আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৯

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৯
suraiya rafa

আষাঢ়স্য প্রথমদিবস। সেই সকাল থেকেই মুখ ভার করে আছে সমগ্র আকাশ। আকাশের ছায়াতলে ধূসর বর্ণ গায়ে মেখেছে অপার সমুদ্র। বাইরে বর্ষার মাতন। বালুচর জুড়ে আপন ছন্দে নৃত্যে মেতেছে বারিধারা। ইনানী আজ বৃষ্টিমুখর। জনমানুষের উপস্থিতি নগন্য সেথায়। সমুদ্রের কাছাকাছি যে ছোট্ট শৌখিন ক্যাফেটা রয়েছে তার সামনে জ্বলজ্বল করছে “open ” খচিত নেইম-প্লেট।
ক্যাফে ছাড়িয়ে একটু দূরে, গেটের ধারে, ছাতা হাতে , সটান দাঁড়িয়ে পাঁচজন বিশালদেহী দেহরক্ষী। যান্ত্রিক তাদের অভিব্যক্তি। যেন ফুটন্ত এক পুষ্পের সুরক্ষায় সদা নিয়োজিত প্রহরী। শঙ্খাকৃতির গোলাকার ক্যাফেটার অভ্যন্তরে সেই পুষ্পের অবস্থান। সাধারণ কোনো পুষ্প নয়। এক অনুভূতিহীন নির্দয় মানব, যার প্রস্তর কঠিন হৃদয়ের প্রথম এবং একমাত্র নমনীয়তা সেই সত্তা । পাষাণ মানব ভালোবেসে যার নাম দিয়েছে “সাকুরা”।

সেই তখন থেকে কফিমেকারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে ঈশানী। বৃষ্টির দিনে কফির আধিক্য বেশ। কাস্টমারের কমতি নেই। ছোট পরিসরের শৌখিন ক্যাফে বলে একাই সামলাতে পারে ও।
জরজেট লেডিস শার্টের উপর খাকি কাপড়ের এ্যাপ্রোন আর চূড়োকরে বাঁধা পোনিটেইলে ভীষণ প্রাণবন্ত লাগছে মেয়েটাকে ।রাজহংসীর ন্যায় গমরঙা ত্বকের ভাঁজে অপার্থিব মোহনীয়তা,সাথে যোগ হয়েছে একজোড়া জ্বলজ্বলে নীলাক্ষী।
ডংডংডং….
দরজার কাছে ভিন্টেজের যে সৌন্দর্য্যবর্ধক ঘণ্টীটা রয়েছে, সেটা বেজে উঠলো অকস্মাৎ। অর্থাৎ কাস্টমার এসেছে। একাধিক পদধ্বনি। কোনো টুরিস্ট গ্রুপ হবে হয়তো। পেছনে না তাকিয়েই তাদেরকে স্বাগতম জানালো ঈশানী,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— ওয়েলকাম।
গোলাকার কফি টেবিলের চারদিকে স্থির হয়ে চেয়ার টেনে বসলো সকলে, পরক্ষণেই ভেসে এলো রিনরিনে নারী কণ্ঠ,
—এক্সকিউজ মি, টু আমেরিকানো উইথ আউট সুগার।সাথে একটা ল্যাটে,আর একটা ভ্যানিলা ফ্র্যাপচিনো প্লিজ।
কফিমেকারের ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করলো ঈশানী,
— ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করুন।
অতঃপর, কাচের দেওয়ালে বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে সকলে মিলে মশগুল হলো আড্ডার আমেজে। গিটারের গায়ে আঙুলের দক্ষতায় টুংটাং শব্দের বিমুগ্ধ ঝঙ্কার তুলে গলা ছেড়ে একযোগে ধরলো বৃষ্টির গান,
বৃষ্টি ভেজা রাতে
আমি তোমায় নিয়ে যাবো।
যতগুলো কথা হয়নি বলা
তোমাকেই বলে দেবো।
গানের সুর কাটলো ঈশানীর অতর্কিত আগমনে। খানিক বাদেই কফির ট্রে হাতে নিয়ে সেখানে হাজির হলো ঈশানী, সতর্ক হাতে সার্ভ করছিল একে একে। দৃষ্টি তার উত্তপ্ত কফি কাপে নিবদ্ধ। এরই মাঝে বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে আসে বিস্ময়কর হর্ষধ্বনি,

— আরেহ! এতো ঈশানী!
হতচকিত হয়ে চোখ তোলে ঈশানী। পরক্ষণেই সামনে বসে থাকা মুখ গুলো ভালোমতো অবলোকন করে আপনাআপনি অধর ফাঁক হয়ে যায় তার। কণ্ঠে চমক, স্বগোতক্তিতে বিরবিরায়,
— তোমরা এখানে!
সবার মাঝে খুঁজে ফেরে সেই আকাঙ্ক্ষিত মুখ। পেয়েও যায় খানিকবাদে। গলারস্বর খাদে নামিয়ে বড্ড কসরত করে ডেকে ওঠে,
— জিসান!
এতোগুলো মাস বাদে জিসানকে দেখতে পেয়ে ঈশানীর মাঝে উৎপীড়ন দেখা গেলো, অথচ তেমন কিছুই ঘটলো না জিসানের মাঝে। সে নিরুদ্বেগ। প্রস্তর খণ্ডের ন্যায় নির্বাক, নির্লিপ্ত তার অভিব্যক্তি। দৃষ্টতে নিদারুণ সাবলীলতা, যেন কিছুই ঘটেনি আশেপাশে। ওদিকে বাকরুদ্ধ ঈশানী, জিসানের নির্লিপ্ত ভাবাবেগ কৌতুহলী করে তুললো মেয়েটাকে ।অগত্যা নির্দ্বিধায় সবাইকে উপেক্ষা করে প্রশ্ন ছুড়লো ও,

— ঠিক আছিস তুই?
উপস্থিত সকলে চমকালেও চমকায় না জিসান। অপরিচিতদের মতোই সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানালো সে । জিসানের অদ্ভুত আচরণে ঈশানীর মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্নের উদয় হয় ঠিকই, কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা।অন্তরের কোথায় যেন ঝেঁকে বসে বিতৃষ্ণা। নিজ থেকে যেচে পড়ে কথা ওর ধাঁচে নেই, তারউপর জিসানের মতো একটা উগ্র প্রজাতির ছেলের সঙ্গে তো না-ই । নেহাৎ শেষবার দু’জনে একসঙ্গে বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল, জিসানের পা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাই তো এতো অস্থিরতা।
ঈশানীর চোখেমুখে বিস্ময়। নির্বিকারে তাকিয়ে আছে জিসানের পানে, তন্মধ্যে ওর কব্জিতে হ্যাঁচকা টান মে’রে সিটে বসিয়ে দিলো জিসানের ব্যাচমেট মৃণালিনী। ঠোঁটের আগায় চমৎকার হাসি টেনে বললো,
— কতদিন পর দেখা বলোতো? সেই যে খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে এলাম, তারপর থেকেই তুমি উধাও । ভাগ্যিস দেখা হয়ে গেলো, তোমাকে তো ভুলতেই বসেছিলাম আমরা।
মলিন বদনে হাসলো ঈশানী। কিঞ্চিৎ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,

— ওই আর কি, ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম একটু।
— এখানে চাকরি করো নিশ্চয়ই ?
ভিন্টেজ কারুকাজ শোভিত অত্যাধুনিক ক্যাফেটার চারিদিকে অবাক দৃষ্টি বুলিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে মৃণা। ঈশানী থমকায়, চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, হাত বাড়িয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজতে গুঁজতে বলে,
— না, এটা আমার নিজের ।
চোখ কপালে উঠে যায় মৃণালিনীর।বিস্মিত হয়ে একযোগে চিৎকার দিয়ে ওঠে উপস্থিত সকলে,
— কি! এই ক্যাফেটেরিয়া তোমার?
নির্বিকারে মাথা ঝাঁকায় ঈশানী। পরপরই ওর বা হাতটা খপ করে টেনে ধরে মৃণালিনী। বিস্ফারিত নয়নে অবলোকন করে ওর অনামিকায় আবৃত অদ্ভুত পাথরের আংটিটা। কণ্ঠে কৌতুহল ঢেলে শুধায়,
— এ্যাই তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? এতো বড় একটা রিং পড়ে আছো যে? আর এটা কেমন রিং? বিয়ের রিং হবে ঝকঝকে নজরকাঁড়া। কিন্তু এটা দেখেই তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার। মনে হচ্ছে তাজা র’ক্ত দিয়ে মোড়ানো।
মৃণালিনীর কথা বলতে বাকি তৎক্ষনাৎ ঈশানীর পানে দৃষ্টি ঘোরালো মৃণার বয়ফ্রেন্ড নিকোলাস। সরু, কুটিল চাহনী। এক দৃষ্টে পযর্বেক্ষণ করলো পাথরটিকে।জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠলো,

— এই পাথর কোথায় পেয়েছো তুমি?
তাড়াহুড়ো হাত নমিত করলো ঈশানী, কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই প্রসঙ্গ পাল্টালো অকস্মাৎ,
— কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । প্লিজ এনজয়।
বাক্যটা শেষ করে। সম্মোহনী হেসে উঠে যেতে উদ্যত হয় মেয়েটা, ফের পেছন থেকে ভেসে এলো নারী কণ্ঠস্বর,
— তুমি কোথায় যাচ্ছো? কতদিন বাদে দেখা, এসো আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিবে। এ্যাই জিসান আটকা ওকে!
মৃণার কথার পাছে জিসান ও ডেকে উঠলো এবার,
— এ্যা! হ্যা হ্যা….ঈশু বস। এখানে এসে কফি খা। বিল টা আমাদের নামে করে দিস।
ঘুরে তাকালো ঈশানী। ঠোঁট প্রশস্ত করে নৈঃশব্দ্যিক এক রহস্যময়ী হাসি ফেরত দিলো সকলকে। অস্ফুট স্বরে ধ্বনিত হলো,

— নো থ্যাংক’স।
— কেন, খেলে কি সমস্যা?
বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে এলো জিসানের জোড়ালো কন্ঠস্বর। সামান্য ঘুরে ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঈশানী। দৃষ্টিতে অমীমাংসিত রহস্য টেনে বললো,
— তুই অদ্ভুত রকম বদলে গিয়েছিস জিসান।যদিও এতে আমার কিছু যায় আসেনা। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোর, আচরণ, কথা বলার ধরন, শারীরিক গঠন এমনকি তোর পায়ের গুলিটাও। সবকিছুতে পরিবর্তন।
ঈশানীর কথার পাছে আচানক বিষম খেলো জিসান। কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারি দিয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ইশারা করে বলে,
— ধূর! কি যে বলিস না তুই।
— ঠিকই বলেছি। তোর মাঝের সেই জেদী আত্নবিশ্বাসটাও এখন অনুপস্থিত।
— বাদ দাও তো ওর কথা। তুমি এদিকে এসো।
তৃতীয় পক্ষের হস্তেক্ষেপে অবসান ঘটলো স্নায়ুযুদ্ধের। মৃণালিনীর পানে গ্রীবাদেশ ঘুরিয়ে চাইলো এবার ঈশানী। থমথমে স্পষ্ট বাক্যে বলে উঠলো,
— প্লিজ এনজয় ইয়োরসেল্ফ!
অতঃপর দ্রুতপদধ্বনিতে জায়গা ত্যাগ। এহেন উপেক্ষায় কিছুটা বিব্রত দেখালো মৃণালিনীকে। অবসন্ন মুখে মাথা নোয়ালো মেয়েটা, তক্ষুণি ওর কাঁধের উপর হাত রাখলো নিকোলাস।বিপরীতে গ্রীবা তুলে চাইলো মৃণা।অক্ষিপুটে পলক ছেড়ে প্রেমিকাকে আস্বস্ত করে বিড়বিড়ালো নিকোলাস।
— ইট’স ওকে বেইব।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা । ধরিত্রী জুড়ে আঁধারের মায়াজাল। বৃষ্টির তোড়ে ধোঁয়াসা, অস্পষ্ট চারিদিক। ক্যাফেটা বন্ধ করে ছাতা হাতে দ্রুত হাঁটছে ঈশানী। বৈরী বৃষ্টির এলোমেলো বর্ষণে ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে তার তনু কায়া।
হঠাৎ দমকা হাওয়ায় হাত ফসকে উড়ে গেলো ছাতাটা। নিমেষেই ঝুম বৃষ্টির শীতল পরশে সিক্ত হয়ে উঠলো শীর্ণকায় দেহখানি। বৃষ্টিস্নাত সর্বাঙ্গে অদ্ভুত বন্য শিহরণ বইলো রমণীর , হুট করেই মনে পরে গেলো মাফিয়া বসটাকে। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেলো ফেরে না সে। এরীশ চলে গেলে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে যায় ওদের মাঝে, কারণ মাফিয়া বসের নির্দিষ্ট কোনো নাম্বার নেই। আর না আছে ঈশানীর হাতে কোনোপ্রকার মুঠোফোন। এ কেমন অদ্ভুত, অবাস্তব সম্পর্কে জড়ালো ওরা? না আছে কোনো প্রতিশ্রুতি, না আছে বর্তমান আর না তো ভবিষ্যত। এভাবেও বুঝি ভালোবাসা হয়? বেখেয়ালে থমকে আসে ঈশানী পদচারণা। স্থবির চিত্তে সে দাঁড়িয়ে পড়ে বর্ষণমন্দ্রিত জমিনে। অস্ফুট স্বরে ধ্বনিত হয় তার ভেজা বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর ,
— আপনি কখনো ভালোবাসি বলেন না এরীশ ইউভান।
— বলবেও না কোনোদিন!
পেছন থেকে ভেসে আসা ভারিক্কি পুরুষালি কণ্ঠের আকস্মিকতায় বিভ্রম কেটে গেলো ঈশানীর। চকিতে ঘুরলো পেছনে। ওর থেকে খানিকটা দূরে স্থির দাঁড়িয়ে জিসান। হাতে ছাতা নেই, যার দরুন মুষলধারার বর্ষণে ভিজে জুবুথুবু তার সমস্ত শরীর। লোকালয় বিহীন ধু ধু প্রান্তরে অকস্মাৎ জিসানের উপস্থিতি খানিক অস্বস্তি দিলো ঈশানীকে। কিঞ্চিৎ ভ্রুঁ বাঁকিয়ে বলে উঠলো,

— তুই ফিরে যাস নি?
বৃষ্টির কাদাজল পায়ে মারিয়ে চপচপে ভেজা পায়ে এগিয়ে এলো জিসান। ঈশানীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছুঁড়লো রুক্ষধ্বনি,
— তুই এতো জেদি কেন ঈশানী? এতোকিছু জানার পরেও সেই রাশিয়ান স্মাগলার টাকেই বিয়ে করলি? বিয়ের গুরুত্ব বোঝে ও?
এসব বিষয়ে কথা বাড়াতে অনিচ্ছুক ঈশানী, সহসা কোনোরূপ ভণিতা না করেই বলে উঠলো,
— পথ ছাড় জিসান। যাবো আমি!
— কোথায় যাবি? ওই প্রস্টিটিউড ক্লাবের মাফিয়াটার কাছে? তোকে আস্ত রাখবে ও?
— মুখ সামলে কথা বল।
— সামলাবো না।
জিসানের কণ্ঠে তীব্রক্রোধ। ফুঁসছে সে রাগের তোড়ে।
— অবশেষে নিজের আসল রূপে পুনরাগমন করলি তাহলে?

ঈশানীর কণ্ঠে বিদ্রুপ। জিসান তেড়ে এলো এবার। সন্নিকটে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— তুই পস্তাবি। তোর এসব ডার্ক ফ্যান্টাসী তোকে সত্যি সত্যি ভিলেইনের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করাবে একদিন। তখন বুঝবি কষ্ট কাকে বলে।
— এরীশের মতো জানোয়ার কে চোখের ইশারায় বশ করার ক্ষমতা আমি রাখি জিসান। আমাকে বাস্তবতা বোঝাতে আসিস না,জীবন পুড়িয়ে আবেগ জমাই আমি। আগুন কিভাবে ছায়া বানাতে হয়, সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে।
— কথায় বেশ ধার হয়েছে আজকাল। এতো তেজ কার জোরে? ওই মাফিয়াটার!
— যদি বলি হ্যা।
— মাফিয়া বরের ভয় দেখাচ্ছিস! কি করবে তোর মাফিয়া বর? রাশিয়া থেকে গুলি করবে আমায়?
কথা বলতে বলতে ঈশানীর কাঁধ বরাবর ধাক্কা দিতে উদ্যত হয় জিসান। তবে স্পর্শ করার আগেই কোথা থেকে যেন ঝড়ের বেগে ছুটে এসে অকস্মাৎ জিসানের কব্জি চেপে ধরে একজন গার্ড। পরপরই আরও দু’তিনজন কালো পোশাকধারী এসে দু’হাতে চ্যাংদোলা করে তুচ্ছ আবর্জনার মতোই ঈশানীর থেকে কয়েকহাত দূরে সরিয়ে নেয় ছেলেটাকে । সর্বশেষ যে গার্ডটা ছিল সে তাড়াহুড়ো ছুটে এসে ছাতা মেলে ধরে ঈশানীর মাথায়। কুর্নিশ জানিয়ে নরম কণ্ঠে বলে,

— প্লিজ ম্যাম গাড়িতে চলুন। ইউ মাইট ক্যাচ আ কোল্ড।
ঈশানী গেলোনা। বিশালদেহী গার্ডগুলোর বাইসেপ বাহুর ফাঁকে অসহায়ের মতো আঁটকে থাকা জিসানের পানে দৃষ্টিপাত করে বিদ্রুপাত্তক স্বরে বলে উঠলো,
— আমার মাফিয়া বরের ক্ষমতা দেখা হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই!
মূহুর্তেই গর্জে উঠলো জিসান। রাগের তাড়নায় গজগজ করতে করতে বিষাক্ত তীরের ফলার মতোই ছুড়ে দিলো শব্দের বিষ,
— খুব শীঘ্রই পস্তাবি তুই ঈশানী। মার্ক মাই ওয়ার্ড, ইউ’ল বি ডেসট্রয়েড।
আর একমূহুর্ত ও সময় অতিবাহিত করলো না রমণী। জিসান কে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ জানিয়ে, দ্রুত পদক্ষেপে ত্যাগ করলো সেই স্থান।

রাত তখন সারে আটটা। বিষণ্ণ মনে ব্ল্যাকহোলে পা রেখেছে ঈশানী। শরীর তার চপচপে কাকভেঁজা। হৃদয়জুড়ে আশঙ্কার কোলাহল। কি বলতে কি বললো জিসান? এই ছেলেটা কেন সবসময় ভুলভাল বকে এতো?
করিডোর অতিক্রম করার সময় খাবারের জন্য ডাকলো নাতালিয়া, ঈশানী ঘুরেও তাকালো না সেদিকে । দৃষ্টিজুড়ে বৈরাগ্য তার, হৃদয়ের কোণে বিষাদের ঘনঘটা। এলোমেলো পা ফেলে সোজা গিয়ে পৌঁছালো নিজের কক্ষে। দরজা খুলে প্রবেশ করার অবকাশ পেলোনা, তার আগেই অশুভ শিকারীর ন্যায় অকস্মাৎ কব্জিতে টান মে’রে মেয়েটাকে দু’কদম পিছিয়ে আনলো জোড়ালো এক অস্তিত্ব। আজকাল আকস্মিকতায় অভ্যস্ত ঈশানী, তাই ভড়কালো না।
লতানো নারীদেহের, শীর্ণকায় তনু গিয়ে ঠায় নিলো ইস্পাতকঠিন বক্ষভাঁজে ।
পরপরই ওর নির্মেদ সিক্ত কটিদেশে অনুভূত হলো এক খরখরে পুরুষালি হাতের গাঢ় স্পর্শ,ধীরে ধীরে কোমড় ছাপিয়ে ভেজা চুলে স্পষ্টত হলো সিগারেট পোড়া শুষ্ক ওষ্ঠের এলেমেলো চুম্বন। একবার দু’বার নয় অসংখ্যবার। বেদনাদায়ক স্পর্শের দৃঢ়তায় তড়িৎ খেলে গেলো অন্তরে। কৃত্রিম সুগন্ধির সঙ্গে এই পুরুষালি শরীরের ক্লোন মিশ্রিত মাদকীয় সুবাসটা বড্ড পরিচিত ঠেকলো রমণীর। ফলস্বরূপ মস্তিষ্কের দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে সর্বাঙ্গ জুড়ে জাগ্রত হলো অদ্ভুত শিহরণ। নির্মল কণ্ঠে একাই আওড়ালো,

— অরণ্য!
— উমমম!
প্রেয়সীর চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে, অস্ফুট স্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো মাফিয়া বস। কণ্ঠ তার মোহাচ্ছন্ন।শ্বাসপ্রস্বাসে এ্যালকোহলের উৎকট গন্ধ। ঈশানী উপলব্ধি করলো এরীশের অস্বাভাবিক টালমাটাল অস্তিত্বকে। সহসা প্রশ্ন ছুড়লো শীতল কন্ঠে,
— কখন ফিরে এলে?
কোনো প্রত্যুত্তর নেই। ঈশানীতে মশগুল হয়ে আছে সে মানব , মাতাল স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
— আই থিংক এটা তোমার চুলের ঘ্রাণ।
— কোনটা?
— ভ্যানিলা।
সংকীর্ণতা বাড়লো আরেকটুখানি। তন্মধ্যে তপ্তশ্বাস ছেড়ে নিজেকে এরীশের থেকে ছাড়িয়ে নিলো ঈশানী। কনুই অবধি হাতা গুটানো কালো শার্টের সঙ্গে মিলিয়ে পরিহিত কালো বেল্টের ঘড়িটায় যতটা না নজরকাড়া লাগছে, তারচেয়েও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে কালচে বাদামী শুষ্ক অধরের নিচে চকচক করতে থাকা কুচকুচে কালো তিলকটায়। ধূসর বাদামি গহ্বর দু’টি তলিয়ে আছে নেশার ঘোরে, নিয়ন্ত্রণহীন, নিস্তব্ধ পদযুগল , এক্ষুণি অবচেতন হয়ে পড়লো বলে।

— সচরাচর এতোটা মাতাল হও না তুমি। তারমানে গত কয়েকদিন যাবত একনাগাড়ে এ্যালকোহল গিলেছো?
বাধ্য স্বামীর মতোই জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো এরীশ ইউভান।
— ড্রাগ ও নিয়েছো?
একই উদ্যমে ফের ঝাঁকিয়ে উঠলো মাথাটা।
— জানোয়ার!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চাইলো এরীশের মুখের পানে। ঘরের চার দেওয়ালে অবিরাম জ্বলতে থাকা স্ফটিকের আলোয় স্পষ্ট দৃশ্যমান তার টালমাটাল মুখাবয়ব। যা দেখা মাত্রই কুঞ্চিত ভ্রুযুগল ধীরে ধীরে সোজা হয়ে গেলো রমণীর। বিরক্তি উবে গিয়ে অন্তর জমিনে ধরা দিলো বৃষ্টির ছন্দের ন্যায় অপার মুগ্ধতা।
গৌড় বর্ণের কাটকাট চেহারায় নজরকাড়া দীপ্তি তার । সিল্কি কালো কেশরাশি থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে অদ্ভুত পুরুষালি গাম্ভীর্য।একবার তাকালে নজর সরানো দ্বায়।
প্রথম দেখায় কে বলবে এই লোকটা আসলে অশুভ এক হৃদয়হীন দানব। যার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে লুকিয়ে আছে আঁধারের ন্যায় পাষবিক নৃ’শংস’তা।
সেই তখন নিস্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে আছে ঈশানী। এরীশ প্রশ্ন করলো না, উল্টো দু’হাতে তুলে এক লহমায় ঘুরিয়ে ডেস্কের উপর বসিয়ে দিলো মেয়েটাকে । বক্রাকার ভ্রুযুগল তীর্যক উঁচিয়ে ছুড়ঁলো গম্ভীর বাক্য,

— সরে গেলে কেন?
ভাবনার সুতোয় টান পড়লো রমণীর । কুণ্ঠিত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
— আমি ভিজে আছি এরীশ। এভাবে বেশিক্ষন জড়িয়ে থাকলে তুমিও ভিজে যাবে।
নির্বিকারে তাকিয়ে রইলো মাফিয়া বস।নেত্রজুড়ে অনড় দৃঢ়তা তার। নির্জীব শীতল কন্ঠে অশুভের ন্যায় বিড়বিড়ালো,
— ডু ইউ থিংক আই কেয়ার!
চোখ ঘোরালো ঈশানী। অনিশ্চয়তার ভারে মস্তিষ্ক বুদ হয়ে আছে তার। কপালে জড়ো হয়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। মেয়েটার এহেন পানসে আচরণ মোটেই পছন্দ হলো না এরীশের। নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্কের প্রলোভনে ক্ষুব্ধ হয়ে চেপে ধরলো রমণীর নাজুক গ্রীবাদেশ। জোড়ালো হাতে সন্নিকটে টেনে এনে ছুড়লো ব্যঘ্র ধ্বণি।
— কি হয়েছে! হোয়াই আর ইউ রিজেক্টিং মি গার্ল!
শক্ত হাতের দৃঢ়তায় রমণীর কণ্ঠনালির নরম হাড়গুলো চূর্ণ প্রায়। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে ক্রমশ। তীব্র ব্যথা সহ্য হলো না ঈশানীর। চাপা আর্তনাদে ককিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ, চোখ খিঁচে ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো,

— এরীশ, ছাড়ো লাগছে।
ছাড়লো না এরীশ। গর্জে উঠলো হিংস্রতায় ,
— মন খারাপ কেন? কে কি বলেছে তোমায়?
— কেউ কিচ্ছু বলেনি। বিশ্বাস করো!
জিসানের ব্যাপারটা কৌশলে এরিয়ে গেলো ঈশানী।
— ডিড সামওয়ান টাচ্ ইউ!
মাফিয়া বসের রাশভারি কণ্ঠস্বর। ঢুলুঢুলু নেত্রে নিদারুণ উদ্বেগ। সুক্ষ্ম দৃষ্টে ভেজা শরীরের ঈশুকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো সে। এবারে না হেসে পারলো না ঈশানী, অধর চেপে হাসি দমানোর বৃথা প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে দু-হাতের করতলের ভাঁজে আঁজলা করে ধরলো স্বামীর মুখাবয়ব খানি।
খারাপ জিনিস বরাবরই আকর্ষনীয়, মানতেই হবে । কি সুদর্শন এই লোক। এক মূহুর্ত থমকায় ঈশানী। ফের মাফিয়া বসের সরু দৃষ্টি অন্তরভেদ করলে, প্রলম্বিত স্বরে বলে ওঠে,

— রিল্যাক্স! কেউ স্পর্শ করেনি আমায়।
— তোমাকে স্পর্শ করা প্রতিটি বৃষ্টি কণাকেও ততটাই হিংসা করি আমি, যতটা হিংসা কোনো মানুষের স্পর্শকে করতাম।
রমণীর দুপাশে দু’টো হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে এলো মাফিয়া বস। হেয়ালির স্বরে প্রশ্ন ছোঁড়ে ঈশানী,
— তুমি বৃষ্টিকে থামিয়ে দিতে চাইছো ?
— সাধ্য থাকলে সেটাও দিতাম। ওরা কেন ছোঁবে তোমায়?
— তুমি মাতাল হয়ে আছো এরীশ।সামলাও নিজেকে।
— আজ নয়, অন্যদিন।
ফের নৈঃশব্দ্য। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
— কেউ স্পর্শ করলে কি করতে?
ঈশানীর পানে আরও খানিকটা ঝুঁকে বরফ শীতল কন্ঠে বলতে আরম্ভ করলো মাফিয়া বস,

— প্রথমে তার কণ্ঠনালি ভে’ঙে কয়েক টুকরো করে দিতাম যাতে চিৎকার করার সুযোগ না পায়। তারপর হাতের নখগুলো সব একে একে উ”পড়ে ফেলতাম। প্রতিটা আঙুলের সরু হা”ড়গুলো এদিকে ওদিক বেঁ”কিয়ে দিতাম। পায়ের গোড়ালি ছিঁ”ড়ে র”ক্ত মাং”স থেকে আলাদা করে দিতাম । মাথার চা”মড়াটা এমন ভাবে ছি”ল”তাম….
— প্লিজ থামো!
ঈশানীর কণ্ঠে আকুতি , দৃষ্টিতে ভয়। শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। অস্থির স্বরে বলে ওঠে,
— কারোর মস্তিষ্কের ভাবনা এতোটা ভ”য়া”নক কি-করে হতে পারে?
— ইয়েস দ্যাট’স মাই থটস।
মাফিয়া বসের দ্বিধাহীন নির্লিপ্ত প্রত্যুত্তর। নেশার ঘোরেও ছোট্ট শরীরের প্রতিটি ভাঁজে প্রকম্পন উপলব্ধি করলো সে । নিয়ন্ত্রহীন হৃৎস্পন্দনের তোড়ে হাসফাস করছে ঈশানী। দু’হাতের মাঝে আঁটকে থাকা তুলতুলে নারীদেহের মাত্রাহীন অস্থিরতায় কপাল গোছালো এরীশ। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
—হেই, ডোন্ট প্যানিক ওকে। আজ জ্ঞান হারালে কিছুতেই মানবো না। একটু শান্ত হও, কিছুক্ষণ বাদেই চলে যাবো জান ।
— চলে যাবে মানে?
ভেতরের অস্থিরতাটুকু আলগোছে দমিয়ে নিলো রমণী। ধড়ফড়িয়ে উঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো উদভ্রান্তের ন্যায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপর-নিচে মাথা নাড়ায় এরীশ। ধীর কণ্ঠে বলতে থাকে,

— রান ওয়েতে প্রাইভেট জেট ওয়েট করছে, আজ রাতেই ইউ এস এ ব্যাক করবো । এখানে কয়েক ঘন্টার জন্য ট্রানজিট নিয়েছি, শুধু মাত্র তোমাকে দেখার জন্য।
ঈশানীর চোখে মুখে নিদারুণ বিস্ময়। আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠলো,
— কিন্তু কেন এরীশ!
গুছিয়ে প্রত্যুত্তর করতে পারলো না এরীশ। শুধু বললো,
— দেখতে ইচ্ছে হলো তাই। পাগলের মতো মিস করছিলাম তোমায়।
কথা বলতে বলতে শক্ত দু’হাতে রমণীর লতানো কটিদেশ আঁকড়ে ধরে মাফিয়া বস। নাজুক ত্বকের ভাঁজে আঁচড় কেটে যায় তার রুক্ষ হাতের প্রতিটি নখর। সেসবে নজর নেই এরীশের। হ্যাঁচকা টান মে’রে আরও খানিকটা দূরত্ব ঘোঁচায় সে । ধনুকের মতো বাঁকানো নারীদেহের সুডৌল অঙ্গের ভাঁজে মুখ ডোবাতে যাবে, তার আগেই বাক্য ছোঁড়ে ঈশানী।
— কিন্তু তুমি তো আমাকে সর্বক্ষণই দেখো এরীশ ।
কথাশেষ করে কক্ষের এককোণে সেট করা সিকিউরিটি ক্যামেরার পানে আড়চোখে দৃষ্টিপাত করে ঈশানী। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে এরীশও তাকালো একপল। পরক্ষনেই প্রেয়সীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে হিসহিসিয়ে ধ্বনিত হলো তার মাদকীয় কণ্ঠস্বর,
— দেখে দেখে মন ভরছিল না। আই ওয়ান্ট টু ফিল ইউ সো ব্যাড।

লজ্জিত হয় রমণী, অজান্তেই রক্তাভ হয়ে ওঠ তার পেলব কপোল। মুখশ্রী ছাপিয়ে উষ্ণতা ছড়ায় সর্বাঙ্গে। ওর মুখের উপর তপ্তশ্বাস ফেলে মাফিয়া বস। ঝলসে ওঠে মুখাবয়ব। কানের কাছে বেজে ওঠে পুরুষালি কণ্ঠের মাদকীয় ঝঙ্কার,
— রেগে আছি ভীষণ। আজ একটু বেশিই কষ্ট দেবো তোমায়।
তড়াক করে চোখ তুলে চাইলো ঈশানী। দৃষ্টির মিলন ঘটিয়ে শুধালো,
— কেন রেগে আছো?
অস্থির হয়ে আছে মাফিয়া বস। ঈশানীর ভেজা শার্টখানি টেনেটুনে খোলার বৃথা চেষ্টা চালাতে চালাতেই জবাব দিলো,
— প্রশ্ন করোনা, কৈফিয়ত দিই না আমি।
— এরীশ!
কণ্ঠে ক্ষোভ ঢাললো ঈশানী। অভিমান নিয়ে বললো,
— তুমি কখনো ভালোবাসি বলোনি আমায়।
— আগেও বলেছি সবার মুখে সবকিছু শোভা পায়না।
— কিন্তু আমি শুনতে চাই। তবুও কেন বলোনা!
— কারণ আমি ভালোবাসতে জানিনা।
মাফিয়া বসের নমনীয় সত্তা উবে গেলো অকস্মাৎ। দৃষ্টিতে জড়ো হলো প্রগাঢ় আঁধার।
ব্যথিত চিত্তে ফুপিয়ে উঠলো ঈশানী। প্রকৃতির উত্তাল ঝোড়ো হাওয়া একমুহূর্তে ছাপিয়ে গেলো তার অন্তর। শুরু হলো জলোচ্ছ্বাস।
— তোমার জীবনে আমার অস্তিত্বের নাম তবে কি এরীশ ইউভান?
অতর্কিত ধাক্কায় ঈশানীকে ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিলো এরীশ। জিভের ডগায় অধর ভিজিয়ে ধীরস্থির কদমে এগুতে লাগলো সেদিকে, পরিধেয় শার্টের বোতামে হাত চালাতে চালাতে অস্পষ্ট মাতাল স্বরে জবাব দিলো,
— তুমি আমার একজীবনের চাওয়া। হারলেও তোমাকে চাই, জিতলেও তোমাকে চাই। তোমাকে আমার চাইই চাই!

বষর্ণমন্দ্রিত রজনী।নিকাশ, নিস্তব্ধ প্রহর। বারিধারায় মাতোয়ারা ধরণী। জানালার ওপাশে ঝড়ের ঝঙ্কার, এপাশে দীর্ঘশ্বাস। সন্ধ্যা রাতে, বৃষ্টির মাতাল হাওয়া গায়ে মেখে দু’টো অস্থির প্রাণে যে উথাল পাথাল ঝড় উঠেছিল তার ইতি ঘটলো গিয়ে শেষ রাতে।
ঘনকালো আঁধারের চাদরে ঢাকা কক্ষে শুনশান নৈঃশব্দ্য। ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ওঠা বিজলির তেরছা আলোয় স্পষ্ট ভেসে ওঠে বিবস্ত্র শরীরে ফোপাঁতে থাকা এক নারীমূর্তির অবয়ব। ব্যথাতুর শরীরটাকে কোনোমতে সফেদ চাদরে প্যাঁচিয়ে কলমিলতার ন্যায় মাথাটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে নীরবে অশ্রু বির্সজন দিচ্ছে সে মানবী।
তার থেকে খানিকটা দূরে সটান দাঁড়িয়ে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে এরীশ। পেছন থেকে ভেসে আসা ক্রন্দিত ঈশানীর ফোঁপানোর আওয়াজে অকস্মাৎ সচকিত হয়ে ওঠে তার মস্তিষ্ক। অন্তরের তাড়নায় ব্যতিগ্রস্ত হয়ে তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় রমণীর নিকট। হাঁটু ভেঙে ওর মুখোমুখি হয়ে বসে অস্থির স্বরে বলে ওঠে,

— ডিড ইট হার্ট টু মাচ? লেট মি সি।
— হৃদয়ের ব্যথা কি করে দেখাবো তোমায় মাফিয়া বস!
— কি হয়েছে?
— এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও কেন তুমি একটাবার বলতে পারছো না ভালোবাসি, কিসের জড়তা তোমার? কেন এতো নির্দয় তুমি?
কান্নার তোড়ে কথা আঁটকে আসে মেয়েটার। অভিমানে তিরতির করে কেঁপে ওঠে তার তীর্যক নাকের ডগা।
— আমি পুরোপুরি ভেঙে গেলে খুশি হবে নিশ্চয়ই?
— ভাঙছো তো তুমি আমায়। প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে।
শরীরে জড়ানো সুক্ষ্ম আবারণটুকু পুরোপুরি ঠেলে সরিয়ে ঠোঁট ভেঙে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঈশানী। আলোআধাঁরির মায়াজালে স্পষ্ট দৃশ্যমান হয় সুনিপুণ এক আকর্ষনীয় নারীকায়া । খানিক আগেই যার প্রতিটি বাঁকে অগাধ কতৃত্বের প্রতিফলন ঘটিয়েছে মাফিয়া বস।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৮

অথচ এই মূহুর্তে দৃষ্টি নিভে আসে তার। প্রত্যুত্তর করে না এরীশ। তুলতুলে নরম শরীরটাকে সন্তোর্পণে ঢুকিয়ে নেয় নিজ শরীরের আস্তিনে। দু’হাতের আলতো স্পর্শে মেয়েটাকে আরেকটু কাছে টেনে, কপালে কপাল ঠেকায় নৈঃশব্দ্যে।
অতঃপর ক্রন্দিত রমণীর কানে ঝঙ্কার তুলে ঘোষিত হয় গম্ভীর হিসহিস প্রতিধ্বণি,
— আই ডোন্ট নিড এ্যানি ওয়ার্ড টু এক্সপ্রেস মাই ফিলিং।লুক, মাই হার্ট অনলি বিট’স ফর ইউ।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫০