আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬০

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬০
suraiya rafa

চিটাগং, বাংলাদেশ,
কৃত্রিম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের প্রভাবে হিমশীতল হয়ে আছে মাঝারি সাইজের নান্দনিক লিভিং এরিয়া। ভেতরের ইন্টেরিয়র চমৎকার, ঘরের মালকিন নিঃসন্দেহে রুচির প্রশংসার দাবিদার। লিভিং এরিয়ার ঠিক মাঝখানে শরীর দাবানো গদিতে থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন নিঝুমের বাবা নাজমুল আহসান সাহেব। অকারণ একটা বিরক্তি ভাব পদ্মাসন হয়ে গেড়ে বসে আছে তার দুই ভ্রুর মাঝখানে। চোখের সামনে কারুকাজ শোভিত কফি টেবিলের উপর ধোঁয়া ওঠা গরম চা আর কয়েক প্রকারের নাস্তা রাখা, মাত্রই একজন বুয়া শ্রেণির মহিলা এসে দিয়ে গেলো এসব, নাস্তা দেখে নাজমুল সাহেবের বিরক্তিভাব বাড়লো বৈ কমলো না। তার কুঁচকানো চোখের প্রখর দৃষ্টি ভেতরের দরজায় নিবদ্ধ। যেন কারোর বিশেষ দর্শনের প্রতীক্ষায় তিনি।

ভেতর ভেতর ক্রোধের পাহাড় জমিয়ে বাইরে স্বাভাবিক মুখ নিয়ে বসে থাকা দুষ্কর। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ এই পরিস্থিতিতে বসে থাকতে হলোনা নাজমুল সাহেবকে। তার অপেক্ষার ইতি ঘটিয়ে ভেতরের ঘর থেকে ধীর পায়ে বেড়িয়ে এলো তূর্য। কপালে গজ কাপড়ের ভারী পট্টি। হাত পা সহ শরীরের দৃশ্যমান অংশে টুকটাক ক্ষতচিহ্নের অভাব নেই, হাঁটছেও সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।
বিরক্ত ভঙ্গিমায় অটল থেকেই তূর্যকে একবার আপাদমস্তক পরখ করলেন নাজমুল সাহেব। তূর্য সম্মোহনী আলাপের ধার ধারলো না, সোজা গিয়ে গা এলিয়ে দিলো কাউচের উপর, হাতে একটা আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে দ্বিধাহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কি ব্যাপার শশুর আব্বা, নাস্তা নিচ্ছেন না যে?
ঠিক এই কারণেই তূর্যকে একদম পছন্দ নয় নাজমুল সাহেবের। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক মানুষ তারউপর একমাত্র শশুর, অথচ একটা সালাম অবধি দিলোনা!
থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে, কাউচের উপর আসন দিয়ে বসে হ্যাংলার মতো আপেল খাচ্ছে, এ কেমন বেয়াদবি? কে মেনে নিবে এমন মেয়ে জামাই? নাজমুল সাহেবের ও মেনে নিতে বিশেষ আপত্তি, নেহাৎই তন্দ্রা জাওয়াদ ভদ্রমহিলা দুঃসময়ের সাথী, তাদের বিপদের বন্ধু, তাই না করতে পারেননি। নয়তো এমন বেয়ারা, বেশরম অশিষ্ট ছেলেকে কভুও নিজের আদরের কন্যার পাশে কল্পনা করতে চাননা তিনি।
— শশুর আব্বা কি একটু রেগে আছেন?
মুখ ভর্তি আপেল নিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় কথাটা বললো তূর্য। তার কথার পাছে নাজমুল সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই তড়িঘড়ি করে বাক্য শুধরালো সে,

— একটু না, মনে হয় বেশি রেগে আছেন!
নাজমুল সাহেবের শক্ত চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে, তিনি ক্রোধ দমাতে না পেরে রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— ফাজলামো করছো?
— উহু,
আপেল খাওয়া বাদ দিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো তূর্য। অর্থাৎ সে খুব সিরিয়াস।বেজার মুখে জবাব দিলো,
— আপনার সঙ্গে কি ফাজলামো মানায় বলুন? মানালে নিশ্চয়ই করতাম।
— তাহলে আমার মেয়ে কোথায়?
নাজমুল সাহেব চটে গেলেন। তূর্য সাবলীল কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,
— ঘরেই আছে, ঘুমাচ্ছে।
— ঘরে যে আছে সেটা আমিও জানি। কিন্তু ওর তো পা ভেঙে গেছে। তাও তোমার জন্য। ড্রাইভ করতে না জানলে গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত দাও কেন বুঝিনা বাপু।
— দোষটা আমার নয়, আপনার মেয়ের। গাড়ির মধ্যে বসে ওই ক্যাঁচড় ক্যাঁচড় করে আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিল।

তূর্যের কথা শুনে নাজমুল সাহেবের বিরক্তিভাব আরও বেড়ে গেলো। একেতো তার মেয়েটার পা ভেঙে রেখেছে, তারউপর সঙ্গে করে বাড়িতেও নিয়ে যেতে দিচ্ছে না, চাইছে টা কি এই ছেলে?সহসা প্রশ্ন ছুড়লো,
— তুমি চাচ্ছো টা কি বলোতো? এই নিয়ে তিনবার এসে ফিরে গেলাম। অথচ একবারও নিঝুমকে সঙ্গে যেতে দিচ্ছো না। কেন? ওর মায়ের কাছে থাকলে জুতসই সেবাযত্ন পেয়ে মেয়েটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, সেটা কি তোমার বুঝে আসে না?
ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠলো তূর্যের অভিব্যক্তি, থমথমে গলায় জবাব দিলো,
— আমি আছি এখানে,ওর সেবা করার জন্য। কিন্তু ওকে যেতে দেওয়া যাবেনা।
নাজমুল সাহেব থমকালেন, একমুহূর্তের জন্য মনে হলো এই ছেলেটা রহস্যময়, ওর দু’চোখে ঘনীভূত হয়ে আছে অন্তহীন আঁধার।

— কেন? কেন যেতে দেওয়া যাবে না শুনি?
নাজমুল সাহেবের কণ্ঠে বিরক্তি। তূর্য কঠিন গলায় বললো,
— নিঝুমকে দিয়ে দিলে আমি কিভাবে থাকবো? বিবাহিত হয়ে এতোদিন একা থাকা যায় নাকি? তাছাড়া আমারও তো সেবা যত্নের প্রয়োজন আছে।
— বেহায়া ছেলে জবান সামলাও। আমি তোমার শশুর হই।
সমগ্র মুখগহ্বর নিমসিদ্ধ জলের মতো তেঁতো হয়ে উঠেছে তার । এই ছেলের ভালো ম্যানার তো দূরে থাক সামান্য কমনসেন্স টুকু অবধি নেই। কার সামনে কি বলতে হয় সেটাও জানেনা। নাজমুল সাহেব যখন মনেমনে তূর্যের তুলোধুনো করছিলেন, সেসময় আবারও বাক্য ছোড়ে তূর্য। দাঁত কেলিয়ে হেসে শুধায়,
— বলছি সে শশুর আব্বা পাস্তাটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চিজ পাস্তা তো, আমার ভীষণ প্রিয়, চোখের সামনে এভাবে অবহেলা সহ্য হচ্ছে না।তাই আপনি অনুমতি দিলে,
বাক্য শেষ না করেই লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকালো তূর্য। হতাশ নাজমুল সাহেব চোখের চশমা ঠিক করে কাউচ ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,

— খাও খাও সব খাও। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
— ধন্যবাদ।
ছোট্ট সম্মোহনীতে বাক্যালাপের ইতি টেনে পাস্তার প্লেট কোলে তুলে নিলো তূর্য। গপাগপ কয়েক চামচ মুখে পুরে ফের বললো,
— একি! উঠছেন যে? নেংটি, না মানে নিঝুমের সাথে দেখা করে যাবেন না?
কিছুটা স্বস্তি, আর কিছুটা বিরক্তি এই দুয়ের মিশেলে তপ্তশ্বাস ছাড়লেন নাজমুল সাহেব। মুখের গম্ভীর ভাবটা অটুট রেখে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে থমথমে গলায় জবাব দিলেন,
— ঘুমাচ্ছে যখন আজকে থাক। পরের বার ওর মাকে নিয়ে আসবো।
— ঠিক আছে বায় বায়। নিঝুমের পা ঠিক হলে আমরাও গিয়ে বেড়িয়ে আসবো।
গতিহীন কথায় শশুরকে বিদায় জানালো তূর্য। এদিকে দরজা খুলতে গিয়েও পেছনে তাকিয়ে কটমটিয়ে উঠলেন নাজমুল সাহেব। বিরক্তিভরা কণ্ঠে স্বগোতক্তি করে আওড়ালেন,
— শশুরকে যে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে হয় সেটাও জানেনা। ম্যানারলেস কোথাকার !

নিঝুমের পা ভেঙেছে আজ প্রায় পনেরো দিন। পা ভাঙার পর থেকেই চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ তার জীবন। আজকাল ভীষণ অস্থির লাগে, মাঝেমধ্যেই দম বন্ধ হয়ে আসে, মন চায় একটু খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাসে মন ভরে নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু কিভাবে? সাধারণ ঘরের কাজগুলোও তার করতে হয় তূর্যের সাহায্য নিয়ে। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ওয়াশরুম যাওয়া অবধি সবকিছুতেই তূর্যের উপর নির্ভরশীল। সেখানে একা একা বাসার বাইরে যাওয়া তো বিলাসিতা। আজকাল চারিদিকে শুধু তূর্যকেই দেখতে পায় নিঝুম। ডানে-বামে সামনে পেছনে যখন যেটার প্রয়োজন হয় তূর্য সুপারম্যানের মতো হাজির।
এই যেমন মাত্রই,
নিঝুম বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো তূর্যের সরব ধ্বনি,

— সেই বিকেল থেকে বই পড়ছিস, এখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, সে খেয়াল আছে?
বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে চারিদিকে তাকালো নিঝুম, সত্যিই তো সূর্য ডুবে গেছে আরও আগেই। সহসা মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলো,
— বইয়ের পাতায় ডুবে গিয়েছিলাম, তাই টের পাইনি।
আজকাল ঝগড়া হয়না ওদের। খুব জোর মনমালিন্য হয়, কারণ নিঝুমের সবকাজেই তো এখন তূর্যকে প্রয়োজন। নিঝুম ক্রীসে ভর করে উঠতে উদ্যত হয়, তূর্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
— ক্রীস লাগবে না। দাঁড়া আমি তুলে দিয়ে আসছি।
কথা শেষ করে নিঝুমকে আর কিছু বলার সময় দিলোনা তূর্য। কোলে তুলে সোজা বিছানায় নিয়ে বসালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

— রাতে কি খাবি?
— আপনি রান্না করবেন?
নিঝুমের পাল্টা প্রশ্ন। তূর্য একটু সন্দিগ্ধ গলায় বললো,
— হ্যা, কেন?
— তাহলে চিংড়ি।
ফটাফট উত্তর দিলো নিঝুম । তূর্যের কপাল কুঁচকে গেলো। কটমট করে বললো,
— তুই আর ভালো হলিনা নেংটি। পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে বসে আছিস তবুও আমাকে জ্বালাতে ছাড়ছিস না।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করলো নিঝুম। ছদ্ম মন খারাপ নিয়ে বললো,
— সেদিন আপনি ওভাবে গাড়ি না চালালে তো এ্”ক্সিডেন্ট হতোনা, আর এ”ক্সিডেন্ট না হলে আমার পা ভা’ঙতো না, আর পা না ভা’ঙলে তো আর আপনাকে এলার্জী নিয়ে চিংড়ি রাঁধতে হতো না তূর্য ভাই।
তূর্যের চোয়াল ঝুলে পড়লো। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চঞ্চল মেয়েটির দুষ্টুমি ভরা চোখের পানে। নিঝুম আবারও বললো,

— এই বিশ্লেষণের সারমর্ম কি বুঝতে পেরেছেন নাকি ভেঙে বলবো?
তূর্য তৎক্ষনাৎ বিপ্লবী গলায় সে কথা প্রতিহত করে বললো,
— বুঝেছি বুঝেছি, আর সারমর্ম বোঝাতে হবে না। আমার অসহায়ত্বের ফায়দা লুটে আর কতো?
হতাশার বুলি আওড়াতে আওড়াতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো তূর্য। এদিকে নিঝুম না চাইতেও ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো। আজকাল তুষারকে আর খুব একটা মনে পড়েনা নিঝুমের। আগের মতো দেখার লোভ জাগেনা মানুষটাকে, বুকের ভেতর উথাল পাথাল প্রেমটাও কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে । তূর্য সারাক্ষণ এমন ভাবে মাতিয়ে রাখে চারপাশ, যে না চাইতেও ঘোরের মধ্যে থাকে নিঝুম। স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন নাকি অন্য কিছু, জানা নেই। তবে আজকাল বুকের ভেতর তূর্যের প্রতি গভীর একটা মায়া সৃষ্টি হয়েছে রমণীর। নিঝুম অবশ্য জানেনা সেই মায়ার গভীরতা, কখনো খতিয়ে দেখা হয়নি আসলে। কিন্তু সেদিন গাড়িটা হঠাৎ ওভাবে খাদে না পড়ে গেলে এই মায়াটুকুও অনুভব হতোনা বোধ হয়।
নিজ মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ডুবে গিয়ে, নিঝুম হারিয়ে গেলো পনেরো দিন আগের ভাবনায়।

ভার্সিটিতে পরীক্ষা চলছে, আজকেই শেষদিন। এরপর শুরু হবে সেমিস্টার ব্রেকের লম্বা ছুটি। পরীক্ষার শেষ দিন একটু সময় নিয়েই হল থেকে বেড়িয়েছিল নিঝুম। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতার মাঝে ক্যাম্পাস পেড়িয়ে কখন যে গেটে চলে এলো তার হদিস নেই।

শরতের শেষ কটা দিন ভীষণ মেঘলা। ধূসর মেঘে থমথম করছে সমগ্র আকাশ। বিরাগ অভিমান নিয়ে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূর্যরাজ, এমন এক মেঘলা দুপুরে হঠাৎ ভার্সিটির গেটে দেখা মিললো অপ্রত্যাশিত এক মানবের। হুট করে বিশ্বাস হচ্ছিল না, তাই দ্বিতীয়বার চোখ কচলে আবারও ভালোভাবে খেয়াল করলো নিঝুম। সফেদ শার্ট আর কালো প্যান্টের ফর্মাল বেশভূষা নিয়ে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কখনো গেটের দিকে তাকাচ্ছে, কখনো বা কব্জি তুলে ঘড়ি দেখছে আনমনে। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের তূর্যকে সাদা শার্টে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। চেহারায় কোথায় কোনো ছেলেমানুষীর ছোঁয়া নেই, বরং তীক্ষ্ণ চোয়াল আর অভিব্যক্তির গম্ভীরতায় তাকে ব্যক্তিত্ববান যুবকের মতোই আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণের বিস্ময় কাটিয়ে তূর্যের দিকে এগিয়ে গেলো নিঝুম। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অতি সাবলীল কণ্ঠে শুধালো,

— কাউকে খুঁজছেন তূর্য ভাই?
— তোকে।
— আমাকে কেন? আমিতো হলে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম।
কাঁধ ঝেড়ে সটান হয়ে দাঁড়ালো তূর্য। প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে জবাব দিলো,
— চারিদিকে একটা আষ্ঠে গন্ধ টের পাচ্ছিস? কেমন যেন ইঁদুর ইঁদুর!
বলেই নাক কুঁচকালো তূর্য। তার সস্তা তিরস্কার বুঝতে পেরে চোখ রাঙালো নিঝুম। শক্ত গলায় বললো,
— আপনি কি আমাকে এখানে অ’পমান করতে এসেছেন তূর্য ভাই?
— উহু, মোটেই না। তোকে গাড়িতে তুলে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে এসেছি।
তূর্যের দায়সারা প্রত্যুত্তর। নিঝুম কটমটিয়ে বললো,
— আপনি আগে গাড়িতে উঠুন। চারিদিকের মানুষ দেখছেন কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে? নির্ঘাত আমার পাশে আপনাকে দেখে ভয় পেয়েছে। ভাবছে, এই হুতুম পেঁচাটা আবার দিনেদুপুরে কোত্থেকে উদয় হলো !
নিঝুমের কথায় তূর্য অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক চাইলো,

— কই না তো!
— তাকাচ্ছে, তাকাচ্ছে, জলদি গাড়িতে উঠুন। ভার্সিটিতে আমার একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে, সব শেষ হয়ে গেলো।
কথা বলতে বলতেই তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলো নিঝুম।
ভার্সিটির চত্ত্বর পার হতে না হতেই ঘটলো আরেক বিপত্তি। সামনের সড়কে বিশাল জ্যাম। কয়েকবার অযথা হর্ণ বাজিয়ে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালো তূর্য। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে নিঝুমকে বললো,
— তুই বস, আমি দেখছি কি হয়েছে।
অগত্যা নির্লিপ্ত মুখে গাড়িতেই বসে রইলো নিঝুম। একটু বাদে জ্যাম ছেড়ে দিলো, তূর্যও ফিরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো। নিঝুম একটু কৌতুহল নিয়ে শুধালো,
— কি হয়েছিল ওখানে বলুন তো?
তূর্য কাঁধ ঝাঁকালো, স্টিয়ারিং এ হাত চালিয়ে ঠোঁট উল্টে দায়সারা গলায় বললো,

— আরেহ ভার্সিটির ছেলেপেলেদের চাইল্ডিস কাণ্ড, এরা প্রেমপিরিতি ছাড়া কিছু বোঝে নাকি? রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে কোন মেয়েকে যেন প্রোপোজ করছে একটা ছেলে, বন্ধুরা আবার তাতে উৎফুল্ল হয়ে হইরই করে হাততালি দিচ্ছে, যত্তসব হিরোগিরি।
কেউ কাউকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিতেই পারে, এটা এতো বিরক্তি নিয়ে বলার কি আছে? নিঝুমের মেজাজ খিঁচড়ে গেলো। অসন্তোষ গলায় বললো,
— আপনার মধ্যে একটা ভিলেইন ভিলেইন ভাব আছে। এভরিসিতে গিয়ে অডিশন দিলে নিশ্চিৎ বাংলা সিনেমায় চান্স পেতেন।

— আমিতো ভিলেইনই।
সড়কে ইউটার্ন নিয়ে অতি সাবলীল কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো তূর্য। অথচ এই ছোট্ট কথাটিতে নিঝুমের ভাঙা হৃদয়ে কি ভীষণ ঝড় বয়ে গেলো। হুট করেই মানস্পটে ভেসে উঠলো একটা ছন্নছাড়া, অনুভূতিহীন,গম্ভীর চেহারা। যে সবসময় নিজেকে ভিলেইন সম্মোধন করতো। নিঝুমের মনে হলো ওর বুকের উপর গোটা পাহাড় চাপিয়ে দিয়েছে কেউ, যার দরুন আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাপা অভিমান নিয়ে বিড়বিড়ালো,
— কখনো প্রেমে পড়লে এই কথা বলতেন না।
ড্রাইভ করতে করতেই ঘাড় ঘোরালো তূর্য, নিঝুম কে উপহাস করে বললো,
— এমন ভাব দেখাচ্ছিস যেন তুই প্রেম বিষয়ক পিএইচডি করে বসে আছিস।
নিঝুম একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল, তাই বেখেয়ালেই বলে উঠলো,
— প্রেমে তো ঠিকই পড়েছি।
— কার প্রেমে?
ক্রিকেট বলের মতো বাক্যটাকে ঝট করেই ক্যাচ করলো তূর্য। ধ্যানভঙ্গ হলো নিঝুমের, বোধশক্তি ফিরে পেতেই কথা এড়িয়ে জবাব দিলো,

—- ক…কারোর না।
— না, বলতেই হবে।
— বলেছি তো কারোর না, এমনি মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে।
কথার মাথায় হুট করেই গাড়ির স্পিড একশোর কাটায় উঠিয়ে দিলো তূর্য। গতি জড়তায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো নিঝুম। কোনোমতে সিটবেল্ট আঁকড়ে নিজেকে সামলে চেঁচিয়ে বললো,
— কি শুরু করলেন তূর্য ভাই? এভাবে পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? এ’ক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো।
তূূর্য গায়ে মাখলো না সেই কথা, উল্টো সড়ক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিঝুমের দিকে ঝুঁকে পড়লো সে। বললো,
— মুখ ফস্কে কার কথা বেড়িয়েছে সেটা আগে বল। কার প্রেমে পড়েছিলি তুই?
পরপরই ইউটার্ন এলো রাস্তায়, সেবেলা তূর্য কোনোমতে স্টিয়ারিং সামলাতে পারলেও, নিঝুম যখন বলে উঠলো,
— একপাক্ষিক প্রেম কোনো প্রেম নয়, ওটা শুধুই যন্ত্রণা।
ব্যাস, তারপর আর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারলো না তূর্য। ব্যস্ত সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গড়াতে গড়াতে সোজা গিয়ে রাস্তার খাদে উল্টে পড়লো গাড়িটা।
জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে র’ক্তা’ক্ত তূর্য নিঝুমকে বুকে আগলে ধরেছিল। তারপর থেমে থেমে ধ্বনিত হচ্ছিল তার অস্ফুট কণ্ঠস্বর,
— এবার প্লিজ এটা বলিস না জান, যে তোর সেই একপাক্ষিক ভালোবাসা আমি নই, অন্য কেউ।

সেদিনের কথা ভাবতে গিয়ে আবারও শিওরে উঠলো নিঝুম। চারিদিকে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে ,বাইরে বোধ হয় মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসন্ন। নিঝুম উঁকিঝুকি দিতেই খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ঘরে এলো তূর্য। গলদা চিংড়ি ভুনা আর ধোঁয়া ওঠা সাদা গরম ভাত। একটাই প্লেট, সেটা নিঝুমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে শরীর চুলকাচ্ছে তূর্য। একপল ভাতের প্লেটে নজর বুলিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তূর্যের দিকে তাকালো নিঝুম। তূর্য তাড়া দেখিয়ে বললো,
— তাড়াতাড়ি ধর, চিংড়ি কেটেছি ভীষণ হাত চুলকাচ্ছে। এক্ষুণি মেডিসিন না নিলে আমি শেষ।
— আপনি কেন? বুয়া কোথায়?
— তুইতো বুয়ার রান্না খেতে পারিস না।
তূর্যের কথা শুনে নিঝুমের মাথায় হাত । কিছুটা অধৈর্য গলায় বললো,
— তাই বলে আপনি মাছ কাটবেন?
— আশ্চর্য! তুই বললি বলেই তো কাটলাম।
তূর্যের কপালে চিন্তার বলিরেখা। নিঝুম তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো না। তাড়াহুড়ো ওর হাতটা টেনে নিয়ে দেখতে দেখতে বিরক্তির স্বরে বললো,

— আমি বলেছি বলেই কাটতে হবে? কে আমি?
— আমার বউ।
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই লোকের সঙ্গে পারা যাচ্ছেনা আর। তাই রাগ দেখিয়ে বললো,
— খাবো না আমি।
— আমি এতো কষ্ট করে এলার্জী নিয়ে চিংড়ি রেঁধেছি, তুই খাবিনা মানে? তোর বাপ খাবে।
বলেই জোর করে এক লোকমা ভাত তুলে দিলো নিঝুমের গালে। নিঝুম ভাত চিবোতে চিবোতে রাগে লাল হয়ে বললো,
— আমার বাপ তুলে কথা বলবেন না একদম।
— স্যরি, আমার শশুর আব্বা। এবার ঠিক আছে?

বাইরে অবিরাম বর্ষন। জানালার গরাদে বৃষ্টির ছাট। ভাত খেতে খেতে বেশ রাত করে ফেলেছে নিঝুম। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে, ওকে ওষুধ খায়িয়ে তূর্য বললো,
— এবার শুয়ে পর, আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি।
সহসা মাথা নাড়ালো নিঝুম। উল্টো প্রশ্ন করলো, —আপনি কি করবেন?
তূর্য জানালো, সে আপাতত গানের প্র্যাক্টিস করবে, খুব শীঘ্রই এলবামের কাজ শুরু হবে তার। এই কথা শোনা মাত্রই সদ্য কিশোরীর মতো বায়না ধরলো নিঝুম,
— আমাকে একটা গান শোনাবেন? আসলে ঘুম আসছে না।
এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। এমন সুযোগ লুফে নিতে মোটেই দেরী করলো না তূর্য। চটজলদি বললো,

— শোনাবো এক শর্তে।
— কি শর্ত?
— তোকে শাড়ি পড়তে হবে।
নিঝুমের চোখ কপালে। ব্যান্ডেজে মোড়ানো পায়ের দিকে ইশারা করে বললো,
— এই অবস্থায়?
— আমি আছি কি করতে? তুই শুধু বল পড়বি কি না?
নিঝুম একটু আড়ষ্ট হলো। যদিও পা ভাঙার পর থেকে তাকে জামা কাপড় পড়তে যথেষ্ট সাহায্য করে তূর্য। তার কাছে লজ্জা পাওয়ার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবুও শাড়ি পড়ানোর ব্যাপারটা একটু আলাদা। শাড়ি সচারাচর মানুষ ভালোবেসে পড়িয়ে দেয়। সেখানে পা ভাঙা অবস্থায় তূর্য কি করে শাড়ি পড়াবে?
নিঝুমকে ভাবতে দেখে তূর্য হুট করেই কোলে তুলে নিলো ওকে। কাবার্ডের দিকে যেতে যেতে বললো,
— চল শাড়ি চ্যুজ করবি।

পাইথন প্যারাডাইস রাশিয়া,
গভীর রাত। অবিশ্রাম অঝোর ধারা তখনও ঝরছে।
তুষার লাউঞ্জে বসে কোলের উপর ম্যাকবুক চাপিয়ে একমনে কিছু একটা করছে। পাশেই ঘুমন্ত ইয়াশকে নিয়ে নীরবে পায়চারি করছে ফ্লোরা। প্রায় আধঘন্টা ধরে এভাবেই তুষারের চোখের সামনে ঘুরঘুর করছে মেয়েটা, অথচ যন্ত্রমানবের মুখ তোলার নামই নেই। উল্টো কানের মধ্যে এয়ারবার্ডস গুঁজে বসে আছে সে ।
সারারাত পায়চারি করলেও তুষার ঘুরেও তাকাবে না, ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে ফ্লোরাই নীরবতা ভাঙলো প্রথমে,
— ইয়াশ ঘুম থেকে জেগে আবারও ঘুমিয়ে গেলো, অথচ ঈশু আর এরীশ এখনো ফিরলো না।
— তারা রোমান্স করছে আপাতত ।
দৃষ্টি না তুলেই নির্বিকারে জবাব দিলো তুষার। ফ্লোরার কপাল বেঁকে গেলো। প্রশ্ন ছুড়লো,
— আপনি কি করে বুঝলেন?
তুষার নিজের কব্জিতে আবদ্ধ ঘড়িটা তুলে ধরলো, আঙুলের ইশারা করে বললো,
— মাফিয়া বসের হার্টবিট ফাস্ট হয়ে আছে। প্রেশার ও হাই।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নীরবে ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো ফ্লোরা, পরপরই স্বগোতক্তি করে বিড়বিড়ালো,

— আপনি রোমান্স ও বোঝেন, বাহ!
— কি বললে?
এতোক্ষণে চোখ তুললো তুষার। ফ্লোরা প্রসঙ্গ এড়িয়ে মিনমিনিয়ে শুধালো,
— না মানে, আপনি আসলেই বিয়ে করবেন?
ফের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তুষার। ম্যাকবুকে চোখ বুলিয়ে আনমনে বললো,
— না করার তো কোনো কারণ দেখছি না।
ফ্লোরা হতাশ হয়ে আবারও ঠোঁট উল্টালো। মনেমনে ভাবতে লাগলো,এই রোবটের মতো লোকটা আদৌও তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে কিনা? মনের মাঝে ঘুঁনোপোকার মতো অসন্তোষ দলা পাকালো।মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইলো সে নির্বিকারে। রুশকন্যাকে হঠাৎ জমে যেতে দেখে চোখ তুললো তুষার। অনুভূতিহীন গলায় বললো,

— কি হয়েছে?
ফ্লোরা না সূচক মাথা নাড়ালো। গলা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করলো,
— আমাকেই কেন?
— বিয়ে করার কথা বলছো?
তুষারের পাল্টা প্রশ্ন, ফ্লোরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভেসে এলো ওপাশ থেকে,
— কেন আবার, কাপড়-চোপড় ধোঁয়ানোর জন্য। আমার মনে হয় পৃথিবীর বেস্ট ধোপা তুমি, তোমার চেয়ে ভালো কাপড় আর কেউ কাচতে পারেনা।
ফ্লোরার খারাপ মনটা এবার আধার থমথমে হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতোই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে হয়ে গেলো তার স্বপ্নে বোনা মায়াকানন । কাল সারারাত ঘুম হয়নি একটুও, তুষারের ওই একটুখানি আস্কারায় কতকিই না ভেবে ফেলেছে মেয়েটা। সেসব মনে পড়লে এখন লজ্জা আর গ্লানিতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে ভেতরটা। কণ্ঠতালু বুজে আসে অভিমানে।

— ওহ।
ফ্লোরা আর দাঁড়িয়ে থাকলো না। সংক্ষিপ্ত উত্তরে কথাশেষ করে তড়িঘড়ি করে হাঁটা ধরলো ঘরের দিকে। তখনই পেছন থেকে আরও একবার ডেকে উঠলো তুষার,
— আরও একটা কাজের জন্য।
অভিমানের পাশাপাশি এবার রাগও হলো ফ্লোরার, লোকটা শুধু কাজই বোঝে, সহসা ঘাড় ফিরিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— আবার কি কাজ?
দাঁতের ডগায় অধর কামড়ালো তুষার, ভাবুক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ নীরব থেকে হিমশীতল কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,
— উমমম, এখন নয়, বিয়ের পর বলবো।

বাংলাদেশ,
বৃষ্টিস্নাত ঠান্ডা রাতে শক্ত পাথরের মতো জমে আছে নিঝুম। মোম নরম কমনীয় শরীরের খাঁজে পুরুষালী হাতের খরখরে স্পর্শ অনুভূত হতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের ন্যায় কেঁপে উঠছে তার শীর্ণদেহ। রমণীর মুঠোবন্দি হাত, আর জমে থাকা শরীরের দিকে একনজর দৃষ্টি বুলিয়ে হঠাৎ করেই মাঝপথে শাড়ি পড়ানো থামিয়ে দিলো তূর্য। চকিতে প্রশ্ন ছুড়লো নিঝুম,
— কি হলো পারছেন না?
তূর্য কিছু বলতে যাবে,তন্মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলো,ফলস্বরূপ তড়িৎ পায়ে এগিয়ে এসে তূর্যের বাহু আকড়ে ধরলো নিঝুম। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে কুণ্ঠিত স্বরে বলে উঠলো,

— বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার আর সময় পেলোনা, এমনিতেই বাইরে ঝড় উঠেছে।
— আমার ভেতরে আরও বড় ঝড় উঠেছে নিঝুম। সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো তূর্য। নিঝুম একটু অবাক হলো। বিজলির ক্ষীণ আলোয় তামাটে বর্ণের শ্যামসুন্দর মুখটিকে পরখ করে বলে উঠলো,
— কি হয়েছে আপনার?
তূর্য সময় নষ্ট করলো না, তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
— শাড়ি পড়তে হবেনা তোর।
— ওমা কেন?
তূর্য আর উত্তর দিলোনা সে কথার, শাড়ির বাকি অংশটুকু নিঝুমের শরীরের এলোমেলো ভাবে পেঁচিয়ে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুয়িয়ে দিলো ,পরপরই ওর উপর আধশোয়া হয়ে মোহাবিষ্ট গলায় আওড়ালো,
— তুই সবসময় আমার অসহায়ত্বের ফায়দা নিস, আজ যদি আমি তোর অসুস্থতার ফায়দা নিই তাহলে কি খুব বেশি রাগ করবি?
নিঝুম অবুঝ নয়। যা দরুন তূর্যের আকার ইঙ্গিতে বলা কথাখানায় পিলে চমকে গেলো রমণীর।তূর্যের বাহুতলে মিয়িয়ে গিয়ে আড়ষ্ট গলায় বললো,

— আমি সময় চেয়েছিলাম তূর্য ভাই।
তূর্য আরেকটু ঝুঁকলো। রমণীর পেলব ত্বকে তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,
— আর কতো? দিনের পর দিন তোকে এভাবে দেখছি, এতোকিছুর পরে নিজেকে সংযত রাখা দায়, প্লিজ বোঝার চেষ্টা চেষ্টা কর, আমিও তো মানুষ।
মস্তিষ্ক বলছে সে আমার স্বামী, এদিকে মন বলছে ভালো কি করে বাসবো? সহসা মন মস্তিষ্কের বিরোধে কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে তূর্যের বাহুমাঝে পরে রইলো নিঝুম।
অতঃপর ক্ষণকালের নৈঃশব্দ্য। বাইরে বৃষ্টির রেশ তখন সীমানা ছাড়িয়ে অবিরাম। একটু বাদে বাদেই বাজ পড়ছে সশব্দে, ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা। একটু থেমে তূর্যই প্রথম ভাঙলো সেই মৌনতা। রমণীর কর্ণগুহরের সংস্পর্শে গিয়ে বললো,

— তুই কি জানিস, তোকে আমি কেন বাড়িতে যেতে দিইনি না?
নিঝুম প্রশ্ন করলো না, একটু থেমে নিজে থেকেই উত্তর দিলো তূর্য,
— কারণ এই সময়টা আমি তোর কাছাকাছি থাকতে পারি, এমনিতে তো আমার ধারেকাছেও ঘেষিস না। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।
তূর্যের শেষ কথাতে ক্রমশ দ্রবীভূত হতে থাকলো নিঝুমের জমে থাকা অন্তরঃকরণ। আড়ষ্ট ভাবটা কমে গিয়ে ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আশ্চর্য এক রমণীয় চাহিদা, শরীরের উপর ঝুকে থাকা পুরুষটির প্রতি আকর্ষন বাড়লো, এতোদিন বুকের ভেতর যে অদৃশ্য দাবানল টের পেয়েছিল, আজ স্বামী নামক পুরুষটির সংস্পর্শে তা যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ঠেকলো।

অবশেষে দূরত্বের শক্ত প্রাচীরে প্রথম আঘাতটা তূর্যই হানলো, কোনোকিছু না বলেই অতর্কিত এক চুমু আঁকলো রমণীর কোমল ওষ্ঠে। নিঝুম হকচকালো, দিশেহারা তূর্য লজ্জাটুকু পাওয়ার ফুরসত দিলোনা ওকে। পরপর আরও কয়েকটা গতিহীন চুম্বনের প্রগাঢ়তায় ভিজিয়ে দিলো ঠোঁট।
অতঃপর জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় বাঁধভাঙা হলো অনুভূতি। নিকোশ নিবিড় নিশীথে বৃষ্টির তালে তালে গভীর থেকে গভীরতর হলো অদমনীয় স্পর্শ। শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। নাম তার ‘প্রণয়’।
সে রাতে তূর্য তার কথা রেখেছিল। শেষরাতে, নিজের পরিণিতাকে পাশে রেখেই সুর তুলেছিল গীটারে, চোখের তারায় অজস্র তৃপ্তি নিয়ে চমৎকার গলায় গেয়েছিল,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৯

রোজ বিকেলে আতর ঢেলে
তোকে সাজাবোই,
মেলায় যাবো রিকশা চড়ে,
বসবি পাশে তুই,
বন্দি আছে হাজার আশা
বুকের মাঝে দেখ,
একটু চিনে নিলেই হবো
দু’জন মিলে এক..

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬১