আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫২(২)

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫২(২)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

মেঘ মীমের সঙ্গে উপরে চলে গেছে। মীম কোমড়ের সাথে সাথে পায়েও অল্প ব্যথা পেয়েছে৷ আগে বুঝতে না পারলেও এখন মীমের পা জ্বলছে। কাটা স্থান থেকে রক্ত বেড়িয়ে পড়নের সেলোয়ারে দাগ হয়ে গেছে। মেঘ আগে ভেবেছিল সামান্য ব্যথা পেয়েছে তাই এত গুরুত্ব দেয় নি। মীমের অবস্থা দেখে এখন মেঘ নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। বাসার কাউকে জানালে তুলকালাম কান্ড হয়ে যাবে।

মীম পায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর আরিফকে অনর্গল বকেই যাচ্ছে। মেঘ বুঝিয়ে শুনিয়ে মীমকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। মেঘ কাটা স্থান জীবাণু মুক্ত করে একটা মলম লাগিয়ে ব্যথার ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। বেশকিছুক্ষণ বুঝানোর পর মীম কিছুটা শান্ত হয়েছে।মীম অন্য একটা ড্রেস পরেছে। কিছুক্ষণ পর দুইবোন একই সঙ্গে নিচে আসছে। পায়ে আর কোমড়ে ব্যথার জন্য মীম ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না৷ ওরা নিচে আসতেই দেখল আলী আহমদ খানের রুমের সামনে ভিড়, মেঘ মীমকে সোফায় বসিয়ে এগিয়ে গেল বড় আব্বুর রুমের দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুমের বাহিরে মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান, মালিহা খান, হালিমা খান, আকলিমা খান দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আম্মু আর কাকিয়ার পাশ কেটে দরজা পর্যন্ত আসতেই মেঘের পা যুগল থমকে গেছে সেই সাথে হৃদস্পন্দনও হঠাৎ থেমে গেল। মাহমুদা খান এবং ওনার হাসবেন্ড দুজনে আলী আহমদ খানের দু পা আঁকড়ে ধরে অবিচ্ছেদ্য ভাবে কেঁদেই চলেছেন৷ ব্যগ্র স্বরে নিজের ভুল স্বীকার করছেন আর আলী আহমদ খানের কাছে মাফ চাচ্ছেন। আলী আহমদ খান বোনকে অনেকদিন আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবে আজ বোনের হাসবেন্ড কে সামনাসামনি দেখার পর নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

পাথুরে মানবের ন্যায় আলী আহমদ খান বিছানার এক পাশে বসে আছেন৷ মোজাম্মেল খান ব্যতীত দরজার সামনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষের চোখ টলমল করছে। মেঘ কাতর বদনে ফুপ্পির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, মেঘের বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে, হৃদয় খুঁড়ে আসা আর্তনাদ গুলো অবিক্ষিপ্ত গতিতে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে। ক্ষণিকের জন্য মেঘ নিজেকে ফুপ্পির জায়গায় কল্পনা করতেই মেঘের চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকার সর্বশক্তি মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেছে। মেঘ দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। মীমের পাশে সোফায় গিয়ে বসে চোখ বন্ধ রেখে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মেঘের অস্থিরতা দেখে মীম অবাক চোখে চাইলো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে মীম সন্ধিহান কন্ঠে শুধালো,

“আপু কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?”
মেঘ নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“কিছু হয় নি।”
অন্যদিকে আবিরের রুমে আসিফ, জান্নাত, তানভির, আরিফ, আইরিন সবাই খুনসুটিতে মেতে আছে। বেশকিছুক্ষণ খুশগল্প করার পর আসিফ হঠাৎ ই গম্ভীর কণ্ঠে আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“শুনলাম তুই নাকি মেঘের জন্য এক্সিডেন্ট করেছিস?”
“মোটেই না৷ তোমরা শুধু শুধু আমার ওনাকে দোষারোপ করছো। ওনার কোনো দোষ ই নাই। ভাগ্যে ছিল তাই এক্সিডেন্ট করেছি।
আসিফ কিঞ্চিৎ হেসে বললো,

” এখনি তার পক্ষ নিচ্ছিস? বিয়ের পর কি করবি তাহলে?”
আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে মৃদুস্বরে বলল,
“পরে বউ ভক্ত জামাই হবো। ও যা বলবে, যেভাবে বলবে আমি সেভাবেই চলবো। বাস্তবে কেন, স্বপ্নেও কোনোদিন ওকে আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ তুলতে দিব না৷ ইনশাআল্লাহ। ”
জান্নাত, আসিফ আর তানভির একসঙ্গে “ইনশাআল্লাহ” বলে উঠল।
আইরিন হাসিমুখে শুধালো,

“ভাইয়া তুমি বিয়েটা কবে করবা? আমরা কি বিয়ে খাবো না?”
আবির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“তোকে বিয়ে দিয়ে তারপর ই করবো।”
আইরিন মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার কি বিয়ের বয়স হয়ছে? মাত্র ১৬ বছর বয়স আমার। আমি এখনও শিশু।”
তানভির হেসে বলল,

” এখনও কত কত গ্রামে ১২-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে তুই তো তাদের থেকে ২ বছরের বড়৷ তোকে দিতে সমস্যা কি?”
আইরিন গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
“তোমার বোন যে আমার থেকে আরও ৩ বছরের বড় সে বেলায়? তাকে বিয়ে দাও না কেন?”
তানভির সত্বর জবাব দিল,
“আমার বোনের জামাই ফিক্সড তাই কোনো টেনশন নাই কিন্তু তোর জন্য তো ছেলে খোঁজতে হবে এজন্য সবার টেনশন। ”

আইরিন ভ্রু নাকের গুঁড়ায় টেনে রাশভারি কন্ঠে বলল,
“আমি বিয়েই করবো না। ”
আইরিনের কথা শুনে সবাই উঁচু স্বরে হাসতে শুরু করেছে। আইরিন রাগে কটকট করতে করতে সবার দিকে তাকাচ্ছে। জান্নাত ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,

” তোমরা সবসময় আমার ননদিনী টাকে রাগাও। আমার ননদিনীকে বিয়েই দিব না, সারাজীবন আমাদের কাছে রেখে দিব। তাহলে আম্মুকেও মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করতে হবে না। ”
আইরিনের গাল ফুলানো দেখে আরিফ আইরিনের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“তুই এত বেক্কল কেন রে? মজাও বুঝিস না?”

আইরিন মাথায় ঘষতে ঘষতে অসহায় মুখ করে আরিফের দিকে চেয়ে আছে। আরিফ সবার সাথে অন্য বিষয়ে কথা বলায় ব্যস্ত । এরমধ্যে আকলিমা খান দরজা থেকে ডেকে বললেন,
“তানভির, ওদের নিয়ে বাসা টা একটু ঘুরে দেখা। আর পারলে আবিরকে ধরে রুমটা থেকে বের কর। এক রুমে বন্দি থাকতে কত ভালো লাগে?”
তানভির ধীর কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছে।তুমি যাও, আমি ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছি। ”

আইরিন, আরিফ, জান্নাত আগে বেড়িয়ে গেছে।তানভির আর আসিফ দুপাশ থেকে আবিরকে ধরে আস্তেধীরে নিয়ে যাচ্ছে। আবিরের হাত মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে, পায়ে ব্যথা রয়েছে। বাড়ির নিরিবিলি পরিবেশ দেখে জান্নাত এগিয়ে গিয়ে আকলিমা খানকে শ্বাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। মেঘ আর মীম দু’জন ই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। সবাইকে বের হতে দেখে হালিমা খান এগিয়ে এসে মেঘকে ডেকে বললেন,
“ওদের নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আয়। আমরা খাবার রেডি করছি।”
এদিকে ওদিক নজর বুলিয়ে মেঘ উঠে নিজের মনকে সামলে মুখে হাসি নিয়ে বলল,

“চলো।”
মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কিরে তুই যেতে পারবি ?”
মীম মেঘের দিকে এক পলকের জন্য তাকাতেই হঠাৎ আরিফের দিকে চোখ পরলো। ওমনি মীম রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছে। রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“আমি যাব না। তুমি যাদের নিয়ে যাচ্ছিলে তাদের নিয়েই যাও।”
মেঘ যথারীতি আইরিন আর আরিফকে নিয়ে উপরে চলে গেছে। এক এক করে মীম,তানভির, মেঘ, আবির সবার রুম ঘুরিয়ে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদ ভর্তি এত এত গাছ দেখে আইরিন খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। আইরিনের উইশলিস্টের প্রায় অনেক গাছ অলরেডি মেঘদের ছাদে আছে। আইরিন আপন মনে বকবক করেই যাচ্ছে,

“এই গাছটা আমার আছে, ঐটা ছিল এখন নাই, এই গাছটা আমাদের বাসায় হয় না। তুমি আবার আমাদের বাসায় গেলে তোমাকে আমাদের বাসার ছাদে নিয়ে যাব। ”
মেঘ মৃদু হেসে শুধু বলল,
” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
অনেকক্ষণ যাবৎ বকবক সহ্য করে অবশেষে আরিফ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল,
“তোদের সাথে এসে আমার নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। গাছগাছালি নিয়ে এত আলোচনা গবেষণাগারের গবেষকরাও বোধহয় করেন না। ”
আইরিন ঠাট্টার স্বরে বলল,
“তুই ভালো মানুষ ছিলি কবে?”

আরিফ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই আইরিন ভেঙচি কাটলো। মেঘ হেসে বলল,
“আচ্ছা গাছ নিয়ে আর কথা বলব না। তোমার যে বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে সেই বিষয়েই বলো।”
আরিফের রাগ মুহুর্তেই গায়ের হয়ে গেছে। সহসা অস্ফুট কন্ঠে বলল,
“এই না হলে আমার ভা..”
আইরিন সঙ্গে সঙ্গে আরিফের মুখ চেপে ধরে ফেলল। মেঘ আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকিয়ে আইরিনকে শুধালো,
“আরিফের মুখ চেপে ধরেছো কেন?”
পুনরায় আরিফকে শুধালো,

“কি বলতে চাইছিলে বলো, ভা মানে কি?”
আরিফ ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল,
“ভালো বোন।”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,
“সত্যি? তাহলে আইরিন মুখ চেপে ধরেছে কেন?”
“আইরিন খুব হিংসুটে, ও নিজেকে
ছাড়া আর কাউকে ভালো বলতে দিবে না। তোমাকে ভালো বলে ফেলছি এটা ওর সহ্য হচ্ছে না। ”
আইরিন বিপুল চোখে আরিফের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসতেছে। বিড়বিড় করে বলল,
“আগে বাসায় চল, তারপর তোকে বুঝাবো।”

মেঘ, আইরিন, আরিফ তাদের পড়াশোনা, ভার্সিটি লাইফ আর স্কুল লাইফ নিয়ে গল্প করছে। এদিকে আবির, তানভির, আসিফ সোফায় বসে বসে গল্প করছে। আবিরের ব্যবসা, তানভিরের রাজনীতি, আসিফের জব লাইফ নিয়েই নানান আলাপ আলোচনায় মগ্ন। জান্নাত, হালিমা খান ও আকলিমা খানের সাথে খাবার পরিবেশনে সাহায্য করছে৷ মাহমুদা খান, ওনার হাসবেন্ড এবং বাকিরা আলী আহমদ খানের রুমেই টুকটাক কথা বলছেন। মাহমুদা খানকে আলী আহমদ খান নতুন করে সবার পরিচয় দিচ্ছেন, যদিও মাহমুদা খান সবাইকে আগে থেকে চিনেন। আলী আহমদ খান হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,

“তোর ছেলে মেয়ে কি তিনজন ই?”
মাহমুদা খান মৃদুস্বরে বললেন,
“নাহ। আমার আলহামদুলিল্লাহ দুই ছেলে আর দুই মেয়ে।”
মোজাম্মেল খান শুধালেন,
“আরেক মেয়ে কোথায়? নিয়ে আসলি না কেনো?”
“বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,কানাডা থাকে।”
ইকবাল খান আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বললেন,
“আফা, তোমার এক মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে ফেলছো? ”
মাহমুদা খান মলিন হেসে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ একবছরের একজন নাতিও আছে। ”

মোজাম্মেল খান বোনের কথায় রীতিমতো ভীমড়ি খেলো। আলী আহমদ খান মালিহা খানের দিকে তাকিয়ে উদাসীন কন্ঠে শুধালেন,
” আমার ছেলেকে এবার বিয়ে করানো দরকার। নাকি বলো?”
মালিহা খান কিছুটা তপ্ত স্বরে বললেন,
“আবির ফেরার পর থেকে আপনার কাছে আমি এই কথা বলছি। কিন্তু আপনি তো আমার কথা গুরুত্বই দিচ্ছেন না। ”
“এবার গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। আমার ছোট বোন নানি হয়ে গেছে আর আমি এখনও ছেলের বউ এর মুখে আব্বাজান ডাক ই শুনতে পারলাম না।”

মোজাম্মেল খান চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোনো মেয়ে কি পছন্দ হয়েছে ভাইজান? দেখেছো কি?”
“হ্যাঁ। মেয়ে আমার পছন্দ করায় আছে। আবির শুধু হ্যাঁ বললেই হবে৷ ”
মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
“মেয়ে কে? কি করে?”
আলী আহমদ খান ঠাট্টার স্বরে বললেন,
“মেয়ে তুমিও দেখেছিলে এবার আমিও দেখেছি। এখন দেখি ছেলে কি করে। ”
মোজাম্মেল খান আবারও প্রশ্ন করলেন,

“ভাইজান, তুমি কি শাকিল সাহেবের মেয়ের কথা ভাবতেছো?”
মালিহা খান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“শাকিল সাহেব কে?”
ইকবাল খান উত্তর দিলেন,
“ভাইজানের ব্যবসায়িক বন্ধু।”
“মেয়ে দেখতে কেমন?”

“মাশাআল্লাহ ভাবি। মেয়ে দেখার মতো। আপনি দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না যাকে বলে আগুন সুন্দরী। তারউপর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। ”
মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে জানালেন,
“নাহ। আমার ছেলের বউ হবে আমাদের মতো সাধারণ, অবশ্যই মিশুক হতে হবে। যে আগুনের আশেপাশে ভিড়তেই পারবো না সে আগুনে আমার ছেলেকে পুড়তে দিব না। ”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“তোমার ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হলে তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। ”
এদিকে মাহমুদা খানের বুকের ভেতর থাকা হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠেছে। ওনি এতদিনে আবিরকে যতটুকু চিনেছেন, আবির মেঘকে না পেলে আবিরও বাঁ-চবে না। যেকোনো একটা বড় ধরনের এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলবে। মাহমুদা খান আলী আহমদ খানের সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না, আবার চুপচাপ কথাগুলো হজমও করতে পারছেন না।

অন্যদিকে মীম সোফায় বসে ছিল, আবির রা সােফায় এসে বসতেই, মীম কিছু একটা ভেবে তড়িঘড়ি করে উঠে পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়ে রান্নাঘরে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো,
“আম্মু, বাসায় কলা আছে?”
“হ্যাঁ৷ কেনো?”
“আমায় একটা কলা দাও। ”
” ভাত খাওয়ার সময় কলা দিয়ে কি করবি?”
“খাবো৷ এখনি দাও। একটা না দুটা কলা দিও ”
আকলিমা খান কপাল কুঁচকে মীমের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে দুটা কলা বের করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হালিমা খান মীমকে বললেন,

” মীম, ছাদ থেকে ওদের ডেকে নিয়ে আয় তো মা।”
মীম ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,
“অবশ্যই । এখনি যাচ্ছি।”
মীম কলা খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। মুহুর্তেই যেন পায়ের ব্যথার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। ছাদের দরজা থেকে ডাকলো,
“আপু, মামনি তোমাদের ডাকছে। ”
মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু তুই এখানে আসলি কিভাবে?”
“এভাবেই৷ ”

মেঘ আর আইরিন গল্প করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে৷ আরিফ মীমের শারীরিক অবস্থা বুঝার জন্য এক পলক মীমের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। মীম যদি বুঝতে পারে আরিফ ইচ্ছেকৃত মীমের দিকে তাকিয়েছে তাহলে এবার সিডর, আইলার মতো তান্ডব শুরু করে দিবে। আরিফ ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে মীমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। আরিফ ৪-৫ সিঁড়ি নামতেই হঠাৎ স্লিপ কেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কয়েক সিঁড়ি নেমে সামনে থাকা আইরিনের দু কাঁধে ধরার চেষ্টা করে।

আরিফের ভর আইরিন নিতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয়, মেঘ তাড়াতাড়ি আইরিনকে ধরে ফেলে, ততক্ষণে আরিফ ও নিজের শক্তি দিয়ে কোনোরকমে স্থির হয়েছে। পায়ের ২-৩ জায়গায় ঘষা খাওয়ায় আরিফের পা জ্বলছে, সেদিকে না তাকিয়ে আরিফ পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল একটা সিঁড়িতে কলার বাকল অক্ষত অবস্থায় পরে আছে, এর আগের সিঁড়িটাতেই আরিফের পা পরেছিল। মীম দুটা কলা খেয়ে পরপর দুই সিঁড়িতে বাকল ফেলেছে, যেন যেকোনো একটাতে আরিফ স্লিপ খায়।

মেঘ আর আইরিন আগে নেমে যাওয়ায় এবং আরিফের মনোযোগ ফোনে থাকায় মীমের কাজে বেশ সুবিধা হয়েছে। আরিফ চোখ তুলে মীমের দিকে তাকাতেই মীম নিজের দুহাত ঝেড়ে এমন ভাব নিলো যেন সে বিশাল কিছু করে ফেলেছে। আরিফের রাগ হলেও সে প্রকাশ করল না, আইরিন নিজের মতো করে আরিফকে বকছে, আইরিন ভেবেছে আরিফ ইচ্ছে করে আইরিনকে ধাক্কা দিয়েছে। আরিফ সেসবে পাত্তা না দিয়ে মেঘদের পাশ কাটিয়ে নিচে চলে গেছে। মীম নেমে এসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“আইরিন আপু, তুমি কি ব্যথা পেয়েছো?”
মেঘ সন্দেহের দৃষ্টিতে মীমকে দেখেও কিছু বললো না। নিচে নামতেই দেখল সবাই খাবার টেবিলে বসা। আজ ডাইনিং এ আরও ৫ টা চেয়ার এড করায় জায়গা তুলনামূলক কম। ফুপ্পিদের পাশে দুটা চেয়ার ফাঁকা, আবিরের পাশের একটা চেয়ারও ফাঁকা৷ আইরিন তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো, মীম ফুপ্পিদের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে মেঘকে চোখে ইশারা করল, যেন আবিরের পাশে গিয়ে বসে। মেঘ কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরমধ্যে আবির দুবার তাকিয়েছে, কিন্তু মেঘের নজর অন্যদিকে। তানভির আবিরের পাশের চেয়ারটা ইশারা করে মোলায়েম কন্ঠে মেঘকে বলল,

“বনু, এখানে এসে বস। ”
সঙ্গে সঙ্গে আলী আহমদ খানও বললেন,
“বসো বসো, খাওয়া শুরু করি।”
মেঘ আগপাছ না ভেবে আবিরের পাশে গিয়ে বসলো। অজানা এক অনুভূতিতে মেঘের মন শিউরে উঠছে। তিরতির করে কাঁপছে মেঘের হাত, আবির মেঘের হাতের দিকে নজর বুলায়। আড়চোখে মেঘকে কয়েক মুহুর্ত পর্যবেক্ষণ করে। মেঘের কাঁপা কাঁপি দেখে আবির ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়ে নিজেই মেঘের প্লেটে খাবার তুলে দিল৷ আচমকা মেঘের সঙ্গে হাতের স্পর্শ লাগতেই মেঘ কারেন্টে শক খাওয়ার মতো আঁতকে উঠে। মুহুর্তেই হাত ছিঁটকে সরিয়ে নিয়েছে। অকস্মাৎ মেঘের এরকম আচরণে আবির কপাল গুটিয়ে অবাক চোখে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বলল না। খাওয়ার মাঝে প্রয়োজনের বাহিরে কেউই কোনো কথা বলে নি। মীমের সাথে দু একবার আরিফের চোখাচোখি হয়েছে, মীম প্রতিবার ই ভেংচি কেটে সহসা অন্যদিকে তাকিয়ে পরেছে। আলী আহমদ খান খাবার শেষ করে গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,

“আমি খান বাড়ির সবার উপস্থিতিতে আমার ছেলের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি৷ আমার ছেলের সম্মতি থাকলে আমি সামনের ঈদ নাগাদ ছেলের বউ ঘরে তুলতে চাই। ”
আলী আহমদ খানের কথাগুলো আবিরের মনে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছে৷ আবিরের চোখ মুখে অন্ধকার নেমেছে, কপালে কয়েক স্তর ভাঁজ পরে গেছে। এদিকে মেঘের নিঃশ্বাস গলায় আঁটকে গেছে, অবিরত ঢোক গিলে নিঃশ্বাস নেয়ার প্রবল চেষ্টা করছে। তানভির, আসিফ, আরিফ, জান্নাত, আইরিন, মীম সকলেই আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। সবার মনে উত্তেজনা আর ভয় একসঙ্গে কাজ করছে। আলী আহমদ খান পুনরায় শুধালেন,

” আবির, এখন বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আবিরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে, মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করা পরিকল্পনা গুলো এলোপাতাড়ি ছুটছে। পিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা দপদপ করে কাঁপছে। আব্বু, চাচ্চু সহ খান বাড়ির প্রায় সব সদস্য আজ এখানে উপস্থিত। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আবির ফুপ্পিকে প্রথমবারের মতো বাসায় আনতে সফল হয়েছে, আবির যতটা চেষ্টা প্রকাশ্যে করেছে তার থেকে অনেক বেশি চেষ্টা গোপনে করেছে। ফুপ্পির সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকে, মালিহা খানকে দিয়ে আবির যথাসাধ্য আলী আহমদ খানকে বুঝানোর চেষ্টা করে আসছে।

এতদিনে ভাই বোনের সম্পর্ক মোটামুটি ঠিক হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় আবির কোনোভাবেই নতুন কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না। বর্তমানে আবিরের অবস্থান অনুসারে, মেঘের কথা বাসায় জানানো বা আব্বু, চাচ্চুর কাছে মেঘকে চাওয়ার মতো মিনিমাম যোগ্যতাও আবিরের নেই। আর যাই হোক, আবির মেঘের ব্যাপারে “নাহ” শব্দ শুনতে নারাজ। এদিকে টেনশনে মেঘের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবির বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে আর যে কোনো ক্রমে অন্য মেয়ের সাথে আবিরের বিয়ের কথা হলে মেঘের কি হবে সেটা ভেবেই মেঘ ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বসায় আবিরের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না,আবিরের রিয়াকশন ও বুঝতে পারছে না। কিছু মুহুর্তের জন্য খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা চললো৷ অবশেষে আবির ছোট করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

” আমি আপাতত বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না। ”
” আমি কি তোমাকে এখনই বিয়ে করতে বলছি নাকি? ঈদ পর্যন্ত সময় নাও, মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও।”
আবির আগপাছ না ভেবে বলে উঠল,
“সরি আব্বু ৷ ঈদ নাগাদ সময়ে আমি নিজেকে গুছাতে পারবো না। আমার আরও সময় লাগবে।”
“কতদিন? ”
“আগামী ১ বছর আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।”

” আরও একবছর? তুমি বাড়িতে আসছো প্রায় ১ বছর হতে চললো। তাছাড়া তোমার বিয়ের বয়সও হয়েছে, তোমার আম্মু অনেকদিন যাবৎ ই আমাকে বলছিল। আমার উচিত বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব স্বীয় ভাবে পালন করা। ”
” কিন্তু আব্বু আমি এখন কোনো অবস্থাতেই বিয়ে করতে পারবো না৷ বিয়ে করার মতো যোগ্যতা আমার এখনও হয় নি৷ ”

“কেন হবে না? যদি ইনকামের কথাও চিন্তা করি, তুমি প্রায় ৮-৯ মাস যাবৎ আমাদের পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবসা সামলাচ্ছো। তোমার পার্সোনাল ইনকাম বাদ দিলাম, আমাদের কোম্পানি থেকে প্রতিমাসে তোমাকে যে স্যালারিটা দেয়া হয় আমি আশাবাদী তা দিয়ে তুমি তোমার বউ নিয়ে দিব্যি চলতে পারবে। প্রয়োজনে বিয়ের পর তোমার স্যালারি বাড়ানো হবে। ব্যবসার দায়িত্ব এখন তোমার কাছ, তোমার যা প্রয়োজন তার সবটায় তুমি নিতে পারো। এরপরও যদি সমস্যা মনে হয় তাহলে আমি তো আছিই। বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ না হয় আমিই দিলাম। ”

আবির মলিন হেসে বলল,
” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। প্রয়োজনে ১ বছরের জায়গায় দুই বছর পর বিয়ে করবো তবুও বিয়ের জন্য আমি কারো কাছ থেকে এক পয়সাও নিব না। ”
মোজাম্মেল খান রাশভারি কন্ঠে বলে উঠল,
” যদি টাকার জন্য ই বিয়ে করতে সমস্যা হয় তাহলে তোমার আব্বুর বা আমার একাউন্ট থেকে চাইলে তুমি তোমার প্রয়োজনীয় এমাউন্ট ধার নিতে পারো। তারপর ধীরে ধীরে পরিশোধ করে দিও। তোমার আব্বু তোমাকে বিয়ে করাতে চাইছেন, তোমার রাজি হওয়া উচিত। ”

মোজাম্মেল খান একটু থেমে পুনরায় বললেন,
” আর মেয়েটা তোমার অপরিচিত কেউ না!”
মোজাম্মেল খানের কথায় আবির আঁতকে উঠল। মুহুর্তেই মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। সহসা হৃৎস্পন্দন জোড়ালো হয়ে গেছে। মনের গহীনে একটা চিন্তা বার বার উঁকি দিচ্ছে,
“আব্বু- চাচ্চু কি কোনোভাবে মেঘের কথা বলতে চাচ্ছেন?”
অন্যমনস্কতায় আবিরের ওষ্ঠ যুগল কিছুটা প্রশস্ত হলো।নিপুন কৌশলে আবির নিজের অল্পবিস্তর হাসিটাকে আড়াল করে গুরুতর কন্ঠে শুধালো,

“কে সে?”
মোজাম্মেল খান অবলীলায় বলতে শুরু করলেন,
” শাকিল সাহেবকে তো তুমি চিনোই । ওনার মেয়ে সারা কেও নিশ্চয়ই দেখেছো, মাঝে মাঝে অফিসেও আসে। গতকাল তোমার অসুস্থতার কথা শুনে শাকিল সাহেব অফিসে আসছিলেন, তারপর নিজে থেকেই সারা র সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কথা বলেছেন। যদিও ভাইজান তেমন কিছু বলে নি, বাসায় আলোচনা না করে ওনাকে কিছু জানানো ঠিক হবে না। বাসার সবার ও তোমার মতামত থাকলে ওনাদের বাসায় দাওয়াত করা হবে। মেয়ে অপছন্দ হওয়ার মতো কিছু নেই, তারা আসলে এনগেজমেন্ট টাও না হয় করে নেয়া যাবে। ”

সারার কথা শুনে আবিরের মেজাজ চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে গেছে। মনের কোণে যে একটুকরো সুখের আভাস উঁকি দিয়েছিল তা যেন মুহুর্তেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে, গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছে । মেঘ, তানভির দুই ভাই বোনই অসহায় মুখ করে আব্বুর অভিমুখে চেয়ে আছে। মেঘ পাশে তাকিয়ে একপলক আবির কে দেখছে পুনরায় একপলক আব্বুকে দেখছে। উপস্থিত সকলের মনে অস্থিরতা। এতক্ষণ যাবৎ একটুর জন্য হলেও মনে হয়েছিল, তারা আবিরের মতামত জানতে চাইবে৷ কিন্তু মোজাম্মেল খানের মুখে এনগেজমেন্টের কথা শুনে সকলেই থতমত খেয়ে গেছে।

ফুপ্পিরা সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সবাই সবার দিকে তাকালেও আবিরের দৃষ্টি প্লেটের দিকে স্থির। রাগে আবির দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে, কপালের দুপাশের শিরা-উপশিরা গুলো দ্রুতগতিতে লাফাচ্ছে, গলার রগ গুলো ফুলে উঠেছে৷ সারা মেয়েটা ইদানীং ঘনঘন অফিসে আসছিল, ওনাদের সাথে কোনো মিটিং বা যেকোনো আলোচনাতেই সারা শাকিল সাহেবের সঙ্গে আসতো। প্রথম দিন ফরমালিটি করে আবির সারার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিল, এক কাপ কফিও অফার করেছিল, মিটিং এ যাওয়ার আগে আবির কাউকে কফি দেয়ার কথা বলেও গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যস্ততার জন্য সারা র সঙ্গে আর কোনো কথা হয় নি।

সেই থেকে সারা প্রায় ই অফিসে আসতো, যেচে আবিরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো, আবির ব্যস্ততা দেখিয়ে সবসময় ইগ্নোর করতো। সারা বেশ কয়েকবার আবিরের নাম্বারও চেয়েছে, কিন্তু আবির দেয় নি। সেই মেয়ের সঙ্গে বাবা-চাচা আবিরের বিয়ের কথা ভাবছে এতেই আবিরের মেজাজ তুঙ্গে। আবির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টানলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শেষ চেষ্টা করল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কন্ঠ চারগুণ ভারী করে বলল,

” আমি বিয়ে করবো না মানে করবোই না। আগামী এক বছর এই বাড়িতে কোনো প্রকার বিয়ের আলোচনা শুনতে চাই না। শাকিল সাহেবের মেয়েই হোক আর যে সাহেবের মেয়েই হোক, আজকের পর থেকে অফিসিয়াল কার্যক্রমের সদস্য ব্যতীত অফিসে যেন কোনো মেয়ে না আসে। আর অনুগ্রহ করে আমার বিয়ে নিয়ে আপনারা আলোচনা বন্ধ করুন।”
আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,

“তুমি কথা শেষ করতে তো দিবে। ”
“আব্বু,আমি আর কোনো কথা শুনতে বা বলতে চাচ্ছি না। ”
“তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,
“আপনারা আপনাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে, এনগেজমেন্ট পর্যন্ত ফিক্সড করে ফেলছেন আর এখন আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন। বাহ! অসাধারণ। ”
মালিহা খান শান্ত স্বরে বললেন,
“আবির, আব্বুর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। ওনারা তে তোর সিদ্ধান্ত জানতেই চাচ্ছেন। ”

“আম্মু এটাকে সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া বলে না। ওনারা ওনাদের মর্জি আমার উপর চাপালেই আমি ওনাদের সব সিদ্ধান্ত মানতে পারব না। আর যদি আমার সিদ্ধান্ত জানতেই চাও, তাহলে আমি আবারও বলছি আগামী এক বছর আমি বিয়ে করতে পারব না৷ এ ব্যাপারে আমার সামনে অথবা আড়ালে আর কোনো কথা যেন না হয়!”
আলী আহমদ খান উঠে যেতে যেতে ভারী কন্ঠে বললেন,
” ঠিক আছে, তোমার বিয়ে নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। ”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
“ধন্যবাদ।”

মোজাম্মেল খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে নিজের মর্জিতে চলতে চায়, বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান হয়ে যায়, বড়দের সিদ্ধান্ত তখন তাদের কাছে মূল্যহীন মনে হয়। কাউকে পরোয়া করে না। ”
আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

“পারলে নিজের মেয়েকে আমার কাছে দেন বিয়ে, তারপর দেখুন আপনাদের সিদ্ধান্তের মূল্য দেয় কি না! নিজের মেয়ের কথা তো একবারও বললেন না! কোথাকার কোন মেয়েকে আমার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে রাজি হয় নি বলে আমি অবাধ্য সন্তান হয়ে গেছি। বাহ! শ্বশুর আব্বু, বাহ! আপনার মেয়েকে বিয়ে দিলে ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, আজ, এই মুহুর্তেই বিয়ে করে ফেলবো। ”

মোজাম্মেল খান বিড়বিড় করতে করতে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেছেন। আবির একপলক চাচ্চুর দিকে তাকালো, বিড়বিড় করে বলা কথার কিছুই আবির বুঝবো না। চোখ ঘুরাতেই তানভিরকে চোখে পরলো, আবির তানভিরকে দেখেই সিম্পলি স্মাইল দিল, তানভিরের মুখে গাম্ভীর্যতা লেগেই আছে। আবির ফুপ্পিদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তোমরা খাচ্ছো না কেনো? খাও খাও।”

সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, শুধু আশপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ইকবাল খান, মালিহা খান, আকলিমা খান উপস্থিত আছে বিধায় কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার মনমরা ভাব দেখে আবির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“সামনের বছর আমার বিয়ে। তোমাদের সবার দাওয়াত, এখন থেকেই বিয়ের প্রিপারেশন শুরু করো। বিয়ে আমার ধুমধাম করেই হবে। ”

আইরিন আর মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোরা ডান্স শেখা শুরু কর, আমার বিয়েতে ঠিকমতো নাচতে না পারলে তোদের খবরই আছে।”
আবিরের কথা শুনে সবাই না চাইতেও হেসে ফেললো। নিজের বিয়ের দাওয়াত নিজেই দিচ্ছে, আবার নাচার জন্য বোনদের রীতিমতো থ্রেট দিচ্ছে। এমন কান্ড একমাত্র আবিরই করতে পারে। আরিফ মজা করে বলল,
“ভাইয়া আমরা কি দোষ করেছি? ছেলে বলে কি আমরা নাচতে পারবো না?”
আবির হেসে বলল,

” অবশ্যই নাচবি৷ তোদের বেশকিছু লুঙ্গি কিনে দিব। তখন সবগুলো মিলে লুঙ্গি ডান্স দিস। ”
মালিহা খান তপ্ত স্বরে বললেন,
” আবির, তোর আব্বুর কথা…”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলল,
“আম্মু…!”
মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি আর কিছুই বলবো না। ”
“এইতো আমার লক্ষ্মী আম্মু।”

আলী আহমদ খান কিছুক্ষণ আগেই রুমে গেছেন, আলী আহমদ খানকে দেখতে মালিহা খানও এবার নিজের রুমে চলে গেছেন। আবির আড়চোখে নিজের প্রেয়সীর দিকে এক নজর তাকালো। মেঘ মাথা নিচু করে ভাতের প্লেটে আঙুল বুলাচ্ছে। বাকিদের মুখে হাসি থাকলেও মেঘের মনে কালবৈশাখী ঝড় বইছে। আব্বু আর বড় আব্বু যেভাবে বিয়ের কথা বলছিল, আবির ভাই রাজি হলেই বিয়ে হয়ে যেত। এদিকে আবির ভাইয়ের মনে মেঘ আছে কি না এ বিষয়েও মেঘের মনে সন্দেহ আছে। মেঘের প্রতি আবিরের মনে ভালোবাসা নাকি ভালো লাগা,এক বছর পর আদো আবির কি মেঘকে বিয়ে করবে? নাকি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে সেসব ভেবেই মেঘের মন আরও বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেঘের বার বার শুধু মনে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পেছনে ছুটছে সে। আবিরের মনের কথা জানতে করা এক কর্মকান্ডে আবিরের এই অবস্থা হয়েছে। এখন সে কি করবে!

মেঘের হাবভাব দেখে আবির মেঘের দিকে সরাসরি তাকালো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
” ভাতের প্লেটে আবার কি চাষ করবি?”
মেঘ বিস্ময় সমেত চোখ তুলে তাকালো। মোহনীয় সেই দৃষ্টি। ফুপ্পিরা আসবে শুনে মেঘ সকাল সকাল গোসল করে সাজুগুজু করেছিল, এখন সেই সাজ অনেকটায় বিনত হয়ে গেছে তবুও আবির মেঘের চোখের গভীরে অক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আশপাশ থেকে অন্যদের কন্ঠস্বর কানে আসতেই আবির নড়েচড়ে বসল, চোখে চোখ রেখেই শান্ত স্বরে বলল,

” পারিপার্শ্বিক ব্যাপারে কান না দিয়ে, চুপচাপ খাবার শেষ কর।”
মেঘ অসহায় দৃষ্টিতে আবিরকে পরখ করলো৷ মনে মনে নিজেকে আওড়ালো,
“মানুষটা এমন কেন? এত কিছুর পরেও একটা মানুষ এতটা স্বাভাবিক কিভাবে থাকতে পারে?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫২

মেঘ পুনরায় মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খাবার টেবিলে তেমন কোনো কথা হলো না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফুপ্পিরা কিছুক্ষণ গল্প করে বিকেলের দিকে বাসায় চলে গেছেন। যাওয়ার সময় আলী আহমদ খান গিফটের পরিবর্তে সবাইকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যার পর পর মেঘ ঘুমিয়েছিল, সেই ঘুম ভেঙেছে রাত ১১.৩০ নাগাদ।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৩