আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

তানভির বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুম পর্যন্ত যেতেই ফোনে কল বেজে উঠল৷ তানভিরের বেস্ট ফ্রেন্ড সোহাগ কল দিচ্ছে৷ তানভির কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সোহাগ একদমে কতকি বলতে থাকলো। তানভির প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,
” আমাকে এসব বলে কোনো লাভ নাই৷ আমি এখন আসতে পারবো না। এমপির সাথে একটা পোগ্রামে যেতে হবে। ”
“প্লিজ দোস্ত৷ একটু আয়! ”
“আরে ভাই আমার সময় নাই। ”

” শুন তানভির, আমাকে যতই ব্যস্ততা দেখাস সমস্যা নাই। কিন্তু তোর গার্লফ্রেন্ড এর জন্য অন্তত আয়।”
” একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবি না। তোর আমার মাঝখানে ও কে কেনো টানতেছিস?”
“কারণ আমার কথা তুই গুরুত্ব দিচ্ছিস না। প্লিজ তানভির, জাস্ট ৫ মিনিট লাগবে, আয় তুই। ”
তানভির ভারী কন্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বন্যা কি এখনও ভার্সিটিতে? ”
“আমি তোর কাছে সকাল থেকে চিল্লাচিল্লি করছি, তুই আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না৷ বন্যার নাম শুনতেই কন্ঠস্বর পাল্টে গেছে। দাঁড়া, এখন থেকে তোকে ওর কসম দিয়ে সব কাজ করাবো।”
তানভির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” আর যাই করিস, কোনোদিন ওর নাম নিয়ে কসম কাটতে বলবি না। পরিবারের বাহিরে ও আমার একমাত্র দূর্বলতা। তাছাড়া কসম কাটা ঠিক না। ”

“আচ্ছা ঠিক আছে, কাটাবো না কসম। এখন বল আসবি ?”
“বন্যা যদি সত্যি ই ভার্সিটিতে থাকে তাহলে আসবো।”
“আরে আছে আছে। প্রয়োজনে আটকিয়ে রাখবো। তাও তুই আয়। আমার কাজ টা কিন্তু করে দিতে হবে। ”
” ভুলেও বন্যাকে কিছু বলতে যাইস না। আমি আসতেছি।”

তানভির দ্রুত বেড়িয়ে পরেছে। এদিকে মেঘ আবিরের আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তানভির চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে, মেঘ আতঙ্কে এখনও চোখ খুলতে পারছে না। আবির ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে অপলক দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে। তিরতির করে কাঁপছে মেঘের ওষ্ঠদ্বয়, লজ্জা আর ভয়ে নাকের ডগা আর গাল পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা বুঝতে পেরে মেঘ ধীরে ধীরে চোখ মেলল ৷ সরাসরি চোখ পরল আবিরের চোখের দিকে। আবিরের নেশাক্ত দৃষ্টি দেখে মেঘ লজ্জায় মাথা নিচু করে ঘাড় কাত করে তানভিরকে দেখার চেষ্টা করলো। তানভিরকে রুমের কোথাও দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

” ভাইয়া কোথায়?”
“চলে গেছে ”
“কেন?”
“সেটা আমি কিভাবে বলবো, তোর ভাইকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে।”
হঠাৎ দেয়ালের দিকে আবিরের নজর পরে। যে হাতটা দিয়ে নিজেকে আঁটকেছিল সেই হাতে যে রঙ ছিল আবিরের সেটা খেয়াল ই ছিল না। মেঘের চুল বাঁচাতে গিয়ে উল্টো দেয়াল নষ্ট করে ফেলেছে। আবিরের সাথে সাথে মেঘ ও চোখ ঘুড়িয়ে তাকালো। দেয়ালে আবিরের হাত দেখে আর্তনাদ করে উঠল,

“এটা আপনি কি করলেন?”
“আমি ইচ্ছে করে করছি নাকি? তোর চুল বাঁচাতেই তো করেছি। ”
মেঘ একটু দূরে সরে দেয়ালটাকে দেখে পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমি এখানটায় এখন কিভাবে ডিজাইন করবো?”

আবির মেঘের হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে রঙের বক্সে চুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে ছাপ দিল। যেখানে আবির হাতটা রেখেছিল ঠিক সেখানেই। মেঘ আটকানোর খুব চেষ্টা করেছে কিন্তু আবিরের শক্তির সামনে মেঘ অতি নগন্য একটা মানুষ৷ আবিরের হাতের রঙ অনেকটা শক্ত হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো বুঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু মেঘের হাতের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ভালোভাবে খেয়াল করলে মেঘের ছোট্ট হাতকে ঘিরে আবিরের বড় হাতের অপ্রখর ছাপ টা ঠিকই চোখে পরে। মেঘ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল,

” আপনি এমন করলেন কেন?”
” কি ডিজাইন করবি ভেবে পাচ্ছিস না তাহলে কি করব?”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমি কিন্তু সম্পূর্ণ দেয়াল টায় নষ্ট করে ফেলবো।”
আবির মুচকি হেসে বলল,
” একদিনের জন্য রুম তোকে দিয়ে দিয়েছি, সাজাবি নাকি নষ্ট করবি পুরোটাই তোর উপর। আমি কিছুই বলবো না। ”
মেঘ শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,

“মাঝখানে হাতের ছাপটার কারণে কি পঁচা লাগছে। আপনি এমনটা না করলেও পারতেন। ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তুই তোর কাজ শেষ কর, তারপর দেখিস কত সুন্দর লাগে। ”
মেঘ মুখ ভোঁতা করে ঠোঁট ভেঙে কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির মুচকি হেসে দু আঙুলে মেঘের রাগে ফুলে উঠা নাকটা আলতোভাবে চেপে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” দেয়াল জুড়ে এত সুন্দর পেইন্টিং থাকবে আর তাতে ডিজাইনারের হাতের ছাপ থাকবে না তা কি করে হয়! ছাপ টার নিচে তোর নামটাও লিখে দিস। ”
“বাসার মানুষ দেখলে কি ভাববে!”

” বাসার মানুষ যখন জিজ্ঞেস করবে এই ডিজাইন কে করেছে? তখন আমি কি বলবো? শেওড়াপাড়ার পে*ত্নীটা ডিজাইন করে দিয়ে গেছে নাকি আমার কাল্পনিক বউটা এসে করেছে?”
মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল,
“কথায় কথায় বউ বউ করবেন না। আমি কিন্তু বড় আব্বুকে বলে দিব ”
“কি বলবি?”

“বলবো আপনি সারাদিন বউ বউ করেন, অথচ বিয়ের কথা বললে ভাব নেন। আপনাকে ডাক্তার দেখাতে হবে! ”
আবির নিঃশব্দে হেসে শুধালো,
“তুই কি আমায় ইন্ডাইরেক্টলি পাগল বললি? ”
“মুখের উপর কিভাবে বলবো! ”
“কিহ?”

আবির এক পা এক পা করে এগুচ্ছে, মেঘ পেছাতে পেছাতে চেঁচিয়ে উঠল,
“এমন করলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”
“কর চিৎকার। কাকে ডাকবি ডাক, দেখি তোকে কে বাঁচায়। ”
মেঘ ভেঁজা কন্ঠে ডেকে উঠল,
” আম্মু বাঁচাও!”
আবির মেঘের মুখ চেপে ধরে ঠাট্টার স্বরে বলল,

“ছিঃ মেঘ! যেভাবে মামনিকে ডাকছিস, মামনি ভাববে আমি তোকে ধ*… ছিঃ ”
মেঘ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির মেঘের মুখ ছেড়ে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“সরি, তোকে আর ডিস্টার্ব করব না। তুই তোর কাজ শেষ কর। ”

আবির টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেছে৷ মেঘ আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আবির ভাই যে রাগ করেছে এটা ওনার কথাতেই বুঝা গেছে। মেঘ কি করবে তাই ভাবছে। আচমকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে নজর পরতেই মেঘ সব ভুলে গেল। গালে আবিরের হাতের স্পর্শ, গলা আর ঘাড়েও আঙ্গুলের দাগ, নাক আর কপাল জুড়েও রঙ লেগে আছে। মেঘ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবছে আর বার বার লজ্জায় ললিত হয়ে যাচ্ছে৷ মেঘ নিজের গালে হাত রেখে আবিরের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করছে ওমনি বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়ে গেছে । আচমকা মীম দরজায় দাঁড়াতেই মেঘ তাড়াহুড়ো করে দেয়ালের দিকে ঘুরে মাথায় ওড়না দিল যাতে রঙের দাগ মীম কোনোভাবেই না দেখে। মীম দৌড়ে এসে উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো,
“আপু তুমি আমায় দেখে কি লুকাইছো? দেখি এদিকে ঘুরো তো৷ ”

মেঘ দেয়ালে রঙ করতে করতে তপ্ত স্বরে বলল,
“ডিস্টার্ব করিস না৷ রুমে যা ”
“তুমি কি লুকাচ্ছো বলো, তাহলেই চলে যাব।”
মেঘ হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“আবির ভাই কিন্তু ওয়াশরুমে আছে। ডাকবো?”
মীম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া রুমে আগে বলবা না, আমি গেলাম। পরে এসে দেখবো তুমি কি লুকাইছো। ”
মেঘ কিছুক্ষণ ভেবে পুনরায় কাজ শুরু করল। আবির ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ভেজা শরীরে টিশার্ট গায়ে দিয়ে ফোন নিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে, মেঘের দিকে একবারের জন্য তাকিয়েও দেখে নি। মেঘ অসহায় মুখ করে আবিরের যাওয়ার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। চোখেমুখে বিষন্নতা ভর করেছে, তবুও সবকিছু একপাশে রেখে কাজে মনোযোগ দিল। আবির নিচে নামতেই মীম ছুটে গেল মেঘকে দেখতে। ততক্ষণে মেঘ রঙ দিয়ে গালে আর গলায় থাকা আঙুলের ছাপ গুলো মুছে ফেলেছে।
মীম রুমে ঢুকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“তখন কি লুকাইছিলা?”
মেঘ স্বাভাবিক ভাবে ঘুরে মীমের গালে রঙের দু আঙুল ছুঁইয়ে বলল,
“তোর কাছ থেকে আমি কি লুকাবো বল?”
“আপু তোমার গালে এত রঙ কেন?”
“খেয়াল ছিল না, হুট করে গালে হাত দিয়ে ফেলছিলাম। ”
দুটা দেয়াল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মীম বলল,
“আপু, দুটা ডিজাইন ই অনেক সুন্দর হয়েছে। ভাইয়ার রুমটা অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ”
মেঘ মৃদুস্বরে বলল,

“সত্যি সুন্দর হয়েছে?”
“১০০% সত্যি। ”
“ওনার কি পছন্দ হবে? কিছুই তো বললেন না”
“আমি বলছি ভাইয়ার পছন্দ হবেই হবে। তাছাড়া তুমি যা এঁকে দিবা ভাইয়া সেটার ই প্রশংসা করবে দেইখো। সেটা যদি ব্যাঙের ছাতাও হয় তবুও বলবে অনেক সুন্দর হয়েছে। ”
মীম বিছানার উপর বসে পা ঝুলাচ্ছে আর মেঘের সাথে গল্প করছে। মেঘ আবিরের কথা মতো নিজের হাতের ছাপটার নিচে নিজের নাম লিখেছে তাছাড়া একসাইডে ‘সাজ্জাদুল খান আবির’ নাম লিখে ডিজাইনও করে দিয়েছে। মীমকে কিছু জিনিস দিয়ে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকি গুলো নিয়ে মেঘ পেছন পেছন আসছে। এতক্ষণের মধ্যে আবির একবারও উপরে যায় নি৷ মীম নিচে আসতেই আবির প্রশ্ন করল,

” তোর বোনের কাজ শেষ হয়েছে? ”
“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে।”
আবির কোনো কথা না বলেই নিজের রুমে চলে গেছে। দুটা দেয়ালের ডিজাইনের কারণে রুমটাকে চেনায় যাচ্ছে না। আবিরের রুম টা খান বাড়ির সবগুলো রুমের থেকে বড়। এক সময় এই রুমে আলী আহমদ খান আর মালিহা খান থাকতেন। ওনাদের জন্য ই মূলত বানানো হয়েছিল পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যার কারণে আলী আহমদ খানরা নিচে চলে আসেন। আর রুমটা আবিরের দখলে চলে যায়। রুমটার ঠিক মাঝামাঝিতে দরজাটা অবস্থিত।

ভেতরে একপাশে আবিরের ব্যবহার্য সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী আর অন্য পাশে সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ছোটবেলার সাইকেল থেকে শুরু করে, লাগেজ, ক্রিকেট, ফুটবল খেলার যাবতীয় জিনিসপত্র, পুরোনো একটা ওয়ারড্রব আরও অনেককিছু। ঐদিকের সব জিনিসপত্র বড় কাপড় দিয়ে ঢাকা। মালিহা খান বলেছিলেন পুরোনো জিনিসপত্র স্টোররুমে রেখে দিতে কিন্তু আবির সেগুলো সরাতে রাজি হয় নি। রুমে আর্ট করায় এখন এক পাশ অতিরিক্ত সুন্দর হয়ে গেছে আর অন্যপাশ অগোছালো।

তবে আবিরের সেদিকে মনোযোগ নেই। আবির উদ্রিত নয়নে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। একবার চোখ পরছে নিজের নামের দিকে পুনরায় নজর আঁটকায় মেঘের হাতের ছাপে সেই সাথে লেখা ‘Megh’ নামটার উপর। অকস্মাৎ আবিরের মুখে হাসি ফুটে।
অন্যদিকে তানভির ভার্সিটির সামনে আসতেই সোহাগ আর শিমুলকে দেখতে পেল। ওরা তানভিরকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। তানভির প্রশ্ন করল,

“বন্যা কোথায়?”
” চল,আমাদের কাজটা আগে শেষ করে আসি! ৫ মিনিটের কাজ। ”
“বন্যার সাথে আগে দেখা করবো তারপর তোদের ব্যাপারটা ভেবে দেখব।”
“দুটা মেয়ের সাথে ঐদিকে গেল। ”

তানভির ওদের দেখানো পথে বাইক স্টার্ট দিল। থামলো ঠিক বন্যাদের পেছনে। বন্যারা পেছন ফিরে তাকিয়েও দেখল না। তানভির ঘনঘন হর্ন দিতে লাগলো। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বন্যা পেছন ফিরতেই দেখলো তানভির বাইক থেকে নিরেট দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বন্যা চেহারা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। তানভির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এদিকে আসো।”

বন্যা বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসলো। তানভির প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,
“ফোন দিলে ফোন রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করো না। ইদানীং ফোন বন্ধ করে রেখেছো। সমস্যা কি?”
বন্যা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আমার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন ফোন কিনতে হবে। আব্বু বলছেন আগামী সপ্তাহে ফোন কিনে দিবেন।”
“ওহ৷ আর কোনো কারণ নেই তো?”
“আর কি কারণ থাকবে?”

“ভাইয়া যখন এক্সিডেন্ট করেছিল তখন তোমাকে রাগে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম তারজন্য দুঃখিত। ভাইয়ার র*ক্তা*ক্ত দেহ দেখে আমি তখন মানসিকভাবে ভেঙে পরেছিলাম। বুঝে না বুঝে তোমার সাথে রাগ দেখিয়েছি৷ ”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
” কোনো ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করি নি। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এভাবেই রিয়েক্ট করতাম নয়তো আরও বেশি করতাম৷ ”
“I am really Sorry, Bonna.”
“এত ফরমালিটি করতে হবে না। আমি সত্যি ই কিছু মনে করি নি। আবির ভাইয়া এখন কেমন আছেন? মেঘ কেমন আছে?”

“দুজনেই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”
বন্যা হঠাৎ ই ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে শুধালো,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। ”
“আপনি মিনহাজ আর তামিমকে কি করছিলেন?”
“কেনো? কোনো সমস্যা? ”

“না না৷ ওরা অনেকদিন ভার্সিটিতে আসে নি। এখন আসলেও অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে তাই বলছিলাম..! ”
“ওহ আচ্ছা। এসব কোনো বিষয় না। আমি বেশি কিছু করি নি। আমার জায়গায় ভাইয়া থাকলে ওদের আর কোনোদিন দেখতেও পারতা না। ”
তানভির একটু থেমে আবার প্রশ্ন করল,
“ওহ একটা কথা, ভার্সিটিতে কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করে?”
বন্যা মনে মনে আওড়াল,
“ডিস্টার্ব করলেও তো আপনাকে বলবো না।”
স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” নাহ। ”

“যদি মনে করো আমাকে না বললে আমি কিছু জানতে পারবো না তাহলে এটা তোমার ভুল ধারণা, বরং তুমি নিজ থেকে জানালে তোমারই লাভ। ”
বন্যা কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“এখন আসি। ”
“যেতে বলছি তোমায়?”
“আমার তাড়া আছে। ”
“কেন?কেউ অপেক্ষা করছে?”
“মানে..”
“কিছু না।”
“ভার্সিটিতে পরশুদিন পোগ্রাম আছে কষ্ট করে মেঘকে জানিয়ে দিয়েন৷ ”
“ঠিক আছে। এখন চলো”
“কোথায়?”
“তোমায় কিছু খাওয়ায়। ”

“আমি আজ কিছু খাবো না। অন্য কোনো দিন আমি আপনাদের খাওয়াবো।”
তানভির ভারী কন্ঠে বলল,
“সেসব পরে দেখা যাবে, এখন বাইকে বসো। একগ্লাস আঁখের জুস হলেও খেতে হবে। না হয় আমি ধরে নিব, তুমি আমার উপর রাগ করে আছো। ”
“আমি সত্যি রেগে নেই। বিশ্বাস করুন।”
“মানলাম & বিশ্বাসও করলাম, এখন চলো।”

বন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বাইকে উঠে বসলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তানভিরের সঙ্গে দু গ্লাস আঁখের জুস খেয়েছে। শুধুমাত্র মেঘের ভাই বলে বাধ্য হয়ে বন্যা তানভিরের সাথে কথা বলে, না হয় কোনোদিন বলতো না। মিনহাজ আর তামিমকে বন্যা দু একবার জিজ্ঞেস করেছিল, কি হয়েছিল বলতে কিন্তু ওরাও কিছু বলে না। বারবার কথা এড়িয়ে যায়, তারজন্য বন্যাও তেমন জোর করে না। তবে ভালো কিছু যে ঘটে নি, বন্যা ১০০% নিশ্চিত।

আবিরের অসুস্থতার পর থেকে মেঘ মিনহাজদের কথা ভুলেও ভাবে না৷ বন্যা কিছু বললেও তেমন পাত্তা দেয় না, এমনকি রেগুলার ভার্সিটিও আসে না। বাড়ির কেউ কিছু বললে, শরীর খারাপ, মন খারাপ বলে নানান বাহানা দেয় আর বাকি সব তানভির সামলায়। না বোনকে কিছু বলতে পারে আর না বাসায়৷ মেঘের চোখে তানভির সেরা ভাই হলেও বন্যার চোখে তানভির একজন রাজনীতিবিদ, দাপটী, ভি*লেন টাইপের ছেলে। এত বছর যাবৎ মেঘকে শাসন করা দেখে বন্যা তানভিরকে ভয় পেত, মিনহাজদের ঘটনার পর থেকে বন্যা আরও বেশি আতঙ্কে থাকে। দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে। তানভির বন্যাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে সোহাগ দের কাছে আসছে৷ সোহাগ ঠাট্টার স্বরে বলল,

“আগে আসতেই চাইছিলি না আর এখন….”
তানভির মুচকি হেসে বলল,
” কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম।”
“আহা! কত আবেগ! ”
“কোথায় যাবি বলছিলি চল”
বিকেল থেকেই মেঘ আর মীম শপিং এ যাবে বলে পাগলামি করছে। তানভিরকে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু তানভির পোগ্রামে ব্যস্ত বলে যেতে পারবে না ৷ মেঘ আর মীম একা যেতে পাগলামি শুরু করেছে৷ ওদের হাউকাউ শুনে আবির নিচে আসছে। আবিরকে দেখেই দুই বোন চুপ করে গেছে৷ সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসায় আবিরের চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে আছে।

আবির অস্ফুট কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে তোদের?”
মেঘ, মীম কেউ কোনো কথা বলল না। আকলিমা খান বললেন,
“ওরা শপিং এ যেতে চাচ্ছে।”
“যেতে চাচ্ছে যাক, সমস্যা কি?”
“একা যেতে চাচ্ছে! ”
আবির কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“একা যেতে হবে কেন? তোমরা না গেলে আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি । ”
মেঘ আর মীম দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,
“নাহ!”

রাগে আবিরের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“সমস্যা কি তোদের?”
মেঘ মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
“কোনো সমস্যা নাই”
“সমস্যা না থাকলে কাকিয়াদের নিয়ে শপিং এ যা৷ বেশি ত্যাড়ামি করবি না। ঠিক আছে?”

মেঘ একদৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো। অনুমতি ছাড়া একা শপিং এ যাওয়া অসম্ভব বিষয় এটা তাদের অজানা নয়, তবুও চেষ্টা করে দেখছিল, যদি অনুমতি পেয়ে যায়। আবির আগের ভাবমূর্তি বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে, মেঘ আর মীম তাড়াহুড়ো করে নিজেদের রুমে চলে গেছে। হালিমা খান আর আকলিমা খানের সঙ্গে মীম আর মেঘ শপিং এ গেছে। মেঘ আর মীম সুযোগ বুঝে আবিরের জন্য ২-৩ টা সাদা টিশার্ট, আর দুজনের জন্য ৩ টা পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে আসছে। মেঘরা বাসায় ফিরতেই তানভির ভার্সিটির পোগ্রামের কথা বলেছে৷ আবিরও সেখানেই উপস্থিত ছিল৷ মেঘ নিজের হাতের শপিং ব্যাগ গুলো লুকিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেছে৷ আবির বিষয়টা খেয়াল করেও কিছু বলে নি৷

আবির রাতে ঘুমানোর জন্য রুমে ঢুকে দরজা চাপাতেই রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেছে। আবিরের দরজার আড়ালে মেঘের হাতের ছাপটা আগের মতো বেরঙিন নেই। মেঘ সেখানে নীল রঙের ছাপ দিয়েছে, এমনকি অন্য হাতের ছাপও দিয়েছে। পাশাপাশি মেঘের দু হাতের ছাপ দেখে আবির মুচকি হেসে বলল,
” পাগলি একটা। ”

পোগ্রামের দিন ঠিক সময় মতো মেঘ ভার্সিটিতে চলে আসছে৷ মেঘকে দেখে মিনহাজ আর তামিম এগিয়ে এসে শুধালো,
“কেমন আছিস? ”
মেঘ অন্যদিকে মুখ করে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। ”

মেঘ ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। বন্যা আর মেঘ দুজনেই আজ গাউন ড্রেসের সঙ্গে হিজাব পড়ে আসছে। মেঘ আর বন্যা কিছুটা সামনে এগুতেই লিফাত নামের ছেলেটার সাথে দেখা। লিফাতের হাতে সিগারেট, বন্যা আর মেঘকে দেখেই থতমত খেল। সিগারেট পেছনে ফেলে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
“কেমন আছো তোমরা?”
বন্যা আর মেঘ দুজনেই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে৷ বন্যা ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
বন্যা মেঘের হাত ধরে বলল,
“চল এখান থেকে।!

মেঘ তখনও সরু নেত্রে লিফাতকে পরখ করছে। ছেলেটার মুখে রহস্যময় হাসি৷ লিফাত প্রশ্ন করল,
” কেউ কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে প্রতিত্তোরে তাকেও জিজ্ঞেস করতে হয় এটাও কি জানো না?”
বন্যা শক্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“নাহ। জানি না। ”
বন্যা মেঘকে টেনে নিয়ে চলে গেছে । মেঘ কপাল কুঁচকে শুধালো,
“এই ছেলে আবার কে?”
“রসায়ন ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের এক বড় ভাই৷ ”
“তোর সাথে কথা বলতে আসছে কেন?”

“আল্লাহ জানেন। তুই তো ইদানীং তেমন ক্লাসে আসিস না, একদিন আমি ফোনে কথা বলছিলাম, তখন এই ছেলে ইচ্ছে করেই আমার কাছে গেছে। আমি হঠাৎ ঘুরাতে প্রায় ধাক্কা লেগেই গেছিল, কথা বার্তা নেই হুট করে আমাকে ধমকিয়ে চলে গেছে। এরপর থেকে দেখলেই কেমন করে হাসে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করে৷ ইচ্ছে করে মা*থাটা ফা*টিয়ে দেয়। ”

“ভাইয়াকে বলবো?”
“না না না৷ তোর ভাই আরেক ডেঞ্জারাস পাবলিক। ঐদিন দেখা হয়ছিল পরেও জিজ্ঞেস করতেছিল, আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করে কি না!”
“তুই কি বলছিস?”
“আমি না করছি।”
“কেনো?”
“তোর ভাই মিনহাজদের যে অবস্থা করছে, আমি আর কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না।”
“তাহলে আবির ভাইকে বলি?”

“ভুলেও না। তোর এই গু*ন্ডাপা*ন্ডা ভাইদেরকে আমার ব্যাপারে কিছু বলবি না।”
“তুই গুন্ডাপান্ডা কাকে বলছিস? আমার আবির ভাই ভাই হিরো নট ভি*লেন ওকে?”
“আর তোর ভাই?”
“আমার ভাই ও হিরো৷ মিনহাজদের যদি মে*রেও থাকে, ভাইয়া কি শুধু শুধু মা*রছে নাকি? আমার কর্মকাণ্ডে তোর কি তখন আমাকে মা*রতে ইচ্ছে করে নি? বল করে নি?”
“করেছে। ”

“তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমার কাজে তুই আমার উপর বিরক্ত হয়ছিস৷ এমনকি আমি নিজেই আমার উপর বিরক্ত ছিলাম। সেখানে ভাইয়া না মিনহাজকে চিনে, আর না তামিমকে চিনে। আবির ভাই আর তানভির ভাইয়ার প্রাণ এক সুতোয় বাঁধা, ওদের একজনের কিছু হলে আরেকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাঁচাবে। সেখানে সামান্য মা*ইর আর এমন কি!”
বন্যা উদাসীন কন্ঠে বলল,
“এখন চল, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে ”
মেঘ আর বন্যা ভেতরে ঢুকলো। পেছন দিকে বসতে যাবে এমন সময় ওদের একজন ক্লাসমেট সামনে থেকে ডেকে বলল,

“মেঘ, তোরা এখানে আয়। তোদের জন্য সিট আছে।”
মেঘ আর বন্যা এগিয়ে গেল। পাশাপাশি দুটা সিটে মেঘ আর বন্যা বসলো৷ ওদের সামনের সারিতেই লিফাতের বন্ধুরা বসা, কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই লিফাত এসে বসলো। মেঘ আর বন্যা লিফাতকে দেখেই পেছনে চলে যাওয়ার জন্য ফিসফিস শুরু করল। লিফাত পেছনে ঘুরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আরে তোমরা এখানে, কোনো কিছু লাগলে শুধু একবার বলবা, সাথে সাথে এনে দিব। ”
বন্যা আর মেঘ দুজনেই রাগে ফুঁসছে। বন্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ একজন রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,

” তোর কলিজাটা আমার লাগবে, দে এখন ”
মেঘ আর বন্যা দুজনেই চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালো৷ লিফাত ও আঁতকে উঠে সেদিকে তাকালো। চোখ পর্যন্ত ঢেকে রাখা ক্যাপ টা সরাতেই তানভিরের মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। লিফাতের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানভিরকে দেখে বন্যা আর মেঘ দু’জনেই ভয় পাচ্ছে। লিফাত বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ ই হেসে ফেলল।
তানভির চোখ মুখ কুঁচকে পুনরায় বলল,

“কি হলো দিবি না? মেয়েদের প্রতি এত যত্ন, যা চাইবে সাথে সাথে এনে দিবি আর আমি সামান্য কলিজাটা চাইছি তুই সেটা দিতেই রাজি হচ্ছিস না! লিফাত, তোর থেকে এটা আশা করি নি।”
লিফাত হঠাৎ ই অস্বাভাবিকভাবে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে বলল,
” আরে ভাই তুমি? তোমার কি লাগবে বলো শুধু! দেখো তোমার ভাই তোমার জন্য কি করে!”
তানভিরের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
“আপাতত তোর কলিজাটা হলেই হবে৷ চাইলে তোর হার্টটাও দিতে পারিস, আমিও দেখি ঐখানে ঠিক কতজনকে জায়গা দিয়েছিস৷ ”

লিফাত মুখে হাসি রেখেই বলল, এই সর সর, আমাকে সাইড দে। লিফাত এগিয়ে আসতেই তানভির বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো । লিফাত তানভিরকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“প্লিজ ভাই, এখানে অনেক জুনিয়র আছে। ওদের সামনে আমার মানসম্মান টা ডুবিয়ো না। প্লিজ।”
তানভির রাগান্বিত কন্ঠে গজগজ করতে করতে বলল,

“তোর হিসাবের খাতায় এখন অব্দি ১০০০ খানের মেয়ের নাম উঠেছে। আর কত?”
“সরি ভাই। তুমি এখানে কেন আসছো ওরা কি তোমার কিছু হয়? নাকি অন্য কারো জন্য আসছো?”
“যেই বন্যার পিছনে ঘুরঘুর করছিস সে একান্ত ই আমার, তার পাশের জন আমার একমাত্র বোন আর আবির ভাইয়ার পার্সোনাল সম্পত্তি। তুই ভুল জায়গায় হাত বাড়িয়েছিস লিফাত, তোকে কি করা উচিত নিজেই বল। ”
“সরি ভাইয়া। প্লিজ মাফ করে দাও। আমি জানতাম না ওরা তোমার কাছের লোক।”
“তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি লিফাত, ভবিষ্যতে কোনো মেয়ের দিকে কুনজর দিলে, সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারবি না বলে দিলাম। ”

“প্লিজ তানভির ভাই, এমনটা করো না। প্রয়োজনে আমি তোমার পায়ে ধরে মাফ চাইবো। আবির ভাইয়া কোথায় আছেন, আমি ওনার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিবো। তবুও এমন কিছু করো না ভাই। ”
“ঠিক আছে৷ লাস্ট বারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। ”
লিফাত একগাল হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ ভাই। ”
তানভির ভারী কন্ঠে বলল,
“মনে থাকে যেন।”
“অবশ্যই। ”
লিফাত নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। পেছন ফেরা তো দূর ঘাড় পর্যন্ত কাত করছে না। তানভির মেঘ আর বন্যার জন্য কিছু খাবার আগেই কিনে নিয়ে আসছিল। সেগুলো দিয়ে ক্যাপ পড়তে পড়তে বলল,
“আমি আসছি।”
মেঘ হাসিমুখে বলল,
“অনুষ্ঠান দেখবা না?”
“আমি অনুষ্ঠান দেখতে আসি নি। যে কাজে আসছিলাম তা শেষ । অনুষ্ঠান শেষে বাসায় চলে যাস, উল্টাপাল্টা ঘুরিস না। ”
তানভির চলে গেছে। খুশিতে মেঘের চোখ চকচক করছে। বন্যার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,
“দেখেছিস, আমার ভাই সেরাদের সেরা। তুই না বললেও ঠিকই জেনে ফেলছে৷ ঐ ছেলে মাফ যে চাইছে দেখছিস! ”

বন্যা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল,
“তুই গিয়ে শুনছিলি? মাফ নাও চাইতে পারে ”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এই তুই কি আমার ভাইয়ের পাওয়ার নিয়ে সন্দেহ করছিস? আমি সিউর এই ছেলে ভাইয়ার কাছে মাফ চাইছে৷ বিশ্বাস না হলে ছেলেকে ডাক দে, যদি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে তাহলে বুঝবো ভাইয়া কিছু বলে নি। আর যদি কন্ঠস্বর বদলে যায় তাহলে বুঝবো ভাইয়া ঝাড়ছে৷ ”
বন্যা ভাবলেশহীন জবাব দিল,

“আমি পারব না। ”
মেঘ ভেঙচি কেটে বলল,
” না পারলে নাই, আমার ভাই যে হিরো তার প্রমাণ আমার দিতেই হবে। ”
মেঘ সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে ডাকলো,
“Excuse me vaiya.”
ছেলেটা পেছনে না তাকিয়েই ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে জবাব দিল,
“জ্বি আপু, কিছু বলবেন? আমাদের জন্য কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমরা কি পেছনে চলে যাব?”
মেঘ তাড়াহুড়ো করে বলল,

“না পেছনে যেতে হবে না। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ”
মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“দেখলি?”

এরমধ্যে রাজনীতিবিদদের আগমন ঘটলো। আশেপাশে বসা জুনিয়র রা সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিচ্ছে। মেঘ আর বন্যা স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইলো। একজনের নজর মেঘদের দিকে পরতেই সামনের দুতিন জনকে ডেকে বলল, অকস্মাৎ ওরা থমকে গেল৷ ঘুরে এসে মেঘদের কাছে দাঁড়ালো। মেঘ আর বন্যা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। ভাবছে, দাঁড়ায় নি বলে হয়তো ওনারা বকা দিতে আসছেন। তাদের মধ্যে একজন মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“আসসালামু আলাইকুম আপু।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

“তোমরা এত পেছনে বসছো কেনো? আসো সামনে এসে বসো।”
মেঘ আর বন্যা দুজনেই থতমত খেয়ে বলল,
“না ভাইয়া, আমরা এখানেই ঠিক আছি। ”
“তা বললে হবে না আপু। আবির ভাইয়াকে এত করে রিকুয়েষ্ট করার পরও ওনি আমাদের পোগ্রামে আসেন নি। অবশ্য তার জন্য আমরায় দায়ী৷ ভাইয়া বারবার বলেছিল ওনাকে নিয়ে যেন কোনোরকম প্ল্যান না করি৷ কিন্তু আমাদের মন তাতে সায় দেয় নি, ভাইয়ার জন্য স্পেশাল আয়োজন করেছিলাম। ভাইয়া কোনোভাবে খবর পেয়েছে তারপর আর পোগ্রামেই আসে নি। সেসব পুরোনো কথা বাদ দেয়, এখন তোমরা যেহেতু আজকের পোগ্রামে আসছো, আমাদের উচিত তোমাদের সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করা। প্লিজ তোমরা সামনে এসে বসো, প্লিজ ”

৪-৫ একসঙ্গে রিকুয়েষ্ট করতে শুরু করেছে। ওনাদের এত রিকুয়েষ্ট করা দেখে মেঘ আর বন্যা ভীষণ লজ্জায় পরে গেছে। পুরো হলের মানুষ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মেঘ আর বন্যার দিকে। যাদের দাপটে সবাই আতঙ্কে থেকে সেখানে তারা প্রথম বর্ষের দুই মেয়েকে এত রিকুয়েষ্ট করতেছে এটা সবার কল্পনার বাহিরে। মেঘ আর বন্যা বাধ্য হয়ে সামনে গিয়ে বসলো। এত সামনে বসে পোগ্রাম দেখতে মেঘ আর বন্যা দু’জনের ই অস্বস্তি লাগছে৷ উঠে যেতেও পারছে না, একটু নড়লেই দুএকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

“আপু কোনো সমস্যা? কিছু লাগবে?”
তাই উঠে যেতেও পারছে না। পোগ্রামের বিরতিতে মেঘদের খাবার পর্যন্ত দিয়ে গেছে৷ তানভির নিজেও অনেক খাবার কিনে দিয়ে গেছিলো। মেঘ আর বন্যা শুধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কিছুই খেতে পারছে না।
মেঘ বাধ্য হয়ে আবিরকে কল দিল। আবির অফিসে কাজ করছিল। গতকাল থেকেই অফিসে আসছে। অফিসে আসলেও এখনও বাইক চালানোর অনুমতি পায় নি আবির। দুদিন যাবৎ আলী আহমদ খান নিজের সাথেই আবিরকে অফিসে নিয়ে যান, আবিরও বাধ্য ছেলের মতো আব্বুর সঙ্গেই যায়। মেঘ কল দিতেই আবির মুচকি হেসে কল রিসিভ করল,

মেঘ সালাম দিলো। আবির সালামের উত্তর দিয়ে শুধালো,
” কি ব্যাপার? তাদের আপ্যায়নে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিস?”
মেঘ উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে জানতে চাইলো,
“আপনি কিভাবে জানেন?”
” তোর আশেপাশে কখন কি ঘটনা ঘটে সব আপডেট ই আমার কাছে থাকে। ”
“ওনারা কল দিয়েছিল?”
“আমায় না জানিয়ে তোকে কিছু বললে ওদের যে কি অবস্থা হবে এটা তুই না জানলেও ওরা খুব ভালো করে জানে৷ খাবার খাইছিস?”

“নাহ। ”
“খেয়ে নে। না হয় একটার পর একটা দিতেই থাকবে৷ ওদের অতিরিক্ত ভালোবাসায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি যোগাযোগ কমিয়ে ফেলেছি। এতদিনে তোকে পেয়েছে, তোকে ঠিকঠাক আপ্যায়ন করতে না পারলে ওরা ঘুমিয়েও দুঃস্বপ্ন দেখবে। বুঝলি।”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,

“আমাদের পোগ্রাম দেখতে ভালো লাগছে না, সামনে এনে বসাইছে সব বিরক্ত লাগছে। ”
“কিছুক্ষণ দেখে বেশি খারাপ লাগলে আমার কথা বলে বেড়িয়ে পরিস৷ ”
“আচ্ছা। আপনি আসবেন?”
“কেনো? অনুষ্ঠান দেখতে নাকি ওদের কর্মকান্ড দেখতে?”
“নাহ নাহ, এমনি। আসবেন কি না জিজ্ঞেস করছি।”
আবির মন খারাপ করে বলল,

“জানিস ই তো আব্বু আমাকে বাইক নিয়ে বের হতে দেয় না। আব্বুর গাড়ি আমি নিব না, আসলে রিক্সা নিয়ে আসতে হবে। আসবো?”
মেঘ খানিক ভাবল, এমনিতেই আবিরের শরীর দূর্বল, এ অবস্থায় যদি আবার কোনো এক্সিডেন্ট ঘটে সে ভয়ে মেঘ বলল,
“নাহ, আপনার আসতে হবে না। ”

“রাগ করছিস? আমি রিক্সা নিয়ে আসি, সমস্যা নেই। ”
“সত্যি রাগ করি নি। আপনি পুরোপুরি সুস্থ হলে অনেক ঘুরতে পারবো৷ এখন না হয় বড় আব্বুর লক্ষ্মী ছেলে হয়েই থাকুন ”
আবির নিঃশব্দে হেসে বলল,
” সাবধানে থাকিস আর কোনো সমস্যা হলে জানাইস। ”
মেঘ ঠাট্টার স্বরে বলল,
” জানাবো না। ”
“কেনো?”
“কারণ আমি জানি, আমার কোনো সমস্যা হওয়ার আগেই কেউ বা কারা, কোনো না কোনো ভাবে আমাকে প্রটেক্ট করবেই। ”

“এত কনফিডেন্ট?”
“Yes, Sir”
“Okay Mam. পাকনামি রেখে এখন খেয়ে নেন।”
“আচ্ছা। আপনি খেয়েছেন?”
“আব্বু আমাকে খাওয়ার উপরই রেখেছেন। ঘন্টায় ঘন্টায় খাবার পাঠাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে অফিসে না এসে বাসায় থাকলেই ভালো হতো।”
” ঠিক আছে খান, রাখি তাহলে ”
“ওকে।”

মেঘ আবার ডাকলো,
“আবির ভাই….!”
“হুমমমমমমম”
“কিছু না৷ রাখছি।”
মেঘ কল কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বন্যা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মেঘ ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
” এখন কি আমার ভাইয়া আর আবির ভাইয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে আইডিয়া হয়ছে?”
বন্যা অস্থির হয়ে বলল,

“সেসব হয়েছে, কিন্তু তুই আগে এটা বল,
তুই আর আবির ভাই কি রিলেশনে আছিস?”
“হ্যাঁ”
“সত্যি? ওনি কি তোকে প্রপোজ করে ফেলছেন?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৩(২)

“প্রপোজ করেন নি। তবে আমি মনে মনে এক্সেপ্ট করে নিয়েছি। কেন বল তো?”
“তোদের এত সুন্দর কথোপকথন শুনে আমার নিজের ই শান্তি শান্তি লাগছে।”
মেঘ মুচকি হাসলো, সাথে বন্যাও।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here