আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৮

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৮
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

খাওয়াদাওয়া শেষে ফুপ্পিরা বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। পথশিশুদের খাওয়া শেষে আবির নিজেই এগিয়ে দিতে গেছে এই সুযোগে মেঘ আর তার বন্ধু বান্ধবীরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। তানভির পাশের টেবিলে বসে ফোন চাপছে আর একটু পর পর মেঘদের দেখছে। পাশে বসাতে ওদের সব কথোপকথন ই তানভিরের কানে যাচ্ছে। তামিম দু একটা কথা বললেও মিনহাজ তেমন কথায় বলছে না।

দু একবার এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে তানভিরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে। তানভিরের গুরুগম্ভীর চেহারা আর ক্রোধিত আঁখি দেখেই মিনহাজ দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে। তানভিরের ভয়ে কিছুই বলতে পারছে না৷ মিনহাজ গিফটের পাশাপাশি মেঘের জন্য একটা ব্রেসলেট এনেছিল যেটার ঠিক মাঝখানে M অক্ষর ছিল৷ মিনহাজ আর মেঘ দুজনের নামের প্রথম অক্ষরই M সেই সুবাদে মিনহাজ এটা এনেছে। মেঘ তেমন কিছু না ভাবলেও মিনহাজ নিজের কথায় ভাববে। কিন্তু তানভিরের ভয়ে প্রথম থেকেই মিনহাজ সিটিয়ে আছে। আবির আসার পর তো মিনহাজের স্বাভাবিক নিঃশ্বাস ই বন্ধ হয়ে গেছে। আবিরের দেয়া সুবৃহৎ সারপ্রাইজ, মেঘকে দেয়া ডায়মন্ডের আংটি, তানভিরের দেয়া গোল্ডের ব্রেসলেট, ফুপ্পিদের দেয়া দামি গিফটের ভিড়ে মিনহাজের গিফট কিছুই না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তানভির কিছুক্ষণ পর নরম স্বরে বলল,
” তোমরা আর কি কি খাবে বলো, আনাচ্ছি।”
মিষ্টিরা সকলেই সমস্বরে বলল,
” কিছু লাগবে না ভাইয়া, অনেক ধন্যবাদ। ”
তানভির মৃদু হাসল, কিছুই বলল না। এই ফাঁকে বন্যাকে খানিক দেখে নিল। বন্যা আজ নেভি ব্লু রঙের একটা মোটামুটি গর্জিয়াছ গাউন পরেছে সাথে গর্জিয়াছ গোল্ডেন হিজাব, ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজল। বন্যা সচরাচর সাজে না আজ বন্যার এত সাজ দেখে তানভিরের হৃদয়ে ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল। বন্যা আসার পর থেকে তানভির একটু পর পর আড়চোখে বন্যাকেই দেখছিল। সবার সামনে সরাসরি তাকাতেও পারছিল না আবার না তাকিয়েও থাকতে পারছিল না। তানভিরের ভূকম্প এখন অনেকটায় কমে এসেছে। তবে মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন জানান দিচ্ছে,

” তাহার মোহমায়ায় জর্জরিত তানভিরের অন্তরতম অঁচল। তাহার দৃষ্টি শান্ত হৃদয়ে অশান্তির তোলপাড় চালাচ্ছে।”
তবুও তানভির সব কিছু উপেক্ষা করে মায়াভরা সেই গভীর কূয়োতে ঝাপিয়ে পড়তে চায়। নিজেকে সংহার করতে চায় । কিছুক্ষণ পর আবির আসছে। রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করে মেঘদের কাছে এসে মিনহাজ আর তামিমের দিকে তাকিয়ে সচেতন কন্ঠে শুধালো,

“তোমরা কি যেতে পারবে?”
তামিম উপর- নিচ মাথা নেড়ে ভদ্রতার সহিত বলল,
“জ্বি ভাইয়া। যেতে পারবো।”
আবির এবার মেঘের পানে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আড্ডা দেয়া শেষ হলে আসুন, যেতে হবে।”

আবিরের আপনি সম্বোধনে বন্যা কপাল কুঁচকালো৷ বন্যা যতবার আবিরকে দেখেছে ততবারই মেঘকে তুই বলে সম্বোধন করতে শুনেছে। আজ হঠাৎ আপনি বলছে! বন্যা ভুল শুনলো কি না তাই ভাবছে! মেঘ বান্ধবীদের থেকে বিদায় নিয়ে উঠলো। তানভির মেঘের গিফটগুলো নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। তানভিরের কিছুটা পিছনেই আবির, আবিরের থেকে একটু দূরে মেঘ, মেঘের পেছনে বন্যারা, সবশেষে তামিম আর মিনহাজ। রেস্টুরেন্টের দরজার কাছাকাছি যেতেই মেঘের গাউন থেকে বের হওয়া সুতার সঙ্গে জুতার স্টোন আঁটকে গেছে। ড্রেসে টান পরতেই মেঘের সম্পূর্ণ শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে আসে সেই সঙ্গে মুখ দিয়ে অকস্মাৎ বেড়িয়ে আসে,

“উফফফফ”
শব্দটা আবিরের কানে পৌঁছানো মাত্রই, আবির ঘুরে দীর্ঘ দুকদম এগিয়ে এসে মেঘের দু কাঁধে ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করা শুরু করে,
“কি হয়েছে তোর? কোথায় ব্যথা পাইছিস?”
বন্যা,মিষ্টি, মিনহাজ সবাই একসঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মেঘের কি হয়েছে তা বুঝে উঠার আগেই আবির মেঘকে ধরে ফেলেছে। আবির নিজেও বুঝতে পারে নি মেঘের কি হয়েছে! আবিরের চিন্তিত কণ্ঠের একের পর এক প্রশ্নের প্রতিত্তোরে মেঘ ধীর কন্ঠে বলল,

” মনে হয় জুতায় সুতা আঁটকেছে।”
এরমধ্যে বন্যা এগিয়ে এসে মেঘের হাত ধরল৷ আবির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছে। এক মুহুর্ত দেরি না করে জুতা সহ মেঘের পা আবিরের হাঁটুর উপর তুলে নিল। শরীরের ব্যালেন্স হারাতে নিলে মেঘ তাড়াতাড়ি আবিরের মাথায় হাত রাখে। পা উপরে উঠানোতে মেঘও কিছুটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির সুস্থির হস্তে জুতা থেকে মেঘের ড্রেসের সুতা খুলে দিচ্ছে। তানভিরের এতক্ষণে পেছন ফিরে তাকিয়েছে। সহসা উচ্চস্বরে বলল,

“কি হয়েছে বনুর?”
আবির বসা অবস্থাতেই বলল,
“কিছু না, তুই যা।”
তানভির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে চলে গেছে। আবির মেঘের পা নামিয়ে, দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে শুধালো,
“শুধু সুতায় আঁটকেছিল নাকি পায়েও ব্যথা পেয়েছিস?”
মেঘ আস্তে করে বলল,
“পায়ে ব্যথা পায় নি।”
“সত্যি তো?”
“হ্যাঁ”

আবির দাঁতে দাঁত চেপে অতি ধীর কন্ঠে বলল,
” দেখেশুনে হাঁটবি তো নাকি! আর একটু হলেই মাথায় লাগতো ”
বন্যা অবাক চোখে আবিরকেই দেখছে, আবিরের হাঁটুতে ময়লা লেগে আছে অথচ সেদিকে তার বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। বন্যার সঙ্গে সঙ্গে মেঘও আশ্চর্য নয়নে আবিরকে দেখছে। এতগুলো চোখ অবাক দৃষ্টিতে আবিরকে দেখছে তা বুঝতে পেরে আবির চোখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

“হাঁটতে পারবি?”
“পারবো।”
মেঘ আবারও ডাকলো,
“আবির ভাই”
“হুমমমমমমম”
“আপনার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। ”
“কোনো ব্যাপার না”
মেঘের হাতের পার্টস, ফোন, আবিরের দেয়া আংটির খালি বক্স আবির নিজের হাতে নিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“ড্রেসটা একটু উঠিয়ে হাঁটিস।”

মেঘও আবিরের কথামতো দুহাতে ড্রেসটা হালকা উঠিয়ে পা বাড়ালো। আবির সামনের দিকে থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টি তার পেছনে৷ মেঘের হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে কি না, জুতায় সুতা আটকাচ্ছে কি না তাই দেখছে। আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে আবারও শুধালো,
“ব্যথা পাচ্ছিস না তো?”
মেঘ এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে বলল,” নাহ।”
বন্যা প্রখর নেত্রে আবিরকে পরখ করছে৷
তামিম মিনহাজকে উদ্দেশ্য করে বিড়বিড় করে বলল,
“কিছু কি বুঝতে পারছিস? ”

তানভির চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল,” কি?”
“মেঘের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে যাওয়ার কথা তোর, অথচ তুই বুঝার আগেই আরেকজন দায়িত্ব পালন করে ফেলছে।”
মিনহাজ তামিমের দিকে তাকিয়ে ভ্রু গুটালো। তামিমের কথাটা তার ভালো লাগে নি তাই বুঝালো। নিচে আসতেই আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তুই দাঁড়া এখানে, আমি বাইক টা নিয়ে আসি।”
আবির যেতেই বন্যা মেঘের কাছাকাছি এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“Baby,I am shocked.”

মেঘ চোখ ঘুরিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়েই লাজুক হাসলো। বন্যা পুনরায় বলল,
“আমার কিন্তু আবির ভাইয়ার উপর সন্দেহ হচ্ছে। তোর হচ্ছে না?”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
“সন্দেহ আমি বেশকিছুদিন যাবৎ ই করছি৷ কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। কারণ ওনার আচরণ কেমন জানি, একদম অদ্ভুত৷ এইযে দেখলি এত যত্ন নিচ্ছে একটু পরেই দেখা যাবে রাগে যা তা বলছে।”
বন্যার উত্তেজিত চেহারায় চিন্তার ছাপ পরে গেছে৷ চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“থাক, এত ভাবিস না। দোয়া করি ওনি অদ্ভুত হলেও বহুরূপী যেন না হয়!”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বন্যার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“বহুরূপী মানে?”

” মানে বুঝতে হবে না বেবি। আমি চাই তোর ওনার মনে তুই না থাকলেও অন্য কোনো নারীর অস্তিত্ব যেন না থাকে।”
মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে ভেঙচি কেটে বলল,
“অন্য নারীর অস্তিত্ব থাকলেও আমি চিরতরে সেই অস্তিত্ব মুছে দিব। ওনি আমার মানে আমারই। ওনি আমার প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা, ওনাকে এত সহজে ছাড়ছি না। বাস্তব জীবনে ওনাকে না পেলে ম*রে পে*ত্নী হয়ে ওনাকে মে*রে ফেলবো। তারপর ভূত আর পেত্নী মিলে সংসার করবো। তবুও ওনাকেই আমার লাগবে।”
বন্যা হাসতে হাসতে বলল,

” তোদের সংসারে আমায় দাওয়াত দিবি না?”
“কেন দিব না! তুই আমার একমাত্র বেস্টু বলে কথা! তোকেও মে*রে আমাদের কাছে নিয়ে যাব চিন্তা করিস না।”
বন্যা মেঘের বাহুতে আস্তে করে থাপ্পড় মেরে বলল,
“পাগলি একটা”
মেঘ হঠাৎ ই বন্যার দিকে কেমন করে তাকালো, বন্যা আস্তে করে বলল,
“কি হয়ছে?”
“আবির ভাই আমার প্রেমে পাগল হবে কবে?”
“কেন?”

“আমি তো অলরেডি পাগলি হয়ে গেছি, আবির ভাই পাগল হলেই পাবনা গিয়ে সংসার টা শুরু করবো।”
বন্যা হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। মুখে হাসি রেখেই বলল,
“আল্লাহ আমায় বাঁচাও। বিয়ের খবর নাই, এদিকে কোথায় সংসার করবে তা ভেবে ফেলছে।”
মিনহাজ, মিষ্টিরা মেঘদের একটু পেছনে ছিল। বন্যার এত হাসি দেখে মিনহাজ বিরক্তির স্বরে বলল,
” এত হাসছিস কেন?”
“ভাল্লাগছে তাই হাসছি৷ তোর কোনো সমস্যা? ”
“হ্যাঁ আমার কানে লাগছে। ”
“তাহলে কানে আঙুল দিয়ে রাখ ”

মিনহাজের রাগ আরও বেড়ে গেছে। একদিকে মেঘের প্রতি আবিরের কেয়ার অন্যদিকে বন্যার হাসিতে মিনহাজ রীতিমতো রাগে কটমট করছে। এরমধ্যে আবির আর তানভির দুজনেই হাজির হলো। আবির তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই ওদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবি। আমি মেঘকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। ”
“আচ্ছা ভাইয়া। ”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোর পার্টস গাড়িতে রেখেছি আর ফোন আমার পকেটে লাগলে বলিস। চল এখন”

মেঘ বাইক পর্যন্ত যেতেই আবির বাইক থেকে একটা হেলমেট নিয়ে প্রতিদিনের মতই মেঘকে পরিয়ে দিচ্ছে। বন্যা এসব ঘটনা দেখে অভ্যস্ত৷ কিন্তু মিষ্টিরা প্রথমবার দেখছে৷ এতদিন শুধু মেঘের মুখেই আবিরের প্রশংসা শুনে আসছে, আজ তার খানিকটা নিজের চোখেই দেখছে। মেঘ বাইকে বসার পরও আবির কয়েকবার পেছনে ঘুরে মেঘের ড্রেস ঠিক করে দিচ্ছে, যাতে জুতা বা বাইকে কোনোভাবে না আটকায়। আবির মেঘকে নিয়ে চলে গেছে। তানভির তামিমদের উদ্দেশ্য বলল,

” তোমাদের রিক্সা ঠিক করে দিয়েছি৷ যাও। ”
বন্যাদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তোমরা গাড়িতে বসো।”
ওরা কিছু বলতে গেলে বন্যা চোখে ইশারা দিলো। সন্ধ্যার পর হয়ে গেছে এ অবস্থায় তানভির নিজেই ওদের এগিয়ে দিয়ে আসতো তারউপর আবিরও বলে গেছে। এখন মিষ্টিরা কিছু বললেই তানভিরের ধমক শুনবে তাই বন্যা ওদের আঁটকিয়েছে৷ মিষ্টিরা দুজনকে নামিয়ে তানভির বন্যাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর তানভির একটু ভেবে প্রশ্ন করল,

“ফুচকা খাবে?”
“নাহ। ”
“কেন? তোমার না ফুচকা প্রিয়?”
“অনেক খেয়ে ফেলছি। পেটে জায়গা নেই ”
তানভির হেসে বলল,
“ফুচকার জন্য পেটে নয় মনে জায়গা দরকার।”
তানভির রাস্তার পাশে গাড়ি সাইড করে নামলো। তানভিরের দেখাদেখি বন্যাও নেমেছে। বন্যা ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আমি এখন সত্যিই ফুচকা খেতে পারবো না। ”
“সমস্যা নেই, একটু হাঁটবে যখন খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে তারপর যাব ”
বন্যা মাথা নিচু করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“এটা ঠিক না।”
“ঠিক বেঠিক আমি কম বুঝি!”
বন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘরা একেকটা ভাইবোন ঘাড়ত্যাড়ার সেরা। ওরা যা বলবে তাই করবে৷ বন্যা হাল ছাড়লো না। অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,
“রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে।”
তানভির আড়চোখে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
“এই মেয়ে, তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
“নাহ, তেমন না। কিন্তু.. ”
“তাহলে কিন্তু কিসের? তোমার বাসার মানুষ জানে তুমি কোথায় গিয়েছো। আর আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে যাব সেটাও জানে তারপরও এত টেনশন কিসের তোমার?”
“এমনি ”

আশেপাশে মানুষের ভিড়ে তানভির হাঁটছে সঙ্গে বন্যাও হাঁটছে। কিছুটা সামনে যেতেই দুটা ছেলে তানভিরকে সালাম দিল। তানভির সালাম উত্তর দিতেই দুজনের মধ্যে একজন মুচকি হেসে শুধালো,
“ভাই, ওনি কি ভাবি নাকি?”
তানভির সহসা বন্যার দিকে তাকালো। বন্যা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তানভিরের দিকে। তানভির ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
” কখন কি প্রশ্ন করতে হয় তোরা এটাও জানিস না। যা এখান থেকে।”
ছেলে দুটা সরি বলে মাথা নিচু করে চলে গেছে। তানভির বন্যার দিকে না তাকিয়েই বলল,

“Don’t mind, please. ”
বন্যা শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি বাসায় যাব”
“কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
“ওহ”
“ওহ মানে?”
“তোমার যখন ভালো লাগবে তখন ফুচকা খাবে তারপর বাসায় যাবে ”
বন্যা রাগে বলল,
“আজব , আমি বললাম তো আমার ভালো লাগছে না৷ ”
তানভিরও এবার রাগী স্বরে প্রশ্ন করল,
“তো আমি কি করব? নদীতে ফেলে দিয়ে আসবো?”
“মানে?”

তানভিরের হঠাৎ আবিরের বলা কথাটা মনে পরছে। রাগ উঠলেও বন্যাকে রাগ দেখানো ঠিক হবে না। তানভির কপাল গুটিয়ে বলল,
” মন খারাপ করে বাসায় গেলে সবাই ভাববে আমরা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। সত্যি ই কি তাই?”
“কেউ কিছু ভাববে না৷ ”
তানভির মৃদুস্বরে শুধালো,
” ছেলেগুলোর কথায় মাইন্ড করছো?”
“নাহ। ”
“তো?”
“এমনি৷ চলে যাব।”
তানভির নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। রেগে বলল,

” তোমার সময় নষ্ট করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। আর কখনো এমন কাজ করবো না। ”
তানভিরের প্রবল রাগ বুঝতে পেরে বন্যা শান্ত হয়ে গেছে। কোমল কন্ঠে বলল,
“আমি ফুচকা খেয়ে যাব।”
“খেতে হবে না ফুচকা। মনের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে হবে না। চলো”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে।”
তানভির তীব্র আক্রোশ কন্ঠে ঢেলে বলল,
“ঠিক আছে।খেয়ে আসো আমি গাড়িতে আছি ”
বন্যা মৃদুস্বরে বলল,
“আমার একা থাকতে ভয় লাগছে”

তানভির এবার বিরক্ত হয়ে বন্যার দিকে তাকালো। বন্যার মায়াবী দৃষ্টি চোখে পরতেই তানভিরের অভিব্যক্তি বদলে গেল৷ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” এখানেই বসো, আমি অর্ডার দিয়ে আসছি। ”
তানভির চেয়েছিল রাতের শীতল পরিবেশে বন্যার সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে। তানভিরের ভেতর জুড়ে সর্বদা বন্যায় ঘুরপাক খায়। বিকেল থেকে বন্যাকে দেখার, একান্তে কথা বলার তীব্র ইচ্ছে জেগেছিল তানভিরের মনে তাই ফুচকার কথা বলে নিয়ে আসছিল। ফুচকা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে, বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল। বন্যার বাসার সবার জন্য আবির রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার পার্সেল করে দিয়েছে। তারপরও বন্যা ওর বোনের জন্য ফুচকা নিয়েছে।
এদিকে আবির মেঘকে বাসার কাছে পর্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে। মেঘ নেমে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“আপনার আংটি টা দিয়ে দেই?”
“কেন?”

“আমার আংটি লাগবে না। আপনার জিনিস আপনার কাছেই রেখে দেন ”
“কেন? আবার কি হয়ছে?”
মেঘ মনে মনে আওড়াল,
“দামী গিফট দিয়ে আমি কি করব। আপনিই যদি আমার না হোন।”
মেঘের নিরবতা বুঝতে পেরে আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“আংটি যদি হাত থেকে খুলিস তাহলে খবর আছে। বাসায় যা ”
“খুললে কি করবেন? ”
“সেটা এখন কেন বলবো, খুললে বুঝাবো”
মেঘ ডানহাত দিয়ে একটানে অনামিকা আঙুল থেকে আংটি খুলে হাতের তালুতে নিতে আবিরের সামনে ধরে বলল,
“এই নিন।”

আবির আংটি টা হাতে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“তোর এই আংটির প্রয়োজন নেই?”
“নাহ!”
“ফেলে দিলে আপসোস থাকবে না তো?”
আবির বাইকে বসে আংটি ফেলে দেয়ার জন্য হাত তোলা মাত্র মেঘ দুহাতে আবিরের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“প্লিজ, ফেলবেন না। আমি পড়বো আমায় দিন।”
“তুই যেহেতু পড়তে চাস না থাক বাদ দে। অপছন্দের জিনিস না পড়ায় ভালো।”
মেঘ আবিরের হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি কখন বললাম অপছন্দের জিনিস! আমার আংটি আমায় দিন।”
“দুদিন পর পর খুলে ফেলার থেকে ভালো আমি এনেছি আমিই ফেলে দেয়। ”
মেঘ তপ্ত স্বরে বলল,
” আর ফেলব না। ”
“সত্যি তো?”
“সত্যি ”

আবির আংটি টা হাতে নিয়ে এক সেকেন্ড দেরি না করে মেঘের বামহাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়েছে। মেঘের হৃৎস্পন্দন সঙ্গে সঙ্গে জোড়ালো হয়ে গেছে৷ মেঘের নিস্তব্ধ আঁখি যুগল স্তব্ধ হয়ে আছে হাতের অনামিকা আঙুলে। অকস্মাৎ বিপুল চোখে তাকালো আবিরের দিকে। আবির নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পকেট থেকে মেঘের ফোন বের করছে। ফোন মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বাসায় যাহ।”

আবির চলে গেছে। কিন্তু মেঘের পা থেমে আছে। আঙুলের দিকে তাকাতেই আবির ভাইয়ের আংটি পড়ানোর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর প্রতিবার ই গা শিউরে উঠছে। রেস্টুরেন্টে ডায়মন্ডের আংটি দেখে এক মুহুর্তের জন্য মেঘের মনে অদম্য ইচ্ছে জেগেছিল আবির ভাইয়ের হাত থেকে আংটি টা পরবে। কিন্তু ফুপ্পিরা, তানভির ভাইয়া, বন্যারা সবার সামনে নিজের ম্যাচিউরিটির প্রমাণ দিতে নিজেই আংটি পরে নিয়েছিল। অথচ মেঘের সুপ্ত ইচ্ছে কোনো না কোনোভাবে পূরণ হয়েই গেছে।
এদিকে রুমে ঢুকেই মিনহাজ লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। তামিম হাতমুখ ধৌয়ে রুমে এসে মিনহাজের এ অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে,

“কিরে তোর আবার কি হয়ছে?”
“ভালো লাগছে না ”
“ভালো না লাগাটাই স্বাভাবিক। ”
মিনহাজ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তামিমের দিকে তাকিয়ে আছে। তামিম কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারও বলল,
“আমার সাথে রাগ দেখালে কি হবে? তুই নিজেই সব দেখে আসছিস। মেঘ যদি রাজকুমারী হয় তাহলে মেঘের আবির ভাই রাজকুমার। ওদের ব্যাপার স্যাপার ই আলাদা লেবেলের। মেঘ আমাদের সাথে সিম্পলভাবে মিশে বলে, এই না তারা আমাদের মতো সাধারণ৷ আজ তানভির ভাইয়া আর আবির ভাইয়া ইন্ডাইরেক্টলি তাদের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন। সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বুকিং করে, আনলিমিটেড খাবার, ডায়মন্ড, গোল্ডের গিফটের ভিড়ে তোর আমার অবস্থান ঠিক কোথায় বুঝতে পারছিস?”
মিনহাজ চোখ নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“আমি মেঘকে পছন্দ করি।”

“তুই পছন্দ করিস কিন্তু আমার মনে হয়ছে আবির ভাইয়া মেঘকে ভালোবাসে। মেঘের প্রতি ওনার কনসার্ন দেখছিস? মেঘ উফ করতে দেরি হয়ছে কিন্তু ওনার একশান নিতে দেরি হয় নি। তাছাড়া খাওয়ার সময় দেখছিলি? মেঘকে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছিলো৷ তাছাড়া মেঘ চাওয়ার আগেই সব হাজির। ওদের সাথে আমরা নিজেদের ভাবতেই পারবো না৷ বন্যা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হয়েই আমায় রিজেক্ট করতে একবার ভাবে নি। আর তুই মেঘকে নিয়ে ভাবছিস! তোর কপালে শনি আছে। ”
“শনি থাকলেও আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
“শা*লা নিজেও ম*রবি আমাকেও মা*রবি। ”

আজ মেঘ ভার্সিটিতে আসার পর থেকে মিষ্টিরা মেঘকে রাগাচ্ছে। মিষ্টি আবির ভাইয়ের লুক আর ব্যবহারের উপর ক্রাশ খাইছে একথা বলামাত্র মেঘ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। মিনহাজ ও সেই সঙ্গে বলছে,
“মিষ্টি তোর পছন্দ হলে প্রেম করতে পারিস।”
মেঘ রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
” তোর মা*থাটা আগে ফা*টিয়ে তারপর মিষ্টির মা*থা ফা*টাবো বলে দিলাম।”
মিনহাজ হেসে বলল,

“বললেই হলো, তুই বারণ করার কে? মিষ্টি তুই এগিয়ে যা আমি তোর পাশে আছি।”
মেঘ মিষ্টির হাত থেকে মিষ্টির সানগ্লাস টা একটানে নিয়ে নিজের চোখে দিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
“আমি কিন্তু আবির ভাইয়ের হবু বউ”
“মানে?”
“আবির ভাই আমায় আংটি পরিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আমি কি ওনার হবু বউ হবো না?”
মিনহাজ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তামিম হাসতে হাসতে বলল,
“নিশ্চিত রাতে স্বপ্ন দেখছিস। কাল আমাদের সামনে নিজের হাতে নিজে আংটি পরলি এখন আসছিস ভাব নিতে?”
মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

“ভাব কেন নিবো৷ ওনি বাসার সামনে গিয়ে আংটি নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছেন। ”
ওরা কেউ ই বিশ্বাস করছে না। বন্যা মেঘের ভাব ভঙ্গি দেখে আস্তে করে বলল,
“সত্যি পরাইছেন?”
মেঘ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
“১০০% সত্যি। ”
মিনহাজ বিরক্তির স্বরে বলল,
“কোন হাতে পড়াইছেন?”
মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বাম হাতে”

মিনহাজ মাথা নিচু করে মাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হাসতে হাসতে বলল,
“বাম হাতে আংটি পড়ালে বিয়ে হয় না”
মেঘ ভেঙছি কেটে বলল,
“আমায় এত কিছু বুঝাতে হবে না। বিয়ে হয়ছে মানে হয়ছে। তোদের মানতে হবে না। আমি মানলেই হলো।”
তামিম বিড়বিড় করে বলল,
“তোর মাথা পুরা গেছে।”

মেঘদের দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। কিন্তু আবিরের ক্রোধ কোনোমতেই কমছে না। আশেপাশে সব খোঁজ নিয়েছে৷ মেঘকে পার্সেলটা কে দিয়েছিল তার কোনো খবর পাচ্ছে না। শুক্রবার সন্ধ্যার পর আবির ছাদের সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল৷ তানভির আবিরকে সারা বাড়ি খুঁজে অবশেষে ছাদে আসছে। আবিরের রাগান্বিত মুখবিবর দেখে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়ছে ভাইয়া? আজ আড্ডা দিতে যাও নি?”
“না। ভালো লাগছে না।”
“কেন ভাইয়া?”
আবির ভারী কন্ঠে বলল,

“ও রে পার্সেল টা কে পাঠাইছে এখনও জানতে পারলাম না। তোর বোনকে যতবার জিজ্ঞেস করি ও কেমন যেন উল্টা পাল্টা উত্তর দেয়। ভালো লাগছে না আমার।”
তানভির একপা একপা করে পেছাতে লাগলো, তানভিরের ভাব দেখে আবির থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“তোর আবার কি হয়ছে?”
তানভির আবিরের থেকে ৮-১০ হাত দূরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসলে পার্সেল টা আমিই পাঠাইছিলাম।”
“কি?” বলে আবির দাঁড়াতেই তানভির দৌড়াতে শুরু করে।

তানভিরের পেছনে আবিরও ছুটছে। তানভির দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে আসছে, এদিকে সোফায় বাড়ির মহিলারা সহ মেঘ, মীম, আদি বসে ছিল। তানভিরকে দৌড়ে নামতে দেখে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেছে৷ তানভিরের পেছনে আবিরকে দেখে সহসা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেছে। তানভির সোজা মেইন গেইট পর্যন্ত চলে গেছে, দরজা খুলার চেষ্টা করছে যেন বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে৷ কিন্তু দরজা খুলার আগেই আবির চলে আসছে। আবির তানভিরের পিঠে ২-৩ থা*প্পড় মেরেছে। তানভির সঙ্গে সঙ্গে বসে পরেছে। যতটা ব্যথা পেয়েছে তার থেকেও বেশি চিৎকার করছে,
“আল্লাহ আমি শেষ”

হালিমা খান, মালিহা খান দুজনেই ছুটে এসে উত্তেজিত কন্ঠে শুধান,
“এই কি হয়ছে তোদের? তানভিরকে মার*তেছিস কেন?”
মেঘ মীমরাও ছুটে আসছে। মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ভাইয়াকে এভাবে মারছেন কেন? ব্যথা পাচ্ছে না?”
আবির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আহাগো! আসছে তাহার দরদী বোন। তোর ভাই যে অপরাধ করছে তারজন্য ওরে সারাদিন পেটানো দরকার। ”
“কি করছে?”
“তোদের বলা যাবে না। ”

হালিমা খান করুণ কণ্ঠে বললেন,
“তানভির কি করছে? খুব বড় অপরাধ করে ফেলছে?”
মামনির করুণ স্বর শুনে আবির তানভিরকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” তোমাদের কাছে কিছুই না কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। ”
হালিমা খান তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিরে? কি করছিস তুই?”
তানভির দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,

“তেমন কিছুই না, ভাইয়ার কলিজার হাত দিছিলাম”
বলেই তানভির রুমের দিকে ছুটে গেছে। আবির নিচে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” রুম থেকে বের হইস শুধু, তোর খবর আছে। ”
মালিহা খান সচেতন কন্ঠে বললেন,
“আবির কি হচ্ছে এসব ?”
“কিছু না।”

“তানভিরের পেছনে লাগছিস কেন?”
আবির ভারী কন্ঠে বলল,
“আমি ওর পেছনে লাগি নাই আম্মু। ও আমার পেছনে লাগছে। আর আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে তোমরা ঢুইকো না প্লিজ।”
“ঠিক আছে ঢুকলাম না। তোদের যা মন চাই কর।”
“ধন্যবাদ। ”
আবির নিজের রুমে চলে গেছে। তানভির কিছুক্ষণ পর রুম থেকে বের হয়েছে। বেলকনিতে মেঘকে পেয়ে ধীর কন্ঠে শুধালো,
“ভাইয়া কোথায় রে?”

“রুমে। কেন?”
“একটু দেখা করে আসি।”
“ভাইয়া, তুমি যাইয়ো না। আবির ভাই তোমাকে মা*রবে।”
“আরে না। কিছু করবে না। ”
মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
“যাও, মা-ইর খাওয়ার শখ লাগছে যখন খেয়ে আসো।”
তানভির হেসে চলে গেছে । আবির দরজা থেকে গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে ডাকল,
“ভাইয়া….!”
আবির বই পড়তেছে। তানভির আবারও ডাকলো,
“ও ভাইয়া…!”
“কি হয়ছে?”
“আসবো?”
“কেন?”
“একটু আসি”
“আয়।”

তানভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমার সাথে রাগ করার মতো আমি কিছু করি নি।”
আবির গুরুতর কন্ঠে বলল,
” পার্সেলের টেনশনে আমার মাথা পুরা নষ্ট হয়ে গেছে। ১০-১২ দিন ধরে তন্নতন্ন করে মানুষটাকে খোঁজছি আর তুই রিলাক্সে বসে আছিস ”
“তুমি আমায় বলতা”
“জানিস তো, আমার কাউকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে ভালো লাগে না!”
“আচ্ছা সরি। আমি ভাবছি তুমি পার্সেলের বিষয় ভুলে গেছো।”
“তোর বোনকে ঘিরে সামান্যতম বিষয়ও আমি ভুলতে পারি না।”

“এত যত্ন, এত ভালোবাসা থাকা স্বত্তেও রাগ দেখাও কেন? দিনের পর দিন দু’জনে গাল ফুলিয়ে রাখো কেন?আর ঐদিন পার্সেল পাঠাইছিলাম বলেই তো বনুতে এত সুন্দর সারপ্রাইজ দিয়েছো। ”
আবির হঠাৎ ই সিক্ত আঁখিতে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ৷ কিন্তু আমার খুব ভয় হয়৷ ও কে হারানোর ভয় সর্বক্ষণ আমার মনে ঘুরপাক খায়৷ কি করি না করি নিজেই বুঝি না। ”
তানভির শান্ত স্বরে বলল,
“টেনশন করো না৷ ইনশাআল্লাহ সবকিছু ঠিক থাকবে।”
মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,

“আসব?”
তানভির আবিরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” আমার বোন এখন এই রুমে আসতে অনুমতি নিচ্ছে, অথচ কয়দিন পরে তোমাকেই রুম থেকে বের করে দিবে৷ ভাবতেই ভাল্লাগছে।”
এতক্ষণে আবিরের মুখে হাসি ফুটলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই মেঘকে বলল,
“আসেন।”
মেঘ রুমে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

“আপনাদের দুই ভাইয়ের মান-অভিমান ভাঙছে?”
তানভির উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আমরা দুই ভাই কখনো অভিমান করিই না। ”
মেঘ কপাল গুটিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“খুঁটা দিলা?”
তানভির থমথমে কন্ঠে বলল,
“ছিঃ আমার বোনকে আমি খুঁটা দিতে পারি?”
মেঘ শীতল কণ্ঠে জানালো,
“আমি কিন্তু যার তার সাথে অভিমান করি না। যে আমার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করে তার সাথেই অভিমান করি।”
তানভির হেসে বলল,

” তোর অভিমান নিয়ে আমি কিছু বলি না আর বলবোও না৷ তোর ইচ্ছে হলে ২৪ ঘন্টা অভিমান করে বসে থাকবি৷ আর মানুষ তোর অভিমান ভাঙাবে। ”
আবির গম্ভীর মুখ করে তানভির কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আজ অভিমান করতে পারি না বলে কারো কাছে পাত্তা পায় না। ”
তানভির রাশভারি কন্ঠে বলল,

“হইছে তোমার আর অভিমান করতে হবে না। একেকজনের ঢং দেখলে বাঁচি না।”
দুদিন পর আবির মেঘকে পার্সেলটা দিয়েছে। পার্সেল দেয়ায় মেঘ সরু নেত্রে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“পার্সেল দিয়ে দিচ্ছেন যে! কে পাঠাইছে? ”
“তা জেনে তোর কাজ কি? নিলে নে না নিলে নাই”
মেঘ পার্সেল নিয়ে রুমে চলে গেছে। পার্সেলে বই, চকলেট, ছোট ছোট গিফটে বরা একটা বক্স ছিল।

এক সপ্তাহ কেটে গেছে৷ আজ মেঘের মন টা খারাপ, ক্লাসে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে তাই বন্যার সাথে বসতেও পারে নি। একা একা মন খারাপ করে ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে আসছে৷ সেমিনারে বন্যা আর মিষ্টির সঙ্গে হাঁটছিল আচমকা মিনহাজ পেছন থেকে মেঘের মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল,
“এই পঁচা মেয়ে ”
মেঘ মাথায় হাত বুলিয়ে পেছনে তাকাতেই মিনহাজ প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,
“তুই আমায় ব্লক দিছিস কেন?”
মেঘের এমনিতেই মেজাজ খারাপ তারউপর মিনহাজের উল্টাপাল্টা কথা শুনে মেঘের মেজাজ আরও বেশি খারাপ হচ্ছে৷ মেঘ অদম্য কন্ঠে বলল,

” আমি তোকে ব্লক দিব কেন? আর কোথা থেকেই বা দিব?”
“তুই আমাকে ফে*সবুকে ব্লক দিছিস ”
“দূর, আমি ব্লক দেয় নি। জ্বালাস না আমায়৷ এমনিতেই মন ভালো না”
“তুই ব্লক দিছিস। বিশ্বাস না করলে চেক কর।”
“ইশশশ আমি গত দুইদিন যাবৎ ফেসবুকে ঢুকি না। তোকে ব্লক দিব কিভাবে?”
“আমি গতকাল রাতে তোকে মেসেজ দিছি তার কিছুক্ষণ পর দেখি তুই আমায় ব্লক মারছিস।”
“বাজে কথা বলিস না মিনহাজ। ”

“তুই তোর ফোন বের কর, ব্লকলিস্ট চেক কর তাহলেই হবে।”
মেঘ ফোন বের করে বন্যাকে দিয়ে সাইডে চলে গেছে৷ মন খারাপ থাকলে কারো সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করে না সেখানে হাঙ্গামা করা তো দূরের বিষয়। বন্যা ফে*সবুকে ঢুকেই মেঘের ব্লকলিস্টে ঢুকলো৷ ব্লকলিস্টের প্রথম আইডিটায় মিনহাজের। বন্যা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“মেঘ, সত্যি সত্যি মিনহাজকে ব্লক দেয়া। ”
মেঘ বিরক্তির স্বরে বলল,

“আমি কাল ফে*সবুকে ঢুকিই নাই”
বন্যা এবার শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
“মিনহাজ, কি হয়ছিল পুরো ঘটনা বল”
মিনহাজ বলা শুরু করল,
” মেঘকে মাঝে মাঝেই আমি মেসেজ দেয়। ওর মন চাইলে রিপ্লাই করে না মন চাইলে করে না৷ দুদিন ভার্সিটি বন্ধ ছিল৷ ভাবলাম একটু স্মরণ করি। গত পরশু দিন মেসেজ দিছি নেটে আসে নি। গতকাল মজার ছলে মেসেজ দিছিলাম, “Baby, I miss you” তারপর নেট থেকে বেরিয়ে খেতে গেছি৷ খেয়ে এসে নেটে ঢুকতেই দেখি মেঘের আইডি থেকে ব্লক দেয়া। ”
মেঘ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানাল,

“আমি নেটে ঢুকিও নি আর এমন কোনো মেসেজ দেখিও নি”
বন্যা একটু ভেবে প্রশ্ন করল,
“তোর আইডির পাসওয়ার্ড কেউ জানে?”
“না তো। কে জানবে?”
“তোর আইডি কে খুলে দিছিল?”
মেঘ সহসা বলল,
“ভাইয়া”
“পাসওয়ার্ড পাল্টাইছিলি পরে?”
“নাহ”
“তাহলে তানভির ভাই..”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৭

মেঘ আচমকা চটপটে স্বরে বলল,
“না না! ভাইয়া না, আবির ভাই আইডি খুলে দিছিলো।”
বন্যা, মিষ্টি, মিনহাজ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মিষ্টি একটু পর মৃদু হেসে বলল,
“মেঘরে তুই শেষ! মিনহাজকে ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্লক দিয়ে দিছে মানে তোর আবির ভাই সর্বক্ষণ তোকে চোখে চোখে রাখছে৷ যাহ তুই সাকসেস! সাথে তোর ভালোবাসাও।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৯