আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৩

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৩
suraiya rafa

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুজ্জামানের ব্লাড প্রেসার হাই। দুশ্চিন্তায় ঘামছেন তিনি দরদরিয়ে। মাথার কাছে হাই ভোল্টেজের এসি। ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখাও, তবুও একটা এয়ারকুলার হাতে নিয়ে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে লিও। এতোকিছুর পরেও মস্তিষ্ক ঠান্ডা হচ্ছেনা মন্ত্রী সাহেবের,লিওর পানে দৃষ্টিপাত করে অযথাই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি,
— কোন এ্যাঙ্গেলে এয়ারকুলার ধরেছো? ঠান্ডার বদলে গরম বাতাস বের হচ্ছে,পজিশন ঠিক করো।
লিও হতাশায় দম ছাড়লো, কোনোপ্রকার ছলচাতুরী না করে সোজাসাপ্টা গলায় বললো,
— নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখলে আর্থিক সংকটের বদলে আপনার প্রাণ সংকটের ঝুঁকি রয়েছে স্যার।
— চুপ করো! প্রাণ সংকটের এখনো বাকি আছে কিছু? চব্বিশ ঘণ্টা শেষ হতে চললো এখনো ওই মেয়েকে খুঁজে পাইনি। এরপর কি হবে জানো?
বাধ্য শিশুর মতো এদিকে ওদিকে মাথা দোলালো লিও। অর্থাৎ সে জানেনা। মন্ত্রীসাহেব রুদ্ধশ্বাসে জবাব দিলেন,

— আমার ক্ষমতা, আমার স্মাগলিং এর বিজনেস,আমার বেগম পাড়ার শতশত কোটি টাকার সম্পত্তি সবকিছু ধরে টান দিবে ওই এরীশ ইউভান। ইতিমধ্যে সে আমার সোনারগাঁও এর বাগান বাড়িটা পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে এরপর নির্ঘাত বাসাবোর কন্সট্র্যাকশনে হা’মলা করে বসবে ।কত কোটি টাকার প্রোপার্টি নষ্ট হয়ে যাবে ভাবতে পারছো?।
লিও আবারও মাথা নাড়ায়, অর্থাৎ সে ভাবতে পারছে না।
—ওর থাবার মুখে একবার পড়লে আমি আনিসুজ্জামান দু’মিনিটে পথের নেড়ি কুকুর হয়ে যাবো।
লিও হতবুদ্ধি হয়ে ঠোঁট উল্টায়, একটু থেমে হয়ে শুধায়,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কিন্তু স্যার একটা মেয়ের জন্য…
বাক্য শেষ হবার পূর্বেই কথা কাটেন মন্ত্রী সাহেব। ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে স্বগোতক্তি করে বিড়বিড়ান,
— সেটাই তো বুঝতে পারছি না লিও। এই ব্লাডিবিস্টটা হঠাৎ কোনো মেয়ের পেছনে কেন পড়লো। কেইস টা কি?
— লাভ কেইস স্যার।
লিওর কথায় অপ্রসন্ন মুখে নাক সেটকান ভদ্রলোক, বিকৃত মুখে বলেন,
— ন্যায়য়য়াহ! এরীশ আর লাভ। এতো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ঘটনা। নির্ঘাত মেয়েটাকে ধরে বেচার ধান্ধায় আছে মাফিয়াটা।
কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্য। এরপরই ঢং ঢং আওয়াজ তুলে দিনের দ্বিপ্রহরের জানান দিয়ে গেলো ভিন্টেজ দেওয়াল ঘড়িটা। সেদিকে দৃষ্টিপাত করে সচকিত হয়ে উঠলো লিও , তড়িঘড়ি করে বললো,

— আপাতত কেইসটাকে সাইডে রেখে দিন স্যার। মাফিয়া বসকে কল লাগান, চব্বিশ ঘণ্টা তো শেষ হয়ে গেলো।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মন্ত্রী সাহেব। মুঠোফোন বের করে কল লাগালেন এরীশের প্রাইভেট নম্বরে। কয়েক মূহুর্ত বাদে ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই তোতলানো শুরু করলেন তিনি।
* কক্সবাজারের পাহাড় ঘেঁষা নিরিবিলি সড়ক। সারারাত দিকভ্রান্তের মতো ড্রাইভ করে কোথা থেকে কোথায় এসে থেমেছে তার হদিস জানেনা মাফিয়া বস। ড্যাশবোর্ডের গুগল ম্যাপে বড়বড় অক্ষরে Error লেখা ভেসে আছে। সামনে সমুদ্র, পেছনে পাহাড়, সাথেই লাগোয়া এক দূর্গম পাহাড়ি রাস্তা। এরীশ সেদিকেই এগোচ্ছে, বেলাগাম উদ্যম গতিতে। কেন এগোচ্ছে জানে না সে। যেন পথভ্রষ্ট এক পরাজিত সৈনিক। তন্মধ্যে বিপ বিপ করে ভাইব্রেট আওয়াজ ভেসে এলো মোবাইল থেকে, ড্রাইভিং করার দরুন কানে এয়ারবাডস ঢুকিয়ে সেন্সরে আঙুল দাবাতেই বিপরীতে প্রান্ত থেকে ভেসে এলো মন্ত্রী সাহেবের ম্লান কণ্ঠস্বর,

— এরীশ!
— বলে ফেলুন।
থমথমে স্বরে প্রত্যুত্তর করলো মাফিয়া বস। মন্ত্রী সাহেব শঙ্কিত, ক্রমশ কণ্ঠতালু জমে আসছে তার। কথা বলতে যেয়েও সুর হারিয়েছেন তিনি।
— স্পিক আপ! হোয়েয়ার ইজ “মি আমর” ( প্রেম আমার)।
একটু ঘুরিয়ে বললো এরীশ। মন্ত্রী সাহেব সে কথা বুঝলো কি বুঝলোনা তার ইয়ত্তা নেই। দুম করেই বলে দিলো,
— শী ইজ আউট অফ দ্যা কান্ট্রি।
— মশকরা করছেন?
এরীশের ধিম কন্ঠে আত্মা খামচে উঠলো আনিসুজ্জামানের। সে বান্দা রুদ্ধস্বরে জবাব দিলো,
— বিলিভ মি এরীশ। তুমি যেইভাবে প্ল্যান দিয়েছিলে, ঠিক সেইভাবে ফোর্স পাঠিয়ে প্রতিটি জেলায় জেলায় চেকপোস্ট বসিয়েছি, বাট শী ইজ গন। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি মেয়েটাকে।

ওপাশের অবিরাম কথার ঝড় কিছুতেই আর কর্ণগোচর হলো না এরীশের। অন্তরের তাড়নায় অস্থির হয়ে এক হাতে প্রথমে মুখমণ্ডল কচলালো সে, তার হাতের পেষণ এতোই তীব্রতর ছিল যে আইব্রাও রিংটা একদিক থেকে খুলে অন্যদিকের মাংসপিণ্ড অবধি বিদ্ধ করে ফেলেছে। পুরো পিয়ার্সিং এর জায়গাটা র”ক্তের লালিমায় রঞ্জিত এখন ,সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো মানুষটা। জিভের ডগায় গাল ঠেলে, অ্যাক্সেলেটেরে পা দাবিয়ে প্যাডেল দিতে লাগলো ইচ্ছেমতো, ফলস্বরূপ মূহুর্তেই লাফিয়ে একশোর উপরে গেলো স্পিডোমিটারের ঘুরন্ত কাটা। বন্ধুর পাহাড়ি রাস্তার পিচ্ছিলতাকে চাকার ঘর্ষণে পিষ্ট করে চোখের পলকে উড়ে যেতে চাইছে যেন গাড়িটা।
ঝড়ের গতিতে ছুটে চলা গাড়িটাকে দিগুণ বেপরোয়া করে দিতে ফের অ্যাক্সেলে পা চেপে ধরলো এরীশ। গতিবিধির তোড়ে গাড়ির ইঞ্জিন স্পৃষ্ট হয়ে হওয়ার উপক্রম। ব্রেকটাও কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে গতির তাণ্ডবে। তবুও দমবার নাম নেই মাফিয়া বসের। সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার তাড়নায় সে ধেয়ে চলেছে উন্মত্ত, ছন্নছাড়া হর্ষের গতিতে। যেন ঈশানীকে না পেলে গোটা দুনিয়া অর্থহীন, তেমন করেই ঘটিয়ে যাচ্ছে একের পর এক বি’ধ্বংস।
শো শো ঝোড়ো বাতাসের তীব্র আওয়াজে ওপাশ থেকে হতচকিত হয়ে উঠলেন মন্ত্রী সাহেব। তিনি অপ্রস্তুত গলায় শুধালেন,

— বাই এ্যানি চান্স, তুমি কি আমার বাড়ির দিকে ছুটে আসছো?
— জানিনা।
দাঁত দাঁত পিষে জবাব দিলো এরীশ।
সহিংস দানবটাকে কিঞ্চিৎ মানানোর চেষ্টা করে তিনি বললেন,
— লিসেন এরীশ। তুমি চাইলে আমি গোটা দেশে কারফিউ বসাবো, তাও আমার বাড়িতে ব’ম্বব্লাস্ট করোনা প্লিজ!
— দেশ কেন? গোটা পৃথিবী তছনছ করে হলেও ওকে এনে আমার কোলে বসাবো, এই যে এখানে।
কথাটা বলতে বলতেই নিজ উরুর উপর হাত চাপড়ালো এরীশ।
— যদি অন্য একটা নীল চোখের মেয়ে, না মানে ট্রেম্পোরারি, তোমাকে শান্ত করার জন্য আর কি।
— সন অব আ বিচ!

অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে ফোনালাপের সমাপ্তি ঘটালো এরীশ। ওপাশের বান্দা কিছু বলার আগেই কানের এয়ারবাডসটা ছুড়ে ফেলে দিলো পাহাড়ের খাদে।
মন্ত্রীর বাচ্চা মন্ত্রী এতোক্ষণে সামনে থাকলে নির্ঘাত কুলখানি হয়ে যেতো। ভদ্রলোকের ভাগ্যটা আজ বেশ ভালো, মানতেই হবে।
কিন্তু এরীশ! তার অশান্ত হৃদয়ের ছটফটানি চোখে দেখার মতো না। দাবানলের মতো দাউদাউ করে জ্বলছে ভেতরটা। প্রতিটি রুদ্ধশ্বাসে যেন ছাইচাপা আগুনের উত্তাপ। ঘুমহীন অস্থির মস্তিষ্ক, আর বেপরোয়া, ব্যতিগ্রস্ত অন্তরের তাড়নায় নিজের মাথার চুল নিজেই খামছে ধরলো এরীশ। গাড়িটা পাগলা ঘোড়ার মতো এদিক-ওদিক ছুটছে, এরীশের মনে হচ্ছে অস্থিরতায় ওর প্রাণটাই বেড়িয়ে আসবে এবার।
নাহ আর সম্ভব নয়! উদভ্রান্ত মস্তিষ্কটাকে শিথিল করার প্রয়াসে গাড়ির ড্রয়ার হাতরে একমুঠো হেরোইন নাকে চেপে ধরলো সে।

খানিকক্ষণ থেমে লম্বা করে শ্বাস নিলো, অতঃপর পুরোপুরি নেশায় বুদ হয়ে গেলো। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই দৃষ্টিপাত করলো সম্মুখে। টালমাটাল ঘোলাটে দৃষ্টিজুড়ে শুধুই এক পবিত্র নীলাম্বরির বিচরণ। এইতো গাড়ির ট্র্যাঙ্কের উপর দু’হাত ছড়িয়ে কেমন আনমনে বসে আছে সে মানবী, বৃষ্টিভেজা হিমেল হওয়ায় তিরতির করে উড়ছে তার ঝরঝরে কেশরাশি। এক স্তর পুরু কাচের আবরণ ভেদ করেও এরীশের নাক চিঁড়ে বুকে এসে লাগছে তার শরীরের স্নিগ্ধ ভ্যানিলার সুঘ্রাণ। ক্রমশ মাতাল হয়ে যাচ্ছে এরীশ,চোখ বন্ধ করলেই তুলতুলে নরম নারীদেহটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে । কখনো কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে ধ্বনিত হচ্ছে,

— অরণ্য… আমার অরণ্য।
তড়াক করে চোখ খুললো এরীশ। গভীর খাদের দাড়প্রান্তে আসতেই টেনে ধরলো গিয়ার। প্রকম্পিত হাতে স্টিয়ার্টিং ঘোরাতে ঘোরাতেই মাদকীয় আচ্ছন্ন স্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
— হেভি ড্রাগ ও তোমার কাছে হার মেনে যায়। তুমিতো নেশার চেয়েও ভয়ংকর। বলো কি তুমি? কি আছে তোমার মাঝে? কেন আমার জীবনে এসেছো? আমাকে নিঃশেষ করে দিতে নিশ্চয়ই?
কয়েক মূহুর্ত নৈঃশব্দ্য। ফের একাই বলতে আরম্ভ করলো এরীশ,
— দুনিয়ার সমগ্র নিয়মের বেড়াজাল পায়ে মারিয়ে এই জানোয়ারটাকে বারবার সুযোগ দিয়েছো, অথচ একমুহূর্ত তাকে বিশ্বাস করে ধৈর্য কেন ধরলে না। কেন সাকুরা?
এরীশের কাল্পনিক সাকুরা প্রত্যুত্তর করলোনা ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বসে, তার বিধ্বস্ত সাকুরা, চোখের কোণের অন্তিম জলটুকু মুছে দুনিয়ার সবটুকু অভিমান নিয়ে ডায়েরির পাতায় লিখলো,
— আমাকে এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল অরণ্য? আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম, তোমার সাথে ফেরারি হয়ে।

আমিতো তোমাকে মেনে নিয়েছিলাম, তোমার পাপের অনলে নিজেকে তমশার মতো মেলে দিয়েছিলাম। তোমার ছোঁড়া বুলেট আর র’ক্তের মিছিলের সঙ্গী হবো বলে কত অনিষ্টই না অগ্রাহ্য করলাম। কত অনাচারের সাক্ষী হলাম। নিজেকে জ্বালিয়ে তোমাকে আলো দিলাম। ধ্বং’সের দারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও চাতকের মতো তোমার সুখ চেয়ে গেলাম। শুধু তোমার হয়ে থাকবো বলে। তোমার ইস্পাত কঠিন বুকের বা পাশে যে নির্জীব হৃদযন্ত্রটা আছে, সেখানে একটুখানি ঠায় পাবো বলে। তোমার অতীত, তোমার বর্তমান, তোমার ভবিষ্যত সবকিছু মেনে নিয়ে এই আমি মরীচিকায় ডুবে গেলাম। অথচ তুমি আমার হাতটা ধরলে না এরীশ। এক সাথে, এক চাদরের নিচে কত ভালোবাসায় মাখানো শব্দহীন প্রতিশ্রুতি ছিল আমাদের,অথচ তুমি আমায় ভালোবাসলে না এরীশ । অবশেষে আরও একবার প্রমান করে দিলে, তুমি আসলে ভালোবাসতেই জানোনা।

বিভ্রমে ডুবে গিয়ে এরীশের বোধশক্তি যখন ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকলো, ঠিক সেই মূহুর্তে সে দেখলো চলন্ত গাড়ির ট্র্যাঙ্কে বসে অবিরত পা দোলাতে থাকা সাকুরা তার পানে চেয়ে সূর্যের মতো হাসছে। কি স্নিগ্ধ সেই হাসি। গাঢ় সমুদ্রের মতো নীলাভ অক্ষিদ্বয় যেন দূর মহাকাশে তিরতির করে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল নক্ষত্রের ঝিলিক। যা দেখা মাত্রই মেঘমুক্ত গোধূলির ন্যায় মাফিয়া বসের ওষ্ঠকোণে এক ছটাক ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠে ফের মিলিয়ে গেলো গাম্ভীর্যের অন্তরায়। তার শুষ্ক কণ্ঠতালু ভেদিয়ে অস্ফুট ব্যথাতুর স্বরে ধ্বনিত হলো,
— প্রেম আমার!
ব্যাস, পরপরই এক বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চারিপাশ। কালো রঙের ঝকঝকে রোলস রয়েস গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় অকস্মাৎ। কয়েক দফা গড়িয়ে, ভেঙে চূর্নবিচূর্ণ হয়ে চোখের পলকে হারিয়ে যায় পাহাড়ের গভীর খাদে।

চিটাগং,
সেই সন্ধ্যা থেকে গুরগুর করছে আকাশ। ঈশান কোণে বুনো মহিষের পালের মতোই জড়ো হয়েছে ঘুটঘুটে কালো মেঘের স্তর। বৃষ্টি আসন্ন, এমতাবস্থায় গলা চিঁড়ে ডাকতে ডাকতে নিঝুমের ঘরে এলো তূর্য।
— নিঝুম, এ্যাই নিঝুম, ঝুমঝুমঝুম!

ডাকে সারা না দিয়েই নিঃশব্দে শুয়েছিল নিঝুম। মনটা আজ বিষণ্ণ তার। মেঘে ঢাকা আকাশের মতোই থমথমে হয়ে আছে হৃদজমিন। জীবনের জটিল সমীকরণে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা । বিয়ের প্রথম প্রথম ভেবেছিল, পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি, আর পরিবারের ব্যস্ততায় কাটিয়ে দিবে জীবনটা। বিয়ে তো সামাজিকতা মাত্র, ভালো যে বাসতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। কিন্তু আজকাল তূর্যকে বিরক্ত লাগেনা আর । আগের মতো অহেতুক ঝামেলাও করে না সে। বরং দ্বায়িত্ববান স্বামীর মতোই একা একা নিজ উদ্যেগে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কটাকে। মাঝে মাঝে নিঝুমের খারাপ লাগে, লজ্জাও হয় ভীষণ। যেখানে নিঝুম এখনো দিনরাত তুষারকে ভেবে ভেবে চোখের জল বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, সেখানে তূর্য তার সবটুকু তাগিদ ব্যায় করছে আত্নীয় স্বজনের সামনে তাদের সম্পর্কটাকে পরিনত দেখানোর প্রচেষ্টায়। নিঝুম অবাক না হয়ে পারেনা, বিস্ময় নিয়ে ভাবে এটাই কি সেই তূর্য? যে বিয়ের রাতে অবধি ওকে খাটে ঘুমাতে দেয়নি।
গত দু’মাসে আর যাই হোক নিঝুম এতোটুকু উপলব্ধি ঠিকই করতে পেরেছে যে তূর্য রহস্যময়। লোকটা ওকে ঠিকঠাক ভালো না বাসলেও অপছন্দ করেনা মোটেই।

— কিরে না খেয়ে শুয়ে আছিস, ডাকছি কানে যায় না?
তূর্যের ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হয় নিঝুমের। সে কাটকাট স্বরে বলে,
— ডাকছেন কেন? আমি ঘুমাবো।
— সারাদিনই তো পরে পরে ঘুমিয়েছিস। খেয়েছিস কয় বেলা? খাবার এখনো টেবিলে পরে আছে কেন?
— খেতে ইচ্ছে করেনি তাই?
কথাটা বলতেই খাটে উঠে এলো তূর্য। ঝট করে নিঝুমের কব্জি ধরে হ্যাঁচকা টান মে’রে বসিয়ে দিলো ওকে। নিঝুম বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখ খুলতেই মিলন ঘটলো নয়নের। মেয়েটার ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া চোখ, আর ছলছলে দৃষ্টির পানে চেয়ে ভ্রু গোছালো তূর্য। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে আহত স্বরে বলে উঠলো,

— তুই কাঁদছিলি?
নিঝুম মাথা নাড়ায়। অনুরোধ করে বলে,
— প্লিজ তূর্য ভাই, একটু একা থাকতে দিন।
— সবসময়ই তো একা থাকিস, নিজের মতো। আমিতো তোকে কোনোদিন বিরক্ত করিনি নিঝুম।
— তাহলে এখন কেন করছেন?
কিছুটা অধৈর্য গলায় চেঁচিয়ে ওঠে নিঝুম। তূর্য পাত্তা দেয়না সেসব। হাত বাড়িয়ে ওর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলে,

— এই বাসাতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই নিঝুম। আমাদের সম্পর্কটা কি আরেকটু উন্নত হতে পারে না?
তূর্যের হাতটা একটা ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে,ফুপিয়ে উঠলো নিঝুম। রুদ্ধস্বরে বললো,
— না পারেনা। হাত সরান।আপনি কেন এতো স্বাভাবিক আচরণ করছেন? কেন আমার নাম ধরে ডাকছেন? কেন নিজেকে আমার স্বামী হিসেবে জাহির করতে চাইছেন? আমি তো এসবে অভ্যস্ত নই তূর্য ভাই।
আচানক প্রত্যাখানে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তূর্যের। দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে ভেতরের ক্রোধ দমিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— জাহির করছি কারণ আমি তোর সত্যিকারের স্বামী আর তুই আমার বিয়ে করা বউ। নিজেকে এতো ইনোসেন্ট ভাবিস না নিঝুম। আমি রেগে গেলে বিছানা থেকে ওঠার মতো অবস্থা আর থাকবে না তোর। ভালোয় ভালোয় বলছি খেতে আয়।

ক্রন্দনে জোয়ার এলো রমণীর। নাকের পাটা কাঁপিয়ে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ভাসালো আবারও। ওর অবিরাম কান্নায় কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো তূর্য। সহসা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নরম গলায় শুধালো,
— বাই এ্যানি চান্স, তোর এভাবে কাঁদার কারণ টা কি আমি?
প্রশ্নটা করতে গিয়েও দম আটকে এলো তূর্যের। কারণ, নারীর কান্নার কারণ হওয়াটাও যে ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এ যাত্রায় সহায় হলোনা তার ভাগ্য। ফুপিয়ে উঠে না সূচক মাথা নাড়ালো নিঝুম।
— তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলি ইডিয়ড! সেই ছেলেকেই করতি, যার জন্য আমার ঘরে বসে এভাবে কাঁদছিস।
অপ্রত্যাশিত হুংকারে আচানক লাফিয়ে উঠলো নিঝুম। তূর্যের এহেন রণমুর্তি ওর ধারণার বাইরে ছিল। মনটা বিষণ্ণ, এমতাবস্থায় তূর্যের চড়াও মেজাজে আগুনে যেন ঘি ঢালার উপক্রম হলো। চটে গিয়ে ছুড়লো কর্কশ বাক্য,

— আপনি কেন বিয়ে করেছেন? আপনাকে তো কেউ জোর করে ধরে বেধে বিয়ে করতে বসায়নি। আপনিতো চাইলেই এক নিমেষে ভেঙে দিতে পারতেন এসব ছলচাতুরী বিয়ের নাটক।
— আমি তোর মতো কাঁদছিও না। সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। আর তোকে দ্যাখ। মানুষ বিধবা হয়ে গেলেও এভাবে কাদেঁনা নিঝুম।
তূর্যের কণ্ঠে পাহাড় সমান আক্ষেপ। কি জানি কি হলো, ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো নিঝুম। রাগের মাথায় হুট করেই উগড়ে দিলো ভেতরে পুষে রাখা চরম সত্যিখানা।
— কেউ কাঁদেনা কিন্তু আমি কাঁদছি, কারণ এই বিয়েটা আমার কাছে শত্রুবিহীন যুদ্ধের মতো। না চাইতেও চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

— আমিতো তোকে জোর করিনি কখনো। তাহলে কেন করছিস নিজের সাথে যুদ্ধ?
— হ্যা করছি, কারণ খালামনির থার্ড স্টেজ ব্লাড ক্যা’ন্সার! মানুষটা অসুস্থ, ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তার অস্তিত্ব। তার শেষমাত্র আবদার টুকু আমি কি করে অগ্রাহ্য করতাম বলুন? শুধুমাত্র খালামনির জন্যই এই বিয়েটা করেছি আমি, আর খালামনির জন্য সারাজীবন এই সম্পর্কটা টিকিয়েও রাখবো। তাই বলে আমার মনের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারোর নেই। আমার স্বামীর ও না।
চকিতে স্তব্ধ হয়ে গেলো তুষার। নিঝুমের কথাগুলো মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে ক্রমাগত বজ্রের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার। শরীরের কোথাও কোনো বাহ্যিক শক্তি নেই, শুধু অনুভব হলো ভেতরের চঞ্চল সত্তাটাকে দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে ফেলেছে কেউ।

— আগে কেন বলিসনি?
হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে প্রকম্পিত স্বরে বাক্য ছুড়লো তূর্য। এতোক্ষণে সংবিৎ ফিরলো নিঝুমের । ঘটনা আঁচ করতেই সঙ্গে সঙ্গে মুখের উপর করতল চেপে ধরে আঁতকে উঠলো সে। নিজের করা বোকামির চরম মূল্য দেওয়ার প্রারম্ভে চোখ খিঁচে আওড়ালো,
— হায় উপরওয়ালা! আমি এতো অধৈর্য কবে হয়ে গেলাম?
— এইজন্যই মা আমাকে চিটাগং পাঠিয়ে দিয়েছে?
তূর্যের কণ্ঠ কঠিন শোনালো। নিঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই পরবর্তী বাক্য ছুড়ঁলো তূর্য,
— আমি এক্ষুণি কক্সবাজার যাবো।
কথাটা বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো সে।
— তূর্য ভাই শুনুন। খালামনি বাড়িতে নেই। তূর্য ভাই!
পেছন থেকে হাজার বার চেঁচিয়েও কাজ হলোনা কোনো। সহসা কোনোমতে ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে তূর্যের পেছনে ছুটলো নিঝুম।

প্রবল বর্ষণে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে রাতের শহর। নিস্তব্ধ সড়কে যানবাহনের আধিক্য নেই, নেই কোনো মানুষের চলাচল। ঝুম বৃষ্টির রাতে সকলেই যেন ঝিমিয়ে পড়েছে নিদারুণ ঘুমঘুম আলস্যে। দিশেহারা, ক্রোধান্বিত তূর্যই কেবল নেমে এসেছে বারিধারায়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বৃষ্টির তোড়ে কাক ভেজা হয়ে গেছে তার সর্বাঙ্গ। সেদিকে মোটেই ধ্যান নেই তার। রাগ আর অভিমানের মিশেলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে হাঁটছে সে দিগ্বিদিক । কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কোনোকিছুই তার বোধগম্য নয় । বেশকিছুটা রাস্তা এভাবেই একাকী হাটতে হাটতে অকস্মাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো নিঝুম।

— পথ ছাড়।
স্পষ্ট স্বরে নিঝুমকে আদেশ করলো তূর্য। দু’কদম এগিয়ে এসে দূরত্বের সংকীর্ণতা বাড়ালো নিঝুম। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললো,
— কোথায় যাচ্ছেন?
— জাহা’ন্নামে।
শব্দটা উচ্চারিত হতেই নিঝুমকে ধাক্কা মে’রে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তূর্য। নিঝুম হাল ছাড়লো না। ছুটে গিয়ে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো তূর্যকে । দু’হাতের নাজুক বাঁধনে সৌষ্ঠব শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে বড্ড অনুনয় করে বলতে লাগলো,
— শুনুন, আমার কথাটা একটু শুনুন। খালামনি বাড়িতে নেই,চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছেন।
একমূর্হুত থেমে, কর্কশ গলায় বাক্য ছুড়লো তূর্য,
— আমি কৈফিয়ত চাইনি। বাসায় যা নিঝুম।
হাতের বাঁধন দৃঢ় করলো নিঝুম। মাথাটা ওর পৃষ্ঠদেশে এলিয়ে দিয়ে বললো,
— আপনিও চলুন।
তপ্তশ্বাস ছাড়লো তূর্য। ছদ্ম রাগ নিয়ে বললো,
— যেভাবে এসেছিস সেভাবে যা।
— আপনার পিছনে ছুটতে গিয়ে কোথা থেকে কোথায় এসেছি নিজেও জানিনা। এখন ভয় করছে।
প্রত্যুত্তর করলো না তূর্য। অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে ছেয়ে গেলো চারিপাশ। উন্মত্ত বারিধারার শীতল পরশ হামেশাই ছুঁয়ে দিলো তাদের সর্বাঙ্গ।তূর্যের পিঠ ছাপানো জলে ভিজে এককার নিঝুম। তার পরিধেয় সফেদ সালোয়ার কামিজের প্রলেপ ছাপিয়ে পেলব তনুর প্রতিটি খাঁজ স্পষ্ট হতেই জমে গেলো তূর্য। শুষ্ক ঢোক গলাধঃকরণ করে নিজের পুরুষালি বাসনা গুলোকে জুতসই সামাল দিয়ে বললো,

—মুক্তি চাস?
— না।
— তবে?
— একটু সময় দিন। আমি গোছাতে চাই নিজেকে, আপনার জন্য।
— আমি ঘরে ফিরলে তোর কাল হবো আজ।
— তবুও চলুন।
তূর্যকে মানানোর প্রয়াসে ঝোঁকের বশেই কথাটা বলে দিলো নিঝুম।
এতোক্ষণে ঘুরে তাকালো তূর্য। গৌড় বর্ণের সুডৌল মুখাবয়ব জুড়ে তার উপচে পরা লালিত্য। বৃষ্টি ভেজা ঝাকড়া চুল মেঘের মতো ঠায় নিয়েছে কপালে। বেদনাবিধুর ছলছলে নেত্রদ্বয় পরখ করতেই অতর্কিতে ভেতরটা খামচে উঠলো নিঝুমের । আজ তার জন্যই ক্ষতবিক্ষত তূর্য। না জানি কতটা কষ্ট বুকে লুকিয়ে এভাবে চেয়ে আছে মানুষটা। ভীষণ টানাপোড়েন নিয়ে আলগোছে আরও খানিকটা সন্নিকটে এগুলো নিঝুম,অতঃপর নিজের গায়ের ওড়নার প্রান্ত তুলে দিলো তূর্যের মাথার অগ্রভাগে। মূহুর্তেই নিঝুমের কপালে কপাল ঠেকালো তূর্য।মোহাবিষ্টের ন্যায় আছন্ন স্বরে বললো,
— চল ফিরে যাই।

কেন রোদের মতো হাসলেনা
আমায় ভালোবাসলেনা,
আমার কাছে…..
দিন ফুরালেও আসলেনা,
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন,
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন…..
— অ্যানাস্থেসিয়া, অ্যানা!
অপরিচিত সম্মোধন , অথচ পরিচিত কণ্ঠস্বর।
পেছন দিকে কারোর অতর্কিত পদধ্বনি টের পেয়ে মাঝপথেই থমকে গেলো ঈশানী। মাহিন গ্রোসারী থেকে ফিরেছে, হাত ভর্তি বাজার তার। ঈশানীকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে আগ বাড়িয়ে শুধালো,

— থেমে গেলে যে?
দিনের শেষ প্রহরের জানান দিয়ে সূর্যরাজ গা এলিয়েছে পশ্চিমে। সোনার ছটার মতো কমলা রঙের মরা রোদ এসে ঠিকরে পড়ছে ভিন্টেজ জানালায়। সেখানটায় দাঁড়িয়ে থাকার দরুন ঈশানীর মোমঢালা কোমল বদনে চিকচিক করছে সোনালি আলো। মাহিনের কণ্ঠে ধাতস্থ হয় রমণী। সহসাই পেছনে ঘুরে জবাব দেয়,
— এমনি?
— এখনো মন খারাপ?
মাহিনের ক্লান্তি মাখা মুখাবয়বে স্বস্তির রেশ। নির্ঘুম চোখে জড়ো হয়েছে ভরসার দীপ্তি। আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হলো বাংলাদেশ ছেড়েছে ওরা। ক্যানাডা ফিরে ঈশানীকে প্রথমে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এক আত্নীয়ের বাড়িতে বন্ধু পরিচয়ে রেখে এসেছিল মাহিন। ভদ্রতার খাতিরে আশ্রয় দিলেও এভাবে একা একা ভিনদেশে একটা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি তারা । তাদের কুঁচকানো নাক আর প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি, চোখ এড়ায়নি মাহিনের। সে যখন বুঝলো এখানকার পরিবেশ আর মানুষ দু’টোই ঈশানীর জন্য বিপজ্জ’নক তখনই এক কাপড়ে নিয়ে চলে এসেছে ঈশানীকে। নতুন শহর, নতুন জীবন, নতুন পরিচয়। যেন পুনরুজ্জীবিন ঘটেছে ঈশানীর। সবকিছু ছাপিয়ে নাজুক উদরে বেড়ে ওঠা অস্তিত্বটাই কেবল পুরাতন।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উইস্টলার শহরটা আলপাইন এরিয়া। ছোট ছোট পাহাড়ি উপত্যকায় মনোরম বাহারি ডিজাইনের সারিসারি বাড়িঘর। এক নজরে দেখলে মনে হবে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে প্রতিফলিত এক ছবিতে আঁকা ছোট্ট শহর। এখানেই একটা রেন্টেড হাউজে উঠেছে ওরা। যদিও আলপাইন অঞ্চল গুলো বছরের বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টি আর বরফে আবৃতিত থাকে,তাই জীবন যাপন কিছুটা দুষ্কর। তবে এরীশের নখদর্পনের আড়ালে থাকার জন্য সরাসরি শহরে না থেকে এই অঞ্চলটাকেই উপযোগী মনে করেছে মাহিন।
খানিক থেমে না সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী। অর্থাৎ তার মন খারাপ নেই। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ওর নিকট এগিয়ে এলো মাহিন। নিরেট স্বরে বললো,

— আই উইশ, তোমার সবটুকু মনখারাপ দূর আকাশের মেঘেদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাক।
ঈশানীর মোমঢালা বদনে আঁধার ঘনালো হঠাৎ। মাথা নমিত করলো তক্ষুনি, পায়ের পাতায় দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই বললো,
— আমার জন্য আপনাকে কতো ঝামেলা পোহাতে হলো। আত্নীয়ের সাথে খারাপ সম্পর্ক তৈরি হলো। কি করে যে বোঝাই,
— কি বোঝাবে?
ঈশানী চট করেই জবাব দিলো,
— আমার বাচ্চাটা হয়ে গেলে আমি আপনার সব ঋণ শোধ করে দিবো মাহিন।
ঈশানীর শিশুসুলভ ভাবনায় মিটিমিটি হাসলো মাহিন, তীর্যক ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

— আচ্ছা! কিভাবে শোধ করবে?
— আমি অনেক কাজ করবো। ততদিন না হয় আমাকে একটু সাহায্য করুন।
ঈশানীর মাথায় হাত রাখতে যেয়েও কি ভেবে যেন ফিরিয়ে নিলো মাহিন। প্রসন্ন হেসে জানালো,
— বোকা মেয়ে! বলেছিলাম না সবসময় পাশে পাবে। তাহলে এখন তো স্যরি কেন হচ্ছো? কে বলেছে তুমি আমার ঝামেলা?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫২

— হুম ঝামেলা, অনেক বড় ঝামেলা।
মলিন মুখে সুপ্ত হাসির রেখা উদয় হলো মাহিনের। ক্লেশ নয়নে এক পৃথিবী সমান আক্ষেপ ধরে রেখে মনে মনে সে আওড়ালো,
— আই উইশ, তুমি আমাকে ভালোবাসতে আর এই সুখের ঝামেলাটুকু সারাজীবন আমার ভাগে লিখে দিতে।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৪