আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৮

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৮
suraiya rafa

গত ক’দিন ধরে লঘুচাপ চলছে সমুদ্রপৃষ্ঠে, বৃষ্টি নেই তবে রোদের ও মুখ দেখা যায়নি এই ক’দিন। পতেঙ্গার সামুদ্রিক ভারী গর্জনে মুখরিত চারিপাশ, সেই সাথে যোগ হয়েছে শঙ্খচিলের কিচিরমিচির।
বাতাসের তান্ডবে ফুসকা চটপটি ওয়ালা মামাদের ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো স্টল গুলো পত পত করে হাওয়ায় উড়ছে,যেন অতি অসাবধানতায় এক্ষুনি সেগুলো উল্টে পড়বে যত্র তত্র। তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না, শাঁই শাঁই বাতাসের মাঝেও হকারীরা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন সানন্দে। মাত্রাতিরিক্ত বাতাসে চাঁদের হাসি ক্যাফের আউটডোর প্ল্যান্ট গুলো কেমন নেতিয়ে পরেছে, জয়া আন্টির চোখে পরলে খবর আছে, তাই সেগুলোকে নিজ উদ্যোগে গুছিয়ে একে একে ভেতরে নিয়ে রাখছে ঈশানী।

ওদিকে বেলা বাড়তেই দু’একজন কাস্টমার এসে হাজির হচ্ছে ক্যাফেতে, গাছ গুলো গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি জিসানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদেরকেও সার্ভ করে যাচ্ছে ও। একটানা ননস্টপ ডিউটি যাকে বলে।
খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে আসার প্রায় দিন চারেক পরে আজ দু’জনার একই সাথে শিফট পরেছে জিসান আর ঈশানীর। যদিও অন্যান্য দিনের মতো আজ আর কুশল বিনিময়ে আগ্রহী নয় ঈশানী, কিন্তু কাজের সূত্র ধরে এটা ওটা বলে ওকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জিসান। ঈশানী ও না পেরে দু’একটা কথার হুম হা উত্তর দিচ্ছে, যেহেতু দু’জন
কো- ওয়ার্কার কথা না বলে উপায় আছে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাজ, আর কাজের ফাঁকে ঈশানীর সঙ্গে একটু আধটু কথা এগোনোর বৃথা চেষ্টা এভাবে করেই কেটে গিয়েছে সে বেলা। তখন বেলা বারোটার দোরগোড়ায়, কাস্টমারদের চাপ খানিকটা কমে এসেছে, সেই সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে, এইটুকু নরম ভেজা বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে হাটার কিছুই নেই তবুও কোথা থেকে যেন ছাতা মাথায় করে ভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু বান্ধব সমেত ভর দুপুরে ক্যাফেতে হাজির হয়েছে নিঝুম।
হয়তো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।সেটা ব্যাপারনা, ঈশানী বেশ খুশিই হলো ওদের দেখে। নিঝুমকে দেখে গাঁ থেকে থেকে এ্যাপ্রোন খুলে তাড়াহুড়ো পায়ে এগিয়ে গিয়ে সম্মোহনী হেঁসে ঈশানী শুধালো,
— নিঝুম, তোরা এই সময়?
বিপরীতে ফিক হাসলো ওরা সকলে, যার অর্থ আমরা আজ বাঙ্ক দিয়েছি।নিঝুম ও হাসির ছন্দে তাল মিলিয়ে ঈশানীকে আস্বস্ত করে বললো,

—- চলে এলাম তোর সাথে আড্ডা দিতে,কত দিন দেখা হয়না বলতো।
প্রত্যুত্তরে ঈশানী ঠোঁট উল্টে বললো,
—- কি বলিস, কাল রাতে তো আমরা একসাথেই ছিলাম।
নিঝুম এবার হাত ধরে টেনে ঈশানীকে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো,
— তাও তোকে মিস করেছি, এবার বেশি বকবক না করে কফি খাওয়াতো।
নিঝুম ঠাট্টা করছে বুঝতে পেরে ঈশানী হেসে শান্ত স্বরে বললো,
—- আমি মোটেও বকবক করিনা,অপেক্ষা কর নিয়ে আসছি।
তবে ঈশানীকে আর উঠতে হলোনা, তার আগেই সবার জন্য ট্রে ভর্তি কোল্ড কফি নিয়ে হাজির হলো জিসান,
জিসান হঠাৎ কফি সার্ভ করায় কিছুটা বিব্রত কন্ঠে ঈশানী বলে ওঠে,

—- তুই কেন আনতে গেলি আমিই তো পারতাম।
— ইট’স ওকে, তুই ফ্রেন্ডদের সাথে গল্প কর আমি ওদিকটা দেখছি।
সবাইকে কফি সার্ভ করা হলে ঈশানীকে জবাব দিয়ে চলে যায় জিসান, সবার সামনে ঈশানীও আর প্রত্যুত্তর করলো না খুব বেশি। ওদিকে জিসানের এমন কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে নিঝুমের এক মেয়ে বন্ধু কিঞ্চিৎ টিপ্পনী কেটে বলে ওঠে,
—- প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট, হাহ?
মেয়েটার কথায় ঈশানীর হাসি উবে গেলো, হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে বললো,
— তেমন কিছুই না আমরা শুধুই কো- ওয়ার্কার।
— তারমানে বলতে চাইছো তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই? কাম অন, এতো সুন্দর চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াও অথচ লাইফে কেউ নেই এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

মুখের কোনে ধরে রাখা মেকি হাসিটা এবার পুরোপুরি মিলিয়ে গেলো ঈশুর,তার বদলে দু’চোখে ভর করলো বর্ষার ঘনঘটা। না, ঈশানী কাঁদছে না, তবে ওর মনে হলো ব্যথাতুর নীল হৃদয়টাতে কেউ শক্তপোক্ত হুল ফুটিয়ে দিলো মাত্রই। মস্তিস্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাজা হয়ে উঠলো সেই মাদকীয় পুরুষালী সুবাস, দীর্ঘরাতের স্মৃতি, গমগমে হাস্কি কন্ঠস্বর,পিয়ার্সিং করা তীক্ষ্ণ ভ্রুজুগল আর অধর তলার নির্লীপ্ত সেই কালো কুচকুচে তিল। এতো কিছু একসঙ্গে ভোলা যায়? কই ঈশানী তো পারছে না?
তারউপর কাল মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে হঠাৎ ফোনের ওপারে সেই একই কন্ঠস্বর,কি এক গোলকধাঁধায় আটকা পরে আছে ওর হৃদয়টা,কি ভীষণ টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছে দিবারাত্রি তা কেবল ঈশানীর হৃদয় জানে।না পারছে মস্তিষ্ক থেকে তার স্মৃতিটুকু মুছে ফেলতে আর না পারছে তাকে ভীষন ভাবে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে, অথচ তার মায়া কাটানো যে দুঃসাধ্য, বাদামী চোখের সেই তীক্ষ্ণ চাহনি মৌমাছির মতোই সারাটাক্ষন তাড়া করে বেড়ায় ঈশানীকে। ভালোবাসা বুঝি সত্যিই এমন বেপরোয়া হয়? কখনো কখনো তাকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা স্বয়ং নিজের হাতেও গচ্ছিত থাকে না আর।কি অদ্ভুত অনুভূতি এই ভালোবাসা!
গত কয়েকটা দিন নিঝুম এতো করে বোঝালো এটা ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা এভাবে হয়না, নিশ্চয়ই কেউ তোকে ম্যানিউপুলেট করে ছেড়ে দিয়েছে, নইলে চিনিস না জানিস না একরাতের এক দেখায় তার প্রেমে পরে গেলি? রিডিকিউলাস।
কিন্তু ঈশানীর যুক্তিটাও ফেলে দেওয়ার মতো না, নিঝুম যতবারই ওকে বুঝাতে গিয়েছে ঈশু তার বিপরীতে একটাই কথা বলেছে,

—- লাভ এ্যট ফার্স্টসাইড বলেও কিছু হয় নিঝুম,এটা যদি বিশ্বাস করে থাকিস , তাহলে আমি প্রথম দেখায় হুট করেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি এটাও তোকে মানতে হবে।
এরপর নিঝুম ও ওকে বারণ করার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি আর,নিঃস্বার্থ ভাবে এটাই মেনে নিয়েছে যে ওর ঘরকুনো অন্তর্মুখী বান্ধবীটা ভীষণ ভাবে কারও প্রেমে জড়িয়ে পরেছে, অবশেষে কারও জন্য মনের দুয়ার খুলে নিজের শক্ত খোলসের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডানা ঝাপ্টাতে চাইছে মুক্ত খোলা স্বাধীন আকাশে।
কিন্তু সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, ইন্টারনেটে হাজার বার সার্চ করেও অরন্য নামক কোনো সেলিব্রিটিকে খুঁজে পায়নি ঈশানী। সেই থেকেই কেমন নেতিয়ে ছিল মেয়েটা, কাজকর্ম খাওয়া দাওয়া সব বাদ দিয়ে দূর্বল শরীরটাকে নিয়ে পরে থাকতো বিছানার এক কোনে, মুখে প্রকাশ করার অভ্যাস নেই ওর, তবে ভেতর ভেতর যে অরন্য নামক ব্যাধিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ঈশু, সেটা বুঝতে বাকি নেই নিঝুমের।

দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিল,সেই সাথে ভারী হচ্ছিল অন্তর্মুখী ঈশানীর নিঃশ্বাসের পাল্লা, তবে কাল মাঝরাতে কিছু একটা অপ্রত্যশিত ঘটেছিল বটে, কাল রাত পৌঁনে দু’টো নাগাদ মুঠোফোনের ওই একটা ফোন কলই যথেষ্ট ছিল ঈশানীর নেতিয়ে যাওয়া দূরহ হৃদয়টাকে পুনরায় সতেজ করে দিতে। যদিও নাম্বারটা ছিল প্রাইভেট, তবে ঘুমের ঘোরে ঈশানী সেই পরিচিত হাস্কি গলাটা স্পষ্ট শুনেছিল বৈকি। অথচ বোকা ঈশানীর মাথায় তখন একটিবারের জন্যও এই প্রশ্নটা জাগেনি যে ওর নতুন নাম্বারের সন্ধ্যান অরন্য হঠাৎ কোথায় পেলো?এটা কি আদৌও একজন সাধারণ মানুষের দ্বারা সম্ভব? পুরো ব্যাপারটা কি এতোটাই স্বাভাবিক? নাকি পুরোটাই নাটকীয়?

ঈশু তো স্রেফ এটা নিয়েই উত্তেজিত যে ফাইনালি আরও একবার অরন্যর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে ও, তারমানে ওই রাতটা শুধুমাত্র ঈশানীর কাছেই অর্থবহ নয়, অরন্যর কাছেও তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। হ্যা রয়েছে তো বটেই, তবে এর পেছনের উদ্দেশ্য তো কেবল অরন্যই ভালো বলতে পারবে। শুধু শুধু তো আর এরীশ ইউভান কারও নাম্বার ট্র্যাক করে তাকে খুঁজে বের করতে যাবেনা! এর পেছনে মোক্ষম কোনো কারণ তো অবশ্যই রয়েছে।
সকালে যখন ঈশানীর মুখ থেকে এই ঘটনার বর্ণনা শুনে নিঝুম শুধালো,
— ফোনে কি বলেছিল অরন্য?
তার উত্তর অবশ্য দিতে পারেনি ঈশানী, গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ফোন রিসিভ করার ফলে ওপাশের কোনো কথাই মস্তিষ্ক অবধি পৌছায়নি ওর। তবে এই না মনে না থাকার আপসোস বোধহয় এ জীবনে ঘুচবে না আর।
তখন থেকে মুখ কালো করে কি যেন ভাবছে ঈশানী, নিঝুম ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ওর বান্ধবীকে তৎক্ষনাৎ চুপ করিয়ে দিলো,অতঃপর সশব্দে ডাকলো ঈশানীকে,

—- কি ভাবছিস হঠাৎ করে?
নিঝুমের ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়লো ঈশানীর, ও এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে জানালো,
— কই কিছু নাতো।
নিঝুম পুনরায় শুধালো,
—- হ্যারে, ওই প্রাইভেট নাম্বার থেকে আর কল টল এসেছিল নাকি?
— নাহ,
এবারও ছোট্ট করে জবাব দিলো ঈশানী।
—তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আবারও কল আসবে, অরন্য আমায় মনে রেখেছে নিঝুম।
কথাটা বলতে গিয়ে নীলাম্বর চোখদুটো খুশির ঝিলিকে চিকচিক করে ওঠে ঈশুর।ওর কথায় সায় জানিয়ে মৃদু হাসলো নিঝুম,
ওদিকে ঈশানীর কথার পাছে নিঝুমের বান্ধবী বলে ওঠে,

—- এই অরন্যটা আবার কে রে? এর কাহিনী তো কখনো বলিস নি আমায়?
ব্যক্তিগত বিষয়ে ঘাটাঘাটি করলে ঈশানীর অস্বস্তি হবে ভেবে বান্ধবীকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিলো নিঝুম, বললো,
—- কেউ না, অরন্য আমাদের ফ্ল্যাটের ময়লা ওয়ালা, কিছুদিন ধরে আসেনা তাই ঈশু একটু ডিপ্রেসড।
নিঝুমের বান্ধবী ঠোঁট পাউট করে চোখ বড় বড় করে ঈশানীর কাঁধে হাত রেখে ওকে আস্বস্ত করে বললো,
— আই ফিল ইওর পেইন ঈশু, চিন্তা করোনা ময়লা ওয়ালা শীঘ্রই চলে আসবে।

প্রায় ঘন্টা খানিক জমিয়ে আড্ডা দিয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেলো নিঝুম রা, ওরা চলে যাওয়ার পর পরই এটো মগ গুলো ট্রেতে তুলে সিংকের দিকে এগিয়ে যায় ঈশা। তবে ধোঁয়া মোছার কাজ শুরু করার আগ মূহুর্তে ওর একহাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরে একটানে ক্যাফের পেছনে স্টোর রুমে নিয়ে যায় জিসান।
আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল ঈশানী,সেই সাথে মেজাজ টাও চড়ে উঠেছে খুব, কোনমতে নিজের হাতটা জিসানের হাতের বাঁধন থেকে ছিটকে সরিয়ে শক্ত গলায় ফোঁস করে উঠলো ঈশা,
—- এভাবে হাত ধরে টানাটানি করার মানে কি জিসান? সবকিছুরই কিন্তু একটা সীমা থাকা প্রয়োজন।
এই মূহুর্তে জিসানের চোখেমুখে ক্রোধ সুস্পষ্ট, ও জবাব না দিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঈশানীকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো উল্টো, বললো,

— সীমা তো তুই অতিক্রম করছিস, এখনো অরন্য অরন্য নাম জপে যাচ্ছিস?
— আমার মুখে আমি কার নাম জপে যাবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার,এক্ষুনি পথ ছাড়।
জিসান পথ ছাড়লো না, উল্টো এগিয়ে গিয়ে ঈশানীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
—- হ্যা জানিতো, সবচেয়ে বড় সর্বনাশ তো ওই অরন্যর হাতেই হয়েছে,রাত কাটিয়ে এসেছিস বলে কথা, নষ্ট হয়ে গিয়েছিস তুই, পুরোপুরি নষ্ট।
ঈশানীর কাছে জিসানের এই বিশ্রী কথাগুলো মানসিক টর্চার ছাড়া আর কিছুই নয়, তবে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া কিংবা এতো বড় একটা ছেলেকে এভাবে ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে থাপ্পড় মা’রার মতো এতোটাও দুঃসাহস নেই ওর, অগত্যাই চোখ মুখ খিঁচে তাড়াহুরো করে যায়গা ত্যাগ করার বৃথা চেষ্টা চালালো ঈশানী, ঠিক তখনই নরম স্বরে জিসান বলে ওঠে,

—- আমার তোকে ভালো লাগে ঈশা, এক্সুয়ালি আ’ম ইন লাভ উইথ ইউ।
এবারও বরাবরের মতোই নিশ্চুপ ঈশানী।
ঈশানীর এমন নীরব থাকার ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হলোনা জিসানের, ভেতরে ভেতরে জমে থাকা ক্রোধটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মূহুর্তেই, ঈশানীর এই নীরবতাকে পুঁজি করে ওর কাঁধে সামান্য ধাক্কা দিয়ে পুনরায় দাঁত খিঁচিয়ে জিসান বলে উঠলো,

—- বরফের মতো কোল্ড একটা মেয়ে, আবেগ নেই অনুভূতি নেই, আমি ড্যাম সিওর তোকে টাচ করেও মজা নেই, তাও কিসের এতো তেজ তোর? জীবনেও তো কারও বন্ধু হতে পারলি না, ভালোবাসার মানুষ তো আরও দূরের কথা, পরিবারের সাথেও সেই একই নড়বড়ে অবস্থা, তোর মধ্যে আছেটা কি? নাথিং।
তবুও আমি তোকে ভালোবেসেছি, সবসময় তোর পাশে থেকেছি, অথচ তুই? আমার কথাটা ভেবে দেখা তো দূরে থাক একটা অচেনা অজানা ছেলের জন্য এখানে লিটরেলি ম’রে যাচ্ছিস তুই। হোয়াই!
কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো জিসান। ঈশানী তবুও নিশ্চুপ, হাত মুঠিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে দাঁতেদাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে শুধু।
— শোন ঈশা, তোর এসব সো কল্ড ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার নাটক টা না আর নেওয়া যাচ্ছে না। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার ভং ধরে থাকিস বলেই তোকে কেউ পছন্দ করেনা, বিয়ে করতে চায়না, তোর যে বিয়ে ভেঙে গিয়েছে সেটা আমি জানিনা ভেবেছিস? বিয়ের দিন তোর হবু বর পর্যন্ত তোকে রেখে বিদেশ চলে গিয়েছে, তাহলে ভাব তুই কতোটা কোল্ড? একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে,
ছেলেদের মন পাওয়ার জন্য না শুধু সুন্দরী হলেই হয়না, ভেতর থেকে যথেষ্ট হট ও হতে হয়,যেটা তোর মধ্যে একপার্সেন্ট ও নেই,নট আ…

জিসান হয়তো রেগেমেগে জিদের বশে আরও কিছু বলতো, তবে ক্ষ্যাপাটে ঈশানী এবার আর তার ফুরসত দেয়নি,কখন যে মেজাজ হারিয়ে নিজের পাঁচ আঙুলের ছাপ জিসানের গালে বসিয়ে দিয়েছে তা নিজেই ঠাহর করে উঠতে কিয়ৎক্ষন সময় লেগে গেলো ওর। তবে জিসানকে থাপ্পড় মে’রে আপসোসের লেশমাত্র নেই ঈশানীর দু’চোখে, উল্টো ভীষণ ক্রোধ আর ঘৃনারা যেন উপচে পড়ছিল নীলাম্বর চোখ দুটোতে।
অকস্মাৎ থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে গজগজ করে উঠলো জিসান, রাগের তোপে কাঁপতে কাঁপতে বলতে আরম্ভ করলো,
—- সারাদিন যে এই অরন্য অরন্য করছিস না? এই অরন্যর মুখোশ যদি আমি টেনে হিঁচড়ে খুলে না আনতে পারি তবে আমার নামও জিসান নয়।
জিসানের কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে গাঁ থেকে এ্যাপ্রোনটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো ঈশা।
ঈশার কর্মকান্ডে বিস্মিত হয়ে জিসান পুনরায় বললো,

—- আমি কিন্তু আন্টিকে ফোন করে সব বলে দেবো ঈশা, তুই জঙ্গলে অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে রাত কাটিয়ে এসেছিস সেটাও বলে দেবো। তখন আর বাড়ি ফেরার মুখ থাকবে তো?
ঈশানী চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু জিসানের কথায় আরও একবার ঘুরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেঁসে ঘৃণা আর ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো ,

—- যা ইচ্ছে তাই করে নে।
নদীর মতো শান্ত গলায় বাক্যটুকু শেষ করে হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় ঈশা, অথচ জিসান এখনো একই যায়গাতে ঠায় দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে একনাগাড়ে চেঁচিয়ে ডাকছে ঈশানীকে,
—- ঈশা যাস না।ইট’স নট ফেয়ার, তুই কিন্তু এই চাকরী টা সারাজীবনের জন্য হারাবি বলে দিলাম, এবার কিন্তু আমি আর সাহায্য করবো না তোকে। ঈশাআআআ!
ঈশানী এভাবে চলে যাক সেটা বোধ হয় কোনো কালেই চায়নি জিসান, ওই জন্যই এটা ওটার ভয় দেখিয়ে ঈশানীকে ঠেকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেছিলো শেষ পর্যন্ত, কিন্তু আজ আর কিছুতেই কিছু হলোনা। চরম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে মহামূল্যবান এই চাকরীটাক একপ্রকার পায়ে ঠেলেই বেরিয়ে যায় ঈশানী।

শ্রাবনের তীব্র বর্ষণে খানিকটা বিশ্রাম টেনে দিয়ে গত একসপ্তাহ ধরে সৌর্যদীপ্ত ধরনী।
যদিও রোদের তেজ তেমন নয়, তবে ঝুড়ঝুড়ে রোদে একেবারে চকচক করছে চারিপাশ। সেই যে দিন দশেক আগে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে চাকরি ফাকরি চুলোয় দিয়ে বেরিয়ে এলো ঈশানী,তখন থেকেই শুয়ে বসে দিন যাচ্ছে ওর। নতুন করে চাকরি পাওয়ার যে মোটেও চেষ্টা চালায়নি তেমনটা নয়, কিন্তু আজকাল কার দিনে পার্ট টাইম চাকরি পাওয়াই যেখানে স্বপ্নের মতো ব্যাপার, সেখানে এতো জলদি ফুল টাইম চাকরি কেইবা দেবে ঈশুকে?

এরমাঝে অবশ্য কম ধকল যায়নি ঈশানীর উপর দিয়ে, জিসান সেদিন জিদের বশবর্তী হয়ে রোকেয়া বেগমকে সব বলে দেয় ফোন করে, যার ফলস্বরূপ ঈশানীর উপর দিয়ে বয়ে যায় একের পর এক মানসিক ঝড় । সকাল বিকাল কথা শুনতে শুনতে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মায়ের ফোন রিসিভ করাই বন্ধ করে দেয় ঈশানী, অতঃপর সেই থেকেই মা মেয়ের যোগাযোগ পুরোপরি বিচ্ছিন্ন। ওদিকে গত একসপ্তাহ ধরে জিসানের ও কোনো খোঁজ খবর নেই, যদিও জিসানের থাকা না থাকা খুব একটা ভাবায় না ঈশানীকে, তবে চাকরি ছেড়ে আসার পরে কয়েকদিন কল দিয়ে খুব জ্বালাতন করতো ছেলেটা, অথচ এখন পুরোপুরি নেটওয়ার্কের বাইরে। আশ্চর্য!
না চাইতেও জিসানের খবর জানার আগ্রহ জন্মে ঈশানীর মনে, কিন্তু অন্য মনের পুরোটা জুড়ে যে আরেকজনের দখলদারি সেটাকেই বা হটাবে কি করে ও?

গত দশদিনে এতোকিছুর মাঝেও একমূহুর্তের জন্য ও অরন্যকে ভুলতে পারেনি ঈশা। এই “না” ভুলতে পারাটাই ওর মনে বিশ্বাস হয়ে গেড়ে বসেছে, আগে দোটানায় পড়ে থাকলেও এখন আর সেটা নেই, এখন ঈশু নিশ্চিত যে অচেনা অজানা গভীর অভ্যায়ন্যের মাঝে একটুকরো টং ঘরের সেই নামহীন মালিককে ভীষণ ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে ও।
আজ এতোগুলা দিন পরেও তাকে দেখার আকাঙ্খায় ছটফট করে ঈশানী। মাঝেমধ্যেই মনে হয় এক্ষুনি বাস ধরে চলে যাই সেই নিষিদ্ধ জঙ্গলে, যেখানে সারিসারি দানবীয় গাছ, ভয়ঙ্কর জন্তু জানোয়ার, সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে ভয়ঙ্কর সুদর্শন একজন পুরুষের বসবাস।
যদিও সেটা আদৌও সম্ভব কিনা তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ঈশানীর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে, তবুও কল্পনা করতে কার না ভালো লাগে? তবে মাঝেমধ্যেই জিসানের বলা সেদিনের কথাগুলো হুটহাট আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দেয় ওর, নিজের অজান্তেই তখন মনে হতে থাকে,

—- জিসান হয়তো ঠিকই বলেছে আমি আসলে কারোরই মনের মতোন নই, আর নাতো আমি কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখি। আমাকে কি সত্যিই কখনো কেউ ভালোবাসবে না? কোনোদিন না?
ভীষন শঙ্কায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় ঈশুর, তবুও অরন্যকে ভুলতে পারেনা মেয়েটা।
সেই রাতের পর থেকে এখনো হাতের কাছে ফোন নিয়ে বসে থাকে ঈশানী, যদি আবারও ভুল করে কখনো ঈশানীকে মনে পরে যায় সেই নির্দয় পাষাণ মানবের? তখন নিশ্চয়ই কল আসবে। দ্বিতীয়বার কল আসলে ঈশানী কল ধরে নিশ্চয়ই খুব অভিমান করবে অরন্যর উপর। কিন্তু গত দশদিনে এমন কিছুই ঘটেনি আর। মায়ের সঙ্গে রাগ করে এতোদিনে হয়তো ফোনটাই বন্ধ করে দিতো ও, শুধু মাত্র একটা আন নৌন কলের অপেক্ষায় সেটা ও আর করার সাহস হয়ে ওঠেনি।

সকাল সকাল কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আকাশ পাতাল চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে ঈশানী, তখনই অসময়ে ঘ্যানঘ্যান আওয়াজে বেজে ওঠে বেয়ারা মুঠো ফোনটা। ঈশানী প্রথমে ভেবেছিল মা কল দিয়েছে, কিন্তু অচেনা নাম্বার চোখে পরতেই কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে গেলো ওর, মন গহীনে কোথাও একটা ধিরিম ধিরিম আওয়াজ তুলে লাফিয়ে উঠলো হৃৎস্পন্দন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দম আটকে আসবে, এই অসময়ে অচেনা নাম্বার থেকে কেই বা কল দিতে পারে অন্তর্মুখী ঈশানীকে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করে কানে তুললো ঈশু, তবে ইতিমধ্যে ওপাশের কন্ঠস্বর শুনে ঈশানীর বুঝতে বাকি নেই যে ওপাশের লোকটা ওর আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পুরুষটি নয় বরং জিসান।
জিসানের কন্ঠ শুনে কিছুটা শক্ত হয়ে এলো ঈশানীর চোয়াল,ওপাশ থেকে গলা খাদে নামিয়ে জিসান শুধালো,

—- কেমন আছিস ঈশা?
ঈশানী হ্যা না কিছুই না বলে ফোনটা কাটতে যাবে তখনই উদ্বিগ্ন কন্ঠে পুনরায় জিসান বলে ওঠে,
—- প্লিজ কলটা কাটিস না ঈশা, তোকে অনেক কিছু জানানোর আছে, তুই শুধু একটাবার আমার সাথে দেখা কর, তোকে আমি তোর অরন্যর আসল চেহারাটা দেখাতে চাই শুধু।
জিসানের কথায় রেগে গেলো ঈশানী, রাগে কটমট করে বললো,

—- আবার সেই একই কথা, তোর কি আমার পেছনে হাতধুয়ে পরে থাকা ছাড়া খেয়ে দেয় আর কোনো কাজ নেই?
—- প্লিজ ঈশু একটাবার আমাকে বিশ্বাস কর, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি, এই সত্যিটা জানা তোর জন্য ভীষণ জরুরি।
— তোর কাছ থেকে কোনো প্রকার সত্যি জানার প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই আমার, রাখলাম বায়।
এক নাগাড়ে কথা শেষ করে জিসানের মুখের উপরে কল কেটে দিলো ঈশা। তবে জিসানের কথাগুলো নিয়ে খুব বেশি ভাবনার সময় করে উঠতে পারলো না ও, তার আগেই দ্বিতীয়বারের মতো বেজে ওঠে মুঠোফোন, ঈশানী চোখ বুলিয়ে দেখলো নিঝুম ফোন করেছে, তাই কোনোরূপ দ্বিধাদন্দ ছাড়াই ফোন রিসিভ করে কানে তুললো এবার। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ভেসে এলো নিঝুমের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর,

— ঈশুরে তুই কোথায়?
দিন দুপুরে নিঝুমের হেয়ালি পনা মোটেই ভালো লাগছে না ঈশার, ও বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,
— বেকার মানুষ কোথায় আর থাকবো,বাসাতেই আছি।
এবার নিঝুমের কন্ঠস্বর আরও দৃঢ় হলো খানিকটা, ও ঈশুকে তাড়া দিয়ে বললো,
—- খবরদার বাসায় থাকিস না, এক্ষুণি কোথাও বেরিয়ে যা।
কপাল কুঁচকালো ঈশানী, গা ছাড়া ভাব ধরে বললো,
—- বেরিয়ে যাবো মানে? কি হয়েছে?
— আন্টি মানে তোর মা, একটু আগেই কল দিয়ে আমাদের বাসার এড্রেস নিলো, উনি চিটাগং এসেছেন তোকে কোন পাত্র পক্ষের সঙ্গে আলাপ করাবেন সেই জন্য। তোর আজ খবর আছে ঈশু, তাড়াতাড়ি ভাআআগ।
এতোক্ষণে হকচকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ঈশানী, কাঁপা গলায় তোতলাতে তোতলাতে বললো,

—- কি বলছিস, এখন এই সময় যাবো টা কোথায় আমি?
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— পাঁচ মিনিট পরে আমার ক্লাস টেস্ট, নয়তো বলতাম ক্যাম্পাসে চলে আয়, কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়, তাই আপাতত যেখানে খুশি চলে যা পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বাড়িতে গিয়ে না হয় সবাইকে মানিয়ে নিস, স্যার এসে গিয়েছে রাখলাম বায়।
হিসহিসিয়ে কি যেন বলে তাড়াহুড়ো করে কল কেটে দিলো নিঝুম।এদিকে ঈশানী পরেছে মহা বিপদে, মনে মনে ভাবছে,

—- মা এখানে এলে নির্ঘাত চেচামেচি করে ফ্ল্যাট মাথায় তুলবে, তার উপর পাত্র পক্ষ এক মহা ঝামেলা। এর চেয়ে আজকের দিনের জন্য কোথায় গা ঢাকা দেওয়াটা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।কিন্তু হুট করে যাবোটা কোথায়?
দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ঈশু, এমন সময় আবারও কল আসে জিসানের নাম্বার থেকে। ভবঘুরে ঈশানী আনমনেই মোবাইলটা কানে তোলে এবার। ঈশানী ফোন রিসিভ করতেই জিসান তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,
—- প্লিজ ঈশানী কল কাটবি না, এটাই শেষবার, শুধু একটাবার আয় সত্যিটা নিজ চোখে দেখে যা, তারপর আর কক্ষনো জ্বালাবো না আমি তোকে, প্রমিস। তবুও শেষ বারের মতো প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কর, সত্যিটা তোর জানা খুব দরকার। প্লিজ ঈশানী না করিস না।
এতোক্ষণে থমকালো ঈশানী, কি এমন সত্যি জানানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে জিসান? তাও আবার সাবজেক্টটা অরন্য, মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে ঠিকই কৌতুহলী হয়ে ওঠে ঈশানী। তাছাড়া এখন বাসা থেকে বের হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি, তাই আর এতোকিছু না ভেবে জিসানের কথায় সায় জানিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পরে ও।

জিসানের টেক্স করা ঠিকানা মোতাবেক এসে, রিকশা ভাড়া মিটিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে ঈশানী দেখলো এটা একটা বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু এখানে কি এমন সত্যি জানাবে ছেলেটা?
ঈশানী যখন কৌতুহলী হয়ে এদিকে ওদিক দেখছিল ঠিক তখনই পেছন থেকে সশব্দে ডেকে ওঠে জিসান,
—- ঈশা!

জিসানের ডাকে পেছনে ঘাড় ঘোরালো ঈশানী,এবং পেছনে ঘুরতেই চোখের সামনে যা দেখলো তাতে আশ্চর্যের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো ও। জিসানের হাত পা সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মা’রের ক্ষত, কিছু কিছু যায়গায় অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো, দেখে মনে হচ্ছে খুব বাজে ভাবে মে’রেছে কেউ, কিন্তু কে করলো জিসানের এই অবস্থা?কেইবা মা’রলো ওকে?
ঈশানীকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর নিকট এগিয়ে আসে জিসান, জিসান এগিয়ে এলে ঈশানী শুধায়,
—- তোর এই অবস্থা কেন? কোথায় ছিলি এতোদিন?
— সব বলবো, তার আগে চল।
এই বলে ঈশানীর দিকে একটা বাসের টিকিট এগিয়ে দেয় জিসান। টিকিটটা হাতে নিয়ে আরেক দফা অবাক হলো ঈশানী, ভ্রুজুগল কুঁচকে কিছুটা ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,

—- চল মানে? কোথায় যাবো? তুই না বললি কি সত্যি জানাবি?
—- খাগড়াছড়ি, ওখানে গেলেই সবটা সত্যি জানতে পারবি তুই, এখন দেরী না করে দ্রুত চল।
কথা শেষ করে ঈশাকে আর প্রশ্ন করার কোনোরূপ সুযোগ দিলোনা জিসান, একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে টেনে নিয়ে গেলো বাসের কাছে। অজ্ঞাত ঈশানী না চাইতেও আজকের দিনটা কোনোমতে পার করার জন্য উঠে পরলো বাসে। গন্তব্য সবুজে ঘেরা স্মৃতি বিজারিত সেই একই পার্বত্যঞ্চল খাগড়াছড়ি।

দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা রাতের পর্দা টেনেছে ধরনী, পূর্ণিমা রাত, আকাশে রূপোর থালার মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপোলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ, সেই আলোতেই জংলা বনবিচুডি পাছে হটিয়ে, হাতে সরু একটা লাঠির সাহায্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জিসান, ওর পিছু পিছু সাবধানে এগিয়ে আসছে ঈশা, কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাটঁতে বিরক্ত ঈশানী, তার উপর এমন স্যাত স্যাতে বনে হাঁটতে হাঁটতে শরীরের মধ্যে কেমন কুটকুট করছে ওর, একপর্যায়ে এসে বিরক্তিভাব দমাতে না পেরে থেমে গেলো ঈশানী,কোমরে হাত দিয়ে নাকটা সিকোয় তুলে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো ,
—- আর কতদূর, আমি আর এই জঙ্গলের মধ্যে হাটতে পারছি না।
—–হুশশশশ!

তৎক্ষনাৎ সচকিত হয়ে পেছনে ঘুরে আঙুলের ঈশারায় ঈশানীকে চুপ করি দেয় জিসান, অতঃপর আঙুল তাক করে কিছু একটা দেখতে বলে ওকে। জিসানের আঙুল বরাবর লক্ষ্য করতেই ঈশা দেখলো জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙাচোরা শ্যাওলা পড়া পুরাতন কংক্রিটের ঘরের মধ্যেখানে সুক্ষ্ম আলো জ্বলছে, তারমানে ওখানে কেউ আছে।
সামনের দৃশ্যপট দৃষ্টিগোচর হতেই এতোক্ষণের ক্লন্তিভাব, বিরক্তি সবকিছু একমূহুর্তের জন্য ভুলে গেলো ঈশানী, এই মূহুর্তে ওর সচকিত মস্তিষ্কে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু,
— কে আছে ওখানে? কিইবা সত্যি দেখাতে এতদূর নিয়ে এলো জিসান?
কিছুক্ষণ তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করার পরে, পুনরায় সাবধানে পা টিপেটিপে একেবারে শ্যাওলা ঘরটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলো ওরা। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে কিছু মানুষের চাপা আর্তনাদের আওয়াজ শোনা গেলো। দেওয়ালের কাছে একটুকরো ভাঙা জানালার আড়াল থেকে বাল্বের আলোয় ভেতরের মানুষ গুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আরেকটু ভালোভাবে দেখার জন্য জিসান একটু সরে গিয়ে ঈশানীকে কিছুটা সামনে এগিয়ে দিলো, এবার সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ঈশানী,

ঘরের ভেতরে পাঁচ ছয়জন আধম’রা লোক নতজানু হয়ে হাটু গেড়ে বসে আছে একটা লোকের সামনে, তাদের প্রত্যেকের শরীর ক্ষ’তবিক্ষত সেই সাথে র’ক্তাক্ত। তাও সকলের মুখে শুধু একটাই বুলি
—- দয়া করে আরেকটা সুযোগ দিন।
তাদের ঠিক সামনে কাউচের উপর গা এলিয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে হাতে রিভলবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ব্ল্যাক স্যুট পরিহিত একটা লোক, সামনে আর্তনাদ করতে থাকা লোক গুলোর জন্য তার চেহারাটা স্পষ্ট নয় ঈশানীর কাছে। তবে কাউচে বসা লোকটার ঠিক ডান পাশেই রিভলবার হাতে নিয়ে সটান দাড়িয়ে ব্ল্যাক স্যুট পরিহিত আরও একজন। লোকটা দেখতে ইয়াং,কতইবা বয়স হবে ত্রিশ বত্রিশ।
কাউচে বসা লোকটা, কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা, দু’জনার কারোরই হেলদোল নেই এতোগুলো লোকের আর্তনাদে। একটু পরেই কাউচে বসা লোকটার গমগমে আওয়াজ শোনা গেলো শুধু ।

—- ওদেরকে বলে দাও তুষার, এরীশ কখনো সেকেন্ড চান্স দেয়না, ওটা আমার ডিকশনারিতেই নেই। প্রাইথন প্যারাডাইসে বিট্রেয়ার দের গন্তব্য একটাই, দ্যাট ইজ “হেল”। আর বিশ্বাসঘাতক দের এরীশ সেটা দুনিয়াতেই দেখিয়ে দেয়।
ভেলভেটের মতো মসৃণ তার কন্ঠস্বর, অথচ কথার পারদে পারদে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার মতোই হিং’স্রতা।
এরীশের কথার পাছে তুষার অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে ওঠে ,
— এরা একেকজন ডেনিয়েলের বিশ্বস্ত সব স্পাই, এদেরকে আর বাচিয়ে রেখে লাভ নেই, সব কটাকে মে’রে ফেলুন এরীশ। বাকিটা গার্ডরা সামলে নেবে।

তুষারের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের নতজানু লোকগুলো পুনরায় হাউমাউ করে হাত জোর করে কেঁদে উঠলো, তাদের আর কিচ্ছু চাইনা শুধু একটু বাঁচার আকুতি, জীবনে আর একটা সুযোগ, আর কিচ্ছু নয়,কিচ্ছু নয়।
অথচ লোকগুলোর কান্নাকাটির মাঝেই একে একে রিভলবার গুলো লোড করে ফেললো হার্টলেস মাফিয়া বস এরীশ, এরপর হিসহিসিয়ে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে কয়েকটা আওয়াজ বের করলো মুখ থেকে,
—- এরীশ কখনো সেকেন্ড চান্স দেয়না। জাস্ট গো টু হেল।

ব্যাস, এরপর পায়ের উপর পা তুলে আরামসে বসে একেরপর এক ট্রিগার প্রেস করে কীটপতঙ্গের মতোই একে একে ঝাঁজরা করতে লাগলো সবগুলো স্পাই এর বুক। মূহুর্তের মধ্যে বারুদ আর র’ক্তের তীক্ষ্ণ গন্ধে ভরে উঠলো জায়গাটা। অত্যন্ত ক্রোধের সাথে গু’লি চালানোর ফলে, একপর্যায়ে স্পাই গুলোর বুক থেকে বের হওয়া র’ক্ত ছিটকে এসে আঁচড়ে পরলো ঈশানী চোখেমুখে,সেইসাথে ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হলো ভীষন প্রিয় পিয়ার্সিং করানো সুদর্শন অথচ হিং’স্র মুখশ্রীখানা। সঙ্গে সঙ্গে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো ঈশানী,
—- অরন্যওওওও

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৭

তৎক্ষনাৎ শক্ত হাতে ওর মুখটা চেপে ধরে জিসান।কয়েক মূহুর্তে ,মাত্র কয়েক মূহুর্তের মধ্যে ঈশানীর নিথর শরীরটা এলিয়ে পড়ে জিসানের কাঁধে।
কিন্তু ততক্ষনে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে।কারণ ইতিমধ্যেই এরীশ ইউভানের পূর্নদৃষ্টি আকর্ষণ করে নিয়েছে আগন্তুক দু’জন মানব মানবী।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৯