আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৪
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
মেঘ ঠোঁট উল্টে বলল,
“ইসসস, এত জোরে কেউ গাট্টা দেয়? মাথাটা ব্যথা হয়ে গেছে। ”
আবির কোমল কন্ঠে বলে,
” তুই ভালোবাসার ভাগ চাইছিস। কম করে কিভাবে দেয় বল!”
“গাট্টামারা ভালোবাসা আমি চাই নি৷ ”
আবির হঠাৎ ই মেঘের দিকে কেমন করে চাইল, উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“তো কেমন ভালোবাসা চাইছিস?”
মেঘ দরদ মাখা কন্ঠে বলল,
” আপনাদের মতো আমিও ফুপ্পির সাথে দেখা করতে চাই, গল্প করতে চাই, ফুপ্পির যত্ন পেতে চাই। ”
“ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম অন্য কিছু। ”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“অন্য কিছু মানে?”
“কিছু না৷ এখন ফুপ্পির বাসায় তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না৷ তোকে নিয়ে আমি বা তানভির যে কেউ বের হলেই হাজার টা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তারথেকে কিছুদিন শান্ত থাক৷ আমি দেখছি কি করা যায়৷”
মেঘ আস্তে করে শুধালো,
“জান্নাত আপুকে আসতে বলছিলেন কেন?”
“দরকার আছে৷ আচ্ছা বল তো, জান্নাতের সঙ্গে আম্মুর কথা হয়ছিল? আম্মুর রিয়েকশন কি?”
“কথা হয় নি আবার! বড় আম্মু পাশের সোফায় বসে খুব সুন্দর মতনে আপুর সঙ্গে কথা বলছেন। বড় আম্মু তো অনেকদিন যাবৎ জান্নাত আপুকে আপনার বউ বানাতে চাচ্ছেন । আপনারা কেন বলছেন না যে আপুর বিয়ে হয়ে গেছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এটা বলে দিলে তো মজাটায় শেষ।”
“মানে”
“জানতে পারবি খুব শীঘ্রই। আর হ্যাঁ মুখ ফস্কে জান্নাতের বিয়ের কথা বলে দিস না যেন।”
“আমি এত বেক্কল না৷ ”
আবির হেসে বলল,
“I know that you are the smartest girl in the world.
মেঘ ফিক করে হেসে ফেলল। আবির ভাইয়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেছে।
সময় ধাবমান। জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারিতে পা দিয়েছে। তীব্র ঠান্ডা অনেকটা কমে এসেছে। মেঘদের ক্লাস শেষ হয়েছে সবেমাত্র পাঁচ মিনিট হলো। বন্যা আর মেঘ গল্প করতে করতে দুজনে হাত ধরে হাঁটছে। তামিম দৌড়ে এসে বন্যার পিছনে দাঁড়িয়ে বন্যাকে ডাকে,
“এই বন্যা ”
বন্যা শুনেও না শুনার মতো হাঁটতে থাকে৷ তামিম এবার বন্যা আর মেঘের সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্যা, মেঘ দুজনেই থমকে দাঁড়ালো। মেঘ তামিমের মুখের পানে তাকালেও বন্যা তাকায় নি, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তামিম অভিযোগের স্বরে বলল,
“বন্যা, তুই আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলিস না কেন?”
“কারণ টা কি তোর অজানা?”
“এতদিন হয়ে গেছে এখনও ঐ বিষয় নিয়ে পরে আছিস। চলতে চলতে কারো প্রতি ইমোশন আসতেই পারে, তোর প্রতিও আসছিল তাই আমি তোকে আমার মনের কথা বলছিলাম। তুইও তোর মতামত জানিয়েছিস এবং আমি তা মেনে নিয়েছি। তুই না করছিস এরপর কি আমি তোকে কোনো প্রশ্ন করছি বা জোরাজোরি করছি? তুই রিজেক্ট করছিস বলে এই না যে আমি মরে যাব। কিন্তু তার প্রভাব বন্ধুত্বের উপর কেন পড়বে বলতো! তারপরও আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। প্লিজ বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুবাদে হলেও আমায় ক্ষমা করে দে।”
বন্যা কিছুটা ভারী কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা”
এরমধ্যে মিনহাজ ও এগিয়ে আসল। তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কিরে, তোরা এখনও এখানে ”
তামিম প্রশ্ন করে,
“তুই কোথায় গেছিলি?”
“নেতারা আসছে। ওনাদের সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সুবাদে ওনারা একটা পোগ্রাম করবে শুনলাম। ভার্সিটির পাশাপাশি ঢাকার সুনামধন্য কলেজের স্যাররা, বড় বড় অবস্থানে থাকা ব্যক্তি বর্গরাও সেই পোগ্রামে আমন্ত্রিত থাকবে৷”
বন্যা বলল,
“ভালো কিন্তু তুই ঐখানে কি করতে গেছিলি?”
“এমনিতেই। নেতাদের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। ওনাদের সাথে পরিচয় থাকা ভালো। রাজনৈতিক পাওয়ার থাকবে, যেকোনো সমস্যায় সাহায্য পাওয়া যাবে। তাছাড়া সাধারণ সম্পাদক আমার রুমমেট। মেঘ বলছিল না, ওর আবির ভাই নাকি আমাদের আধমরা করে বাড়ি পাঠাবে। আর কিছুদিন ওয়েট কর দেখবি আমার কত পাওয়ার হয় !”
বন্যা মেঘের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“দেখছিস মেঘ, তোর আবির ভাইয়ের ভয়ে নেতাদের পিছু নিচ্ছে।”
পুনরায় মিনহাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” নিজের নাই দুই আনা ক্ষমতা আবার ভাব দেখায় ষোল আনার। সেদিন যেভাবে বলছিলি ভাই ব্রাদার্সের পাওয়ার দেখাবি, তখন তো ভাবছিলাম তোদের এলাকার ভাইদের কথা বলছিস। ”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,
“এজন্যই বলি আমার আবির ভাই সবার সেরা। তোদের মতো ৮-১০ জনকে পে*টানো আমার আবির ভাইয়ের কাছে জাস্ট ৫ মিনিটের ব্যাপার। ওনার কাউকে প্রয়োজন নেই, একায় ১৯৯ জনের সমান। ”
তামিম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“১৯৯ জনের সমান কিভাবে হয়? হলে ১০০ জনের সমান হবে।”
” আমার আবির ভাই একটু ব্যতিক্রম তাই ১৯৯ জনের সমান।”
“এটা কেমন লজিক? ”
“এটা আমার লজিক তোরা বুঝবি না। ”
মিনহাজ তপ্ত স্বরে বলল,
“শুন, কথায় কথায় আমার আবির ভাই, আমার আবির ভাই করিস না। কানে খুব লাগে”
“তোর কানে লাগে এটা তোর কানের সমস্যা। তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখা গিয়ে। আমি আমার আবির ভাই ই বলবো। আমার আবির ভাই, আমার আবির ভাই, আমার আবির ভাই। ”
মিনহাজের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। মিনহাজ রাগে অন্যদিকে তাকিয়েছে। অকস্মাৎ মেঘদের দিকে চেয়ে বলল,
“এই সাইড দে, ভাই রা আসতেছে। ”
বন্যা, মেঘ, তামিম সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রায় ১৫-২০ জন ছেলে হেঁটে আসছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়রদের সালাম দেখেই তাদের অবস্থান বুঝা যাচ্ছে। মেঘদের কাছে আসতেই মিনহাজ সুন্দর করে সালাম দিল,
সামনের দিকের গম্ভীর চেহারার একজন চোখ দিয়ে একটু ইশারা করল৷ সালাম গ্রহণ করেছে এটায় বুঝালো। ওনারা পাশ কেটে যেতেই মেঘ বলল,
“কিরে তোর ভাই তো সালামের উত্তর টাও দিল না।”
মিনহাজ বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
“ওনার কি এত মানুষের সালামের উত্তর দেয়ার সময় আছে নাকি৷”
২ মিনিট পরেই কিছুটা দূর থেকে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে। মেঘরা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে ছেলেগুলো কাকে ঘিরে কথাবার্তা বলতেছে। কাকে ঘিরে আছে তা দেখা যাচ্ছে না। কৌতুহল বশতই মেঘ, বন্যা, মিনহাজ, তামিম সবাই সেদিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন একটু সরতেই বাইকটা সাইড করে হেলমেট খুলল।
মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আবির ভাই। ”
বাইকটা দেখেই পরিচিত লাগছিল। কিন্তু সিউর ছিল না। হেলমেট খুলতেই মেঘের চোখ কপালে উঠে গেছে। বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা পিটপিট করছে। মেঘ ভার্সিটিতে ভর্তির পর থেকে আবির মেঘকে নিতে বা দিতে আসলে মেইনগেইটের কাছেই নামিয়ে দেয়। কখনও ভিতরে আসে না। আজ ই প্রথম আবির ভিতরে আসছে। মেঘের সাথে সাথে মিনহাজ, তামিম, বন্যাও বেশ অবাক হয়েছে আবির বাইক থেকে নামতেই সভাপতি, সহ সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক একে একে সবাই আবিরকে জরিয়ে ধরছে। আবিরও স্নেহের সহিত সবাইকে জড়িয়ে ধরছে। মেঘ, বন্যা সহ বাকিরাও কিছুটা এগিয়ে গেল। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। মেঘ বার বার চোখ কচলে তাকাচ্ছে। আবির ভাইয়ের ভার্সিটিতে কেউ পরিচিত আছে, এটা মেঘ জানতোই না। তাও আবার রাজনৈতিক ছেলেপেলের সাথে ৷ রাগী, গুরুগম্ভীর স্বভাবের ছেলেটা হাসিমুখে বলল,
“Thanks Vaiya, তুমি আমাদের কথা মেনে এত ব্যস্ততার মধ্যেও আসছো এটায় অনেক। আমরা তো ভাবছিলাম তুমি হয়তো আসবেই না।”
” তোরা যে এত বছর পরও আমায় স্মরণ করেছিস সেই অনেক বড় ব্যাপার। ”
“তোমাকে কি ভুলা সম্ভব? কলেজের হিরো ছিলা তুমি৷ স্যারদের চোখের মনি সেই সাথে পুরো কলেজের মেয়েদের ক্রাশ বয়। ”
শেষ লাইনটা কানে যেতেই মেঘ সাপের মতো ফোঁস করে ওঠলো ৷ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় আবিরের দিকে। আবির ভাইয়ের আশেপাশে ২-১ টা মেয়ের নামই সহ্য করতে পারে না৷ সেই আবির ভাই নাকি কলেজের সব মেয়ের ক্রাশ ছিল। আল্লাহ জানেন কত মেয়ে প্রেমের প্রপোজাল দিয়েছেন আর কত মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়িয়েছেন। মেঘ নিজের কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে বলল,
” মেঘরে তুই শেষ, হাজারো মেয়ের ক্রাশ ওনি, সেখানে তুই কে? তোর দিকে কোনো ছেলে ফিরেও তাকায় না, ক্রাশ তো বহুদূরের বিষয়। তুই আবার আবির ভাইকে চাস। ছিঃ লজ্জা লাগে না ? আবির ভাই যে বোন হওয়ার সুবাদে তোর সাথে দু-একটা কথা বলে সেই তোর কপাল।”
বন্যা মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” কি বিড়বিড় করছিস? ”
মেঘের চোয়াল অকস্মাৎ ঝুলে পরল। মনের ঘর মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে ৷ শক্ত কন্ঠে বলল,
“কিছু না”
আবির ছেলেটার হাতে চাপড় মেরে বলে,
” বাজে কথা বাদ দে। হঠাৎ আমায় স্মরণ করার কারণ কি?”
আরেকজন বলে উঠলো,
” তুমি আমাদের স্পেশাল গেস্ট তাই স্মরণ করেছি। অবশ্য তোমায় মালা দিয়ে বরণ করা উচিত ছিল। আচ্ছা সমস্যা নেই, পোগ্রামের দিন অবশ্যই মালা দিব।”
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“এই থাম থাম, আমায় বরণ করবি মানে? আমি কে?”
“তুমি আমাদের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। যার জন্য আমরা আজ এই অবস্থানে। ”
“আমার জন্য না । বরং তোরা নিজের অবস্থান নিজেরা তৈরি করেছিস৷ ”
” যখন পথভ্রষ্ট হয়ে গেছিলাম তখন রাস্তা তো তুমিই দেখিয়ে দিয়েছিলে।”
“আচ্ছা বুঝলাম৷ কিন্তু পোগ্রাম টা কিসের?”
“ভার্সিটিতে লাস্ট একটা পোগ্রাম করতে চাচ্ছি।”
“প্রোগ্রাম করবি কর। আমার কি কাজ? আমি তো ভার্সিটির কেউ না, পড়িও নি এখানে”
“পড়ো নি তাতে কি? বাহিরে পড়তে না গেলে তুমি এই ভার্সিটির ই স্টুডেন্ট থাকতা৷ এখন কথা হলো, ভার্সিটির পাশাপাশি, আমরা আমাদের কলেজের স্যার- ম্যামদের ইনভাইট করতে চাচ্ছি। আর ইনভাইট তুমি করবা। তাছাড়া তোমাদের মতো সাকসেসফুল কিছু ব্যক্তিবর্গদের ও ইনভাইট করা হবে। তোমরা তোমাদের সুদর্শন চেহারা দেখিয়ে জুনিয়রদের সঠিক পথ দেখাবা। ”
“প্রথমত আমি কোনো সাকসেসফুল ব্যক্তি না। দ্বিতীয়ত আমি এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট না। তৃতীয়ত তোদের প্রোগ্রামে আমি স্যারদের ইনভাইট করার কে?”
“প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বুঝি না। তুমি আমার ভাই এটায় একমাত্র কথা। ভাই তো নাকি?”
“হ্যাঁ ভাই। তো?”
“তুমি তো আমাদের অবস্থা দেখেই গেছিলা। স্যাররা একপ্রকার বের করে দিচ্ছিল কলেজ থেকে। সেদিন তুমি স্যারদের রিকুয়েষ্ট না করলে আমাদের যে কি অবস্থা হতো আল্লাহ ভালো জানেন। তুমি চলে যাওয়ার পর আমরা যতদিন কলেজে ছিলাম, এমন একটা দিন যায় নি যে স্যাররা আমাদের সামনে আসলে তোমার নাম নেয় নি। তুমি না বললে আমাদের বের করে দিত, আরও কত কথা। সেসব এখন অতীত। তোমার কথামতো পড়াশোনা করে আমাদের ১২ টা বন্ধুর মধ্যে ৯ জন ই DU তে ভর্তি হয়েছি। বাকিরাও ভালো অবস্থানে আছে। তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি নেটওয়ার্কের বাহিরে ছিলা।
কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন তোমাকে একটা মেয়ের সঙ্গে দেখলাম। ডাকার সুযোগ ছিল না। অনেক খোঁজ নিয়ে জানতে পারছি তুমি তানভিরের ভাই। তারপর তানভিরের থেকে ফেসবুক আইডি নিলাম। আমার বা আমাদের জীবনের গল্পে তুমি অন্যরকম ভূমিকা পালন করেছো যার ঋণ কোনোদিন দিয়ে শেষ করতে পারব না। তাই তোমার পোগ্রামে আসতেই হবে।”
“বাবা গো! তোরা যেভাবে আমার প্রশংসা করছিস, আমার বাপেও আজ পর্যন্ত এত প্রশংসা করে নি।”
“তুমি যে কি চিজ, তোমার বাপে হয়তো বুঝেই নাই ”
আবির মৃদু হাসলো। আরেকজন বলে উঠল,
” ভাইয়া জানো, একই শহরে থেকেও গত পাঁচ বছর যাবৎ কোনোদিন কলেজে পা দেয় নি। স্যারদের দেখে মুখ লুকিয়ে চলছি৷ এখন তো ভার্সিটি লাইফ শেষ। দুদিন পর কে কোথায় থাকবো তা জানা নেই। তাই পোগ্রাম টা করতে চাচ্ছিলাম। ভার্সিটির স্যারদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওনাদের আপত্তি নেই৷ এখন তুমি আমাদের সাথে যাবে, আমাদের পক্ষ থেকে কলেজের স্যারদের একটু বলবা। আমরা বললে যদি না আসে, তুমি বললে নিশ্চয়ই রাজি হবেন। ”
আবির রুষ্ট স্বরে বলল,
“সবই করে দিব প্রয়েজনে পোগ্রামেও আসবো কিন্তু গেস্ট হিসেবে নয়। সাধারণ মানুষ আর তোদের ভাই হিসেবে। যদি কোনোপ্রকার মালা দিয়ে বরণ, আমায় নিয়ে ৫০০ শব্দের ভাষণ শুরু করিস। তাহলে একেকটাকে স্টেজে ফেলে পেটা*বো বলে রাখবাম।”
“তাই বলে আমাদের জীবনের গল্পের নায়কের প্রশংসা করব না?”
“না করবি না। আমি শুধু তোদের পথ দেখিয়েছি। বাকি সব তোরা করেছিস। তোদের সাকসেস তোদের এতে আমার কোনো হাত নেই। তোরা যে আমার কথা মনে রেখেছিস এতেই শুকরিয়া। এমনও মানুষ আছে যাদের জন্য জীবন দিয়ে দিলেও তারা সেসব ভুলে যায়। দোয়া করি জীবনে সাকসেসফুল হ।”
“দেখো তো! তোমায় রাস্তায় দাঁড় করিয়েই জীবন ইতিহাস শুরু করে দিয়েছি৷ চলো ভেতরে চলো।”
“ভেতরে আর যাব না। কথা তো হলোই। আমার নাম্বার রাখ। কবে কলেজে যাবি জানাইস। অফিসে কাজ ফেলে আসছি ”
“একদিন কাজ একটু কম করলে কিছু হবে না। কতবছর পর তোমাকে পেয়েছি। আড্ডা না দিয়ে ছাড়ছি না। চলো চলো।”
আবির ঘুরতেই মেঘদের দেখতে পায়। কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। আবির পেছন ফিরে থাকায় আগে দেখতে পায় নি। মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। ওদের সব কথোপকথন ই মেঘ মনোযোগ সহকারে শুনেছে। বুঝতে বাকি নেই ওদের পড়াশোনাতে আবির ভাইয়ের অবদান অনেকখানি। তবে সেই ছেলেগুলোর কি হয়েছিল তা শুনার বেশ আগ্রহ জাগছে মেঘের মনে। আবির কিছুটা এগিয়ে এসে মেঘের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ছোট করে শুধালো,
“ক্লাস শেষ?”
আবিরের কন্ঠে মেঘ হকচকিয়ে তাকাল, মনোযোগ ছিল অন্য কোথাও। উপর নিচ মাথা নেড়ে বলল,
“শেষ৷ কিন্তু আপনি এখানে কেন?”
মেঘ সব কথা শুনেও না শোনার মতো প্রশ্ন টা করেছে। আবির চোখের ইশারায় ছেলেগুলোকে দেখিয়ে বলল,
“ওদের সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম।”
ছেলেগুলো এগিয়ে গেছে, আবিরকে না পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই মেঘকে দেখল। দু কদম এগিয়ে এসে বলল, “ওনাকেই দেখেছিলাম তোমার সাথে। ওনি কে ভাইয়া? তোমার..”
আবির তার আগেই বলল,
“আমার কাজিন। তোরা যা আমি আসছি। ”
ছেলেগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। আবির মেঘকে উদ্দেশ্য করে গলায় তেজ এনে বলল,
“আড্ডা দেয়া শেষ হলে বাসায় যা। গাড়ি অপেক্ষা করছে।”
মিনহাজ আর তামিমকে দেখেও না দেখার মতো করে চলে যাচ্ছে। মেঘ পিছন থেকে ডেকে বলল,
” আমি আপনার সঙ্গে যাব। ”
অনেকদিন হলো আবিরের বাইকে ওঠে না। রাগারাগি, মান অভিমানে ঠিকমতো কথায় বলে নি বাইকে উঠা তো দূরের বিষয়। আজ মেঘের খুব ইচ্ছে করছে আবির ভাইয়ের সাথে বাইকে ঘুরবে। তাছাড়া ফুপ্পির জন্যও মনটা ছটফট করতেছে। সে প্ল্যান করেছে ফুপ্পিকে দেখে একেবারে বাসায় ফিরবে। আবির দু আঙুলে ইশারা দিতেই মেঘ আবিরের কাছে এগিয়ে গেল।
আবির প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,
“আমি না আসলে কি করতি?”
মিনহাজ আর তামিমের প্রতি ক্রোধ চেপে রাখতে পারছে না । ওদের দিকে তাকালেই অঘটন ঘটতে পারে তাই তাকাচ্ছে না।
মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিল,
“আপনি না আসলে গাড়িতে যেতাম। আপনি এসেছেন তাই বাইকে যাব।”
“আমি তোকে নিতে আসি নি। অন্য কাজে আসছি ”
মেঘ জেদ দেখিয়ে বলল,
“আমি এতকিছু জানি না। আপনি আমায় নিয়ে যাবেন এটায় শেষ কথা। ”
মেঘের জেদের কাছে আবিরের সুপ্ত ক্রোধ হার মানতে বাধ্য হয়েছে। আবির ক্ষীণ হাসলো। মেঘ জেদ দেখিয়ে কথা বললে, ওর নাক ফোলে যায়, গাল দুটা লাল টকটকে হয়ে যায়। দুধে আলতা চেহারায় রক্ত বর্ণের ছাপ ভেসে ওঠে, গলার দুপাশের দুটা রগ ফুলে ওঠে । মেঘকে এভাবে দেখলে আবিরের উদ্বেলিত হৃদয়ের কম্পন তীব্র হয়ে ওঠে। কল্পনার জগতে পাড়ি দিতে ইচ্ছে করে। রক্তাভ দুগালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বরাবরের মতোই সে অসহায়। নিজের অনুভূতি লুকাতে হয় প্রতিবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
“ব্যাপার না। অপেক্ষা করবো,
বিড়বিড় করে বলল, সারাজীবন”
আবির দু কদম এগিয়ে পিছন ফিরে আবার তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। এখানে তামিম, মিনহাজ আছে যাদের সহ্য হয় না। আবার মেঘকে নিয়ে ভেতরে যাবে সেখানেও প্রায় ২০-৩০ টা ছেলে আছে। কে কোন নজরে মেঘকে দেখবে এই চিন্তায় মেঘকে কিছু বলল না।
আবির চলে যেতেই বন্যা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মিনহাজ আর তামিমের দিকে তাকালো। মিনহাজ আর তামিম দুজনেই স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখের সামনে এতক্ষণ যা ঘটলো তার কিছুই বিশ্বাসযোগ্য না। নিজের চোখ, নিজের কান কোনোকিছুকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কোথায় ভেবেছিল ভার্সিটির নেতাদের ক্ষমতা দেখিয়ে মেঘদের সামনে একটু ভাব নিয়ে চলবে। উল্টো বড়সড় একটা বাঁশ খেলো। খেলো তো খেলো একদম মেঘদের সামনে। মেয়েরা মুখে প্রকাশ করুক বা না করুক, বেশিরভাগ মেয়েরায় দাপটি ছেলেদের পছন্দ করে। কেউ কিছু বললে ছেলেটা যেন মুখ লুকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান না নেয়। মেয়েটার সম্মান বাঁচাতে ছেলেটা যেন প্রতিবাদ করতে পারে। প্রতিনিয়ত আবিরের এত প্রশংসা শুনে মিনহাজ ও ভেবেছিল রাজনীতি করবে, নেতাদের পরিচিতি লাভ করে মেঘের মন জয় করে নিবে। কিন্তু আবির ক্ষণে ক্ষণে তার সব প্ল্যান ভেস্তে দিচ্ছে।
বন্যা ওদের অসহায় মুখের পানে চেয়ে থেকে হঠাৎ ই হাসি শুরু করেছে। হাসতে হাসতে মেঘের উপর হেলে পড়ছে। বন্যার স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দেখে মেঘও হাসলো। বন্যা কেন হাসছে এটা কারোর ই অজানা নয়। ২ মিনিট, ৫ মিনিট, ১০ মিনিট হয়ে গেছে বন্যা হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে গেছে তবুও বন্যার হাসি থামছে না।। মিনহাজ সহ্য করতে না পেরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“হইছে বইন থাম। এর বেশি হাসলে ম*ইরা যাইবি। ”
বন্যা হাসতে হাসতে বলল,
“তোর শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক বড় ভাইদের আমার সালাম দিস। সালামের পরে বলিস, তুই যে আবির ভাইয়াকে মা*রার হুমকি দিয়েছিস। আবির ভাইয়ার প্রতি তাদের যেই ভালোবাসা দেখলাম, আশা করি তারাই তোকে যোগ্য সম্মানী দিয়ে দিবে। ”
মিনহাজ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“আমি হুম*কি দিলাম কখন?”
“তোর ভাই ব্রাদার্সের পাওয়ার দেখাবি বলছিলি, মনে নেই? এত মন ভুলা তুই?”
“আচ্ছা বাদ দে।”
“এখন বাদ দিচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে এসব আকাশচুম্বী কথাবার্তা বললে তোর শ্রদ্ধেয় ভাইদের বলে দিব।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। ”
মেঘ এতক্ষণ যাবৎ ই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ইদানীং নিজের সাহস দেখে মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যায়। আবির ভাইয়ের মুখের উপর জেদ দেখালো, যদি আবির ভাই ভার্সিটির সবার সামনে থা*প্পড় মা*রতো, তবে কি হতো! ভাবতেই ভয়ে কেঁপে উঠছে। সবার সামনে থা*প্পড় খেলে মুখ দেখানোর অবস্থা থাকত না। আবির কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়িয়ে আসছে মেঘ বাসায় চলে গেলে হয়তো বেশিক্ষণ আড্ডা দিত কিন্তু মেঘকে বাহিরে রেখে গেছে তাই মাথায় চিন্তা কাজ করছে৷ এজন্য তাড়াতাড়ি চলে আসছে। মেঘকে ডাকতেই মেঘ এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আংকেল কি চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ৷ তুই না বললি বাইকে যাবি! তাই তো আংকেলকে চলে যেতে বলছি । কেন?”
“আপনার তো অফিস আছে। আমায় নিয়ে গেলে সময় নষ্ট হবে তাই বলছিলাম আমি গাড়িতে চলে যেতাম।”
“এটা আগে মনে হয় নি? তোর ভাইয়ের মতো রাগ উঠলে তোরও মাথা ঠিক থাকে না। তখন কিছু বুঝার অবস্থাতেও থাকিস না। ব্যাপার না, চল। ”
“আমি রিক্সা দিয়ে বাসায় চলে যায়?”
“মেজাজ খারাপ করিস না। চল বলছি।”
মেঘ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফুপ্পির বাসায় নিয়ে যাবে না আগেই বলছে এখন আবার ফুপ্পির কথা বললে নিশ্চিত মা-ইর খাবে। আবির একটা রিক্সা ঠিক করে বন্যাকে যাওয়ার জন্য ইশারা করল। তারপর মেঘকে নিয়ে চলে গেছে। বাইক চলছে কিন্তু মেঘ স্ট্যাচুর মত বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। আবির স্ট্রিট ফুড দেখে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে খাবে কি না। মেঘ শুধু না করেই যাচ্ছে। অবশেষে একটা ফুচকার দোকান দেখে বাইক থামালো। আবির শীতল কন্ঠে বলল,
“মাথাটা বোধহয় এখনও ঠান্ডা হয় নি। ফুচকা খেলে নিশ্চয় মাথাটা ঠান্ডা হবে।”
মেঘ মাথা নিচু করে বলল,
“আমি ফুচকা খাব না।”
“আমি মনে হয় ভুল শুনলাম”
মেঘ ঠান্ডা অথচ শক্ত কন্ঠে বলল,
“আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি ফুচকা খাব না।”
আবির হেসে বলল তাকা আমার দিকে, মেঘ ধীর গতিতে চোখ তুললো। তাকালো আবিরের চোখের দিকে,আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“ম্যাম,আপনি সত্যি সত্যি ফুচকা খাবেন না?”
আবিরের হাবভাব দেখে মেঘ না চাইতেও হেসে ফেলল। সে আবিরের ভয়ে ফুচকা খাবে না বলছিল, কিন্তু আবির ই তাকে বার বার উস্কাচ্ছে। মেঘ আবিরের মুখের পানে চেয়ে মনে মনে ভাবছে,
” আপনার মধ্যে কি এমন স্পেশাল গুণ আছে যা ক্ষনিকের ব্যবধানে রাগকে ভয়ে আবার ভয়কে জয়ে পরিণত করতে সক্ষম।”
আবির ভ্রু নাচাতেই মেঘ মৃদু হাসলো। ফুচকা অর্ডার দিয়ে বসে আছে। আবির মেঘকে দেখছে আবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। আবির হঠাৎ ই মুচকি হেসে বলল,
“তোকে আজ অনেক বেশি কিউট লাগছে”
মেঘ চোখ গোলগোল করে তাকালো। গলায় শ্বাস আঁটকে গেছে। ঠিক শুনছে নাকি ভুল! আবির ভাই মেঘকে কিউট বলেছে। ভাবা যায়! মেঘ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে তবুও স্বাভাবিক থাকার খুব চেষ্টা করছে। আবির পুনরায় বলল,
“নীল রঙটা তোকে খুব মানাচ্ছে৷ আগে বোধহয় কখনো নীল রঙের জামাতে দেখি নি।”
মেঘ এবার আরও বেশি লজ্জা পেয়েছে। চোখ দ্বিগুণ নামিয়ে নিয়েছে। আবির স্থির দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে৷ পলক ও ফেলছে না। তা বুঝতে পেরে মেঘ আরও তাকাতে পারছে না। গাল আর নাকের ডগা আবারও লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে লাল রঙের ব্লাশ লাগিয়েছে। মেঘ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে, সামান্য কিউট বলাতে যে কেউ এত লজ্জা পেতে পারে, এটা মেঘকে না দেখলে বুঝায় যেত না। মেঘ বার বার নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু চোখ তুলতেই পারছে না। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে তিরতির করে। মেঘের অবস্থা বুঝতে পেরে আবির দৃষ্টি স্বাভাবিক করে পুনরায় বলল,
“ফুপ্পিকে দেখতে যাবি?”
মেঘ এবার আশ্চর্য নয়নে তাকালো। তার মনের কথা আবির ভাই কিভাবে বুঝলো। মেঘের লজ্জায় রাঙা মুখ দেখে আবির ঢোক গিলল। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বলল,
” উফফফফ, আমার শান্ত মনটাকে উল্টেপাল্টে দিতে তোর লজ্জায় লালিত মুখটায় যথেষ্ট। তোকে এভাবে দেখলে বউ বউ ফিল পাই। কবে তোকে আমার করে পাবো? অপেক্ষার প্রহর যে ফুরায় না। ”
মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি ফুপ্পির সাথে দেখা করতে চাই?”
“তুই ই তো বলছিলি।”
“আমি সেই কবে বলছিলাম।তা কি এখনও মনে আছে?”
“তুই কবে কি বলিস সবই আমার মাথায় থাকে। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।”
“সবার কথায় আপনার মাথায় থাকে?”
“সবার কথা মানে?”
“যে যা বলে সবকিছু মনে থাকে?”
“না, প্রয়োজনের বাহিরে সবকিছুই ভুলে যায়”
মেঘ হুট করে বলে উঠল,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড কয়টা?”
মেঘের এমন প্রশ্নে আবির হকচকিয়ে উঠলো। থতমত খেয়ে বলল,
“মানে?”
“গার্লফ্রেন্ড চিনেন না? মেয়ে বন্ধু বা প্রেমিকা। ”
“তা বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?”
“শুনলাম কলেজের সব মেয়ের ক্রাশ ছিলেন। তাই আর কি”
আবির নিঃশব্দে হাসলো। মেঘের মনে হিংসা কাজ করছে এটা আবির বেশ বুঝতে পারছে। আবির জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আছে হাজার খানেক”
মেঘ চেঁচিয়ে উঠল,
“What!”
আবির দু’হাতে ইশারা দিয়ে বলল,
“Cool”
“ফাজলামো করেন আমার সাথে? সত্যি করে বলুন কয়জন? ”
“না বলা যাবে না। তুই সবাইকে বলে দিবি।”
“সত্যি বলব না।বলুন”
“গার্লফ্রেন্ড নেই তবে একটা গোলাপি কালার বউ আছে। ”
মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” থাকেন আপনার গোলাপি কালার বউ নিয়ে। দরকার হলে লাল, নীল, হলুদ বউ নিয়ে থাকুন। ”
মেঘ উঠতে নিলে আবির মেঘের হাত চেপে ধরে বসালো। তপ্ত স্বরে বলল,
“আমার লাল, নীলের প্রয়োজন নেই। গোলাপিটায় যথেষ্ট।”
“ফাইজলামি বন্ধ করুন। মেজাজ খারাপ হচ্ছে”
“কি আমার মেজাজ গো, তাও আবার একটু পর পর খারাপ হয়। আচ্ছা ঠিক আছে বন্ধ করলাম। তুই ও আমায় এমন প্রশ্ন আর করবি না। ”
“করলাম না এমন প্রশ্ন। ”
ফুচকা খেয়ে শেষ করে আবিরের সঙ্গে ফুপ্পির বাসায় আসছে। ফুপ্পি মেঘকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। সেই সঙ্গে বাসার সকলেই খুশি হয়েছে। আবির মেঘকে দূরে সরিয়ে রাখে বলে আবিরকে সবাই সবসময় বকা দেয়। ফুপ্পি তো বকেন, উল্টাপাল্টা কথা বললে মাঝে মাঝে গাট্টাও দেন৷ মেঘ ফুপ্পিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিয়ছেে। মেঘের কান্না দেখে ফুপ্পিও কাদঁছেন। মেয়ে মানুষের মায়া একটু বেশিই থাকে। ফুপ্পির কথা মেঘ যেদিন শুনেছে তার পর থেকে প্রতিরাতেই ফু্প্পির কথা মনে করে মন খারাপ করে, কখনও কখনও কান্নাও করে। মাঝে মাঝে ভাবে আব্বু, বড় আব্বু রাতে কিভাবে ঘুমান! ওনাদের কি বোনের কথা মনে হয় না?
মেঘদের কান্না দেখে আবির ভারী কন্ঠে বলল,
” তোমাদের চোখের পানিতেই দুদিন পর পর রাস্তাঘাটে পানি জমে যায়। এভাবে কান্নাকাটি করো বলেই মেঘকে নিয়ে আসি না। আজকেও যদি কাঁদো তাহলে আর কখনোই নিয়ে আসব না।”
দুজনের কান্নায় কমে এসেছে। আইরিন মজার ছলে বলল,
“ওদের কান্নায় যদি রাস্তায় পানি ওঠে, তোমার কান্নার কারণে নিশ্চয় বাংলাদেশে বন্যা হয়”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ। সামনের বন্যায় তোকে ভাসাইয়া দিব নে।”
“ইহহ। আমি সাঁতার পারি।”
“তাহলে তো আরও ভালো। সাঁতার কেটে শ্বশুর বাড়িতে যাবি আবার বাপের বাড়িতে আসবি।”
“কিসের শ্বশুর বাড়ি, কার শ্বশুর বাড়ি?”
আবির ফুপ্পিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ফুপ্পি তোমার মেয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু করছি।এই বর্ষার আগেই বিয়ে দিয়ে দিব।”
আইরিন আর্তনাদ করে উঠে,
“নাহ, কিসের বিয়ে? নিজের বিয়ের খবর নাই আমার পিছনে লাগছো! তুমি আগে বিয়ে করো। ”
আবির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আমি খবর পাইছি তুই জান্নাতকে খুব জ্বালাস। আমার বউকে জ্বালাবি না তার কি গ্যারেন্টি আছে? এজন্য তোকে বিয়ে দিয়ে তারপর ই বিয়ে করব।”
আইরিন জান্নাতকে জিজ্ঞেস করল,
“ভাবি সত্যি করে বলো, আমি তোমাকে জ্বালায়?”
জান্নাত এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে, হেসে উত্তর দিল,
“কখনোই না।”
আইরিন মেঘকে শুধালো,
“মেঘ আপু আমি কি তোমাকে জ্বালায়? ”
আবির মাথা নিচু করে জ্বিভে কামড় দিয়ে বসে আছে। মনে মনে বলছে, “এই মেয়েটা নিশ্চিত ফাঁসাবে।”
মেঘ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল,
“কই না তো। তুমি তো অনেক লক্ষ্মী মেয়ে”
এবার আইরিন আবিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“দেখছো আমি কাউকেই জ্বালায় না।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবির বলল,
“সেসব পরে দেখা যাবে। ফুপ্পি খুব খুদা লাগছে। দুপুরে খায় নি৷ খেতে দাও ”
জান্নাত বলল,
“আপনারা ফ্রেশ হোন। আমি এখনি খাবার দিচ্ছি।”
১-২ ঘন্টা গল্প করে মেঘকে নিয়ে বাসায় ফিরছে । রাস্তায় যেতে যেতে মেঘ হঠাৎ ই আবিরকে ডাকল,
” আবির ভাই”
“হুমমমমম ”
“আমাদের ভার্সিটির ছেলেগুলো কি আপনার কলেজের? ”
“হ্যাঁ। এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল ”
“ওরা আপনার এত প্রশংসা করছিল কেন। আপনি কি করছিলেন?”
“তুই কি সব শুনে ফেলছিস?”
“জ্বি”
“কলেজে থাকাকালীন একটু ঝামেলা হয়ছিল তখন স্যারদের কে রিকুয়েষ্ট করছিলাম। এই আর কি।”
“কি ঝামেলা সেটায় তো জানতে চাচ্ছি!”
“জানতেই হবে?”
“জ্বি”
“ওরা কলেজে ভর্তির পর কিছুদিন নিয়মকানুন মেনে চলছে, রেজাল্ট ও ভালো করছিল কিন্তু ৬ মাস পর থেকে কোথাকার কোন ছেলেদের সঙ্গে মিশে নে*শা করে একেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছিলো। পড়াশোনার অবস্থা নেই, নিয়ম মানে না, স্যারদের সাথে উগ্র আচরণ,পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করছে। সব মিলিয়ে স্যাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবকটার বাবা মাকে এনে অপমান করে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দিবে। আমি কয়েকজনের মাধ্যমে জানতে পারছি, ২-৩ জন বাদে সবগুলোর পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। বাবা- মা অনেক কষ্ট করে টাকা ইনকাম করে ঢাকা শহরে ছেলেকে পড়তে পাঠাইছে। আর এগুলো সঙ্গ দোষে নিজের জীবন ধ্বংস করছে। জানার পর নিজেরই কষ্ট লাগতেছিল। তারপর ওদের সঙ্গে কিছুদিন বসেছি। ওদের সবার গল্প শুনেছি, বুঝিয়েছি। তখন আমার ক্ষুদ্র মাথায় যা মনে হয়েছিল তাই করেছি আর কি । যখন দেখলাম ওরা আমার কথা একটু একটু মানতে শুরু করেছে তখন স্যারদের রিকুয়েষ্ট করলাম যেন পরবর্তী পরীক্ষা পর্যন্ত ওদের সময় দেয়। স্যারদের খুব আদরের স্টুডেন্ট ছিলাম বলে হয়তো স্যাররা মেনে নিয়েছেন৷ ৩য় সেমিস্টারে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছে। তারপর আমিও চলে গেছি ওদেরও খবর নেয়া হয় নি। ”
“বাহ!”
“কি?”
“আপনি খুব ভালো”
“ধন্যবাদ ম্যাম।”
আবির মেঘকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আবারও অফিসে চলে গেছে।
আজ ৭ ফেব্রুয়ারি। ভার্সিটিতে যেতেই নজর পরে অনেকেই গোলাপ হাতে ঘুরছে৷ কেউ কেউ বন্ধুদের দিচ্ছে, কেউ আবার বান্ধবীকে দিচ্ছে। মেঘ, বন্যা এসব ডে কখনো পালন করে না। মনেও থাকে না কবে কি ডে। হঠাৎ মিনহাজ একটা গোলাপ এনে মেঘকে দিয়ে বলল,
“Happy Rose Day”
বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটায় ফুল পাইছি রে৷ না হয় তোকেও দিতাম। এখন তোর বেবিকেই দেই। ”
মেঘ আশেপাশে তাকালো। হঠাৎ ই মাথায় ভূত চেপেছে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমি তোর থেকে গোলাপ নিব না, শুধু আবির ভাইয়ের থেকে নিব। বন্যাকে দিয়ে দে”
মিনহাজ না চাইতেও বন্যাকে দিল, কিন্তু বন্যাও নেয় নি। বরং উল্টো বলল,”তোদের থেকে ফুল নিতেও ভয় করে৷ কার মনে কি চলে তোরাই জানস”
মেঘ আজ তাড়াতাড়ি করে বাসায় চলে আসছে। ছাদ থেকে একটা লাল টকটকে গোলাপ এনে, সাথে একটা চিরকুট লিখে আবিরের রুমে রেখে আসছে।
আবির সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে দেখল টেবিলের উপর গোলাপ আর চিরকুট রাখা। এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। চিরকুট হাতে নিতেই দেখল,
চিরকুটে লেখা,
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৩
“আপনি মানুষটা রক্তিম গোলাপের মতন,
যার কাঁটার আঘাতে শতশত বার ক্ষতবিক্ষত হয়েও, তার মুগ্ধতার পিছনেই ছুটছি।”
Happy Rose Day Abir Vai
আবির ফুলটা হাতে নিয়ে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো। মুচকি হেসে বলল,
” আমার জীবনেও তুই রক্তিম গোলাপের মতন,
যাকে দেখলেই হৃদয়ে তোলপাড় চলে, প্রেমানুভূতি জেগে উঠে বার বার। খুব ইচ্ছে করে, গোলাপের প্রতিটা পাপড়ির ভাঁজে তোর আমার প্রণয়ের নিশান এঁকে দেয়। ফুলের রানী গোলাপের মতো তোকেও আবিরের মহারানী বানিয়ে রাখি৷ ”