আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৩(২)

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৩(২)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আলী আহমদ খান আজ ফজরের নামাজ পরে বাসায় এসে পরেছেন। সোফায় হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। সচরাচর নামাজ শেষে ঘন্টাখানেক হাটাহাটি করে তারপর বাসায় ফিরেন, তবে আজ শরীর খারাপ লাগছিল বলে হাঁটতে যান নি। আবির বাসায় ফিরে আব্বুর সাথে একটু কথা বলে নিজের রুমে চলে গেছে। আবিরের পা মোটামুটি ঠিক হলেও শরীর এখনও বেশ দূর্বল। এজন্য আলী আহমদ খান আবিরকে অফিসে যেতে দেন না। বাসায় থেকে যতটা সম্ভব কাজ করে, বাকি সব কাজ ইকবাল খানরায় সামলায়।

ইদানীং আবিরের ঘুম ভাঙার পর পরই মেঘের যত্ন শুরু হয়। পা ঠিক হওয়ার পর থেকে আবির নামাজ পড়তে মসজিদে যায়, নামাজ থেকে ফিরতেই টেবিলের উপর কফি সাথে ইউনিক কিছু নাস্তা সাজানো থাকে। মেঘ তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করেই রান্না করতে যায়, আবির আর নিজের জন্য অল্পসল্প নাস্তা রেডি করে নিজের রুমে লুকিয়ে রাখে, আবির নামাজে গেলে চুপিচুপি আবিরের রুমে নাস্তা রেখে নিজের রুমে চলে আসে। আবির সব বুঝতে পেরেও মেঘকে কিছু বলে না, অবশ্য কিছু বলতেও ইচ্ছে করে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবির তার কাদম্বিনীর অতিরিক্ত যত্নে দিনকে দিন মেঘের প্রতি এতটায় আসক্ত হয়ে পরছে যা কোনোভাবেই কাটাতে পারছে না, নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। আবির এক্সিডেন্ট করার পর থেকে আবিরের প্রতি মেঘের দায়িত্ববোধ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে,সেই সাথে বুদ্ধিও বেড়েছে।

এখন আর আগের মতো বাসার মানুষদের সামনে পাগলামি করে না, আবির কিছু বললে একবারেই মেনে নেয়, মুখের উপর প্রশ্নও করে না। আবির প্রতিদিনের মতো আজও রুমে এসে টেবিলে নাস্তা রাখা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। নাস্তা শেষ করে আবারও ঘুমিয়ে পরলো। মেঘও নিজের রুমে নাস্তা করে পড়তে বসেছে। নিচে আলী আহমদ খান সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, মালিহা খান কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন কোনো সমস্যা কি না! কিন্তু ওনি কিছুই বলেন নি। অনেকক্ষণ পর ইকবাল খান বাজার নিয়ে বাসায় ফিরেছেন, ভাইজানকে মনমরা হয়ে সোফায় এভাবে বসে থাকতে দেখে ইকবাল খানও সোফায় গিয়ে বসলেন, শান্ত স্বরে শুধালেন,

“ভাইজান, তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত? ”
“নাহ, তেমন কিছু না। ”
“মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করছো, আমায় বলো৷ ”
“কি বলবো বল, আবিরের ছন্নছাড়া আচরণগুলো আমাকে খুব ভাবাচ্ছে৷ নিজের মতো ব্যবসা করতে চাইছিল, সেখানে আমি জোর করে ও কে আমাদের ব্যবসায় জড়িয়েছি। আদোতে ওর মনে কি চলছে তাও বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম ওকে বিয়ে করাতে পারলে, দুশ্চিন্তাটা অনেকটা কমে যাবে কিন্তু ও বিয়েও করবে না বলে দিল ৷ একমাত্র ছেলে, এতবছর দূরে ছিল বাসায় ফেরার পর যেন দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। আবির কে কিছু বলতেও পারি না, বলার আগেই ওর মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।”
ইকবাল খান মলিন হেসে বললেন,

” ভাইজান তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো। দরকার হলে আমি আবিরের সাথে আবার কথা বলবো। ”
“আপাতত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিছুদিন আবিরকে ওর মতো করেই থাকতে দে। দেখ ওর মতিগতি বদলায় কি না।”
ইকবাল খান মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন৷ দুই ভাইয়ের মুখে কোনো কথা নেই। ইকবাল খান গলা খেঁকিয়ে হঠাৎ উঠে বললেন,
“ভাইজান, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ, বল।”

“আফাকে কি তুমি সত্যিই মন থেকে মেনে নিয়েছো? নাকি মনের ভেতর এখনও ক্ষোভ রয়েই গেছে। ”
“মন থেকে না মানলে আমার বাড়িতে ঢুকার অনুমতি কোনোদিনও দিতাম না, এটা মাথায় রাখিস।”
“কিন্তু.. ”
“কিন্তু কি?”
“মাত্র দুই দিনের সাক্ষাতে আপুদের বাসায় দাওয়াত দিলে। এত সহজে সবটা মানিয়ে নিলে, বিষয়টা সত্যিই অবাক করেছে আমায়। ”
আলী আহমদ খান অনচ্ছ হেসে বললেন,
“তোদের চোখে বিষয়টা দুদিনের ঘটনা হলেও আমার কাছে এটা প্রায় ৮-১০ বছর যাবৎ চলমান একটা ঘটনা।”
“মানে..”

“মাহমুদার বিয়ের পর থেকে ১৫-২০ বছরের মতো আমি ওর নামটা সহ্যও করতে পারি নি। কত রাত ওদের উপর রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়েছি তার হিসেব নেই। আগে প্রতিবছর ঈদে বা অন্যান্য সময় বেড়ানোর জন্য প্রায় ই গ্রামে যেতাম, কিন্তু ঐ ঘটনার পর থেকে গ্রামে গেলে আমার পরিবারের নামে আজেবাজে কথা শুনতে হতো, তার জন্য বাধ্য হয়ে গ্রামের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিজের সাজানো সংসার কে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে সব ছেড়েছিলাম,এমনকি ঈদেও বাড়িতে পা দেয় নি।

সময় আর বয়সের সাথে সাথে অনেককিছু বদলাতে শুরু করে, কিন্তু আমি আমার নীতি থেকে সরতে পারি নি৷ হঠাৎ একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। কথা বলে জানতে পারি সে আমাদের গ্রামের মেম্বারের ছোটভাই মাইদুল । পড়াশোনা শেষে যশোরে চাকরির পোস্টিং হওয়ায় সেখানে যায়, ঐখানে মাহমুদাদের দেখে আমার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে সে আমায় ফোন দিয়ে জানিয়েছে। আমি সেদিন আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি, ওর নামটা শুনে মুখের উপর কল কাটতে পারি নি৷ বোনের প্রতি দূর্বলতায় মাইদুলের বলা সব কথায় শুনেছিলাম। তারপর থেকে মাইদুল মাঝেমধ্যে কল দিয়ে মাহমুদাদের খোঁজখবর জানাতো, কখনো কখনো আমিও কল দিতাম। ওদের ঢাকা আসার খবরও আমি আগেই পেয়েছিলাম, এমনকি আমি মাহমুদা আর ওর মেয়ে আইরিনকে আমি আগেও ২-৩ বার দেখেছি।”

“এতদিন আমাদের কিছু জানাও নি কেনো?”
“কিভাবে জানাতাম? আর কি ই বা জানাতাম!”
“তুমি আফাকে সত্যি মাফ করেছো?”
” যেদিন শুনেছিলাম ওর হাসবেন্ড হার্ট অ্যাটাক করেছে সেদিনই আমি ওদের মাফ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু নিজের নীতি থেকে নড়তে পারি নি, মনের উপর যে শক্ত আবরণ টা পরেছিল সেটাকেও সরাতে পারি নি, নিজের জেদ আর আক্রোশে নিজেই বন্দি হয়েছিলাম।

তারপর হঠাৎ যখন মাহমুদা আর জান্নাতকে দেখলাম আর মাহমুদা আমায় ভাইজান বলে ডাকলো, ওর ডাকে সেদিন মনে হয়েছিল আমার বুকের উপর থেকে ২৮ বছর যাবৎ জমা বিশালাকৃতির পাথর টা যেন মুহুর্তেই বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল ছোটবেলার মতোই সব ভুলে বোনকে কাছে টেনে নিতে, কিন্তু আমি পারি নি। আমার মন সায় দিলেও আমার হাত পা তাতে সায় দেয় নি। তারপর থেকে তোর ভাবি আর আবির, মোজাম্মেল আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। তাই সবকিছু ভুলে ওদের ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাঁচবো আর কতদিন! রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে ম*রেও শান্তি পেতাম না৷ ”

ইকবাল খান নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। কিছু বলার ভাষা নেই ওনার৷ বোনের প্রতি বড় দুই ভাইয়ের মতো ইকবাল খানের ভালোবাসাও প্রবল ছিল৷ মাহমুদা খান আর ইকবাল খান মোটামুটি সমবয়সী ছিল বিধায় দুজনের সম্পর্কটাও বেশ মজবুত ছিল। মাহমুদা খানের ছায়ায় বড় হওয়া ইকবাল খান হঠাৎ বোনকে হারিয়ে এলোমেলো হয়ে উঠেছিলেন। তার পরপর মাকে হারিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ইকবাল খানের জীবনটা বলতে গেলে অনেকটায় ছন্নছাড়া ছিল। এরপর থেকে বড় দুই ভাইয়ের শাসনেই বড় হয়েছেন। ভাইদের কথামতো ব্যবসার কাজে রাজশাহী থাকতে শুরু করেন আর সেখানে থাকা বাসার মালিকের মেয়ের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে যার পরিণতি হয়েছিল কোনোদিন রাজশাহী বিভাগে পা রাখতে না পারা। সংসারের মায়াজালে আটকে গিয়ে রাজশাহীর রমনীকে ভুলতে পারলেও বোনের প্রতি দূর্বলতা কাটাতে পারেন নি, ঢুকরে কেঁদেছেন বহুরাত।

সকালের খাবার খেয়ে তিনভাই অফিসে চলে গেছেন। মোজাম্মেল খান আবিরকে অফিসে যেতে বলেছিলেন কিন্তু আবির আজ ইচ্ছে করেই অফিসে যায় নি৷ আবির রুমে না থাকলে মেঘ আবিরের সব জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে পারে, সেই ভেবেই আবির কোথাও যায় নি। প্রায় ১১.৩০ নাগাদ মেঘ আবিরের রুমে আসছে। আবির রঙ সহ প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম আগেই আনিয়ে রেখেছিল৷ মেঘ মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,
“এখন আর্ট করবো?”
“তোর যখন ইচ্ছে করতে পারিস৷ আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
” আমার পছন্দের ডিজাইন এঁকে দিব?”
“অবশ্যই।”

মেঘ নেট থেকে দেখে কয়েকটা সুন্দর ডিজাইন আগেই বের করে রেখেছিল সেগুলোর একটায় এখন করতেছে । মেঘের পড়নে সুতি কাপড়ের থ্রিপিস,গলায় ওড়নাটা দু প্যাঁচ দিয়ে সামনের দিকে রেখেছে, ঘন,কালো, লম্বা চুলগুলো আজ আগে থেকেই সামলে এসেছে, চুলগুলো পেঁচিয়ে কাঁকড়া দিয়ে আঁটকে নিয়েছে। মেঘের ঘাড় উন্মুক্ত, ছোট ছোট চুল গুলো ঘাড়ে পড়ে আছে। আবির ল্যাপটপে কাজ করছে আর মাঝে মাঝে মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। মেঘ সরাসরি না দেখলেও, আবিরের নজর সে ঠিকই বুঝতে পারছে।

অস্বস্তিতে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে, নাকের ডগায়, কপালে, থুতনির উপরে ঘাম জমে একাকার অবস্থা হয়ে গেছে। হঠাৎ আবিরের ফোনে কল বেজে উঠলো, আবির যথারীতি ফোন কানে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। আবির বের হতেই মেঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবির রুমে নেই দেখে মেঘ কাজের গতি বাড়াচ্ছে, তাড়াতাড়ি ডিজাইন শেষ করে পালাতে পারলেই বাঁচে। আচমকা মীম দরজায় দাঁড়িয়ে কাশতে শুরু করলো৷ মেঘ বুঝতে পেরেও পেছন ফিরে তাকালো না। মীম রুমে না ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে কেশেই যাচ্ছে। মুহুর্তেই মেঘের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, মীমের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে হুঙ্কার দিল,

” আজকে আমায় জ্বালালে তোর খবরই আছে। ”
মেঘের ধমক খেয়ে মীমের ঠোঁট ভেঙে আসছে। মীম ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
” সরি আপু৷ আমি তোমাকে জ্বালাতে আসি নি। শুধু দেখতে আসছিলাম কোন ডিজাইন টা করতেছো। ”
মেঘ শীতল কণ্ঠে বলল,
“ভেতরে এসে দেখে যা কোনটা করছি।”

সঙ্গে সঙ্গে মীমের মুখে হাসি ফুটলো, ছুটে গেল রুমের ভেতর৷ মীমের উত্তেজনা দেখে মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“দেখিস, রুমের কোনো জিনিস নষ্ট করিস না যেন।”
মীম সম্পূর্ণ রুমে চোখ বুলিয়ে আমুদে কন্ঠে বলল,
“ওমা, এখন থেকেই ভাইয়ার রুমের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছো?”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
” আমি দায়িত্ব নিবো না তো কে নিবে!”
মীম হেসে বলল,

“আমিও সেটায় বলি, মনি মুক্তা তো আর দায়িত্ব নিতে পারবে না৷ ”
মেঘ কপাল কুঁচকে ভারী কন্ঠে শুধালো,
“মনি মুক্তা কে?”
মীম হাসতে হাসতে বিছানার পাশে বসে পরেছে। মীমের হাসি দেখে মেঘের চোখ আরও সরু হয়ে গেছে, কপালে কয়েক স্তর ভাজ ফেলে তাকিয়ে আছে। মীম ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
” ধরো তোমার স…”
মেঘ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“মীম….. ”

মীম দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ রাগে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ পর মীম আবার আসছে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো,
” আপু…”
“আবার কি হয়ছে?”
“তোমাকে দেখতে আসছি।”
“কেন? আমার কি রূপ বের হয়ছে?”
” তোমার এই রূপের আগুনে ভাইয়া এমনিতেই পাগল হয়ে গেছে, এরচেয়ে বেশি রূপ যদি বের হয় তাহলে ভাইয়া আর সহ্য করতে পারবে না। ”

“মীম, তোর মুখটা বন্ধ রাখবি? ওনি যদি এসব কথা শুনতে পায় তোকে আর আমাকে দুটাকেই আধম*রা করে ফেলবে।”
“তোমার ওনি নিচে বসে বসে প্রেম করতাছে। এখন আসবে না। ”
“কার সাথে প্রেম করে?”
” হবে তোমার চেয়েও সুন্দরী কেউ। ”
মেঘ রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“তুই যাবি এখান থেকে?”
মীম বিড়বিড় করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মৃদু বাতাসে মেঘের সামনের দিকের ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে, চোখ মুখে ঝাপটে পরছে, মেঘের দুহাতে রঙ ভরে আছে, তাই ঠিক করতে পারছে না। মীমের সাথে কথা বলতে বলতে মেঘ হাতের কব্জি দিয়ে চুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারছে না। বাধ্য হয়ে পুনরায় ডাকল,

” মীম…!”
ততক্ষণে মীম বেড়িয়ে গেছে। বেলকনিতে আবিরকে আসতে দেখে মীম দ্রুত পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেছে। মেঘ উচ্চ স্বরে মীমকে ডাকছে। মেঘ যে দেয়াল ডিজাইন করছে সেটা থেকে দরজা সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থিত। রুমে হঠাৎ কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে মেঘ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,
“এতক্ষণ ধরে ডাকছি আসছিলি না কেন? আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে যা।”
আবির বিছানার উপর ফোন রেখে মেঘের কাছে এগিয়ে গেল। মেঘের কাছাকাছি এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“এদিকে ঘুর।”

আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ চমকে উঠে পেছনে ঘুরলো। মেঘ পেছনে ঘুরতেই আবিরের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করল। আবির ঠিক মেঘের সম্মুখে দাঁড়ানো, মাঝখানে কেবল কয়েক ইঞ্চির গ্যাপ। আবিরের গা থেকে আসা তীব্র গন্ধে মেঘের মা*তাল হওয়ার অবস্থা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সামলাতে মেঘ ঢোক গিলে উষ্ণ কন্ঠে বলল,
” স সরি, আমি ভেবেছিলাম মীম আসছে।”
আবির নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন? আমি ঠিক করে দিতে পারি না?”

মেঘের হৃৎস্পন্দন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন হচ্ছে, শ্বাসনালিতে তুফান, গলা শুকিয়ে কাঠ। উত্তর দেয়ার মতো অবস্থা নেই। জানালা দিয়ে আসা আনম্র পবনে মেঘের ছোট-বড় চুলগুলো দুলল বাতাসে , দু একটা চুল চোখে লাগতেই মেঘ চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ চোখ বন্ধ রেখেই, মেঘ চুল সরানোর জন্য রঙে রাঙানো হাত তুললো, আবির সহসা মেঘের হাতের কব্জিতে ধরে থামিয়ে দিল। আবিরের স্পর্শে মেঘ আবারও চমকে উঠে।

মেঘ হতভম্ব হয়ে তাকালো। কয়েক মুহুর্ত নিগূঢ় দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মেঘের এক হাত আবিরের হাতে বন্দি, বাতাসের হাত থেকে চোখকে বাঁচাতে মেঘ এবার অন্য হাত তুলতে নিল, মেঘের আগে আবির ই নিজের অন্য হাত দিয়ে মেঘের কপালে দু আঙুল ছুঁইয়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে কানে গুজে দিতে লাগতো। আবিরের অনমনীয় হাতের স্পর্শে মেঘের ভেতরটা ছটফট করছে। আবেশে মেঘের দুচোখ বন্ধ হয়ে গেছে। আবির খুব যত্নসহকারে দুই-তিনবারে চুল সরানোর চেষ্টা করলো। মেঘ নিজেকে সামলে আচমকা চোখ মেললো, নিজের মনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

” ছাড়ুন আমায়। ”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ছাড়তেই যখন বলবি তবে এত আকৃষ্ট করিস কেনো আমায়?”
আবিরের কথা শুনে মেঘ বিপুল চোখে তাকালো। আবিরের বিশ্রান্ত চাহনিতে মেঘের অনুভূতির আকাশ জুড়ে প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। মেঘের আদলে লেপ্টে আছে প্রমত্ততা৷ মনে অনুরাগের সুর বাজছে।মেঘের বয়ঃসন্ধির প্রথম প্রেম আবির ভাই। সেই আবির ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা উন্মাদ করে তুলছে মেঘকে৷ আবিরের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বহুদিন আগেই মেঘের মনকে দূর্বল করেছিল, আবির ভাই নামক অসুখ বাসা বেঁধেছিল ছোট্ট মেঘের মনে। যে অসুখ সারানোর ঔষধ আজও আবিষ্কৃত হয় নি৷

আবির নিরেট দৃষ্টিতে মেঘকে দেখেই যাচ্ছে, মেঘও বৃহৎ আঁখিতে তাকিয়ে আছে আবিরের চোখের দিকে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। মেঘ ঘোরের মধ্যে থেকেই অকস্মাৎ পেছনে চলে যাচ্ছে। দু থেকে তিন কদম পেছাতেই আবিরের হাতে থাকা মেঘের হাতটা টান পড়ে, ওমনি আবিরের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। দেয়াল ভর্তি ভেজা রঙ, মেঘ বেখেয়ালি ভাবে পেছাচ্ছে দেখে আবির মেঘের হাতের কব্জি ধরে টান দিতেই মেঘের ছোট্ট দেহ আবিরের পেট আর বুকের মাঝামাঝি অবস্থানে ধাক্কা লাগে। আচমকা আক্রমণে মেঘের গা কেঁপে উঠলো। মেঘের দৃষ্টি আবিরের বুকের দিকে। আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তপ্ত স্বরে বলল,

” কারো প্রণয়ের পরিণীতা হতে চাইলে তার অনুষঙ্গের নিগূঢ়তা সহ্য করার প্রবলতা থাকতে হবে। অনাড়ম্বরে কাঙ্ক্ষিত অভিলাষ অপূর্ণ থেকে যাবে৷ ”
মেঘ কোনোভাবেই ধাতস্থ হতে পারছে না। হতবিহ্বলতায় মেঘের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মেঘের মনে একটা প্রশ্ন আচমকা আঘাত হানলো,
” ঐদিন রাতে কি আবির ভাই সজাগ ছিল? তবে কি আমার সব কথা শুনে ফেলেছেন?”

লজ্জায় মেঘের চিবুক নেমে গেছে, আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবিরের হাতে বন্দি নিজের হাতটার দিকে৷ নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই। দিশাহারা হয়ে আবিরের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসলো। আচমকা আবির মেঘের হাত ছেড়ে তড়িৎ বেগে মেঘের কোমল অনৃজু কোমড় আঁকড়ে ধরলো। ওমনি মেঘের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেছে। আবির এক টানে মেঘকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললো।

মেঘ প্রখর নেত্রে তাকালো আবিরের দিকে, চোখ দুটা রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস গলায় আঁটকে গেছে। আবিরের সম্মোহনী দৃষ্টিতে মেঘের মন তুষারের ন্যায় জমে গেছে। প্রত্যাশিত ব্যক্তির অপ্রত্যাশিত স্পর্শ ভেঙেচুরে দিচ্ছে মেঘের পিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডকে। দীর্ঘসময় পর মেঘ সর্বশক্তি দিয়ে নিজের ভেতরের আবদ্ধ নিঃশ্বাস টা ছাড়লো। মেঘের ধাঁরালো চাউনির নিকট আবির আজ বারংবার ধৃত হচ্ছে তবুও মেঘের স্নিগ্ধ ধৃষ্টতা থেকে নজর সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে। মেঘের শরীর মাত্রাতিরিক্ত ঘামতে শুরু করেছে।

মুহুর্তেই সুতি জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। মেঘের শরীরের তীব্র কম্পনে আবিরের হাতও কাঁপছে। ঘামের কারণে জামার উপর দিয়েই আবিরের হাতের পাঁচ আঙুল ভিজে গেছে। মেঘ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবির গভীর দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। মেঘ ভুলে গেছে হাত ভর্তি রঙের কথা, মুখের ঘাম মুছতে হাত তুলতেই আবির অন্য হাত দিতে মেঘের হাত স্পর্শ করলো, মেঘের হাতে লেগে থাকা ঘন রঙে আবিরের হাত ভরে গেছে, মেঘের দৃষ্টি সেদিকে পড়তেই তাড়াতাড়ি হাত সরাতে চাইলো। ততক্ষণে আবিরের পাঁচ আঙ্গুলে মেঘের আঙুলগুলো বন্দি হয়ে গেছে। মেঘ সুদীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস ছেড়ে আর্তনাদ করে বলতে নিলো,
“আমাকে ছা..”

আবির মেঘের হাত ছেড়ে এক আঙ্গুলে মেঘের ঠোঁট স্পর্শ করেছে। মেঘ সহসা নিশ্চুপ হয়ে গেছে, আবিরের আঙুলের রঙ মেঘের ঠোঁটে লেগে গেছে। মৃদু বাতাসে মেঘের চুলগুলো হালকা ভাবে উড়ছে। ভেতরের কম্পনে মেঘের সেদিকে খেয়াল নেই, আবির আলতো হাতে মেঘের চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। রঙের কারণে চুলগুলো একে একে রঙে আটকে গেছে, চুল সরাতে সরাতে আবিরের দৃষ্টি মেঘের গালে আঁটকালো। বাহির থেকে আসা আলোতে মেঘের গালটা অতিরিক্ত আদুরে দেখাচ্ছে, আবির নিজের মন আর হাত কোনেটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

না চাইতেই রঙে রঙিন হাতে মেঘের গাল ছুঁয়ে দিল, কয়েক মুহুর্ত গালে হাত রেখে ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে গলার একপাশে ঘাড়ে হাত ছুঁড়ালো। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মেঘ নিরস্ত হয়ে গেছে, আবিরের কর্মকান্ডে মেঘের সব শক্তি বিলীন হয়ে গেছে। মেঘের গালে আবিরের পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। আবির মেঘের ঘাড়ে হাত রেখে কিছুটা নিচু হয়ে অন্যপাশে মেঘের ঘাড়ের কাছে মুখ এগিয়ে নিল। আবিরের তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দিচ্ছে মেঘের মসৃণ গ্রীবা। মেঘ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের সুগভীর কন্ঠস্বর ভেসে উঠল,

” এটুকুতেই এই অবস্থা হলে কিভাবে কি হবে?”
আবিরের নেশাক্ত কন্ঠে বলা কথা মেঘের কর্ণপাত হলো না, আবিরের স্পর্শ আর নিঃশ্বাসেই মেঘ পাথর বনে গেছে। আবির আবেশিত কন্ঠে পুনরায় বলল,
” ম্যাম,নিজেকে সামলান, আমি কিন্তু আমাতে নেই। কোনো অনিষ্ট হলে আমি একা কুলষিত হবো না, আপনাকে নিয়েই হবো।”

আবিরের কথা মেঘের কানে ঢুকছে কি না কে জানে, মেঘ বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আবির মেঘকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে৷ মেঘ তখনও পূর্বের জায়গায় দাঁড়ানো। দেখে বুঝায় যাচ্ছে, নিজের সেন্সে নেই। আচমকা মেঘ পেছাতে শুরু করে, দেয়ালে আটকানোর পূর্বেই আবির এগিয়ে এসে মেঘের চুলের খোঁপার ঠিক পেছনে দেয়ালে এক হাত রাখলো, যেন মেঘের চুলে রঙ না লাগে। অন্য হাতে দেয়াল ধরে নিজেকে আটকালো। মেঃ ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

“আমি রুমে যাব।”
আবির মিটিমিটি হেসে শুধালো,
“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
মেঘ চিবুক নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ!”
আবির মনে মনে বিড়বিড় করল,
“কিছু করলামই না, এতেই নাজেহাল অবস্থা। কিছু করলে তো আপনাকে খোঁজে ই পাওয়া যাবে না। এই আবার আপনি আবিরের প্রণয়িনী হতে চান!”
মেঘ শীতল কণ্ঠে বলল,

“সরুন আমি চলে যাব। রঙ পরে করে দিব।”
আবির মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার ইচ্ছে। ”
আচমকা বেলকনি থেকে তানভির ডাকলো,
“ভাইয়া আসবো?”
মেঘ তানভিরের কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে উঠল। গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ৷ মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া আসছে, সরুন প্লিজ।”
আবির ভ্রু কুঁচকে শক্ত কন্ঠে বলল,
“তোর ভাইকে কি আমি ভয় পাই নাকি?”
আবির তানভিরকে উদ্দেশ্য করে উচ্চ স্বরে বলল,
“নাহ। ব্যস্ত আছি। ”
“তুমি যেগুলো আনতে বলছিলে সেগুলো নিয়ে আসছি। ”
“তোর কাছে রাখ, পরে দেখে নিয়ে আসবো। ”

“আমি আবার বেড়িয়ে যাব৷ ফিরতে রাত হবে। তোমার রুমে রেখে যায় ”
আবির বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
“উফফফ, রেখে যা।”
মেঘ উপায় না পেয়ে আবিরের প্রশস্ত বুকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো, ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তানভির বিছানায় কিছু কাগজ আর ২-৩ টা বক্স রাখতে রাখতে বলল,
“তোমার..”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৩

বলতেই মেঘকে অল্পবিস্তর চুপ করে গেল। কপাল গুটিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে কান হাত দিয়ে বিড়বিড় করে “সরি” বলল। আবির চোখে ইশারা করতেই তৎক্ষনাৎ নিজের মাথায় চাপড় মারতে মারতে বেড়িয়ে যাচ্ছে, যেতে যেতে দরজা টাও চাপিয়ে রেখে গেছে। তানভির নিজের কপাল চাপড়ে বেলকনিতে হাঁটছে আর বলছে,
“ছিঃ তানভির, ছিঃ। তুই এত নির্লজ্জ কেন?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here