আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৯
suraiya rafa
শুনশান নিস্তব্ধ নিরিবিলি চারিপাশ,ভীষণ যাতনায় দুলছে পৃথিবীটা, ফাঁকা মস্কিষ্ক, র’ক্তরঞ্জিত দগদগে হৃদয় আর রিভলবার থেকে বের হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বু’লেটের মিছিল, ব্যাস মূহুর্তেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে কান্না হাহাকার যন্ত্রনা আর লা’শের গন্ধ। ঠিক তার উপর দাঁড়িয়ে দক্ষ শুটারদের মতোই একহাতে গান চালাচ্ছে অসম্ভব সুদর্শন অথচ হৃদয়হীন ভালোবাসার মানুষটা, কি তার আসল পরিচয়? কিইবা তার নাম? অরন্য নাকি এরীশ! বুলেটের মতোই এই বিষাক্ত প্রশ্নটা মাথায় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে আচমকা দু’চোখ খুলে ফেললো ঈশানী।
চোখ খোলা মাত্রই ভীষণ যন্ত্রনায় টনটন করে ওঠে ওর মাথা, যেন কেউ হাতুড়ি পেটা করে যাচ্ছে অনবরত। চোখের সামনে দৃশ্যপট এখনও স্পষ্ট নয়, সবকিছু ধোঁয়াসা কেমন যেন দুলছে দুনিয়াটা, যতক্ষণে চোখের ঘোলা দৃষ্টি স্পষ্ট হলো ততক্ষণে ঈশানী বোধ করলো এটা ওর দু’কামরার চিটাগং এর সেই ফ্ল্যাট নয়, বরং অন্য কোনো জায়গা।
যুদ্ধের পরমূহুর্তের মতোই চারিদিকে শান্ত, নিরিবিলি, হিমশীতল ঠান্ডা পরিবেশ বিরাজমান। মাথার উপর বিস্তৃত নান্দনিক কারুকাজ করা সফেদ সিলিং, তার ঠিক মাঝখানে ঝুলছে কয়েক তলা বিশিষ্ট দামীয় ঝাড়বাতির বহর। পুরো রুমটা রাজকীয় প্যালেসের মতোই সুন্দর আর সুসজ্জিত। সম্পূর্ণ মেঝেতে বিছানো হয়েছে মখমলের নরম গালিচা অথচ এতোবড় কক্ষে ঈশু ব্যাতীত আর একটা মানুষের উপস্থিতি পর্যন্ত নেই। কি আশ্চর্য!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতেই আস্তে করে উঠে বসে ঈশানী, কি জানি মাথাটা এখনো কেমন চক্কর দিচ্ছে বারেবারে, রুমের এক সাইডে বিশাল ওয়াল মিরর টাঙানো, কিছু একটা ভেবে বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওয়াল মিররের সামনে দাড়ালো ঈশানী। দেখলো, ওর পড়নে ছেড়া চুড়িদার যা গতকাল রাতে জঙ্গলের ডালপালায় লেগে ছিড়ে গিয়েছিল,উসকো খুসকো চুল, পাংশুটে মুখশ্রী,মহাসমুদ্রের মতো গাঢ় নীল চোখ দুটোর সৌন্দর্যটুকুও আজ উবে গিয়েছে কোথায় যেন। ফর্সা লাস্যময়ী মুখটা শুকিয়ে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে আছে, মুখের আশেপাশে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই ঈশানী দেখতে পেলো কাল রাতের শুকিয়ে যাওয়া র’ক্তের দাগ, এতে কত মানুষের র’ক্ত লেগে মরচে ধরে গিয়েছে তা ভাবতেই গা গুলিয়ে বমি চলে এলো ঈশুর।
এতোক্ষণ ধরে নিজেকে আয়নার সামনে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই ঈশানী আচানক বোধ করলো কাল রাতটা মিথ্যে ছিল না। তারমানে কোনো কিছুই স্বপ্ন ছিলনা?চট করেই সচকিত হয়ে ওঠে ওর মস্তিষ্ক, একে একে মনে পরে যায় কাল সন্ধ্যা রাতের সকল স্মৃতি, মানস্পটে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভালোবাসার মানুষটির নিষ্ঠুরতম বর্বরতা,নতুন করে শুরু হয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। এতো বড় সত্যিটা মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বারের মতো পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় দু’হাতে চুল খামচে ধরে চিৎকার করে মেঝেতে বসে পরে ঈশানী, কাঁদতে কাঁদতে একাই বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
—- তারমানে কিছুই স্বপ্ন নয়, সব সত্যি, সবকিছু সত্যি।ও আসলে অরন্য নয়, মাফিয়া বস এরীশ। জিসান ঠিকই বলেছিল এরীশের মতো মানুষরাই সুইট ডেমোন। যারা আমাদের আশেপাশেই ভালো মানুষ সেজে ঘুরে বেড়ায় অথচ আমরা তাদের মুখোশের আড়ালের আসল চেহারাটা ধরতেই পারিনা। কিন্তু তার মতো একটা অপবিত্র মানুষকে কিভাবে আমি এতোটা ভালোবেসে ফেললাম? হায় খোদা আমি যে পবিত্র।
আবারও হৃদয় বিদারক এক অসহায় চিৎকার বেরিয়ে আসে ঈশানীর বুক চিঁড়ে ।আপসোস আর হৃদয় ভাঙার চোরাবালিতে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে ঈশানী,শুধু মনে হচ্ছে কেউ পেছন থেকে ছু’রিকাঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে ওর বুকের ভেতরটা। মেঝেতে ঝুঁকে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঈশানী আবারও বলে ওঠে,
—- সবাই ঠিকই বলে আমি যতই আত্নবিশ্বাসী হওয়ার ভান ধরে থাকিনা কেন, আসলে ভেতর থেকে আমি একটা বোকা, সত্যিকারের বোকা। যার এই নিষ্ঠুর দুনিয়া সম্মন্ধে কোনো ধারণাই নেই। জিসান ঠিকই বলে কিচ্ছু জানিনা আমি, কিচ্ছুনা।
জিসানের কথা বলতে বলতে হুট করেই ঈশানীর মনে পরে গেলো জিসান কাল রাতে ওর সাথেই ছিল, তাছাড়া এই জায়গাটাও তো ভারী অচেনা। অগত্যাই কান্নাকাটি বাদ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাড়ালো ঈশানী, ভেতর ভেতরে শঙ্কা জেগেছে ওর, এরীশ ইউভান এতো সহজে ওদের ছেড়ে দিলো? ছেড়ে যখন দিলোই তাহলে জিসান কোথায়? আর ওই বা কোথায় আছে এখন?
নিজের অবস্থান জানার জন্য এবার জলদি ছুটে গিয়ে কক্ষের বাইরে পা বাড়ালো ঈশানী, তবে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ব্ল্যাক স্যুট পরিহিত ফরেইনার গার্ড’স এসে আটকে দেয় ওকে। এমন দানবীয় দেখতে লোক গুলোর সঙ্গে কথা বলার সাহস হলোনা ঈশানীর, তাই ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে রুমের জানালার কাছে ছুটে যায় ও, ওটাকেই বহু কসরতে টেনে হিঁচড়ে খুলে বাইরের পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা চালায় কিছুক্ষন। জানালার পাশেই সরু করিডোর ঠিক তার থেকে কয়েক হাত দূরে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই শান্ত নদীর মতো চোখ দুটো আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে উঠলো ঈশানীর, চোখের সামনে যেন পুরো দুনিয়া দুলে উঠলো ওর,আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ, হা হয়ে যাওয়া মুখটা দু’হাতে চেপে ধরে নিজের অজান্তেই কয়েক কদম পিছিয়ে এলো ঈশানী, পিছু হাটতে হাটতে ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠে অস্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো ,
— এটাতো মাঝ সমুদ্র! তাহলে আমি এখানে কেন? কোথায় আছি আমি ?
চারিদিকে আরও একবার ভয়ে ভয়ে চোখ বোলালো ঈশানী, দেখতে দেখতে এতোক্ষণে খেয়াল করে বুঝতে পারলো আসলে তখন থেকে ওর মাথা ঘুরছে না বরং সমুদ্রের মাঝখানে হওয়ায় এই বিশাল আকৃতির বিলাসবহুল জাহাজটাই ঢেউয়ের তালে তালে বারবার দুলে উঠছে।
এই পর্যায়ে এসে ঈশানীর মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা লাগছে, এই মূহুর্তে জিসানের কথা তো দূরের থাক, নিজের জীবনটাই ওর কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। মূহুর্তের মাঝে জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যত, ভালোবাসা সবকিছু ভুলতে বসেছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে জীবনটা এখানেই থমকে যাবে , তীরহারা এই প্রকান্ড সমুদ্রের মাঝেই হারিয়ে যাবে নীল চোখের মেয়েটা, অগত্যা ঈশানী আর কোনোকিছু না ভেবেই একেবারে নির্দ্বিধায় ধপ করে বসে পরলো গালিচা বিছানো মেঝের উপর।
প্রচন্ত মানসিক ধাক্কায় ঈশানী হয়তো আবারও জ্ঞান হারাবে, ঠিক এমন সময়ে দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে আরেক দফা সচকিত হয়ে উঠলো ওর মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ আস্তে করে ঘাড় ঘোরালো ঈশানী, দেখলো বড় বড় পা ফেলে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে মাফিয়া বস টা। দেখতে সব সময়ের মতোই স্টাইলিশ, ভ্রুতে পিয়ার্সিং, হাতে পাইথন খচিত ট্যাটু,ব্রেসলেট, অধর তলার কালো তিল সবকিছু এখনো বিদ্যমান, পরনে সেই ব্ল্যাক স্যুট,ঠিক ওর মনের মতোই কালো আর কুৎসিত ।
কি জানি কি হলো এরীশকে দেখা মাত্রই এতোক্ষণ ধরে ভেতরে ভেতরে চাপা পরে থাকা ক্রোধান্বিত সত্তাটা হঠাৎ করেই জাগ্রত হয়ে উঠলো ঈশানীর মাঝে, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে দৌড়ে গিয়ে হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো এরীশের উপর। নরম দু’হাতে ওর শার্টের কলারটা শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
— নিষ্ঠুর, মিথ্যাবাদী,প্রতারক তুই একটা খু”নী, তোকে আমি পুলিশে দেবো।
ঈশানীর কথায় মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসলো বোধ হয় এরীশ।
এরীশের পেছনেই দু’জন মহিলা সার্ভেন্ট হাতে কিছু জামা কাপড় আর খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ও হাতের ইশারায় তাদেরকে চলে যেতে বললে সার্ভেন্ট গুলো তাড়াহুড়ো পায়ে জায়গা ত্যাগ করে।ঈশানী এখনো চিল্লাপাল্লা করেই যাচ্ছে। কি বলছে, কাকে বলছে কিচ্ছু মাথায় নেই ওর।
—- জিসান কে কি করেছিস, ওকে ছেড়ে…
বাক্যটুকু আর শেষ করতে পারলো না ঈশানী, তার আগেই এরীশের শক্ত হাতের চপেটাঘাতে ঘুরে ছিটকে পরলো মেঝেতে।
ঈশানী সরে যেতেই এরীশ এদিক ওদিক ঘাড় ফুটিয়ে নিজের সিল্কি চুলের ভাঁজে আঙুল চালাতে চালাতে বলে ওঠে,
— আইশ,দিস ইজ টু মাচ, এরীশ ইউভানের কলারে হাত দেওয়ার সাহস হলো কি করে তোমার?
থাপ্পড়ের আঘাতটা এতোই জোরে ছিল যে ঈশানীর ঠোঁট কেটে র’ক্ত বেরিয়ে এসেছে,তবুও নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। হুট করে প্রেমিক পুরুষের এহেন হিং’স্ররূপ মেনে নেওয়া কষ্টকর, ঈশানীও নিজেকে বিশ্বাস করিয়ে উঠতে পারছিল না কিছুতেই,তাইতো সহসা পেছনে ঘুরে আহত গলায় এরীশ কে ডেকে উঠলো ও,
—- অরন্য।
ঈশানী ডেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কদমে এগিয়ে এসে ওর সামনে একহাঁটু ভাজ করে বসে ঈশানীর চোয়ালটা শক্ত হাতে চেপে ধরে গর্জে উঠলো এরীশ, চোখের মাঝে একরাশ আক্রোশ ধরে রেখে দাঁতে দাঁত পিষে গম্ভীর গলায় বললো,
—- অরন্য নয় এরীশ, গ্যাঙস্টার এরীশ ইউভান। যার মধ্যে দয়ামায়া, করুনা,ভালোবাসা,দূর্বলতা কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। আমাকে এই ইনোসেন্ট ব্লু আইস দেখিয়ে কোনো লাভ হবেনা, কারণ আমার কোনো দূর্বলতা নেই আ’ম হার্টলেস।
এরীশের হাতের বাঁধন ছিল পাথরের মতোই শক্ত আর কঠিন। যেন মনে হচ্ছে ঈশানীর নরম তুলতুলে চোয়ালটা এক্ষুনি ভেঙে বেড়িয়ে আসবে, তবুও কাঁদতে কাঁদতে ঈশানী বলে ওঠে,
—- কেন ধরে এনেছেন আমাকে, কি ক্ষতি করেছি আপনার? আর আমার বন্ধু কোথায়?
কয়েক সেকেন্ডের জন্য এক টুকরো ক্রুর হাসি খেলে গেলো এরীশের ঠোঁটের আগায়, এর পরক্ষনেই আবার তা মিলিয়ে গেলো কাঠিন্যতার আড়ালে অতঃপর আগের মতোই শক্ত গলায় এরীশ বলে উঠলো,
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না, তোমার বন্ধুকে তুমি তখনই দেখতে পাবে যখন চুপচাপ আমার কথায় রাজি হবে।
—ক..ককি কথা?
ভয়ে ভয়ে শুধালো ঈশানী।
এরীশ ওর চোয়ালটা ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে ওঠে,
—-তোমাকে আমি প্র’স্টিটিউড বানাবো, আমার মাফিয়া ক্লাবের সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ স্লাট হবে তুমি। ইউ নো হোয়াট আই মিন।
এরীশের কথা শুনে মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো ঈশানীর।সমগ্র দুনিয়াটা যেন মাত্রই ওলোট পালোট হয়ে গেলো চোখের সামনে, সরল সহজ অবুঝ হৃদয়টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গুড়িয়ে গেলো এক পলকে। সামনের নিষ্ঠুরতম মানুষটার ধূসর বাদামী চোখে নিজের নীলাম্বর চোখ দুটো রেখে অকস্মাৎ ঈশানী উপলব্ধি করলো, এরীশ শুধু খারাপই নয় ও আসলে একটা হৃদয়হীন জানোয়ার।মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই নেই ওর মাঝে, কিচ্ছু না। দিশেহারা ঈশানী তখনই এরীশের মুখের উপর প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে চিৎকার করে উঠলো আবারও,
—- অসম্ভব। আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে এটা বলার? অসভ্য, নিষ্ঠুর পাষাণ লোক আমাকে ওইসব অপবিত্র জিনিসের সঙ্গে তুলনা করতে একবার ও বুক কাঁপলো না আপনার?
পুনরায় ওর অন্য গালে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে চড় বসালো এরীশ। এবার থাপ্পড়ের আঘাতে টাল সামলাতে না পেরে খাটের এককোণে লেগে কপালটাই কেটে গেলো ঈশানীর, এক কথায় পুরো মুখমন্ডল র’ক্তাক্ত ওর।
এতোটা আ’ঘাতের পরেও সামনের দিকে ঝুকে ঈশানীর গলা চে’পে ধরে এরীশ বলে উঠলো,
—- তোমার কি করে সাহস হলো এরীশ ইউভানের সামনে এভাবে কথা বলার ? হাউ ডেয়ার ইউ টু টক লাইক দ্যাট? তোমাকে এই প্রত্যেকটা কথার মূল্য চোকাতে হতে পারে সেটাকি তুমি জানো? দ্বিতীয়বার আমার সামনে এভাবে গলা উঁচিয়ে কথা বলার স্পর্ধা দেখাতে এলে জিভ কে’টে ফেলবো আমি তোমার ।জিসানকে বাঁচাতে চাইলে চুপচাপ যা বলছি সেটাই মেনে নাও,এমনিতেও তুমি আর এই জায়গাটা থেকে বের হতে পারবে না, কোনোদিন না।
—- মে’রে ফেলুন আমাকে,এক্ষুনি মে’রে ফেলুন।এই যন্ত্রনা আর নিতে পারছি আমি।
কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে ঈশানী।
এরীশ নতুন উদ্যমে ঈশানীর নরম তুলতুলে সরু গলাটা চেপে ধরলো আবারও, অতঃপর দাঁত খিচিয়ে বলে উঠলো ,
—- তুমি কি বুঝতে পারছো না যে তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারোনা।বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমার চোখের সামনে তোমার বন্ধুকে তিলে তিলে মৃ’ত্যু দেবো আমি। আর তুমি নিশ্চয়ই এটা চাইবে না যে তোমার ছোট্ট একটা ভুলের কারণে বেচারা ইনোসেন্ট ছেলেটার প্রানটাই চলে যাক?
— নাহ!
আঁতকে ওঠে ঈশানী,পরক্ষণেই আবার ডুকরে কান্না শুরু করে দেয় মেয়েটা,কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো হাটুমুড়ে বসে কাতর গলায় বলতে আরম্ভ করে ,
—- কেন করছেন এসব?কি ক্ষতি করেছি আপনার, কোন ভুলের শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে? বলুন, আমিই কেন?
ঈশানীর কথার পাছে আবারও সেই গাঁ জ্বালানো কপট হাসি ফেরত দিলো এরীশ, ওর হাসিটা যতটা না বিরক্তিকর তার চেয়েও বেশি ভ’য়ানক, এরীশকে ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে দেখে ঘৃণায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ঈশানীর, যে চোখে খানিক আগেও অসহায়ের রাজত্ব ছিল সেই চোখে এখন আ’গুন ঝড়ছে মেয়েটার, এরীশ মুখমন্ডলে ক্রুর হাসিটা ধরে রেখেই শান্ত অথচ গভীর গলায় বললো,
— কৈফিয়ত চাইছো?
— হ্যা চাইছি।
কন্ঠে দৃঢ়তা টানলো ঈশানী।
এরীশ ওর হাতের বাঁধন দিগুণ শক্ত করে বললো,
— ইউ নো হোয়াট?কাউকে কৈফিয়ত কিংবা সেকেন্ড চান্স কোনোটাই দেয় না এরীশ । এ্যান্ড ইট উইল গন্না বি ফান,আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি,
i am not the Prince of your fairytale, I’m the monster of your nightmare.
আমি দয়ালু নই, তুমি যা ভেবেছো সেটাও নই, এই পৃথিবীতে আমার কোনো দূর্বলতা নেই, আর যার কোনোকিছুতে দূর্বলতা নেই তাকে কেউ কোনোদিন ভাঙতে পারেনা, কেউ না। শুনেছো তুমি? আই হ্যাভ নো ফাকিং উইকনেস।
সুতরাং আমার সামনে এসব ফেইক ইনোসেন্স দেখিয়ে কোনো লাভ নেই মিস ঈশানী তুজ কর্ণিয়া। তুমি আর এ জীবনে কখনো এই জায়গা ত্যাগ করতে পারবে না, এখান থেকে বেরোনোর সকল রাস্তা তোমার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দ্যাট’স হোয়াই এখন থেকেই একটা ভালো প্র’স্টিটিউট হওয়ার জন্য নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করো। চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো ড্রেস চেঞ্জ করে খাওয়া দাওয়া করে নাও।
কথাগুলো শেষ করে ঈশানীকে ছেড়ে দিয়ে চলেই যাচ্ছিল এরীশ, ঠিক তখনই পেছন থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো ঈশানী, কিছু একটা ভেবে মাথা উঁচিয়ে দৃঢ় গলায় বলে উঠলো ,
—- তোমার এই অহংকার তোমাকে সর্বশান্ত করে দেবে এরীশ ইউভান। একটা কথা ভুল বলেছো তুমি , এই পৃথিবীতে দূর্বলতা ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারেনা। তোমার মতো জানোয়ারেরও দূর্বলতা রয়েছে, হয়তো তুমি সেটা এখনো উপলব্ধি করতে পারছো না, তবে আজ না হয় কাল যখন তুমি তোমার দূর্বলতা ধরে ফেলবে তখন কোনো একদিন তোমার সেই দূর্বলতা তোমাকে ধ্বংস করে দেবে, ভেঙে গুড়িয়ে দেবে তোমার অহমিকার দেওয়াল, নিঃশেষ করে দেবে তোমার অস্তিত্ব , তোমার দূর্বলতাই হবে তোমার ধ্বংসের একমাত্র কারণ।
অত্যন্ত ক্রোধে কথাগুলো বলার সময় তিরতির করে কাঁপছিল ঈশানীর সর্বাঙ্গ। তবে ওর কথাগুলো কর্ণকূহরে পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেলো এরীশের ঠোঁটের সেই অদ্ভুত ক্রুর হাসি,তার বদলে সমগ্র মুখমন্ডলে এসে ভর করলো ভ’য়াবহ কাঠিন্যতা, চোখ দুটোতে জলজল করে উঠলো র’ক্তিম তেজস্ক্রিয়তা, যেন নিভে যাওয়া অঙ্গার ঘি এর প্ররোচনায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে মূহুর্তেই। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে থাকা ঠোঁট দিয়ে দুটো বাক্য উচ্চারণ করলো শুধু,
— আমার সাথে লাগতে এসোনা,ইউ ফাকিং বিচ!
ব্যাস, আবারও নিজের হাত দিয়ে ঈশানীকে আ’ঘাত করে বসলো এরীশ।
এরীশের শক্ত হাতের ধা’ক্কায় ছিটকে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়লো ঈশানী,তৎক্ষনাৎ ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেড়িয়ে এলো ওর নাক গলিয়ে, সমগ্র মুখমন্ডল র’ক্তা’ক্ত, দমটা এবার বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখনো মেঝেতে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে অবচেতন হওয়ার আগ মূহুর্তে নিজেকেই নিজে উপহাস করে হাসলো ঈশানী মনে মনে বললো,
—- আবেগ এখন নিয়ন্ত্রনে অথচ আমি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে।না জেনে, না শুনে দিন রাত একটা জানোয়ার কে ভালোবাসার শা’স্তি হিসেবে এটা তোর প্রাপ্য ঈশানী, হ্যা এটাই তোর প্রাপ্য।
ঈশানীর ঘর থেকে বেরিয়ে মাত্রই লাউঞ্জে ফিরেছে এরীশ, লাউঞ্জে ফিরে সর্বপ্রথম শরীরের ব্লেজারটা অন্য পাশে ছুড়ে ফেলে, টাইয়ের নটটা খানিক টানাটানি করে নিজের ব্যক্তিগত কাউচে মাথা এলিয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পরে সে।
ওকে বেশ ক্লান্ত আর নির্ঘুম দেখাচ্ছে। লাউঞ্জের এককোণে ছোটখাটো একটা বার কাউন্টার, তুষার এতোক্ষণ সেখানেই ছিল,তবে এরীশকে দেখা মাত্রই একটা রেড ওয়াইনের বোতল সমেত এগিয়ে এলো কাউচের দিকে। তখনও চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে আছে এরীশ। তুষার সবসময়ের মতোই বেশ দক্ষ হাতে এরীশের জন্য গ্লাস ভর্তি ওয়াইন সার্ভ করতে করতে বলে,
—- মিস ব্লু আইড অ্যাঞ্জেলের জ্ঞান ফিরলো তাহলে? আপনাকে দেখে হতাশ মনে হচ্ছে এরীশ।
তৎক্ষনাৎ চোখের পাতা খুলে ফেললো এরীশ,ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে নিয়ে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে সেটাকে পরখ করতে করতে বললো,
—- জাস্ট কিপ ইওর মাউথ শাট তুষার, হতাশা এরীশের ডিকশনারিতে নেই। লাইফ ইজ জাস্ট আ মাইন্ড গেইম, হয় জিতে গিয়ে পুরো দুনিয়াকে দেখিয়ে দাও,আর নয়তো তোমার হার দুনিয়া দেখার আগেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও। হতাশা ইজ নট মাই টাইপ।
ওয়াইনের গ্লাসে ছোট্ট একটা সিপ নিয়ে তুষারের দিকে ঘাড় বাঁকালো এরীশ, যে এই মূহুর্তে এরীশকেই সার্ভ করায় ব্যস্ত। ইভেন ও নিজেও এটা ভালো করেই জানে, না বললেও তুষার ওর প্রত্যেকটা ইন্সট্রাকশনে ঠিক কতটা স্ট্রিক্ট, কারণ বিচক্ষণতার দিক দিয়ে এরীশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তুষার।
” তুষার জাওয়াদ” এরীশ ইউভানের ডান হাত। পাইথন প্যারাডাইসের সেকেন্ড লিডার, যার জীবনের মিশন আর ভীশণ শুধু একটাই জীবন দিয়ে হলেও পাইথন প্যারাডাইস আর এরীশ ইউভানকে রক্ষা করে যাওয়া। বয়সের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এরীশ আর তুষার সমবয়সী,তবে স্বভাবের দিক দিয়ে দুজনার বৈশিষ্ট্য বেশ আলাদা, এরীশ যেমন হুটহাট রেগে গিয়ে চারিদিকে ধ্বং’সযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে এক সেকেন্ড ও ভাবেনা,তুষার মোটেই তেমন নয়।পরিস্থিতি অনুকূল হোক কিংবা প্রতিকূল সকল অবস্থাতেই তুষারের মুখ ভঙ্গিমা থাকে একই রকম, উত্তেজিত নয় বরঞ্চ ঠান্ডা মাথায় কৌশলে শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করতে পারদর্শী তুষার।এরীশ হার্টলেস এটা সবাই জানে, তবে তুষারের মন মস্তিষ্কে কখন কি চলে তা ঠিকভাবে অনুমান করা দ্বায়।এক কথায় হি ইজ আ মাস্টার মাইন্ড।
—- মেয়েটাকে কি করবেন?
তুষারের অকস্মাৎ প্রশ্নে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো এরীশ,পায়ের উপর পা তুলে আরেক দফা ওয়াইনে চুমুক দিয়ে জবাবে বললো,
— ও আমাদের কোটি কোটি টাকা এনে দিতে পারবে।
—- আই নো দ্যাট, ওই জন্যই সেদিন মে’রে ফেলতে বারণ করেছিলাম, আপনিতো জঙ্গলের মধ্যে টং ঘরে নিয়েই খেল খতম করে দিতেন।
তুষারের কথায় কিছু একটা ভাবলো এরীশ পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে বললো,
—- হ্যা, কারণ আমি ভেবেছিলাম ও ওই স্পাই গুলোর মধ্যে একজন, নয়তো আমার রেসট্রিক্টেড এরিয়াতে এতো সহজে একটা মেয়ে ঢুকে পরলো।ইউ নো, দ্যাট নট সো ইজি।
— টোটালি মিরাকল। বাট ওর দামটা এখনো আন কাউন্টেবল।
কথাটা বলে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তুষার।
এরীশ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন ভেবে, চট করেই চোখ খুলে সচকিত হয়ে বলে উঠলো,
— ইউ নো হোয়াট তুষার, আমি এর আগে কখনো নীল চোখের বাঙালি মেয়ে দেখিনি। অলসো শী ইজ ভার্জিন।
তুষার চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—- কিন্তু এতো সহজে মেয়েটাকে নিজের ডেরায় টেনে আনলেন কি করে?
কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাকিয়ে কপট হাসলো এরীশ, দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ইলেকট্রিকস সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়িয়ে বললো,
—- জোর জবরদস্তি, টানাহেঁচড়া, আরেকটা পুলিশ কে’ইস এগুলো আসলে আমার পছন্দ নয়, সো তুমি ভালো করেই জানো আমি কি করেছি।
—- হ্যা জানি ম্যানিউপুলেট জিনিসটা আপনি খুব ভালোই পারেন। বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট ইজ আওয়ার নেক্সট প্ল্যান?
এবারের শিরদাঁড়া সোজা করে বেশ মনোযোগী হয়ে বসলো এরীশ, হাতের ভেপটা সাইডে ছুড়ে ফেলে সামনের টি-টেবিল থেকে কুড়িয়ে নিলো আইপ্যাড খানা, সেটাকেই স্ক্রল করতে করতে তুষারের উদ্দেশ্যে বললো,
— নেক্সট টার্গেট উইল বি ব্লাড ডায়মন্ড, ইটস আ হিউজ প্রজেক্ট বি রেডি ফর দ্যাট।
এরীশের কথায় তীক্ষ্ণ ভাজ পরলো তুষারের কপালে, ও কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
— ব্লাড ডায়মন্ড, মানে র’ক্ত হিরক। কিন্তু সেটাতো এক পিস ই আছে, তাও আমাদের চরম শ’ত্রু ড্রাগন হান্টার গ্রুপের গড ফাদার ডেনিয়েল হ্যারিসনের কাছে, ডেনিয়েল এতো সহজে আমাদের সঙ্গে ডিল করবে বলে আপনার মনে হয়?
—- ইট’স নট আ ফাকিং ডিল,ইট’স আ মিশন। ব্লাড ডায়মন্ড আমার চাইই চাই।
এরীশের কথার জের ধরে তুষার আরও কিছু বলবে তার আগেই সদর দরজা খুলে লাউঞ্জে প্রবেশ করে ডেকের একজন তুচ্ছ গার্ড। কোনো এক অজানা কারণে ভীষণ হাঁপাচ্ছে গার্ডটা, লোকটাকে দেখে ভ্রু কুঞ্জিত করে সাইডে রাখা রিভলবারটা লোড করতে শুরু করে দিলো এরীশ,কারণ ও ভেবেছে অন্য কোনো শীপ থেকে হয়তোবা জ’লদস্যু আ’ক্রমন করেছে।
অথচ তুষার বেশ ঠান্ডা আওয়াজে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো,
—- হাঁপাচ্ছো কেন, কি হয়েছে।
— বস ম..মেয়েটা হুট করেই শীপ থেকে ঝাপ দিয়েছে।
ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে কথাটা বের করলো গার্ড।
এরীশ চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
— কোন মেয়েটা?
— নীল চোখের মেয়েটা।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রিভলবার সমেত লাউঞ্জ থেকে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো এরীশ, যেতে যেতে ফের তুষারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— গার্ডদের বলো জিসান ছেলেটাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসতে।
উত্তাল সমুদ্র, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু নীলাম্বর জলের আঁকাবাকা উর্মিমালা,দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই, এ যেন পৃথিবীর বাইরে নতুন আরেক পৃথিবী।
বিলাশবহুল এই জাহাজের ডেকের অংশটা একেবারে নিচে অবস্থিত, খানিকবাদে বাদে বিশালাকৃতির ঢেউ গুলো এসে ভিজিয়ে দেয় জায়গাটা, আপাতত ঈশানীকে উদ্ধার করে গার্ডরা ডেকেই দাঁড়িয়ে আছে,কারণ ইতিমধ্যে এরীশ চলে এসেছে ওখানে ।
এরীশ যখন ডেকের বাইরে পা রাখে তখন দেখতে পায় গার্ডদের কড়া পাহারার মাঝে দাঁড়িয়ে বুকের উপর দু’হাত ভাজ
করে রেখে ঠান্ডায় ঠকঠকিয়ে কাঁপছে ঈশানী।
ওর পড়নে সফেদ রঙা লং শার্ট আর জিন্স, যেগুলো আজ সকালেই মহিলা গার্ডরা ওকে পড়তে দিয়েছিল।পাতলা ফিনফিনে শার্টটা ঈশানীর গমরঙা ত্বকের মতোই কোমল আর হালকা, পানিতে ভিজে সেটা এখন ত্বকের সাথে মিশে গিয়ে পুরোপুরি আয়নাতে পরিনত হয়েছে,যদিও সেদিকে বিন্দু মাত্র নজর নেই এরীশের, তবে ঈশানীর শরীরের তীব্র কম্পন আর দাঁতের ঠকঠক আওয়াজটা ঠিকই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ও। ঈশানীর বেশভূষা দেখে এরীশ বেশ বুঝতে পারলো কোনোভাবে গার্ডদের বোকা বানিয়ে পালাতে চেয়েছিল ঈশানী। ওয়েট, পালাতে তো চায়নি, বরং ম’রতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা এখনো এটাই বুঝতে পারলো যে এরীশ ইউভানের অনুমতি এখানে ব্যাতীত কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়,এমনকি আ’ত্নহ’ত্যাও নয়।
ঈশানী কাঁপছে ঠিকই তবে ওর দু’চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, যেন মৃ’ত্যুই ওর এখান থেকে পরিত্রান পাওয়ার একমাত্র রাস্তা আর ও সেটার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
এরীশ ওর দিকে যতই এগিয়ে আসছিল ওর চোখের ক্ষুব্ধতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এক পর্যায়ে মুখোমুখি হয় দু’জন,দ্বিতীয়বারের মতো মিলিত হয় দু’জোড়া নেত্রপল্লব। একজোড়া গাঢ় নীল মনিযুক্ত চোখের গহ্বরে কঠিন দৃষ্টিপাত নিক্ষিপ্ত হয় আরেকজোড়া ধূসরবাদামী চোখের।
দু’জনার চোখেই আ’গুন ঝরা হিং’স্রতা, এ যেন চোখের সঙ্গে চোখের স্নায়ু যু’দ্ধ। কিন্তু এই দ্বন্ধে ঈশানীকে তো হার মানতেই হবে, কারণ ওর প্রতিপক্ষ স্বয়ং এরীশ ইউভান।
এবং হলোও সেটাই, ঈশানীর দিকে কঠোর দৃষ্টি অভ্যহত রেখে হুট করেই ওর কপাল বরাবর রিভলবার তাক করালো এরীশ। না, তাতে ও ঈশানী ভয় পেলোনা, তবে এরীশের মাথায় সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু চলছিল যা ঈশানীর কল্পনার ও উর্ধে। ঈশানী তখনও নির্ভয়ে রিভলবারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মূহুর্তের মধ্যে রিভলবারটা ঈশানীর কপাল থেকে সরিয়ে নিয়ে নব্বই ডিগ্রী এ্যঙ্গেলে হাত ঘুরিয়ে মূমুর্ষ জিসানের বাম পা’টা কে পয়েন্ট করে ট্রিগার প্রেস করে দেয় এরীশ।
হঠাৎ গু’লির শব্দে সচকিত হয়ে উঠলো ঈশানীর মস্তিষ্ক, ও ঘুরে দাড়িয়ে দেখতে পেলো জিসানের বাম পা থেকে অঝোর ধারায় র’ক্ত গড়িয়ে পরছে। তার মানে গু’লিটা জিসানের লেগেছে।ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে গার্ডরা তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না জিসান, ক্রমশ পরে যাচ্ছে হাটু ভেঙে।
জিসানের এহেন অবস্থা থেকে আপনা আপনি মুখের উপর হাত চলে গেলো ঈশানীর। ও তৎক্ষনাৎ দৌড়ে যেতে চাইলো জিসানের কাছে, তবে তার আগেই গার্ড’স রা ধরে ফেললো ঈশানীকে, অযাচিত ঈশানী এবার এরীশের সামনে গিয়ে দাড়ালো,কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
— কি চাইছেন টা কি আপনি? জিসান কে কেন এভাবে আ’ঘাত করছেন, আমার সাথে শ’ত্রুতা থাকলে আমাকে মে’রে ফেলুন। ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন?
এরীশ নতুন উদ্যমে রিভলবার লোড করতে করতে বললো,
—- আওয়াজ নিচে, আগেও বলেছি এখনো বলছি ওকে একমাত্র তুমিই বাঁচাতে পারো। আর না হলে,
একটু থামলো এরীশ, অতঃপর কিছু একটা ভেবে বললো,
— আমি এবার ওর ডান পায়ে একটা গু’লি করবো, আর তারপর…..
এরীশ কথা শেষ করার আগেই ঈশানী চোখ খিঁচে ভেজা স্যাঁত স্যাঁতে লোহার পাটাতনের উপর হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পরলো, অপারগ ঈশানী দু’হাটুর উপর শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আহত কন্ঠে বলে উঠলো,
—- কি করতে হবে বলুন, আমি সব করবো, তবুও দয়া করে জিসান কে ছেড়ে দিন,প্লিইইজ।
যদিও জিসান কথা বলার অবস্থাতে নেই, তবুও ঈশানীর এহেন আত্নসমর্পণে হকচকিয়ে উঠলো ও।
এরীশ একটা হার্টলেস ব্লাডিবিস্ট, ও পারেনা এমন কিছুই নেই, তা জানা সত্বেও কি করে এতো সহজে হার মেনে নিলো ঈশানী, কেনইবা নিলো? ভাবছে জিসান।
ওদিকে ঈশানীর কাকুতি মিনতি শুনে বেশ খুশি হলো এরীশ। কেউ যখন ওর কাছে হাত জোর করে কাকুতি মিনতি করে, জীবন ভিক্ষা চায় সেটা ও ভীষণ এনজয় করে,কারণ এটাই ওর ন্যাচার। মানুষকে কষ্ট দেওয়া অ’ত্যাচার করা তাদের ওপর নিজের অবাধ কতৃত্ব ফলানোটা এরীশের কাছে ভ্যালু অব পাওয়ার ছাড়া আর কিছুই না।
সমুদ্রের মাঝে ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে, রোগা পাতলা ঈশানীকে জোর হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেলো বলে, অথচ ও একই ভাবে এরীশের সামনে হাটু ভেঙে বসে আছে, অপরাধ বোধ ওকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, মনে মনে ভাবছে,
—- শুধু মাত্র আমার ভুলের জন্য জিসান এতোটা কষ্ট পাচ্ছে। ওর তো কোনো দোষ নেই তাহলে ও কেন আমার জন্য এতোটা শাস্তি ভোগ করবে? এটা আমি হতে দিতে পারিনা, কিছুতেই না।নিজের জীবন দিয়ে হলেও জিসানকে আমার বাঁচানো উচিৎ।
ঈশানীর ভাবনার ছেদ ঘটে এরীশের প্রস্তাবে,
— যা বলছো, ভেবে বলছো তো?
— হ্যা
ছোট্ট করে জবাব দেয় ঈশানী।
— ওকে ফাইন।
নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বলেই ঈশানীর কব্জিতে হ্যাঁচকা টান মে’রে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয় এরীশ, অতঃপর তুষার কে উদ্দেশ্য করে বলে,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৮
—- ওকে প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাংলাদেশের যে কোনো একটা বন্দরে ফেলে রেখে আসবে।
তৎক্ষনাৎ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে কানে এয়ারপড লাগাতে লাগাতে কোথাও একটা চলে যায় তুষার।
আকস্মিক তীব্র জ্বরে ঈশানীর দৃশ্যপট পুরোপুরি ঝাপসা, ঝাপসা নিভু নিভু চোখে ও শুধু দেখতে পেলো জিসানকে ওরা টেনে হিঁচড়ে ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।অথচ ঈশানীর হাতটা এখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে এরীশ, ওর মনে হচ্ছে এখনো হাত না ছাড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে এরীশের বুকেই ঢলে পরবে ও।তবে ঈশানী খুব করে চাইছে এটা না হোক। কিন্তু কথায় আছে না “অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়” ঈশানীর সঙ্গেও তেমনটাই হলো,
ভাবনার কিছুক্ষনের মধ্যেই কাঁপুনি দিয়ে ওঠা তীব্র জ্বরের তোপে চেতনা হারিয়ে নি’ষ্ঠুর মাফিয়া বসটার বুকের উপরেই ঢলে পরলো ঈশা।