আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৫
suraiya rafa
গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ যেমন ধড়ফড়িয়ে ওঠে, তেমন করেই অকস্মাৎ চোখ খুলে একলাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো ঈশানী। শরীর তার ঘেমে নেয়ে একাকার। কণ্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ, হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে সুডৌল বক্ষদেশ।হৃৎস্পন্দনের গতিহীনতায় বুকটা ফেটে পড়ার উপক্রম। তারপরেও উদগ্রীব দৃষ্টে এদিক ওদিকে চোখ বোলালো সে। রুদ্ধশ্বাসে ডেকে উঠলো,
— ইয়াশ! আমার ইয়াশ কোথায়?
— তোমার দূর্বল হার্টের অধপতন হয়েছে দেখছি। এক চড়ে চব্বিশ ঘন্টা সেন্সলেস!
রাশভারি কণ্ঠের কঠিন কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই অতর্কিতে সামনে তাকালো ঈশানী। দেখলো, ওর মুখ বরাবর বিশাল কাউচ চেয়ারে হাঁটুর উপর পা তুলে গা ছড়িয়ে বসে আছে এরীশ। এক দুর্বোধ্য পৈশাচিক হাসির ঢেউ ঠোঁটে লেগে আছে তার। যেন ঈশানীকে কব্জাবন্দি করে বড্ড বেশি তৃপ্ত সে। তেমন করেই তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করছে রমণীকে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এতোক্ষণে ভ্রম কাটলো ঈশানীর। সচেতন দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে মূহুর্তেই তেঁতে উঠলো সে,
— কোথায় নিয়ে এসেছো তুমি আমায়? আমার ছেলে কোথায়? কি করেছো ওকে?
— রিল্যাক্স! দশহাজার মাইল উড়ে এসেছো, তাও সেন্সলেস হয়ে। ভালো করে চোখ বোলাও ঠিক চিনে যাবে।
এরীশের হীমশীতল কণ্ঠস্বর শরীরে কাঁপন ধরায় মানবীর। সে রিল্যাক্স হতে পারেনা। অস্থির হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতেই অনুধাবন করে কক্ষের মপ পলিশড দেওয়াল গুলো অশুভ ছায়ার মতোই কুচকুচে কালো। ভেতরের সোনালু কারুকাজ শোভিত নান্দনিক আসবাব গুলো কালোর মিশেলে অদ্ভুত ভাবে ঝিল দিচ্ছে চোখের তারায় । কালো রঙা ভেলভেট কাউচের উপর গা ছড়িয়ে বসা কালো ট্রেঞ্চ কোট পরিহিত এরীশকে জমে থাকা প্রলয়ের মতোই ভয়ংকর দেখাচ্ছে। যেন দূর মহাকাশের কোনো উদীয়মান অগ্নিপিণ্ড সে । দেখতে ভীষণ সুন্দর কিন্তু হাতে বাড়ালে ঝলসে যেতে হয়।
কনকনে ঠান্ডা বাতাসে ভেসে বেড়ানো গোলা বারুদের ঝাঁঝালো এক গন্ধ নাকে এসে আঁচড়ে পড়ছে ক্রমাগত। ঈশানীর আর বুঝতে বাকি থাকেনা এরীশ তাকে আবারও সেই নরকের দুয়ারে নিয়ে এসেছে। অগত্যা চকিতে ঘাড় ঘোরায় সে । প্রকম্পিত স্বরে বলে ওঠে,
—প… পেন্ট হাউজ!
— ইয়েস বেইব! দ্যা পাইথন প্যারাডাইস। তোমার একমাত্র ডেসটিনেশন।
নির্বিগ্নে পা দোলাতে দোলাতে প্রত্যুত্তর করে মাফিয়া বস। তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো ছলকে ওঠে ঈশানী। বোধশক্তি জাগ্রত হতেই দু’হাতে শরীর খামচে ধরে করুন সুরে চেঁচিয়ে ওঠে সে,
— আমার ছেলে কোথায় এরীশ? ওকে কি করেছো? তারমানে চব্বিশ ঘণ্টা। চব্বিশ ঘণ্টা আমি আমার ছেলেকে দেখিনি। ওকে আমার কাছে এনে দাও। নয়তো সব শেষ করে ফেলবো আমি। তোমাকেও শেষ করে ফেলবো।
— শেষ করার আর কি বাকি রেখেছো? আমাকে ধ্বং”স করার মতো পৃথিবীতে যদি কোনো মা”রণাস্ত্র থেকে থাকে তবে সেটা তুমি।
হাতের পিঠে নাক ঘষতে ঘষতে প্রত্যুত্তর করে এরীশ। তার ভাবভঙ্গিমা দেখে ঈশানীর বুঝতে বাকি থাকেনা যে এরীশ ড্রাগ নিয়েছে। সে এই মূহুর্তে নিজের মধ্যে নেই।
চেঁচাতে গিয়ে কণ্ঠ নিভে আসে ঈশানীর। বানভাসি স্রোতের মতোই থৈথৈ জলে ভরে ওঠে তার নীলাক্ষী। ঠোঁট ভেঙে বিপর্যস্ত স্বরে বলে,
— প্লিজ এরীশ। আমি আমার বাচ্চাকে দেখবো। আমার এইটুকুনি বাচ্চা। আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ও। আমার বাচ্চাটাকে দেখতে দাও।পায়ে পড়ি তোমার।
হাঁটু ভেঙে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে উন্মাদের ন্যায় বিলাপ করছে ঈশানী। যেন ইয়াশ কে না দেখতে পেলে এক্ষুণি দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে সে, তেমন করেই বেড়ে চলেছে উত্তেজনা। এরীশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ অতঃপর ইশারায় কাউকে আদেশ করলো,
— নিয়ে এসো।
তৎক্ষনাৎ কক্ষে এসে হাজির হয় ফ্লোরা। কোল জুড়ে তার হুটোপুটি খাচ্ছে ছোট্ট ইয়াশ। ক্ষুধার তাড়নায় গলা ছিঁড়ে কাঁদছে সে। সন্তানের ক্রন্দিত স্বর কর্ণগহ্বরে এসে পৌঁছাতেই সচকিত হয়ে ওঠে ঈশানী। তৃষ্ণার্থ চাতকীনির মতো কান্না গিলে গিলে সে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় তার বুকের মানিককে। এমন প্রতিকূল মুহূর্তে বহুদিন বাদে দুই বান্ধবীর চোখাচোখি হলেও কথা বলার আর সুযোগ হয় না। ইয়াশকে কাছে পেতেই মাতৃস্নেহে ব্যগ্র হয়ে পড়ে ঈশানী। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তার সন্তানের পেলব নরম গাল দু’টো। ওদিকে এরীশের উপস্থিতিতে ফ্লোরাও প্রস্থান করে নিঃশব্দে।
ফ্লোরা চলে যেতেই ঈশানী বলে ওঠে,
— ওর ক্ষিদে পেয়েছে। খাবার দিতে হবে এক্ষুণি।
ঈশানীর কথায় প্রথমবারের মতো ইয়াশের দিকে আড় চোখে দৃষ্টিপাত করে এরীশ। মায়ের কোলে মোমের মতো লেপ্টে আছে অংশ তার। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে ঠোঁট ফুলিয়ে । নিজের ক্ষুদ্র অংশের লালিত্যে ভরা কোমল মুখটা দেখেও এরীশের মাঝে ভাবান্তর হলোনা বিশেষ । দৃষ্টিতে ধরা দিলোনা কোনোরূপ পিতৃস্নেহ। অনুভূতিহীন প্রস্তরের মতোই সে চোখ বোলালো নির্লিপ্তে, অতঃপর ঠোঁটের আগায় জলন্ত সিগারেটের শলাকা ধরিয়ে বিতৃষ্ণ গলায় বললো,
— কি খেতে চায় জিজ্ঞেস করো ওকে, আমি ব্যাবস্থা করছি।
এরীশের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে ঈশানী। মূক হয়ে আসা হতাশ দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিস্প্রভ। খানিক সময় নিয়ে নিসৃত হয় রমণীর হতবিহ্বলিত কণ্ঠস্বর,
— তুমি কি পাগ’ল! চার মাসের দুধের শিশু ও। ও কিভাবে বাইরের খাবার খাবে?
— তাহলে যা খেতে চায় সেটাই খাওয়াও। এতো নাটক কেন করছো?
এরীশের দায়সারা প্রত্যুত্তর। ঈশানী বলে ওঠে,
— তাহলে বাইরে যাও।
— হোয়াট!
এরীশের প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামায় ঈশানী। গলা খাদে নামিয়ে নরম স্বরে বলে,
— বাইরে যাও, ওকে ব্রেস্টফিড করাতে হবে।
— দৃষ্টির আড়াল হওয়ার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো।যা করার আমার সামনেই করাবে তুমি। তাছাড়া তোমার মাঝে এমন কিছু নেই যা আমার অদেখা।
— এরীশ! ছেলেটা ক্ষুধায় কাঁদছে আমার। এখনো এমন করবে?
— ডু ইট রাইট নাও।
মাফিয়া বসের নীরব হুংকার। ঈশানীর করার কিছু নেই, সে ইয়াশ কে ওভাবেই খাওয়ালো। এরীশের চোখের সামনে বসে। পুরোটা মূহুর্ত এরীশ তাকিয়ে ছিল জীবন্ত মূর্তির মতো। খাওয়ানো শেষ হলে ফের ফ্লোরাকে ডেকে পাঠালো এরীশ। ধীম কণ্ঠে আদেশ করলো,
— নিয়ে যাও।
ফ্লোরা সময় নষ্ট করলো না, এগিয়ে এসে নিয়ে গেলো ইয়াশ কে। অকস্মাৎ কোলশূন্য হওয়ায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো ঈশানী। ব্যতিগ্রস্ত কদমে ফ্লোরার পিছু নিয়ে বললো,
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমার ছেলেকে। ওর আমাকে প্রয়োজন।
ঈশানী একপ্রকার ছুটেই বেড়িয়ে যাচ্ছিল কক্ষ থেকে। তন্মধ্যে ঝড়ের গতিতে ওর পথরোধ করে এরীশ। কক্ষের দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে ঈশানীকে ধাক্কা মে’রে ঠেলে সরায় সে। ঘটনার আকস্মিকতায় আবারও অস্থির হয়ে ওঠে ঈশানী, বাইরে যাওয়ার পাঁয়তারা চালিয়ে তেজস্বী কণ্ঠে বলে,
— আমার ছেলেকে নিয়ে গেলো এরীশ। দরজাটা খুলে দাও। আমি এক্ষুণি যাবো ওর কাছে।
এরীশ দরজা খোলেনা। উল্টো শরীরের ওভার কোটটা কাউচে ছুড়ে ফেলে শার্টের হাতার আস্তিন গোটাতে গোটাতে এগিয়ে আসে নির্জীব পদচারণায়। চোখে তার আগুন ঝরা উত্তাপ। চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে আছে ক্রোধের তাড়নায়।
কাছাকাছি আসতেই এরীশের রণমুর্তি অবলোকন করে থমকে যায় ঈশানী। চেঁচামেচি থামিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই অতর্কিত এক চপেটাঘাত এসে হামলে পড়ে তার নরম কোমল গালে। আ’ঘাতটা এতোটাই জোড়ালো ছিল যে টাল সামলাতে না পেরে বিছানার উপর ছিটকে পড়লো ঈশানী। ঠোঁট ফেটে র’ক্ত বেড়িয়ে এসেছে তার। মাথাটা ঘুরছে ভনভন করে। তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো মাফিয়া বসের পাথরের মতো গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
— এই চড়টা কেন দিয়েছি জানিস? এক বছর, পুরো এক বছর আমার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য। মাহিনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।
ঈশানী ঘুরে তাকালো না। ও ভালো করেই জানতো ওর সঙ্গে এমন কিছুই হবে। অগত্যা নীরব অশ্রু প্লাবনে দু’চোখ বুঁজে আসে রমণীর। এরীশ আরেকটু এগোয়। তারপর একহাঁটু মুড়ে খাটের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা ঈশানীর সামনে গিয়ে বসে। মাঝখানে ন্যানো সেন্টিমিটারের দূরত্ব তাদের। মুখোমুখি হওয়াতে এরীশের তপ্ত শ্বাসে মুখাবয়ব ঝলসে যেতে চায় ঈশানীর। তার রাজহংসীর মতো গমরঙা ত্বকের ভাঁজে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত করে মাফিয়া বস। ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে শীতল গলায় বলে,
— ব্যথা করছে তাইনা? খুব ব্যথা করছে? আমারও করেছিল। তোর জন্য । এক বছরে কত সময় হয় জানিস?
একটু থামলো এরীশ। ভয়, জড়তা আর আক্ষেপের মিশেলে ঠোঁট ভেঙে নীরবে কাঁদছে ঈশানী । কান্নার ঢেউয়ে তিরতিরিয়ে প্রকম্পিত হচ্ছে তার শীর্ণকায় তনুখানি।
— তিনশো পঁয়ষট্টি দিন, আট হাজার সাতশত সাত ঘন্টা, পাঁচ লক্ষ পঁচিশ হাজার ছয়শত মিনিট, তিন কোটি পনেরো লক্ষ্য ছত্রিশ হাজার সেকেন্ড। এই প্রতিটা মূহুর্ত আমি তোর ব্যথায় ছটফট করেছি। হে’রোইন, মর’ফিন, কো’কেইন কি না নিয়েছি। কিন্তু ব্যথা কমেনি। আমার জীবনে না এলেও তো পারতিস!
ড্রাগের কথা মাথায় আসতেই হাতের পিঠে নাক ঘষতে আরম্ভ করলো এরীশ। যা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। শরীরের ক্ষত ছাঁপিয়ে ভেতর ভেতর ভোঁতা এক যন্ত্রণা অনুভূত হলো তার। এতোক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে চোখ তুললো রমণী। বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললো,
— আমি তোমাকে ভয় পাই এরীশ। তুমি আর তোমার এই অশুভ দুনিয়া কোনোটাই আমার ছেলের জন্য নিরাপদ নয়। কেন ভালোভাবে বাঁচতে দিচ্ছো না আমাদের?
ঈশানীর কথায় চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে উঠলো এরীশের। গৌড় চেহারায় র’ক্ত জমাট বেঁধে গেলো নিমেষেই। নীরবে জিভের ডগায় গাল ঠেলে অকস্মাৎ ঈশানীর চুলের মুঠিতে হাত ঢোকালো সে। শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— আমি যে বিধ্বংসী সেটা আগে মনে ছিল না? কে বলেছিল আমার কাছে আসতে? আমাকে এভাবে উন্মাদ বানাতে?
— পালিয়েই তো গিয়েছিলাম। কেন নিয়ে এলে আবার?
ব্যথার তীব্রতায় আর্তনাদ করে ওঠে ঈশানী। দাঁতে দাঁত পিষে এরীশ বলে,
— নাম পরিচয় পাল্টে ফেললেই পালিয়ে বাঁচা যায়না মিস অ্যানাস্থেশিয়া অ্যানা । লিসেন কেয়ার ফুললি, আমার হাত থেকে এই জীবনে রেহাই নেই তোর। পাঁচ বাচ্চার মা হলেও নিয়ে আসতাম, সেখানে তুই তো আমার কপি পেস্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।
— ব্যথা লাগছে এরীশ, আমার সত্যিই ব্যথা লাগছে।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে হু হু করে কেঁদে উঠলো ঈশানী। এতোক্ষণে টললো হিমালয়। নমনীয়তার কাছে জিদ পরাস্ত হলো তার। চক্ষু শীতল করলো খানিক। হাতের বাঁধন ঢিলে করে ধীর গতিতে দৃষ্টি নামালো সে। মোহাচ্ছন্ন চাওনিতে পরখ করতে লাগলো রমণীকে।
ছলছলে সমুদ্র নীল চোখ দু’টো অশ্রু প্লাবনে বানভাসি আজ। মুখের কোণে র’ক্ত, চোখের কার্নিশ জলে ভিজে, রেশমের মতো সিল্কি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে মুখের উপর।
এরীশ ঢোক গিললো। দৃষ্টিযুগল মিলিত হতেই বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা যাতনায় একযোগে কাতরে উঠলো দু’জন। ঈশানীর ব্যথাতুর চাহনী তীরের মতোই বুকে এসে বিঁধছে তার । সমুদ্রের মতো থৈথৈ নীল চোখে গভীর দৃষ্টিপাত করেই হিসহিসালো এরীশ,
— এভাবে তাকাবে না একদম।
ঈশানী প্রত্যুত্তর করেনা। বুকভাঙা অভিমান আর পৃথিবীর সমগ্র ক্লেশ নিয়ে দৃষ্টির প্রখরতায় ক্ষতবিক্ষত করে দেয় মাফিয়া বসটাকে। বিনিময়ে ক্ষিপ্ত হলো না এরীশ। বেপরোয়া নির্লজ্জের মতোই কোনোরূপ বাক্যবিনিময় না করে আচানক ঈশানীর নরম বুকে মুখ গুঁজলো সে । উষ্ণ চাদরের নিচে দু’জনকে একসঙ্গে মুড়িয়ে উন্মাদের মতো বলতে আরম্ভ করলো,
— আ’ম স্যরি, আ’ম স্যরি, আ’ম স্যরি জান, সো সো স্যরি। কোথায় যাবেনা তুমি। বলো কোথাও যাবেনা আর।
খোলার জানালার ফাঁক গলিয়ে আসা ফুরফুরে ভেজা হাওয়ায় শীতল হয়ে উঠেছে কামরা। একটু বাদেই অস্ত যাবে সূর্যরাজ। কমলা রঙ গায়ে মেখে পাহাড়ের চূড়ায় গেড়ে বসেছে শেষ বিকেলের মরা রোদ। অদূরে ঘুঘু পাখির গুঞ্জন যেন ভাত ঘুমের আসর বসিয়েছে মস্তিষ্কে। এইতো কয়েকটা দিন মাত্র। তারপরেই শুরু হবে স্নোফল। শুভ্র বরফে ঢেকে যাবে প্রকৃতি। রাতদিন নিপতিত তুষারের তীব্রতায় জমে গিয়ে ন্যাড়া কাঠ হয়ে পরে থাকবে গাছপালা গুলো। প্রাণ থেকেও যেন মৃ’ত তারা। ফের আবার কবে বরফ গলিয়ে এমন শরতের বিকেল আসবে জানা নেই তুষারের। সেই বিকেল ও কি এমন নরম, ধীর, প্রাঞ্জল হবে?
ভারী এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তুষারের বুক চিঁড়ে। সে ঠিক করেছে আজ আর ক্লাবে যাবেনা, কোনো মা’রামা’রি তে জড়াবে না । সুন্দর এই বিকেলটা উপভোগ করবে নিজের মতো করে । কিন্তু সে উপায় কি আর এই নৃ’শংস দুনিয়ায় আছে?
বহুদিন বাদে আজ কাচের জানালায় চোখ রেখে অযাচিত মনটা বিষিয়ে উঠলো তুষারের। মায়ের মতো কোমল প্রকৃতির ছায়া তাকে এক ফোঁটা সুখ দিতে পারলো না। উল্টো মনে হলো, এই সুন্দর বিকেল তার জন্য নয়। মাঝরাতের ক্যাসিনো,হারজিতের নোংরা খেলা , স্মা’গলিং, প্র’স্টি’টিউড ক্ল্যাব, আর ডার্ক ওয়েভে যার অবাধ বিচরণ তাকে এমন নির্লিপ্ততায় শোভা পায় না।দেখতে চোখে লাগে ভীষণ।
মূহুর্তেই সরে গেলো সে জানালা থেকে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কানে এয়ারবাডস ঢুকিয়ে বসলো ফের ল্যাপটপ নিয়ে। ভেতর ভেতর চাপা একটা ক্রোধ জমে আছে তার নিজের প্রতি। যা চাইলেও কোনোদিন দূরীভূত করতে পারবে না তুষার। উল্টো ক্রোধের পাহাড় জমে জমে তৈরি হয়েছে বিশাল ক্ষত। আর সেখান থেকেই অদৃশ্য র’ক্তক্ষ’রণ।
— আসবো?
মস্তিষ্কের দ্বিধাদ্বন্ধ যখন চরমে ঠিক সেই মূহুর্তে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো রিনরিনে এক নারী কণ্ঠস্বর। তুষার ঘাড় ঘোরালো। নত মস্তিষ্কের ফ্লোরাকে দেখে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো। অতঃপর চোখ ঘুরিয়ে ল্যাপটপে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
— এসো।
তুষারের অদৃশ্য র”ক্তক্ষরণের অন্যতম কারণ যে স্বয়ং ফ্লোরা। তা অজানা নয় রুশ রমণীর। গত একটা বছর তো এভাবেই কেটে গেলো, ফ্লোরা অতীত ভুলে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইলো তবুও মান ভাঙলো না যন্ত্রমানবের। খুব একটা কথা হয়না ওদের, দেখাও হয়না বিশেষ।
ঈশানীর চলে যাওয়া, অতো বড় সার্জারী সবকিছুর পর থেকেই মাফিয়া বস ছন্নছাড়া। সারাদিন ড্রাগ নিয়ে পরে থাকে, মাথা গরম হলেই শ্যুট করে দেয় যখন তখন। গত একটা বছরে কত নিরীহ র”ক্তই ঝরে গেলো শুধু মাত্র ওই একটা মেয়ের জন্য। এই একটা বছরে এরীশের এতো পাগলামি দেখেছে যে ফ্লোরারও এখন আর অজানা নয় কিছুই। তাইতো পাইথন প্যারাডাইসের গুরুত্বপূর্ণ ভার গিয়ে পড়েছে তুষারের মাথায়। সে ব্যস্ত থাকে সবসময়। ছন্নছাড়া এরীশকেও সামলাতে হয় তাকেই। অপ্রয়োজনে ফ্লোরা পা মাড়ায়না এ ঘরে। তুষার থাকলে তো আরও না। কিন্তু আজকে তো আসতেই হতো।
— শুনছেন?
ফ্লোরা আবার ডাকলে আষাঢ় থমথমে মুখ নিয়ে ঘুরে তাকায় তুষার। দেখতে পায় ছোট্ট ইয়াশকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রমণী।
— কি হয়েছে?
ছদ্ম রাগ নিয়ে প্রশ্ন করলে, ফ্লোরা নরম স্বরে জবাব দেয়,
— সেই সকাল থেকে ঈশানীর ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে এরীশ । ভেতরে ওরা দুজন তাই ডাকতেও পারছি না। এদিকে
বাচ্চাটা কাঁদছে খুব, কিছুতেই সামলাতে পারছি না। মনে হয় ক্ষিদে পেয়েছে।
— ক্ষিদে পেলে খাওয়াও। এটাও বলে দিতে হয়?
বিরক্তির স্বরে কথাটা বলতে গিয়ে থমকে গেলো তুষার। তাড়াহুড়ো চোখ সরিয়ে মাথা চুলকালো অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। পায়ের পাতায় দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে মিনমিনিয়ে ফ্লোরা বললো,
— আমি কিভাবে….
বাক্য সম্পন্ন করার প্রয়োজন পড়লো না। তার আগেই ওর মুখের কথা কেড়ে নিলো তুষার,
— ফর্মুলা মিল্কের ব্যাবস্থা করছি আমি । চিন্তা করোনা আ’ল ম্যানেজ।
কথাটা বলেই যেন হাফছেড়ে বাচলো সে। তেমন করেই উঠে চলে গেলো তরতরিয়ে। সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসলো ফ্লোরা, অতঃপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছোট্ট প্রাণটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে।
তুষার আর এরীশের আচারণ মূলত অবাঞ্ছনীয় নয়। ছোট্ট ইয়াশের হঠাৎ আগমনের জন্য প্রস্তুত ছিলনা ওরা কেউই। যার ফলস্বরূপ সারাজীবন রক্তের খেলায় মাতোয়ারা তুষার আর এরীশের মাঝে নরম কোমল অনুভূতির বড়-ই অভাব। আদর স্নেহ তাদের জীবনের অংশ নয়। তারা তো বিধ্বংসী। হয়তো বাচ্চাটার প্রতি বিশেষ টান অনুভব হতেও সময় লাগবে । তবে পরিস্থিতি সব পারে। কেই বা জানতো যে পেন্ট হাউজ সারাজীবন মৃ”ত্যুর হাহাকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকে, সেখানে হঠাৎ প্রাণের অস্তিত্বের আগমন ঘটবে। তাও স্বয়ং মাফিয়া বসের অংশ। তার র’ক্ত, ইয়াশ ইউভান।
পশ্চিম আকাশ লালাভ বর্ণ ধারণ করে আছে। একটু বাদেই নিকশ আঁধারের পর্দা টেনে হয়ে যাবে রজনী। সবুজে ঘেরা নির্জন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু এক বোটানিক্যাল পার্ক। একপাশে তার কাচের মতো স্বচ্ছ ঝিলের জল। তাতে ভেসে আছে প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুল। ইয়াশকে কোলে নিয়ে রাস্তা ধরেই হাটছিল ফ্লোরা। অকস্মাৎ ফুল দেখে থমকে গেলো তার পদযুগল। একটু দূরেই ওদের অনুসরণ করে এগোচ্ছে তুষার, কানে আবদ্ধ তার সক্রিয় এয়ারবাডস। ইয়াশের কান্নাকাটি থামানোর জন্যই মূলত তাদের এই পার্কে আগমন। ফ্লোরাকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে কান থেকে এয়ারবাডস সরালো তুষার, প্রশ্নবিদ্ধ নয়ন জোড়া রমণীর দিকে তাক করে শুধালো,
— কি হলো?
প্রথমে শুষ্ক একটা গিললো ফ্লোরা। তারপর বুকে খানিক সাহস সঞ্চার করে আবদারের স্বরে বললো,
— পেছনের ঝিলটা কি সুন্দর তাইনা? একদম ক্যালেন্ডারের পাতার মতো।
— হু,
মোবাইলে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে ছোট্ট করে সায় জানালো তুষার। ফ্লোরা মৃদু গলায় বললো,
— একটা ছবি তুলে দিন না।
ফ্লোরার অনুরোধে চোখ তুললো তুষার। গায়ে সফেদ রঙা ফ্রক, মাথায় সিল্কের ছোট্ট স্কার্ফ। ঈষৎ বাদামী চুলগুলো তার কোমড় ছুঁয়েছে নির্বিগ্নে। সূর্যের কমলা আভায় অপ্সরার মতোই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে তার গোলাপি কোমল চেহারা। কুণ্ঠায় দাঁতের পেষণে আঁটকে আছে তার টুকটুকে লালাভ অধর।
আজ বহুদিন বাদে মেয়েটাকে দেখলো সে নয়ন ভরে। নিঃশব্দে কেবল দু’জনার দৃষ্টির মিলনে অতিবাহিত হলো কিছু সময়।
— প্লিজ!
আবারও মিষ্টি করে অনুনয় করলো ফ্লোরা। তুষারের ভ্রম কাটলো এতোক্ষণে। সে তার কঠোর অভিব্যক্তিতে ফিরে গিয়ে মাথা দোলালো একটু। তারপর বললো,
— ওখানে গিয়ে দাঁড়াও।
ফ্লোরা ইয়াশকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়ালো সেখানে। একটু বাদে ক্যামেরা থেকে চোখ সরালো তুষার। স্ফীত স্বরে নির্দেশ করলো,
— স্কার্ফটা খুলে তারপর একটু রিল্যাক্স হয়ে পোজ দাও।
ফ্লোরাকে আর পায় কে। স্কার্ফটা একটানে খুলে লম্বা বাদামী চুল গুলোকে উড়িয়ে দিলো ফুরফুরে শীতল হাওয়ায়। তারপর আবারও দাঁড়িয়ে পড়লো ক্যামেরার সামনে। আরও একটা ক্লিক করে ওর পানে মুগ্ধ নয়নে তাকালো তুষার। বিষ্ময় মিশ্রিত কণ্ঠে ডাকলো,
— ফ্লোরা,
— উমমম!
—- তোমাকে মায়ের মতো কোমল দেখাচ্ছে।
একমূর্হুতের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো ফ্লোরা। অযাচিত এক চাপা অভিমানে চোখের কার্নিশ জলে ভরে উঠলো তার। মনগহীনে ঝঙ্কার তুললো বিরহ বীনার সুর। কে যেন দুনিয়ার সবটুকু অভিমান নিয়ে গেয়ে উঠলো,
যার উষ্ণ আঁচে… ভালোবাসা বাঁচে,
সে হৃদয় ভাঙে তা মানিনা,…
জানিনা কেন তা জানিনা,
জানিনা কেন তা জানিনা…
ক্ষণকাল থেমে হাতের পিঠে চোখ মুছলো রমণী। তারপর আবারও হাসিমুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ছোট্ট ইয়াশকে দু’হাতে তুলে বললো,
— এবার তুলুন।
তুষার তুললো। এদিক ওদিক ঘুরে যত ধরনের পোজ মাথায় এসেছে ফ্লোরা তা দিয়েছে। তুষারও অগ্রাহ্য করেনি কোনো। নিরলস তুলে গিয়েছে ফ্লোরার প্রতিটি ছবি। তুষারের ছবিহীন গ্যালারীর সাদা পৃষ্ঠা ভরে উঠেছে ফ্লোরার হাস্যোজ্জল ছবিতে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এখনো ইয়াশকে নিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন ফ্লোরা। তার চুড়ির মতো রিনঝিন হাসির ঝঙ্কারে কখন যে বিস্তৃত হাসিতে পুরুষালি রুক্ষ ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হয়েছে টের পায়নি যন্ত্রমানব।
গভীর রাত। গহীন অরণ্যের বুক চিড়ে দানবের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরীশের দশতলা ভবনের শীর্ষে অবস্থিত সুউচ্চ পেন্টহাউজ। যার প্রতিটি কোণে কোণে মূর্তির মতো পাহারায় নিয়োজিত সশস্ত্র গার্ড। ঈশানী এখানে আসার পর থেকেই সুরক্ষা জোরদার করা হয়েছে দিগুণ। বহাল রাখা হয়েছে জঙ্গলের সীমানায় পাহারারত নাইট ওয়াচারদের।
আঁধারের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে সশব্দে ঈশানীর কক্ষে এসে উপস্থিত হলো এরীশ। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতেই কানে এসে হানা দিলো কৃত্রিম ঝর্ণা প্রবাহের ঝমঝম আওয়াজ। হতাশায় এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে ধপ করে কাউচের উপর বসে পড়লো এরীশ । উদাসীন কণ্ঠে ধ্বনিত হলো,
— রাতে শাওয়ার নেওয়ার বদঅভ্যেস এখনো আছে।
কথা বলতে বলতেই মুঠোফোনের নীল পৃষ্ঠায় ডুব দিলো সে। তবে সেদিকে মনোযোগ বহাল রাখতে পারলো না বিশেষ। তার আগেই ঘুম ভেঙে শব্দ করে কেঁদে উঠলো ছোট্ট ইয়াশ। প্রথমে ধীরে কাঁদলেও ক্রমশ রেশ বাড়ছে তার। ছেলের অশান্ত ক্রন্দনে ভেতর ভেতর উদগ্রীব হয়ে উঠলো মাফিয়া বস। জিভের ডগায় ঠোঁট ভিজিয়ে একবার উঁকি দিলো ওয়াশরুমে দরজায়। নাহ, ঈশানী এখনো বের হয়নি। ঠিক কি করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে নিজের অনুভূতিহীন সত্তায় অটুট থেকে আবারও মোবাইল স্ক্রিনে দৃষ্টিপাত করলো এরীশ।
বহু চেষ্টার পরেও কেন যেন মনোযোগ বারবার ওই আদুরে কণ্ঠের ক্রন্দনেই আটকে যাচ্ছে তার। কোথাও একটা টান অনুভব হচ্ছে ভীষণ।
সেই তখন থেকে কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটা।কান্নার তোড়ে তার ফর্সা কোমল আদুরে মুখখানি ধারণ করেছে র”ক্তবর্ণ। এরীশ আবারও থমকায়। ভেতরের অস্থিরতা দমাতে ক্রমাগত পা দোলায় সে। তবুও বাচ্চার অবিরত ক্রন্দনে বারংবার মনোযোগ ক্ষুন্ন হচ্ছে তার।অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেশ ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মে’রে উঠে দাঁড়ায় সে। গটগটিয়ে দোলনার কাছে এগিয়ে গিয়ে ,গ্রীবা বাঁকিয়ে সামান্য ঝুঁকে অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বলে,
— তোমার মাম্মাম এখানে নেই, এক্ষুণি কান্না থামাও।
নাজুক পলকা অস্তিত্বখানি ধার ধারলো না সেসব বিরক্তির। সে কান্নার রেশ বাড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকলো দিগুণ তালে। এক পর্যায়ে উপায়ন্তর না পেয়ে বড্ড অনীহা নিয়েই বাচ্চাটাকে কোলে তুললো মাফিয়া বস।
প্রথমবারের মতো জন্মদাতা মানবের কোলের উষ্ণতায় কান্নাকাটি থামিয়ে একটুখানি হেসে উঠলো অংশ তার। এরীশ অবাক হলো। ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
— তুমি হাসতেও জানো?
বিপরীত প্রান্ত থেকে প্রত্যুত্তর এলো না কোনো। সে তার ড্যাডের বুকে লেপ্টে গেলো নীরবে। এরীশ ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলো নৈঃশব্দ্যে। বিস্ময়ভরা নয়নে নিজের ক্ষুদ্র অংশকে দেখতে দেখতেই অস্ফুটে আওড়ালো,
— তোমার চোখগুলো হুবহু আমার মতো! আর ঠোঁটের নিচের তীলটাও।
— ওর নাম ইয়াশ!
একপশলা মন্থর হাওয়ার মতোই পেছন থেকে ভেসে এলো ঈশানীর শীতল কন্ঠস্বর। এরীশ তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। সদ্য স্নাত ঈশানীর বাঁকানো শরীরের প্রতিটি জলকণাকে গ্রাস করলো মৌহ দৃষ্টে। দৃষ্টি অবিচল রেখে আচ্ছন্ন স্বরে বলে উঠলো,
— কতদিন তোমাকে শাওয়ার নিতে দেখিনা।
ঈশানীর আত্মসংযম প্রখর, তবুও এরীশের দৃষ্টির প্রতাপে ঈষৎ আড়ষ্টতায় জমে গেলো সে হঠাৎ । গালে এসে জড়ো হাওয়া জাফরানি রঙ এড়াতে দ্রুত চলে গেলো ছাঁদ বারান্দায়। এরীশ সময় নষ্ট করলো না। ইয়াশ কে দোলনায় শুইয়ে সেও এসে দাঁড়ালো খোলা হাওয়ায়। ঈশানী এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে কব্জিতে টান মে’রে এনে ফেললো নিজের ইস্পাত কঠিন বুকের উপর।
— কোথায় যাচ্ছো? আমি দেখে ফেলেছি।
বহুদিন বাদে চেনা পুরুষালি ক্লোনের সুঘ্রানে মস্তিষ্ক বুঁদ হয়ে আসছে ঈশানীর। ইচ্ছে করছে একটুখানি মাথা রেখে মানুষটার হৃদস্পদন উপভোগ করতে। কিন্তু রাগের কাছে অনুভূতি ফিঁকে হয়ে যায় ক্রমশ।
রাগে অভিমানে নাক কুঁচকায় ঈশানী। এরীশকে ঠেলেঠুলে ছুটে যাওয়ার পাঁয়তারা চালাতেই তার দৃষ্টি গিয়ে আঁটকায় মাফিয়া বসের বক্ষ বিভাজিকায়। ঠিক মাঝখান বরাবর গভীর এক ক্ষত। দেখে মনে হচ্ছে কেউ কাটাছেঁড়া করে ফের জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে জায়গাটা। এতবড় একটা কাটা দাগ দেখে উদগ্রীব হয়ে উঠলো ঈশানী। হাত চালিয়ে পরপর দু’টো বোতাম খুলে উদ্বিগ্ন স্বরে বলতে লাগলো,
— কি হয়েছে এখানে দেখি!
তৎক্ষনাৎ ওকে দূরে ঠেলে দিলো এরীশ।
— কি হলো দেখতে দাও?
অন্তরের তাড়নায় দু’কদম সন্নিকটে এগিয়ে এলো ঈশানী। তৎপর হয়ে হাত বাড়াতে গেলে এরীশ পিছিয়ে যায় আবারও। ধ্বনিত হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা,
— দূরে থাকো। সহ্য করতে পারবে না।
— এরীশ!
ঈশানীর কণ্ঠ আহত শোনালো। চোখ ছাপিয়ে জল এলো। দু’একফোঁটা গড়ালোও বোধ হয়। নাক টেনে বললো,
— কি হয়েছে তোমার বুকে? এমনটা তো আগে ছিল না কখনোই। কি লুকিয়েছো তুমি আমার থেকে?
— তোমাকেই লুকাতে চেয়েছি সারাজীবন।
এরীশের রহস্যে ভরা কথার প্যাঁচ বুঝতে পারে না রমণী।
কথা বলতে বলতে ফের এরীশের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায় সে। দু’হাতে এরীশের শার্টের কলার চেপে ধরে প্রবল অধিকারবোধ নিয়ে বলে,
— আমাকে দেখতে দাও। কতটা ব্যথা পেয়েছো?
— তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো। আমিতো জানোয়ার, আমার আবার ব্যথা লাগে নাকি?
এরীশের রাশভারি কণ্ঠে অভিমানের ঢেউ। ঈশানী অস্থির হয়ে বলে,
— সব কথা পরে হবে। আগে আমাকে দেখতে দাও।
নিজ সিদ্ধান্তে নিটোল মাফিয়া বস। সে আবারও স্বার্থপরের মতো দূরে সরিয়ে দিলো ঈশানীকে। তবে এবার নিশ্চুপ রইলো না ঈশানী। গলা ছিঁড়ে চেঁচিয়ে উঠলো অকস্মাৎ,
— কি লুকাচ্ছো তুমি এরীশ! কি লুকাচ্ছো!
এরীশ প্রত্যুত্তর করে না। যান্ত্রিক রোবটের মতোই একে একে খুলতে থাকে তার সিল্ক শার্টের বোতাম। আর ঈশানী? তার দুনিয়াটা দুলে উঠেছে এতোক্ষণে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে দেখতে থাকে তার স্বামীর ক্ষ”তবি”ক্ষত শরীরটাকে। র’ক্তশূন্য মুখে এগিয়ে গিয়ে দু’হাত নিয়ে রাখে চওড়া সৌষ্ঠব বুকের উপর। ফর্সা বুকের ঠিক মাঝখান থেকে পেট অবধি লম্বালম্বি নেমে এসেছে একটা গভীর কাটা দাগ। বুকের বাম তৈরি হয়েছে আরও কিছু বুলেটের আ’ঘাত, পেটের দিকটাও ছিড়ে গিয়েছে কয়েক ধাপে। ডান পাঁজরের মধ্যিখানে পাঁচ ইঞ্চির মতো প্রশস্ত এক ক্ষ’ত।
কিছু ক্ষত এতোই গভীর যে শরীর কাটা দিয়ে ওঠে আতঙ্কে । প্রতিটি ক্ষতচিহ্নে হাতের প্রলেপ বোলাতে গিয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো ঈশানীর। অন্তরের দহন সামাল দিতে না পেরে তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে উঠলো তার সুশ্রী মুখাবয়ব।
— আগেই বলেছিলাম সহ্য করতে পারবে না।
— কি করে হলো এসব?
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।
অচিরেই ভগ্ন ইমারতের ন্যায় এরীশের শরীর ঘেঁষে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লো ঈশানী । তারপর কি জানি কি হলো? হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। দিশেহারা চাতকিনীর মতো আর্তনাদ করে বলতে লাগলো,
— এতোটা ব্যথা কি করে সহ্য করেছো তুমি? কি করে এরীশ, কি করে?
এরীশ জবাব দিলো না। একটানে ওকে টেনে তুলে কক্ষের বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৪
— চলো একটা জিনিস দেখাই তোমাকে।
পাণ্ডুর মুখে ঘুরে তাকায় ঈশানী। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তুমি আমায়?
— তোমার দুঃখ ঘোচাতে।
অতঃপর লম্বা করিডোরের শেষ প্রান্তে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় তাদের দুর্বোধ্য কণ্ঠস্বর।