আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫২
suraiya rafa
আঁধার রাতের রহস্য ভেদ করে বর্ষনে মেতেছে ধরণী। নির্মল, প্রকৃতি জুড়ে শুরু হয়েছে বাতাসের তান্ডব। ধুয়ে মুছে ছাফ হয়ে যাওয়া বৃষ্টিস্নাত পিচঢালা সড়কজুড়ে বারিধারার উন্মত্ত উচ্ছ্বাস। যেন বহুযুগের ক্লান্ত আত্নার নিরবধি প্রফুল্ল স্লোগান।
উত্তাল ঝোড়ো বাতাসের দাপুটে হুংকারে শিউরে উঠছে নীলাচল। তীব্র ঝড়ের মাঝেই আঁধার কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে মাহিনের চার চাকার মার্সিজিড। গন্তব্যহীন এক ফেরারী যাত্রায়।
ঝুম বৃষ্টির দানবীয় ঝাপটায় ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে সম্মুখের দৃশ্যপট । এপাশ-ওপাশ ঘুরতে থাকা গ্লাস ওয়াইপার দু’টো আলগোছে সরিয়ে দিচ্ছে সেই বিঘ্নতা। মাহিনের স্থির দৃষ্টি সড়কে নিবদ্ধ। পাহাড়ি এলাকায় পিচ্ছিল রাস্তাগুলোর প্রতিটি বাঁকই যেন ভয়ংকর মৃ”ত্যু ফাঁদ, তাই মনোযোগ ধরে রাখা আবশ্যক । কিন্তু সেই কাজে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে মাহিন। না চাইতেও তৃষ্ণার্থ নয়ন জোড়া ঘুরেফিরে আঁটকে যাচ্ছে এক রহস্যময়ীর মায়াবী ঐন্দ্রজালে । বর্ষণের এই রোমাঞ্চকর রাতে হুট করেই যার দেখা পেয়েছে মাহিন। এই মূহুর্তে তার পাশেই প্যাসেঞ্জার সিটের উপর গুটিশুটি মেরে বসে আছে ঈশানী। শরীর তার ভিজে চপচপে। সফেদ ফ্রকটার এখানে সেখানে গিজগিজ করছে ধুলোবালির আস্তর। এলোমেলো ফ্যাকাসে মুখশ্রী, সুন্দর নীল চোখের মণি দু’টোর প্রজ্বলন হারিয়ে গেছে বিষাদের রিক্ততায়।
বিধ্বস্ত ঈশানীর আপাদমস্তক পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহিন। নিজের ভাবাবেগ সংবরণ করে অত্যন্ত সাবলীল কণ্ঠে বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— তোমার এই অবস্থার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারছি।
ঈশানী ঘুরে তাকায়। মাহিনের শীতল দৃষ্টি অন্তরে অপরাধবোধ জাগ্রত করে তার। মাহিন বলে,
— সুন্দর সাবলীল একটা বাস্তব জীবনকে পায়ে ঠেলে নিষিদ্ধ মরীচিকার পেছনে ছুটছো যন্ত্রণা তো পোহাতেই হবে তোমায় ।
— আপনার হাতে কি হয়েছে?
স্লিং ব্যাগে ঝোলানো মাহিনের বাম হাতের দিকে ইশারা করে প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী। মেয়েটা নিজ জীবনের সংবেদনশীল অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতে অপ্রস্তুত , ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই মাহিন জবাব দিলো,
— এ্যা’ক্সি’ডেন্ট।
— দুই হাতেই?
— হুম, দু’টোতেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
— ইশ! কি করে হলো এমনটা?
—সেটাতো আমিও জানিনা। নিরিবিলি, শান্ত সড়কে কি করে হলো এমন এক্সিডেন্ট। কোথা থেকেই বা ছুটে এসেছিল অতবড় একটা মালবাহী লড়ি?
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড়ায় মাহিন। ঈশানী কপাল কুঁচকায়, তা দেখা মাত্রই প্রসঙ্গ পাল্টে ফের প্রশ্ন ছোড়ে মাহিন।
— কোথায় যাবে ভেবেছো কিছু?
ব্যাকরেস্টে গা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। গলা খাদে নামিয়ে আওড়ালো,
— এরীশের কাছে।
স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই ঈশানীর পানে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহিন। ঈশানী মলিন হাসলো। অপারগ স্বরে বললো,
— একটা সময় ভাবতাম এই পৃথিবীর সবটুকু ঘৃণা আমি এরীশ কে করি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম মাহিন। আমি কখনো এরীশকে ঘৃণাই করতে পারিনি। যদি পারতাম, তাহলে ওর অন্যায় গুলোকে চোখের সামনে দেখেও ভালোবাসতাম না।
—পুরো দুনিয়া যেখানে অন্যায় দেখছে। তুমি সেখানে ভালোবাসা দেখছো। ইউ আর সিক ঈশানী।
মাহিনের কণ্ঠে বিরোধ। ঈশানী বললো,
— আমার জন্য আপনার এতো চিন্তা কিসের? ভালো লাইফ, ভালো ক্যারিয়ার সব আছে আপনার কাছে। এখনই সময়, জীবনটাকে নিজের মতো গুছিয়ে নিন।
— যদি বলি মুভ অন করতে পারছি না, বিশ্বাস করবে?
তৎক্ষনাৎ কথা ঘোরালো ঈশানী।
— ইনানী চলুন, ব্ল্যাকহোলে যাবো।
ঈশানীর বলতে বাকি তন্মধ্যে অ্যাক্সেলে পা দাবালো মাহিন। অকস্মাৎ গতিজড়তায় সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়েও নিজেকে সামলালো মেয়েটা। মাথা তুলে কিছু বলবে, তার আগেই বাক্য ছোঁড়ে মাহিন,
— তোমার গন্তব্যে এসে গিয়েছি। ওই যে সামনেই দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে ক্যাসেলটা।
মাহিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঈশানী তাকালো একপল। পরমূহুর্তেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে শুধালো,
— আপনি জানতেন আমি এখানে থাকি?
তীর্যক হাসির রেশ খেলে গেলো মাহিনের পুরুষালি ওষ্ঠে। অকপটে জবাব দিলো,
— যার নীল নয়নের আড়ম্বরে কতগুলো মাস ধরে বুদ হয়ে আছি, আড়ালে তার খোঁজ খবর রাখাটাকে অন্যায় বলছো?
— না, আমি আপনার সুরক্ষার কথা ভাবছি।
— আর আমি তোমার!
কথা বাড়ালো না ঈশানী। বৃষ্টির মাঝেই নির্বিকারে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। টিন্ডেট জানালার কার্নিশে ভর দিয়ে বাইরে ঝুঁকলো মাহিন। স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— ভেতরে গিয়ে যদি এরীশ কে না পাও? আমি আসবো তোমার সঙ্গে?
তেঁতো স্বাদের তরল নেমে গেলো ঈশানী শুষ্ক কণ্ঠতালু বেয়ে। মাহিনের কথা অগ্রাহ্য করে বললো,
— আমাকে এতোটা পথ সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ মাহিন । এবার আপনি দ্রুত চলে যান।এই জায়গাটা আপনার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়।
— আর যদি তোমার কোনো বিপদ হয়?
উপহাস করে হাসলো ঈশানী। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বললো,
— বিপদকে আলিঙ্গন করেই তো এখানে পৌঁছেছি। পরিত্রানের উপায় কোথায়?
ব্যক্তিত্বধারী মাহিন মেনে নিলো ঈশানীর সিদ্ধান্ত।
— ঠিক আছে। বি কেয়ারফুল।
হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, ধীর পায়ে প্রস্থান করলো ঈশানী। যাওয়ার সময় আরও একবার পিছু ডাকলো মাহিন। কিঞ্চিৎ অধিকার খাটিয়ে বললো ,
— আমি আশেপাশেই থাকবো চিন্তা নেই।
ঈশানী ফিরে তাকালো না আর। দ্রুত হেঁটে আড়াল হয়ে গেলো দৃশ্যপটের।
ব্ল্যাকহোলে পা রাখতেই সশস্ত্র গার্ডদের নির্ভীক অবস্থান পরিলক্ষণ করে স্তব্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। যে সে গার্ড নয় এরা demon Knight যারা সব সময় সঙ্গ দেয় মাফিয়া বসকে। তারমানে কি ঈশানীর ধারণা সঠিক? এরীশ কি সত্যিই ফিরে এসেছে বিডিতে ? নিজ মনের ভাবনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো রমণীর ফ্যাকাসে বদন। দাঁড়ালো না একমুহূর্ত ও আর, লাউঞ্জের গোলকধাঁধা পেরিয়ে ছুটে চলে গেলো দোতলার অফিস কামরায়।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যেয়ে হৃদস্পন্দন গতি হারায় রমণীর। আজ কতগুলো দিন বাদে মানুষটাকে আবারও চোখের সামনে দেখতে পাবে, সেই ভেবে অযাচিত এক শিহরণ বয়ে যায় তার সর্বাঙ্গে । বিগত দিনগুলোর বর্বর বিষণ্ণতা ছাপিয়ে প্রশান্তির দমকা পবনে পুলকিত হয় অন্তর।
লম্বা শ্বাস টেনে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ঈশানী। ভেতরে পা রাখা মাত্রই আকাঙ্ক্ষিত মানুষটার দর্শনে শেষ বিকেলের মরা রোদের ন্যায় শরীর জুড়ে ঝরঝর করে নেমে আসে ক্লান্তির বহর। ওই তো একটু দূরেই পর্বতের ন্যায় নিটোল দাঁড়িয়ে সে মানব।
অনুভূতিহীন শূন্য নেত্রদ্বয় ধনুকের মতো নিবদ্ধ হয়ে আছে ঈশানীর পানে। শুধু এরীশ নয়, তুষার এবং অজ্ঞাত একটা মেয়ে উপস্থিত ছিল ভেতরে। সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই ঈশানীর। ও কেবল সেই মানুষটাকে অবলোকন করতে ব্যস্ত, যে বলেছিল আমি কখনো ছেড়ে যাবো না তোমায়। সে কি আদৌও জানে, তার অভুমিষ্ঠ অংশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ঈশানী আজ কতটা বিধ্বস্ত,কতটা পরিশ্রান্ত।
কক্ষের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। ঈশানীর আগমন যেন ভীষণ অপ্রত্যাশিত এক অঘটন। তেমন করেই ওর পানে ভ্রুকুটি নয়নে তাকিয়ে আছে সবাই। ঈশানী দমলো না, সবার চাহনি উপেক্ষা করে ভেজা চপচপে শরীর নিয়ে এগিয়ে গেলো এরীশের নিকট।
মুখোমুখি দাঁড়াতেই ঠোঁট কাঁপিয়ে কাতর স্বরে ডেকে উঠলো রমণী,
— অরণ্য।
— কেন এসেছো?
অপ্রত্যাশিত এক শীতল বাক্যস্রোত কণ্ঠনালি ভেদ করলো মাফিয়া বসের। এরীশের কথা কর্ণগোচর হতেই বিস্ফারিত নয়নে একযোগে ঘুরে তাকালো তুষার এবং রিয়ানা।ভাবান্তর হলোনা ঈশানীর মাঝে।ও এগিয়ে এসে এরীশের বক্ষ বিভাজিকায় মাথা রাখার প্রয়াস চালিয়ে বললো,
— আমি খুব ক্লান্ত এরীশ। একটু সময় দাও।
সময় দিলো না মাফিয়া বস, ঈশানীর মাথাটা তার শরীর স্পর্শ করার আগেই ব্যঘ্র থাবায় চেপে ধরলো ওর গ্রীবাদেশ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো ঈশানী। কিছু বুঝে ওটার আগেই অনুভব করলো নিঃশ্বাসের বিঘ্নতা। একমুঠো বিশুদ্ধ বাতাসের তাড়নায় যখন হৃদযন্ত্র ছটফটিয়ে উঠলো ঠিক সেই সময় আবারও বাক্য ছুড়লো নির্দয় মানব,
— মাহিনের সাথে গিয়েছিলি তাইনা?
শ্বাসপ্রশ্বাসের বিঘ্নতায় অস্থির হয়ে আছে ঈশানী। কব্জাবন্দি থাকা অবস্থাতেই বলতে চাইলো,
—আমি মাহিনের সাথে যাইনি এরীশ। আ…
বাক্য সম্পন্ন করতে দিলো না এরীশ। যেন ঈশানীকে তাড়ানোর বড্ড বেশি পাঁয়তারা তার। তেমন করেই উগড়ে দিলো নিজের নিকৃষ্ট দানবীয় সত্তা। মেয়েটার কোমল কণ্ঠনালিতে আঙুল দাবিয়ে হিসহিসালো,
— ডিড হি ফা* ইউ বেটার দ্যান মি?
ব্যাস! এক বাক্যে দুনিয়া দুলে উঠলো রমণীর। একটা মেয়েকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার সর্বশেষ অস্ত্র হলো তার চরিত্রে আঙুল তোলা,সেটাই করলো এরীশ। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করা দ্বায়। অপমানের নীল বেদনায় জীবন্ত লাশের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। হৃদয়টা এফোড় ওফোড় হয়ে শুরু হলো রক্তক্ষরণ। সুশ্রী নীলাক্ষী ছাপিয়ে কখন যে জলস্রোত গড়িয়েছে সে হদিস জানা নেই রমণীর।
কক্ষ জুড়ে পিনপতন নীরবতা। অসহনীয় এই নৈঃশব্দ্য ভেঙে শরীরের নয় বরং অন্তরের যাতনায় মাফিয়া বসের শূন্য চোখে চোখ রেখে আর্তনাদ করে উঠলো ঈশানী,
— এরীশ! কিভাবে উচ্চারণ করলে তুমি এটা?
ব্লাডি মনস্টারের অনুভূতিহীন, নির্দয়, অশুভ আত্মা অবধি পৌছালো না সেই আর্তনাদ তার আগেই অকস্মাৎ ধাক্কায় মেয়েটাকে ছুড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে।দূর্বল শরীরটা মনের যাতনায় কাতর, তারউপর এহেন ধাক্কায় নিজেকে সামলাতে পারলো না ঈশানী। হুমড়ি খেয়ে পড়তেই কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে। পেলব নাসারন্ধ্র ভেদ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াতেই পুরোনো স্মৃতিতে টান পড়েছে আবারও , তরতর করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সেসব গা শিউরানো অতীত। কে বোঝাবে মাফিয়া বসটাকে? ঈশানী যে বিধ্বস্ত, ওকে ভাঙার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
রমণীর হৃদয় ছেঁড়া ক্রন্দনে রিয়ানা একটু টলে উঠলেও, নির্বাক তুষার। চিরাচরিত থমথমে তার অভিব্যক্তি। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে এক হাঁটু দাবিয়ে ঈশানীর মুখোমুখি হয়ে বসলো এবার এরীশ। মিলন ঘটলো নয়নের। যেই নীলাম্বর নয়নে একবার তাকালে উদভ্রান্তের ন্যায় দিশেহারা হয় মাফিয়া বস। সেই নীলাক্ষীদ্বয়ে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই ঠিক প্রথমবারের মতো মেয়েটার তুলতুলে চিবুকটা শক্ত হাতে চেপে ধরলো সে। ব্যথার তীব্রতায় চোখ খিঁচে ককিয়ে উঠলো রমণী।
— নাহ! লাগছে আমার।
এক মূহুর্তের জন্য প্রকম্পিত হলো এরীশের তীক্ষ্ণ এ্যাডামস অ্যাপেল। মাফিয়া বস ঢোক গিললো বোধ হয়। অতঃপর শুষ্ক অধর নাড়িয়ে প্রখর কন্ঠে আওড়ালো ,
— একটা ব্লাডিবিস্ট, একটা দূধর্ষ মাফিয়া বসের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কি এক্সপেক্ট করো তুমি?
— কিচ্ছু না। আর কিচ্ছু আশা করি না।
অবশেষে মুখ খুললো ঈশানী। কান্নার তোড়ে ভেঙেচুরে আসতে চাইছে তার সর্বাঙ্গ। ফ্যাকাসে মুখশ্রী র”ক্তিম হয়ে উঠেছে অপমানে। ক্রন্দিত কণ্ঠজুড়ে আক্ষেপের দাবানল। অনাচারের তীব্রতায় ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
— তুমি এটা ডিজার্ভ করো।
এরীশের জোড়ালো বাক্যে রমণীর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো আবারও,
— আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি একটা জানোয়ার। বিবেক বিবর্জিত মনুষত্ব্যহীন দানব একটা। জানোয়ার কখনো কারোর জন্য নিজেকে বদলায় না,কোনোদিন বদলাতে পারে না। আমিই ভুল করেছি,তোমাকে ভালোবেসে, তোমাকে বিশ্বাস করে, আর সবশেষে…
কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত শেষ বাক্যটা সম্পন্ন করলো না ঈশানী। দু’হাতে নিজের পেটটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো ফের । রমণীর নাজুক মন বিষক্রিয়ায় পরিনত হয়েছে। এতোক্ষণে আর কারোর সন্দেহ রইলো না মাফিয়া বসের চূড়ান্ত বর্বরতা সম্মন্ধে, অতএব সরে দাঁড়ালো এরীশ। কয়েকজন গার্ডকে ইশারা করতেই তারা দ্রুত এসে একটা কালো কাপড়ের আচ্ছাদনে মুখ ঢেকে ফেললো ঈশানীর। সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো মেয়েটা।
— আহহ! আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন, কি করছো তোমরা! আমাকে যেতে দাও…
— নিয়ে যাও।
এরীশের রাশভারি কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই ধড়ফড়ালো ঈশানী। ভালোবাসার মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে আকুতিভরা কণ্ঠে ছুড়লো অসহায় বাক্য,
— আমাকে ছেড়ে দিতে বলো এরীশ, পায়ে পড়ি তোমার।
অপমান, অনাচার আর সবশেষে অস্বীকার। যেন ছুটতে ছুটতে বড্ড ক্লান্ত মেয়েটা,তেমন করেই বিসর্জন দিলো আত্মসম্মান। একপর্যায়ে প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ক্রন্দন থামিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো মেয়েটা। কি জানি, চেতনা এখনো আছে কি নেই। ঈশানীকে যখন ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া হলো তখন এরীশের দৃষ্টি ছিল নিগূঢ়, নিস্প্রভ। শূন্য চোখে কখনো আবেগ প্রস্ফুটিত হয়না মানবের। তবুও এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যিক আঁধারে ছেয়ে গিয়েছিল তার কৃষ্ণগহ্বর।
ঠক ঠক ঠক। বিস্তৃত করিডোরে জোড়ালো পদধ্বনি। অফিস কক্ষের দিকেই তড়িৎ বেগে ধেয়ে আসছে একাধিক পদযুগল। ঈশানীকে যখন মুখ ঢেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখনই তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায় কয়েক জোড়া শক্ত বুট পরিহিত ছায়ামূর্তি। সর্বশেষ বুট জোড়া এসে অকস্মাৎ থমকে যায় ঈশানীর সম্মুখে। গার্ড গুলোকে হাতের ইশারা করতেই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পরে তারা। প্রথম দর্শনেই আগন্তুক ব্যক্তিটির সুচারু নয়ন আপাদমস্তক গিলে নিলো ঈশানীকে, ঠোঁটের আগায় প্রস্ফুটিত হলো তীর্যক বাঁকা হাসির রেশ। হাত বাড়িয়ে কালো কাপড়টা তুলতেই যাবে, তন্মধ্যে পেছন থেকে ভেসে এলো তুষারের স্পষ্ট আওয়াজ,
— ডোন্ট টাচ।
পুরুষালি হাতটা থমকে গেলো আচানক। চোখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই, ফের বাক্য ছুড়লো তুষার ,
— সি বিলোংস টু সামওয়ান এলস।
চকিতে কপাল গোছালো ড্যানিয়েল। তার বিভৎস ঝলসানো চেহারার একাংশ কালো মাস্ক দ্বারা আবৃত্ত। অনাচ্ছাদিত অংশটুকু বিদঘুটে দেখায় ভীষণ। কপাল গোছানোর দরুন সহিংস দানবের ন্যায় ভয়াবহ লাগছে তার মুখটা। সেদিকে চেয়ে জোরপূর্বক হাসলো তুষার। জানালো,
— এক্সুয়ালি, সি ইজ অলরেডি টেকেন।
কপালের ভাঁজ উবে গেলো ড্যানিয়েলের। মাথা নাড়িয়ে কপট হাসলো সে । রমণীর ধনুকের ন্যায় বাঁকানো শরীরটা আরও একবার লোভাতুর নয়নে পরখ করে বললো,
— সো স্যাড। তার সৌন্দর্য আমার নজর কেড়েছে।
— প্লিজ কাম ইন।
হাতের ইশারায় ভেতরে প্রবেশ করার অনুরোধ জানালো তুষার। ড্যানিয়েল এগুলো, দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় তুষারের থমথমে মুখের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে লোকটা আওড়ালো,
— প্রতিশোধ টা তোলা আছে তুষার জাওয়াদ ।
ঠোঁট বাঁকালো তুষার। বিড়বিড় করে জানালো,
— আই এপ্রেশিয়েট ইউ।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরীশ। টলটলে ব্যথাতুর দৃষ্টি তার মেঝেতে আবদ্ধ। ঠিক সেই জায়গাতে, যেখানে একটু আগে ঈশানী পড়ে গিয়েছিল। না, পড়ে যায়নি, এরীশ নিজেই ধাক্কা মে’রে ফেলে দিয়েছিল।
— কি ব্যাপার রীশস্কা, আমাকে ওয়েলকাম করবে না?
দৃষ্টি ঘোরালো এরীশ। তার সম্মুখ চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ড্যানিয়েল। দুপাশে তার চারজন করে মোট আটজন সশস্ত্র গার্ড। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আত্মপ্রতিরক্ষায় সচেষ্ট সে। তাকে দেখা মাত্রই শ্লেষ হাসির ঢেউ খেলে গেলো মাফিয়া বসের ঠোঁটের আগায়। এগিয়ে গিয়ে নিজের গদিতে আসীন হয়ে কটাক্ষের স্বরে প্রত্যুত্তর করলো ,
— আমি যাকে তাকে ওয়েলকাম করিনা মি. হ্যারিসন।
ড্যানিয়েলের আধখানা মুখের রঙ পাল্টে গেলো অকস্মাৎ। সে অপমান গিলে বললো,
— সে তুমি ওয়েলকাম করো কিংবা নাই করো, আমাকে কিন্তু কখনো উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
— বিডি তে কেন এসেছেন সেটা বলুন। কি ডিল আপনার?
এরীশের কথার পাছে নিঃশব্দে হাসলো ড্যানিয়েল। বিভৎস চেহারা জুড়ে তার অদ্ভুত কপটতা। গভীর স্বরে বললো,
— তোমাকে দূর্বল দেখাচ্ছে মাফিয়া বস। কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?
— এরীশ ইউভানের কোনো দূর্বলতা নেই। আপনার এক চোখের দৃষ্টিতে অপরিপক্কতা রয়েছে।
— এক্সুয়ালি আই ওয়ান্ট টু নো। কিছুদিন পরপরই এরীশ ইউভান নিজের মাফিয়া সাম্রাজ্য ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে যায়। তারপর যখন জানতে পারলাম গন্তব্যটা বাংলাদেশ, দেন আই ওয়াজ কনফিউজড। কেন? এখানেই কেন?
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয় না। আগে নিজের ডিল ক্লিয়ার করুন।নয়তো বেঁচে বেরিয়ে যেতে পারবেন না।
বজ্রধ্বনিতে প্রত্যুত্তর করলো এরীশ। কিন্তু ড্যানিয়েল তো গভীর জলের মাছ। তার সন্দিহান দৃষ্টি কক্ষের প্রতিটি কোনায় কোনায় আবদ্ধ।
— আমাকে আটকাবে সাধ্য কার?
— এদিকে তাকান।
পেছন থেকে রিভলবার তাক করে রাশভারি আওয়াজে বাক্য ছুড়লো তুষার। সেদিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ড্যানিয়েল । অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে এরীশের পানে দৃষ্টিপাত করে ক্রূর উল্লাস নিয়ে বললো,
— দিস ডিল বিলোংস টু সামওয়ান এলস। আসলে আমরা একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি। নীল চোখের বাঙালি মেয়ে।
শেষ বাক্যটা ধীরে আওড়ালো ড্যানিয়েল।
— ডিল ক্যান্সেল!
ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরীশ । ড্যানিয়েল তীর্যক হেসে বলে উঠলো,
— আর ইউ ইনসিকিউর বিকজ অফ সামওয়ান?
— এরীশ ডাজ’ন্ট গিভ অ্যা ড্যাম এ্যাবাউট এক্সপ্লেইনশন। ইউ ক্যান লিভ নাও।
ড্যানিয়েলের মুখের উপর শক্ত কথাগুলো ছুড়ে মে’রে, লম্বা পায়ে গটগটিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলো এরীশ।
আকাশে একফোঁটা আলো নেই, না-তো জমিনে কোনো যানবাহন। নিরিবিলি মেঠোপথজুড়ে অসহনীয় নিস্তব্ধতা। অদূর দিগন্তে একফালি চিঁড় ধরা নীল আলোয় আকাশটাকে ভয়ংকর লাগছে ভীষণ । অঝোর ধারার বর্ষনে কিঞ্চিৎ লাগাম টেনেছে প্রকৃতি। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ঘুটঘুটে তমশাচ্ছন্ন সড়কের শেষ মাথায় ল্যামপোস্টের নিচে হাঁটু মুড়ে বসে আছে ঈশানী। শরীর তার কর্দমাক্ত, চোখে দ্যুতি নেই। এক পৃথিবী সমান অভিমান আর বি’ধ্বস্ত ক্ষ’তবি’ক্ষত একটা হৃদয় নিয়ে গা ছেড়ে আনমনে বসে আছে সে। অযাচিত ভোঁতা বিষণ্ণতায় কাঁদতে ভুলে গেছে যেন। দুনিয়ার কোনো দুঃখই আর ছুঁতে পারছে না তাকে। পৃথিবীর মাঝে থেকেও ডুবে আছে এক অদ্ভুত মায়াকাননে।
একটু পরে বৃষ্টির রেশ বাড়লো সাথে বাতাসের প্রকোপ। আকাশ ছিড়ে দানবীয় গর্জন করে উঠলো মেঘকুঞ্জ। আকাশের বাজখাঁই আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই সংবিৎ ফিরলো রমণীর। বৃষ্টিতে ভিজে ফ্যাকাসে বদন নীল হয়ে যাচ্ছে তার। ঠান্ডার তোড়ে কাপছে সে তিরতিরিয়ে। পলকা হাত দু’টো দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল মেয়েটা। আজ বোধ হয় পাপীকে ভালোবাসার দ্বায়ে আকাশটাও ওকে আশ্রয় দিতে অপ্রসন্ন।
ঠিক এমন সময় ঈশানী উপলব্ধি করলো চারিদিকের মুষলধারার বর্ষণ ছুঁতে পারছে না ওকে আর । ঠান্ডার প্রকোপটাও কমে এসেছে খানিক। অদ্ভুত এই ঘটনার রহস্য ভেদ করার প্রয়াসে উপরে তাকাতেই দেখলো মাথা থেকে কয়েক হাত উপরে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা স্যুট বুট পরিহিত লম্বা অবয়ব। যাকে দেখা মাত্রই রমনীর মলিন বদনে প্রস্ফুটিত হলো নির্বাক খুশির রেশ। ঠান্ডায় জমে যাওয়া ঠোঁট দু’টো নাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,
— মাহিন!
— বলেছিলাম না আশেপাশেই থাকবে ।
প্রশস্ত হেসে জবাব দিলো মাহিন।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। প্রকৃতি আজ হামেশাই কেঁদে ভাসাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রগাঢ় হয়েছে আঁধার। সন্ধ্যা লগ্নের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে আলো জ্বলেছে ব্ল্যাকহোলে। সমুদ্রাগত উত্তাল ঢেউয়ের গর্জনে মুখরিত চারিপাশ। অতঃপর পাষণ্ড এরীশ ইউভানের পদধূলি পরেছে ঈশানীর কক্ষে। কক্ষটা খালি পরে আছে। ভিন্টেজ কারুকাজ শোভিত নান্দনিক কক্ষের প্রতিটি দেওয়ালে ভর করেছে অদ্ভুত এক শূন্যতা। প্রতিটি কোণে ঘুরপাক খাচ্ছে নির্মম হাহাকার। এরীশের দৃষ্টি ঘরের আসবাব গুলোর উপর নিবদ্ধ। সবকিছুই ভাঙাচোরা, এলোমেলো। সে এগিয়ে গেলো নিশ্চল পায়ে, আধভাঙা কফি টেবিলটার উপর রহস্যময়ী মলিন দ্যুতি ছড়াতে ব্যস্ত ব্লাড ডায়মন্ডের আংটিটা। হাত বাড়িয়ে সেটাকে তুলে নিলো এরীশ। এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে খানিকক্ষণ পরখ করে হুংকার ছেড়ে ডেকে পাঠালো গার্ডকে। জলদি ছুটে এলো দু’জন গার্ড। মাফিয়া বসের সামনে দাঁড়াতেই মাথা নুয়িয়ে কুর্নিশ জানালো তারা।
— ইয়েস বস।
— মেয়েটা কোথায়?
একজন ভয়ে ভয়ে বললো,
— আপনি বলেছিলেন কক্ষে এনে, তাকে মুক্ত করে দিতে, আমরা সেটাই করেছি।
বাক্য শেষ হতেই গার্ডের পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এরীশ। তার চাহনির দৃঢ়তায় থরথর করে কেঁপে উঠলো লোক দুটো। ঈশানীকে না পেয়ে দিশেহারা উন্মাদ হয়ে উঠলো মাফিয়া বস। হাতের থাবায় দেওয়ালে টাঙানো কুড়ালটা মুঠোবন্দি করে এক কো”পে শিড়’চ্ছেদ করে ফেললো লোকটার। নিমেষেই র”ক্তের তুফান বয়ে গেলো নান্দনিক কক্ষজুড়ে। পাশে দাঁড়ানো গার্ডটার ওষ্ঠাগত প্রাণ। সে প্রহর গুনছে নির্ম”ম মৃ”ত্যুর।
নৃ’শংসতার চূড়োয় পৌঁছে শব্দ করে দম ছাড়লো এরীশ। গর্জে উঠে বললো,
— আমি ওকে মুক্ত করে দিতে বলেছি, নজরের আড়াল করতে নয়।
মাফিয়া বসের এহেন তুলকালামে ছুটে এলো তুষার। পায়ের নিচের চপচপে র”ক্তের জোয়ারে দৃষ্টি বোলাতেই ধ্বনিত হলো তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর
— কি হয়েছে!
কক্ষে পা রাখা মাত্রই তুষারের দিকে তেড়ে এলো এরীশ। র”ক্তা”ক্ত হাতের মুঠোয় ওর কলার চেপে ধরে গর্জন করে বললো,
— ও কোথায়?
এরীশের কণ্ঠে আক্রোশ। ঈশানীর অনুপস্থিতি টের পেয়ে লম্বা করে শ্বাস টানলো তুষার। এরীশকে শান্ত করার প্রয়াসে গলা খাদে নামিয়ে বললো,
— এক্ষুণি গার্ড পাঠাচ্ছি। এই মূহুর্তে এতোটা উত্তেজনা আপনার জন্য সাপোর্টিভ নয়। বি নরমাল এরীশ, ইউ আর ইনজ্যুরড।
— জাস্ট শাট ইউওর ফা”কিং মাউথ তুষার।
তুষারকে ধাক্কা মে’রে গর্জে উঠলো এরীশ। তুষার বললো,
— রাশিয়া হলে এতোক্ষণে সবগুলো ট্রান্সপোর্ট বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটা রক্ষণশীল দেশে টেরো’রি’জম ইজ নট এলাউড।
তুষারের কথায় বিদ্রুপাত্তক হাসলো এরীশ। আচানক থাবায় যন্ত্রমানবের কোমর থেকে দু’দুটো গান ছিনিয়ে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করতে করতেই স্বগোতক্তিতে আওড়ালো,
— কারোর প্রয়োজন নেই। ওকে খুঁজে বের করার জন্য এরীশ একাই যথেষ্ট ।
— বাট ইউ আর উইক।
তুষারের মুখ থেকে বাক্য নিসৃত হতেই, ফের পেছনে ঘুরে ওর কপাল বরাবর রিভলবার চেপে ধরলো এরীশ, দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— আমার কোনো দূর্বলতা নেই। আই রিপিট, আ’ম নট উইক। আ’ম দ্যা স্ট্রোম ইউ কান্ট ইভেন সারভাইভ।
এক লহমায় কথাগুলো উগড়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো সে। লম্বা করিডোরের আড়ালে এরীশের পদধ্বনি মিলিয়ে যেতেই, কাউকে ফোন লাগালো তুষার। ওপাশের ব্যক্তিটি রিসিভ করা মাত্রই, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদেশ করলো তাকে ,
— এরীশের গাড়িতে একটা ট্র্যাকার সেট করে দিয়ো,…… জাস্ট ফর হিজ সেইফটি পারপাস।
মাহিনের কক্সবাজারের এ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বিলাসবহুল। যদিও এখানে সচরাচর থাকেনা মাহিন । কাজের ব্যস্ততা, আর যান্ত্রিক শহরের কোলাহল থেকে দুদণ্ড ফুরসত পেতে যখন নিরিবিলি সমুদ্রের ধারে একটুখানি একাকী সময় কাটাতে ইচ্ছে করে তখনই কেবল এমুখো হয় সে। তেমনই দু’মাস আগে নিজের দু’টো হাতই অকার্যকর হয়ে যাওয়ার দরুন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পারি জমিয়েছিল মাহিন। সেখান থেকে সোজা কক্সবাজারের এই এপ্যার্টমেন্ট।
লিভিং রুমের কাউচে বসে ম্যাগাজিন ঘাঁটছিল মাহিন। দৃষ্টি তার ম্যাগাজিনে আবদ্ধ হলেও মনোযোগ নেই মোটেই। বারবার খেয়াল চলে যাচ্ছে ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে। একটু বাদেই দরজা খুলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো ঈশানী। মুঠিবন্দি টাওয়াল টা মাহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ধন্যবাদ।
সম্মোহনী হাসলো মাহিন। কাউচে বসতে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,
— এখন বেটার লাগছে?
পায়ের পাতায় দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে নির্লিপ্তে হ্যা জানালো রমণী।
— ড্রেস টা কি ঠিকঠাক হয়েছে? আসলে এতো রাতে….
— সব ঠিকঠাক।
বাক্য সম্পন্ন করার আগেই প্রত্যুত্তর করলো ঈশানী। ভাবুক ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালো মাহিন। মসৃণ কণ্ঠে বললো,
— ঠিক আছে, রামেন বানিয়েছি চলো খাবে।
মাহিন উঠতেই যাচ্ছিল, মাঝপথে বাঁধ সাধলো ঈশানী।
— আমার কিছু বলার ছিল মাহিন।
মাহিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ঈশানী বললো,
— আসলে এরীশ…
— তোমাকে একসেপ্ট করেনি তাই তো?
— সেরকম কিছু নয়। কিন্তু আমি আর ফিরতে চাইনা।
— কি করবে ভেবেছো কিছু?
মাহিনের প্রশ্নে থমকে গেলো ঈশানী। কিছুক্ষণ থেমে হাত নিয়ে রাখলো নিজ উদরে। রিনরিনে কন্ঠে বললো ,
— নিজের জন্য চিন্তা করছি না। কিন্তু আমার বাচ্চা….
সম্পূর্ণ কথা আর কানে ঢুকলো না মাহিনের। বাচ্চা শব্দটা উচ্চারিত হতেই মস্তিষ্ক খেই হারালো তার । ঈশানীকে নিজের করে পাওয়ার শেষ রাস্তাটাও চোখের সামনে এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ঠুনকো কাঁচের মতোই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো মাহিনের অন্তর।
যাতনায় টলমল করছে তার অক্ষিপুট। প্রেমিকের দৃষ্টি সবাই বোঝেনা, ঈশানীও বুঝতে পারলো না। বাহ্যিক ব্যক্তিত্বটুকু ধরে রাখার অশেষ পাঁয়তারা চালিয়ে অবুঝের মতোই প্রশ্ন করলো মাহিন,
— বাচ্চাটা নিশ্চয়ই এরীশের?
তড়াক করে চোখ তুলে চাইলো ঈশানী। গভীর নীল চোখ দু’টোতে রাজ্যের অভিমান ধরে রেখে বললো,
— মাহিন! আপনিও?
— ওহ, হ্যা। কিসব বলছি আমি, এটাতো এরীশেরই বেবি।
— এরীশ ইউভান আমার বাচ্চার জন্য হু’মকিস্বরূপ। আমি চাইনা আমার বাচ্চার উপর কখনো তার অশুভ ছায়া পরুক।
নিজেকে সামলালো মাহিন। সশব্দে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
— বেবিটাকে পৃথিবীতে আনার জন্য হলেও এই মূহুর্তে ভালো একটা এনভায়রনমেন্ট প্রয়োজন তোমার । কিছুদিন আগে ক্যানাডার কিছু ব্র্যান্ডের সঙ্গে কোলাবোরেশান হয়েছে আমার। খুব শীঘ্রই চলে যাবো। তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।
তৎক্ষনাৎ না সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫১
— এরীশ আমার পিছু ছাড়বে বলে আপনার মনে হয়? পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি,ও আমাকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে।
ঈশানীর কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো মাহিন। কণ্ঠে অগাধ আত্নবিশ্বাস নিয়ে বললো,
— এরীশ ইউভান খুঁজলে ঈশানীকে তুজ কে খুঁজবে। অন্যকোনো দেশের পাসপোর্টধারী রমণীকে নয়।