আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫১
suraiya rafa
প্রায় দু’মাস পরে……
জীবনের কিছু কিছু সময় মানুষ হয়ে পড়ে সিদ্ধান্তহীন। গোটা জীবনের অযাচিত ভুল শোধরানোর উপায় হিসেবে নতুন করে জন্ম নেয় আরও অনেক গুলো ভুল। এক জীবনের প্রাপ্তি হিসেবে মানুষ যে সহজ গন্তব্য বেছে নেয়,তার বিপরীতে হাঁটা একগুঁয়ে মানুষ গুলো খুব সহজেই জীবনের ভারে ক্লান্ত হয়ে পরে। মরিচীকার মতো অদৃশ্য ভবিষ্যত তাদের তাড়া করে বেড়ায় অহর্নিশ।
বিগত কুড়িটা বসন্তে কখনো শুদ্ধ ভালোবাসার মুখ দেখেনি ঈশানী। কেউ কখনো স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসেনি ওকে। আপনজন নামক ব্যক্তিগুলো কোনোদিন বুঝতে চায়নি রমণীর কোমলপ্রাণকে। যার দরুন ভেতরের শিশুসুলভ সত্তাটা মরে গেছে বহু আগেই। বাবা-মা কিংবা আপনজনের ভালোবাসা ঠিক কতোটা স্বর্গীয় আর হৃদয়স্পর্শী হয় তা জানা নেই মেয়েটার। বরাবরই ভালোবাসার কাঙাল ঈশানী ভালোবাসা জিনিসটাকে ধরেই নিয়েছে দুর্বোধ্য এক বস্তু হিসেবে। যা জয় করতে হয়, ঠিক যোদ্ধার মতো। আর যুদ্ধের পর জিতে যাওয়া ইহ জাগতিক মহা পুরস্কারের নাম হলো প্রেম। ঈশানী এমন ভাবে ভালোবাসা উপভোগ করতে চেয়েছিল, যা এই জীবনে কেউ কোনোদিন ভোগ করেনি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। ঈশানীর যুদ্ধ করতে হয়নি, ভালোবাসা ওর দ্বারে হানা দিয়েছিল অম্লান বসন্তের দমকা হাওয়ার মতোই। সে এক অদ্ভুত প্রেমের উপাখ্যান , যার না আছে কোনো স্বীকারোক্তি আর না-তো প্রতিশ্রুতি। যার ভক্ষক হওয়ার কথা ছিল, ভাগ্যের দোলাচলে সে হয়ে উঠলো সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
এরীশ ইউভান! ঈশানীর একমাত্র আশ্রয়। রমণীর সরল,সহজ নারীমন কখনো বিবেকের বেড়াজালে আঁটকায়নি,চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সুকরুণ বাস্তবতাও কখনো দমাতে পারেনি তাকে, সে ভেসে গেছে আবেগের জোয়ারে, আদরে আদরে ঠিক নদীর প্রবাহমান জলের মতো। হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী সম্রাটের হৃদয়ের একমাত্র সম্রাজ্ঞী।
প্রতিশ্রুতিহীন,নৈঃশব্দ্যিক ভালোবাসার তরে উন্মাদ ছিল ঈশানী, কখনো ভাবতে চায়নি বাস্তবতা। সমগ্র দুনিয়া ভুলে হয়ে উঠেছে ফেরারী। যার কোনো গন্তব্য নেই।
তবুও মরিচীকা কি কোনোদিন আলোর হদিস পায়? দিনের আলোর মতোই পরিস্কার সত্যি টা ঠিক সেদিনই উপলব্ধি করেছিল রমণী। যেদিন তার ছোট্ট নাজুক উদরে আগন্তুকের ন্যায় কড়া নেড়েছিল র’ক্ত মাংসের এক নিস্পাপ অস্তিত্ব!
বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না ঈশানীর। একে তো গত দু’মাস ধরে কোনো হদিস নেই এরীশের। না রেখেছে যোগাযোগ আর না কোনো খবর। ঈশানী নিজে থেকে যে যোগাযোগ করবে তারও কোনো সুযোগ নেই, কারণ এরীশ একেক সময় একেক নাম্বার ব্যবহার করে। এবং এই পরিবর্তনের হার টা এতোই বেশি যে গুনে শেষ করার মতো নয়।
এটাকে বুঝি বৈবাহিক সম্পর্ক বলে? বোধ হয় না, সমাজের সচেতন মহলের কাছে এটাকে বলা হয় অসামাজিক, অসুস্থ সম্পর্ক। ঈশানী ভালো করেই জানে বিয়ে, ভালোবাসা কিংবা সম্পর্কের টানাপোড়েন এসবের কোনো মূল্য নেই মাফিয়া বসের কাছে। এটাতো কেবল ছোট্ট নারী শরীরটাকে বৈধ উপায়ে কাছে পাবার অভিনব কৌশল মাত্র। তবুও কি সে ভালোবাসে? নাকি পুরোটাই মোহ! আচ্ছা মোহ কি কখনো এতোটা গভীর হয়? যতটা গভীরে এরীশ পৌঁছেছিল, রমণীর শরীর থেকে মন প্রতিটি স্তরে যেভাবে সে নিজের কতৃত্ব বিছিয়েছে তেমন করে কি কখনো মোহনীয়তা পৌঁছায়?
মস্তিষ্ক জুড়ে প্রশ্নের সমাহার। আপন সত্তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই মানসিক দ্বন্দ্বে ক্রমাগত ক্লান্ত ঈশানী। কিন্তু ঈশানীকে এভাবে একা ফেলে রেখে কোথায় চলে গেলো এরীশ? সে কি আদৌও ফিরবে তার এই প্রতিশ্রুতিহীন ভালোবাসার কাছে? নাকি মরিচীকার মতোই হারিয়ে যাবে শূন্যতায়!
মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেল মিস হয়েছে আরও একমাস আগে। প্রথম দিকে শারীরিক জটিলতা ভেবে গুরুত্ব না দিলেও ইদানীং বিশেষ কিছু মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনের দরুন মনটা খচখচ করছিল ভীষণ। তাই সেদিন ক্যাফে থেকে ফেরার পথে চুপিচুপি একটা টেষ্টকীট নিয়ে এসেছিল ঈশানী। আজ এই মূহুর্তে সেটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশরুমের ভ্যানিটি মিররের সামনে। মোমঢালা পেলব মুখশ্রী জুড়ে দুশ্চিন্তার উদ্ভাসন। টানা কয়েকদিনের অসুস্থতায় ফর্সা ত্বক হয়ে উঠেছে ফ্যাকাসে । নিজের বিবর্ণ চেহারাখানা এক লহমায় পরখ করে চোখ ঘোরায় ঈশানী। আয়নার ঠিক উপরে সেন্সর শাওয়ারের নিচে একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা, তার ঠিক বিপরীতে আরও একটা।
এরীশের কাছে ঈশানীর কোনো প্রাইভেসীর সুযোগ নেই। সিংহের শিকারের মতোই নজরবন্দী রমণী। ঈশানী ভালো করেই জানে ওর শাওয়ারের মূহুর্ত গুলো এরীশ কতটা গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে। অনেকটা এডিকশনের মতোই, নাজুক রমণীকে দেখে দেখে তৃষ্ণা মেটায় সে । সেবার বাংলাদেশে থাকাকালীন এই সিকিউরিটি ক্যামেরা গুলো সরাতে চাইলে জোর কণ্ঠে বাঁধ সেধেছিল এরীশ, তীব্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেছিল,
—- পৃথিবীর যে প্রান্তে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, আই ক্রেভ ফর দিজ ক্লিপ অফ ইউ।দিজ ইজ মাই এডিকশন এক্সুয়ালি। তাই এটা কখনো সরাবে না!
ঈশানী কথা রেখেছে, কখনো সরায়নি ক্যামেরাটা। বরং বারবার নিজেকে মেলে ধরেছে দু’টো অদেখা অদৃশ্য চোখের সম্মুখে। নিঃশব্দে ভারী এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে দৃষ্টিপাত করলো ঈশানী। চাপা ক্রন্দনে কণ্ঠনালি বুঁজে আসছে তার। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
— অরণ্য! দেখতে পাচ্ছো আমায়?
নৈঃশব্দ্য।
অতঃপর পজিটিভ চিহ্নিত প্রেগন্যান্সি কীট টা আস্তে করে তুলে ধরলো ক্যামেরার বিপরীতে। তীব্র হৃদস্পন্দের তালে তালে ভারী হলো তার শ্বাসপ্রশ্বাস। গিলে রাখা কান্নাটুকু উগরে বেড়িয়ে এলো এবার। নিঃশব্দে টুপটুপ করে কপোলে গড়ালো নোনাজল। ফের অস্ফুট স্বরে বললো,
— আমাদের গন্তব্যহীন ভালোবাসার প্রথম শর্তটা বোধ হয় আমিই ভেঙে ফেললাম এরীশ! তুমি বলেছিলে কোনোদিন সংসার হবেনা আমাদের । অথচ সেই তুমিই আমার মাঝে সংগোপনে রেখে গেলে নিজের অনাগত এক অস্তিত্বকে। এবার এই নিস্পাপ প্রাণ কে কি জবাব দেবো আমি?
প্রত্যুত্তর এলোনা। পাছে বেড়িয়ে এলো নীলাম্বরীর চাপা আর্তনাদ। টেষ্টকীটটা বুকে জড়িয়ে অকস্মাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। বিলাপ করে বলতে লাগলো,
— তুমি কিভাবে চলে এলে বাবা? তোমার তো ধারণাই নেই তুমি কার উত্তরাধিকার হয়ে এসেছো। এবার কি করবো আমি? কিভাবেই বা রক্ষা করবো তোমায়?
উদরের ছোট্ট প্রাণটা জবাব দিলো না। কেবল নিজের উপস্থিতি জানান দিতে আরও একবার নাজেহাল করে তুললো তার অসহায় জননী কে। হঠাৎ করেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো ঈশানীর। গা গুলিয়ে বমি আসার উপক্রম। ছুটে চলে গেলো বেসিনের সামনে। গরগর করে পানির মতো বমি করে দিলো তক্ষুনি। টানা মিনিট পাঁচেকের অসহনীয় যন্ত্রণার এক পর্যায়ে মনে হতে লাগলো খাবারের সাথে নাড়িভুড়ি সব উগড়ে আসবে ওর। বুকের আর পিঠের পাঁজর গুলো ঠাস ঠাস করে ভেঙে বেড়িয়ে যাবে, আর সবশেষে দম ফুরাবে।ফুরোলো না দম, কোনোমতে নিজেকে সামলে শ্বাস টানলো ঈশানী, চোখেমুখেে পানির ঝাপটা দিয়ে তোয়ালে হাতে ত্যাগ করলো ওয়াশরুম।
ঘরের মাঝে পা রাখতেই কর্ণগোচর হলো অযাচিত কণ্ঠস্বর। সাধারণত গার্ডরা কখনো বিরক্ত করেনা ওকে। কখনো কিছুর প্রয়োজন হলে ল্যান্ডলাইনে অনুমতি চায়, তারপর কক্ষে আসে। কিন্তু আজ হঠাৎ কি হলো? নীরবে দরজা খুলে আউটডোরে উঁকি দিলো ঈশানী। সেখানে কারোর অতর্কিত উপস্থিতি টের পেয়ে তৎক্ষনাৎ শঙ্কিত বদনে ঘুরে এলো আবার।
চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ভিড়। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে স্বগোতক্তি করে বিড়বিড়ালো,
— মৃণালিনীর বয়ফ্রেন্ড নিকোলাস আর একটা অচেনা ছেলে । কিন্তু এরা ব্ল্যাকহোলে কি করছে? ভেতরে ঢুকলোই বা কেমন করে?
ওপাশ থেকে ভেসে আসা চাপা উত্তেজনায়, ভ্রম কাটে ঈশানীর। কানাখাড়া করলে শুনতে পায় নিকোলাসের রাশভারি কন্ঠস্বর।
— মেয়েটাকে তাড়াতাড়ি খোঁজ ইয়ার! পুরো ভবনটাই গোলোক ধাঁধা, কোথায় কোন হিডেন সিকিউরিটি আছে আমরা কিচ্ছু জানিনা।
কিঞ্চিৎ গলা খাকাঁরি দিয়ে উঠলো পাশের জন। কণ্ঠে বিরক্তি টেনে বললো,
— একটা হীরের আংটির জন্য এমন করছিস কেন তুই? গত দু’টো মাস ধরে যে পরিমাণ প্ল্যান করেছিস তাতে আমরা গোটা একটা হীরের দোকান লুট করতে পারতাম ডিউড! ইট’স এ্যা লস প্রজেক্ট।
হতাশায় “চ” উচ্চারণ করলো ছেলেটা। পরক্ষণেই নিচু আওয়াজে ধমকে উঠলো নিকোলাস,
— কিপ ইউর মাউথ শাট এ্যাসহোল ! মুখ বন্ধ না করতে পারলে তোকে আমি এখানেই পুঁতে দেবো।
— হেই কুল! হোয়াই ডু ইউ লুক সো সিরিয়াস?
— বিকজ দিস ইস নট আ ফাকিং ডায়মন্ড। ওটা ব্লাড ডায়মন্ড! পৃথিবীতে একপিসই আছে। এমন দূলর্ভ জিনিস একটা এইটুকুনি বাঙালি মেয়ে হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? একবারও ভেবেছিস? হাউ ইজ ইট পসিবল! তারউপর এতো কড়া নিরাপত্তা। ও মাই গড!
— আর ইউ সিওর? ওটা আসলেই ব্লাড ডায়মন্ড?
— অফকোর্স আ’ম।
— তাহলে আজ মিশন সাকসেসফুল হবেই ডিউড। দরকার পরলে ওই মেয়ের আঙুল সহ কেটে নিয়ে আসবো আমরা।
—এই একটা মেয়ের জন্য গত দুমাস ধরে ঘুম নেই আমার। খাওয়া দাওয়া, মিশন, বেটিং, সবকিছু বরবাদ। এতো কড়া পাহারা,এতোকিছু সব ওর জন্য।আমিতো আজ খু”নই করে ফেলবো ওকে।
শেষ বাক্যটুকু কর্ণগোচর হতেই র’ক্তশূণ্য হয়ে গেলো ঈশানীর মুখাবয়ব। থরথর করে কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ। দু’হাতে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে সংবরণ করলো আর্তনাদ।
পিনপতন নিস্তব্ধ হয়ে আছে পুরো ব্ল্যাকহোল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারিদিকে হিমশীতল শূন্যতা। দরজাটা এখনো খোলাই পরে আছে, প্রকম্পিত হাতে সেটাকে লাগানোর প্রয়াসে একটু এগোতেই আচানক কক্ষে ঢুকে পরলো ওরা দু’জন। জমে গেলো ঈশানী, ভয়ে তার ওষ্ঠাগত প্রাণ। নিজেকে আড়াল করার প্রয়াসে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রেখে ঝট করে লুকিয়ে পরলো ঘরের এককোণের রকিং চেয়ারের পেছনে ।
এদিক সেদিক তন্নতন্ন করে ঈশানীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ছেলে দু’টো। দু’জনার হাতে টানানো ট্রিগারের দু’টো বড় সাইজের শটগান। কক্ষটা বেশ বড় হওয়ার দরুন দু’জনের খোঁজাখুজির মাঝেই আরেকটু বুদ্ধি করে দু’পা এগিয়ে দরজার আড়ালে ঢুকে গেলো ঈশানী।তবে পরিস্থিতির বৈরাগ্যতায় এবারও হারলো সে । তাড়াহুড়োয় সেন্সরে আঙুল লাগতেই পিক পিক আওয়াজ তুলে মালকিনের উপস্থিতি জানান দিলো দরজাটা। শব্দের উৎস খুজঁতে তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো নিকোলাস। আতঙ্কে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো ঈশানীর। কি করবে বুঝতে না পেরে দরজার পেছনে থাকা সুইচবোর্ড চেপে আলো নিভিয়ে দিলো অকস্মাৎ । ঠকঠক করে ছুটে আসা পদযুগল থমকে গেলো তখন। সেই ফাঁকে ঈশানী গিয়ে ঠায় নিলো কাবার্ডের ভেতর।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান তন্মধ্যে দরজাটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো তারা।পাশের ছেলেটা বলে উঠলো,
— এই ঘরেই আছে, আমি নিশ্চিত।
— আমিও।
স্বগোতক্তিতে বিড়বিড়ালো নিকোলাস । ওদের কথোপকথনের মাঝপথে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো ঈশানী। ভয়ে আত্না কাপছে তার। সঙ্গে যোগ হয়েছে দূর্বল শরীরের রুগ্নতা। যখন তখন অবচেতন হওয়ার উপক্রম। ঈশানীর মায়া হতে লাগলো ভীষণ। নিজের জন্য নয়, উদরে বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্য। তার আগমন যেন নৃ”শংসতার উদ্ভাসন। এ কি নির্মম ভাগ্য ঈশানীর! মাফিয়া বসটাকেই কেন ভালোবাসতে হলো ওর? মাহিনের মতো ভদ্র সভ্য, বাস্তবিক ছেলেটার জন্য কেন একটাবার মরিয়া হলোনা অন্তর? তাহলে কি সবটাই ভবিতব্য? কিন্তু কার? এরীশের? নাকি তার ঔরসজাত সন্তানের!
ছুরি-চাকুর ঝনঝন আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটে ঈশানীর। কার্বাডের দরজাটা সামান্য খুলে বাইরে চোখ রাখতেই দেখতে পায়, ঘরের প্রত্যেকটা আসবাব কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে ছেলে দুটো৷ খুব শীঘ্রই হয়তো কাবার্ডের দিকে এগিয়ে আসবে তারা । বলতে বাকি সঙ্গে সঙ্গে নিকোলাসের তীক্ষ্ণ নজর গিয়ে আটকালো কাবার্ডে। নিমেষেই তরিৎ খেলে গেলো অন্তরে। ঠান্ডা এক শীতল স্রোত নেমে এলো শীঁড়দারা বেয়ে। চোখ বন্ধ করে উপর ওয়ালাকে ডাকতে লাগলো ঈশানী। মনেমনে ভাবলো এরীশের কথা, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক এতোক্ষণে মাফিয়া বসের টনক নড়ে যাওয়ার কথা। তাহলে মিরাকল ঘটছে না কেন? কোথায় সে? তার নির্ধারিত গার্ডরাই বা কোথায়?
ভাবনার ফুরসত মিললো না রমণীর, তার আগেই একটা ধারালো ছুরির ফলা এসে আচানক বিদীর্ণ করলো কাবার্ডের মাঝ বরাবর। কুণ্ঠায় সিঁটিয়ে গেলো ঈশানী। শীর্ণকায় শরীরটা জড়োসড়ো করে বসে পড়লো এক কোনে। বসতে গিয়ে ধাতব হ্যাঙারের খোঁচায় চিড়চিড় করে ছিড়ে গেলো তার মাথার ত্বক। প্রচন্ত যন্ত্রনায় আর্তনাদ করতে গিয়ে দু’হাতে মুখ চেপে নিজেকে সামলালো মেয়েটা। কপাল তার র”ক্তসিক্ত।সেথায় টপটপ করে বয়ে চলেছে রঞ্জিত ধারা। ভয়ে কাঁপছে ঈশানী। পালানোর পথ নেই আর, অতএব নিঃশব্দে একটু একটু করে প্রহর গুনছে মৃ”ত্যুর।
একটু বাদেই কাবার্ডটা টান মে’রে খুলে ফেললো নিকোলাস। সাথের ছেলেটাও এসে হাজির হলো সেখানে। মাত্রাতিরিক্ত ভয়ে চিৎকার করতে গিয়েও গলার স্বর নিভে এলো ঈশানীর।
— এইতো ব্লাড ডায়মন্ড! কি মারাত্মক এটা ব্রো!
পাশের ছেলেটা গ্রীবা নামিয়ে ঝুঁকে আসতেই, দু’হাতে নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টায় অন্যদিকে ঘুরলো ঈশানী। তৎক্ষনাৎ ঘটে গেলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঈশানীর হাতের আংটিটা থেকে গ্যাসের মতো কিছু একটা নিসৃত হলো যেন। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওপাশে ছিটকে পরলো ছেলেটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো নিকোলাস। সেই সুযোগে একছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো ঈশানী।
চোখমুখ ঝলসে গিয়েছে বান্দার। নিকোলাস দেখলো ঠিকই, তবে বন্ধুর বিলাপে বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ না করেই ছুটতে লাগলো ঈশানীর পিছু। চোখেমুখ খিঁচে উন্মাদের মতো ছুটছে ঈশানী। দৌড়াতে দৌড়াতেই তার ক্লান্ত মস্তিষ্কে হানা দিলো খানিক আগের ঘটনাটা। এরীশ একবার বলেছিল,
— এটা স্রেফ আংটি নয় , আমার অনুপস্থিতিতে তোমার রক্ষাকবচ। তাই সামলে রেখো।
আজ সেই কথার প্রতিফলন ঘটলো। র”ক্তের মিশেলে এই ধাতু এসিড উৎপন্ন করতে সক্ষম, এবং কোনো না কোনোভাবে মনিবের সুরক্ষায় সোচ্চার হয় এটি ।যদিও এর সঠিক ব্যবহার জানা নেই ঈশানীর।
প্রাণপনে ছুটতে ছুটতে প্ররিশ্রান্ত ঈশানী। অজান্তেই চলে এসেছে অনেকটা পথ। এতোবেশি উত্তেজনা কখনোই সামাল দিতে পারে না ওর দূর্বল হৃদয়, তাই একটু থেমে হাঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা । কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।
এরই মাঝে পেছনে তাকাতেই ভেসে উঠলো ছুটে আসা নিকোলাসের দানবীয় হুংকার।
— তোকে আমি ধরবোই বিচ! আই সয়ার, তোকে আমি ধরবোই!
নিমেষেই আঁতকে উঠলো হৃদয়টা। ব্যথায় নীল হয়ে আসা স্তব্ধ পদযুগল ফের চলতে শুরু করলো রমণীর। মফস্বলের নির্জন রাস্তার বাঁকে বাঁকে চললো লুকোনোর প্রতিযোগীতা। একপর্যায়ে ঈশানীকে গোলোক ধাঁধায় ফেলে হারিয়ে গেলো নিকোলাস।বিভ্রান্ত হয়ে চারিদিকে সচকিত নজর বোলালো ঈশানী। পেছনের দিকে ঘাড় ঘোরাতেই অন্ধকারের সরু গলি থেকে একটা পোক্ত হাত বেড়িয়ে এসে অকস্মাৎ টেনে নিয়ে গেলো ওকে। অতর্কিতে চিৎকার দিয়ে ওঠার আগেই ওর মুখটা চেপে ধরলো আগন্তুক। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,
— হুঁশশ! দেওয়ালের ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
ধুরুধুরু বুকে পাশ ফিরলো ঈশানী। আবছায়ার মাঝে জীবন্ত মূর্তির মতো ভেসে উঠলো জিসানের ঘর্মাক্ত মুখাবয়ব। জিসানকে দেখা মাত্রই চোখ বুঁজে দম ছাড়লো ঈশানী।
নিজেদের মাঝে হাজারো স্নায়ুদন্ধ থাকা সত্ত্বেও জিসানের আগমনে বৃষ্টি শেষে আদ্র বাতাসের মতোই শীতল হয়ে উঠলো তার উদভ্রান্ত অন্তঃকরণ।
সময় পেরোলো। এক পর্যায়ে ঈশানীকে খুঁজে না পেয়ে অন্যদিকে চলে যেতে বাধ্য হলো নিকোলাস। নিকোলাস সরে যেতেই মুখ খুললো ঈশানী,
— তুই এখানে?
— তার আগে বল তোকে কেন তাড়া করছিল ওই ছেলেটা?
ঈশানী কথা ঘোরায়,
— আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিবি?
— কোন বাড়ি?
জিসানের চোখে বিস্ময়!
আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী। অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,
— আমাদের বাড়িতে।
ঈশানী বাড়িতে ফিরেছে আজ দু’দিন হলো। এই দু’দিন রোকেয়া প্রাচী, দেবোরা, সবাই খুব স্বাভাবিক আচরণ করেছে ওর সঙ্গে। না-তো পেছনের কোনোকিছু নিয়ে জ্বালাতন করেছে, আর কোনোপ্রকার নতুন উৎপীড়ন।
বাড়িতে আসার পর থেকেই এরীশের সঙ্গে যোগাযোগ করার বহু প্রচেষ্টা করেছে ঈশানী, কিন্তু লাভ হয়নি। মাফিয়া বস ঠিকই বলেছিল, সে মরিচীকা। পৃথিবীর বুকে থেকেও যেন অস্তিত্বহীন। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে কল করেছিল, রাশিয়া থেকে ফেরার সময় ফ্লোরার দেওয়া পেন্টহাউজের ল্যান্ডলাইন নাম্বারে। আফসোস সেটাও বন্ধ। আঁধার সাম্রাজ্যের আলফার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো উপায় জানা নেই ঈশানীর। তাহলে বাচ্চাটার কি হবে?
তলপেটের উপর আদুরে প্রলেপ বুলিয়ে নীরবে খাটে বসে পড়লো ঈশানী, অপারগ হাহাকারে টইটম্বুর হয়ে আছে তার নীলাক্ষী। এমন সময় দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ঊষা। বোনের উপস্থিতিতে আবেগ সংবরণের পাঁয়তারা চালালো ঈশানী। আড়ালে চোখ মুছে মেকি হাসিতে প্রসারিত করলো অধর কোণ। হাত বাড়িয়ে ডাকলো,
—কাছে আয়।
খানিক এগিয়ে এসে ঈশানীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো ঊষা। বললো,
— এতোদিন কোথায় ছিলে আপু? জানো ওই লোকটা তোমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিল।
— কেন অসুস্থ হয়ে পরেছিল?
ভাবাবেগ শূন্য ঈশানী। ঊষা প্রত্যুত্তর করলো,
— তোমার চিন্তায়। মা ভেবেছিল ওই লোকটা তোমাকে মে’রে ফেলবে।
—মা বুঝি বাঁচিয়ে রাখতো?
আপুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলোনা ঊষা। মিনমিন করে জবাব দিলো,
— নিচে এসো, নানী খেতে ডাকছে।
— তুই যা, আসছি আমি।
আজ দুপুরে এলাহী আয়োজন। পোলাও করা হয়েছে সাথে মেজবান। এছাড়া অনেক পদের সুস্বাদু খাবার, শেষ পাতে ফিরনী ও রেখেছেন রোকেয়া। খাবারের বৈচিত্র্য দেখে কিঞ্চিৎ কৌতুহল জাগলো ঈশানীর। বসার ঘরের এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে শুধালো ,
— কোনো অতিথি এসেছে নাকি! এতো আয়োজন?
— তোর জন্য করেছি সব।
টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন রোকেয়া।
ঈশানী আর প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ বসে পড়লো চেয়ার টেনে। খাবার ঘরে কোলাহল হলোনা আজ , অন্য সময়ের মতো হম্বিতম্বি করলেন না রোকেয়া। যে যার মতো নীরবে খাচ্ছে। শুধু খেতে পারছে না ঈশানী। খাওয়া তো দূরে থাক। মশলা কষানো মাংসের ক্যাটকেটে ঝোলের দিকে তাকালেই গা গুলিয়ে আসছে ওর। সবার খাওয়া দেখেও কেমন কেমন লাগছে।
— কিরে নাতিন, হানা নো হস কা?বেক্কিন ফদ তোর মা লাইন্দে, হানা বউত মজা অইয়্যে, হাই সা।
নানীর কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী। মৃদু হেসে প্লেটের দিকে নজর বুলিয়ে বললো,
— খাচ্ছি।
মায়ের যত্নে খানিক আপ্লুত ঈশানী। এতোগুলো দিন বাদে হয়তো নিজেকে শোধরাতে চেয়েছেন রোকেয়া প্রাচী। তাইতো না খেয়ে থাকতে পারলো না ঈশানী। নিজেকে শক্ত করে চুপচাপ হাত বাড়ালো খাবারে।
—ছাঁ ছাঁ আড্ডি ইয়েন কী মজা।
নানী মজা করে মেজবানী মাংস খাচ্ছে। তা দেখে চোখ গোছালো ঊষা, মুখ ভেঙিয়ে বললো,
— উহ! বুড়ির ঢং দেখো। দাঁত নাই আবার হাড্ডি চিবায়। বলি একটু কম কম খাও। এই বয়সে এতো গোস্তো খাওয়া ভালো না, ব্লাডপ্রেশার বাড়ে।
নাতনীর কথায় খেঁকিয়ে উঠলেন দেবোরা। মেয়েটার সব কথাতে পাকনামি।চোখ রাঙিয়ে বললেন,
—ওই মাইয়াফুয়া, তোত্তে কি অইয়্যে। তোর ফাতের মিক্কে তুই সা।বেশি পাগি গেইয়ুস!
নানীর কথার পাছে ঊষা কিছু বলবে তার আগেই কাণ্ড ঘটালো ঈশানী। নানীর মেজবান খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে গরগর করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো ডাইনিং টেবিল। সবাই তাজ্জব হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে। অবকাশ করলো না ঈশানী, মুখের উপর হাত চেপে ধরে চলে গেলো বেসিনে। কোনোমতে হাতমুখ ধুয়ে সোজা উপরে। ঈশানী চলে যেতেই বিড়াবিড়ালেন দেবোরা,
—কি অইয়্যি ইয়েন!
একপল মায়ের পানে দৃষ্টি বুলিয়ে, থমথমে গলায় বাক্য ছুড়লো রোকেয়া,
— তোমরা থাকো, আমি দেখে আসছি।
ঈশানীর পিছু পিছু রোকেয়া প্রাচী গিয়ে উপস্থিত হলেন কক্ষে। মায়ের আগমনে ওড়নার পেছনে কিছু একটা লুকিয়ে ফেললো ঈশানী। মেয়ের আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করতে করতে চট করেই বোম ফাঁটালো রোকেয়া,
— কি লুকিয়েছিস পেছনে?
শুষ্ক একটা ঢোক গিলে আচারের বয়ামটা পাশের টেবিলের উপর রেখে দিলো ঈশানী,
— তুই পোয়াতি!
ছোট্ট বাক্যটা কর্ণগোচর হতেই তড়াক করে চোখ তুললো ঈশানী। আড়ষ্টতায় জমে হীম হয়ে আছে তার শীর্ণকায়।
— কার পাপ পেটে ধরেছিস?
আবারও তিক্ত আওয়াজ।
— পাপ নয় মা।
কণ্ঠস্বর বুঁজে এলো ঈশানীর
— চুপ্প!
নানী নাতনীর খুনসুটি এখনো চলমান বসার ঘরে, তন্মধ্যে উপর তলা থেকে ভেসে এলো ঈশানীর অযাচিত আর্তনাদ। ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচাচ্ছেন রোকেয়া প্রাচী। তার হইচই তে সচকিত হয়ে উঠলেন দেবোরা, ঊষাকে তাড়া দিয়ে বললেন,
—ওবুক! আয় তো চাই আই গ্যুঁই কী অইয়্যি( চলতো দেখি কি হয়েছে)!
ওরা দু’জন ছুটে এসে দেখলো, ঘরের এককোণে মেঝেতে বসে কাঁদছে ঈশানী। অন্যপাশে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় রাগে ফুঁসছেন রোকেয়া। রুগ্ন কদমে এগিয়ে গিয়ে নিজের মেয়েকে প্রশ্ন ছুড়লেন দেবোরা,
—- কী অইয়্যি ঘরবাড়ি মাথাত তুইল্লুস দে কিল্লেই?
ক্রোধে গজগজ করতে করতে ঈশানীর দিকে আঙুল তুলে জবাব দিলেন রোকেয়া,
— ওই জানোয়ার টার সঙ্গে শুয়ে পোয়াতি হয়ে ফিরেছে তোমার নাতনী! কি ভেবেছে ছেড়ে দেবো ওকে আমি? যতবার ভাবি মেয়েটাকে স্নেহ করবো ততবার একটা না একটা অপরাধ করবেই ও। আর এবার তো শুধু অপরাধ নয়, একেবারে নোংরামি করে ফিরেছে ।
অপমানে শ্রবণেন্দ্রিয় বুদ হয়ে এলো ঈশানীর, হতচকিত নানীর পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— বিশ্বাস করো নানী আমাদের বিয়ে হয়েছে৷ এই বাচ্চা অবৈধ না।
— প্রমাণ ইবা দেহাইত ফারিবি না?
ঈশানীর কাছে প্রমান নেই, তাই চুপ হয়ে রইলো। রোকেয়া কর্কশ স্বরে বললেন,
— কিভাবে প্রমান দেখাবে ও? আছে নাকি এই বাচ্চার পিতৃ পরিচয়।
মায়ের কথায় গর্জে উঠলো ঈশানী,
— খবরদার মা, আমার বাচ্চাকে অবৈধ বলবেনা একদম। ওর বাবা আছে।
— কোথায় ওর বাবা?
মায়ের প্রশ্নে ফের নিশ্চুপ হতে বাধ্য হয় ঈশানী।সত্যিই তো, এরীশ ইউভান কোথায়? গত দু’মাসেও তো খোঁজ নিলোনা ঈশানীর । তবে কি সে সত্যিই ভুলে গেলো? অতর্কিত ব্যথায় খামছে ওঠে ঈশানীর হৃদয়। অস্ফুটে কিছু বলবে, তার আগেই গম্ভীর স্বরে বাক্য ছুড়লো রোকেয়া,
— কোনো গুন্ডা-জানোয়ারের পাপের ফসল আমার মেয়ের গর্ভে থাকতে পারেনা।কিছুতেই না! এই বাচ্চা জন্মালে সমাজে আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না আমাদের।
— তই, কিরিবি?( তাহলে কি করবি?)
ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন দেবোরা।
— গ”র্ভপা”ত!
শব্দটা শোনা মাত্রই দুনিয়া দুলে ওঠে ঈশানীর। অস্থির হয়ে বলে,
— তুমি কিসব বলছো মা! এটা আমার সন্তান। ওর বাবা এখনো জানেইনা ওর অস্তিত্বের কথা। একবার যদি সে এসব কুচক্রের কথা জানতে পারে তাহলে তোমাদের কি হাল করবে ভাবতে পারছো?
মেয়ের কথায় কর্ণপাত করলেন না রোকেয়া। নির্বিকারে কক্ষ ত্যাগে উদ্যত হয়ে জোড় গলায় আদেশ করলেন ঊষাকে,
— ওর ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দে ঊষা । আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোন করছি, সন্ধ্যা বেলায় নিয়ে যাবো ওকে।
— আমার যেদিন সন্তান হবে, সেদিন তোমাকে দেখিয়ে দিবো মা। সত্যিকারের মা কি করে হতে হয়।
কাঁদতে কাঁদতে গলা চিঁড়ে বাক্য ছুঁড়লো ঈশানী।
সেসব কথায় ভ্রুক্ষেপ না করেই দরজা আঁটকে ঈশানীকে কক্ষবন্ধী করে একে একে চলে গেলো সবাই। স্তম্ভিত বিমূঢ় চিত্তে কেবল মেঝেতে পরে রইলো ঈশানী। আলতো হাতে নিজের উদর স্পর্শ করে হিসহিস করে বিড়বিড়ালো,
— যে যা খুশি বলুক, মা তোমাকে রক্ষা করবেই বাবা, তুমি ভয় পেয়োনা।
অতঃপর নৈঃশব্দ্য। কক্ষজুড়ে শুধু ফোপাঁনোর করুন আওয়াজ।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হলো । জোরজবরদস্তি করে ঈশানীকে নিয়ে আসা হলো সদর হাসপাতালে। পরনে তার ধুলোমাখা ময়লা একটা সফেদ ফ্রক, যার পাড়ের অংশ ছিঁড়ে গেছে টানাহেঁচড়ায়। ফ্যাকাসে বর্ণের চেহারায় ক্লান্তির নিদারুণ ছাপ।সবচেয়ে সুন্দর চোখের নিম্নাংশ কালসিটে হয়ে আছে, কার্নিশে জমে আছে
ঘর্মাক্ত নোনাজল।
সন্ধ্যার সময় আউটডোরে রোগীদের উপচে পরা ভিড় ।শ্বাস ফেলার জায়গা অবধি নেই। মানুষের মাঝে কোনোমতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী, ওর একহাতের কব্জিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে ঊষা। রোকেয়া প্রাচী ভেতরে সিরিয়ালের জন্য গিয়েছেন।
এসব গোপনীয় ব্যপারে ভাইকে অনুপ্রবেশ করাতে চাননা রোকেয়া, তাই ঊষাকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ঈশানীকে চোখে চোখে রাখার জন্য। এতো সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে ঈশানী নয়। মনেমনে ভাবতে লাগলো পালানোর কৌশল।
মানুষের গাদাগাদি তে ঊষার যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ, তখনই হুট করে বলে উঠলো,
— হাতটা ছাড় ঊষা ওয়াশরুম যাবো।
মাথা নাড়িয়ে নাকচ করলো ঊষা। বললো,
— মা নিষেধ করেছে আপু।
— তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না?
বোনের কথায় চুপসে গেলো ঊষা।মুখ কাঁচুমাচু করে আওড়ালো,
— কিন্তু মা যদি….
— কিচ্ছু হবেনা আমি যাবো আর আসবো।
বেচারি ঊষা, দ্বিধাদ্বন্ধের মধ্যে ফেঁসে গিয়ে একপর্যায়ে ছেড়েই দিলো ঈশানীর হাত। এরপর ঈশানীকে আর পায় কে? চোখমুখ খিঁচে দৌড়াতে লাগলো অহর্নিশ। করিডোরের উপচে পরা ভিড় কিংবা আঁধারের নিস্তব্ধতা, কোনোকিছুই আর দমাতে পারলো না ওকে।
ছুটতে ছুটতে হাসপাতালের গেট পেরিয়ে চলে এলো ব্যস্ত সড়কে। রোড সিগনাল আর গাড়ির হর্ণে মুখর চারিপাশ। আশেপাশে অচেনা সব ভয়ংকর চোখ । কোথাও কোনো আপনজন নেই,কোনো কাছের মানুষ নেই। ফিরে যাওয়ার মতো কোনো জায়গাও নেই। খোলা আকাশের নিচে ঈশানীর তরে পরে রইলো শুধু দীর্ঘশ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস । বিদীর্ণ চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই অজ্ঞাত বিষাদে ভার হয়ে এলো অন্তর। কিন্তু এখানেই থেমে গেলে তো চলবে না। কথাটা ভেবেই, ফের হন্যে হয়ে ছুটতে আরম্ভ করলো মেয়েটা।
ব্যস্ত সড়ক, সারি সারি স্ট্রিট লাইট সবকিছু পেছনে ফেলে ঈশানী যখন বহুদূর চলে এলো চারিপাশ তখন ঘুটঘুটে অমানিশার কালগ্রাসে আবর্তিত।হয়রান পদযুগল স্তব্ধ হতেই রিমঝিম বর্ষনের উল্লাসে মেতে উঠেছে প্রকৃতি। বৃষ্টি মুখরিত আদ্র সড়ক ধরে বিদ্ধস্ত পায়ে এলোমেলো হাঁটছে ঈশানী। উদরে তার দু’মাসের ছোট্ট এক অস্তিত্ব। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শীর্ণকায়া। বৃষ্টির তোড়ে ঝাপসা দৃশ্যপট। ঠিক সে সময় অদূরের কোনো এক হ্যাজাক জ্বালানো টং দোকানের ক্যাসেট থেকে ভেসে এলো বিষণ্ন সুরের উপমা, যা শোনা মাত্রই ক্লান্ত পা’দুটো থমকে গেলো রমণীর।
হায় গো প্রাণ বন্দের পিরিতে
আমায় পাগল করেছে,
দেওয়ানা বানাইছে……
কি জাদু করিয়া বন্দে
মায়া লাগাইছে,
অন্ধকার রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিভ্রমে পিছনে তাকিয়ে ছিল ঈশানী । নীল রঙের চোখ দু’টো যে কখন জলে ভরে উঠেছে সে হদিস জানা নেই তার। জীবন্ত মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে আছে নিঃশব্দে। সেই নিঃশব্দ ছাপিয়ে আচানক বেজে উঠলো গাড়ির হর্ণ। হর্ণের বাজখাঁই আওয়াজে কান বন্ধ হয়ে এলো ঈশানীর,ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বের চলন্ত গাড়ির হেটলাইটের তীক্ষ্ণ আলোটুকু দেখা মাত্রই চোখ খিঁচে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো মেয়েটা। অতঃপর ইঞ্জিন থেমে যাওয়ার জোড়ালো প্রকম্পন।
ঈশানীর শরীর থেকে ন্যানো সেন্টিমিটার দূরত্বে এসে অকস্মাৎ থমকে গিয়েছে গাড়িটা। এখনো একই অবস্থাতে দাঁড়িয়ে চোখ খিঁচে রেখেছে রমণী । ভয়ের তোড়ে তিরতির কাঁপছে তার সর্বাঙ্গ। হৃদস্পন্দনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণহীন । হয়তো জ্ঞান হারাবে শীঘ্রই। খানিক বাদেই ছাতা হাতে গাড়ি থেকে নামলো এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ । বৃষ্টির কাঁদাজল পায়ে মারিয়ে চপচপ আওয়াজ তুলে এগিয়ে এলো মেয়েটার সন্নিকটে। অতঃপর হুট করেই ঈশানীর শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করলো অতি পরিচিত এক কর্ণস্বর,
— ঈশানী!
চকিতে চোখ খুললো ঈশানী, সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে তীর্যক নয়নে পরখ করে একই সুরে আওড়ালো,
— মাহিন!
রাশিয়া,
ইয়াকুতিয়ার ছোট্ট গ্রামটা তুষারে ঢেকে থাকে প্রায় সারা বছর। এপ্রিল আর মে, বছরের এই দু’টো মাসেই কেবল দেখা মেলে সূর্যরাজের। ইদানীং ঠান্ডাটা কমে এসেছে খানিক। দুপুরের অনেকটা সময় তাপ বিকিরণের দরুন উষ্ণ হয়ে ওঠে চারিপাশ। আজ তেমনই এক আলো ঝলমলে দুপুর।
গত দু’মাস ধরেই দাদীর কাছে আছে ফ্লোরা। কি জানি তুষার কোথায় আছে ! এতোদিন খোঁজ নেওয়ার সাহস কিংবা স্পর্ধা কোনোটাই হয়ে ওঠেনি রমণীর। তবে আজকের আবহাওয়াটা পাল্টে দিলো মনবাসনা। কি ভেবে যেন ছুটে গিয়ে ফ্যাক্স মেশিনটা নিয়ে বসে পড়লো ফ্লোরা। বড্ড উতলা হয়ে টাইপ করলো,
— জানেন, আজকের দিনটা কত সুন্দর? সূর্যের আলো ঝলমল করছে চারিদিকে, তুষারের স্তূর্প গলতে শুরু করেছে।
ফ্যাক্স পাঠানোর একটু বাদেই বিপ বিপ আওয়াজ হলো মেশিনে, ছুটে গেলো রমণী। মেশিন থেকে কাগজটা বের করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো গুটিগুটি রাশিয়ান অক্ষর,
—- তুষার গলে যাচ্ছে বলে এতো খুশি?
ফ্লোরা ঠোঁট উল্টালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিখলো,
— আমি চাই আপনিও গলে যান, ঠিক গ্রীষ্মের তুষারের মতোই। আমার উপর রাগটা কি আজীবন পুষে রাখবেন?
ফ্যাক্স পাঠিয়ে অপেক্ষায় বসলো রুশকন্যা। এবার নিশ্চয়ই ভালো কিছু পাঠাবে লোকটা। যা পড়া মাত্রই মন ফুরফুরে হয়ে যাবে তার । কিন্তু এতো তুষার জাওয়াদ।
কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা শেষে ছোট্ট করে ফ্যাক্স এলো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫০
—- রাগ নয় আক্ষেপ! তুমি যেদিন সতিত্ব ফিরে পাবে, সেদিন আমার আক্ষেপ ও মুছে যাবে।
রাগে দুঃখে ফ্যাক্স মেশিনটাকে ছুড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরা। হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
—- কেন আপনি এতো স্বার্থপর তুষার? কেনননন!