আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫০

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫০
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবিরকে, রাকিব আর রাসেল মিলে কলের পর কল দিচ্ছে কিন্তু আবির একবারের জন্যও কল ধরছে না। প্রথম দিকে আবিরের ফোনে কল ঢুকলেও কিছুক্ষণ পরই আবির ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। মিষ্টি, সাদিয়া আর লিজা একে অপরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। বন্যা বিড়বিড় করে বলল,
” তোদের সাবধান করেছিলাম, একবারের জন্যও কথা শুনলি না। ”
ওরা একসঙ্গে বলল,
“সরি দোস্ত। ”

রাকিব, মিনহাজ আর তামিমের দিকে তাকিয়েই দেখছে না। পাবলিক প্লেসে মারছিল বলে বাধ্য হয় তানভিরকে তখন আঁটকিয়েছিল রাকিব। না হয় তানভিরের সাথে সাথে রাকিবও দুটাকে পিটাইতো।ওদের প্রতি প্রায় ৫ মাসের ক্ষোভ জমে আছে রাকিবের মনে । রাকিবের কলিজার বন্ধু আবির, আবিরের সবকিছুতে রাকিব যেমন সবার আগে এগিয়ে আসে তেমনি আবিরও তাই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোট বেলা থেকেই ওদের ফ্রেন্ডশিপ অনেক স্ট্রং। সচরাচর দেখা যায় এক বন্ধু ঝগড়া লাগলে আরেক বন্ধু থামায় অথচ ওদের মধ্যে এমন সম্পর্ক যে একজন ঝগড়া লাগলে আরেকজন সঙ্গ দেয়। দুজন মিলে ঐ ছেলেকে মারে। কলেজ জীবনে রাকিব টুকিটাকি রাজনীতি করতো, কিন্তু আবিরের সেসবে কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। তবে রাকিবের সাথে যে ই লাগতে আসতো দুই বন্ধু মিলে ঐটার অবস্থা খারাপ করে ফেলতো।

পরবর্তীতে কলেজের পরীক্ষায় রাকিবের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আবির বুঝিয়ে শুনিয়ে রাকিবকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনেছিল৷ এখনও কলেজের অনেক বন্ধুরা রাকিবকে লিডার বলে ডাকে। রাকিব আবিরকে কল দিয়েই যাচ্ছে, এই সুযোগে রাসেল চোখের ইশারায় মিনহাজ আর তামিমকে চলে যেতে বলল। কারণ তানভির যদি বাই চান্স আবার এখানে আসে আর মিনহাজদের সামনে পায় তাহলে এবার আর ওদের বাঁচানো যাবে না। তামিম মিনহাজকে নিয়ে চলে গেছে। রাকিব কিছুক্ষণ পর বিষয়টা খেয়াল করেছে তবুও রাসেলকে কিছু বলে নি। রাকিবের সব টেনশন এখন আবিরকে নিয়ে। শহরের আশেপাশে যত বন্ধু আছে একে একে সবাইকে কল দিয়ে জানিয়েছে। যাদের বাইক আছে তারা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। রাকিব এগিয়ে গিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করে বন্যাকে বললো,

“তুমি বাসায় চলে যাও”
বন্যা “আচ্ছা” বলে চলে গেছে। রাকিব বাকিদের উদ্দেশ্যে রেগে বলল,
“তোমরা যাও এখন”
রাকিবের রাগী স্বর শুনে ওরাও মাথা নিচু করে চলে গেছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে রাসেলের গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে৷ রাকিব রাসেলকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। তানভির মেঘকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে, একটা কথাও বলে নি। রাকিবরা প্রায় ১ ঘন্টা যাবৎ আনাচে কানাচে ঘুরছে অথচ আবির একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কেউ আবিরের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না।
বন্যা বাসায় গিয়েই মেঘকে কল দিল। মেঘ রিসিভ করতেই বলল,

“কিরে তুই ঠিক আছিস?”
মেঘ মৃদুস্বরে বলল,
“আমি ঠিক আছি কিন্তু আবির ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ”
“তুই আবির ভাইয়া কে কল দে”
“আমার ভয় লাগতেছে।”
“এখন ভয় লাগে কেন? এতদিন বারণ করার পরও তো একটু ভয় লাগলো না”
“আমি এখন কি করবো?”
” আবির ভাইয়াকে কল দে আর কিছু করতে হবে না। ”
” ওনি কি কল ধরবেন?”
“ধরবেন কি না সেটা দিলেই বুঝবি। তুই ওনাকে রাগাইছিস তোকেই শান্ত করতে হবে। ”
“আমি পারবো না। ভয় লাগতেছে। ”
“আর একটা কথা বললে তোর খবর আছে বলে দিলাম। মিনহাজ, মিষ্টিদের কথায় লাফানির সময় ভয় ডর কোথায় ছিল তোর?”

“আচ্ছা দিচ্ছি কল।”
বন্যার কল কেটেই মেঘ আবিরের নাম্বার বের করল। ভয়ে বুক কাঁপছে অবিরাম। ৫ মিনিট অপেক্ষার পর বুকে সাহস নিয়ে আবিরের নাম্বারে ডায়াল করল। আবিরের ফোন বন্ধ পেয়ে আঁতকে উঠলো মেঘ। বার বার কল দিতে লাগলো। ভয় আর দুশ্চিন্তা তিনগুণ বেড়ে গেছে। রাকিব, রাসেল, তানভির এদিকে মেঘ সবার একাধারে কল দেয়ার কারণে একবার নেটওয়ার্ক বিজি বলছে আবার বন্ধ বলছে। মেঘ আজ পর্যন্ত যতবার আবিরকে কল দিয়েছে কোনো সময় ফোন বন্ধ পায় নি আজই প্রথম আবিরের ফোন বন্ধ। মেঘ রাগের চোটে কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রায় ১৫ মিনিট একের পর এক কল করতে করতে অবশেষে একটু থামলো। ভয়ে ভয়ে কল করলো তানভিরকে। তানভির কল রিসিভ করতেই মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

” আবির ভাইয়ের কোনো খোঁজ পেয়েছো ভাইয়া?”
তানভির ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” না, বাসায় আপাতত কিছু বলিস না।”
“আচ্ছা”

তানভির কল কেটে দিয়েছে। মেঘের টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ এখনও আবিরের কোনো খবর নেই৷ আজ বাসায় তেমন মানুষও নেই। মীমের নানু খুব অসুস্থ তাই মীমরা দুদিন হলো ওদের নানুবাড়িতে গেছে। ইকবাল খান মীমদের নিয়ে গেছেন এখনও বাসায় আসেন নি। হালিমা খান আর মালিহা খান বাসায় আছেন। আলী আহমদ খান অফিসে। মোজাম্মেল খান আজ সকালেই রাজশাহী গেছেন।

মেঘ উপুড় হয়ে শুয়ে ফোনে আবিরের ছবি দেখছে আর অঝোরে কাঁদছে। মেঘের বর্তমান বয়সটায় দোষের৷ এই বয়সে এমন ঘটনা ঘটানো অস্বাভাবিক কিছু না। আবির ভাইয়ের প্রতি বেধক আবেগ, ভালোবাসি শুনার তীব্র আকাঙ্খায় যে যা বলেছে সব শুনেছে। নিজের করা ভুলের জন্য এখন খুব প্রস্তাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চললো কিন্তু আবিরের কোনো হদিস নেই। আলী আহমদ খান ৭ টার দিকে বাসায় ফিরেছেন। আলী আহমদ খান নিজেও আবিরকে ২-৩ বার কল দিয়েছেন। আবিরের ফোন বন্ধ পেয়ে বাসায় এসে মালিহা খানকে শুধালেন,

“আবির কি বাসায় আসছে?”
“এখনও আসে নি ”
“ওর ফোন বন্ধ কেন? তোমার সাথে কথা হয়েছে?”
“নাহ। হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। তুমি দুশ্চিন্তা করো না”
আলী আহমদ খান অল্প নাস্তা করে শুয়ে পরেছেন। একটু পর মেঘের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো। প্রথম বার রিসিভ করল না। দ্বিতীয় বার রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাকিব আতঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,

“আবির, কোথায় তুই?”
মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আমি মেঘ৷ ”
“মেঘ আমি তোমার রাকিব ভাইয়া”
“জ্বি ভাইয়া, চিনতে পারছি। ”
রাকিব কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
“আবির কি বাসায় গেছে?”
মেঘ আকুল স্বরে বলল,
“এখনও আসে নি। ওনি কোথায় আছে ভাইয়া?”
রাকিব তটস্থ হয়ে বলল,
” আবির বাসায় যায় নি? তাহলে এই নাম্বার? ”
‘এটা আমার নাম্বার। ভাইয়া সীমটা আমায় দিয়েছিল ”
রাকিব শান্ত স্বরে বলল,

“ওহ আমি জানতাম না, সরি। আসলে এই সীম টা আগে আবির ইউজ করতো। দেশের বাহিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটায় ওর নাম্বার ছিল। পরে নতুন সীম নিয়েছে। এত বছর যাবৎ নতুন সীম গুলোতেই যোগাযোগ করে আসছি। আজ ওর ফোন বন্ধ পেয়ে অনেক খোঁজে এই নাম্বার টা পেয়েছি৷ এই সীম তাহলে তোমায় দিয়ে দিছে!”
মেঘের মাথায় এবার আকাশ ভেঙে পরেছে। প্রায় ২-৩ বছর যাবৎ মেঘ এই সীম ইউজ করছে। ভেবেছে তানভিরের সীম তাই তেমন মাথাও ঘামায় নি। অথচ এই সীম আবির ভাইয়ের। এক মুহূর্তেই মেঘের চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামান্য ভালোবাসার কথা শুনার জন্য মেঘ এতটা উতলা হয়ে ছিল অথচ মেঘের সবকিছু জুড়েই আবিরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে৷ আবির ভাই তাকে সবদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে৷ মেঘ করুণ স্বরে বলল,

“ওনার খোঁজ পেলে আমায় জানাবেন, প্লিজ। ”
“অবশ্যই। রাখছি ”
রাকিব কল কেটে দিতেই মেঘ ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নিজের উপর এত রাগ হচ্ছে যে কি করতে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্লোরে বসে দু’হাতে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে অপরিচ্ছিন্নভাবে কেঁদেই চলেছে।
রাত প্রায় ৯ টার পর তানভির হঠাৎ হালিমা খানকে কল দিল। তানভিরের কথা শুনে হালিমা খান আর্তনাদ করে উঠলেন। তানভির কল কাটতেই হালিমা খান ছুটে গেলেন মালিহা খানের কাছে, মেঘকে অবিরত ডাকতে লাগলেন। মেঘ চোখ মুছে বেলকনিতে আসতেই দেখল বড় আব্বু, বড় আম্মু বাসা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। হালিমা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

“মেঘ তাড়াতাড়ি আয়, আমাদের বের হতে হবে।”
“কোথায়?”
“তুই আয় আগে।”
মেঘ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“রেডি হতে হবে না? ”
“না। যেভাবে আছিস সেভাবেই চল।”
মেঘ দ্রুত নেমে আসলো। হালিমা খান বাসা তালা দিয়ে গাড়িতে বসলেন। মালিহা খান শীতল কণ্ঠে শুধালো,
“কে অসুস্থ? বললে না তো!”
মেঘ বুকটা ছ্যাত করে উঠল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। ফোন টাও বাসায় ফেলে আসছে। আবির ভাইয়ের খোঁজ পায় নি এখনও। মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কথা বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। হালিমা খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

” হাসপাতালে গিয়ে দেখি। ”
মালিহা খান আর্তনাদ করে উঠলেন,
“আমাদের কারো কিছু হয়েছে?”
হালিমা খান তানভিরকে কল দিয়ে হাসপাতালের ডিটেইলস নিয়েছে। মালিহা খানের কথার কোনো উত্তর দেন নি। জ্যাম পেরিয়ে হাসপাতালে আসতে আসতে ১০ টার উপরে বেজে গেছে। হাসপাতালের সামনেই রাকিব দাঁড়ানো ছিল৷ সবাই নামতেই রাকিব রাস্তা দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘ হাঁটছে ঠিকই তবে হাঁটায় কোনো গতি নেই। অক্লিষ্ট আঁখিতে মেঘ রাকিব ভাইয়াকে দেখছে।

রাকিবের শার্টে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে শার্ট টা ভেজা। মেঘের পা চলছে না, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। মাথা ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছে। কোনোরকমে ওদের পেছন পেছন একটা রুমের দরজা পর্যন্ত এসেই সবাই থমকে দাঁড়ালো। প্রাইভেট ক্লিনিকের একটা ছিমছাম রুমের বেডে বেহুঁশ অবস্থায় শুয়ে আছে আবির। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ, ডান হাতে, ডানপায়ে ব্যান্ডেজ করা। আবিরকে এ অবস্থায় দেখে ছুটে গিয়ে মালিহা খান আবিরকে ধরে বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন। আলী আহমদ খান করুণ দৃষ্টিতে ছেলেকে কিছুক্ষণ দেখে আশপাশে নজর দিলেন৷ তারপর ভারী কন্ঠে রাকিবকে শুধালেন,

“কি হয়ছিল?”
“বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।”
আলী আহমদ খান সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” বাইক কিনার সময় ই বলছিলাম, এক বারের জন্যও আমার কথা মানলো না। ”
আলী আহমদ খান আবারও হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“তানভির কোথায়?”
রাকিব আস্তে করে বলল,
“ইম্পর্ট্যান্ট কাজে গেছে।চলে আসবে।”
“ওর কি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কাজ? ”

রাকিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বলছে না। এদিকে মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে, এক চুল নড়ছে না। মেঘের অবিক্ষিপ্ত আঁখি যুগল আবিরের পরিশ্রান্ত চেহারায় আঁটকে আছে। হালিমা খান, মালিহা খান অঝোরে কেঁদেই চলেছেন কিন্তু মেঘের চোখে এক ফোঁটা পানি নেই, পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে, নেই কোনো অনুভূতি। তানভির হালিমা খানকে ফোন করে আগেই সবটা জানিয়েছিল,হালিমা খানকে শক্ত থেকে মেঘ সহ বড় আব্বু, বড় আম্মু কে নিয়ে আসতে বলছিল। তাই হালিমা খান বুকে পাথর চেপে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। আবিরের জ্ঞান ফিরছে না, ডাক্তার বলেছেন মাথায় চাপ খাওয়ায় ঘন্টা কয়েক সময় লাগবে। আপাতত হাসপাতালেই রাখতে বলেছেন।

এরমধ্যে তানভির আসছে। হালকা রঙের শার্ট টা রক্তের দাগে কালো খয়েরী রঙ ধারণ করেছে। দুহাতে, পায়ে, গায়েও রক্ত লেগে আছে৷ কিছু রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে আর কিছু দাগ এখনও ভেজা। এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে তানভির সবার আগে আবিরের কাছে পৌছেছিল৷ রাস্তায় স্প্রীড ব্রেকারের কাছে আবিরের রক্তাক্ত দেহ নিথর হয়ে পরে ছিল৷ টকটকে লাল রক্তে অর্ধেক রাস্তা ভরে গিয়েছিলো। তানভির আবিরকে একায় এম্বুলেন্সে উঠিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে আসছে। হাসপাতালে রাকিব আর রাসেল আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। রাকিব আর তানভির মিলে আবিরকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছিল। আবিরের চিকিৎসা শুরু করা মাত্র তানভির এই অবস্থাতেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে। আবিরকে রুমে দেয়ার পরপরই রাকিব রাসেলকে বাসায় পাঠিয়েছে, রাকিবের টিশার্ট আর অন্যান্য কিছু জিনিস নিয়ে আসছে। তানভির রুমে ঢুকতেই আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,

“কোথায় ছিলে?”
তানভির শার্টের হাতার ফোল্ড খুলতে খুলতে গম্ভীর স্বরে বলল,
“কাজ ছিল।”
“তোমার ভাইকে একা ফেলে যাওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল?”
তানভির রাগী স্বরে বলল,
“হয়তো।”
তানভির হালিমা খানকে আগেই বাসা থেকে ড্রেস আনতে বলেছিল। তানভির ব্যাগ থেকে একটা টিশার্ট আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে চলে গেছে। আলী আহমদ খান পাশে একটা চেয়ারে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন। একমাত্র ছেলে এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় পরে থাকলে কোনো বাবা মা ই ঠিক থাকতে পারেন না। এরমধ্যে মোজাম্মেল খান কল দিয়েছেন। আলী আহমদ খান ফোন রিসিভ করতেই মোজাম্মেল খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

“ভাইজান, কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ। বাসার সবাই কেমন আছে?”
“কেমন আর থাকবে। তোর ভাতিজা এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে পরে আছে। ”
“কে আবির?”
“হ্যাঁ”
“কবে? কিভাবে?”
“আজকেই,কিছুক্ষণ আগে। কিভাবে এক্সিডেন্ট করছে এটা ছেলের জ্ঞান ফিরলে বলতে পারবো। এখনও জ্ঞান ফিরে নি।”
“আমি রওনা দিব এখন?”

“নাহ। ডাক্তার বলছেন তেমন সমস্যা নেই। কয়েক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। তাছাড়া কাল পরশু নাগাদ হয়তো বাসায় নিয়ে যেতে পারব। তুই কাজ শেষ করেই আয়।”
“আচ্ছা। তানভিরের কি অবস্থা? ”
“ওর অবস্থা আমি বলতে পারবো না। আবিরকে হাসপাতালে এনে কোথায় গেছিলো কে জানে মাত্র আসছে। ”
“তোমরা সাবধানে থেকো। আর আমি তানভিরের সাথে কথা বলে নিব।”
রাত ১২ টা বাজতে চললো আবিরের এখনও জ্ঞান ফিরে নি৷ তানভির আর রাকিব হাসপাতালের বেলকনিতে বসে আছে। মেঘ আবিরের পায়ের কাছে বসে আছে, হালিমা খান, মালিহা খান দুজনেই আবিরের পাশে বসে আছেন।তানভির রুমে এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“তোমাদের এখানে থাকতে হবে না। আমি আর রাকিব ভাইয়া আছি। কোনো সমস্যা হলে জানাবো।”
মালিহা খান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
“আমি যাব না এখানেই থাকবো। আবিরের জ্ঞান ফিরবে কখন?”
“ডাক্তার বলছেন একটু সময় লাগবে৷ অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। ”
“জ্ঞান না ফিরলে আমি বাসায় যাব না। ”
“বড় আম্মু প্লিজ এমন করো না। তুমি অসুস্থ তাছাড়া বড় আব্বুরও পর্যাপ্ত রেস্ট নেয়া দরকার। তোমরা বাসায় গিয়ে ঘুমাও। সকালে রান্না করে খাবার নিয়ে এসো।”

মালিহা খানের আপত্তি স্বত্বেও তানভির হালিমা খানকে চোখের ইশারায় বুঝালো, ওনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। মেঘ মাথা নিচু বসে আছে। তানভির মেঘকে উদ্দেশ্য করে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আম্মুরা বাসায় যাচ্ছে তুই ও বাসায় চলে যা। ”
মেঘ মাথা নিচু করেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আমি কোথাও যাব না।”
” সমস্যা নেই, আমরা আছি, তুই বাসায় যা।”
“আমিও থাকবো।”
তানভির শক্ত কন্ঠে বলল,
“মেঘ”

মেঘের চোখ টলমল করছে, চোখ তুলে তাকালো তানভিরের দিকে৷ করুণ স্বরে বলল,
“প্লিজ ভাইয়া, আমি থাকি। ”
তানভির গম্ভীর কণ্ঠে মেঘকে বুঝানোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু মেঘ যাবে না মানে যাবেই না। বাধ্য হয়ে তানভির আম্মু, বড় আম্মু আর বড় আব্বুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসছে। হালিমা খান মেঘকে নিয়ে যেতে চাইলে তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বনু থাকতে চাচ্ছে থাকুক। তাছাড়া তোমরা তো সকালে আসবেই। তুমি বড় আব্বু আর বড় আম্মুর খেয়াল রেখো৷ ”
“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। আর মেঘকে দেখে রাখিস৷ ”
“আচ্ছা যাও তোমরা। ”

ওরা চলে যেতেই বন্যার নাম্বার থেকে তানভিরের ফোনে কল আসছে। তানভির কল রিসিভ করতে করতে ভেতরে গেল।
বন্যা উতলা হয়ে শুধালো,
“আবির ভাইয়া কেমন আছেন? ”
“আমার ভাইয়ের খবর নেয়ার কি দরকার। চিন্তা করো না, তোমাদের আশা পূরণ হয়েছে।”
“মানে?”
“ভাইয়া এক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। ”
“কি বলছেন এসব!”
“তোমরা তো এটায় চাইছিলে।”
বন্যা মলিন স্বরে বলল,

“বিশ্বাস করুন আমি এমন কিছু চাই নি। ওরা মজা করছিল আর.. ”
তানভির হুঙ্কার দিল,
“তুমি ওখানে কি করছিলে? তুমি মেঘকে বারণ করতে পারলে না?”
“ও আমার কথা শুনে নি। আমি বারণ..”
“কিসের বেস্ট ফ্রেন্ড তুমি? বারণ করা স্বত্তেও বনু তোমার কথা অমান্য করে কিভাবে?”
বন্যা আস্তে করে বলল,
“মেঘ কোথায়?”
“আছে৷ ”

“ও কে একটু দেয়া যাবে?”
” কি দরকার? কথা যখন মানাতেই পারো নি তাহলে এখন আর কথা বলতে হবে না।”
“একটু দরকার ছিল। ”
“কি দরকার আমায় বলো।”
“মিনহাজ আর তামিমকে ফোনে পাচ্ছি না৷ ওদের সাথে মেঘের কথা হয়েছে কি না জানতাম।”
“মিনহাজ আর তামিম যেখানে থাকার সেখানেই আছে। বনুর সাথে কথা হয় নি। শান্তি?”
“মানে? কি করেছেন ওদের?”

“যা করার তাই করেছি। আগামী তিনদিন তাদের কোনো খোঁজ পাবে না। ”
“কি বলছেন কি এসব? কি করেছেন ওদের? ওরা কোথায়?”
“ওদের প্রতি ভীষণ দরদ দেখা যাচ্ছে! তোমার যদি দুদিনেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রতি দরদ উথলায় পড়ে তাহলে ভাবো ওদের জন্য আমার ভাই এক্সিডেন্ট করছে। যে ভাইয়ের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক, জন্মের পর ২৪ বছর যাবৎ ভাইয়ার ছায়ায় আমি বড় হয়েছি। ভাইয়া আমার জীবনে বন্ধুর থেকেও কয়েকগুণ বেশি কিছু৷ ফারদার যদি বন্ধুদের খোঁজ নিতে আমায় কল করেছো তাহলে তোমার খবর আছে বলে রাখলাম”

তানভির কল কেটে মেঘের কাছে আসছে৷ মেঘ তখনও আবিরের পায়ের কাছেই বসে ছিল। তানভির রুমে এসে তপ্ত স্বরে বলল,
“তুই ভাইয়ার কাছে থাক। আমি আর রাকিব ভাইয়া বাহিরে আছি। কোনো ধরনের সমস্যা হলে ডাকিস। ”
“আচ্ছা। ”
তানভির রুমের লাইট অফ করে একটা ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে যেতে নিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দরজা টা ভেতর থেকে বন্ধ করে দে।”

তানভির চলে যেতেই মেঘ এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। হালকা সবুজ রঙের আলোতে আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে রইলো মেঘ। নিস্তব্ধ পরিবেশে আবিরকে দেখে ভেতর ফেটে কান্না আসছে মেঘের। আচমকা আবিরের পাশে বসে আবিরের বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করেছে। দীর্ঘসময় ধরে অঝোরে কাঁদছে, মেঘের চোখের পানিতে আবিরের বুক ভিজে গেছে। কত সময় ব্যাপী মেঘের গভীর ক্রন্দন চললো তা জানা নেই। শ্বাস ছেড়ে কান্নারত অবস্থায় বলতে শুরু করল,

“আমি মিনহাজকে পছন্দ করি না। একটুও করি না। আপনাকে ছাড়া আমি কাউকে পছন্দ করি না। আপনি আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। আবির ভাই কে ছাড়া মেঘ একেবারে নিঃস্ব । বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি৷ আপনাকে আমি এভাবে দেখতে চাই নি। আমি শুধু আপনার মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চেয়েছিলাম আর কিছুই চাই নি আমি।

মিনহাজরা আমায় বুঝিয়েছিল আমি এমন আচরণ করলে আপনি আমায় ভালোবাসি বলবেন, আপনার মনের কথা আমায় জানাবেন৷ ওদের কথা মেনে আমি আপনার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করছি। আমায় মাফ করে দেন প্লিজ৷ আমি আর জীবনেও কারো কথা শুনবো না৷ আপনি ভালো না বাসলেও আমি কোনোদিন বাড়াবাড়ি করবো না। আমি সারাজীবন আপনাকে এক তরফা ভালোবাসবো। কোনোদিন কোনো অধিকার দেখাবো না। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন প্লিজ। আপনি অসুস্থ থাকলে আপনার চড়ুই এর কি হবে!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ আবার বলতে শুরু করলো,
“ছোট বেলা আপনি আমায় একটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন বলে আমি আপনার সাথে দিনের পর দিন কথা বলি নি৷ আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন তবুও আমি বলি নি। আপনি তারপরও আমায় নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেই গেছেন। দেশে ফেরার সময় সবচেয়ে বেশি গিফট আমার জন্যই নিয়ে আসছেন৷ আপনি বাইক কিনে বাসায় আসার পর প্রথমবার আপনাকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেছিলো।

সেদিন আমি প্রথমবারের মতো আপনার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করেছিলাম। তারপর থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে আপনার প্রতি দূর্বল হতে শুরু করি। দেখতে দেখতে সেই দূর্বলতা কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারি নি। আপনি আমার কাছাকাছি থাকলে আমার আকাশে রংধনু উঠে, মনটা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়৷ আপনি দূরে চলে গেলেই মনের উঠোনে বৃষ্টি নামে৷ ক্ষণে ক্ষণে আপনি নিজের অজান্তেই আমায় নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছেন।

আপনি হয়তো জানেন ও না আপনাকে দেখার জন্য প্রতিদিন কত ঘন্টা বেলকনিতে অপেক্ষা করি, কত রাত নির্ঘুম কাটায়। আপনার এক ঝলক হাসি দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা আপনার অভিমুখে চেয়ে থাকি। আপনার প্রতি এতবছরের ক্রোধ কয়েক মাসেই কিভাবে যেন প্রণয়ে রূপ নিয়েছে। এখন রাগ করলেও সেই রাগ বেশিসময় স্থির হয় না। আপনার একটু যত্নেই সব ভুলে যায়। কিন্তু সব ভুলে গেলেও আপনার আশেপাশে কোনো মেয়ের ছায়া আমি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারি না৷ মালা আপু,এমপির মেয়ের আচরণে আমায় যতটা রাগিয়েছিল তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম, যেদিন আপনি বলেছিলেন আপনি বিবাহিত, একটা বাচ্চা আছে।

তখন ২ রাত আমি শুধু কেঁদেই ছিলাম। আপনার অনাদেয় কর্মকাণ্ড আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে মিনহাজদের তালে তাল মিলিয়েছিলাম। আপনার অধিকারবোধ আমায় বরাবরই আকৃষ্ট করে। তবে আজ কেন অধিকার দেখান নি? আমি আপনার কথায় “হ্যাঁ” বলেছিলাম যাতে আপনি আপনার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন। আপনি তখন আমায় দুটা থাপ্পড় দিয়ে কেন কিছু বললেন না। কেন আপনি নিশ্চুপ থেকে নিজের ক্ষতি করেছেন?”

মেঘের কান্না ধীরে ধীরে কমে এসেছে তবে এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদঁছে৷ আবিরের বুকে মাথা রেখেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আজকের পর আর কোনোদিন কোনোপ্রকার বাড়াবাড়ি করবো না। আপনি যেভাবে চান, আমি সেভাবেই চলবো। আপনার ভালোবাসা আদায় করতে আর উঠেপড়ে লাগবো না। আপনি ভালোবাসলেও আমি আপনার, আপনি ভালো না বাসলেও আমি আপনার। তবুও প্লিজ সুস্থ হয়ে উঠুন। ”

গভীর রাত পর্যন্ত মেঘ আবোলতাবোল বলেই গেছে, আর আবিরকে ডেকেছে। ধীরে ধীরে মেঘ শান্ত হয়ে গেছে। ক্লান্তিতে আবিরের বুকে মাথা রেখে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরেছে। ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৫ মিনিট পর ঘুমের মধ্যে মেঘের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। সহসা পিটপিট করে চোখ মেলল আবির। জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ আগে, প্রেয়সীর আবেগজড়িত অনুদ্বিগ্ন অনুভূতি শুনতে ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রেখেছিল৷ আবির চোখ নামিয়ে তাকালো মেঘের ক্রন্দিত মুখের পানে। মৃদু আলোতে আবিরের প্রেয়সীকে দেখলো খানিকক্ষণ। সহসা চোখ বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস ছাড়লো।

এটা প্রথমবার নয়৷ মেঘ আবিরের জন্য প্রথমবার যখন কেঁদেছিল তারপর ১ সপ্তাহ গলা দিয়ে কথা বের হয় নি মেঘের। তখন মেঘের বয়স ৫ কি ৬ আর আবিরের বয়স ১২ কি ১৩ চলে। আবির তখন হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেছিল। টানা ১৫ দিনে উপরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অবুঝ মেঘের জীবনে আবির তখন একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল। আবির আর তানভিরের বয়সের পার্থক্য ২ বছর হওয়ায় তানভিরের স্মৃতি আবিরের মাথায় ছিল না।

তবে মেঘ জন্মের সময় আবির ৭-৮ বছরের ছিল বিদায় মোটামুটি বুঝতো৷ প্রথম বোন হওয়ায় মেঘকে সর্বোচ্চ আদরে রেখেছে আবির৷ মেঘের আদো আদো কন্ঠের ডাক এড়িয়ে খেলতে যাওয়ার সাধ্যি ছিল না আবিরের। সারাক্ষণ বাড়িতেই মেঘের সঙ্গে খেলতো। মেঘ ঘুমালে খেলতে বের হতো ৷ ৭-৮ বছর বয়সের ছেলের চোখে মেঘ তখন বোন মানে বোন ই ছিল৷ মেঘকে বোন ব্যতীত অন্য কোনো নজরে দেখে নি আবির। ধীরে ধীরে আবির, মেঘ বড় হতে শুরু করেছে। আবিরের যত্নে মেঘ তখন থেকেই আবিরের প্রতি উন্মাদ ছিল।

শিশুদের যারা বেশি আদর করে তারা তাদের সঙ্গেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হঠাৎ আবিরের অসুস্থতা ছোট্ট মেঘের মনেও গভীর আঘাত দিয়েছিল। আবির হাসপাতালে থাকাকালীন মেঘকে কেউ নিয়ে যায় নি ৷ ১৫ দিন পর আবিরের শারীরিক অবস্থা এতটায় দূর্বল হয়ে পরেছিল যে ডাক্তার চিকিৎসা চালাতেও হিমসিম খাচ্ছিলো। আবির কোনোকিছুতেই রেসপন্স করছিল না৷ হার্টবিট একেবারে কমে গেছিলো। কোনোকারণে ব্রেইনে প্রেশার পরেছিল। মৃত্যুর সময় অতি সন্নিকটে চলে আসছিলো৷ ডাক্তার সঠিক রোগ ধরতে পারছিল না, কোনো চিকিৎসা চলছিল না। নিরুপায় হয়ে ডাক্তার বাড়িতে জানিয়েছিল,

” আবির যদি নিজ থেকে রেসপন্স না করে তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
এই কথা শুনে বাড়ির সবাই হাসপাতালে হাজির হয়েছিল৷ সেদিন প্রথমবারের মতো ছোট্ট মেঘ আবিরের উপর উপুড় হয়ে পরে কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে মেঘ বলছিল,
“ভাইয়া উঠো, আমার সাথে খেলবে না?”
মালিহা খান কেঁদে বলেছিলেন,
“তোর ভাই হয়তো আর কোনোদিন তোর সাথে খেলতে পারবে না”
ছোট্ট মেঘ তখনই হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিল,

“চুপ করো, ভাইয়ার কিছু হবে না।”
আবিরকে শক্ত করে ঝাপ্টে ধরে আর্তনাদ করে বলেছিল,
“তোমার কিছু হলে আমার কি হবে! তুমি মরে গেলে কিন্তু আমিও মরে যাব। ভাইয়া উঠো। কথা বলো আমার সাথে।”
সবাই টেনেও মেঘকে আবিরের বুকের উপর থেকে উঠাতে পারে নি। মেঘ কাঁদতে কাঁদতে একটা কথায় বার বার বলছিল,

” তুমি মরলে আমায় নিয়ে মরবা। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমিও মরে যাব।”
মেঘের নিরন্তর কান্নায় হঠাৎ আবিরের জ্ঞান ফিরে, দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পিটপিট করে তাকাতেই একে একে চোখে পরে বাবা, মা, চাচ্চু, মামনির কান্নারত মুখমণ্ডল সেই সাথে অনুভব করে পিচ্চি দুই হাতের স্পর্শ। আবিরের জ্ঞান ফেরায় সবাই যখন আবির কে ডাকছিল মেঘও দু’হাতে আবিরের দু গালে আলতোভাবে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছি,
“ভাইয়া, কথা বলো। ওরা বলছে তুমি নাকি মরে যাবে। তুমি একবার বলো তোমার কিছু হবে না। ”
আবিরের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তবুও মেঘের কান্না দেখে মেঘের হাতে স্পর্শ করে অনেক কষ্টে বলেছিল,
“আমার কিছু হবে না।”

আলী আহমদ খান দ্রুত গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসছিলেন। ডাক্তার আবারও পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। আবিরের হার্টবিট আগের তুলনায় বেড়েছে দেখে ডাক্তার পুনরায় চিকিৎসা শুরু করেছেন। সেই থেকে আরও প্রায় ৭ দিন আবির হাসপাতালে ভর্তি ছিল। মেঘ একবারের জন্যও বাসায় যায় নি। সারাক্ষণ আবিরের মাথার কাছে বসে থাকতো।মেঘ ঘুমালে বাসায় নিয়ে যাবে বলে আবিরকে জরিয়ে ধরে ই ঘুমাতো। ৭ দিন পর আবিরকে বাসায় নিয়ে আসছে। আবির আগের তুলনায় অনেকটায় সুস্থ হয়ে গিয়েছিল।

বাসায় আসার পরও মেঘের আহ্লাদের কমতি ছিল না সারাক্ষণ আবিরকে দেখতো, আবির খেয়েছে কি না, ঔষধ খেয়েছে কি না, ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে কি না সব নজর রাখায় যেন মেঘের একমাত্র দায়িত্ব ছিল। ১২-১৩ বছর বয়সের কিশোরের মনে হঠাৎ করেই মেঘের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি জন্মাতে শুরু করল। জন্মের পর থেকে ৬-৭ বছর বয়স পর্যন্ত যাকে বোনের নজরে দেখে এসেছে হুট করেই তার প্রতি ভিন্ন এক টান অনুভব করতে শুরু করল। মেঘের আহ্লাদী কন্ঠে বলা প্রতিটা কথা আবিরের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। কিছুদিন পর আবির মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর একদিন সোফায় বসে টিভি দেখছিল। তখন মেঘ ছুটে এসে আবিরের পাশে বসতে বসতে বলছিল,

” ভাইয়া তুমি জানো তুমি সুস্থ হয়েছো কেন?”
“কেন?”
“আম্মুরা বলছে, তুমি শুধু আমার জন্য সুস্থ হয়েছো। আমি কান্না করছিলাম বলেই আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন৷ বুঝলা?”
আবির মলিন হেসে বলেছিল,
“এখন আমার কি করতে হবে?”
“তুমি সবসময় আমার সাথে খেলবা, আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে, আমাকে অনেক আদর করবা, আর কখনো আমায় ছেড়ে যেতে পারবা না। ”

আবির সেদিন মেঘের হাতে হাত রেখে গুরুতরভাবে বলেছিল,
“আজ,এই মুহুর্তে আবির মেঘকে কথা দিচ্ছে, আবির কোনোদিন তার মেঘকে ছাড়বে না। যাই হয়ে যাক না কেন, আবিরের প্রাণ মেঘেতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”
মেঘ বলেছিল,
“মনে থাকে যেন!”
আবির হেসে বলেছিল,
“তুই ভুলে গেলেও আমি কখনো ভুলবো না।”

সেদিন থেকে আবিরের মন মেঘেতে আঁটকে গেছে। আবির মেঘের টানে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিল। মেঘের আহ্লাদী আবদার আবিরকে মেঘের প্রতি সিরিয়াস করেছিল৷ ধীরে ধীরে আবির বড় হতে শুরু করেছে সেই সাথে মেঘের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। মেঘও তার ছোটবেলার স্মৃতি ভুলতে শুরু করেছে৷

এত বছর পর আবিরের মেঘ দ্বিতীয়বারের মতো আবিরের অসুস্থতায় এভাবে কাঁদছে। আবির গভীর ভাবনা শেষে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মেঘের অভিমুখে৷ মেঘ গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। চোখের পানি এখনও গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে৷ আবির বামহাতে মেঘের গাল মুছে, আলতো হাতে চুলগুলো ঠিক করে দিল৷ বাকি রাত আবিরের নির্ঘুম কেটেছে। আবিরের বুকে শুয়ে আছে আবিরের কাদম্বিনী, আবির অপলক দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র আলোতে তার কাদম্বিনীকে দেখেই রাত কাটিয়ে দিয়েছে ।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৪৯(২)

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে এমন সময় আবির ঘুমিয়েছে। তার ঘন্টাখানেক পর আচমকা মেঘের ঘুম ভাঙে। নিজেকে আবিষ্কার করে আবির ভাইয়ে প্রশস্ত বুকে। চোখ তুলে তাকায় আবিরের মুখের পানে। আবিরকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠতে নিলে পিঠে ভারী কিছু অনুভব করে। ঘুমের মধ্যে চুলের খোঁপা খুলে এলোমেলো হয়ে গেছিলো, চুলের কারণে কিছু বুঝতে পারছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে তাকাতেই খেয়াল করলো, আবির বামহাতে মেঘের পিঠ বরাবর শক্ত করে ধরে রেখেছে যাতে ঘুমের মধ্যে মেঘ পড়ে না যায়। মেঘ বিপুল চোখে আবিরের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের অজান্তেই মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটলো

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫১