আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(৩)

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(৩)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবির ঘুমের ঘোরেই মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বিমোহিত কন্ঠে জানতে চাইল,
“আবির কি কোনো অন্যায় করেছে? তা না হলে, মাঝরাতে পরীর বদলে পে*ত্নী কেন কল দিবে আমায়?”
“হ্যাঁ। আপনি মস্ত বড় অ*পরা*ধ করেছেন।”
আবিরের চোখ বন্ধ, এখনও ঘুমের রেশ লেগে আছে চোখে মুখে। আধঘুমে থেকেই আবির পুনরায় প্রশ্ন করল,

” সর্বনাশ! অপ*রা*ধ টা কি বলা যাবে?”
মেঘ নিচু কন্ঠে বলল,
“আপনি আমার প্রথম কল টা ধরলেন না কেন?”
আবির চোখ মেলে ফোনের দিকে তাকালো। তড়িঘড়ি করে কল লিস্ট চেক করল। ঘুমের ঘোরে কল কাটার ঘটনা মনে পড়তেই মাথা চুলকে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“Ops! Sorry. ঘুমের মধ্যে কিভাবে বুঝবো যে আপনি কল দিয়েছেন? সরি ”
সদ্য ঘুম থেকে উঠা আবিরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠ শুনে মেঘের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কি যেন হৃদ*য়ে ছু*রি*র ন্যা*য় তোলপাড় চালাচ্ছে। সবকিছু যেন মুহুর্তেই ত*ছনছ করে দিবে। মেঘ বুকের বাম প্রকোষ্ঠে হাত রেখে নিজেকে সংযত করে ধীরস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“সেহরি খাবেন না? উঠুন। ”
আবির নীরস গলায় বলল,
“না খেয়ে কত রমজান কাটিয়েছি! এখন না খেয়ে রোজা রাখা অভ্যাস হয়ে গেছে। ”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,

” না খেয়ে থাকতেন কেন? ”
“তখন তো আর কেউ কল দিয়ে জাগিয়ে দিত না আমায়।”
মেঘ চাপা স্বরে বলে উঠল,
” এখন যেহেতু জাগিয়ে দিচ্ছে, তারমানে বুঝতে হবে অভ্যাস পরিবর্তন করার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ওঠেন, আমি রাখছি। ”
আবির তপ্ত স্বরে ডাকল,
“মেঘ…”
“জ্বি৷ ”

” নিজেকে সবকিছুতে জড়িয়ে রাখিস। কোনো একটাকে কেন্দ্র করে চললে পরবর্তীতে তার ব্যথাটা সহ্য করতে পারবি না। ”
মেঘ কপাল গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“রাত-বিরেতে এসব কি কথা বলছেন? উঠবেন নাকি উঠবেন না বলুন? ”
“আরে বাবা এখনি উঠতেছি৷ হাত মুখটা ধৌয়ে আসছি। ”
“ওকে।”

মেঘ কল কেটে তাড়াতাড়ি নিচে আসছে। ততক্ষণে টেবিলে খাবার রেডি৷ প্রথম রোজা বলে আজ আদিও উঠেছে। আবির হাত মুখ ধৌয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে আসছে, আসার সময় তানভিরকেও ডেকে নিয়ে আসছে। মেঘের বিপরীতে বসতে বসতে আবির অল্প করে ভ্রু নাচালো । মেঘ অপ্রখর হেসে চিবুক নামিয়ে নিল। খাওয়া শেষে যে যার মতো রুমে চলে গেছে। আবির নামাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। মেঘ রেস্ট নেয়ার জন্য একটু শুয়েছে। বন্যাকে নেটে দেখে সঙ্গে সঙ্গে কল দিল। বন্যা কল রিসিভ করামাত্র মেঘ বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম। সেহরি খেয়েছো জানু? ”
“মাত্রই খেয়ে আসলাম। তুমি খেয়েছো বেবি?”
“হ্যাঁ খেয়েছি৷ এখন রেস্ট নিচ্ছি।”
বন্যা ঠাট্টার স্বরে বলল,

” সাবধান, রোজা রমজানের দিন৷ দিনের বেলা মন কে সংযত রাখিস। আবির ভাইয়াকে ঢ্যাবঢ্যাব করে দেখিস না আর ওনাকে নিয়ে বেশি ভাবিসও না৷ ”
মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ওনাকে দেখব কিভাবে? ওনি সারাদিন অফিসেই থাকবেন৷ আচ্ছা একটা কথা বলবি?”
“কি? ”

“আমি যদি রোজা রেখে পাঞ্জাবি বা টিশার্ট পেইন্ট করি তাহলে কি আমার রোজা হালকা হয়ে যাবে?”
বন্যা হাসতে হাসতে বলল,
“হ্যাঁ হয়ে যাবে কারণ তুই রঙ করতে করতে আবির ভাইয়ার কথা ভাববি। তাই দিনের বেলা জামা কাপড়ের দিকে ভুলেও তাকাবি না। বুঝলি?”

“আচ্ছা ঠিক আছে। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। রাখছি। ”
বন্যা কল কাটতেই দেখল তানভিরের আইডি থেকে মেসেজ আসছে। ছোট করে লেখা,
“সেহরি খেয়েছো?”
বন্যা উত্তর দিল,
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ৷ ”

কোনো পাশ থেকেই আর কোনো মেসেজ আসলো না। তানভির ২-৩ বার কিছু লিখেও বার বার মুছে দিয়েছে। কিছু একটা বললে সেই মেসেজ মেঘকে দেখালে বোনের নজরে তানভির ছোট হয়ে যাবে সেসব ভেবেই তানভির কিছু লিখতে পারছে না। প্রায় ৫ মিনিট পর বন্যার আইডি থেকে মেসেজ আসলো,
“গুড নাইট৷ ”
তানভির মলিন হেসে লিখল,
“গুড নাইট & টেইক কেয়ার। ”

সকালে মেঘের ঘুম ভাঙার আগেই আবির অফিসে চলে গেছে। বাড়ি সম্পূর্ণ নিরব। মেঘ একে একে সবার রুমেই চক্কর দিয়ে আসছে। মীম আর আদি টিউশনে গেছে, তানভির, আবির, আলী আহমদ খানরা কেউ বাসায় নেই। বাড়ির তিন কর্তী নিজেদের রুমে কুরআন শরীফ পড়ছেন। মেঘ ঘুরে ফিরে নিজের রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে ওজু করে সেও কুরআন শরীফ পড়তে বসেছে৷ ইফতারের আগমুহূর্তে আবিররা বাসায় ফিরেছে। প্রথম রোজা তাই মালিহা খান বার বার সবাইকে বলে দিয়েছিলেন যেন ইফতারের আগেই চলে আসে৷ মেঘ শরবত বানাচ্ছে, মীম মেঘকে সাহায্য করছে। আর আদি দুপুর থেকেই সোফায় পরে আছে। ১০ মিনিট পর পর জিজ্ঞেস করে,
“মেঘাপু, আর কতক্ষণ? ”

“আপু আর কতক্ষণ পরে আজান দিবে?”
মেঘ আর মীম আদি কে বুঝিয়ে রাখতে রাখতে নিজেরাই ক্লান্ত হয়ে গেছে। আদি এইযে শোফায় শুয়েছিল আর উঠতেই পারছে না। আবির ইফতারের আগে আগে এসে আদিকে কোলে করে চেয়ারে নিয়ে বসিয়েছে। চেয়ারে বসেও আদি হেলে পড়ে যাচ্ছে । আদির অবস্থা দেখা মীম মিটিমিটি হাসছে। আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“এভাবে হেসো না, এমন দিন সবাই পার করে আসছে। ”

সঙ্গে সঙ্গে মীমের হাসি থেমে গেছে। চুপচাপ ইফতার করতে বসে পরেছে। মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরবতে একটু পর পর চিনি দিচ্ছে৷ প্রথমবারের মতো শরবত বানানোর দায়িত্ব মেঘ নিয়েছে। যদি ঠিকঠাক না হয় তাহলে বাড়ির সবার সামনে নাক কাটা যাবে। এজন্য আরও বেশি ভয় পাচ্ছে৷ আবারও চিনি দিতে যাবে তখনই আবির মৃদু স্বরে বলল,
“আর কত চিনি দিবি! থাম এবার। তোর চিনি দেয়া দেখে একদিনেই সবার ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। ”
মেঘ কপাল গুটিয়ে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না৷ তানভির বলে উঠল,

“প্রথম বার শরবত বানাচ্ছে তাই এই অবস্থা। সপ্তাহ খানেক বানালেই অভ্যাস হয়ে যাবে। ”
আকলিমা খান রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন,
” তানভির, সবসময় তো তুমিই শরবত বানাও। এবার দায়িত্ব মেঘকে দিয়েছো কেনো?”
তানভির মুচকি হেসে বলল,

” সবসময় আমার শরবত খেয়েছো এবার আমার বোনের হাতের শরবত খাবে। সমস্যা কি?এই রমজান যেমন স্পেশাল তেমন শরবত টাও স্পেশাল হবে।”
“রমজান স্পেশাল কেন?”
“বাহ রে! কতবছর পর ভাইয়ার সাথে রমজান পালন করছি। তাছাড়া আমাদের ফুপ্পিকে পেয়েছি। স্পেশাল হবে না?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। ”

ব্যস্ততার মধ্যেই রমজান কাটছে সবার। ঈদের ছুটির জন্য বেশিরভাগ কাজ আগেভাগে শেষ করে রাখছে। সময় করে ইকবাল খান সিলেট আর মোজাম্মেল খান কিছুদিনের জন্য রাজশাহী গেছেন। আলী আহমদ খান আর আবির মিলেই অফিস সামলাচ্ছে। আলী আহমদ খান ইফতারের আগে আগে বাসায় চলে গেলেও আবির প্রতিদিন ফিরতে পারে না। আব্বুর অফিসের কাজ শেষ করে নিজের অফিসে যাওয়ার আগে, মাঝে মাঝে রাস্তাতেই মাগরিবের আজান পড়ে যায়, মাঝে মাঝে রাকিবদের সাথে ইফতার করে৷ কিন্তু প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পরপরই মেঘ কল দেয়। কল দিয়ে প্রথম প্রশ্ন টায় থাকে,

“ইফতার করেছেন? কি কি খেয়েছেন?”
দ্বিতীয় প্রশ্ন,
“বাসায় কখন আসবেন?”
প্রতিদিন ই মেঘের একই রুটিন। আবিরের বাসায় ফেরার সময় অনুসারে মেঘ নিজের কাজ শেষ করে। আবির বাসায় ইফতার করে বের হলে ফিরতে ফিরতে প্রায় ১-২ টা বেজে যায়৷ আর ইফতার বাহিরে করলে তারাবির নামাজ শেষে বাসায় চলে আসে। মেঘও সেই অনুযায়ী নামাজ শেষ করে পাঞ্জাবি ডিজাইন করতে থাকে। আবির ফিরলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে৷ রাত ছাড়া এখন আবিরকে দেখা যায় না বললেই চলে৷ তাই রাতটায় আবিরকে দেখার উত্তম সময়৷ যেদিন আবির বেশি রাত করে বাসায় ফিরে সেদিন সেহরিতে আবির মেঘকে আগে কল দেয়৷ অন্যদিনগুলোতে মেঘ আবিরকে কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়৷ পাশাপাশি রুমে থেকেও সামনাসামনি কারো মুখে কোনো কথা নেই৷

আজ শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় আবির সকাল থেকে জামাকাপড় ধৌয়তেছে। মেঘ কোনো কারণে ছাদে গিয়ে দেখে ছাদ ভরে আছে আবিরের শার্ট আর টিশার্টে। সবগুলোর মধ্যে সাদা শার্টের সংখ্যায় বেশি। সবগুলো গুনে শেষ করে মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে মেঘ নিচে নামছে৷ আবির আরও কতগুলো শার্ট আর পাঞ্জাবি নিয়ে উপড়ে উঠছে৷ মেঘকে বিড়বিড় করে নামতে দেখে প্রশ্ন করল,
” ভরদুপুরে ছাদে গেছিলি কেন?”
মেঘ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“একটা মানুষের ২৭ টা সাদা শার্ট কিভাবে থাকবে পারে?”
আবির ভ্রু কুঁচকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“আরও ৫ টা এখনও পড়িই নি।”
“এত শার্ট দিয়ে কি করবেন?”
“ধৌয়ে দিলাম, যেগুলো ছোট হবে সেগুলো দিয়ে দিব। ”
মেঘ চাপা স্বরে আওড়াল,
“আমাকে দুটা শার্ট দিয়েন।”
আবির ভারী কন্ঠে শুধালো,
“তোর শার্ট লাগবে?”
মেঘ বিপুল চোখে চেয়ে তাড়াতাড়ি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো৷ মনে মনে বলল,
“ইশশশ, ওনি শুনে ফেলল!”

মেঘ দ্রুত নিজের রুমে চলে গেছে। আবির নামাজ পড়ে এসে সেই যে ঘুমিয়েছে এরমধ্যে রাকিব প্রায় ২২ টা কল দিয়েছে। আবির ঘুম থেকে উঠে এতগুলো কল দেখে ভয়ে ভয়ে কল দিল। রাকিব কল রিসিভ করেই হুঙ্কার দিল,
“আজকে রোজা রাখছি বলে, তোকে বকতে পারছি না৷ কতগুলো কল দিলাম কই ছিলি?”
“ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাইছিলাম। কেনো? ”
“একটু ঝামেলা হয়ছে। একটু না বেশিই ঝামেলা। ”
“ফোনে বলবি নাকি দেখা করবি?”
“ইফতার করে বের হইস।”
আবির উষ্ণ স্বরে জানালো,

“শরীর টা খুব দূর্বল। তুই বাসায় আয়। এখনি চলে আয় সমস্যা নেই। ”
“নাহ নাহ। এখন আসলে সবার সাথে ইফতার করতে হবে। তোর বাপেরে আমি বিরাট ভয় পায়। ওনি আমার দিকে তাকালেই মনে হয়, আমি গড়গড় করে সব বলে দিব।”
”কি বলে দিবি?”
“তোর আর মেঘের ব্যাপারে যা জানি সব এমনিতেই মুখ ফঁসকে বলে দিব। তারচেয়ে বরং ইফতারের পরে আসি৷ ”
“তোর ইচ্ছে। ”
নামাজ শেষে আবির বাসায় আসার ১০ মিনিট পর ই রাকিব বাসায় আসছে। মালিহা খানকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সরাসরি আবিরের রুমে চলে গেছে। আবিরকে বিস্তারিত ঘটনা বলার পর আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

” তুই এখন কি চাচ্ছিস?”
“আমি রিয়াকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।”
“এখনি বিয়ে করবি?”
“সব জানাজানি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলে পরবর্তীতে ঝামেলা আরও বাড়বে। ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তাহলে আন্টিকে তুই বুঝা।”
‘গতকাল রাত থেকে আম্মু আমার সাথে কথা বলে না। প্রথমে ভাবছি ঠিক হয়ে যাবে। আজকে বিকাল নাগাদ যখন কথায় বলছে না তখন বাধ্য হয়ে বাসা থেকে চলে আসছি। ”
“এখন আমি কি করতে পারি সেটা বল।”

রাকিব মলিন হেসে বলল,
“তুই আম্মুকে বুঝাবি। ”
আবির হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
” আমি আমার পরিবার মানাতে পারছি না বলে বিয়েই করতে পারছি না৷ সেখানে তুই আসছিস আমাকে দিয়ে তোর পরিবার মানাতে? বাহ! রাকিব বাহ!”
“প্লিজ বন্ধু, তুই ছাড়া আমার কে আছে বল?”
“তুই আমার কাছে যেকোনো সমস্যার সমাধান চা আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু যেই মারপ্যাচে আমি আঁটকে আছি সেটার সমাধান আমার কাছে চাইস না৷ ”

রাকিব আকুল কন্ঠে বলে উঠল,
“এতদিন আমার বাসায় সমস্যা ছিল না শুধু রিয়ার বাসায় সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন ওদের বাসার সাথে সাথে আম্মুও প্যাঁচ ধরে বসে আছে। জান্নাত আম্মুকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু আম্মু কথা মানার অবস্থাতেই নেই। ”
আবির রাশভারি কন্ঠে বলল,

“দেখ, এর সমাধান আমার কাছে নেই। তুই যেমন আব্বুকে ভয় পাস আমিও তেমন আন্টিকে ভয় পায়। আমার এখনও মনে আছে, ছোটবেলা গণিত পরীক্ষায় তুই দুই নাম্বার কম পেয়েছিলি বলে রাস্তার মাঝখানে তোকে কি মাই*রটায় না দিয়েছিল৷ সেই থেকে আমি তোর বাসায় যায় না। ”
“তুই না গেলে কি হবে। আম্মু তোকে খুব ভালোবাসে। তোর কথা বললে যেকোনো অনুমতি দিয়ে দেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা সিরিয়াস তাই তোকে নিয়ে যেতে হবে।”

“আমার পা টা ঠিক হয়ছে বেশিদিন হয় নি। আব্বু এখনও বাইক চালানোর অনুমতি দেন নি৷ রিক্সায় করে অফিসে যায় আমি৷ সেখানে তোর বিয়ের কথা বলতে তোদের বাসায় যায় আর আন্টির হাতে মা*ইর খেয়ে আবার বিছানায় পড়ি নাকি? গতবার আমার শ্বশুর বেশি না মাত্র ২ ঘন্টা ঝাড়ছিল, এবার কিছু হলে সোজা মা*র্ডা*র করে ফেলবে। তুই কি চাস না আমি বিয়ে করি? ২-১ টা পরী আমাদের সংসারে আসুক, তোকে চাচ্চু বলে ডাকুক? আর আমায় আব্বু! ”
রাকিব গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,

” একটা প্রবাদ বাক্য আছে, অইবো পোলা ডাকবো বাপ তে যাইবো মনে পাপ। তোর অবস্থা হইছে এরকম।”
আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,
“আমার পোলা লাগতো না। একটা মেয়ে হলেই হবে যাকে ঘিরে আমাদের ছোটখাটো একটা সংসার হবে। ”
রাকিব রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” আর কত কল্পনায় ভাসবি এবার বাস্তবে আয়। বাস্তবে এসে আমাকে বাঁচা৷ ”
“আমি পারবো না, দুঃখিত।”
মেঘ দরজা থেকে উঁচু স্বরে বলল,

“আসবো?”
আবির ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
“হ্যাঁ, আসেন।”
মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“বড় আম্মু আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।”
রাকিব ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো আপু?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?”
“আমি ভালো নেই। আমার অবস্থা খুব খারাপ। ”
“কেনো ভাইয়া? কি হয়েছে?”
“তোমার আবির ভাইকে একটু বলো আমাকে সাহায্য করতে। ও ছাড়া আমি কাউকে ভরসা করতে পারবো না। তুমি একবার বলো মেঘ!”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে সরু নেত্রে চেয়ে আছে, আচমকা প্রশ্ন করল,
“কি বলবো?”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কিছু না। তুই রুমে যা। ”

“নাহ মেঘ। তুমি যাবে না। তুমি আবিরকে একবার বলো তারপর চলে যেও। ”
মেঘ আবারও প্রশ্ন করল,
“বলবো কি আমি?”
“তুমি বলো আমাকে যেন আবির সাহায্য করে। ”
মেঘ আবিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মসৃণ কন্ঠে বলল,
“রাকিব ভাইয়া কিসের সাহায্য চাচ্ছেন। করে ফেলুন সাহায্য! ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ঠিক আছে। তুই যা এখন।”
রাকিব পুনরায় বলে উঠল,
” আপু, তুমি জিজ্ঞেস করো, আবির সাহায্য করবে কি না! হ্যাঁ অথবা না। ”
আবির চেঁচিয়ে উঠে বলল,

” হ্যাঁ হ্যাঁ করব সাহায্য, হইছে? ”
রাকিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসিমুখে বলল,
“এই না হলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ”
আবির অগ্নিদৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ চলে যেতে নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা কি হয়ছে?”
রাকিব স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি রিয়া কে চিনো?”
“আপনার গার্লফ্রেন্ড রিয়া আপু?”
রাকিব আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাহ! আবির”
পুনরায় মেঘকে বলল,

“হ্যাঁ। আমাদের বাসার সবাই রিয়ার ব্যাপারে মোটামুটি জানতো। বিয়া দু একবার আমাদের বাসায়ও আসছে। সবার সাথে আলাপ ও হয়েছে। রিয়া শারীরিক ভাবে একটু অসুস্থ, এটা আমার বাসায় কেউ জানতো না, গতকাল কথায় কথায় এটা বলেছি তারপর থেকে শুরু হয়ছে আম্মুর চিল্লাচিল্লি। বাড়ির বড় বউ হবে, রোগী হলে কিভাবে হবে? লোকে কি বলবে? সারাজীবন ডাক্তারের কাছে দৌড়াইতে দৌড়াইতে শেষ হয়ে যাব।আরও কত কি! আম্মু এখন আমার সাথে কথায় বলতেছে না। তাই তোমার আবির ভাইকে বলতেছি, আমাদের বাসায় যেতে, আম্মুকে একটু বুঝাতে। ”

“বিয়া আপুর কি সমস্যা? ”
“শ্বাসকষ্ট, এলার্জির সমস্যা আরও কিছু সমস্যা আছে।”
মেঘ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে উদাসীন কন্ঠে মনে মনে বলল,
” রিয়া আপুর সামান্য সমস্যার কারণে আন্টি কত বছরের সম্পর্ক মানছেন না।আর আমি যে তাড় ছিঁড়া এটা জানার পর আমার শ্বাশুড়ি কি আমাকে মেনে নিবেন?”
আবির মেঘকে ডাকতেই মেঘ নড়েচড়ে উঠল,কথা শেষ করে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ যেতেই রাকিব বলল,
“আজ মেঘ আসছিল বলে বেঁচে গেলাম।”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

” লোকে এজন্যই বলে কাউকে দূর্বল জায়গা চিনাতে নেই। ”
“আমি নিজেই এখন আধমরা তাই তো মেঘকে দিয়ে সাহায্য চাইলাম। আচ্ছা, তুই না একবার বলছিলি মেঘ অসুস্থ। ঠিকই তো দেখলাম।”
আবির কপাল গুটিয়ে গুরুভার কন্ঠে বলল,
” অসুস্থ না রে, বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। ধমকের হাত থেকে বাঁচতে শ্বশুরের মুখের উপর বলছিলাম,

“আপনার মেয়ের কিছু না হলেই তো হলো।” যেই কথা সেই কাজ, আমার শ্বশুর সকাল বিকাল দেখে মেয়ের জ্বর, সর্দি আসছে কি না! কারণ কিছু একটা হলেই আমায় ইচ্ছে মতো ঝাড়তে পারবে। ওনি যদি ঢালে ঢালে চলে তবে আমিও চলি পাতায় পাতায়। সপ্তাহ খানেক মেঘকে গরম পানির উপর রেখেছি, সারাক্ষণ গরম পানি খেয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াইছি, প্রাকৃতিক ঔষধ সহ যতধরনের ঘরোয়া পদ্ধতি আছে সব চেষ্টা করে ফেলছি৷ আল্লাহ র রহমতে সর্দি-জ্বর কিছু হয় নি৷ ”

“তোর জীবন এখন ডিসকভারি চ্যানেলের বাঘ আর হরিণের মতো হয়ে গেছে। জামাই শ্বশুরের চ্যালেঞ্জ৷ চাচ্চু যেদিন জানতে পারবে ওনার পরীর মতো মেয়ের পিছনে তোর মতো বানর ঘুরঘুর করছে৷ তখন ওনার কি অবস্থা হবে আবির?”
“সেই দিন নিয়ে এখনও ভাবি নি। যা হবে সেদিনই হবে। বাঁচা আর ম*রা দু হাতে নিয়েই ওনাদের সম্মুখীন হবো। ”
“আচ্ছা এখন চল, নামাজ পড়ে আমাদের বাসায় যাবি। ”

আবির আচ্ছা বলার আগেই জান্নাত আবিরের নাম্বারে কল দিল। আবির রিসিভ করতেই জান্নাত বলল,
“আবির ভাইয়া, রাকিব ভাইয়া বাসা থেকে চলে গেছে, ভাইয়ার ফোনও বন্ধ। আম্মু টেনশনে অসুস্থ হয়ে পরেছিল, এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে। ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। আপনি ভাইয়াকে খোঁজে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় আসুন, প্লিজ।”
“আচ্ছা আসতেছি ”

আবির আর রাকিব ঘন্টাখানেকের মধ্যে রাকিবদের বাসায় আসছে। আন্টি আংকেলের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রিয়াকে কল দিয়ে রিয়ার আম্মুর সাথেও কথা বলে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক আলাপ-আলোচনা শেষে রাকিব আর রিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঈদের একদিন পরেই বিয়ে। রিয়ার পরিবার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে অনেকেই এই বিয়েতে রাজি না তাই মোটামুটি ঘরোয়া ভাবে বাসাতেই পোগ্রাম করা হবে। আবির বাসায় ফিরতেই আলী আহমদ খান শুধালেন,

“কোথায় ছিলে?”
“রাকিবদের বাসায় গিয়েছিলাম। ”
“রাকিব দেখলাম সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসলো আবার তুমি এখন ওদের বাসা থেকে ফিরছো। কোনো সমস্যা? ”
“নাহ আব্বু। তেমন কোনো সমস্যা না। রাকিবের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঈদের একদিন পর বিয়ে।”
আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” কোথায় ঈদের পর তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তা না হয়ে তোমার বন্ধুর বিয়ে করছে । ভালো ভালো। ”
আবির মনে মনে আওড়াল,
“যাকে বিয়ে করতে চাই তাকে বিয়ে না দিলে এই ঈদ কেন, একেরপর এক ঈদ কেটে গেলেও আবির অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। ”

দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহে পরেই ঈদুল ফিতর। খান বাড়িতে শপিং এর মেলা বসেছে। আলী আহমদ খান, ইকবাল খান, মোজাম্মেল খান তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে সবার জন্য জামাকাপড় এনেছে। বছরে একবার ই ওনারা নিজে শপিং এ যান। তাছাড়া তানভিরও সবার জন্য জামাকাপড় এনেছে। বাড়ির ছোট দুই কর্তী একদিন মেঘদের শপিং এ নিয়ে গিয়ে সবার জন্য শপিং করিয়ে এনেছে। মেঘের অলরেডি ৫-৬ সেট ড্রেস হয়ে গেছে। তবে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির থেকে এখনও কিছু পাওয়া হয় নি তাই মেঘের মন তেমন ভালো না। আবিরদের পাঞ্জাবি, টিশার্টের কাজ কমপ্লিট৷ এখন শুধু দেয়ার অপেক্ষা।
আজ সকাল থেকে তানভির আবিরকে খোঁজছে।। আবির রাকিবের বিয়ের শপিং করতে বেড়িয়েছে। আবির দুপুরের দিকে বাসায় আসতেই তানভির ছুটে গেল। আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে তোর? ”
তানভির অনচ্ছ হেসে বলল,
“ওর জন্য একটা ড্রেস কিনেছি। কিভাবে দিব বুঝতে পারছি না। হেল্প করো।”
” আমার হেল্প করতে হয় কেন? সামনে যেতে না চাইলে নিজের বুদ্ধি কাজে লাগা। ”
“মানে?”
“তোর বোনকে যেভাবে গিফট পাঠিয়েছিলি সেভাবে পাঠা। ”
“ও যদি না পড়ে?”
“এত চিন্তা করলে অকালে চুল পেঁকে যাবে। তোর কাজ গিফট দেয়া, এক্সেপ্ট করবে কি না সেটা তার বিষয়। ”
“ঠিক আছে।”

তানভির বন্যার ঠিকানা দিয়ে ড্রেস কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কুরিয়ার থেকে বক্স নিয়ে বন্যা রুমে গেল। সন্দেহ নিয়ে বক্স খুলতেই বিশাল গর্জিয়াছ এক ড্রেস বের হলো। ড্রেসের ওজনই বলে দিচ্ছে ড্রেসটা অনেক দামী। বন্যা সঙ্গে সঙ্গে মেঘকে কল দিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল। মেঘ অচতুর কন্ঠে বলল,
“গিফট কে পাঠালো সেটা বড় বিষয় না। গিফট পেয়েছিস এটা নিয়েই খুশি থাক।”
“এত দামী ড্রেস কি করব আমি? কেউ হয়তো ভুলে পাঠাইছে।”
মেঘ তাড়িত বেগে বলল,

“আরে বোকা! ঠিকানা তোর বাসার, ফোন নাম্বার তোর মানে কেউ ইচ্ছে করেই তোকে পাঠিয়েছে।”
“আমি এই ড্রেস পড়ব না। যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিব।”
মেঘ সঙ্গিনভাবে ধমকে উঠে,
“তুই ড্রেস না পড়লে মজা টা করবো কিভাবে?”
“কিসের মজা?”
“তুই ড্রেস টা পড়ে ছবি তুলে একটা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করবি, তারপর দেখব পরিচিত মানুষের বাহিরে কে তোর ছবিতে রিয়েক্ট দেয়। সেখান থেকে খোঁজে নিব, মনে মনে কে তোকে পছন্দ করে। আর কোন বড়লোক বাপের ছেলে এত দামী ড্রেস তোর জন্য পাঠায়।”
“আমি পারবো না।”

“চুপ, আমি যা বলছি তাই হবে। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনবোও না মানবোও না।”
“কিরে? তোর আবার কি হলো?”
“না দেখছিলাম, আবির ভাইয়ের স্টাইলে কথা বললে কেমন লাগে, রাখি এখন, টা টা। ”
“আচ্ছা। টা টা। ”

আগামীকাল ঈদ৷ মেঘ এখনও অপেক্ষায় আছে আবির তাকে একটা ড্রেস গিফট করছে। আর সেটা মেঘ ঈদের দিন সকালে পড়বে। অথচ আবির এখনও ড্রেস দিচ্ছে না। এদিকে দুপুর থেকে হালিমা খান মেঘদের পার্লারে যেতে বলছেন, মেহেদী দেয়ার জন্য বুকিং দিয়ে রেখেছে আরও ১ মাস আগে। কিন্তু মেঘের পার্লার যাওয়াতে মনোযোগ নেই। এক ফাঁকে মেঘ ছুটে গেল আবিরের রুমে। আবিরকে ডেকে বলল,
“আবির ভাই আপনি আমায় মেহেদী দিয়ে দিবেন না?”
“কেন? মেহেদী আর্টিস্ট কোথায়?”

“আর্টিস্টের কাছে দিব না। আপনি রাতে দিয়ে দিবেন। ”
“আমি পারব না। মীমকে নিয়ে তাড়াতাড়ি মেহেদী দিতে যা। ইফতারের আগে আগে চলে আসিস। ”
মেঘ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মাইশা আপুর বিয়েতে আপনি কত সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে দিছিলেন, আজকে একটু দিয়ে দেন না! প্লিজ”
আবির রাগান্বিত কন্ঠ বলল,
“মেঘ, উল্টাপাল্টা বায়না ধরবি না। যা বলছি তা শুন।”

মেঘ মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেছে। মেহেদী দিবে না বলার পরও বাড়ির সবাই জোর করে পার্লারে পাঠিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরেই মেঘ দেখল তার বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ রাখা৷ শপিং এ দুটা ড্রেস, একটা হলুদ রঙের আরেকটা গাঢ় নীল রঙের। দুটা ড্রেস ই খুব সুন্দর তবে মেঘের নীল ড্রেস টা বেশি পছন্দ হয়েছে। মেঘ ড্রেস দেখতে দেখতে আজান পড়ে গেছে। মেঘ দ্রুত ইফতার করতে চলে গেছে। ইফতার করে রুমে এসে নামাজ শেষে আবারও ড্রেস গুলো দেখছে। আবির ইশার নামাজ পড়তে বের হতেই মেঘ আবিরের জন্য ডিজাইন করা দুটা পাঞ্জাবি আর টিশার্ট গুলো আবিরের রুমে রেখে আসছে। তানভিরের রুমেও একটা পাঞ্জাবি আর একটা টিশার্ট রেখে আসছে।

আবির কিছুক্ষণ পর রুমে এসে দেখলো পাঞ্জাবির উপর ছোট একটা চিরকুট। হাতে নিতেই দেখল এতে লেখা,
” আপনার Sparrow-র দেয়া প্রথম পাঞ্জাবি। ভালো লাগলে চোখ খুলে পড়বেন, ভালো না লাগলে চোখ বন্ধ করে পড়বেন, তবুও পড়তেই হবে। ”
সাথে আরেকটা চিরকুটে লেখা,
” আপনি আমার কোমল মনে আঘাত দিয়েছেন তাই আমি রাগ করেছি, খুব রাগ করেছি। সামান্য একটু মেহেদী দিয়ে দিলে আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? আপনি আমার মনের ছোট ছোট অভিযোগে সৃষ্টি বিশালাকার পর্বত। আপনাকে ঘিরে আমার যত অভিযোগ ছিল সব ঈদের চাঁদের কাছে সঁপে দিয়েছি। তবুও দোয়া করি আপনি ভালো থাকুন, পৃথিবীর সব সুখ আপনাকে ঘিরে রাখুক, ঈদ মোবারক। ”
আবির চিরকুট টা পড়ে মুচকি হেসে বলল,

“পৃথিবীর সব সুখ যদি আমায় ঘিরে রাখে তবে আমি সেই সুখের চাদর দিয়ে তোকে ঘিরে রাখবো। তোর মনের ঘরে চুল পরিমাণ অভিযোগ ঢুকার রাস্তাও রাখবো না। তোকে আমার ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবো। একদিন কেন, সারাজীবন তোকে রাঙিয়ে রাখার দায়িত্ব আমি নিবো ইনশাআল্লাহ। ”

মেঘ আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছে। এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে উঠে শাওয়ার নিতে চলে গেছে। ফজরের নামাজ পড়ে ঘন্টাখানেক কুরআন শরীফ পড়েছে। তারপর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে মেঘের দুচোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়তে শুরু করেছে। দাদা, দাদু সহ যত আত্মীয় মারা গেছেন তাদের কথা ভেবেই মেঘ কাঁদছে৷ নামাজ পড়েও তাদের দোয়া করেছে । ঘন্টাখানেক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে মেঘ ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধৌয়ে রেডি হতে শুরু করলো। বিছানা ছড়ানো ৮ টা ড্রেস। সবগুলোই সুন্দর কিন্তু মেঘের নজর এক আবিরের ড্রেসেই আঁটকে গেছে। খুব ভেবে চিন্তে আবিরের দেয়া নীল রঙের ড্রেসটায় পরেছে।

সাথে নীল রঙের বড় বড় কানের দুল, হাতে নীল চুড়ি। শুরুতেই চুল শুকিয়ে স্ট্রেইট করে নিয়েছিল সেই চুলে মাঝখানে সিঁথি করে দুপাশে দুটা কাঁকড়া বেন্ট দিয়ে ডিজাইন করে চুল বেঁধেছে। পেছন থেকে সব চুল ছাড়া, তবে স্ট্রেইট করার জন্য খুব সুন্দর লাগছে। মুখে হালকা মেকাপ করে ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। সাজা শেষে রুম থেকে বেড়িয়ে সেদিক সেদিক উঁকি দিচ্ছে, কোথাও কেউ নেই, আবিরের রুমেও দেখে এসেছে আবির নেই। হঠাৎ বড় আব্বুকে নামাজ থেকে ফিরতে দেখে মেঘ দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেছে, আর আবিরের উপরে আসার অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর আবির উপরে আসামাত্রই মেঘ রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা আবিরের সামনে গিয়ে বসে পরেছে। মেঘের এমনকান্ডে আবির কিছুটা ভড়কে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দু পা পিছিয়ে দাঁড়ালো । মেঘ উপরে তাকিয়ে দুহাতে আবিরের দু পা স্পর্শ করলো। ততক্ষণে আবির নিচু হয়ে মেঘের দু কাঁধ আলতোভাবে হাত রেখে বলল,

“সালাম করতে হবে না, ওঠেন।”
মেঘ সালাম করে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আবিরের পড়নে মেঘের দেয়া সাদা পাঞ্জাবি। তা দেখে মেঘের ওষ্ঠ যুগল আরও বেশি প্রশস্ত হলো।মেঘের কল্পনায় আবির ভাইকে যতটা সুন্দর লেগেছিল বাস্তবে তার থেকে বহুগুণ বেশি সুন্দর লাগছে। আবিরও নির্বাক হয়ে মেঘকে দেখছে, নীল রঙ আবিরের খুব প্রিয় তবে সচরাচর নীল রঙের কিছু আবির কিনে না। কারণ প্রিয় মানুষকে প্রিয় রঙের ড্রেসে দেখলে মুগ্ধতায় চোখ সরাতে পারবে না ভেবেই এই রঙটাকে এড়িয়ে যায় । তবে দোকানে নীল রঙের জামাটা দেখে এত পছন্দ হয়েছিল যে না কিনে থাকতেই পারে নি। অকস্মাৎ আবির ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,

“সালামি লাগবে?”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
” আগে দোয়া করবেন তারপর সালামি দিবেন।”
আবির মেঘের মাথায় হাত রেখে সুমধুর কন্ঠে বলল,
” দোয়া করি জীবনে অনেক বড়, সবসময় হাসি খুশি থাক”
মেঘ নাক সিটকিয়ে বলল,
“এসব দোয়া তো সবাই করে, আপনি বরং ইউনিক দোয়া করুন।”
“দোয়াও আবার ইউনিক হয়?”
“হ্যাঁ হয়। ”

আবির মাথা থেকে হাত নামিয়ে দুহাতে মেঘের দুগালে আলতোভাবে হাত রাখলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্নিগ্ধশীতল কন্ঠে বলল,
” আমি দোয়া করি, তোর মনের সব ইচ্ছে পূরণ হোক। ছোট থেকে বড় ইনফেক্ট যেগুলো তুই মনে মনে ভাবিস কিংবা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে বা কল্পনায় দেখিস সেই সব ইচ্ছে পূরণ হোক। তুই যা চাস, যাকে চাস ঠিক যেভাবে চাস সেভাবেই যেন পেয়ে যাস। তোর আকাশ জুড়ে ভালোবাসার বৃষ্টি হোক, যেই বৃষ্টি তোর মনে জমে থাকা অভিযোগ, অভিমান গুলোকে ধৌয়ে মুছে বিলীন করে দিবে সেই সঙ্গে আগামী দিনগুলোতেও তোর মন ভালো রাখবে। প্রয়োজনে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে দুটা হাঁসের বাচ্চাও আসুক। যেগুলো তোকে সারাদিন হাসাবে। মহিলা হাঁসটার নাম হবে মেঘ, পুরুষ হাঁসের নাম যা খুশি রেখে দিস। তারপর তাঁদের একটা সংসার হবে ।পরে ডিম হবে, বাচ্চা দিবে.. আরও বলবো?”

মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
“এটা আপনার ইউনিক দোয়া?”
“তো কি দোয়া চাস বল?”
“থাক দোয়া করতে হবে না। সালামি দেন!”
“কত লাগবে? ২ টাকা নাকি ৫ টাকা? ”
“আপনার যত ইচ্ছে দেন । সালামি চাইতে নেই। ”
“আবির পকেট থেকে একটা নতুন ৫০০ টাকার বান্ডেল বের করে দিল।”
মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” এত টাকা নিয়ে কি করব?”
“তোর বোধশক্তি হওয়ার পর প্রথমবার সালামি দিচ্ছি৷ কম কেনো দিব?”
মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

“ধন্যবাদ। ”
“সালামি দিলে আবার ধন্যবাদও দেস?”
“সালামির জন্য ধন্যবাদ দেয় নি। পাঞ্জাবির জন্য দিয়েছি। ”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনাকেও ধন্যবাদ, জামাটা পড়ার জন্য। ”
মেঘ রুমে যেতে যেতে হঠাৎ বলে উঠল,
“আমি কিন্তু পুরুষ হাঁসের নাম ফিক্সড করে ফেলেছি। ”
আবির মুচকি হেসে বলল,
“আমি জানি। ”

আবির নিজের রুমে চলে যাচ্ছে।মেঘ নিজের রুমে এসে টাকাগুলো ড্রয়ারে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে,
“পুরুষ হাঁস টা আবির আর মহিলা হাঁসটা মেঘ। একদিন তাদের বিয়ে হবে। তাদের সাজানো ছোট্ট একটা সংসার হবে। তারপর তাদের ঘর আলো করে একটা রাজকন্যা না হয় রাজপুত্র আসবে। উফফফ”
বলেই মেঘ লজ্জায় দুহাতে নিজের মুখ ডেকে ফেলেছে। ব্লাশ দেয়ায় গাল দুটা যতটা লাল হয়েছিল এসব কথা ভেবে দু গাল তিনগুণ বেশি লাল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই মেঘ স্বাভাবিক হয়ে নিচে নামলো। মেঘের ড্রেস দেখে কাকিয়া বলল,
” এই ড্রেসটা অনেক সুন্দর। তোকে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু তুই যেটা পছন্দ করে কিনলি সেটা পরিস নি কেন?”
মেঘ হাসিমুখে বলল,

“ঈদ সাতদিন থাকে। সবার দেয়া ড্রেস ই পড়বো।”
তানভির নামাজের সময় তাড়াহুড়ো করে গেছিল বলে মেঘের দেয়া পাঞ্জাবি টা পড়ে যেতে পারে নি। বাসায় এসে তাড়াতাড়ি করে মেঘের দেয়া পাঞ্জাবি পড়ে নিচে আসছে। আবিরও ততক্ষণে নিচে আসছে। সবাই একবার আবিরকে দেখছে আবার তানভিরকে। হালিমা খান প্রশ্ন করলেন,

“তোরা কি সেইম পাঞ্জাবি কিনছিস?”
তানভির ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
” পাঞ্জাবি গিফট পেয়েছি। ”
“কে দিল?”
“বনু আমাকে আর ভাইয়াকে গিফট করেছে!”
“ডিজাইন নিজে করেছিস?”
মেঘ ছোট করে বলল,
“হ্যাঁ!”
“বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে। তোর আব্বু চাচ্চুদেরও দিতি।”
“ভালো লাগলে ইনশাআল্লাহ আগামী ঈদে সবাইকে দিব।”
“ইনশাআল্লাহ। ”

সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ৫ ভাইবোন মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছে। তানভির ড্রাইভ করছে আবির তার পাশের সিটে বসে আছে। ফুপ্পির বাসা থেকে অলরেডি ঘুরে অল্প নাস্তা করে আসছে। রাস্তায় যেতে যেতে মেঘ হঠাৎ ই বলে উঠল,
“ভাইয়া চলো না বন্যাদের বাসার এদিকে যায়।”
আবির আর তানভির দুজনেই আঁতকে উঠল। তাদের প্ল্যান ছিল এদিক সেদিক ঘুরে শেষে বন্যাদের বাসার এদিকে যাবে । কিন্তু মেঘ শুরুতেই বলে ফেলল। তানভির মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৪(২)

“ঐদিকে কেন?”
“বন্যা ঈদে কোথাও বের হয় না। আমরা যেহেতু বের হয়ছি ওকে দেখে আসি৷ ”
আবির মৃদু হেসে বলল,
“শুধু দেখে আসবি কেন? ওকে নিয়ে আসিস। সবাই এক সঙ্গে ঘুরবো।”
“আচ্ছা। বলবো ওকে। ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here