক যেন মূর্তিমানব।
— চিন্তা করবেন না, আমি আর ফিরবো না এই দেশে।
ছোট্ট স্বরে প্রত্যুত্তর করলো তুষার।
তন্দ্রা বললেন,
— দু’দিন বাদে বত্রিশ হতে চললো, এখনো জুতোর ফিতে বাঁধা শেখোনি।
মূহুর্তেই নিজের পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো তুষার, সত্যিই তো ফিতে গুলো এলোমেলো ভাবে বাঁধা, পেন্টহাউজে থাকলে এগুলো বেশিরভাগ সময় ফ্লোরাই করে দেয়, তাইতো তুষার বেখেয়ালি এতো। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
— দুদিন বাদে আমার জন্মদিন আপনি সেটাও জানেন?
এবার আর জবাব দিলেন না ভদ্রমহিলা, পায়ের তলার খসখসে শুকনো পাতা মারিয়ে সোজা হেঁটে গেলেন পাঁচিল ধরে। সময় অতিবাহিত করলো না তুষার, সে নিজেও ঘুরে হাঁটা ধরলো বিপরীত মুখে। যেতে যেতে অনুভব করলো, এই মায়া জড়ানো ছোট্ট দেশটাতে তার আর কোনো পিছুটান রইলো না, বারংবার ফিরে আসার জন্য রইলো না কোনো অযুহাত । খোলা আকাশের নিচে বনায়ন প্রান্তরে পরে রইলো কেবল একবুক আক্ষেপ, আর এক জীবন সমান অনুশোচনা। এই পৃথিবীতে জন্মানোর অনুশোচনা, যার ক্ষত গোটা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে তুষারকে।
একই উদরে জন্ম নেওয়া দু’ভাই, অথচ সময়ের স্রোত অচেনা বানিয়ে দিলো তাদের , বাস্তবতা তুলে দিলো দূরত্বের অদৃশ্য প্রাচীর। মা ও ছেলে দু’জনই বিপরীতমুখী হয়ে হাটছে দু’দিকে , মাঝখানে পড়ে আছে কেবল চাপা দীর্ঘশ্বাস। আহা! কি শূন্যতা! কি শূন্যতা!
দু’জনারই হৃদয়ে র’ক্তক্ষরণ, বেজে চলেছে বিষণ্ণ এক সুরের মূর্ছনা,
আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন,
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন।
আহারে জীবন, আহা জীবন,
জলে ভাসা পদ্ম জীবন…
পুষ্পসজ্জিত বাসরঘর। খাটের উপর আলগোছে বসে আছে নিঝুম। বিয়েটা ওর হয়েই গেলো অবশেষে। হ্যা, এতো জলদি নিঝুমের এই বিয়েতে সায় দেওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ এটাই, খালামনির ম’রণব্যাঁধি। তূর্য জানেনা এখনো কিছুই, জানলে হয়তো এতোটা উদাসীন হয়ে ঘুরতো না কখনোই, আর না তো কখনো রাজি হতো এই বিয়েতে।
কক্ষটা তূর্যের,এই বাড়িতে গত ক’মাস ধরে থাকলে ও তূর্যের ঘরে কখনো উঁকিও দিতো না নিঝুম। যদিও বা কখনো প্রয়োজনে এসেছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে তবেই ফিরেছে। সারাজীবন যে এই ঝগড়ুটে লোকের সঙ্গে কি ভাবে অতিবাহিত করবে সে নিয়ে সন্দিহান নিঝুম, তার উপর হৃদয়ের টানাপোড়েন তো আছেই। আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেয়েটা, মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড়ালো,
— হুতুম পেঁচা কোথাকার।
কথাটা বলে কক্ষটাতে চোখ বোলালো নিঝুম, ওয়াইল্ড জেসমিন আর ল্যাভেন্ডারের সুঘ্রাণে বিমোহিত চারিপাশ। খাট সজ্জিত হয়েছে তরতাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধায়। বিস্তৃত কক্ষের প্রতিটি কোণে সারিসারি মোমের আয়োজন। নিয়ন দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করতে পুরো ঘর। দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খুলে রাখা, হু হু করে হিমেল হওয়া বইছে সেথায়। মৃদু বাতাসের আবরণ গায়ে লাগতেই আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো নিঝুম,অযাচিত ভাবনায় ছাঁড়লো দীর্ঘশ্বাস। তন্মধ্যে ওপাশ থেকে ভেসে এলো কর্কষ পুরুষালি বাক্যধ্বনি,
— কিরে এ ঘরে কি করিস? তোর ঘর নেই?
চমকে উঠে পাশ ফিরলো নিঝুম। দেখলো, একটা গিটার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। পরিধানের প্রিন্স কোটের সবগুলো বোতাম খোলা, দৃশ্যমান স্যান্ডোগেঞ্জি, এলোমেলো সিল্কি চুল। কে বলবে আজ সন্ধ্যার আসরে বিয়ে হয়েছে এই ছেলের? নিজের খালাতো বোনের নামে কবুল বলেছে সে তিন তিন বার!
— কালা নাকি তুই?
তুষারের অকস্মাৎ বাক্যে ভ্রম কেটে গেলো নিঝুমের। চটজলদি মাথা নাড়ালো এদিকওদিক।
— তাহলে কথা বলছিস না কেন? এ ঘরে কি?
— সবাই মিলে এখানে দিয়ে গেলো, বললো বাসর রাত।
— তারমানে তুই বাসরের জন্য প্রস্তুত তাইতো?
আগ বাড়িয়ে মুখের কথা কেড়ে নিলো তূর্য। তৎক্ষনাৎ জোরে জোরে মাথা নাড়ালো নিঝুম। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলো,
— আপনি একটু বেশিই বোঝেন তূর্য ভাই।
— ভাই!
বিস্ময়ের সাথে শব্দটা উচ্চারণ করে এক ভ্রু উঁচালো তূর্য।
— ওই আর কি।
দায়সারা প্রত্যুত্তর নিঝুমের। বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই চোখ আটকালো খাটের হেড বোর্ডে এলিয়ে রাখা গিটারের উপর। সহসা প্রশ্ন করলো,
— আপনি গানও পারেন!
— পারি তো, শুনবি নাকি?
— না থাক।
— আরেহ শোনাই একটা, টাকা দিতে হবে না ফ্রি ফ্রি শোন। যত যাই হোক তুই আমার খালাতো বউ, টাকা নিলে কেমন দেখায় বল?
ওর কথার প্রেক্ষিতে নিঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই অদ্ভুত বেসুরো গলায় গান ধরলো তূর্য,
— ও টুনির মা, তোমার টুনি কথা শোনেনা…
আহ! থামুন। কি বিশ্রী গলা। গানের লিরিক্সের কি ছিঁড়ি ছ্যাহ!
দমলো না তূর্য, দাঁত কেলিয়ে বললো,
— আচ্ছা দাঁড়া তাহলে আরেকটা শোনাই,
কথাটা বলেই ফের গান ধরলো সে,
— আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি বলে দিতে পারো তা আমায়……
— হ্যা করছেন, প্রচণ্ড বিরক্ত করছেন। এই গান ফ্রি দিলেও শুনবো না আমি, এই মূহুর্তে বন্ধ করুন আপনার রুটির দোকান।
বিরক্তির স্বরে চ্যাঁচিয়ে ওঠে নিঝুম। তূর্য গিটার রেখে দিলো, চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
— তুই আর কোনোদিন আমার কণ্ঠে গান শুনতে পাবি না যাহ।
নাক ফোলালো নিঝুম, বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
— শোনার ইচ্ছে ও নেই, পেঁচার চেয়েও খারাপ আপনার গানের গলা। এতোদিন পেঁচা পেঁচা বলে পেঁচাকে অপমান করেছি আমি।
প্রথম রাতেই বউয়ের কাছে উড়া ধুরা ঝাড়ি খেয়ে হতভম্ব তূর্য, রীতিমতো কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ওর, মনে মনে বলে উঠলো,
— এই ছিল মোর কপালে।
— সরুন তো ঘুমাবো।
ব্যতিগ্রস্ত নিঝুম, ওর ভালো লাগছে না কিছুই, তাই গয়নাগাটি নিয়েই শুতে চলে গেলো বিছানায়, তৎক্ষনাৎ বাঁধ সাধলো তূর্য।
— এ্যাই কি করছিস?
— ঘুমাচ্ছি।
— এই ঘরটা কার?
— আপনার।
— এই বিছানাটা কার?
— এটাও আপনারই।
— তাহলে তুই কোন আক্কেলে কাঁথা মুড়ি দিচ্ছিস বেয়াদব!
তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো নিঝুম। ঠিকই তো এভাবে অন্যের কাঁথা বালিশ দখল করার কি মানে আছে? সহসা মুখ কাচুমাচু করে তূর্যের পানে দৃষ্টিপাত করলো মেয়েটা , অসহায় কণ্ঠে শুধালো,
— তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো?
— আমি কি জানি, যা ভাগ!
নিঝুমকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে নিজে গিয়ে টানটান হয়ে খাটে শুয়ে পড়লো তূর্য।
— আমি তাহলে আমার ঘরে যাই।
— খবরদার! এতোরাতে লোক হাসাস না।
নিঝুম চলেই যাচ্ছিল, তক্ষুনি বাক্য উগড়ে দিয়ে পাশ ঘুরে শুয়ে পড়লো তূর্য। নিঝুম আর কিইবা করবে অপারগ হয়ে গা এলিয়ে দিলো কক্ষের এককোণে রাখা বিস্তৃত কাউচের উপর।
গভীররাত। শুনশান নিস্তব্ধ প্রকৃতি, এরইমাঝে ঘুমন্ত নিঝুমের শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করলো অপূর্ব সুরের পঙক্তি। ঝিনঝিন গিটারের আওয়াজে সচল হয়ে উঠলো মস্তিষ্ক, রমণীর তন্দ্রা কেটে গেলো তৎক্ষনাৎ। আঁধারের মাঝে আড়মোড়া ভেঙে উঠতে নিয়ে অনুভব করলো ওর গায়ে পাতলা চাদরের আবরণ। কে দিলো এই চাদর?
ভাবতে পারলো না নিঝুম, তার আগেই ওর সবটুকু আকর্ষন কেড়ে নিলো বেলকনি থেকে আগত অপার্থিক এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর । তড়িঘড়ি করে কাঁউচ ছেড়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো নিঝুম, সামান্য উঁকি দিতেই দেখলো,
আঁধার রাতে বেলকনির ডিভানে বসে গিটারের ছন্দে ঝঙ্কার তুলেছে এক ছায়া মানব, কণ্ঠে তার নিখুঁত মসৃণ সুর,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৬
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাকা
চলতে ভীষণ ভয়……..
তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে
করোনা কিছুতেই ভয়……
কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে……
কখনো ভাবিনি ফিরে আসবে না
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে……..
বিমুগ্ধ চিত্তে গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো নিঝুম। বিমোহিত হয়ে বেখেয়ালি স্বরে বলে উঠলো,
— যতটা ভেবেছিলাম, ততটাও খারাপ নয়। গানটা বেশ ভালোই গায়।