আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৮
suraiya rafa
নিস্তব্ধ নিশীথে পর্বততূল্য পেন্ট হাউজটিকে অশরীরীর মতো ভয়ানক লাগছে। বড়ো বড়ো ছাঁদ বারান্দা দু’টো যেন তাদের আগ্রাসী চোখ। যার চতুর্দিকে ঘেরাও করে আছে ধবধবে সাদা রোমশ শরীরের শত-শত নেকড়ে প্যাক।
শেষরাতের দিকে একটু একটু তুষারপাত হচ্ছে। পেজা তুলোর মতোন মোলায়েম বরফের আস্তরে ভরে উঠেছে ছাঁদ বারান্দার মসৃণ কাচের দেওয়াল। ভেতরে অসহনীয় নৈঃশব্দ্য। আধার মিশ্রিত গাঢ় ধোঁয়াসার মাঝেই করিডোরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বাকৃতির অবয়ব, তার প্রশ্বস্ত বুকের মধ্যিখানে লতার মতো লেপ্টে আছে মোমনরম একটা নারী শরীর।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই লতানো রমণীর সমুদ্র নীল চোখে দৃষ্টি ডুবিয়ে রেখেছে মাফিয়া বস। এরীশের সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তরে কয়েকমূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল রমণীর দোদুল্যমান হৃদয়। পরক্ষনেই হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সে। কণ্ঠে বিতৃষ্ণা ধরে রেখে বললো,
— তুমি আবারও ড্রাগ নিয়েছো?
নির্লিপ্তে মাথা নাড়ালো মাফিয়া বস। ঈশানীর পানে আরেকটু ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বললো,
— না নিলে ম’রে যাই।
ঈশানী চোখ তুললো। স্বামীর সিল্ক শার্টের কলারটা দু’হাতে চেপে ধরে সীমাহীন অধিকার নিয়ে বললো,
— তুমি ড্রাগ ছেড়ে দিবে।
— পারবো না তো।
অবলীলায় জবাব দিলো এরীশ। ঈশানী ভ্রু কুঁচকালো। কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— কেন পারবে না? আমি তো আছি।
এরীশ এবার আরেকটু ঝুঁকলো। রমণীর কণ্ঠনালির সংস্পর্শে মুখ নামিয়ে নাক টেনে ভ্যানিলার মিষ্টি সুঘ্রাণ নিলো। তারপর কয়েকমূহুর্ত থেমে অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,
— তোমাকে চাওয়াটা যন্ত্রণার। কাছে পাওয়াটা ততোধিক বেশি যন্ত্রণার। তার চেয়ে ড্রাগই ভালো, ব্যথা তো আর দিচ্ছে না আমায়।
এরীশের কণ্ঠে অব্যক্ত বিদ্রুপ। যার ফলে এক আশ্চর্য বিষাদে ছেয়ে গেলো রমণীর সমগ্র অন্তরঃকরন। মাত্রাধিক অভিমান নিয়ে বললো,
— আমি যদি এতোই যন্ত্রণার, তবে কেন রেখে দিয়েছো নিজের কাছে?
— কারণ তুমি ড্রাগের চেয়েও ভয়ংকর নেশা। তোমাকে দূরে সরানো মানে আত্মঘাতী হওয়া।
এরীশের কথার বিপরীতে ঈশানী কিছু বলতে যাবে। তন্মধ্যে ওর চোখ গিয়ে আটকালো ইস্পাত কঠিন বুকের মাঝে সেই গভীর কাটা দাগটায়। শার্টের দুটো বোতামের অকার্যকারীতায় স্পষ্ট সেই বিভৎস ক্ষতচিহ্ন। ঈশানী ধীরে ধীরে হাত বাড়ালো, প্রকম্পিত পরশে ছুঁয়ে দেখলো জায়গাটা। অতঃপর অনুভূতিহীন গলায় বললো,
— এখানে অন্য কারোর হৃদয় বসানো হয়েছে।
বাক্যটুকু শেষ করে তড়িৎ পায়ে চলেই যাচ্ছিল মেয়েটা, তক্ষুণি ফের জোড়ালো টানে ওকে বুকের উপর এনে ফেললো এরীশ। জড়ানো আওয়াজ তুলে বললো,
— কোথায় যাচ্ছো? কথা শেষ হয়নি আমার।
— যা বলার দ্রুত বলো। আমার ছেলে ওঠার সময় হয়ে এসেছে।
ঈশানীর কণ্ঠে চাপা ক্রোধ। এরীশ নিজের মাঝে নেই। তার বলিষ্ঠ দেহ হাওয়ার মতো টলছে। অথচ কণ্ঠে দৃঢ় অধিকার নিয়ে ঈশানীকে সংশোধন করে জবাব দিলো,
— আমার নয়, আমাদের ছেলে।
ঈশানী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরীশ জানতে চাইলো,
— আর কি যেন বললে?
তৎক্ষনাৎ ওর বক্ষবিভাজিকার দগদগে ক্ষতস্থানে আবারও হাত ছোঁয়ালো রমণী । বললো,
— এটা অন্য কারোর হৃদয়।
মাফিয়া বসের ধূসর গহ্বরে মাদকের মতো ঘোর, অথচ চোখের তারায় কি বিষম ব্যথা। কি করুন তার চাহনী। ততটা কাতর স্বরেই রমণীকে মাঝপথে প্রতিহত করলো সে,
— এটা যার হৃদয়ই হোক না কেন, এ দেহে প্রবেশ করার পর, তা কেবল তোমার জন্যই স্পন্দিত।
ঈশানীর শুষ্ক চোখের কোটর জলে ভরে উঠলো। জমে থাকা শক্ত শরীরটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। কলমিলতার মতোই স্বামীর শরীরে ঝুঁকে পড়েছে মেয়েটা। তন্মধ্যে আবারও ভেসে এলো নিয়ন্ত্রণহীন লোকটার বিগলিত কাতুরে কণ্ঠস্বর,
— কেন তুমি এতো দূরে? কেন তোমার স্পর্শ গুলো এতো দূরত্বের? একটু কি কাছে আসা যায় না? আমি কি এতোই খারাপ, এতোই জঘন্য?
ঈশানীর চোখে বিষ্ময়।এরীশের ঘোলাটে চোখে দৃষ্টিপাত করে অকপটে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে তোমার এরীশ? এমন কেন করছো?
দাম্ভিক এরীশ ইউভানের হিমালয়ের মতো নিটোল শরীরটা আত্মসম্মানের ভারে টলে উঠলো খানিক । তবুও থমকালো না সে। যেন আজ না বললে কোনোকিছুই আর বলা হবে না কোনোদিন, তেমন করেই ধ্বনিত হলো তার ব্যথাভরা কণ্ঠস্বর,
— ভালোই তো ছিলাম আমি আমার নৃশংস জগতে । আমার অন্ধকারে নিমজ্জিত অশুভ দুনিয়ায়। আমার পাওয়ার, আমার কৌশল , আমার পাপের রাজত্ব সবকিছুই আমাকে সন্তুষ্টি দিতো। রক্তের ছাপ পৈশাচিক তৃপ্তি দিতো। সবকিছু তো ভালোই চলছিল। হৃদয় আমার সর্বদা মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সেইসব কিছু প্রলয়ের মতো লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে হৃদয়ে এসে গেড়ে বসেছো তুমি। আমার মতো একটা নিষ্ঠুর, পাপী, অনুভূতিহীন মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে ফেলেছো।
— আমি না-হয় দূর্বল। আত্মবিশ্বাসহীন বোকা একটা মেয়ে। তাই না বুঝেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু তুমি কেন উন্মাদ হতে গেলে এরীশ? এটা তো কথা ছিল না।
ঈশানীর কথার বিপরীতে ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে এলো মাফিয়া বসের হিমশীতল কণ্ঠস্বর। তরল গলায় বললো,
— কোনো এক বিষন্ন সন্ধ্যায় আমি পেন্ট হাউজে ফিরেছিলাম। তারপর হুট করেই দেখতে পেলাম, আমার আঁধার কালো পেন্ট হাউজে সাদা পায়রার মতো ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে এক পবিত্র রমণী। তার হাসির প্রভাবে চেরিব্লোসমের মিষ্টি সুবাদে ভরে উঠেছে সমগ্র প্যারাডাইস। ঠিক সেই মূহুর্তে আমার পৈশাচিক আত্মাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অনুভূতিহীন মস্তিষ্কজুড়ে তড়াক করে বেজে উঠলো স্নায়ু যুদ্ধের শক্তিশালী দামামা। আমি দু’হাতে ঠেলে প্রতিহত করতে চাইলাম সেই অভিলাষ। কিন্তু আমার বেহায়া দু’চোখ ঘুরেফিরে বারবার ওই একই দৃশ্যতে আঁটকে রইলো। তখনও বুঝতে পারিনি আমার অগোচরে এই পাথর হৃদয়ে কি বিশাল চিড় ধরে গিয়েছিল সেদিন ।
এটুকু বলে ঈশানীর দু’টো হাত এনে নিজের বুকের উপর রাখলো এরীশ। রমণী নির্বাক হয়ে দেখে যাচ্ছে শুধু। এরীশ আবারও বললো,
— এই রঙহীন ধূসর জীবনে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে এসে ঠায় জমালে। আমার কড়াপড়া হৃদয়টাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করলে।
মায়ার জন্মদিলে, অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস বইয়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলে, আর এখন বলছো আমার কি হয়েছে? কেন এমন করছি?
আধারের মাঝেই ঈশানীর ঢলঢলে পেলব চেহারাখানা আঁজলা করে ধরলো এরীশ। মুখটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ঈশানীর মুখের উপর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
— কেন এলে তুমি আমার মরীচিকার জীবনে? কেন দেখালে এই সুখের আভাস? আমি তো চাইনি কিছুই। বলিনি তোমাকে ভালোবাসতে। তাহলে কেন নীল চোখের উত্তাপে এভাবে ঝলসে দিচ্ছো হৃদয়টা? কেন এভাবে পোড়াচ্ছো আমায়?
তোমার শরীর থেকে আত্মা সবকিছুর অধিকার শুধু আমার। তাহলে কেন মাহিন জড়িয়ে ধরলো তোমাকে? কেন ধরলো? আন্সার মি!
এরীশের শেষ হুংকারে ঝটিকা প্রবাহের মতোই কেঁপে উঠল রমণী। বুকের ভেতর টিপটিপ করে ঝরে পড়ছে অনুভূতির ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ঈশানী ভালোভাবেই টের পেল সেই শীতল আবেশটুকু। পরমূহুর্তেই মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে, তন্মধ্যে আরেকদফা বাক্য ছুড়লো মাফিয়া বস,
— আমি জানি আমি খারাপ, যাস্ট আ ফাকিং মাফিয়া টেরোরিস্ট । তোমার ভাষায় জানোয়ার। কিন্তু আমারও তো কষ্ট হয়। আমিওতো মানুষ। নাকি তুমি আমাকে সত্যি সত্যি জানোয়ার ভাবা শুরু করে দিয়েছো?
স্তম্ভিত বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঈশানী। শান্ত দীঘির জলের ন্যায় চোখ দু’টো এতোক্ষণে ছলকে উঠলো এরীশের। সেখানটায় মুক্ত দানার মতো একফোঁটা স্বচ্ছ জল উঁকি দিয়ে ফের মিলিয়ে গেলো ধোঁয়াসায়। এরীশ বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
— তুমি যদি জানতে কী ভীষণ যন্ত্রণা আমার বুকের ভেতরে। তাহলে এতোক্ষণে ভয়ে আতঙ্কে মুষড়ে পড়তে।
একটু থেমে আরও বললো,
— আমি যেই কলুষিত আঁধারের মরীচিকা,তুমি সেখানে প্রস্ফুটিত আলোর ঝলমলে বিচ্যুরণ। আমি ধ্বংসের দূত হলে তুমি সৃষ্টির শুভ্রতা। আমি এক পাপের সংগ্রাম, আর তুমি আমার একমাত্র পরিণিতা।
মাফিয়া বসের প্রেমিক মনের অভিলাষ অমানিশার আধারের মতোই প্রগাঢ়। তার ধূসর বাদামি চোখের তারায় ভর করেছে নিখাঁদ বেদনা। ঈশানী ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ। আধারের মাঝে চিকচিক করছে তার নীলাভ চোখের নির্লিপ্ত আবেগাশ্রু। কয়েক মূহুর্ত সেভাবেই অতিবাহিত হলো। ওরা দু’জনই পার করলো ওদের জীবন সংগ্রামের সবচেয়ে কঠোরতম অধ্যায়।
খানিকবাদে নড়েচড়ে উঠলো রমণী। নাক টেনে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— এতো কষ্ট, এতো যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়ে কি লাভ এরীশ? জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কি কোনো ডেসটিনি রয়েছে? তুমি কি আদৌও কখনো ছাড়তে পারবে এই কালো দুনিয়া? দিতে পারবে আমার ছেলেকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত?
ওপাশে পিনপতন নৈঃশব্দ্য। এই সামান্য নীরবতাটুকুও সহ্য হলোনা রমণীর। সহসা তড়িৎ হাতে মাফিয়া বসের কলার চেপে ধরে চাপা অভিমান নিয়ে ফুঁসে উঠলো মেয়েটা ।
— আমি জানি তুমি পারবেনা। এই অন্ধকার দুনিয়া থেকে বেড়িয়ে তুমি কখনোই একটা সাজানো সংসার দিতে পারবেনা আমাকে এরীশ। আর না তো কখনো পিতৃস্নেহে আগলে রাখতে পারবে নিজের সন্তান কে। তুমি আর তোমার চারপাশের এই মাফিয়া নামক জানোয়ার গুলো এই অসুস্থ জীবনে এতোটাই অভ্যস্ত যে চাইলেও কখনো বেরোতে পারবেনা এখান থেকে। তাহলে আমার ছেলের ভবিষ্যত টা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলতে পারো ? কি শিখবে ও? কোথায় বড় হবে? এই নৃশংস প্যারাডাইসে? এটা কি আদৌও কোনো জীবন? ওর বাবা একজন মাফিয়া বস এতে তো ওর কোনো দোষ নেই। তাহলে কেন আমার ছেলেটা এই পাপের দুনিয়ার কলুষতা গায়ে মেখে বড় হবে ? একজন বাবা হিসেবে তুমি ঠিক কতটা ব্যর্থ বুঝতে পারছো?
আমার ছেলেটা কি একটা স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভ করেনা এরীশ? কেন দিচ্ছো না তাহলে আমাদের একটা স্বাভাবিক জীবন? কেন ও অন্য সবার মতো বাবা মায়ের সঙ্গে একটা পরিবার পাচ্ছেনা। কেনইবা স্বামী সন্তান নিয়ে একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখতে পারিনা আমি ? বলো এরীশ !
ঈশানীর কথায় ক্রমশ চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে এলো এরীশের। মেয়েটাকে বোঝানোর প্রয়াসে দু’হাতে তার বাঁকানো কোমরটাকে শক্ত করে চেপে ধরলো মাফিয়া বস। অতঃপর ধ্বনিত হলো গমগমে ভারিক্কি আওয়াজ।
— লিসেন বেইব , যাস্ট লিসেন টু মি।
এক মূহুর্ত থমকালো ঈশানী। ঠিক তক্ষুণি এরীশ বলে উঠলো,
— আমি যে তোমাকে আর ইয়াশকে আলাদা ম্যানসনে রাখতে পারিনা এমনটা নয়। এ্যাক্সুয়ালি আ’ম ওয়ারিড এ্যাবাউট সামথিং।
কয়েক সেকেন্ড থেমে নিগূঢ় দৃষ্টে ঈশানীর অভিমানী ছলছলে চেহারাটা পরখ করে আবারও বললো সে,
— আমি যতটা পাওয়ারফুল আমার শত্রুরা ঠিক ততটাই ধূর্ত আর কৌশলী। প্রতিনিয়ত তারা আমার দূর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। আই থিংক তারা ইতিমধ্যে এটাও জেনে গেছে যে, আই হ্যাভ আ নিউ বর্ন বেবি। যেখানে পেন্ট হাউজ সুরক্ষিত নয়। ব্লাকহোল সুরক্ষিত নয়। সেখানে আমি তোমাকে আর ইয়াশকে কিভাবে একটা ম্যানসনে রাখবো বলো?
— পেন্ট হাউজ সুরক্ষিত নয় মানে?
ভ্রুকুটি করে কথাটা বলেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো ঈশানী। এরীশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জিভের ডগায় ঠোঁট ভিজিয়ে প্রথমে শ্রান্ত কণ্ঠে আওড়ালো,
—ফ্লোরা..
পরক্ষনেই কি ভেবে যেন বাক্য সম্পন্ন করলো না আর । প্রসঙ্গ পাল্টে চোয়ালের পেশী শক্ত করে তপ্তস্বরে জবাব দিলো,
— তুমি ভালো করেই জানো, এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না।
গত কয়েকপ্রহর যাবৎ এতো এতো ভালোবাসার বুলি আওড়ানোর পর অকস্মাৎ এহেন প্রত্যাখান সহ্য হলো না ঈশানীর। সহসা আর একটা কথাও বললো না সে। সম্পর্কের দোলাচল আর অনুভূতিটুকু অমীমাংসিত রেখেই কান্নাভেজা চোখে হনহনিয়ে হাটা ধরলো কক্ষের দিকে। পেছন থেকে ভেসে এলো মাফিয়া বসের জোড়ালো মুষ্টাঘাতের শব্দ। ক্রোধান্ধ হয়ে দেওয়ালের উপর ঘুষি ছেড়েছে বোধ হয় । তবুও ফিরে তাকালো না রমণী। পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
ঘড়ির কাটা চারের ঘরে স্থির। ভোরের আলো ফুটতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। ইয়াশকে খায়িয়ে ন্যাপি পাল্টে আরেকদফা ঘুম পারিয়েছে ঈশানী। এবার ওর নিজের ও বিশ্রাম নেওয়ার পালা। কিন্তু আজ চোখ দু’টো ভীষণ জ্বলছে রমণীর । এক সমুদ্র ফেনিল জলরাশির মতোই বুদবুদ করে সমগ্র হৃদয়ের বেলাভূমি জুড়ে আঁচড়ে পড়ছে অসহনীয় তীব্র বেদনা। জীবনের ভুল সমীকরণ মেলাতে মেলাতে এতদূর চলে এলো মেয়েটা।অথচ আজ অবধি উত্তরের দেখা নেই।
বাইরে তুমুল বেগে তুষার পাত। ঈশানী একটু এগিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলো। শুভ্র তুষারের আবরণে শ্বেত বকের মতোই ধবধবে সাদা হয়ে উঠেছে চারিপাশ। পবিত্র একটা অনুভূতির উষ্মায় চোখ জুড়িয়ে এলো ঈশানীর। সে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরই মাঝে দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। ঈশানী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো, দু’জন কালো পোশাকধারী গার্ড অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কক্ষের বাইরে।
— কি হয়েছে?
সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়তেই নিজেদের মাঝে চাওয়াচাওয়ি করলো গার্ড দু’টো অতঃপর উদগ্রীব হয়ে জানালো,
— তুষার বস আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। জরুরি প্রয়োজন।
পাশের কফি টেবিল হাতরে শরীরে একটা উলের চাদর জড়ালো ঈশানী। তারপর কৌতুহলী গলায় জানতে চাইলো,
— এতো রাতে হঠাৎ কি প্রয়োজন?
লোকদুটো আবারও নিজেদের মাঝে দৃষ্টির আদান-প্রদান করলো। তারা উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছে, ব্যাপারটা উপলব্ধি হতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। কিঞ্চিৎ ঠোঁট নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,
— ঠিকাছে চলুন।
লোক দু’টোকে অনুসরণ করে এরীশের কক্ষের সামনে চলে এলো ঈশানী। তুষার আগে থেকেই উপস্থিত সেখানে। সহসা এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রমানবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো রমণী,
— কি হয়েছে?
তুষার প্রত্যুত্তর করলো না। নির্লিপ্তে চেয়ে রইলো ঘরের ভেতর। তুষারের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঈশানী একটু উঁকি দিতেই শরীর শিওরে উঠলো তার। ঘরের ভেতরে প্রত্যেকটা আসবাব উল্টে পরে আছে। কাঁচের দেওয়াল গুলো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ। অত্যাধুনিক শ্যাম্পেইন আর বিয়ারের বোতল গুলোরও একই দশা। কক্ষের ঠিক মাঝ বরাবর কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বিশাল আকৃতির চ্যান্ডেলিয়ার টা। তার ঠিক পেছনেই দেওয়ালের সংস্পর্শে পিঠ ঠেকিয়ে চিত্ত পুত্তলিকার মুতো ঠায় বসে আছে এরীশ।পরিধেয় চার্কোল রঙের শার্টটা রক্তে মাখামাখি। পুরুষালি চওড়া হাতের তালুতে আড়াআড়িভাবে আঁটকে আছে একটা বড় সাইজের কাঁচের টুকরো। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে অনর্গল। যান্ত্রিক রোবটের মতোই নিজের রক্তাভ হাতের মাঝে অপলক দৃষ্টিপাত করে আছে মাফিয়া বস। সবকিছু এক নজর পর্যবেক্ষন করে তুষারের পানে দৃষ্টি ঘোরালো ঈশানী, কণ্ঠে চাপা ক্রোধ নিয়ে বললো,
— এমন ভয়াবহ তাণ্ডব কখন ঘটিয়েছে এরীশ?
— একটু আগেই।
— মানুষটা এভাবে নিজেকে রক্তাক্ত করেছে। কেউ আটকায়নি কেন ওকে?
তুষারের মুখাবয়ব নির্লিপ্ত। কঠিন স্বরেই জবাব দিলো,
— মাফিয়া বসকে আটকানোর সাধ্য কার? ওকে আটকানো মানে নিজের মৃত্যুকে নিজেই আলিঙ্গন করা।
— মানে?
রমণীর কণ্ঠে বিস্ময়। তুষার জবাব দিলো,
— ওর হাতে রিভলবার দেখছো? ওটা ফুললি লোড। এই মূহুর্তে এরীশের সামনে গেলে যে কাউকে চোখ বুঁজে শ্যুট করে দিবে ও।
ঈশানী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর খালি পায়ে কাঁচের টুকরো ভর্তি মেঝে মাড়িয়ে সোজা হেঁটে গেলো এরীশের নিকট। পেছন থেকে তুষার ডাকলো। তবে ঈশানী আর ঘুরে তাকায়নি। রমণীর দৃঢ় বিশ্বাস এরীশ তাকে কিছুই করবে না।
ঈশানী যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, মাফিয়া বস তখনও নির্লিপ্ত। পূর্বের ন্যায় নিজের র”ক্তা’ক্ত হাতের দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।কোনোরূপ বাক্যালাপ না করেই হাঁটু মুড়ে তার মুখোমুখি হয়ে বসলো ঈশানী, তারপর ক্ষতবিক্ষত হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় পুরে আলতো করে ফুঁ দিতে আরম্ভ করলো। রমণীর মখমলি পরশে মূহুর্তেই বিভ্রম কেটে গেলো এরীশের। সে তাকিয়ে দেখলো প্রেয়সীর তৎপরতা। কাঁচের টুকরো তুলতে গিয়ে কেমন চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছে মেয়েটা। সহসা নিরেট গলায় জবাব দিলো এরীশ।
— এটা ব্যথা করছে না, একটুও ব্যথা করছে না। আই উইশ এটা একটু ব্যথা করুক।
ঈশানী চোখ খুললো। থৈথৈ নয়ন মেলে মাফিয়া বসের র’ক্তাভ অক্ষিপটে দৃষ্টির মিলন ঘটিয়ে বললো,
— কাঁচের টুকরোটা পুরোপুরি ঢুকে গিয়েছে। এটা বের করার সময় ব্যথা লাগবে।
— উহু লাগবে না।
নিরুদ্বেগ স্বরে কথাটা বলতে না বলতেই ওর করতল থেকে টান মে’রে কাচের টুকরো টা বের করে আনলো ঈশানী। এরীশ এতেটাই পাথর হয়ে আছে, একবার পলক অবধি ফেললো না। ওদিকে সমগ্র হাত জুড়ে র’ক্তের ধারা বইতে শুরু করেছে। ঈশানী দু’হাতে চেপে ধরেছে ক্ষতস্থান। এরীশ ওর দিকেই চেয়ে আছে নিস্প্রভ। মেয়েটার অতর্কিত উদ্বেগ অনুভূতিহীন লোকটার ভেতরে আশ্চর্য এক প্রশান্তি দিচ্ছে । বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা যন্ত্রণাগুলো একটু শিথিল মনে হচ্ছে। পুনরায় অপ্রত্যাশিত ভাবে দৃষ্টি মিলিত হলো দু’জনার। মাফিয়া বসের কাতর দৃষ্টিতে থমকে গেলো রমণী। হাতটা সাদা গজে মোড়াতে মোড়াতে মায়াভরা কণ্ঠে শুধালো,
— ব্যথা করছে খুব তাইনা?
এরীশ না সূচক মাথা নাড়ালো। অভিব্যক্তি জুড়ে মেঘের মতো আধার নামলো তার। মরা বিকেলের নিভে আসা রোদের মতোই বালকসুলভ অভিমান নিয়ে বললো,
— এর চেয়ে হাজার গুন বেশি ব্যথা করেছিল যখন মাহিন বলেছে, তুমি আমাকে ভয় পাও। আর ভয় পাও বলেই আমার সঙ্গে আছো। বলো এটা সত্যি নয়!
এরীশের হাতটা ছেড়ে এতোক্ষণে আরেকটু সন্নিকটে এগুলো রমণী। জীবনে প্রথম কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ ছাড়াই অপার লালিত্যে ভরা সৌম্য চেহারাখানা দু’হাতে আঁজলা করে ধরলো সে । চিবুকের তিলক থেকে শুরু করে আইভ্রু পিয়ার্সড সবখানে আদুরে পরশ বুলিয়ে তরল গলায় আওড়ালো,
— উহু! ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি এরীশ। সবকিছু জেনেশুনে পৃথিবীতে যদি একমাত্র কেউ তোমাকে ভালোবাসার দুঃসাহস দেখাতে পারে। তবে সেটা আমি। আমি যে তোমার একমাত্র পরিণিতা।ভালো না বেসে কোথায় যাবো বলো?
বাক্য শেষ হতে না হতেই অতর্কিত আ’ক্রমণে রমণীর ওষ্ঠপুটের বিভাজিকায় হামলে পড়লো এরীশ। মাত্রাধিক আলিঙ্গনে একনিমেষে ধরাশায়ী কর ফেললো মেয়েটাকে। ঈশানী এক মূহুর্তের জন্য ওকে ছাড়াতে সক্ষম হলে, নাজেহাল কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
— রীশ!
— সে ইট এগেইন!
সংক্ষিপ্ত জবাবে আরও খানিকটা আবেগ ঢাললো মাফিয়া বস। অতঃপর ঈশানী সমেত পরে গেলো কাচ ভর্তি মেঝেতে। এরীশ দিশেহারা, উন্মাদ। তার স্পর্শগুলো দানবের মতোই বন্য। তার ওষ্ঠাধরের উন্মত্ত বিচরণে নাস্তানাবুদ রমণী। একটুখানি ছাড়া পেতেই সতর্ক গলায় ফের বলে উঠলো,
— তোমার পিঠে কাচ বিঁধে যাবে তো।
— বিঁধুক!
রমণীর উপর আরেকদফা স্বতঃপ্রণোদিত আ”ক্রমণ চালাতে চালাতেই অস্থির স্বরে প্রত্যুত্তর করলো মাফিয়া বস।
আলো ঝলমলে মনোরম সকাল। কাচের দেওয়াল গলে সূর্যরশ্মির মোলায়েম উষ্ণতাটুকু সুড়সুড়ি খাচ্ছে পায়ের খাচ্ছে। বাইরে শনশন হিমেল হাওয়া,সারারাত ধরে নিপতিত স্তূপাকৃতির বরফের আস্তরণ গলে গিয়ে মিঠে মিঠে রোদে চকচক করছে চারিপাশ। সকাল সকাল এরীশের অফিস কক্ষ থেকে তলব করা হয়েছে তুষারকে। তাই ঘুম ভেঙেই তড়িঘড়ি করে এখানে এসেছে তুষার।
স্যুট বুট পরিহিত যান্ত্রিক রোবটের মতোই হাতে একটা আইপ্যাড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাফিয়া বসের সামনে। ওদিকে লেদারে মোড়ানো নান্দনিক চেয়ারে বসে একমনে পা দোলাচ্ছে এরীশ। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ এরীশের এহেন নির্লিপ্ততা তুষারকে একটু ভাবালো। সহসা প্রশ্ন ছুড়লো ,
— আমরা কি কোনো মিশনে যাচ্ছি?
— আপাতত না।
— তাহলে?
এতোক্ষণে কানের এয়ার্বাডস খুলে টেবিলের উপর রাখলো এরীশ। অতঃপর তুষারের পানে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত নিটোল গলায় জানালো,
— আমি বিয়ে করবো।
চোখ কপালে উঠে গেলো তুষারের। এতোক্ষণের শান্ত, থমথমে মসৃণ কপালে জড়ো হলো চিন্তার বলিরেখা। কাল রাতেও তো মেঝেতে গড়াগড়ি করে ঈশানীর সঙ্গে ওমন , তাহলে আজ হঠাৎ হলো টা কি? কৌতুহল যেন আকাশ ছুঁলো যন্ত্রমানবের। কলের পুতুলের মতো নির্লিপ্ত মুখে শুধালো,
— আবার বিয়ে করবেন? কিন্তু কাকে?
এরীশ অবিশ্বাস্য নয়নে তাকালো একপল। পরমূহুর্তেই শক্ত মুখে জবাব দিলো,
— আমার বাচ্চার মাকে।
তুষার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো এতোক্ষণে। ভাবনার ফুরসত না দিয়ে এরীশ আবারও বললো,
— ফুল, আলো, সুগন্ধি কোনোকিছুর যাতে কমতি না থাকে। আই ওয়ান্ট আ গ্র্যান্ড ওয়েডিং সিরিমনি।
হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে তৎক্ষনাৎ সায় জানালো তুষার,
— ঠিক আছে।
— একটা নয় দু’দুটো বিয়ে হবে।
কপাল গোছালো তুষার। ভ্রুকুটি করে শুধালো,
— দু’টো! কিন্তু আরেকটা কার?
কোনরূপ কপটতা অবলম্বন করলো না মাফিয়া বস, স্পষ্ট গলায় জানালো,
— তোমার আর ফ্লোরার।
—- আমি বিয়ে করবো? ফ্লোরাকে?
ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর খুঁজে পেলোনা তুষার। তাই তার কথাগুলো প্রশ্নের মতো শোনালো। এতোক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো এরীশ। তুষারের মুখোমুখি দাঁড়াতেই চোয়ালের পেশী কঠিন হয়ে এলো তার। রক্ত জমাট মুখে জবাব দিলো,
— হ্যা তুমি। ভুলে যেওনা তুমি এখনো আমার কাছে জিম্মি। তোমার সঙ্গে বোঝা পড়াটা রয়েই গিয়েছে তুষার জাওয়াদ। তাই সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টাও করোনা।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে দাম্ভিক পদক্ষেপে অফিস কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো এরীশ। ওদিকে এরীশ চলে যেতেই টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে মেজাজ হারিয়ে এরীশকে দু’টো অস্রাব্য গালি দিলো তুষার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— ফাকিং ব্লাডিমনস্টার! ভাঙবে তবু মচকাবে না।
সারাদিন আর পেন্ট হাউজে ছিলনা তুষার। সন্ধ্যা রাতের দিকে ফিরে নিজের ঘরে পা রাখতেই দেখা পেলো ফ্লোরার। মেয়েটা একমনে বসে জামাকাপড় গোছাচ্ছিল। হঠাৎ ঘরের ভেতর তুষারের উপস্থিতি টের পেতেই সুরসুর করে নীরবে বেড়িয়ে যাচ্ছিল রমণী। কিন্তু যাওয়ার আগেই খপ করে ওর হাতটা টেনে ধরলো তুষার।ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
— কোথায় যাচ্ছো?
— ব..বাইরে।
তুষার কখনো এভাবে হুটহাট স্পর্শ করে না। আজ হঠাৎ এভাবে হাত ধরায় বেশ ভড়কে গিয়েছে ফ্লোরা। পরিস্থিতি আঁচ করার আগেই আবারও টেনে মেয়েটাকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো সে। নাকের পাটা ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
— বাইরেই যখন যাচ্ছো, তাহলে এসেছিলে কেন?
সকালের কাহিনির পর থেকেই মনে মনে ভীষণ তেতে আছে তুষার। কেন যে মনমেজাজ এতোটা তিরিক্ষি হয়ে আছে কে জানে? হতে পারে আত্মসম্মান কিংবা প্রবল অব্যক্ত অভিমান। সে যাই হোক আপাতত ফ্লোরাকে নাজেহাল করাই যেন যন্ত্রমানবের মোক্ষম উদ্দেশ্য। তাই আরেকটু শক্ত গলায় বললো,
— কি হলো কথা শুনতে পাওনি?
— না মানে কাপড় গোছানো শেষ তাই।
মিহি গলায় জবাব দিলো রুশকন্যা। তৎক্ষনাৎ আরেকদফা প্রশ্ন ছুড়লো তুষার,
— সবসময় এমন পালাই পালাই করো কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক? দেখতে পেলেই খেয়ে ফেলবো তোমায়? খেলে খাবো, আমিই তো খাবো অন্য কেউ তো আর না। আমার কাছে এতো কিসের সংকোচ তোমার?
ফ্লোরা অনভ্যস্ত চোখে তাকালো। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললো,
— পালাইনি তো। আপনি বিরক্ত হবেন বলেই তো চলে যাচ্ছিলাম।
— কে বললো আমি বিরক্ত হবো? আমি বলেছি কখনো?
— বলেননি কিন্তু…
— কিন্তু কিই!
তুষারের হাঁকডাকে লাফিয়ে উঠলো ফ্লোরা। কণ্ঠখাদে নামিয়ে বললো,
— আপনি এমন কেন করছেন হঠাৎ? আমি কি কোনো ভুল করেছি?
— আগে বলো তুমি আমাকে এতো ভয় পাও কেন? এতো ভয় নিয়ে সারাজীবন একসাথে থাকবে কি করে? তুমি কি জানো বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রী এক বেডে ঘুমায়? তখন কি করবে?
— বিয়ে!
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৭
আশ্চর্য কণ্ঠে শব্দটা ধ্বনিত হতেই তড়াক করে চোখ তুললো ফ্লোরা। প্রসঙ্গ পাল্টালো না তুষার। গ্রীবা বাঁকিয়ে ঝুঁকলো রুশ রমণীর পানে। মেয়েটার গোলাপি চেহারায় আরক্ত আভা ধরিয়ে দিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে স্পষ্ট আওয়াজে জবাব দিলো,
— তুমি চাও কিংবা না চাও, গ্যাংস্টার তুষার জাওয়াদ ইজ ফিক্সড।