আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৭
suraiya rafa
লাউঞ্জ এরিয়াতে আজ শ্মশানের নীরবতা। কোথাও কোনো ‘টু’ পরিমাণ শব্দ নেই। কালো স্যুট আর সোনালী রঙের খোদাইকৃত বিশেষ সীলমোহর পরিহিত গার্ড গুলো কলের পুতুলের মতোই দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ ভাবে। কিচেন কাউন্টারে রান্না বসিয়েছে ফ্লোরা, কারণ আজ পেন্ট হাউজেই মধ্যাহ্নভোজ সারবে মাফিয়া বস।
ক্ষণকালের বিলম্বে লাউঞ্জে এসে হাজির হলো এরীশ। রিভলবারটা হোলস্টারে গুঁজে আস্তেধীরে কাউচে গিয়ে বসলো সে। উরুর ওপর পা তুলে দিতেই পদতলে এসে নেউটে বিড়ালের মতো হুটোপুটি শুরু করে দিয়েছি শক্তিশালী বোজো। তার দানবীয় নখড় আর লকলকে জিহ্বার বীভৎসতায় কুণ্ঠিত হয়ে দূরে সরে গেলো গার্ডগুলো।
এরীশ ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যঙ্গাত্তক হাসলো, অতঃপর হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো হিংস্র দানবের রোমশ শরীর। তুলোর মতো নমনীয় শ্বেতকায় শরীরটাতে নির্লিপ্ত পরশ বোলাতে বোলাতেই কণ্ঠনালি ভেদ করে গভীর আওয়াজ নিসৃত হলো তার,
— বোজোকে খাবার দাও।
গার্ডদের সঙ্গে একজন রাশিয়ান ক্লায়েন্ট ও ছিল। মাফিয়া বসের নাম শুনেছে অনেক, কখনো সচক্ষে দেখা হয়নি। পাইথন লিডার রীশষ্কা নাকি দিনে দুপুরে পায়ের কাছে নেকড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পেন্ট হাউজে পা রাখার আগ অবধি সবকিছু তার কাছে অন্ধের বুলি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে লোকটা। কৌতূহলের শিয়রে পৌঁছে, ঠাস করেই নীরবতা ভাঙলো সে। সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো মাফিয়া বসের উদ্দেশ্যে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— মি. রীশস্কা, আমি শুনেছি নেকড়ে কখনো পোষ মানেনা। তাহলে আপনি কিভাবে….
লোকটার বাক্য শেষ হওয়ার আগেই চোখ তুললো এরীশ। তার সুচারু দৃষ্টির প্রখরতায় চুপসে গেলো লোকটা। একটু থেমে ফের বিড়বিড়িয়ে বললো,
— না মানে, পেন্ট হাউজের চারপাশে বিশাল নেকড়ে প্যাকের পাহারা, আবার ভেতরেও নেকড়ে।
— বোজো! ওর নাম বোজো।
এরীশের শীতল আওয়াজে জমে গেলো সে । থতমত খেয়ে শঙ্কা লুকিয়ে হাসার বৃথা চেষ্টা করে আওড়ালো,
— ইট’স কাইন্ডা ডেঞ্জারাস রাইট?
—এরীশ ইউভান সব পারে। জানোয়ার কেন, মন চাইলেও মানুষকেও পোষ মানাতে পারে। তাছাড়া মানুষের মাংস আবার বোজোর বেশ পছন্দ।
পুনরায় মাফিয়া বসের হিমশীতল কণ্ঠে কেঁপে উঠল লোকটা। আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে তাড়াহুড়ো অন্য একটা গার্ডের আড়ালে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এতোক্ষণে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো এরীশ। পায়ের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাক্ষসের মতো খাবার খাচ্ছে বোজো। সেদিকে তাকিয়ে তৃপ্তিতে ঠোঁট বাঁকালো সে , অতঃপর কালো স্যুট পরিহিত মাফিয়া গার্ড গুলোকে আদেশের স্বরে বললো,
— ক্যাসিনো ক্লাবের রিপোর্ট গুলো দাও।
তাদের মধ্যে একজন আইপ্যাড খুলে মতামত পেশ করতে আরম্ভ করলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে আওড়ালো,
— ডেনিয়েল রাশিয়াতে ব্যাক করেছে। এবং গত মাসের নিলাম টা সেই জিতেছে। খুব শীঘ্রই ড্রাগন হান্টার গ্রুপ আবারও শাইন করবে বস।
নির্বিকারে কাউচের হাতলে আঙুল নাড়ছে এরীশ। কোনো এক কৌশলী ভাবনায় পুরোপুরি নিমজ্জিত সে। ঠিক সেই মূহুর্তে কোথা থেকে যেন উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো তুষার। থমথমে গলায় জানালো,
— উই নিড টু টক এরীশ , ইট’স আর্জেন্ট!
— কি হয়েছে?
এরীশের সজাগ দৃষ্টি। গম্ভীর স্বরে তুষার জানালো,
— মাহিন বেনজামিন।
নামটা শুনতেই এরীশের উজ্জ্বলাভ কপালে ধরা দিলো চিন্তার বলিরেখা। অকপটে প্রশ্ন ছুড়লো,
— কি করেছে মাহিন বেনজামিন?
— মিস ব্লু আইড এ্যাঞ্জেলের খোঁজে পেন্ট হাউজ অবধি চলে এসেছে। আপাতত গার্ডের হাতে বন্দী আছে।
ঈশানীর প্রসঙ্গ আসতেই দমে গেলো মাফিয়া বস। তপ্তশ্বাস ছেড়ে জানালো,
— ওকে আসতে দাও, আফটার অল ইট’স আ ভেরী পার্সনাল ইশ্যু ফর মি ।
একটু বাদেই লাউঞ্জ এরিয়াতে পদার্পণ করলো মাহিন। শান্ত, দীঘির জলের মতো দৃষ্টিতে কোথায় কোনো ভয়ের লেশ মাত্র নেই মাহিনের। বরং জোড়ালো পদচারণায় এগিয়ে এসে সে মুখোমুখি হলো এরীশের। এরীশ ও তাকিয়ে আছে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে। ধূসর বাদামি কৃষ্ণগহব্বরে দাউদাউ করছে ক্রোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। অথচ অনুভূতিহীন নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি। মাহিন এসে দাঁড়াতেই লাউঞ্জে উপস্থিত সকল গার্ডদের চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে এরীশের পেছনে এসে দণ্ডায়মান হলো অস্ত্রধারী তুষার জাওয়াদ। তুষারের হাতে আবদ্ধ লোড করা রিভলবারটার দিকে একপল চেয়ে শ্লেষ হাসলো মাহিন। পরমূহুর্তেই এরীশের পানে দৃষ্টিপাত করে কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে অকপটে জানতে চাইলো,
— ঈশানী আর ইয়াশ কোথায়?
চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে এলো এরীশের, দাঁতে দাঁত পিষে প্রশ্ন ছুড়লো ,
— আমার স্ত্রী সন্তান দিয়ে তোমার কি কাজ?
লম্বা, চওড়া বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী মাফিয়া বসের সম্মুখে মেইনটেইন ফিগারের মাহিনকে নিতান্তই এক ছেলে মানুষ লাগছে। যদিও লম্বায় কেউ কারোর চেয়ে কম নয়। একজনের শরীরে অশুভের মতো ঝিলিক দিচ্ছে ব্ল্যাক ভেলভেট কাপড়ের দামী স্যুট, আর অন্যজনের হোয়াইট সোয়েট শার্টের ওপর ব্রাউন ওভারকোটে যেন ঘীরে রেখেছে মায়াময় এক শুভ্রতা। তুচ্ছ এক রমণীর জন্য আজ জলন্ত অগ্নিপিণ্ড হয়ে মুখোমুখি দুজন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ কাউকে একচুল পরিমাণ ছাড় দিতে প্রস্তুত নয় তারা। সহসা শক্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলো মাহিন,
— আমি ঈশানীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
— তোমার সাথে ওর কোনো কথা নেই।
— ঈশানী বলেছে এই কথা ?
— শী ইজ মাই প্রোপার্টি।
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের যথোপযুক্ত চেষ্টা বহাল রেখে শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো মাফিয়া বস।
— এ্যাকজ্যাক্টলি মি. মাফিয়া বস। আপনার কাছে ঈশানী হলো প্রোপার্টি আর আমার কাছে প্রেয়সী। আর এটাই আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য।
ধৈর্যের সীমা বাঁধ ভাঙলো এরীশের। ভেতর ভেতর ছটফট করতে থাকা পৈশাচিক সত্তাটা বেড়িয়ে এলো অকস্মাৎ, ফলস্বরূপ শিকারী থাবায় মাহিনের মসৃণ কলারটা মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো এরীশ। দাঁতে দাঁত পিষে প্রবল আক্রোশ নিয়ে আওড়ালো,
— ফাক ইউওর হিরোইজম! আমি কোনো হিরো নই।
একটু থেমে ফের ধ্বনিত হলো তার হিমশীতল কণ্ঠস্বর,
— আই রিপিট, আমি দুনিয়াখ্যাত কোনো হিরো নই যে পৃথিবীর বিনিময়ে নিজের প্রেমিকাকে বিসর্জন দেয়, আ’ম আ আন্ডারওয়্যাল্ড টেরোরিস্ট! আ ফাকিং ভিলেইন, যে নিজের প্রেমিকার তরে পৃথিবী জ্বালিয়ে দেয়।
এরীশের মুখ থেকে নিসৃত ধারালো কথার ফলা মাহিনকে ঠিক কতটা র’ক্তা’ক্ত করতে পেরেছে তা বলা মুশকিল। কারণ তার অভিব্যক্তি জুড়ে ক্রোধের ছায়া সুস্পষ্ট। মাফিয়া বসের হাতের মুঠোয় থেকেই সে ছুড়ে দিলো কঠিন কিছু বাক্যবহর,
— পাওয়ার আর ব্ল্যাকমানি দিয়ে সবকিছু পাওয়া যায় না মি. ব্লাডিবিস্ট।
এক বাক্যে ছক্কা হাঁকালো মাহিন। এরীশের ফর্সা মুখে রক্ত জমে লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে, সেসবে তোয়াক্কা না করেই অকপটে বলতে লাগলো মাহিন,
— দ্যা কিং অব আন্ডারওয়্যার্ল্ড, আপনি যার জন্য দুনিয়া জ্বালিয়ে দিতে চাইছেন, যার জন্য আপনার এতো পাগলামি, এতো উৎপীড়ন। আপনি কি জানেন, সে আপনাকে দানবের মতো ভয় পায়? আপনার সাথে ও যদি থেকেও থাকে তবে সেটা শুধুই ভয় পেয়ে, ভালোবেসে নয়। না আপনি ওকে কোনোদিন সংসার দিতে পারবেন, আর না তো একটা স্বাভাবিক জীবন। সারাজীবন কোথায় রাখবেন ওকে? নিরীহ মানুষের কান্না, হাহাকার, র’ক্ত বিজড়িত এই পেন্ট হাউজে? কোথায় বড় হবে আপনার ছেলে? এই অ’স্ত্রধারী মাফিয়া গুলোর মধ্যে?সারাজীবন কি শিখবে? কিভাবে টর্চার সেলে আঁটকে রেখে মানুষ মা’রা যায়, নাকি ক্যাসিনো ক্ল্যাবে বসে কি করে স্মাগলিং এর বিজনেস করা যায়?
আর রইলো ভালোবাসা। আপনার ভেতরে তো হৃদয়টাই নেই। রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি স্রেফ একটা যন্ত্র দিয়ে কি আর ভালোবাসা বোঝা যায়? প্রেমিক হতে গেলে স্যাক্রিফাইস করতে হয়।
মাহিনের কথা শেষ হতে না হতেই জোড়ালো মুষ্টাঘাতে ওকে কাউচের উপর ফেলে দিলো এরীশ। ঠোঁট কেটে মুখগহ্বরের ভেতরে রক্তের নোনতা স্বাদ অনুভব করলো মাহিন। ঘুরে তাকিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই শক্ত পদাঘাতে তার গতিবিধি রোধ করলো এরীশ। সৌষ্ঠব শরীরটাকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে মাহিনের কপাল বরাবর রিভলবার ঠেকালো সে। ক্রোধান্ধ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে হিসহিসালো,
— স্যাক্রিফাইস ! আমি স্যাক্রিফাইস বুঝিনা। ভালোবাসা! সেটাও বুঝিনা। আমি শুধু ওই মেয়েটাকে বুঝি। আমি এরীশ ইউভান ওর জন্য সব করতে পারি। মরতেও পারি , আবার মারতেও পারি।
কথাকটা শেষ করে দৃঢ় হাতে ট্রিগার টানতে যাবে তন্মধ্যে সিঁড়ির কাছ থেকে ভেসে এলো ঈশানীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর,
— এরীশ থামো! ওকে মেরোনা!
নিমেষেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো এরীশের ধাতব বুলেট। চকিতে ঘাড় ঘোরাতেই দেখলো সিঁড়ি ভেঙে এদিকেই ছুটে আসছে ঈশানী। মেয়েটার আগমনে পৈশাচিক সত্তা উবে গেলো আচানক। হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো তার হায়েনার মতো শিকারী দৃষ্টি। স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে নির্বোধ বালকের মতোই রমণীর পানে চেয়ে রইলো মাফিয়া বস। তার চিত্ত পুত্তলিকার মতো অবয়ব যেন চিরনমনীয়তার প্রতীক।
ঈশানী এগিয়ে এসে তড়িঘড়ি করে মাহিনকে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। এরীশের পানে একপল ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পর মূহুর্তেই মাহিনের দিকে করুন চোখে তাকালো ঈশানী। ভঙ্গুর স্বরে জানতে চাইলো,
— আপনি ঠিক আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না মাহিন। হাতের পৃষ্ঠে রক্ত মুছে আহত স্বরে জানালো,
— তোমাদের খোঁজ না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
— তাই বলে এখানে চলে আসবেন?
ঈশানীর কণ্ঠে শঙ্কা। অথচ এরীশ নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে মেয়েটার মুখের পানে। যেন বোধবুদ্ধি সবকিছু লোপ পেয়েছে তার। মাহিন বললো,
— তোমার আর ইয়াশের জন্য এতোটাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম যে নিজের কথা মাথায় আসেনি একবারও ।
— আমরা ভালো আছি, আপনি ফিরে যান।
থৈথৈ চোখ নিয়ে কথাটা বললো ঈশানী। মূহুর্তেই ভেঙেচুরে মুষড়ে পড়লো মাহিনের আশাতীত হৃদয়। রক্তসিক্ত মুখ নিয়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
— নিজের জীবনের পরোয়া না করেই এতোখানি পথ আমি তোমার জন্য ছুটে এসেছি ঈশানী। আমি কখনোই তোমাকে জোর করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না। শুধু জানতে চাইবো, যা বলছো ভেবে বলছো তো?
চোখের জল ছেড়ে চোয়াল শক্ত করলো ঈশানী। চোখ খিঁচে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বললো,
— হ্যা ভেবেই বলছি। আপনি দয়া করে ফিরে যান।
— ঈশানী! একবার একটু আলাদা কথা বলবে আমার সঙ্গে? বেশি সময় নেবোনা, মাত্র দুমিনিটের জন্য। প্লিইইজ!
চোখ তুলে ভয়ে ভয়ে এরীশের মুখের দিকে তাকালো ঈশানী। যার অনুভূতিহীন শূন্য দৃষ্টি ইতিমধ্যে ঈশানীতে আবদ্ধ। ওপাশ থেকে গমগমে আওয়াজে তুষার না করতেই যাবে, তক্ষুণি হাতের ইশারায় তাকে বাঁধ সাধলো এরীশ। অন্য সময় হলে হয়তো এতোক্ষণে মাটির নিচে পুঁতে দিতো মাহিনকে, চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন করে দিতো ওর অস্তিত্ব। কিন্তু ঈশানীর মানসিক অবস্থা মোটেও ভালো হয়। এমতাবস্থায় আর কোনো বিপর্যয় ঘটাতে চায় না এরীশ। সহসা লাউঞ্জের পাশে ঈশানীর যে আগের যে ঘরটা ছিল, একান্তে কথার বলার উদ্দেশ্যে সেখানেই এলো ওরা।
ঘরে এসে মুখোমুখি দাঁড়াতেই অস্থির স্বরে বলতে লাগলো মাহিন,
— তুমি ভয় পেয়ে আছো তাইনা ঈশানী? এখানে তো এরীশ নেই, প্লিজ একবার বলো তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও, বাদবাকি সব আমি ম্যানেজ করবো। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না তোমার।
— মাহিন!
ঈশানীর শীতল কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই থমকে গেলো মাহিন। নীরব দৃষ্টিতে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলো তার বিউটিবোনে এরীশের দেওয়া একাধিক ভালোবাসার চিহ্ন। বেশ কয়েক জায়গায় রক্ত জমে ধারণ করেছে কালচে নীল বর্ণ। মাহিন তাচ্ছিল্যের স্বরে আওড়ালো,
— এগুলোকে তোমার কাছে ভালোবাসা মনে হয়? ইজ ইট রোমান্টিকজম?
ঈশানী একটু ইতস্তত বোধ করলো। না, এরীশ ওর সঙ্গে জোরজবরদস্তি কিছু করেনি, আর না তো ঘটেছিল দীর্ঘ দূরত্বের পরিসমাপ্তি । কাল রাতে ছাঁদ বারান্দায় বসে মাত্রাধিক অনুভূতির তাড়নায় ঈশানীকে কাছে টেনেছিল খানিক। বহুদিনের সুপ্ত বাসনা হঠাৎ মাথাচাড়া দিতেই বন্য হয়ে উঠেছিল এরীশ। ঠিক যেন জানোয়ার। তবে সীমালঙ্ঘন সে করেনি। খানিকবাদেই ছেড়ে দিয়েছিল ঈশানীকে। আর এই মূহুর্তে মাহিনের চোখ এড়াতে কয়েক গাছি চুল সামনে এনে সেগুলো ঢাকার প্রচেষ্টা করলো রমণী। মাহিন আবারও বলে উঠলো,
— হোয়াই আর ইউ সো স্কেয়ার্ড ঈশানী? কাম অন! আমি আছি না?
পরক্ষণেই ভেসে এলো রমণীর বিপর্যস্ত কণ্ঠস্বর।
— পালাতে পালাতে ভীষণ ক্লান্ত আমি মাহিন। এবার একটু স্বস্তি চাই । এই জীবনে এরীশ আর আমার পিছু ছাড়বে না। ওর সঙ্গেই বাঁচতে হবে আমায়।
— আর ইয়াশ? তোমার ছোট্ট ইয়াশের কি হবে ঈশানী? যার জন্য তুমি এতো লড়াই করেছো।
প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো ঈশানী। আশাহত গলায় জবাব দিলো,
— ইয়াশ এরীশের রক্ত। এরীশ ওর কোনো ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না আমার।
— এভাবে ফিরিয়ে দিবে?
মাহিনের কণ্ঠে আক্ষেপ। এক ঝাঁক ফেরারি পাখির দল অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে তার বুকের ভেতর। বিষাদে ভারাক্রান্ত মনটা ক্রমশ চিৎকার দিয়ে বলছে,
—- এটাই শেষ। আর বোধ হয় দেখা হবেনা। কোনোদিন ও না।
মাহিনের নির্বিকার মেঘ থমথমে মুখাবয়ব অবলোকন করে স্তব্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। কান্না বিজড়িত গলায় বললো,
— আমি কখনোই আপনার খারাপ চাইবো না মাহিন। আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে আপনার অনিষ্ট হবে এমন কিছু আমি ঘটতে দিতে পারিনা । তাই দয়া করে চলে যান। যতদ্রুত সম্ভব প্যারাডাইস সীমানা অতিক্রম করে নিজের শুদ্ধ গোছানো জীবনে ফিরে যান। অনুরোধ নয়, নির্দেশ করছি।
অতর্কিত বেদনায় নীল হয়ে গেলো মাহিনের হৃদয়। ভেতরের ব্যথাটুকু আলগোছে লুকিয়ে সে থেমে থেমে আওড়ালো,
— তুমি যেহেতু চাইছো , ফিরে যাবো। এক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আমি সর্বদা তোমাকে প্রাধান্য দিয়েছি ঈশানী , আজকেও তার ব্যতিক্রম করবো না। সবসময়ের মতো আমি ফিরেই যাবো। শুধু একটা অনুরোধ।
ঈশানী চোখ তুলে চাইলো। দৃষ্টিজুড়ে থমথম করছে আষাঢ়ে আঁধার। একটু এদিকওদিক হলেই অভিমানী বালিকার মতোই উগড়ে আসবে অঝোর ধারা। কোনোরূপ ভণিতা করলো না মাহিন। স্বতঃপ্রণোদিত স্বরে বলে উঠলো,
— শেষবারের মতো আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে। প্লিইজ?
কথাটা বলেই ঈশানীর অনুমতির অপেক্ষা করলো না মাহিন। দু’হাত বাড়িয়ে অতি সংবেদনশীল স্পর্শে জড়িয়ে ধরলো রমণীকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো ঈশানী।কিয়ৎক্ষণ মূক হয়ে স্থবির চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই অনুভব করলো তপ্তজলে ভিজে উঠেছে ওর কাঁধের অগ্রভাগ। মাহিনের চোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে বেদনাশ্রু । ব্যাপারটা উপলব্ধি হতেই ঈশানী কিছু বলতে যাবে, তন্মধ্যে ভেসে এলো মাহিনের অস্ফুট প্রকম্পিত কণ্ঠস্বর,
— তোমাকে আর ইয়াশকে ছাড়া বেঁচে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে ঈশানী। অনেক দিনের অভ্যাস, ছেলেটাকে কি করে ভুলে যাবো বলোতো?
নিজেকে শক্ত করলো ঈশানী। জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে অন্তরে ঠায় দিয়ে দু’হাতে ঠেলে সরালো সকল নমনীয়তা। অনুভূতিহীন স্বরে বললো,
— খুব সম্ভবত ইয়াশের আপনার কথা মনে থাকবে না। কিন্তু মা হিসেবে আমি অবশ্যই আপনার কৃতার্থের কথা ওকে জানাবো। চিন্তা করবেন না, ইয়াশের মস্তিষ্কে সর্বদাই আপনি পিতৃশ্রদ্ধায় আরোপিত থাকবেন।
অপরপ্রান্ত থেকে প্রত্যুত্তর এলোনা আর। গুমোট, ঈষদুষ্ণ দমকা হওয়ার মতোই ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাস। ঠিক তখনই ঈশানীর দৃষ্টি গিয়ে আটকালো দরজায়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দৃষ্টিপাত করতেই একজোড়া ছলছলে ব্যথাভরা চোখ নিমেষেই কেড়ে নিলো রমণীর সকল মনোযোগ। সেই চোখে চোখ পড়তেই হৃদযন্ত্র খামচে উঠলো ঈশানীর।
করিডোরের ম্লান আলোয় ধূসর বাদামি চোখের গভীর দৃষ্টিতে টলমল করছে অব্যক্ত বেদনার ছাপ। অদৃশ্য এক হাহাকার প্রলয়ের মতো চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো তার অন্তর। যেই চোখে কোনোদিন এক ফোটা নমনীয়তা অবধি দেখেনি , সেই শূন্য শীতল অক্ষিপটে আজ টলমল করছে আক্ষেপ আর যন্ত্রণার ঢেউ। যা দেখা মাত্র অচিরেই নিস্তেজ হয়ে পড়লো রমণী। ভোঁতা একটা কষ্টদায়ক অনুভূতি অধরা বলয়ের মতোই ঘিরে ধরেছে তাকে। মন বলছে, —আচ্ছা কিসের এতো যন্ত্রণা তার?
মনের কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে গিয়ে তীরের মতো বিঁধলো, সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ হাতে মাহিন কে ঠেলে সরালো ঈশানী। অজ্ঞাত মাহিনের দিকে একবারের জন্যও দৃষ্টিপাত না করে তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলো দরজার কাছে, যেতে যেতেই রমণীর উদগ্রীব কণ্ঠনালি ভেদ করে নিসৃত হলো অপ্রত্যাশিত সেই নাম,
— অরণ্য।
ঈশানী চলে গেলে মাহিন নিজের উপর বিদ্রুপ করে হাসলো। মনে মনে স্বগোতক্তি করে আওড়ালো,
— ভালোবাসা আসলে অদ্ভুত। ভালোমন্দ কিংবা দোষগুন বিচার করে ভালোবাসা হয়না। তৈরি হয় অদৃশ্য এক দৈববলে। কখন, কার সাথে কিভাবে হয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। ঈশানীর জীবনের ভালোবাসার নাম ‘অরণ্য ‘।
পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষটাও যদি এরীশ ইউভান হতো, তবুও ঈশানী ধর্মান্ধের মতো শুধু তাকেই চেয়ে যেতো । মাহিন বেনজামিনকে নয়।
ছুটে এসে দরজার কাছে দাঁড়াতেই আরেক দফা হোঁচট খেলো ঈশানী। জায়গাটা ফাঁকা পরে আছে, কক্ষের সামনে কেউ নেই। অথচ বাতাসের সঙ্গে ভেসে বেড়ানো পুরুষালি ক্লোনের মাস্কি সুঘ্রাণটা স্পষ্ট জানান দিয়ে গেলো এরীশের উপস্থিতির।
ঈশানী নাক টেনে নিঃশ্বাস নিলো। সুপরিচিত গন্ধটা মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দিকভ্রান্তের মতো করিডোরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেলো রমণী। নাহ, কোথাও সে নেই। নিষ্ঠুর মানবের অনুপস্থিতিতে ঝিমঝিম শ্মশানের নীরবতায় ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো চারিপাশ । সেই সাথে অকারণ একটা তীব্র ব্যথা পাথরের মতোই চেপে বসলো দিশেহারা রমণীর অন্তর জুড়ে । মন গহীনে কোথায় যেন বেজে উঠলো বিরহবিধুর সুর,
কেন হয় এমন,মনে নেইতো মন
হাওয়া বড়ই বেরঙিন।
নারে নয় সহজ, পাওয়া তোর মতোন,
আর কাউকেও কোনোদিন।
হারিয়ে গেলাম, ফুরিয়ে এলাম
চোখে শুকিয়ে গেলো জল….
আকাশে আজ চাঁদের আলো নেই। নেই কোনো জোৎস্না জড়ানো তারকারাজি। সারা গায়ে আঁধার মেখে অশুভ অধিপতির মতোই শূন্যস্থানে বিচরণ তার ।
নিকষকালো অমানিশায় ডুবে আছে প্রকৃতি। গহীন অভরণ্য থেকে ভেসে আসা রাত জাগা নিশাচরের উৎসুক হর্ষধ্বনিতে মুখরিত চারিপাশ। রাত যত গভীর হয় তত স্পষ্টত হয় নেকড়ে প্যাকের গা শিউরানো হাউলিং।
মাফিয়া প্যারাডাইসের মানুষ গুলো হাউলিং এ ভীতিগ্রস্ত নয়। তারা নেকড়ের চেয়েও ভয়ংকর। তেমনই ভয়ংকর গভীর রাতে নিশাচর গুলোকে গাড়ির আলোয় আতঙ্কিত করে পেন্ট হাউজে ফিরেছে তুষার। লাউঞ্জ এরিয়াতে পিনপতন নৈঃশব্দ্য। তবুও চারিদিকে একপল সচকিত দৃষ্টি বোলালো সে। অতঃপর বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।
কক্ষে এসে ওভার কোটটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে, তড়িৎ হাতে সিগারেট ধরালো সে। নাকমুখ দিয়ে ধূমায়িত বাষ্প ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো জানালার কাছে। স্টেইনলেস থাই গ্লাসের অপরপ্রান্তে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তুষার আলতো হাতে খানিকটা কাচের আবরণ টেনে সরালো,সঙ্গে সঙ্গে কনকনে দমকা হাওয়ায় চোখমুখ বন্ধ হয়ে এলো তার। কিয়ৎক্ষণ বাদে চোখ খুলে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো সে। নিঝুম আঁধারের মাঝে নিস্প্রভ চেয়ে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো তার ঘোলাটে দৃষ্টি। সিগারেট শেষ হতেই পরপর আরেকটা ধরালো ঠোঁটের ফাঁকে। অকারণ একটা অসন্তোষ তীব্র ভাবে জেঁকে বসেছে তার অন্তরে। যার প্রভাবে ছটফট করছে তুষার।
আগে যত রাতই হোক না কেন ফ্লোরা ঠিকই লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করতো তুষারের জন্য। কিন্তু এখন আর করেনা। কারণটা অবশ্য তুষার নিজেই। অপেক্ষমান ফ্লোরাকে কতবার যে অনীহা করেছে সে, তার ইয়ত্তা নেই। ছোট্ট মেয়েটার প্রতি জমে আছে অগাধ অভিমান। যে অভিমানের প্রগাঢ়তা চাইলেও মুখফুটে ব্যক্ত করতে পারেনা তুষার । সে যে মেশিনের মতো যান্ত্রিক, তার মুখে কি অভিমান সাজে?
তক্ষুণি অন্তরগহীনে কেউ একজন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো,
— কেন সাজে না অভিমান? সে কি মানুষ নয়? তাহলে কেন অনুভূতি প্রকাশে তার এতো দ্বিধা? কেন এতো অসীম জড়তা?
ফ্লোরার একটুখানি অবহেলায় তুষারের যান্ত্রিক হৃদয়ে যখন বিষাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মূহুর্তে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো ঈশানী। আগন্তুকের উপস্থিতি টের পেয়ে নাক-মুখে ধোঁয়া ছেড়ে পেছনে ঘুরে তাকালো তুষার। ঈশানীর অতর্কিত আগমনে সে যে অবাক হয়নি তা নয়।তবে সবসময়ের মতোই নিজের নিটোল অভিব্যক্তি ধরে রেখে তাকিয়ে রইলো নির্বিকারে।
ঈশানী কুণ্ঠিত হলো না, সামনের দিকে এগিয়ে এসে অকপটে জিজ্ঞেস করলো,
— এরীশ কোথায়?
তীর্যক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো তুষার। নির্বিকার কপালে কৌতুহলের ভাজ জমে আছে তার। ঈশানী কঠিন গলায় বললো,
— আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে।
নিরুদ্বেগ ভাবে সিগারেটের শলাকায় ওষ্ঠ ডোবালো তুষার। নাক-মুখ দিয়ে বাষ্পাকুল ধোঁয়া উড়িয়ে বললো,
— সেটা তোমার জানার কথা।
— না আমি জানিনা। আমি কিচ্ছু জানিনা। এরীশের চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ও আমাকে চায়।কিন্তু বস্তুত ও তো একটা জানোয়ার। আমাকে কষ্টের অতলে নিমজ্জিত করতে দু’বার ভাবে না ও। এরীশের আসল উদ্দেশ্য আজও আমি বুঝতে পারিনা ।
ভেতরের সমস্ত শঙ্কাটুকু উগড়ে দিতেই জমে গেলো ঈশানী। ওদিকে নির্বিকার বিপরীত প্রান্ত। থমথমে মুখ নিয়ে জানালা গলিয়ে নিকষ আঁধারের পানে দৃষ্টিপাত করে আছে তুষার। তুষারের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা লক্ষ্য করতেই নাকের পাটা তিরতির করে ফুলে উঠলো রমণীর। কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে বললো,
— আমি জানি আপনি উত্তর দিতে বাধ্য নন, কিন্তু এরীশ আমার স্বামী। তার সম্মন্ধে সবকিছু জানার অধিকার আমার আছে।
এবারও নীরব বিপরীত পক্ষ। ঈশানী হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বেকার প্রশ্ন করছে, উত্তর দেওয়ার মতো মানুষ তুষার নয়। সেই ভেবে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে দমকা হওয়ার মতোই ভেসে এলো যন্ত্রমানবের রাশভারি কণ্ঠস্বর,
— স্বামীর থেকে পালাতে গেলে কেন? হোয়াই! নাম পরিচয় বদলে ঈশানী থেকে অ্যানাস্থেশিয়া হয়েছো। একবারও ভেবেছো তোমার অবর্তমানে তোমার স্বামীর ঠিক কি অবস্থা হয়েছে?
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী। তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করার মতো ঠিকঠাক ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। ফলস্বরূপ একটু থেমে আবারও ধ্বনিত হলো তুষারের ক্রোধান্ধ কণ্ঠস্বর,
— পরপর দু দু’টো ক্রিটিক্যাল এক্সিডেন্ট,তারপর এতোবড় শকড, হি হ্যাজ বিক্যাম আ ফাকিং ড্রাগ এডিক্টেড! কোথায় না খুঁজেছে তোমাকে এরীশ? পুরো রাশিয়া তোলপাড় করে দিয়েছে তোমার সন্ধ্যানে। কিন্তু আফসোস, তোমাকে খুঁজে পেতে এরীশ ইউভানের একবছর লেগে গেলো। কারন, মানুষ নিজ ইচ্ছেতে হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
শুষ্ক ঢোক গলাধঃকরণ করে, ভেতর ভেতর আত্মবিশ্বাস সংগ্রহ করলো ঈশানী। বললো,
— আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন তুষার।
ক্ষুব্ধ মস্তিষ্কটাকে সংবরণ করলো তুষার। তরল গলায় বললো,
— কি জানতে চাও?
— সবকিছু।
তরিৎ বেগে ঘুরে তাকালো ঈশানী। একটু থেমে আরও একটা সিগারেট ধরালো তুষার। বাষ্পায়িত নিকোটিন ছেড়ে জবাব দিলো,
— এরীশ একটা জানোয়ার, নিকৃষ্ট, পাপীষ্ঠ সত্তা। কিন্তু সে তুমি ব্যাতীত অন্য কোনো নারীকে স্পর্শ করেনি কোনোদিন।
তুষারের জবাব শুনে বিদ্রুপকরে হাসলো ঈশানী। বললো,
— নিজে স্পর্শ করা, আর প্রস্টিটিউড ক্লাবে টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে স্পর্শ করানোর তফাৎ কোথায় মি. তুষার?
অযাচিত এক কাঠিন্যতা ভর করলো তুষারের তীক্ষ্ণ চোয়ালে। সে থমথমে গলায় জবাব দিলো,
— তফাৎ আছে। প্রস্টিটিউড ক্লাবে সবাই নিজের ইচ্ছেতে কলুষিত হয়। তাদের কাছে ক্লাবের অভ্যন্তরের দুনিয়াটা স্বপ্নের মতো। ওসব তুমি বুঝবে না। আফটার অল দিস ইজ আওয়ার প্রফেশন, তোমাকে আগেও বলেছি, এরীশ কোনো সত্য স্বাদু ব্যক্তি নয়।
— কিন্তু আমার সাথে….
ঈশানীর বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই,তার ভাবাবেগ ধরে ফেললো তুষার। সহসা নিরেট গলায় বাক্য ছুড়লো সে ,
— তোমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি জানিনা সেই শুরু থেকেই এরীশ কেন তোমার প্রতি এতোটা অবসেসড। তুমিই বোধ হয় প্রথম ব্যক্তি, যার বেলায় অসংখ্যবার নিজের সিদ্ধান্ত বদলেছে মাফিয়া বস। তুমি কি জানো মাফিয়াদের দূর্বলতা থাকতে নেই?
তুষারের রহস্যে মোড়ানো কথার প্যাঁচ বুঝে উঠতে হিমশিম খেলো ঈশানী, সহসা হ্যা না কিছুই বললো না সে । চিত্ত পুত্তলিকার ন্যায় নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো তুষারের পানে। ঈশানীর অযাচিত দৃষ্টি পরখ করে ঠোঁট বাঁকালো তুষার। বললো,
— মাফিয়াদের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় তাদের দূর্বলতা। অথচ এরীশের মতো ব্লাডিবিস্টের ও দূর্বলতা আছে। এরীশ মুখে স্বীকার করুক কিংবা না করুক। আমি নিশ্চিত জানি তুমিই ওর দূর্বলতা,এরীশ ইউভানের ধ্বংসের দূত।
— এভাবে কেন বলছেন?
অদ্ভুত যাতনায় মুষড়ে পড়ে রমণী। সঙ্গে সঙ্গে শীতল কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করে তুষার,
— কারণ পৃথিবীর অন্য কিছুর জন্য এরীশকে কোনোদিন এতোটা মরিয়া হতে দেখিনি আমি। প্রোপার্টি, পাওয়ার, ব্যাংকব্যালেন্স নাথিং। আই থিংক, তোমার কাছে ওর জীবনটাও ভ্যালুলেস। মাঝেমাঝে আমি নিজেও হতভাগ হয়ে যাই, ভাবতে থাকি, তোমার বেলায় কেন এতো নমনীয় এরীশ ইউভান , কি আছে তোমার মাঝে?
— ওহ!
সংক্ষিপ্ত জবাবে কথা শেষ করলো ঈশানী। আর কিছু জানার আগ্রহ নেই তার। অগত্যা ধীর পদক্ষেপে দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে ভেসে এলো তুষারের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।
— তোমার বোধ হয় আরও কিছু জানার আছে।
এহেন জটিল বাক্যে প্রতিরোধ হলো ঈশানীর গতিবেগ । সে হতচকিত হয়ে ঘুরে তাকাতেই, ফের রহস্যময়ী বাক্য ছুড়লো তুষার,
— অ্যাম আই রাইট ?
ভ্রুকুটি করলো ঈশানী। কলের পুতুলের মতোই আনমনে আওড়ালো,
— আরও কিছু জানার আছে? কিন্তু কি?
কোনোরূপ ভণিতা করলো না যন্ত্রমানব। তরল গলায় বলতে আরম্ভ করলো,
— সমানে সমানে না হলে কখনো যুদ্ধ সংঘটিত হয় না জানোতো?
অবোধ বালিকার মতোই তুষারের কঠিন চেহারার পানে চেয়ে রইলো ঈশানী। রুদ্ধস্বরে আওড়ালো,
— কি বলতে চাইছেন?
— মাফিয়া বস এরীশ যতটা শক্তিশালী, তার শত্রুপক্ষও ঠিক ততটাই ধূর্ত আর কৌশলী। মাফিয়া প্যারাডাইস লড়াইয়ের জায়গা, জীবনের প্রতিটা মূহুর্তে যোদ্ধার মতো লড়াই করে টিকে থাকতে হয় এখানে। কখনো কৌশলে আবার কখনো শক্তিবলে।
— এসব কথা আমাকে বলছেন?
ঈশানীর চোখে কৌতুহল। সিগারেটের শেষ টুকরোটা পায়ে পিষে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো তুষার। ঈশানীর পানে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে জানালো,
—- বছর দেরেকে আগে এরীশ হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই?
নির্বিকারে চোখের পলক ফেললো ঈশানী। একটু থেমে তুষার বললো,
— এ্যাক্সুয়ালি উই ওয়েয়ার ইন আ সিক্রেট মিশন। আমরা দু’জনই তখন আমেরিকাতে ছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল, মিশন অলরেডি সাকসেসফুল। ঠিক সেই মূহুর্তে এরীশের দেখা হয় রিয়ানার সঙ্গে। রিয়ানা ইজ আ মিস্ট্রিয়াস ক্যারেক্টার।
এরীশ রিয়ানাকে ধাওয়া করে ওর ডেরায় পৌঁছায়।
কথার এই পর্যায়ে নিজ হাতের অত্যাধুনিক টেকনোলজি সম্পন্ন ঘড়িটাকে ইশারা করে তুষার। ঈশানী সেদিকে দৃষ্টিপাত করতেই বলে ওঠে,
— এই ঘড়িটা দেখতে পাচ্ছো? এটা আমার আর এরীশের মাঝে কানেকশন মেইনটেইন করে। অনেকটা ট্র্যাকিং এর মতো। এরীশের পার্লস কিংবা হার্টবিট স্লো হয়ে গেলে আমি তৎক্ষনাৎ তা টের পেয়ে যাই ।
সেদিনও আমি এরীশকে ট্র্যাক করেই খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু,
তুষার একটু থেমে যেতেই তড়াক করে প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
— কিন্তু!
তুষার ওর দিকে তাকালো। মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে আছে। ভয়, জড়তা,আর কৌতুহলের মিশেলে বিপন্ন দেখাচ্ছে তাকে। সহসা বিলম্ব না করেই প্রত্যুত্তর করলো তুষার।
— এরীশের হার্টের ঠিক মাঝ বরাবর তিন তিনটে গুলি লেগেছিল সেদিন।
মূহুর্তেই থমকে গেলো ঈশানীর হৃদস্পন্দন। বিষ্ময়ে বিমূঢ় হয়ে র’ক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে রইলো তুষারের দিকে। তুষার জানালো,
— বুলেটের আ’ঘাতে সেদিন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল ওর হৃদয়টা।
শরীর ঘেমে হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে এসেছে ঈশানীর। তারপরও একটুখানি ঠোঁট নাড়িয়ে থেমে থেমে আওড়ালো,
— ক….কি ন্তু এরীশ তো বেঁচে আছে তাইনা?
তপ্ত শ্বাস ফেললো তুষার। শীতল গলায় জানালো,
— এরীশের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ ওর ভেতরে অন্য একজনের হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সেদিন ঠিক একই সময়ে আমাদের উপর গ্রে”নেড হাম”লা হয়। যার ফলে আমি নিজেও আহত ছিলাম বেশ কিছুদিন। সেদিন রিয়ানা না থাকলে আমরা হয়তো সেখানেই নিঃশেষ হয়ে যেতাম।
বাক্য শেষে যন্ত্রমানবের বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস।
ঈশানীর শরীরটা অসার হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এতেগুলো রহস্য একসঙ্গে সামনে আসতেই বোধশক্তি হারিয়ে ফেললো অকস্মাৎ। বুকের মাঝে ধিকধিক করছে ছাইচাপা অঙ্গার। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যথারা সব অশ্রু হয়ে ধরা দিলো রমণীর চোখের পাতায়। তারমানে ঈশানীই ঠিক ছিল, এরীশ কখনো ইচ্ছাকৃত যোগাযোগ বন্ধ করেনি তার সঙ্গে। মাফিয়া বস মরণাপন্ন ছিল বলেই তাকে এতোটা যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। কিন্তু ফিরে আসার পরে এরীশ কি তা বুঝতে দিয়েছিল? দেয় নি তো। উল্টো অজস্র কথার আঘাতে এফোড় ওফোড় করে দিয়েছিল ওর নাজুক হৃদয়টাকে। এতোটা কষ্ট দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল?
সেদিনের কথা মনে পড়তেই আরও হাজারটা প্রশ্ন মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো ঈশানীর ভেতর। চোখের কোলে জড়ো হওয়া জলটুকু হাতের পৃষ্ঠে মুছে জড়ানো গলায় বললো,
— কিন্তু সেদিন…
বাক্য শেষ হওয়ার আগে আবারও তার মুখের কথা কেড়ে নিলো তুষার। রাশভারি কণ্ঠে বলে উঠলো,
— লিডার যখন পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে তখন সৈন্যরাও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। আমার আর এরীশের অনুপস্থিতিতে আমাদের শত্রুপক্ষ সুযোগ খুঁজে পায়। একের পর এক শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ব্ল্যাকহোলের বেশিরভাগ গার্ডই বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠে। যার সূত্র ধরে তোমার উপর আ”ক্রমণ চালানোর সুযোগ পেয়েছিল নিকোলাস। ও আসলে ছোটখাটো মাফিয়া সংঘের সাথে জড়িত ছিল, তাই ব্লাড ডায়মন্ড সম্মন্ধে অবগত । তবে এর কর্মক্ষমতা কিছুই জানা নেই ওর।
দু’মাসের মাথায় এরীশ যখন সুস্থ হলো, তখন থেকেই ও পর্যবেক্ষন করতো তোমাকে৷ কিন্তু যখন জানতে পারলো ডেনিয়েল তার গ্রুপ সহ বিডিতে পৌঁছেছে, তাও তোমার খোঁজে। তখন বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম আমরা। পাইথন গ্রুপ কখনো ডেনিয়েল কে ভয় পায়না। কিন্তু ওর পেছনে একজন গডফাদারের হাত রয়েছে, যাকে আমরা এখনো খুঁজে পায়নি। ইনভেস্টিকেশন করে জানা গিয়েছে , সে শুধু এরীশের নয় তোমারও শত্রু।
— আমার শত্রু? কোনো মাফিয়া গডফাদার কিভাবে আমার শত্রু হতে পারে?
ঈশানীর নীলাভ চোখে বিস্ময়ের ঢেউ । নমনীয় ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালো তুষার। আবারও বলতে আরম্ভ করলো,
— তখনই এরীশ নিজ উদ্যেগে সকল কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে দেয় তোমার সঙ্গে । কারন ডেনিয়েল ততদিনে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এরীশের প্রেমিকা অর্থাৎ তোমাকে।
— তারমানে শেষ সময়ের সিসিটিভি ফুটেজগুলো এরীশ আর দেখতে পায়নি।
তুষার এদিক ওদিক মাথা নাঁড়িয়ে জবাব দিলো ,
— না। তবে ব্ল্যাকহোলে ফেরার পরে এরীশ তোমার ‘র’ ফুটেজ গুলো অনেক খুঁজেছে।কিন্তু পাওয়া যায়নি। সম্ভবত ওগুলো চুরি হয়ে আমাদের শত্রুপক্ষের হাতে গিয়ে পড়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। একটু থেমে পুনরায় জানতে চাইলো,
— তাহলে আপনারা ওই সময় বিডিতে কেন ফিরেছিলেন?
— তোমার জন্য।
অতি সাবলীল কণ্ঠে জবাব দিলো তুষার। ঈশানী প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকাতেই বললো,
— সেদিন নিকোলাস তোমার উপর আক্রমণ করায় অস্থির হয়ে উঠেছিল এরীশ। যেহেতু ও নিজে থেকে ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে সব কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, তাই ঘটনা জানতে একদিন সময় লেগে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ তোমার সুরক্ষায় আহত শরীর নিয়েই এমারজেন্সি ফ্লাইটে বাংলাদেশে ব্যাক করে এরীশ।
যেহেতু ডেনিয়েল বিডিতে, তারউপর আমি এরীশ দু’জনই মারাত্মক ইনজিউরড। তাই আমাদের প্ল্যান ছিল ভিন্ন। আমরা কৌশলে খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখান থেকে তুমি এসে সবকিছুতে জল ঢেলে দিলে।
ঈশানীর মোমঢালা চেহারায় অমানিশার আঁধার নামলো। মাফিয়াদের জটিল জীবনের রহস্য, এতো কৌশলী পরিকল্পনা সবকিছুই কেমন বিষাদ ঠেকলো রমণীর। তার আর জানতে ইচ্ছে করছে না কিছুই। শুধু করুন গলায় বললো,
— এরীশের দেওয়া কথার আঘাতে আমার হৃদয়টা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল সেদিন । মনে হয়েছিল আমি তক্ষুণি ম”রে যাই। কিন্তু সন্তানের মুখ চেয়ে ম’র”তে পারিনি । অথচ সেই দগদগে আঘাত গুলো আমার স্মৃতিতে আজও অভিশাপের মতোই আঁটকে আছে। যা আমাকে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক দেয়।
ঈশানীর কান্না বিজড়িত কণ্ঠে,তুষারের থমথমে চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলোনা। সে রোবটের মতো অনুভূতিহীন গলায় বললো,
— এরীশ চাইলেই সেদিন তোমাকে নীরবে আড়াল করে ফেলতে পারতো।কিন্তু ওভাবে প্রসঙ্গ পাল্টে হঠাৎ সিনক্রিয়েট কেন করলো ঠিক বুঝতে পারছি না। হতে পারে রিয়ানার জন্য। এরীশ সম্ভবত রিয়ানাকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। তাই রিয়ানার সামনে নিজের অনুভূতি লুকাতে তার এহেন নিকৃষ্টতম আচরণ।
নীরবে চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়ালো ঈশানীর। এতোক্ষণে বোধহয় অযাচিত এই নামটা মস্তিষ্কে আটকালো তার। যার দরুন প্রশ্ন করলো,
— রিয়ানা কে?
ঈশানীর প্রশ্নে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো তুষার। একটু থেমে কি যেন ভাবলো, অতঃপর গভীর স্বরে উত্তর দিলো,
— এক রহস্যময়ী মানবী। যার উদ্দেশ্য এখনো অজানা সবার ।
ঈশানী যখন তুষারের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো তখন শেষ রাত। করিডোরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমগ্র পেন্ট হাউজজুড়ে নেমে এসেছে ভয়াল আঁধার। আড়ষ্ট নয়নে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাড়াহুড়ো নিজের ঘরের অভিমুখে পা চালালো ঈশানী। চোখ খিঁচে কয়েক পদক্ষেপ এগোতেই দুটো বলিষ্ঠ হাতের হ্যাঁচকা টানে আচানক পিছিয়ে গেলো সে। ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলো অযাচিত এক পুরুষালি চওড়া বুকের মধ্যিখানে। ঈশানী ধড়ফড়িয়ে উঠে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সহনীয় ধাক্কায় রমণীকে দেওয়ালের সঙ্গে আঁচড়ে ফেললো আগন্তুক। হাতদুটো টান মে’রে উপরে তুলে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরতেই শিউরে উঠলো মেয়েটা। এ্যালকোহল মিশ্রিত সুপরিচিত পুরুষালি গন্ধটা নাকে এসে লাগতেই ভেতর ভেতর স্বস্তি পেলো খানিক। বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় সরু হাতদুটো আবদ্ধ করেই ধীরে ধীরে ঈশানীর সংস্পর্শে এসে দাঁড়ালো সে । খুব কাছে, যতটা কাছ থেকে রমণীর শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করা যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা অস্থির হয়ে কিছু বলতে যাবে, তন্মধ্যে ওর পিঠ থেকে চুলের গাছি সরিয়ে আলো পিছলানো মসৃণ ত্বকে মোহাবিষ্টের ন্যায় নাক ঘষলো আগন্তুক। তার তপ্ত নিঃশ্বাসে ঝলসে যাচ্ছে রমনীর পেলব ত্বক। কিয়ৎক্ষণ জমে থেকে অবশেষে আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়লো ঈশানী। হাঁপড়ের মতো শ্বাস ফেলে আওড়ালো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৬
— এরীশ!
তৎক্ষনাৎ ওকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিলো এরীশ। হাতদুটো আগের মতোই দেওয়ালে আবদ্ধ। শুনশান নৈঃশব্দ্যের মাঝেই অদ্ভুত ঝঙ্কার তুলেছে দু’জনার অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন। সবকিছুকে উপেক্ষা করে আধার গোলানো ধোঁয়াসার মাঝেই দৃষ্টি মিলন ঘটালো মাফিয়া বস। অতঃপর ঘোর লাগা মাদকীয় স্বরে বিড়বিড়ালো,
— প্রেম আমার।
Wow..