আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(২)

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(২)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

চৈত্রের উত্তপ্ত আবহে নগর যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। শহর জুড়ে বৃষ্টির জন্য হাহাকার৷ আরোপিত শীতলতার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত আবির, তবুও গাত্র ঘেমে নাজেহাল অবস্থা। পূর্বের তুলবায় কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। একফোঁটা বৃষ্টির আশায় সবাই অসহায়ের মতো আকাশের পানে চেয়ে আছে। অসহ্য গরমের জন্য আজ অফিস একটু তাড়াতাড়ি ই ছুটি হয়েছে। আবিরকে ফুপ্পি সকাল থেকে অনেকবার কল দিচ্ছিলো, আবির সুস্থ হয়েছে শুনে বার বার যেতে বলছিল কিন্তু আলী আহমদ খান আবিরকে কোনোমতেই যেতে দিবেন না, অন্ততপক্ষে এই ভর দুপুরে তো নয় ই। এমনকি বিকেলেও যেতে দেন নি। আবিরও বাবার মুখের উপর কিছু বলে নি। আবির বাসায় ফেরার পর থেকেই দেখছে মেঘ আর মীম মামনিদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। মামনিরা বারবার বারণ করছে দেখে আবির এগিয়ে গিয়ে শুধালো,

” কি হয়েছে তোদের? ”
মীম চট করে বলল,
“ফুপ্পি কল দিয়েছিল, আমাদেরকে বাসায় যেতে বলেছেন কিন্তু আম্মুরা যেতে দিচ্ছে না।”
আবিরের কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ পড়েছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ফুপ্পি সকাল থেকে আমাকেও বার বার কল দিচ্ছেন, কোনো সমস্যা ই হলো কি না!”
আবির ফের জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মামনি, তোমাদের কিছু বলেছে?”
“তেমন কিছু বলে নি। শুধু বলছেন তোরা যেন রাতে ওখানে খাওয়াদাওয়া করিস। ”
“তোমাদের কিছু বলে নি?”
“আমাদের শুক্রবারের দাওয়াত দিয়েছে। আবার বললো আসিফ আর আরিফকে পাঠিয়ে দাওয়াত দিবে। তোর আব্বুকেও কল দিয়ে বলবে বললো।”
আবির স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম শুধু আমাকেই কল দিচ্ছে। সকালে বলছি বিকালে আসতে পারি! কিন্তু গরমের জন্য আব্বু যেতে দেন নি, জোর করে বাসায় নিয়ে আসছে। ”

” রাতে ঝড় হতে পারে ভেবে, তোর চাচ্চুও ওদের পাঠাতে না করলো। এদিকে আফা বার বার কল দিয়েই যাচ্ছে। তানভিরও কল দিয়ে বলল ওদের পাঠাতে, তানভির নাকি কাজ শেষ করে ফুপ্পির বাসায় যাবে। ”
“আচ্ছা, আমি ফুপ্পির সাথে কথা বলছি।শুক্রবারে সবাই গেলে আজ তাহলে কারো যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
“সেই বরং ভালো। তুই কথা বলে দেখ।”

আবির ফোন হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে, মেঘ কপাল গুটিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একটু দূরে যেতেই মেঘ দ্রুত আবিরের কাছে গিয়ে হাতে চিমটি কাটলো। আবির তাকাতেই মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে তাকালো, মেঘের চোখের পাপড়ি ঘনঘন কাঁপছে, হালিমা খান, আকলিমা খান আর মীম তিনজনের নজরই মেঘের দিকে। মেঘ তড়িঘড়ি করে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। মেঘ চোখ মুখ গুটিয়ে কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছে। মেঘের ইশারায় বুঝানো কথা আবিরের বোধগম্য হলো না। পরপর দুবার ভ্রু নাচিয়ে নিঃশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। মেঘ চাপা স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

“আজ আইরিনের জন্মদিন৷ সে বায়না ধরেছে আজ আমাদের নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াবে।তারজন্য ফুপ্পি বার বার কল দিচ্ছেন।”
আবির মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল,
“তোকে কে বলছে?”
“জান্নাত আপু।”
“আচ্ছা দেখছি,কি করা যায়।”
আবির আলী আহমদ খানের রুমে চলে গেছে। মেঘকে ডেকে আকলিমা খান জিজ্ঞেস করলেন,
“আবিরকে কি বলছিস ?”
মেঘ হাসিমুখে বলল,

” দেখো কাকিয়া, ফুপ্পিরা সবাই আমাদের বাসায় আসছে, খাওয়াদাওয়া করেছে, সারাদিন সময় দিয়েছে। প্রথমবার ফুপ্পি আমাদের যেতে বলছেন, আমাদের কি যাওয়া উচিত না বলো?”
“অবশ্যই উচিত। কিন্তু তোর আব্বু যে না করে গেল।”
“আবির ভাই বড় আব্বুর সাথে কথা বলতে গেছেন। দেখবা বড় আব্বু রাজি হয়ে গেছে। তখন আব্বু আর কিছুই বলতে পারবে না। ”
আকলিমা খান হেসে বললেন,
“তোদের মাথায় সারাক্ষণ শুধু দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরে তাই না!”

মেঘ আর মীম দুজনেই হাসছে। এরমধ্যে আবির বেড়িয়ে এসে বলল,
” হাসাহাসি রেখে এখন রেডি হতে যা, কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে হবে৷ ”
হালিমা খান প্রশ্ন করলেন,
“আবির, তুই কি বাসা চিনিস?”
আচমকা এমন প্রশ্নে আবির থতমত খেল, নিরবে ঢোক গিলল৷ মেঘ শান্ত স্বরে বলল,
“আজকাল বাড়িঘর চিনতে হয় না, বুঝছো আম্মু। ফোন নাম্বার আছে, গুগল ম্যাপ আছে কোনো না কোনোভাবে চলে যাওয়া যাবে। ”
হালিমা খান আর কিছু বললেন না। মেঘ, মীম আর আদি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“চল চল রেডি হতে হবে। ”

আদি আমতা আমতা করে বলল,
“আমি আম্মুকে ছাড়া যাব না৷ তোমরা যাও৷ ”
মেঘ কপাল গুটিয়ে বলল,
” তুই কবে বড় হবি! মীম চল আমরায় যায়। ”
আবিরের সহজ স্বীকারোক্তি,
“তোরা রেডি হয়ে আমাকে ডাকিস।”
“ঠিক আছে । ”

মেঘ আর মীম দুজনেই রুমে চলে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ই মেঘ রেডি হয়ে গেছে, যথারীতি আবিরকে আর মীম দরজা থেকে ডেকে নিচে চলে আসছে। আবিরও রেডি হয়ে নিচে আসছে। মীম এখনও নামছে না দেখে মেঘ আবিরের ভয়ে চিল্লিয়ে উঠল,
“এই মীম, তাড়াতাড়ি আয়। ”
মীম রুম থেকে বেড়িয়ে আসছে। পড়নে বাসার জামা দেখে মেঘ রাগী কন্ঠে বলল,
“এতক্ষণেও হয় নি তোর!”
আবির ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“এখনও রেডি হস নি কেন?”
মীম মাথা নিচু করে বলল,
“তোমরা যাও, আমি যাব না। ”
আবির প্রশ্ন করল,
“যাবি না কেন?আমরা অপেক্ষা করছি, যা রেডি হয়ে আয়। ”
মীম চাপা স্বরে জানাল,
“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি যাব না।”
আকলিমা খান রাগে কটকট করে বললেন,
“এতক্ষণ তো যাওয়ার জন্য দুই বোন বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছিলি, এখন কি হলো?”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“তুই কিছু বলছিস?”
মেঘ থমথমে কন্ঠে বলল,
“নাহ, আমি কিছুই বলি নি।”
মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই মীম, কি হয়ছে তোর, চল না যাই৷ অনেক মজা হবে। ”
“আপু তোমরা যাও, প্লিজ৷ আমার ভালো লাগছে না।”
আকলিমা খান কিছুটা রেগে বললেন,
” থাক, ওরে আর তেল মারতে হবে না। তোরাই বরং যা৷ ”
আবির গাড়ির চাবি মামনিকে দিয়ে বলল,
“দুজন গেলে গাড়ি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ চাবিটা রেখে দিও। ”
“আবির গাড়ি নিয়ে যাহ। তোর আব্বু বা চাচ্চু শুনলে রাগ করবে।”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

” ফুপ্পিদের বাসা পর্যন্ত গাড়ি নাও যেতে পারে।”
আবির বেড়িয়ে গেছে। মেঘ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেও ছুটলো। মীম মুচকি হেসে দরজার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“তোমাদের দু’জনের মাঝে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না৷ ”
আবির রিক্সা ডেকে নিজে উঠে পরপর হাত বাড়িয়ে মেঘকে উঠালো৷ মেঘ ঘাড় ফিরিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি তার নিরেট। পাশাপাশি বসাতে আবিরের হাতের সাথে বার বার ধাক্কা লাগছিল, অজান্তেই মেঘের বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভব হলো। আবিরের সংস্পর্শ পেয়ে মেঘের মন কল্পনায় ভাসতে শুরু করেছে৷ আবির তাকাতেই সরাসরি মেঘের চোখে নজর পরল, মেঘের গভীর চাউনি, রাস্তার পাশের কৃত্রিম আলোতে আবিরের কাদম্বিনীকে অতীব মায়াবী লাগছে৷ আবির টেনেহিঁচড়ে দৃষ্টি সরালো। এই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আবির নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, অন্য জগতে পাড়ি জমাতে ইচ্ছে করে। প্রায় অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে, অথচ মেঘ ঘোরেই আঁটকে আছে। অবশেষে আবির গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,

“আইরিনের জন্য কি নিবো?”
আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ চমকে উঠে, রিক্সার গতি আর নিজেকে একসঙ্গে সামাল দিতে না পেরে নড়ে ওঠে৷ আবির তৎক্ষনাৎ বামহাতে মেঘের কাঁধে হাত রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“ঠিক আছিস?”
“হ্যাঁ”
“আইরিনের জন্য কি নিবো?”
” আপনার যা ইচ্ছে নিন।”
” আমি আন্দাজি কি নিবো? মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তারজন্য ই তো তোর মতামত জানতে চাইছি৷ ”
মেঘ আড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” আপনি আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন? ”

“বাব্বাহ! মতামত জানতে চেয়ে অন্যায় করে ফেললাম নাকি?”
“হ্যাঁ, করেছেন। অনেক বড় অন্যায় করেছেন। বাই দ্য ওয়ে, আপনি মেয়েদের পছন্দ- অপছন্দ জানেন না তাহলে আমাকে সুন্দর সুন্দর গিফট দেন কিভাবে?”
“তুই সবকিছু নিজের সঙ্গে তুলনা করিস কেন বুঝলাম না! তোকে কিছু দিতে গেলে আমার একবারের জন্যও ভাবতে হয় না। আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি, আমার দেয়া ২০ টাকার একটা গোলাপ কিংবা ২০ হাজার টাকা দামের কোনো গিফট দুটায় তোর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাকিদের ক্ষেত্রে আমি তা পারবো না। ”

মেঘ বিপুল চোখে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল,
“এই কনফিডেন্স টা নিয়ে আমায় প্রপোজ করতে পারেন না? আপনি তো জানেন আমি হ্যাঁ ই বলবো তাহলে কেনো করেন না প্রপোজ? ”
আবির মেঘের গাঢ় কালো পল্লবে চোখ রেখে বলল,
” এভাবে তাকাইস না মেঘ, তছনছ হয়ে যাবো।”

মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল, আবির ভাই নামক অসুখ টা ইদানীং মেঘকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। আবিরের বলা কথা, আচরণ সবেতেই অন্যরকম মাধুর্যতা মিশ্রিত। ধীরে ধীরে মেঘও বুঝতে পারছে আবির ভাই তার জীবনে বিশালাকৃতির গাছের ন্যায় ভূমিকা পালন করছে, গাছের শেকড় আর ঢাল পালার মতোই মেঘকে সকলপ্রকার অশুভ অঁচল থেকে আগলে রাখছে। আইরিনের জন্য গিফট কিনে যথাসময়ে বাসায় উপস্থিত হয়েছে, ততক্ষণে তানভিরও চলে আসছে। আড্ডা, খাওয়াদাওয়া শেষে প্রায় অনেক রাত করে ফুপ্পির বাসা থেকে বেড়িয়েছে। ততক্ষণে আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সাথে মেঘের গর্জন। মেঘ উৎফুল্ল মেজাজে সামনে হাঁটছে। তানভির বাসা থেকে বেড়িয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

“ভাইয়া, অনেক রাত হয়ে গেছে তুমি বরং বনুকে নিয়ে বাইক দিয়ে চলে যাও। ”
“বাসা থেকে অনুমতি নিয়ে প্রথমবারের মতো ও কে নিয়ে রাতের বেলা বেড়িয়েছি, এত তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেলে কিভাবে হবে! তাছাড়া আব্বু আমায় বাইক চালানোর অনুমতি দেন নি, হাজার হোক আমি আব্বুর বাধ্য সন্তান! আব্বুর অনুমতি ব্যতীত বাইক চালাতে পারি না। ”

“দিনের অবস্থা ভালো না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। তারপর ভিজে যেতে হবে। ”
“ভিজলাম সমস্যা কি? জ্বর হলে না হয় দুজনের ই হলো। ”
তানভির রাগী স্বরে বলল,
“একবার জ্বরে ভোগে শিক্ষা হয় নি তোমাদের? ”
আবির নাক কুঁচকে বলল,
“তখন কি একসাথে ভিজছিলাম নাকি? তাছাড়া মাঝে মাঝে বৃষ্টি বিলাস করা ভালো, এতে ভালোবাসা বাড়ে। বুঝছিস?”
” হ্যাঁ, তোমার প্রেম বিষয়ক আজগুবি লজিক খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। ”
আবির এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

“তুই কিন্তু একা বাসায় যাইস না।”
তানভির চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“হ্যাঁ,হ্যাঁ তোমাদের জন্য আমি এখন গাছতলায় বসে থাকি আর শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজি। নাকি?”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ভাইও তোর, বোনও তোর তাই দায়িত্বটাও তোর ই। ”
আবির হাসতে হাসতে সামনে চলে গেছে। তানভির না চাইতেই মৃদু হাসলো। আবিরের যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করে। এটা তানভিরের থেকে আর কেউ ই ভালো জানে না। আবিরের সব পাগলামির একমাত্র সাক্ষী তানভির। আবিরের বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে মানে এখন তাকে ভিজতেই হবে। তানভির বাইক স্টার্ট দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আবারও বলল,
“তাড়াতাড়ি চলে এসো।”

মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে আর গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে। কিছুক্ষণ রাস্তাটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ প্রশ্ন করল,
“এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকায় যেত, তাহলে আনেন নি কেন গাড়ি?”
“কেন আনি নি তার উত্তর এখন তোকে দিতে পারবো না। সময় হলে নিজেই বুঝতে পারবি৷ ”
মেঘ বলার মতো কথা খোঁজে পাচ্ছে না বলে চুপচাপ হাঁটছে। আবিরও নিশ্চুপ হাঁটছে । কোলাহলশূন্য নির্জন পথ, রাস্তা গুটিকয়েক বাইক আপন গতিতে ছুটছে। ফুপ্পিদের বাসার গলি থেকে বেড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে মেঘ হঠাৎ ই আকুল কন্ঠে শুধালো,
” আমরা বাসায় যাব কিভাবে?”
“বাসায় না গেলে হবে না? ”

মেঘ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আবিরের দিকে চেয়ে আছে। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে। কোথায় তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তা না উল্টো মজা করছেন। ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। মেঘের গর্জনের শব্দ আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা দেখে মেঘ ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। দিনের বেলা বৃষ্টি তার খুব বেশি পছন্দ হলেও রাতের বেলা বিদ্যুৎ চমকালেই মেঘের কলিজা শুকিয়ে যায়৷ আতঙ্কে মেঘের হাঁটার গতি কমে গেছে, বার বার আকাশের পানে তাকাচ্ছে আর আর আস্তে আস্তে হাঁটছে। আবির বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ মেঘের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,

“কোনো সমস্যা? ”
মেঘ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“আপনি গাড়িটা নিয়ে আসেন নি কেন? আমার ভয় লাগতাছে। রাস্তায় একটা রিক্সাও নেই এখন কিভাবে বাসায় যাব?”
আবিরের নির্লিপ্ত জবাব এলো,
“আমি ভেবেছিলাম তুই অনেক সাহসী মেয়ে।”
মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আমি দিনের বেলা সাহসী কিন্তু রাতের বেলা ভিষণ ভীতু। ”
আবির শান্ত চোখে চেয়ে মনে মনে কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসলো। মেঘের সেদিকে মনোযোগ নেই, একবার বিদুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘের গা কেঁপে উঠছে।

আবির উদাসীন কন্ঠে শুধালো,
“আমি কাছে থাকা স্বত্তেও তুই এত ভয় পাচ্ছিস? তাহলে আমি থেকে কি লাভ হলো?”
মেঘ নিশ্চুপ। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে দুজন, কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। আবির কিছু বলতে চেয়েও বার বার ঢোক গিলে কথা গিলছে । বৃষ্টিস্নাত পথে প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে বুকের বাম প্রকোষ্ঠে লুকায়িত কথাগুলো বলার সুপ্ত ইচ্ছে আবিরের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত এক দেয়াল বার বার আঁটকে দিচ্ছে আবিরকে।

পরিবার নামক বেড়াজালে আবির আবদ্ধ হয়ে আছে, মেঘ আবিরকে ভালোবাসে, অনেক বেশিই ভালোবাসে কিন্তু আবিরকে পাওয়ার জন্য আদোও কি মেঘ পরিবারের সামনে দাঁড়াতে পারবে? যেখানে আবির নিজেই বাড়ির সবার মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য ভাবতে পারছে না সেখানে মেঘ তো কিছুই না। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি বাড়ছে, সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মাত্রাও বেড়েছে৷ দুজনেই কাকভেজা হয়ে গেছে, আবিরের পড়নে নেভিব্লু রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সঙ্গে একবারে লেপ্টে গেছে। ফোন আর ওয়ালেট টা ফুপ্পির বাসা থেকেই পলিথিনে পেঁচিয়ে নিয়ে আসছিলো। মেঘ আজ থ্রিপিস পড়েছিল, চুলে খোঁপা করে মাথায় ওড়না দিয়েছিল কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। সরু রাস্তায় বড় বড় কদম ফেলায় আবির মেঘের থেকে কিছুটা এগিয়ে গেছে। প্রবল বৃষ্টিতে মেঘ হাঁটতেই পারছে না। আবির সামনে থেকে মেঘের দিকে তাকালেই মেঘ তেজঃপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
“আপনি আমায় ফেলে চলে যাচ্ছেন কেন? দেখছেন না আমি ভয় পাচ্ছি? ”

আবিরের পদযুগল থমকে গেছে, একপলক সামনে তাকালো পুনরায় আড়চোখে চেয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
“কোলে নিতে হবে?”
মেঘ শশব্যস্ত হয়ে আবিরের দিকে তাকালো। সহসা মনে পড়ে গেছে আবিরের সঙ্গে কোনো এক বিকেলে বৃষ্টিতে ভেজার ঘটনা। সেদিন হোঁচট খাওয়ার পরপর আবিরের কোলে তোলার ঘটনা মনে পড়তেই মেঘ থতমত খেয়ে বলল,
‘নাহ নাহ, আপনি শুধু আমার কাছাকাছি থাকুন। ”

আবির নিজের হাত বাড়ালো, মেঘ একহাতে আবিরের হাতটা ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘের ছোট্ট হাত আবিরের মোটা হাতকে ঠিকমতো ধরতে না পেরে সহসা দু’হাতে আবিরের বাহু চেপে ধরেছে। আবির চাপা স্বরে বলল,
” মুরগির কলিজা নিয়ে রাতে ঘুমাস কিভাবে তুই?”
মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবারও বিদ্যুৎ চমকালো, মেঘ ভয়ে দুহাতে আবিরের বাহু আরও শক্ত করে ধরেছে। আবিরের নিজের অন্য হাত মেঘের হাতের উপর রেখে কোমল কন্ঠে বলল,

“ভয় পাইস না, আমি আছি তো!”
আবিরের স্পর্শ সেইসঙ্গে মোলায়েম কন্ঠে বলা ছোট্ট একটা কথাতেই মেঘের মন থেকে ভয় ডর সব একেবারে চলে গেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,
” আমার আবির ভাই আমার পাশে থাকলে আর কিচ্ছু চাই না। যদি আজ আমার মৃ*ত্যুও হয় তবে যেন আবির ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ম*রতে পারি। ”

আস্তে আস্তে মেঘের ভ*য় অনেকটায় কে*টে গেছে। আবিরের হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে মেঘও নিজের মতো হাঁটছে। তবে আবিরের হাত একবারের জন্যও ছাড়ছে না।মেঘ আর আবির ফুপ্পিদের বিষয়ে টুকিটাকি কথা বলছে। এতবছর আবিরকে নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও এখন আবিরের ব্যাপারে মেঘের খুব চিন্তা। মেঘ আচমকা প্রশ্ন করে বসল,
“আবির ভাই, আপনি কি এখনও সি*গারে*ট খান?”
আবির ভ্রু গুটিয়ে বলল,

“নাহ। কেনো?”
“সত্যি করে বলুন, আপনি কবে থেকে সি*গারে*ট খাওয়া শুরু করেছিলেন আর কবে শেষ করেছেন? নাকি এখনও খান?”
রোমান্টিক আবহাওয়ায় মেঘের এমন প্রশ্ন আবিরের কাটা গায়ে নুনের ছিটার মতো লাগছে। আবির কড়া গলায় বলল,
” এখন এসব প্রশ্ন করার সময়?”
মেঘ গাল ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“তারমানে আপনি এখনও সি*গা*রেট খান?”
আবির বিরক্ত হয়ে মেঘের দিকে তাকালো পরপর এদিক সেদিক তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

” আমি মিথ্যা কথা বলি না মেঘ, তারপরও যদি তোর আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাহলে আমার কিছুই বলার নেই। ”
মেঘ হতবাক হয়ে গেছে। আবিরকে ইদানীং কিছু বললেই ছ্যাত করে উঠে৷ বিশেষ করে বিশ্বাস নিয়ে কথা বললে তো উপায় ই নেই। মেঘ মনোযোগ দিয়ে কতক্ষণ আবিরকে দেখে প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে আপনার? এভাবে কথা বলছেন কেন?”
আবির জোর গলায় বলা শুরু করল,

” আমি কখনো কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করি নি। তোর তো নয় ই। সি*গা*রেট আমার নে*শা না, যখন কোনো বিষয়ে খুব বেশি রে*গে থাকি, দিশাবিশা পায় না তখন একটু আধটু সিগা*রেট খেতাম এটুকুই ৷ তারপরও এত বছরে হাতে গুনা কয়েকটা সি*গারেট ই খেয়েছি। এসব এখন অতীত। সি*গারেট ছেড়েছি বহুদিন হলো, ছোঁয় ও না পর্যন্ত। সেদিনের পর তুই কোনোদিন আমার হাতে সিগা*রেট দেখেছিস? রুমে পেয়েছিস? নাকি আমার গায়ে সি*গারেটের গন্ধ পেয়েছিস? তবুও কেন এত অবিশ্বাস? তোর সন্দেহের তালিকায় কেনো সবসময় আমার নামটায় থাকে? এখনও এই মানুষটাকে একেবারে বিশ্বাস করা যায় না? ”

আবির একরাশ হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলেছে। শেষ প্রশ্ন গুলো বলার সময় আবিরের গলা কাঁপছিল । অজানা এক ক্রোধে আবির আবার দগদগে স্বরে বলল,
“তানভির কে কল দিয়ে তোকে নিয়ে যেতে বলি।”
মেঘ আর্তনাদ করে উঠল,
“কেনো?”
“আর যাই হোক, আবির কখনো কাউকে জোর করবে না অন্ততপক্ষে তাকে বিশ্বাস করতে তো নয় ই। আমার সত্যিই গাড়িটা নিয়ে আসা উচিত ছিল। ”
মেঘ মায়াবী দৃষ্টিতে চেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, অনেক বেশি বিশ্বাস করি। সত্যি বলছি। ভাইয়াকে কল দিবেন না, প্লিজ। আমি আপনার সাথেই যাব। ”
আবির উদাসীন কন্ঠে বলল,
” যেখানে তুই ই আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস না সেখানে তোর বাবা মায়ের চোখে তো আমি মস্ত বড় অপরাধী হয়ে যাব। তোর জ্বর হলে কেউ আমায় ছেড়ে কথা বলবে না। ”
আবির দু পা এগুতেই,মেঘ এক হাতে আবিরের আঙুল ধরার চেষ্টা করে কিন্তু আবির আঙুল ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই মেঘ তড়িঘড়ি করে আবিরের সামনে গিয়ে সরাসরি আবিরের শার্ট আঁকড়ে ধরে সাফাই দেয়ার মতো করে আকুল কন্ঠে বলে উঠল,

” আমি আর কোনোদিন আপনাকে এমন কথা বলব না, আপনাক কখনও অবিশ্বাস করব না৷ আপনি যা বলবেন, যে অবস্থাতেই বলবেন আমি সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলবো৷ প্লিজ আপনি রাগ করবেন না, প্লিজ৷ আমি কানে ধরছি….”
এতক্ষণ আবির শক্ত থাকলেও মেঘের শেষ বাক্যে আবির তৎক্ষনাৎ মেঘের হাত চেপে ধরলো৷ মেঘের হাত তখনও আবিরের বুকেই ছিল, সবেমাত্র কানে ধরার জন্য হাত তুলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই আবির আঁটকে দিয়েছে। আবিরের রাগ মুহুর্তেই দমে গেল। ভারী কন্ঠে বলল,

” অতি সামান্য কারণে আবির কাউকে এত বড় শাস্তি দিবে না!”
মেঘ ফের বলে উঠল,
“আপনি রাগ করলে আমার খুব ভয় হয়..”
আবির অনুচিন্তন মনে শুধালো,
“কিসের ভয়?”
মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
“আপনাকে হারানোর। ”
ঝুম বৃষ্টিতে মেঘের বিড়বিড় করে বলা কথাটা আবির ঠিকমতো বুঝতে পারে নি। সিউর হতে আবির পুনরায় শুধালো,
” কি বললি?”

মেঘ কিছু না বলে আবিরের উপর মাথা ঠেকালো। অনেকক্ষণ যাবৎ বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মেঘের শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অকস্মাৎ ভয়ে আবিরের বুক কাঁপছে, মেঘের শরীর যদি আবার খারাপ হয়! আবির তড়িঘড়ি করে বলল,
“শরীর খারাপ লাগছে?”

মেঘ সহসা আবিরের থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। প্রিয় মানুষের সাহচর্য পেলে মানুষ সব ভুলে যায়। মেঘের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে৷ ঘোরের মধ্যে কখন যে আবিরের বুকে মাথা রেখেছে সেটা খেয়াল ই করে নি৷ আবির ডাকতেই মেঘের ঘোর কেটে গেছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আবির পিছু পিছু ডাকছে, কিন্তু মেঘ তাকাতেই পারছে না। আবির এগিয়ে গিয়ে মেঘের মাথার কিছুটা উপরে দুহাত রাখলো। যেন সরাসরি বৃষ্টির পানি মেঘের মাথায় না পড়ে। মেঘ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল একবার, পুনরায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আবির ভাই মানুষটা কেমন জানি, এই রাগ করেন,এই আবার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নেন।

ওনার মন বুঝার সাধ্যি পৃথিবীর কারোর নেই৷ কিছুটা এগুতেই মেঘ চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে অথচ আবির খোঁজছে মেডিকেল শপ৷ নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অসময়ে মেঘকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এখন নিজেই টেনশন করছে। মেঘের সেদিকে খেয়াল নেই, সে নিজের মতো ঘুরছে আর চায়ের দোকান খোঁজছে । জীবনে প্রথমবার গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজছে, মেঘের মন এমনিতেই খুব উতলা হয়ে আছে তারউপর সাথে আবির ভাই। বাসার সব চিন্তা ভুলে বৃষ্টি উপভোগ করছে আর আবিরের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে আছে। অবশেষে একটা চায়ের দোকানে মেঘকে বসিয়ে আবির পকেট থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করছে। উপরে টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। মেঘ আপনমনে বসা থেকে সেই চালের দিকে চেয়ে আছে। টিনের চালের মাতাল করা শব্দে মেঘের ভাবনারা ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মেঘ আবিরের দিকে তাকাতেই আবির বলে উঠল,

” বৃষ্টির শব্দটা ভালো লাগছে?”
“হ্যাঁ! আগে বর্ষাকালে নানা বাড়ি গেলে এই শব্দটা শুনতাম, অনেক ভালো লাগতো। কতবছর পর আবার শুনছি। ”
আবির প্রশ্ন করল,
“লাল চা খাবি নাকি দুধ চা?”
“লাল চা খাব।”
“ঠিক আছে ম্যাম।”
আবির চলে গেল। হঠাৎ ই মেঘের কানে আবিরের কন্ঠ বেজে উঠলো,
“মামা, আপনি বসুন। চা আমি বানাচ্ছি।”

মেঘ আঁতকে উঠে পিছনে ঘুরলো। সত্যি সত্যি আবির চা বানাচ্ছে । মেঘ তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভেতরে থাকা হৃদপিণ্ড ছুটছে দিগবিদিক, ঠোঁটে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির হাসি। অকস্মাৎ মনে দুশ্চিন্তারাও ভর করেছে, নিজের অজান্তেই বলে উঠল,
” এত সুখ আমার কপালে সইবে তো?”
সঙ্গে সঙ্গে মেঘ নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“কি সব বাজে কথা ভাবছিস!”

আবির দুকাপ চা নিয়ে এগিয়ে আসলো৷ আদা, লেবু দিয়ে দুকাপ চা নিয়ে আসছে। আবিরকে দেখে মেঘ পুনরায় চেয়ারে বসলো। মেঘকে এককাপ চা দিয়ে আবির পাশের চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিল। মেঘ একচুমুক চা খেয়ে মেঘ মুগ্ধ হয়ে আবিরের পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আর ঠিক কি কি পারেন একটু বলবেন?”
আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
” বলতে পারবো না, তবে প্র্যাক্টিকেললি সব পারবো।”
“বাহ! বড় আব্বু আর বড় আম্মুর একমাত্র ভদ্র ছেলে। আপনি ছেলে হয়ে যা পারেন আমি মেয়ে হয়েও তা পারি না।”
আবির উদগ্রীব হয়ে বলল,

“আমি কখনোই ভদ্র ছেলে ছিলাম না। আমি এক নাম্বারে অসভ্য আর অভদ্র একটা ছেলে। তাছাড়া তোকে কাজ শিখতে বলেছে কেউ? তোর যখন যা লাগবে শুধু অর্ডার করবি!”
মেঘ প্রশ্ন করল,
” আপনি অভদ্র এটা কে বলছে? ”
“তোর আব্বু৷ ”
মেঘ হেসে বলল,

” আব্বুর চোখে দুনিয়ার সব ছেলেরায় অভদ্র। দেখবেন দুদিন পর থেকে আদিকেও এভাবেই কথা শুনাবে।”
আবিরও মলিন হাসলো। নিষ্টুর এই পৃথিবীতে সবার প্রিয় হয়ে উঠা কারো পক্ষেই সম্ভব না। তবে আবিরের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র নিজেকে প্রমাণ করা। আবির অভদ্র নয় তবে অসভ্য তো বটেই। মেঘকে কাছে পেলে আরও বেশি অসভ্য হয়ে যায়। এজন্য মেঘের দিকে ঠিকমতো তাকাচ্ছেই না। আবির ফোন চেক করতেই দেখলো মোট ১৭ টা কল আসছে। বাসা থেকে ৮ টা কল আসছে, তানভিরও ৪-৫ বার কল দিয়েছে, ফুপ্পি, রাকিব ও কয়েকবার কল দিয়েছে।

এখন ফোন দিলেই যে যার মতো কথা শুনাবে তারপর আবার মন খারাপ হবে সেই ভেবে কাউকেই কল ব্যাক করে নি। রাস্তায় একটা মেডিকেল শপ থেকে মেঘকে ঔষধ কিনে খাইয়েছে যাতে জ্বর না আসে। আবির আশেপাশে রিক্সা খোঁজছে, বাসার মানুষের থেকেও বেশি টেনশন হচ্ছে মেঘকে নিয়ে। কারণ মেঘকে সামাল দেয়ার মতো মানসিক অবস্থা আবিরের নেই। বৃষ্টির পানিতে চিকচিক করা মেঘের দু গাল, গোলাপের ভেজা পাপড়ির মতো লাল টকটকে দুই ঠোঁটে তাকানো মাত্রই আবিরের বুকে কম্পন অনুভব করে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু মেঘ নিজের মতো করে কথা বলছে, হুটহাট আজগুবি প্রশ্ন করতে শুরু করে যে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো পরিস্থিতি আবিরের নেই। তাই মেঘকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাচ্ছে। একটা ফুলের দোকান দেখে মেঘ বলে উঠল,

“আবির ভাই, আমাকে একটা গোলাপ ফুল কিনে দিবেন?”
“নাহ।”
“কেনো?”
” গোলাপ ব্যতীত অন্য কোনো ফুল নে। ”
“লাল গোলাপ গুলো খুব সুন্দর লাগছে। একটা নেয়?”
“বললাম তো নাহ।”
মেঘ মন খারাপ করে দুটা বেলীফুলের মালা নিয়েছে। আবির টাকা দিয়ে বেড়িয়ে এসে বলল,
“দে পড়িয়ে দেই। ”

“প্রয়োজন নেই।”
“কেন?”
“কারণ এগুলো মীমের জন্য নিয়েছি।”
“ওয়েট আরও কয়েকটা নিয়ে আসি। ”
“লাগবে না। আমার জন্য আনলে লাল গোলাপ নিয়ে আসুন।”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“চল সামনে যায়, সামনে হয়তো রিক্সা পাবো।”
মেঘ উষ্ণ স্বরে বলল,
“তবুও গোলাপ দিবেন না?”
“নাহ।”

মেঘ রাগে ফোঁসতে ফোঁসতে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি কমে এসেছে। তবে গাছ থেকে এখনও টুপটুপ করে পানি পড়ছে। আবির মেঘের গমনপথে চেয়ে ভারী কন্ঠে বলল,
“যেই ফুল তোকে অন্য কোনো ছেলে দিতে চেয়েছিল, সেই ফুল আমার চোখে বিষের মতো। আবির সেই বিষ ছুঁবে না। ”
এদিকে তানভির বাসার কাছে গাছের নিচে বাইকে বসে আছে আর ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি কমাতে আবিরকে কয়েকবার কল পর্যন্ত দিয়েছে কিন্তু আবির ফোন ই ধরছে না। হঠাৎ বন্যার কথা ভেবে কল দিল বন্যার নাম্বারে। অনেকদিন পর বন্যার ফোনে কল ঢুকছে। প্রথমবার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয় বার রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা প্রশ্ন করল,

“হ্যালো কে?”
তানভির কপাল গুটিয়ে বলল,
“বাহ! এত অপরিচিত হয়ে গেলাম?”
বন্যা তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“সরি তানভির ভাই। নতুন ফোন তাই নাম্বার টা সেইভ ছিল না। ”
“ওহ আচ্ছা। ফোন কবে কিনলা?”
“আজকেই কিনেছি। আপনি কি বাহিরে?”
“হ্যাঁ। কেনো?”

“বৃষ্টি, বাতাস এসবের শব্দ হচ্ছে মনে হয় ।”
“ওহ আচ্ছা। গাছতলায় বসে আছি তাই এমন শব্দ হচ্ছে। ”
“গাছতলায় কেন?”
“এমনিতেই একটু কাজ ছিল। রাতে খেয়েছো?”
“জ্বি। আপনি?”
“হ্যাঁ ফুপ্পিদের বাসায় খেয়ে আসলাম।”
“ফুপ্পিরা কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“আচ্ছা ভালো থাকুন, রাখি এখন।”
“কেনো?”
“ঘুমাবো।”
“আচ্ছা ঘুমাও। ”

তানভিরের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আবির আর মেঘ আসছে। যথারীতি তিন জনেই কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছে৷ রাত ১১ টার উপরে বেজে গেছে, অথচ তিন ভাই ই সোফায় বসে আছে। কাঠগড়ায় মেঘ,আবির আর তানভির। মেঘ হাঁচি দিতেই আবির মাথা নিচু করে কপাল গুটিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে। আজ একটা ঘূর্ণিঝড় হতে চলেছে যার সূচনা মেঘের একটা হাঁচিই করে দিল। আবির মাথা নিচু করে মেঘকে আস্তে করে বলল,
“রুমে যা। ”

মেঘ কোনোদিকে না তাকিয়ে ভেজা জামা নিয়েই নিজের রুমে দিকে ছুটছে৷ ড্রয়িং রুম, সিঁড়ি সব ভিজে গেছে। আলী আহমদ খান মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় আবিরদের দেখলো৷ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“তোমাদের এই অবস্থা কেন?”
আবির সাফাই দেয়ার স্বরে বলল,
“আপনিই বলেছেন বাইক যেন না চালাই। আর রাস্তায় রিক্সা পায় নি।”
“গাড়ি নাও নি কেন?”
“ফুপ্পিদের বাসা পর্যন্ত গাড়ি ঢুকবে কি না সিউর ছিলাম না৷ ”
“বাসা পর্যন্ত না যাক রাস্তা পর্যন্ত তো যেতো?”

“রাস্তায় রাখবো, তারপর কোনো এক্সিডেন্ট হলে আই মিন চু*রি হলে গাড়ির দায় কে নিবে? আমি?”
আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“তুমি না নিলে তোমার বাপেই না হয় দায় নিতো। যত যাই হোক গাড়ি টা তো তোমার বাপের ই। ”
আবির মৃদু হেসে বলল,
” আমার জন্য কাউকে কোনো দায় নিতে হবে না৷ আর আমিও অযথা কোনো দায় নিতে চাই না। ”
মোজাম্মেল খান এবার চেঁচিয়ে উঠলেন,
” তোমাদের ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য আমার মেয়েটাকে কেন ভিজিয়েছো? ওর কিছু হলে! ”
আবির রাশভারি কন্ঠে বলল,
“আপনার মেয়ের কিছু না হলেই তো হলো! ”

এতরাতে এখানে কথা বাড়ালে ঝামেলা হবে ভেবেই মোজাম্মেল খান হুঙ্কার দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে চলে গেছেন। ইকবাল খান ও নিজের রুমে চলে গেছেন। আলী আহমদ খান কাজের মহিলাকে ডেকে ফ্লোর মুছার কথা বলে নিজেও ভেতরে চলে গেছেন। আবির ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। রুমে গিয়ে রাগে বিছানার উপর ফোন ছুঁড়ে ফেলে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেছে৷ আবিরের রাগের একমাত্র কারণ সে নিজেই। আবির শাওয়ার নিয়ে আবার রান্নাঘরে এসে মেঘের জন্য স্যুপ আর কফি করে নিয়ে গেছে। মেঘকে ডাকতেই মেঘ দরজা খুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“ভেতরে আসুন ”
আবির গুরুতর কন্ঠে বলল,
“নাহ থাক, কখন আবার চেঁচিয়ে তোর আব্বুকে ডাকবি। ”
মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে খাবার গুলো নিলো। আবির সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। তানভির ফ্রেশ হয়ে আবিরের রুমে আসছে। মূলত মিনহাজদের ব্যাপারে কথা বলতেই এসেছে। আবিরের এক্সিডেন্টের পর থেকে মেঘের মতো আবিরও ওদের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তানভিরকে প্রথম এক দুবার জিজ্ঞেস করলেও এরপর থেকে একবারের জন্যও তাদের কথা জিজ্ঞেস করে নি। তানভির আজ নিজ থেকেই কথা বলতে আসছে।

আজ শুক্রবার। ফুপ্পির বাসাতে আজকে সবার দাওয়াত৷ নামাজ পড়েই সবাই রওনা দিয়েছে। আবির, তানভিররা, মেঘ, মীম,আদি ইকবাল খানের গাড়িতে যাচ্ছে৷ বাকিরা আলী আহমদ খানের গাড়িতে। আরিফ আর আসিফ দুজনেই গলির মোড় থেকে ওনাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে৷ মীম আরিফকে দেখেই বড় করে ভেঙছি কাটলো। আত্মীয়তার সম্পর্কের খাতিরে আরিফ মৃদুভাবে হাসলো। মেঘ মীমকে সারাদিন সামলে রেখেছে, যেন কোনোভাবেই কোনো অঘটন না ঘটায়। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে বিকেলের দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে । আগামী পরশু থেকে রমজান শুরু তাই ফুপ্পির জোরাজোরিতে আজই সবাইকে আসতে হলো। ফুপ্পির সাথে সবার ই খুব ফরমাল সম্পর্ক৷ আবিররা ফুপ্পিকে যতটা আপন করে নিয়েছে বড় ঠিক ততটা পারছে না।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪

মাঝরাতে হঠাৎ ই আবিরের ফোনে কল বাজতেছে। আবির ঘুমের ঘোরে প্রথমে কেটে দিয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে আবারও ফোনে কল বাজতেছে। আবির কল রিসিভ করে অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় জিজ্ঞেস করল,
“কে?”
“পে*ত্নী।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here