আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৬
suraiya rafa
গ্যালারীর মতো বিস্তৃত পেন্ট হাউজের বেজমেন্টের দরজায় গিয়ে থমকালো এলিভেটর। যান্ত্রিক বাহনের নৈঃশব্দ্যিক গতি জড়তায় একটুখানি চমকালো ঈশানী। অবশ্য সে একপ্রকার দিশাহীন ঘোরের মধ্যেই বিরাজ করছে এই মূহুর্তে। ক্ষণকাল আগে এরীশের দেখানো ক্ষতচিহ্ন গুলো তীব্র একটা ব্যথা হয়ে পাথরের মতোই বুকে চেপে আছে তার। ব্যাকুল হৃদয় বারবার উতলা হয়ে জানতে চাইছে,
— কি হয়েছে এরীশের? কেন এতো ব্যথা তার? সেবার একটানা দু’মাস কোথায়ই বা হারিয়ে গিয়েছিল মানুষটা?
ওদিকে দৃঢ় আত্মসংযমে প্রতিজ্ঞ মস্তিষ্কটা তীব্র আক্রোশ নিয়ে রুখে দিচ্ছে সেই উদ্বেগ। তপ্ত ক্রোধ নিয়ে বলছে,
— খবরদার! যে তার বিবাহিতা স্ত্রীর চরিত্রে আঙুল তুলতে পারে। এতো এতো মানসিক যন্ত্রণা দিতে পারে, সে মানুষ নয়, নিতান্তই একটা পাষবিক জানোয়ার।
ঈশানীর কোমল প্রাণ উপহাস করে হাসে। উগড়ে দেয় স্বতঃস্ফূর্ত বাক্য,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— জানোয়ারটাকে জেনেশুনে ভালোবেসে ছিলাম আমি। তার মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলাম নিজের সবটুকু লাজুকতা।
— পাপ করেছিস! অন্যায় করেছিস! তোরা দু’জন পৃথিবীর দুই প্রান্তের যাযাবর। আগুন আর জলের মতোই সাংঘর্ষিক । তোদের মিলন মানেই বি’ধ্বংস। না এরীশ কখনো নিজের কালো দুনিয়া থেকে মুক্তি পাবে। আর না’তো তোকে কখনো স্বাভাবিক একটা জীবন দিতে পারবে।
ঈশানীর নাজুক সত্তা কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। সে উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
— তাহলে আমার ছেলের কি হবে? ওর কোমল পৃথিবীটা কি এই অশুভ আঁধারের রুক্ষতার মাঝেই আটকা পড়ে যাবে?
আত্নবিশ্বাসী মস্তিষ্কটা ফের প্রত্যুত্তর করবে। তার আগে ওর হাতের কব্জিটা করতলের শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে এরীশ। কোনোকিছু না বলেই সোজা নিয়ে আসে ট’চার্র সেলের একটা জরাজীর্ণ কামরায়।
সেলের ভেতর থেকে আসা উৎকট গন্ধে আচানক গা গুলিয়ে উঠলো ঈশানীর। পেটের নাড়িভুড়ি উগড়ে আসতে চাইছে যেন। তরিৎ হাতে নাক চেপে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে। মূর্তিমান নির্জীব এরীশের পানে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করলো,
—- এতো বাজে গন্ধ কেন এখানে? গা গুলিয়ে আসছে আমার।
— গা তো গুলাবেই, মানুষ পঁচা গন্ধ বলে কথা।
ধীর হিমশীতল গলায় প্রত্যুত্তর করলো মাফিয়া বস।মূহুর্তেই পদধ্বনি থমকে গেলো ঈশানীর। বিভ্রম কেটে গিয়ে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো তার। বুকের ভেতরে ঝড় তুললো অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দণ। রক্তশূন্য মুখে এরীশের পানে তাকিয়ে পুনরাবৃত্তি করলো,
— কি বললে!
নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টালো এরীশ। রাশভারি কণ্ঠে ক্রোধের উষ্মা নিয়ে বললো,
— দেখবে চলো।
অতঃপর ঈশানীর সম্মতির জন্য অপেক্ষা করলো না সে। হাতটা ধরেই তড়িৎ পায়ে এগিয়ে গেলো সেলের নিকট। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী স্নাইপার গুলোকে আঙুলের ইশারা করতেই কুর্নিশ জানিয়ে দুপাশে সরে দাঁড়ালো তারা, সঙ্গে সঙ্গে মসৃণ গতিতে হুঁশ করে খুলে গেলো অত্যাধুনিক নিরাপত্তায় বেষ্টিত প্রবেশ পথ। নৈঃশব্দ্যে ঈশানীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো এরীশ। কক্ষের ঠিক মাঝ বরাবর মেঝে থেকে কয়েক হাত উপরে একটা রক্তিম বাল্বের উপস্থিতি। অন্ধকারের মাঝে অকস্মাৎ আলোর দ্যুতি চোখে পড়তেই তীক্ষ্ণ রশ্মিতে দৃষ্টি ধাঁধিয়ে এলো ঈশানীর। সে চোখ খিঁচে ফেললো। এরই মাঝে কিয়ৎক্ষণের নীরবতা ছাপিয়ে তার কর্ণগহ্বরে ভেসে এলো মৃদু পুরুষালি আর্তনাদ।
— হাহ্! পানিহ!
তড়াক করে চোখ খুললো রমণী। সংবিৎ ফিরে এলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। অপ্রত্যাশিত এক বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হতেই অতর্কিতে বমি করে ভাসিয়ে দিলো এরীশের চার্কোল রঙা মসৃণ শার্ট। এতোকিছুর পরেও নির্বিকার এরীশ ইউভান। বেজমেন্টের গা গুলানো গন্ধ কিংবা ঈশানীর গরগরিয়ে করা বমির বিদঘুটে দৃশ্য কোনো কিছুই যেন ছুঁতে পারছে না তাকে। প্রশস্ত হাতে রুগ্ন মেয়েটাকে সামলালো মাফিয়া বস। অতঃপর পূর্ণদৃষ্টে সামনে তাকালো সে। গভীর শীতল কণ্ঠে আওড়ালো,
— বলেছিলাম না, তোমা দুঃখ ঘোচাবো। দেখোতো চিনতে পারো কিনা?
এরীশের কথায় আধো আধো করে চোখ তুললো ঈশানী। একটা মানুষ, ঠিক মানুষ নয়, পঁচে গলে যাওয়া আধমরা এক মানবাকৃতির অস্তিত্ব। যাকে দেখা মাত্রই পুনরায় ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো ঈশানী। প্রবল আতঙ্কিত হয়ে অজান্তেই পা পেছাতে লাগলো সে। প্রকম্পিত স্বরে আওড়ালো,
— এ… এটা কে?
— চিনতে পারছো না? আরেকটু কাছে এসো।
হাতের কব্জায় জোড়ালো টান পড়তেই প্রস্তরবেদীর মতো কঠোর হয়ে ওঠে ঈশানী। বেজে ওঠে জড়োসড়ো কণ্ঠের নিরেট প্রতিরোধ,
— নাহ!
এরীশ থেমে যায়। ঈশানীর কাছাকাছি এগিয়ে এসে ওর রেশমের মতো কুন্তল রাশিতে আদরের প্রলেপ বোলায়, ধীরে ধীরে বৃদ্ধাঙ্গলী এসে স্থির হয় রমণী পুরন্ত ঠোঁটের কার্নিশে। পরপরই গ্রীবাটা বাঁকিয়ে আবারও হিসহিসায় লোকটা,
—গেইস করো বেইব।
ঈশানী সচকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকায় আবারও । দু’হাত আর পা পুরু শিকলে বাঁধা অবস্থায় কক্ষের মাঝ বরাবর ঝুলে আছে এক অবয়ব। পায়ের গোড়ালি দু’টো ভেঙে পুরোপুরি বেড়িয়ে এসেছে তার। মুখের অবস্থা ভয়াবহ রকমের বীভৎস। চোখের নিচে মাংস নেই, হাত পায়ের নখ নেই, মাথার উপর কোনো চুলের স্তর নেই। পেটের দিকটায় পচন ধরেছে, ভোঁ ভোঁ করে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। হাত পায়ের ঠিক কতগুলো হাড় ভে”ঙ্গে গেছে তা অনুমান করা দুষ্কর।
— পানিহ!
লোকটা স্পষ্ট বাংলায় পানির অনুনয় করতেই শিউরে উঠলো ঈশানী। পরমূহুর্তেই কিছু একটা অনুধাবন করে ওষ্ঠাধর ফাঁকা হয়ে গেলো তার। দু’হাত মুখের উপর চলে গেলো আপনাআপনি। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো রুদ্ধশ্বাস,
— নিক…. নিকোলাস!
রুগ্ন নিকোলাস চোখ তুলে চাওয়ার চেষ্টা চালায়, তার দূর্বোধ্য কুৎসিত দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই চমকে গিয়ে অসাবধানতায় মেঝেতে বসে পড়ে ঈশানী। শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষ অসার হয়ে আসছে যেন । কণ্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ, শুষ্ক একটা ঢোক গিলে অস্থির স্বরে বিড়বিড়ায় ঈশানী ,
— পানি দাও, পানি দাও এরীশ, ওকে পানি দাও।
এরীশ একহাটু হাঁটু মুড়ে ঈশানীর সামনে গিয়ে বসলো। রমণীর গাঢ় নীলাভ চোখে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে ধিম গলায় আওড়ালো,
— ইট’স অল এ্যাবাউট ইউ। গত একবছর ধরে বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি ওকে আমি। আর এখন, এই মূহুর্তে ওর দীর্ঘ আয়ু শেষষষ!
শেষ শব্দটা খুব সময় নিয়ে উচ্চারণ করলো এরীশ।
মাফিয়া বসের অশুভ বাক্য কর্ণগোচর হতেই সমগ্র শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক প্রকম্পন খেলে যায় রমণীর। সজল নয়নে অবিশ্বাস। বিহ্বলিত হয়ে এরীশের পানে তাকাতেই দেখলো, নিকোলাসের র”ক্ত জমাট কপালে রিভলবার ধরে আছে সে ।
— ওঁকে একটু পানি দাও।
ফ্যাঁসফেঁসে চিড় ধরা কণ্ঠে, কোনোমতে বাক্যটুকু নিসৃত করলো ঈশানী। তড়িৎ এর মতো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে তার হৃৎস্পন্দন। এরীশ একবার ঈশানীর দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে, বুকের উপর হাত চেপে ধরেই হাঁপড়ের মতো শ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। ফের আবারও গ্রীবা ঘুরিয়ে একজনকে চোখের ইশারা করে বললো পানি দিতে।
মূহুর্তেই একগ্লাস স্বচ্ছ ঝকঝকে তরল পানীয় নিয়ে হাজির হলো গার্ড। যা দেখা মাত্রই গলাকাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করে উঠলো নিকোলাসের বিধ্বস্ত শরীরটা। ওর অস্থিরতা পরখ করে ভয়াল দৃষ্টে ভ্রু কুঁচকায় ঈশানী। মনে মনে ভাবে,
—পানির জন্যই তো এতোক্ষণ এতো অস্থির হয়ে উঠছিল, এখন তাহলে কি হলো আশ্চর্য!
তার ভাবনার ছেদ ঘটলো এরীশের হীমশীতল কণ্ঠে,
— সাকুরাকে যে বিরক্ত করে, তার জীবনটাকে পৃথিবীতেই জা”হান্নাম বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। আর তুই তো ওকে রীতিমতো আতঙ্ক দিয়েছিস।
একটু থেমে, চোখের ইশারায় পানি পান করানোর আদেশ দিলো এরীশ। তারপর আবারও স্বগোতক্তি করে বলতে লাগলো,
— ভাগ্যিস সেদিন চেতনায় ছিলাম না। নয়তো পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকতাম, সেখানে বসেই তোর জন্য ডেথ নোট সাজাতাম আমি।
মাফিয়া বসের কথা শেষ না হতেই, নিকোলাসের বীভৎস চোয়ালটাকে শক্ত করে চেপে ধরে জোরপূর্বক পানি পান করানো হলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় ধরিত্রী কাঁপিয়ে দানবের মতো চিৎকার দিয়ে উঠলো নিকোলাস।
চিড়চিড়িয়ে ধূমায়িত বাষ্পের মতো গলে যেতে লাগলো তার খাদ্যনালির অগ্রভাগ। তরল পানীয়টা শরীরের যে যে পথ দিয়ে অতিক্রম করেছে, সেই জায়গা গুলোও একইভাবে ঝলসে গিয়েছে তার।
এটা যে সাধারণ কোনো পানযোগ্য পানীয় নয়, তা এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছে ঈশানী। হতে পারে কোনো দ্রবীভূত এ”সিড।
মাফিয়া বসের নিষ্ঠুর, বর্বরতা সম্মন্ধে অবগত রমণী। তবুও, আজকের ঘটনায় চোখের সামনে যেন সমগ্র পৃথিবী দুলে উঠলো তার। নিকোলাসের হৃদয় কাঁপানো চিৎকার শুনে, ভয়ে আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে আচানক মেঝের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঈশানী। এহেন নৃ”শংসতা দেখে আপনাআপনি কণ্ঠরোধ হয়ে এলো তার। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে করতেই আহাজারির স্বরে আওড়ালো,
— প্লিজ বন্ধ করো! এই জঘন্য খেলা বন্ধ করো এরীশ। আমি আর নিতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
এরীশ ঘুরে তাকায়। তপ্তস্বরে বলে ওঠে,
— আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, তোমাকে স্পর্শ করলে আমি তার ঠিক কিই হাল করবো।
— রক্তের ছাপ পানি দিয়ে ধুতে হয়, প্রতিহিংসা দিয়ে নয়।
ঈশানীর নীতি বাণী শোনার কিংবা বোঝার মন নেই এরীশের। নৃ”শংসতা তার রন্ধ্রে বয়ে যায়। চাইলেও আঁটকে রাখতে পারেনা পৈশাচিক মস্তিষ্কটাকে। ফলস্বরূপ হাতের পৃষ্ঠে নাক ঘষে ন্যানো সেকেন্ডের মাথায় ট্রিগার টানলো সে। মূহুর্তেই বিকট আওয়াজ করে রিভলবারের প্রথম গু”লিটা বরাবর মস্তিষ্কে ঢুকে যায় নিকোলাসের। তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে ঈশানীর ভগ্নহৃদয়ের জোরালো আত্মচিৎকার। এরীশ ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পায়, চেতনা হারিয়ে ধীরে ধীরে জমিনে লুটিয়ে পরছে মেয়েটা । এরীশ ছুটে গিয়ে হাত বাড়ায়। নরম শরীরটাকে একহাতে পেঁচিয়ে কাঁধে তুলে নেয় সন্তোর্পণে। মেয়েটার মোমনরম ফ্যাকাসে চেহারায় দৃষ্টিপাত করে উচ্চারিত হয় তার হিমালয়ের মতো শীতল হুংকার ,
— হোয়াই আর ইউ সো মেসড আপ ড্যামইট!
এহেন নীরব হুংকারে হেলদোল হয়না রমণীর। গলানো শীশার মতোই সে লেপ্টে থাকে এরীশের পাথর কঠিন বুকে।
সেদিকে লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস উগড়ে দিলো এরীশ। দৃষ্টিতে ধরা দিলো তার সুপ্ত এক নমনীয়তা। কথা বাড়ালো না আর, মেয়েটাকে আরেকটু ভালোভাবে বুক আগলে নিয়ে পা বাড়ালো সেলের বাইরে। কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে রিভলবারের সবকটা বুলেট একে একে ঢুকিয়ে দেয় নিকোলাসের নিথর শরীরের অভ্যন্তরে। একটা গার্ড পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, ঘটনার আকস্মিকতায় বৃষ্টির ছাঁটের মতোই র”ক্তের লালিমায় ভিজে ওঠে তার সমগ্র মুখমণ্ডল। বাকিসব গার্ডগুলো চিত্ত পুত্তলিকার মতোই নির্জীব দাঁড়িয়ে। যেন নিত্তনৈমিত্তিক কোনো সাংসারিক অরাজকতা চলছে এখানে, তেমন করেই দেখলো সবকিছু। অথচ তাদের পাথর হৃদয়ে আজ বিস্ময়ের দোলাচল। মুখাবয়ব স্বাভাবিক থাকলেও নিস্ক্রিয় নয়নে প্রশ্নের ঢেউ,
— কি আছে! কি আছে এই মেয়েটার মাঝে? যা এরীশের মতো জানোয়ারের চোখেও অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস তুলে দিতে পারে।
গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে আসা নির্ঘুম নিশাচরের সুর তোলা হাঁক জানান দিয়ে যায় শেষ রাতের। ক্যালেন্ডারের সীমারেখা নভেম্বর ছুঁতেই শুরু হয়েছে মসৃণ তুষারপাত। জঙ্গলের সীমানায় নাইট ওয়াচারদের সরব নিরক্ষণ। প্যারাডাইসের সমগ্র বেষ্টনী ঘিরে রেখেছে মাংসাশী নেকড়ের পাল। ভেতরে শয়ে শয়ে সশস্ত্র স্নাইপার তো রয়েছেই, তারপরেও যান্ত্রিক কমান্ডে কিছু এক্সট্রা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পেন্ট হাউজের বিস্তৃত করিডোরে দাঁড়িয়ে আঁধারের ঘেরা ঘন জঙ্গলের দিকে অলীক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মাফিয়া বস। মাথার উপর সূর্যের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে স্ফটিক চ্যান্ডেলিয়রের মৃদু আলো। ঠোঁটের ফাঁকে নিঃশব্দে রাজ করছে জ্বলন্ত এক ধূমায়িত শলাকা। অথচ দু’টো হাতই পকেটে আবদ্ধ তার। শুধুমাত্র ঠোঁট দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোর ব্যাপারটা আকর্ষনীয় ভীষণ। যার ফলে লোকটাকে আরও বেশি বেপরোয়া আর ব্যক্তিত্তবান মনে হচ্ছে। অথচ নিস্তব্ধ নিঝুম রজনীর ধোঁয়াসার মতোই ঘোলাটে তার দৃষ্টি। মন মস্তিষ্কের বিশাল দ্বিধাদ্বন্দ্বে বুদ হয়ে আছে স্বয়ং মরীচিকা। তখনই পেছন থেকে হিমেল হাওয়ায় ভর করে ভেসে এলো তুষারের রাশভারি কণ্ঠস্বর,
— এরীশ! ডক্টর মাতভেই একবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
— কোন ব্যাপারে?
ঘুরে দাঁড়িয়ে জলন্ত ধূমায়িত শলাকাটা হাতে তুলে নিলো এরীশ।
— আসলে মিস ব্লু আইড অ্যাঞ্জেল….
বাক্য সম্পন্ন করার প্রয়োজন পড়লো না তুষারের, তার আগেই প্রত্যুত্তর করলো এরীশ,
— পাঠিয়ে দাও।
তুষার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলো। একটু বাদেই সেখানে এসে হাজির হলেন ডাঃ মাতভেই। লম্বা, চওড়া, ধূসর চুলের বলবান এক ব্যক্তি। জন্ম তার রাশিয়াতে হলেও পেশার তাগিদে আজন্ম ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশে। বয়সের ষাটোর্ধে এসে এখনও এরীশের জন্য বেশ পেরেশানিতে থাকতে হয় লোকটাকে । যদিও তাকে কেউ জোর করেনি এ পেশায়, তবে মাঝবয়সী লোকটা কেন যে নিজের আশির্বাদী পেশা আর শ্রমের অপব্যবহার করে বারবার এই দূর্ধষ মাফিয়া ত্রাসকে বাঁচিয়ে তোলেন সেটা রহস্যই বটে।
মাতভেই এর আগমনে খুব একটা ভাবান্তর প্রকাশ পেলোনা এরীশের মাঝে। জঙ্গলের গভীর আঁধারে দৃষ্টি স্থির রেখেই নীরবে স্মোক করছে সে। সহসা এগিয়ে এসে নিজেই কথা বলে উঠলেন মাতভেই,
— শী ইজ ইন লাস্ট স্টেজ!
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো এরীশ। মাতভেই একই সুরে বললেন,
— ডিপ্রেশন। শী ইন হার পোস্টপার্টাম ইরা। অলসো সাফারিং ফ্রম সার্ভ হার্ট উইকনেস। আগেই জানিয়েছিলাম তুষারকে, মেয়েটার হৃদস্পন্দন অনিয়মিত। লাস্ট দু’দিনে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে কয়েকবার। আমি নিশ্চিত নই, তবে এভাবে চলতে থাকলে,
এটুকু বলে থমকালো মাতভেই। ধাতব রিভলবারটা মুঠোয় পুরে, নিজের পিয়ার্সড করা ভ্রু টা তীর্যক ভাবে উঁচালো এরীশ । দৃষ্টির মিলন ঘটতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাতভেই, বললো,
— শী মে নট সারভাইভ এট অল।
মাতভেই এর কথায় নির্জীব দৃষ্টি অকস্মাৎ জ্বলে উঠলো এরীশের। অতর্কিতে রক্ত জমলো চেহারায়। চোয়ালের পেশী শক্ত করে আওড়ালো একটা মাত্র বাক্য,
— আর ইউ ইনসেইন ডক্টর?
— নো, আ’ম নট। আই হ্যাভ টোল্ড ইউ দ্যা ট্রুথ।
সিগারেটের শেষাংশ পায়ে পিষে অকস্মাৎ জোড়ালো থাবায় ডক্টর মাতভেই এর কলার চেপে ধরলো এরীশ। দাঁতে দাঁত পিষে হিমশীতল আওয়াজে বললো,
— ইফ শী ডাজ’ন্ট সারভাইভ,আই হ্যাভ নো রিজন টু লিভ। আ’ল ফেইড এ্যাওয়ে এ্যাজ ওয়েল।
আরেকদফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাতভেই, মাফিয়া বসটাকে ভয় পায় না সে একদম। বরং আস্বস্ত গলায় বলে,
— শী ইজ ট্রমাটাইজড এরীশ। মেয়েটার এই জঘন্য পরিস্থির জন্য একমাত্র তুমিই দ্বায়ী। তোমার এসব জোরজবরদস্তি র” ক্তের খেলায় হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা। আমি জানি এরপরেও থামবে না তুমি। একের পর এক নৃ”শংসতা চালিয়ে যাবে নিজের মতোই। তবুও, মেয়েটাকে একটু স্বস্তি দাও, গোলা-বারুদের ঝাঁঝালো প্রান্তর থেকে বেড়িয়ে ওকে একটু খোলা বাতাসে দম নিতে দাও।
পুনরায় গর্জে উঠলো এরীশ। রুদ্ধস্বরে বললো,
— আমি ওকে জোর করে আমার জীবনে আনিনি। ও নিজে এসেছে। আমার কুচকুচে কালো অশুভ জীবনে রঙধনুর মতো রঙ ছিঁটিয়েছে। ওয়ার্ন করেছিলাম। বারবার মস্তিষ্ক থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু শুনলো না। এ্যান্ড নাও, আ’ম টোটালি অবসেসড উইথ হার। ওকে ছেড়ে দিলে আমি শেষ হয়ে যাবো মাতভেই। এরীশ ইউভান উইল বি ডেসট্রয়েড।
— ইট’স ইউওর ডিউটি টু প্রটেক্ট হার। অন্তত একটু ভালো ফিল করাও। শী রিয়েলি নিডস হেল্প রাইট নাও এরীশ। ওর ট্রমা গুলোকে দূর করার চেষ্টা করো। বোঝাও যে ও স্বাভাবিক জীবনের মধ্যেই আছে। এখানে অস্বাভাবিক, অনিশ্চিত কিচ্ছু নেই।
মাতভেই এর কথার বিপরীতে একটুখানি ঠোঁট নাড়ালো এরীশ ,
— এখন কি অবস্থা?
— ঘুমের ওষুধ দিয়েছি, কিন্তু আদৌও সে ঘুমাতে পারবে কিনা আমি নিশ্চিত নই।
প্রত্যুত্তরে একটা কথাও বললো না এরীশ। নীরব পদচারণায় প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ঈশানীর কক্ষের অভিমুখে। এরীশ যত এগোচ্ছে ততই গতি হারাচ্ছে হৃদস্পন্দন । অকারন একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা পাথরের মতো বুকে চেপে বসেছে তার । ভেতরের অশুভ অস্তিত্ব যেন হৃদয়ের র”ক্তক্ষরণে সিক্ত আজ। তেমন করেই মলিন মুখে কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো এরীশ। দরজাটা খোলাই ছিল। ভেতরে ড্রীমলাইট জ্বালানো। ওয়াইল্ড ল্যাভেন্ডার ফ্লেভারের একটা সুগন্ধী মোমবাতিও কফি টেবিলের উপর জ্বালিয়ে রেখে গেছে ফ্লোরা। বাচ্চাটার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধ হয় ফ্লোরা নিয়ে গেছে।
এরীশ আরেকটু এগোলো, অচিরেই একটা মাদকীয় সুবাস নাকে এসে আঁচড়ে পড়লো তার। সে চোখ বুঁজে গভীর শীতল গলায় আওড়ালো,
— ভ্যানিলা।
পরক্ষণে রমণীর ক্রন্দিত স্বর কানে বাজতেই মোহভঙ্গ হলো তার। চট করেই সামনে তাকিয়ে দেখলো হাঁটু মুড়ে বসে দু’হাত পেঁচিয়ে তাতে কলমিলতার মতো মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে ঈশানী। অন্ধকারের মাঝেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুমরে গুমরে কাঁদছে সে। কি করুন সেই কান্নার সুর। এরীশের মতো জানোয়ারেরও শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ড্রীমলাইটের নিয়ন আলোয় তরঙ্গিত হয় তার পুরুষালি এ্যাডামস অ্যাপেল। রূঢ় মাফিয়া বসটা সংশয়ে ঢোক গিললো বোধ হয়।
কক্ষের মাঝে সুপরিচিত পুরুষালি ক্লোনের গাঢ় সুবাস যেন মানুষটার উপস্থিতির অব্যক্ত এক ঘোষণা। কাঁদতে কাঁদতেই নাক টেনে হাল্কা করে চোখ ঘোরায় ঈশানী। অশ্রুজলে আরক্ত হয়ে আছে তার গমরঙা তুলতুলে বদন। মুখের উপর এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে কুন্তলরাশি।
সেগুলো সরিয়ে মেয়েটাকে ভালোমতো দেখতে চাইলো এরীশ, সহসা হাত বাড়ালো নীরবে। তক্ষুনি এরীশের স্পর্শ এড়িয়ে ঝট করে সরে গেলো ঈশানী। এরীশের ভবঘুরে নয়ন ঈশানীতে আবদ্ধ। ভয় আর জড়তার মিশেলে কেমন কুঁকড়ে গিয়েছে মেয়েটা। যা দেখা মাত্রই এরীশের সজাগ দৃষ্টি নরম হয়ে এলো । একটু কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে রমণীর মুখোমুখি হয়ে বসলো সে। বৃদ্ধাঙ্গুলি বাড়িয়ে স্রোতস্বীনি অশ্রুধারা মুছে দিতে দিতেই হিসহিসালো,
— ইট’স ওকে, ইট’স ওকে। আ’ম হিয়ার উইথ ইউ। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
রমণীর শীর্ণকায়া প্রকম্পিত হয়। সে অনুভব করে তার হৃদয়ের শিথিলতা। দগদগে অ”গ্নিদাহে একটুখানি ব্যথানাশকের প্রলেপ। অন্তরের তাড়নায় ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
— তুমি কেন মরীচিকা হতে গেলে এরীশ? কেন বাস্তবে থেকেও দৃশ্যমান নও?
ঈশানীর নীলাভ নয়নে দৃষ্টি ডোবায় এরীশ। চোখের মিলনে উদ্বেলিত হয় হাজারো অভিমানের মিছিল। হৃদয় তোলপাড় করা অভিমানী আক্ষেপের মাঝেই, নিঃসৃত হলো মাফিয়া বসের আহত কণ্ঠস্বর,
— তুমি কেন এই অশুভ জীবনে পায়রার মতো উড়ে এলে?আর এলেই যখন, তখন কেন আমার হয়েও আমার নও?
ভেতরটা উথাল পাথাল করে ওঠে ঈশানীর।
এটাই বোধ হয় প্রথমবার যখন এরীশ এতোটা নমনীয় আকুল হয়ে কথা বলছে ওর সঙ্গে। ফের চোখ ছাপিয়ে জল আসে রমণীর। আকুতি ভরা কণ্ঠে আওড়ায়,
— অরণ্য!
এরীশ প্রত্যুত্তর করেনা। মেয়েটার কপালে কপাল ঠেকিয়ে গভীরস্বরে বিড়বিড়ায়,
— আ’ম হিয়ার।
বুকের ভেতর অনুভূতির ভাঙন টের পেলো ঈশানী। আর কোনো কথা বেরোলো না তার মুখ থেকে। ভয়, জড়তা, হতাশা সবকিছু মিলেমিশে কণ্ঠরোধ হয়ে কান্না উগড়ে এলো শুধু। নাজুক শরীরের মৃদু প্রকম্পণ অনুভব হতেই ওকে একঝটকায় কোলে তুলে নিলো এরীশ। গায়ে পরিহিত উলের সোয়েটারটা বুকের দিকে আরেকটু ভালোমতো টেনে দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটা ধরলো ছাঁদ বারান্দার দিকে। আজ বোধ হয় তুষারবিলাশ করবে ওরা দু’জন। যেতে যেতেই দু’জনার হৃদয়ঙ্গম হলো অভূতপূর্ব সুরের মোহনা,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৫
হাম তেরে বিন আব রেহ নেহি সাকতে
তেরে বিনা কেয়া ওয়াজুদ মেরা…
তুজসে জুদা কার হো যায়েঙ্গে তো,
খুদ সেহি হো যায়েঙ্গে জুদা।
কিউনকি তুম হি হো, আব তুম হিহো,
জিন্দেগী আব তুমি হি হো…….
অনেক সুন্দর হইছে আপু এই উপন্যাস টা প্লিজ পর্ব গুলা তারাতাড়ি দিয়েন,🙂🙏
Apu porer porbo gula kothay?56 er pore ar porbo nei😔