আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৭

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৭
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

তানভিরের গান শুনে আবির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে৷ হেলমেটের আড়ালে আবিরের অভিব্যক্তি বুঝার উপায় নেই তবুও তানভির গান বন্ধ করে দিয়েছে। ফাঁকা রাস্তা, নিরিবিলি পরিবেশ, দুপাশে সারি সারি গাছ। আবির আচমকা একহাতে হেলমেট খুলে সাইডে রেখে গাইতে শুরু করল,
“এসেছি তোকে নিয়ে ফিরবো বলে
মনেরেই পথ চিনে আয়না চলে
তোর ছেড়ে জ্বর বুকে ছাড়ে না
পারছে তোকে ছাড়া না রে না”

আবিরের কন্ঠে গান শুনে তানভির আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। তানভিরের বাইকের গতি কমে গেছে। তানভির ভাবছিল আবির রাগ করবে অথচ আবিরও গান গাইছে। তৎক্ষনাৎ তানভির নিজের হেলমেট ও খুলে ফেলছে। বাইকের স্প্রীড বাড়িয়ে আবারও আবিরের সমান্তরালে গিয়ে আবিরের সমস্বরে গান ধরলো। অনেক টা পথ দু ভাই একের পর এক গান গাইতে গাইতে অবশেষে তানভিরের নানাবাড়ি পর্যন্ত চলে আসছে। বাইকের শব্দে মেঘ সহ বাকি কাজিনরাও বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসছে। তানভিরকে দেখেই মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে ডাকল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ভাইয়া”
“ইহহহ আসছে এখন ঢং করতে! ৭ দিনে একবারও ভাইয়ের কথা মনে হয় নি? নিষ্ঠুর কোথাকার! ”
মেঘ হেসে বলল,
“কেমন আছো ভাইয়া?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

তানভির বাকি কাজিনদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। কাজিনদের পছন্দ মতো খাবার নিয়ে আসছে তানভির, সেগুলোই সবাইকে দিচ্ছে। মেঘ মনের বিরুদ্ধে গিয়েও একবার পিছন ফিরে দেখলো আবির আসছে কি না! আবিরকে দেখতে না পেয়ে চিবুক নামিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। আবির ভাইকে বলার পরও আসলো না, ভাবতেই মেঘের মন বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। একটু সামনে এগুতেই পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে,
“কেমন আছেন, ম্যাম?”

সুপরিচিত প্রিয় কন্ঠস্বর মস্তিষ্কের সঙ্গে সঙ্গে অষ্টাদশীর হৃদয়কেও আন্দোলিত করেছে। মেঘ অকস্মাৎ পেছন ফিরে তাকাতেই সরাসরি নজর পরে আবিরের মলিন মুখমন্ডলে। নিজের প্রতি করা বেধক অবহেলা আবিরের চোখেমুখে লেপ্টে আছে। অষ্টাদশী নিষ্পলক চেয়ে থেকে খানিকক্ষণ পরখ করলো আবিরকে৷ আবিরের পরিশ্রান্ত চেহারা দেখে অষ্টাদশীর বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভব হলো। হৃদয়ের ক্লেশ উপেক্ষা করে মেঘ মাথা নিচু করে নিরেট কন্ঠে বলল,

“আলহামদুলিল্লাহ। ”
কথা টা বলতে দেরি হয়েছে অথচ মেঘের বাড়ির ভেতরে যেতে দেরি হয় নি। মেঘ ভেতরে চলে গেলেও আবির পূর্বের জায়গাতেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। এই কয়েকদিনের এলোপাতাড়ি চলাচলে আবিরের কাদম্বিনীর চেহারার লাবণ্য অনেকটায় কমে গেছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অযত্নে কাটছে তার প্রেয়সীর দিন। নানুবাড়িতে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই, হালিমা খান বকা দিলে মামারা, খালামনি, নানা নানু আহ্লাদে মেঘকে মাথায় তুলে রাখে৷ তাদের অতিরিক্ত আদরে এ কয়দিন খেয়ে না খেয়ে ছুটোছুটি করেছে।

আবির চোখ বন্ধ করে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে নানার রুমে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেঘের খালামনি আর দুই মামি নাস্তা নিয়ে আসছে। আবির, তানভিরের পছন্দ মতো পিঠা আরও অন্যান্য খাবার। হালিমা খান কয়েকবার এসে দেখে গেছেন। ওনি ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত৷ নাস্তা খেয়ে তানভির, আবির, আরও ২-৩ জন কাজিন মিলে ঘুরতে গেছে। সবার নানুর বাড়িতেই অপ্রকাশিত অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকে।

তানভির আশেপাশে ঘুরছে, ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে যারা বাড়িতে ছিল তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করেছে৷ তারপর বাড়িতে এসে হাতমুখ ধৌয়ে খেতে বসেছে। আবিরদের উদ্দেশ্যে দুই মামি মিলে এলাহি আয়োজন করেছেন। অবশ্য এত আয়োজনের পেছনে মেঘের ই হাত৷ ছোটবেলা আবির মেঘের নানুবাড়িতে আসছিল কি না তা মেঘ জানে না। মেঘের কাছে মনে হচ্ছে, এটায় আবিরের প্রথম আগমন।

নানুবাড়িতে আবির ভাইয়ের খাবারদাবারে যেন কোনোরকম ত্রুটি না থাকে তাই মেঘ নিজে সব লিস্ট করে দিয়েছে, রান্নার তদারকিও মেঘই করেছে৷ আবিরের পছন্দের তালিকার যতটুকু মেঘ জানে সবটাই করিয়েছে। বেশকয়েকটা রেসিপি মেঘ নিজেই রান্না করেছে৷ সঙ্গে তানভিরের পছন্দ মতো রান্নাও হয়েছে৷ সালাদ থেকে শুরু করে যা যা মেঘের পক্ষে করা সম্ভব সেসবই সে করেছে। ওরা আসতেই দেখা করে মেঘ লুকিয়ে পরেছে। একবারের জন্যও ওদের সামনে আসছে না । তানভির আবিরের সঙ্গে অন্যান্য কাজিনরাও খেতে বসেছে৷ তানভির আচমকা আবিরের দিকে তাকিয়ে ডাকল,

“ভাইয়া”
“কি?”
“আবেগে বেশি খেয়ে ফেলল না আবার!”
আবির আড়চোখে তানভিরের দিকে তাকালো৷ তানভিরের মুখে রহস্যময় হাসি৷ আবির ভ্রু গুটাতেই তানভির বিড়বিড় করে বলল,

“আমি খবর পেয়েছি, তোমার জন্য আজকে স্পেশালি আমার বোন নিজে হাতে রান্না করেছে৷ ”
আবির ভ্রু উঁচিয়ে ওষ্ঠ বেঁকিয়ে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তানভির মুচকি হেসে বলল,
” এভাবে আমায় না দেখে আমার বনুটাকে দেখলেও তো পারো।”
আবির গলা খাঁকারি দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” সময় হওক তখন দেখবি, তোর বোন ব্যতীত কোনো দিকে তাকাবোই না।”
তানভির নিঃশব্দে হাসলো সাথে আবিরও৷ খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো। মেঘ আর হালিমা খানও সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়েছে। মেঘের কাজিনরাও মেঘদের সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে আসছে। মেঘ তানভিরকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“ভাইয়া আমি তোমার সাথে যাব ”
তানভির সহসা জানাল,
“আমি তোকে নিতে পারব না।”
“কেনো?”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আব্বু কি বলছিল মনে নাই? আমি যেন তোকে নিয়ে বাইক না চালায়।”
মেঘ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

“কেনো? আমাকে নিয়ে চালালে কি হবে?”
তানভির আকাশের পানে তাকিয়ে বলল,
“আব্বুর আমাদেরকে নিয়ে টেনশন হয়, তুই আমি একসঙ্গে গেলে বাই চান্স এক্সিডেন্ট হলে আর আমাদের কিছু হয়ে গেলে কি হবে! সেই ভেবেই আব্বু ভয় পায়। তুই ভাইয়ার সঙ্গে যা, আমি আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছি। ”
” এক্সিডেন্ট করলে করব, মরে গেলে যাব৷ তবুও আমি তোমার সাথেই যাব!”
তানভির শক্ত কন্ঠে বলল,

“বনু। বাজে কথা একদম বলবি না। আমার কিছু হলেও সমস্যা নাই কিন্তু আমার কারণে তোর কিছু হলে আমাকে আব্বু মা*র্ডার করে ফেলবে।”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ওনার সাথে গেলে যে আমার কিছু হবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে?”
“গ্যারেন্টি আমি তোকে দিচ্ছি। কিছু হবে না তোর। ”
মেঘ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“তবুও তুমি আমায় নিয়ে যাবে না?”
“আব্বুর কথা অমান্য করলে আমায় বাড়িতে জায়গা দিবে না বইন। তুই কি চাস তোর এই হতভাগা ভাই টা অকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাক?”
মেঘ রাগে কটকট করে বলল,

“হয়ছে আর ইমোশনাল ব্যাকমেইল করতে হবে না। নিয়ে যাও আম্মুকে৷ আমিও বাসায় গিয়ে আব্বুকে বিচার দিব।”
তানভির হেসে আম্মুকে গাড়িতে বসতে বলল। হালিমা খান উঠতেই তানভির বাইক স্টার্ট দিল। এদিকে আবির এতক্ষণ যাবৎ কোনো কোথায় বলে নি৷ ওরা কিছুদূর যেতেই আবির বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
“কেউ কি আমার সঙ্গে বাইকে যেতে বিরক্তবোধ করছে?”

মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগ টা মাঝখানে রেখে ১ সেকেন্ডের মধ্যে বাইকে উঠে বসছে। আবির লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে প্রেয়সীর রাগান্বিত মুখবিবর দেখে মৃদু হেসে বাইক স্টার্ট দিল। মেঘের রাগ অতিসহজে কমবে না এটা আবির বেশ বুঝতে পারছে। মেঘের ছোট থেকেই এই স্বভাব। নিজের পছন্দের কোনো জিনিস কাউকে দিতে চায় না, এমনকি মীমকেও না। আর যদি কারো উপর রাগ উঠে তাহলে এত সহজে রাগ কমে না। কথা বললেও রাগে কটকট করতে করতেই বলে।

বড় হয়েছে ঠিকই তবে এখনও আগের স্বভাব ই আছে। তানভির ওর আম্মুকে নিয়ে অনেকটা সামনে চলে গেছে, ওদের আর দেখা যাচ্ছে না। আবির একটা চায়ের স্টল দেখে বাইক থামিয়ে দুকাপ চা নিয়ে আসছে। মেঘ প্রথমে নিতে না চাইলেও আবিরের জোরাজোরিতে নিয়েছে। আবির রাস্তার পাশে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে চা খাচ্ছে আর অভিভূতের ন্যায় মেঘকে দেখছে। রাগের কারণে মেঘের মুখ ফুলে আছে, থুঁতনিতে কেমন যেন ভাঁজ হয়ে গেছে৷ আবির চুল থেকে শুরু করে পায়ের কনিষ্ঠা আঙুল পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে করতে চা শেষ করল। টাকা পরিশোধ করে বাইকের কাছে এসে শান্ত স্বরে বলল,
“এখনও রাগ কমেনি তোর?”

“কিসের রাগ? আমার কারো উপর কোনো রাগ নেই। ”
“তা তোর চোখেই ভাসতেছে”
মেঘ চোখ তুলে তাকাতেই আবির মুচকি হাসলো। কিন্তু মেঘের চেহারা অপরিবর্তিত। মেঘ চিবুক নামিয়ে কর্কশ গলায় বলল,

” আপনি কি আমায় বাসা পর্যন্ত নিয়ে যাবেন?”
“যদি না নিয়ে যায়। তাহলে কি করবি?”
“বাস বা অন্য কিছু দিয়ে চলে যাব।”
“সত্যি? ”
“সত্যি। ”
“তুই আমায় একা ফেলে চলে যাবি?”
“আপনি তো আর অবুঝ না। যেভাবে এসেছেন সেভাবে বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন।”
আবির হঠাৎ ই দু আঙুলে মেঘের থুতনি উঠালো, আচমকা আবিরের স্পর্শে মেঘের দেহ শিউরে ওঠে। সহসা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। আবির গুরুতর কন্ঠে বলল,

“তাকা”
মেঘ নিভু নিভু চোখে তাকাতেই আবিরের গভীর নেত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে মেঘের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। এই এক জোড়া চোখ মেঘকে কি যেন বলতে চাচ্ছে, চোখের ভাষা বুঝার সাধ্যি ছোট্ট অষ্টাদশীর নেই তবে দৃষ্টির গভীরতা প্রখর তা বুঝতে সময় লাগে নি। ইদানীং আবিরের নজরের অস্বাভাবিকতা মেঘ প্রায় ই খেয়াল করে। মেঘ তাকালে, চোখে চোখ পরলেই নিজেকে কেমন যেন আড়াল করে নেয় আবির ৷ আজও আবিরের দৃষ্টি প্রখর। অষ্টাদশীর আঁখি জোড়াও আবিরের চোখে নিস্তব্ধ হয়ে আছে। পলক ফেলছে না কেউই।
আবির হঠাৎ ই নমনীয় কন্ঠে বলা শুরু করল,

“I am Sorry Megh. দিনকে দিন আমি মানুষটা বড্ড পাষাণ হয়ে যাচ্ছি, মাঝে মাঝে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না৷ মানুষ মন থেকে খুব করে কিছু চেয়ে যখন সেটা পায় না তখন ই তার দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যায়৷ সেই জিনিসটা পাওয়ার জন্য আবেগ, অনুভূতি বিসর্জন দিতেও দুবার ভাবে না। আমার অবস্থা এখন তেমনই। আমি জানি, তুই এসবের কিছুই বুঝবি না, তবুও কেন জানি তোকে বলতে ইচ্ছে করছে। তোর সাথে সেদিন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছি, যদি সম্ভব হয় আমায় ক্ষমা করে দিস। আমি তোর খারাপ চাই না কখনো, কিন্তু আমার ভালো চাওয়াগুলোও কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়৷”

আবিরের প্রথম কথাগুলো শান্ত স্বরের হলেও শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে আবিরের গলা ভিজে আসছিল। এদিকে আবির ভাইয়ের স্পর্শ, শীতল কণ্ঠে বলা কথাগুলো অষ্টাদশীর হৃদয়ে সাতদিন যাবৎ জ্বলজ্বল করা তীব্র অনলকে মুহুর্তেই নিভিয়ে দিয়েছে। আবিরের বলা প্রতিটা কথা অষ্টাদশীর হৃদয় স্পর্শ করেছে। আবির কোনো বিষয়ে আপসেট এটা বুঝতে বাকি নেই মেঘের৷ আবির ভাই কিছু চেয়ে পান নি এটা খুব স্পষ্ট৷ তবে কি চেয়েছিলেন তিনি? কেনোই বা পান নি? সেই ক্ষোভ কেন মেঘের উপর ঝাড়েন! সব প্রশ্নের উত্তর ই অজানা। আবিরের চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। আবির ঢোক গিলে মেঘের থুতনিতে রাখা নিজের আঙুল সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

“আমি আসছি একটু। ”
মেঘ স্তব্ধ হয়ে আছে। আবির কোথায় যেন গেছে৷ মেঘের মনে প্রশ্নেরা ঘুরপাক খাচ্ছে। একবার ভাবছে জিজ্ঞেস করবে। আবার মনে হলো, আবির ভাই কিছু বলার পাত্র নয়। জিজ্ঞেস করলেও আশানুরূপ উত্তর পাবে না। তাই অষ্টাদশীর মনের গহীনে উদিত প্রশ্নগুলোকে সেখানেই চাপা দিয়ে দিয়েছে। তবে আবির ভাইয়ের একটা জিনিস বরাবরই অষ্টাদশীকে আকৃষ্ট করে। আবির যেমন রাগ দেখায় একটা সময় পর মেঘকে নিজেই সরি বলে। তবে এবার অষ্টাদশীর মন এত সহজে গলবে না। আবিরের রাগ দেখাতে পারলে অষ্টাদশীও রাগ দেখাতে পারে৷ তবে সম্পূর্ণ অন্যভাবে।

কিছুক্ষণ পর আবির আসছে। ভেজা চুল ঝেড়ে হেলমেট পড়ে নিয়েছে। কথা না বলে বাইক স্টার্ট দিল, মেঘ পূর্বের ন্যায় বাইকে বসছে। সম্পূর্ণ রাস্তা কেউ কোনো কথা বলল না। বাসায় এসেও যে যার মতো রুমে চলে গেছে।
সময় চলছে নিজের মতো সেই সাথে সবাই সবার মতোই দিন কাটাচ্ছে। নানুবাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর থেকে মেঘ অনেকটায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আবিরের কথা ভেবে মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে না। মীম,আদির সঙ্গে আড্ডা, ছাদের গাছগুলোর যত্ন নেয়া, ভার্সিটি,ক্লাস, বন্ধুদের সাথে গল্প সব নিয়েই ব্যস্ত থাকে মেঘ । আবির ও নিজের কাজে ব্যস্ত।

আলী আহমদ খান কিছুদিন যাবৎ অফিসে যাচ্ছেন। তবে মিটিং থেকে শুরু করে বেশিরভাগ কাজ আবিরই করে তাছাড়া মোজাম্মেল খান বাকি কাজ করেন। তানভিরও নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে গেছে। আবির মেঘের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও মেঘ কোনো কথায় তেমন সাড়া দেয় না। বাড়ির বাকি সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার মাঝে আবির আসলেই মেঘ নিশ্চুপ হয়ে যায়। একটা কথায় মেঘের মাথায় সর্বক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খায়, “আমি কখনো আবির ভাইয়ের বিরক্তির কারণ হবো না।”

মেঘদের সঙ্গে তামিম আর মিনহাজদের সম্পর্ক আগের থেকেও ভালো হয়েছে। তামিম বন্যাকে আর কোনো দিন উল্টাপাল্টা কথা বলবে না বলে প্রমিস করেছে। মিনহাজ দিন দিন মেঘের প্রতি একটু বেশিই কেয়ার দেখায়। মেঘের সেসব ভালো না লাগলেও বন্ধু ভেবে তেমন কিছুই বলে না এসব বিষয় ইগ্নোর করে চলে।

দু তিনদিন যাবৎ আবির খুব চেষ্টা করছে মেঘের সঙ্গে কথা বলার কিন্তু কোনোভাবেই পারছে না। সবার সামনে তেমন কিছু বলতে পারে না, মেঘ রুমে থাকলেও দরজা বন্ধ করে রাখে। দরজায় ডাকলে মেঘ দরজা খুলবে কি না, বাড়ির মানুষ দেখলে কি ভাববে এসব ভেবেই আবির কুল কিনারা পাচ্ছে না। এদিকে প্রেয়সীর রাগান্বিত মুখবিবর আবির আর সহ্য করতে পারছে না।

কতদিন হয়ে গেছে আবির মেয়েটার মুখের হাসি দেখতে পারছে না। সর্বক্ষণ মেঘের দুশ্চিন্তায় থাকতে থাকতে কাজেও ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারে না। এক কাজ দুবার – তিনবার করতে হয়। আজকে বিকেলে মীম, আদি, হালিমা খান, আকলিমা খান শপিং এ যাবেন। মেঘকেও বলেছিল কিন্তু মেঘ যাবে না বলেছে। মালিহা খান অসুস্থতার কারণে ইচ্ছে করেই যান নি৷ আবির আজ ২ টার দিকে অফিস থেকে বাসায় আসছে। বিকেলের দিকে আবির রেডি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামছে। মেঘ তখন সোফায় বসে কার্টুন দেখছিল৷ ঘাড় ফিরিয়ে সিঁড়িতে আবিরকে দেখে টিভির সাউন্ড কমাতে লাগলো। আবির সোফার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“কার্টুন দেখা শেষ হলে একটু ছাদে যাস। ”
মেঘ কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে শুধালো,
“কেনো?”
আবির পূর্বের ন্যায় ভারী কন্ঠে উত্তর দিল,
“গেলেই বুঝবি। ”

আবির বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ আবিরের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, পুনরায় কার্টুন দেখায় মনোযোগ দিল। মনের ভেতর খুঁতখুঁত করছে। আবির ভাই ছাদে যেতে বললেন কেন? একবার ভাবছে যাবে আবার ভাবছে যাবে না। যার সঙ্গে আড়ি তার কথায় ছাদে যাওয়ার কোনো মানে হয় না! কিন্তু অবুঝ মনকে মানাতে পারলো না। ১০-১৫ মিনিট পর টিভি বন্ধ করে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ছাদের দরজায় একটা চিরকুটে লেখা-
“Welcome ”

মেঘ কপাল কুঁচকে দরজা থেকে চিরকুট তুলে হাতে নিয়ে দরজা খুলতেই আশ্চর্য বনে গেল। দৃষ্টির সীমানা জুড়ে বড় ছোট চিরকুটের ছড়াছড়ি। সাদা, হলুদ, লাল, গোলাপী, নীল প্রতিটা চিরকুটেই লেখা,
“I am Sorry Megh.”
“Please forgive me.”
“Sorry.”
“I feel regret and guilt”

এরমতো অসংখ্য বাক্যের চিরকুটে সম্পূর্ণ ছাদ, ছাদের গাছের ঢাল,পাতা রঙিন হয়ে আছে। মেঘ গুটিগুটি পায়ে হেঁটে প্রতিটা চিরকুটে লেখা লাইনগুলো পড়ছে। নিজের অজান্তেই অষ্টাদশীর ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। প্রায় ৪০ মিনিট যাবৎ অষ্টাদশী ছাদে হাঁটছে আর চিরকুট পড়েছে। সবগুলো চিরকুট পড়ে পড়ে নিজের হাতে জমা করছে।মেঘের মনের আকাশ জুড়ে শুধু একটা কথায় বিচরণ করছে,
“আপনি মানুষটা অত্যধিক রহস্যময়, কৌশলে যেমন কষ্ট দেয়ায় পটু তেমনি নিপুণ দক্ষতায় সেই ক্লেশ দূরীকরণেও সক্ষম।”

মেঘ মুচকি হেসে বলল,
“তবে আপনার চড়ুইও কম না। আপনি সবসময় কৌশলে আমার মন ভালো করে দিলেও এবার আর আমার মন ভালো হচ্ছে না৷ আপনি আমার কোমল হৃদয়ে যে আঘাতটা করেছেন তার জন্য একটু ভোগান্তি তো আপনাকে ভুগতেই হবে।”

মেঘ চিরকুট গুলো নিয়ে রুমে চলে গেছে। মন টা আজ খুব ভালো কিন্তু সেটা আবির ভাইকে বুঝানো যাবে না। রাতে খাবার টেবিলে আবিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেঘ গাল ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আবির কপাল গুটিয়ে মেঘকে কয়েক মুহুর্ত দেখল। এতকিছুর পরও মেয়েটার মুখে একটু হাসি ফুটলো না। ভাবতেই আবিরের মাথায় ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তাহলে কি মেঘ ছাদে যায় নি? আবির কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি ছাদে গেল৷ ছাদে একটা চিরকুট ও নেই। তারমানে মেঘ ছাদে আসছিল আর চিরকুট নিয়েও গিয়েছে৷ আবির তার কাদম্বিনীর রাগ ভাঙাতে ব্যর্থ হয়েছে ভেবেই আকাশের ন্যায় কোমল দৃষ্টিতে তাকালো৷হৃদপিণ্ডটা অবিরাম কাঁপছে। মনের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছে। চোখ বন্ধ করতেই ৯ বছর আগের স্মৃতি একের পর এক চোখের সামনে ভেসে আসছে। আচমকা ধপ করে ছাদের ফ্লোরেই বসে পরেছে। কি হচ্ছে আর কি হবে তা ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পরেছে।

আজ মার্চের ৩ তারিখ। মেঘের জন্মদিন। অষ্টাদশী আজ উনিশ বছরে পা দিয়েছে। বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা৷ এই বাড়িতে কখনোই জন্মদিন পালন করা হয় না৷ সামান্য উইশ টুকুও কেউ করে না। তাই কারোর জন্মদিনের কথা মনেই থাকে না৷ আবির গত রাতে দেরি করে বাসায় ফেরার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে নি। আবির ১২ টার দিকে অফিসে যেতে চাইলে আলী আহমদ খান অফিসে তেমন চাপ নেই বলে যেতে নিষেধ করেন। এজন্য আবির দুপুরের দিকে সোফায় বসে আদিকে পড়াচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর মেঘ ভার্সিটি থেকে বাসায় আসছে। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছে। হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ হতেই আবির গিয়ে দরজা খুলে দিল৷ ডেলিভারি বয় জিজ্ঞেস করলেন,
“এখানে মাহদিবা খান নামের কেউ আছেন?”

মেঘ খাবার খাওয়া বন্ধ করে দরজার দিকে তাকালো৷ আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেনো?”
“ওনার নামে পার্সেল আসছে।”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কোথা থেকে?”
“সরি ভাইয়া, সেটা বলতে পারছি না । ”
পার্সেলের কথা শুনে মেঘ তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে হাত ধৌয়ে দৌড়ে আসছে। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আমি মাহদিবা”

ছেলেটা মেঘের সাইন নিয়ে পার্সেল দিয়ে চলে গেছে। মেঘ পার্সেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। আবির স্তব্ধ হয়ে গেছে। আবির দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি পর্যন্ত আসতেই তানভির নামছে। মেঘকে হাস্যোজ্জল চেহারা দেখে আবিরের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল,
“কি হয়ছে?”

আবির উত্তর না দিয়ে তানভিরকে পাশ কাটিয়ে মেঘের রুমে চলে গেছে। মেঘ টেবিলের উপর পার্সেল রেখে কাঁচি আনতে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেছে। আবির রুমে ঢুকে পার্সেল হাতে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“পার্সেল কে পাঠাইছে?”
মেঘ হেসে উত্তর দিল,
“আমি কি করে বলবো?”
“তাহলে পার্সেল পেয়ে এত খুশি কেন?”
“গিফট পেলে সবাই খুশি হয় সেটা যেই দেক না কেন! আমার পার্সেল দিন। ”
“কে পাঠিয়ে না বললে পার্সেল দিব না”
“আজব তো! আমি জানি না কে পাঠাইছে।”
“তাহলে পার্সেল দেখার দরকার নেই।”

বলেই আবির পার্সেল নিয়ে চলে গেছে। মেঘ আহাম্মকের মতো চেয়ে আছে৷ মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,
” নিজে সামান্য উইশ ও করবে না আবার কেউ পার্সেল দিলে নিতেও দিবে না। এ কেমন মানুষ রে বাবা!”
আবির পার্সেল নিয়ে রুমে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে৷ আবিরের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হয়তো মিনহাজ গিফট পাঠিয়েছে। মেঘ কি করবে ভেবে না পেয়ে একে একে বন্যা, মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি সবাইকে কল দিয়েছে, কেউ পার্সেল পাঠিয়েছে কি না জিজ্ঞেস করেছে৷ কিন্তু কেউ ই কিছু জানে না৷ মিনহাজকে জিজ্ঞেস করায়, মিনহাজ বলেছে,
“তোদের বাসার ঠিকানা জানলে আমি নিজেই পার্সেল নিয়ে হাজির হইতাম ”

মেঘ প্রথমে ভেবেছিল বন্ধুদের মধ্যেই কেউ পাঠিয়েছিল কিন্তু ওদের কথা শুনে এখন মেঘ নিজেই চিন্তায় পরে গেছে৷ তবে কে দিল পার্সেল?
দুপুরের পর পর আবির বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর তানভির একটা ড্রেস মেঘকে দিয়ে বলল,
“এটা পড়ে রেডি হয়ে নে, তোকে নিয়ে বের হবো”
“কেন?”
তানভির মুচকি হেসে বলল,
“এমনি”

মেঘও সঙ্গে সঙ্গে হাসলো। সবার মধ্যে তার ভাই যে তার জন্মদিন মনে রেখে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলছে সেই অনেক। মেঘ ঝটপট রেডি হয়ে বের হয়েছে। তানভির ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল। হালিমা খানকে বলেই মেঘকে নিয়ে বের হচ্ছে। মেঘ তানভিরের পিছু পিছু যেতে যেতে বলল,
“আজ দুজনে বাইকে গেলে কিছু হবে না?”
“হতেও পারে। তারজন্য ই গাড়ি নিয়ে যাব”

মেঘ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিরবে ভেঙচি কাটলো। মেঘ ভেবেছিল তানভির কে কথা শুনাবে তা না হয়ে উল্টো নিজেই বোকা হয়ে গেছে। তানভির মেঘকে নিয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো৷ রেস্টুরেন্টে পা দিতেই মেঘের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে৷ সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বার্থডের জন্য সুন্দর করে সাজানো । তানভির মুখে হাসি রেখে বলল,

“Happy birthday Bonu”
মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“Thank you vaiya”
মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে দেখছে। কিছু ভাবার বা বলার আগেই আচমকা কেউ মেঘের দু চোখে চেপে ধরে। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে হাত স্পর্শ করেই উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“বন্যা”
হাত ছাড়তেই মেঘ পিছনে ঘুরে বন্যাকে জড়িয়ে ধরেছে। বন্যাও জড়িয়ে ধরে বলল,
“Happy Birthday baby. ”
মেঘ হেসে বলল,
“Thank you baby”
এবার মিনহাজ, তামিন, মিষ্টিরা সমস্বরে বলে উঠল,
“Happy birthday Megh”

মেঘ অবাক চোখে সবাইকে দেখছে। বার বার তাকাচ্ছে তানভিরের দিকে। তানভিরের ঠোঁটে হাসি। মেঘ কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জীবনে প্রথমবার কেউ মেঘের জন্মদিন পালন করছে তাও আবার এত ঝাঁজ জমক ভাবে। সবাই একে একে মেঘকে গিফট দিচ্ছে। মেঘ সেসব গিফট টেবিলের উপর রেখে দৌড়ে গেল তানভিরের দিকে। কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“এতকিছু করার কি দরকার ছিল।”
তানভির মৃদুস্বরে বলল,

“এগুলো কিছুই না। একটু অপেক্ষা কর দেখবি।”
মেঘ তানভিরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ২-৩ মিনিট পর প্রায় ৩০ জনের মতো পথশিশু রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসে একজোট হয়ে মেঘকে উইশ করলো। মেঘ নিজের চোখ কে কোনো মতেই বিশ্বাস করতে পারছে না৷ তানভির মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আজ তোর জন্মদিন উপলক্ষে ওদের সবাইকে নিজের হাতে খাওয়াবি৷ পারবি না?”
মেঘের চোখ ছলছল করছে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অকস্মাৎ ফুপ্পিকে দেখে মেঘ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। ফুপ্পি, আইরিনরা সবাই আসছে৷ মেঘ ফুপ্পিকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিয়েছে। প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর তানভির শক্ত কন্ঠে বলল,

“আর কতক্ষণ কাঁদবি? ”
মেঘ চোখ মুছতে মুছতে তানভিরকে জিজ্ঞেস করল,
“এত আয়োজন তুমি করেছো?”
তানভির বিপুল চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমার এত সামর্থ্য এখনও হয় নি বনু। এসব ভাইয়া করেছে”
মেঘের হাসি মিলিয়ে গেছে৷ আশেপাশে চোখ বুলায়। আবিরের কোনো অস্তিত্ব না পেয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে মেঘের মুখ। উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধায়

“ওনি কোথায়?”
“জানি না”
“ওনি আসবেন না?”
“বোধহয় নাহ।”
মেঘ এবার তপ্ত স্বরে বলল,
“কেনো?”
“তুই নাকি ভাইয়ার উপর রেগে আছিস তাই। ”
“তাহলে এসব করেছেন কেন?”
“তুই ভাইয়ার জন্মদিন করেছিলি তাই ভাইয়াও তোর জন্মদিনের আয়োজন করেছেন।”
মেঘ আশেপাশে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ওখানে আসতে বলো।”

তানভির পকেট থেকে ফোন বের করে আবিরকে কল দিল, আসার কথা বলায় আবির শীতল কন্ঠে বলল,
“তোরা কেক কেটে ফেল, আমি আসব না।”
সাউন্ড বেশি থাকায় মেঘ পাশ থেকে আবিরের কথা শুনে ফেলছে৷ হাত বাড়িয়ে তানভিরের থেকে ফোন নিয়ে মেঘ রাগী স্বরে বলল,
“আপনি না আসা পর্যন্ত আমি কেক কাটবো না। এবার আপনি ভাবুন, আসবেন কি না!”

বলেই মেঘ কল কেটে দিয়েছে৷ মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো৷ বন্যা হা হয়ে মেঘকে দেখছে৷ যে আবির ভাইকে মেঘ বাঘের মতো ভয় পেতো আজ কি সুন্দর ভাবে ওনার উপর অধিকার দেখাচ্ছেন। মিনহাজ তামিম শুধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তানভিরের সামনের মেঘকে আলাদা ভাবে কিছু বলার সাহস নেই ওদের। মেঘ আইরিনদের সঙ্গে গল্প করছে। বন্যাকেও ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর আবির আসছে, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, ব্লেজার বুকের উপর সানগ্লাস ঝুলানো, আবির ঢুকতেই সবার নজর পরে আবিরের দিকে৷আবিরকে দেখেই মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটেছে৷ বন্যা, মিনহাজ, তামিমও হা হয়ে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে৷ মিষ্টিরা আবিরের গেটআপ দেখে ফিদা হয়ে গেছে। আবির আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই কেক কাটা হয়েছে। ফুপ্পির থেকে শুরু করে আবির,তানভির সহ যতজন পথশিশু ছিল সবাইকে মেঘ নিজের হাতে কেক খাইয়ে দিয়েছে। কেক কাটার পর্ব শেষ হতেই আবির পকেট থেকে একটা বক্স বের করে মেঘকে দিয়ে বলল,
“Happy birthday dear sparrow. ”

মেঘ “Thank you ” বলে বক্স খুলতেই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকায়। আবিরের নিরুদ্বেগ ভাব দেখে মেঘ একে একে সবার দিকে তাকাচ্ছে। বক্সে জ্বলজ্বল করছে ডায়মন্ডের আংটি। তা দেখে মেঘের হাত কাঁপছে। মেঘের ভাবভঙ্গি দেখে আবির থমথমে কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল,

” আংটির দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকিস না, তোর ফ্রেন্ডরা ভাববে জীবনে ডায়মন্ড দেখিস নি। তাড়াতাড়ি আংটিটা পড়, আমাকে আংটি পড়াতে বাধ্য করিস না। আমি আংটি পড়ালে এখানে কাহিনী হয়ে যাবে। ”
মেঘ একপলক আবিরকে দেখে আস্তে করে গলা খাঁকারি দিয়ে টেবিলের উপর বক্স রেখে আংটি টা নিয়ে নিজেই নিজের অনামিকা আঙ্গুলে ঢুকালো। নিজের হাতের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে মেঘ, জীবনে প্রথমবার ডায়মন্ডের আংটি পরেছে হাতে৷ মেঘ খুশিতে ফুপ্পি সহ সবাইকে সেই আংটি দেখাচ্ছে। উপস্থিত প্রত্যেকের মুখে হাসি থাকলেও মিনহাজ আর তামিম নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুই বলতে পারছে না। শুধু চোখে ইশারা দিচ্ছে।

সবটা যে আবিরের পরিকল্পনা তা বুঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। মেঘের জন্মদিনে ছোটখাটো সারপ্রাইজ দিবে এটা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল আবির। কিন্তু আজ মেঘের নামে পার্সেল আসার পর সেই চিন্তা মুহুর্তেই বদলে গেছে। বাসায় বসেই সব পরিকল্পনা করেছে। দুপরের পর মার্কেটে গিয়ে মেঘের জন্য ড্রেস কিনে তানভিরকে দিয়ে পাঠিয়েছে। তানভিরকে দিয়ে বন্যাকে কল দিয়ে ইনভাইট করেছে।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৬(২)

সেই সঙ্গে বন্যাকে দায়িত্ব দিয়েছে মিনহাজদের বলার জন্য এবং অবশ্যই যেন সবাই আসে। বন্যাও তানভিরের কথামতো সবাইকে বলেছে। ফুপ্পিদের আবিরই জানিয়েছে৷ মিনহাজ আর তামিমকে নিজের অবস্থান বুঝানোর জন্যই আবির ইচ্ছে করে মেঘের জন্মদিনে সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বুকিং দিয়েছে, সেই সঙ্গে মেঘের জন্য নিজে পছন্দ করে ডায়মন্ডের আংটি নিয়ে আসছে। যেখানে মা*রপিট আর কথায় কিছু বুঝানো অসম্ভব হয়ে পরে সেখানে কিছু কৌশল খাটাতেই হয়।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৮