আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫২
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বললেন,
“তোমার ফুপ্পিকে আসতে বলেছি প্রয়োজনে আবার বলবো কিন্তু তোমার ফুপাকে কিছু বলতে বলো না আমায়। এই একটা মানুষের জন্য আমার পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেছে তাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না আমি৷ ”
মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“আর কতদিন মনের ভেতর বিদ্বেষ পুষে রাখবেন। এবার অন্ততঃ সবকিছু ঠিক করে নেন। ”
“তোমরা কি চাইছো? আমি নিজে থেকে সব ভুলে ঐ লোকের সাথে কথা বলি?”
আবির তপ্ত স্বরে বলল,
“নাহ। মনের বিরুদ্ধে আপনাকে কিছু করতে বলছি না। আপনি ফুপ্পিকে সত্যিই বাসায় আনতে চাইলে ফুপ্পিকে কল দিয়ে ভালোমন্দ কথা বলে দাওয়াত দিবেন, বাসার সবাইকে নিয়ে আসতে বলবেন। এটুকুই। ”
“আমার কাছে ওদের কারো নাম্বার নেই। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“নাম্বার আমি সংগ্রহ করে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে দিও।”
সকালবেলা খাবার টেবিলে আবির আর মোজাম্মেল খান ব্যতীত সবাই উপস্থিত। আলী আহমদ খান খাবার শেষ করে স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালেন,
” তোমাদের ফুপ্পিকে বাসায় দাওয়াত দিতে চাচ্ছি। এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো মতামত থাকলে বলতে পারো। ”
খুশিতে গদগদ হয়ে মেঘ বলল,
“কোনো মতামত নেই। ফুপ্পি আসলেই হবে।”
তানভিরের সরল স্বীকারোক্তি,
“আপনার বোনকে আপনি বাসায় আনতে চাচ্ছেন এ ব্যাপারে আমাদের মতামতের থেকেও আপনাদের মতামত টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আব্বু, আপনি, কাকামনি প্রয়োজনে আম্মুরা আছেন ওনাদের সাথে কথা বলে আপনারা যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নিতে পারেন।”
“আমরা আমাদের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া তোমার আব্বু আজ আসবে আবশ্যকতায় আবার আলোচনা করবো। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তারা আসলে তোমরা তাদের সাথে কেমন আচরণ করবে?”
তানভির মৃদু হেসে বলল,
“সে বিষয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না। আমি, আমার বোনেরা কিংবা আদি, ওনাদের মনে আঘাত দেয়ার মতো কোনোপ্রকার খারাপ আচরণ করবো না। আপনার এবং এই বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
মীম আর আদিও তানভিরের সঙ্গে তাল মেলালো। মীম আর আদিকে মেঘ অনেকদিন আগে থেকেই ফুপ্পির কথা বলছে। ফুপাতো ভাইবোনদের কথাও বলেছে। তাদের সাথে পরিচিত হতে মীম আর আদিও খুব এক্সাইটেড। মোজাম্মেল খান দুপুরের পরপর বাসায় আসছেন, এসেই সরাসরি আবিরের রুমে চলে গেছেন। আলী আহমদ খানের ছেলের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে আবিরকে কিছু না বললেও মোজাম্মেল খান একায় সেই ঝাঁঝ মিটিয়েছেন। টানা ২ ঘন্টা আবিরের উপর রাগ ঝেড়েছেন, বহুবছর আগে আলী আহমদ খানের এক্সিডেন্টের ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনার নিগূঢ় বর্ণনা দিয়েছেন। হালিমা খান দু একবার থামানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু এতে লাভ হওয়ার বদলে উল্টো ক্ষতি হয়েছে ।
মোজাম্মেল খানের রাগ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তানভির যেমন আবিরের প্রতি কনসার্ন তেমনি মোজাম্মেল খানও বড় ভাইয়ের অতিশয় ভক্ত। আলী আহমদ খানের এত বছরের পরিশ্রম, এই পরিবারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সবটায় মোজাম্মেল খানের খুব কাছ থেকে দেখা। আবির আর তানভির দুজনের ছন্নছাড়া আচরণে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান দু’জনেই অনেক বেশি চিন্তিত। কাজের চাপে আবিরের একটু আধটু সিরিয়াসনেস দেখা গেলেও তানভির বরাবরই গা ছাড়া ভাবে চলে। তারউপর আবির ইচ্ছেকৃত তানভিরকে আরও বেশি আগলে রাখে যা মোজাম্মেল খানের একেবারেই পছন্দ না।
আবিরের পাশাপাশি তানভিরও যদি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পারিবারিক ব্যবসাটা সামলাতো তাহলে এতদিনে তাদের অবস্থান আরও উপরে থাকতো। একমাত্র ছেলের প্রতি মোজাম্মেল খানের ভালোবাসা যেমন আছে তেমনি দুশ্চিন্তারও অন্ত নেই। আবির পড়াশোনায় ভালো, কাজেও খুব মনোযোগী কিন্তু তানভির সম্পূর্ণ উল্টো। বর্তমানে যা করছে তাতে ও যদি গুরুত্ব না থাকে তবে ছেলের ভবিষ্যৎ কি হবে সেই নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন প্রতিনিয়ত। সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আজ আবিরের সামনে। আবির চুপচাপ মাথানিচু করে চাচ্চুর সব কথা শুনছে। আবির চাইলেও এখন কিছুই বলতে পারবে না। একটা কথা বলতে গেলে মোজাম্মেল খান আরও ১০ কথা শুনাবেন তার থেকে বরং চুপ থাকায় শ্রেয়। আবির নিজের মনকে বুঝাচ্ছে,
“আবির আর যাই করিস না কেন, শ্বশুরের সাথে কখনো ত্যাড়ামি করিস না। আবির ধৈর্য রাখতে হবে, ২ ঘন্টা কেন আরও ৩ ঘন্টা বকলেও সহ্য করে নিতে হবে। শ্বশুরকে রাগালে বউকে আর নিজের করে পাবি না। সো বি কেয়ার ফুল আবির। ”
এরমধ্যে মেঘ আবিরের জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসছে। আব্বুর রাগ দেখে মেঘের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। দুধ নিয়ে ভেতরে আসবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পরলো।
মেঘ মনে মনে আওড়াল,
“আজ আমার জন্য আবির ভাইয়ের এ অবস্থা। আব্বু ওনাকে একা বকবেন কেন, আমিও তো বকা খাওয়ার অর্ধেক অংশীদার। ”
মেঘ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও রুমের দিকে পা বাড়ালো। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে মোজাম্মেল খান সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। মেঘের হাতে দুধের গ্লাস থরথর করে কাঁপছে। মেঘ অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে গ্লাসটা ধরে রেখেছেন। মোজাম্মেল খান মেঘকে দেখে একটু থামলেন। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বললেন,
” তারা এক্সিডেন্ট করে একেক দিন একেকজন পরে থাকবে আর ঘর গুষ্টি মিলে তাদের সেবা করবে। করো করো, আরও বেশি করে সেবা করো। দুধের সাথে আপেল, আঙ্গুর, কলাও নিয়ে আসতা। ”
মেঘ একগাল হেসে বলল,
“সব রেডি করা আছে। দুধ খাওয়া শেষ হলেই ঐগুলা নিয়ে আসবো। ”
মোজাম্মেল খান তীব্র বিরক্তি আর বিদ্রুপের স্বরে কথাটা বলেছিলেন অথচ মেঘ তা বুঝতে না পেরে উল্টো সাবলীল ভঙ্গিতে অচতুর স্বীকারোক্তি দিয়েছে। মেঘের উত্তর শুনে মোজাম্মেল খান কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। মেঘ উত্তর দেয়ার পর নিজেই কনফিউশানে পরে গেছে, আব্বু কি ঠাট্টা করলো নাকি সিরিয়াসলি বলছে এটায় বুঝতে পারছে না । আবির মেঘের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। মোজাম্মেল খান পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে আবিরকে উদ্দেশ্য কি যেন বলেছেন। মেঘ সে কথা বুঝেছে কি বুঝে নি কে জানে! কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
” এক্সিডেন্টের কারণে যে পরিমাণ রক্ত শরীর বেড়িয়েছে তা পূরণ করতে দুধ, ডিম, ফল খাওয়াবো না তো কি আপনার বকা খাওয়াবো? ”
মোজাম্মেল খান মেঘকে শুধালেন,
“তানভির কোথায়?”
মেঘের চোখ আবিরের দিকে পরতেই দেখল আবির মাথা দিয়ে না করতেছে। মেঘ সহসা মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
“জানি না।”
এরমধ্যে হালিমা খান ফল, সাথে ডিম সিদ্ধ নিয়ে আসছেন। রুমে ঢুকতে ঢুকতে চড়া গলায় বললেন,
“তানভির যেখানেই থাকুক অন্তত এখন এখানে তাকে ডাকবো না। ২ ঘন্টা যাবৎ ছেলেটাকে ইচ্ছেমতো কথা শুনাচ্ছেন। আর কত! আপনি এখন যান এখান থেকে। ফ্রেশ হয়ে আসুন আপনাকে খেতে দিচ্ছি। আর ছেলেটাকেও শান্তিতে খেতে দিন।”
তানভির ঘন্টাখানেক আগেই বাসায় আসছে। আবিরের রুমে আসতেও চেয়েছিল কিন্তু হালিমা খান বারণ করেছেন। মোজাম্মেল খানের সামনে আবির আর তানভির দুজনেই গুরুতর আসামি। দোষ যেই করুক না কেন, শাস্তি দু’জনেরই প্রাপ্য। হালিমা খানের উদ্বেল কন্ঠের কথাবার্তা শুনে মোজাম্মেল খান আর কথা বাড়ালেন না। নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। হালিমা খান আবিরের কাছে ফলের প্লেট টা রেখে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তুই বরং এখানে থাক। আমি তোর আব্বুর জন্য খাবার রেডি করি।”
মেঘ ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। হালিমা খান চলে যেতেই আবির ফলের প্লেটের দিকে তাকালো৷ হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য যে যে ফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে সব ফলে প্লেট ভর্তি করে নিয়ে আসছে।
আবির ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,
“এত ফল আনছিস কেন। কে খাবে?”
“আপনি খাবেন ”
” এত ফল খাইয়ে একদিনে আমার শরীর ঠিক করার প্ল্যান করছিস নাকি?”
” একদিনে না পারি কিছুদিনেই ঠিক করে ফেলব ইনশাআল্লাহ।”
আবির সুস্থির কন্ঠে বলল,
“এত খেতে পারবো না। যেটুকু পারবো সেটুকুই খাবো৷ ”
মেঘ মুচকি মুচকি হাসছে। মেঘের রহস্যময় হাসি দেখে আবির ভ্রু যুগল নাকের গুঁড়ায় টেনে রাশভারি কন্ঠে শুধালো,
“এভাবে হাসার কারণ কি? মনের ভেতর কি চলছে, হুমমমমম?”
মেঘের মুচকি হাসি প্রখর হলো। বেশকিছু সময় চলবো মেঘের অঁবাধ হাসি। আবির বিস্তীর্ণ আঁখিতে চেয়ে আছে তার কাদম্বিনীর দুটি নেত্রে। আজ কতদিন পর আবিরের প্রিয়তমার অকৃত্রিম হাসি দেখছে যাতে নেই কোনোরকম কৃপণতা। দীর্ঘ সময়ের হাসির নিমিত্তে মেঘের চোখ দুটা টলমল করছে। গাঢ় কমলা রঙের একটা জামার সাথে সাদার মধ্যে হ্যান্ডপ্রিন্টের একটা ওড়না মেঘের গায়ে জড়ানো।
কমলা আর সাদার কম্বিনেশনে মেঘকে আজ অপরূপা লাগছে, সেই সাথে ঠোঁট গুলো আজ মাত্রাতিরিক্ত লাল দেখা যাচ্ছে, চোখের নিচে কাজল কিছুটা লেপ্টে আছে। নিরবধি হাসির কারণে ঘামে চিকচিক করছে নাকের ডগা। কোনো রমণীর প্রেমে পরার জন্য এরচেয়ে বড় কারণ বোধহয় আর হয় না। মুগ্ধতায় আবিরের দু চোখ আঁটকে আছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে,বাস্তব আর কল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। মেঘ চেষ্টা করেও নিজের হাসি থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে । দিশাবিশা না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজের হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। আবির তখনও নিরেট দৃষ্টিতে চেয়েই আছে। দৃষ্টির গভীরতা জুড়েই অবিশ্রান্ত ভালোবাসার সুবাস৷ মেঘের মোহমায়ায় জর্জরিত আবিরের হৃদয়।
মেঘ হাসি থামিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির ভ্রু জোড়া নাচালো। মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
” আপনি এগুলো খাওয়া শুরু করুন। আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“আসতেছি এখনি।”
মেঘ কিছুক্ষণের মধ্যে দুটা প্লেট হাতে ফিরে আসলো। এক প্লেট ভর্তি ফল আরেক প্লেটে এক হালি সিদ্ধ ডিম। মেঘ ঠোঁটে হাসি রেখে প্লেট দুটা আবিরের সামনে রাখতেই আবির বিষম খেয়ে উঠল৷ কাশতে কাশতে আবিরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অলরেডি আবিরের সামনে ১ হালি ডিম, এক প্লেট ভর্তি ফল, তারউপর মেঘ আরও এক হালি ডিম আর এক প্লেট ফল নিয়ে আসছে। আবির কাশতে কাশতে বলল,
” এইইই, এসবের মানে কি?”
মেঘ হেসে বলল,
“এই সবগুলো আপনি এখন খেয়ে শেষ করবেন। আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। ”
আবির বিপুল চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের যত্ন দেখে মনে হচ্ছে একদিনেই আবিরকে পুরোপুরি সুস্থ করে ফেলবে । শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত বের হয়ছে তা একদিনেই পূরণ করে ছাড়বে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একগ্লাস দুধ, একহালি ডিম আর এক প্লেট ফল কোনোরকমে খেয়ে শেষ করেছে। মেঘ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আবিরকে পরখ করছে। খাওয়াতে কোনো প্রকার গাফিলতি যেন না করতে পারে। আবির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“ম্যাম, আমি কি একটু রেস্ট নিতে পারবো?”
” বেশি কষ্ট হচ্ছে? ”
“একটু তবে আপনি বললে শেষ করে ফেলব।”
“থাক, পরে খেয়ে নিয়েন৷ এখন আমি আসছি। ”
আবির উদাসীন কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা। ”
আলী আহমদ খান বাসায় ফিরেই আবিরের থেকে নাম্বার নিয়ে গেছেন। মোজাম্মেল খান সহ বাকিদের সাথে কথা বলে অবশেষে মাহমুদা খানের নাম্বারে কল দিলেন৷মাহমুদা খানের ফোনে অলরেডি আলী আহমদ খানের নাম্বার ভাইজান লিখে সেইভ করা তাই চিনতে অসুবিধা হয় নি। কল দেয়ার পর প্রথমবারেই কল রিসিভ হলো।
মাহমুদা খান কন্ঠ খাদে নামিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছ ?”
“আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় আছিস?”
“বাসায়। আবির কেমন আছে?”
“আগের থেকে কিছুটা সুস্থ।”
“ভাবিরা কেমন আছে? বাকি সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। যে কারণে তোকে ফোন দেয়া, আগামীকাল তোদের বাসার সবাইকে আমাদের বাসায় দাওয়াত। সবাইকে নিয়ে সকাল সকাল বাসায় চলে আসিস। আমার যেন দ্বিতীয় বার ফোন দিতে না হয়৷ ”
“ঠিক আছে, ভাইজান।”
মাহমুদা খান ফোন রেখেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন, আইরিন আর আরিফ ও মায়ের সাথে সাথে কাঁদছে। জন্মের পর থেকে মা কে দেখে আসছে ভাইদের জন্য সবসময় কান্না করেন, ঈদ কিংবা কোনো উৎসব আসলেই তাদের মায়ের কান্না দেখতে হয়। ২৮ বছর পর খান বাড়িতে ঢুকার অনুমতি পেয়েছেন, সেই খুশিতে নিজের কান্না আটকে রাখতে পারছেন না। আলী আহমদ খানের রাগ এত সহজে কমে যাবে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। আবিরও ভেবেছিল অন্ততপক্ষে ১-২ বছর চেষ্টা করলে হয়তো বা আব্বুর রাগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু বোনকে প্রথম দেখাতেই ওনি সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিবে এটা কেউ ই ভাবে নি।
আজ সকাল থেকে খান বাড়ির অন্দরমহলে কাজের ধুম পরেছে। দুজন হেল্পিং হ্যান্ড, বাড়ির তিন কর্তী সহ মেঘ, মীম আর আদিও কাজে ব্যস্ত। মেঘ কাজের ফাঁকে ফাঁকে আবিরকে দেখে আসে। আবিরের হাত অনেকেটায় ঠিক হয়েছে, তবে পায়ের ব্যথাটা এখনও অনেক বেশি। আজ তিনভাই একসঙ্গে বাজার করতে বেড়িয়েছেন৷ বোনের পছন্দ মতো মাছ থেকে শুরু করে সবজি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসছে।
মীম, মেঘ মিলে চুপিচুপি একটা বরণডালাও সাজিয়েছে যেটা মীমের রুমে লুকিয়ে রেখেছে। আবির সুযোগ মতো মেঘকে ডেকে ঠান্ডা মাথায় সব বুঝিয়ে দিয়েছে, মেঘ যেন কোনো প্রকার উশৃংখল আচরণ না করে। আব্বু, চাচ্চুর প্রতি আবিরের বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই, মেঘকে না আটকালে কখন কোন অঘটন ঘটবে তার আশঙ্কায় আছে। মেঘকে প্রটেক্ট করতে আজ আবিরও সামনে থাকতে পারবে না, তানভির কখন কোন কাজে ব্যস্ত থাকবে তাও বলা যায় না।
যদি ফুপ্পির সাথে ফুপাকে দেখে আবিরের আব্বুর মাথা গরম হয়ে যায় তাহলেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে। আবিরই বলেছিল ফুপ্পিকে বাসায় আনার কথা, কারণ এখন আবিরের অসুস্থতার কারণে আলী আহমদ খানের মন এমনিতেই খুব নরম, এমতাবস্থায় ফুপ্পিকে না আনতে পারলে পরবর্তীতে কবে সুযোগ পাবে তা জানা নেই।
প্রায় ১২ টার দিকে ফুপ্পিরা বাসায় আসছেন। মেঘ নিচ থেকে চিৎকার করে মীমকে ডাকছে। অথচ মীম রুমে সাজুগুজু করতে ব্যস্ত। মাহমুদা খান, ওনার হাসবেন্ড, আইরিন, আসিফ, জান্নাত সবাই এসেছে। আসিফ গতকাল ই দেশে ফিরেছে৷ আবিরদের সারপ্রাইজ দিবে ভেবেই কিছু জানায় নি। মীম বরণডালা নিয়ে আসছে না দেখে মেঘও ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় ঢুকেই সবাই আবিরকে দেখার জন্য আবিরের রুমে চলে গেছে। মেঘ গ্লাস হাতে নিয়ে আবিরের রুমে যাচ্ছে এসময় মীম উপরের বেলকনিতে থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
“আপু ওনারা কোথায়?”
মেঘ রুষ্ট হয়ে বলল,
“ওনারা চলে আসছে। ”
মেঘ আবিরের রুমে চলে গেছে। মীম কি বুঝলো কে জানে। দ্রুত রুমে চলে গেছে। সহসা একহাতে বরণডালা নিয়ে অন্যহাতে পা অব্দি ঢাকা লং ড্রেসের এক পাশ উঠিয়ে ছুটছে। মীমের পড়নে গাঢ় জলপাই রঙের একটা গাউন ড্রেস, একপাশে ওড়না সেফটিপিন দিয়ে আটকানো, স্ট্রেইট চুলগুলো কাঁধের নিচ পর্যন্ত পৌঁছেছে, মেঘ নিজেই মীমের চোখে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে দিয়েছে,মীম ঠোঁটে রঞ্জকও লাগিয়েছে।
মীমের একহাতে কালো ফিতার ঘড়ি, অন্য হাতে কতগুলো চুড়ি, এক পায়ে পায়েল সাথে পুতুলওয়ালা নরম তুলতুলে স্যান্ডেল পড়নে। এলোপাতাড়ি দৌড়ের কারণে মীমের কাঁধ ছাড়ানো চুলগুলো রীতিমতো লাফাচ্ছে। আশপাশ কোনোদিকে তাকানোর মতো সময় নেই। বরণডালা হাতে নিয়ে মেইনগেইট পার হতেই আচমকা একছেলের সাথে ধাক্কা লাগতেই সামনের ছেলেটা দ্রুত সরে গেছে। মীমের হাতের বরণডালা সহ ফুলের পাপড়ি সব পরে গেছে, সাথে সাথে মীমও ধপাস করে নিচে পরে গেছে। ব্যাথায় মীম চিৎকার করে উঠল,
“ও মা গো।”
চিকন লম্বা এক ছেলে দু কদম এগিয়ে এসে শুধালো,
“ব্যথা পেয়েছো?”
মীম রাগে কটকট করে বলল,
” এই কে আপনি, আমার বাসায় এসে আমাকে ফেলে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন ব্যথা পাইছি কি না! আপনার সাহস তো কম না।”
আবারও আর্তনাদ করতে করতে বলল,
“উফফফ! আমি শেষ”
ছেলেটাও খেপা স্বরে বলল,
” নিজে দেখে চলতে পারো না আবার আমায় দোষারোপ করছো? আমি কি তোমায় ফেলছি নাকি? নিজের গায়ে জোর নাই আবার আমায় বলতে আসে।”
মীম এখনও মাটিতে পরে আছে।মীমের রাগ মাথায় উঠে যাচ্ছে, রাগে কটকট করতে করতে বলল,
“একদম গায়ের জোর নিয়ে কথা বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করে আমায় ফেলছেন। আমি এখনি ভাইয়াকে ডাকবো।”
এমন সময় মেঘ আসছে। দরজার সামনে মীমকে বসে থাকতে দেখে মেঘ কপাল কুঁচকে শুধালো,
“কিরে তুই এখানে বসে আছিস কেন?”
মীম ফোঁস করে উঠল৷ গাল ফুলিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে বলা শুরু করল,
“আমি এখানে শুধু শুধু বসে আছি না। এই ছেলে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ”
মেঘ ছেলের দিকে তাকাতেই ছেলেটা নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল,
“আপু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয় নি। ভেতর থেকে কে ছুটে আসছে আমি কিভাবে বুঝবো! আমি ভেতরে ঢুকছি সে হুট করে সামনে চলে আসছে, আমি ভয় পেয়ে কিছুটা সরে গেছি আর সে পরে গেছে। ”
“নাহ আপু৷ ওনি ইচ্ছে করে ফেলছে। তুমি ভাইয়াকে এখনি ডাকো। এই ছেলের বিচার করতে হবে। উফফ আমার কোমর টা মনে হয় ভেঙেই গেছে। ”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,
“আরিফ, তুমি ভেতরে যাও।”
আরিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আপু সত্যিই আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি।”
মেঘ তপ্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
“বুঝতে পেরেছি, তবে একটু সাবধানে থেকো। এসেই পাগলকে উস্কে দিয়েছো, এর পরিণাম কি হবে আমার জানা নেই। ভেতরে যাও।”
আরিফ ভেতরে চলে গেছে। মীম রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“আপু ওনি ঐ ছেলেকে ভেতরে ঢুকতে দিলে কেন? ঐ ছেলে আমায় এত ব্যথা দিল তবুও তুমি তাকে ছেড়ে দিলে? তুমি আমার বোন হয়ে এটা করতে পারলে?”
মেঘ হাত বাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মুখ টা বন্ধ করে ওঠ। কাজের কাজ কিছুই করতে পারিস না, তখন চিৎকার করে ডাকলাম, বরণডালা নিয়ে নামতে তুই নামিস নি। ওরা সবাই ভেতরে চলে গেছে এতক্ষণে তোর খবর হয়েছে। বরণ তো হলোই না বরং শুধু শুধু কোমড়ে ব্যথা টা পেয়েছিস। সাথে ড্রেস টাও নষ্ট করেছিস। ”
মীম মেঘের হাত ধরে কোনো রকমে উঠলো। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। মেঘ মীমের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
” পা টা শক্ত করে ঝাড়া দে, দেখবি ঠিক হয়ে গেছে।”
মেঘের কথা মতো মীম দুই তিনবার চেষ্টা করলো। কিছুটা ঠিক হওয়ার পর মেঘকে ধরে ধরে ভেতরে ঢুকলো। আবিরের রুমের দরজার সামনে আসতেই আকলিমা খান শুধালেন,
“কিরে কি হলো তোর?”
মীম রাগে বলতে নিল,
“এই ছে..”
মেঘ তাড়াতাড়ি মীমের মুখ চেপে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“এমনি ব্যথা পেয়েছে।”
আকলিমা খান পুনরায় বললেন,
“সারাদিন উল্টাপাল্টা দৌড়াবে, ব্যথা তো পাবেই। বেশি ব্যথা পাইছিস?”
সিরিয়াস আলোচনায় মীমের ব্যথাটা আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে ফেলছে, আবিরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আরে বেশি কিছু হয় নি। আমি এখনি ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা কথা বলো।”
মেঘ মীমকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেছে। আবিরের রুমে আলী আহমদ খান ব্যতীত আর সবাই উপস্থিত। আলী আহমদ খান নিজের রুমেই বসে আছেন। বোনের প্রতি ক্রোধ কিছুটা কমলেও, বোনের হাসবেন্ডকে তিনি এখনও মন থেকে মানতে পারছেন না।
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫১(২)
তাই সামনেই আসছেন না। মোজাম্মেল খান, মালিহা খান, হালিমা খান আলোচনা করে মাহমুদা খান আর ওনার হাসবেন্ডকে আলী আহমদ খানের রুমে পাঠাচ্ছেন ৷ ২৮-৩০ বছরের গড়ে ওঠা অদম্য অন্তরাল ভাঙতে মাহমুদা খান এবং ওনার হাসবেন্ড প্রয়োজনে আলী আহমদ খানের পায়ে ধরতেও রাজি।