আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৮

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৮
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

মীমের মুখে অকল্পনীয় কথাটা শুনতেই আবিরের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে অকস্মাৎ মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেছে,নিঃশ্বাস আঁটকে আছে গলায়, শ্বাসনালীতে তুফান। মুহুর্তের মধ্যে চোখের শিরা উপশিরা রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে, বক্ষস্পন্দন বেড়ে আকাশ ছোঁয়ার পথে। আবির নিজের সর্বোচ্চ অনুবলে মেঘকে যতই আগলে রাখতে চাইছে প্রতিনিয়ত ততই বিপাকে পড়ে যাচ্ছে। মেঘের মুখে নিরন্তর হাসি ফুটাতে আবির নিজের সাথে একের পর এক নিগূঢ় বিগ্রহ করেই চলেছে তারপরও কোনো কিনারা পাচ্ছে না। কন্ঠস্বরে তেজ ঢেলে আবির শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” মেঘ কোথায়?”
” আম্মুরা সবাই আপুর রুমে বসে আছে আর আপুকে সাজুগুজু করতে বলছে কিন্তু আপু চুপচাপ বসে আছে। ”
আবির চোখ বন্ধ জোরে শ্বাস টেনে পরপর সর্বশক্তি দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিরূদ্ধ করার চেষ্টা করলো। অতঃপর নিরেট কন্ঠে বলল,
” ওকে বলিস সাজুগুজু করতে হবে না আর দেখিস ঐদিনের মতো কান্নাকাটি যেন না করে। আমি দেখছি।”
মীম আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আপনি এখন বাসায় আসলে সমস্যা হবে।”
আবির অদম্য কন্ঠে বলল,
“বাসায় আসবো না। শুন, তোর দায়িত্ব হলো যত দ্রুত সম্ভব তুই ছেলের বাবার নাম টা জেনে আমায় কোনোভাবে টেক্সট করে জানাবি।”
মীম শীতল কণ্ঠে বলল,
” আচ্ছা। ”

আবির কল কেটে দিয়েছে। মীমের সাথে আবির শান্ত স্বরে কথা বলেছে ঠিকই কিন্তু আবিরের ভেতর টা রাগ আর দুশ্চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে। মেঘ বাসায় অল্প সাজুগুজু করলেই আবিরের কলিজায় আঘাত লাগে, নিজের দৃষ্টি সামলে একের পর এক দোয়া পড়তে থাকে যাতে মেঘের উপর শয়*তানের কুনজর না পড়ে। সেখানে কোথাকার কোন পরিবার মেঘকে দেখতে আসবে এটা আবির বেঁচে থাকতে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না।

তানভিরকে কল দিতে দিতে আবির দ্রুত অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে। রাকিব, রাসেল কারো সাথেই দেখা হয় নি। এদিকে মেঘ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে, আশেপাশে আম্মু, বড় আম্মু, কাকিয়া সবাই মেঘকে বুঝাচ্ছে, রেডি হতে বলছে। মেঘের সেসবে মনোযোগ নেই, আজ মেঘের চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই। সেদিন প্রথমবারের মতো কেউ বা কারা দেখতে আসবে কথাটা শুনে মেঘ নিজেকে শান্ত রাখতে পারে নি তারউপর আবিরের উদাসীনতা মেঘকে আরও বেশি কাঁদিয়েছিল৷ কিন্তু রাতের বেলা আবিরের কথা শুনে মেঘ সবটায় বুঝেছিল আর নিজেই নিজেকে বকেওছিল। তাই আজ মেঘের মনে আতঙ্কের রেশ মাত্র নেই, দিব্যি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আঙ্গুর খাচ্ছে।
হালিমা খান চাপা স্বরে বললেন,

“এই মেঘ, আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবি? উঠে রেডি হ৷ ওনারা কখন জানি চলে আসেন। তখন তোর আব্বু রাগারাগি করবে।”
মেঘ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আম্মু, আমি শান্তি করে খাচ্ছি এটা কি তোমার সহ্য হচ্ছে না?”
“সহ্য হবে না কেন? তুই রেডি হস নি শুনে তোর আব্বু যে চিল্লাচিল্লি করবে। তখন আমি কি করব? ওনারা চলে গেলে না হয় আবার খাইস। ”
আকলিমা খান শান্ত স্বরে বললেন,

” তোমার আব্বু আর বড় আব্বুকে তো চিনোই। সময়ের কাজ সময়ে না হলে মেজাজ গরম হয়ে যায়।”
এমন সময় মীম রুমে আসছে, নিচে আব্বু চাচ্চুর কথোপকথনে ছেলে আর তার বাবার নাম শুনে আম্মুর নাম্বার থেকে আবিরকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে অতঃপর উপরে আসছে। আলী আহমদ খান বাসায় নেই, ইকবাল খানকে আকলিমা খান জানানোর পরপর ই তিনি বাসায় চলে আসছে। মোজাম্মেল খানকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছেন। অথচ মোজাম্মেল খান কিছু বুঝতেই চাইছে নাম। আবিরকে কল দিয়ে বললে আবির উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে এই ভয়ে ইকবাল খান নিজেই বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মীম মেঘের রুমে ঢুকতেই মেঘ খাওয়া বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালো, সহসা মীম চোখের ইশারায় আবিরকে জানানোর কথাটা বুঝিয়ে দিয়েছে। মেঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আম্মুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
” তোমরা থামো। আগে ওনারা আসুক তারপর আমি সাজবো।”

মালিহা খান শান্ত স্বরে মেঘকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মেঘের এক কথা, দেখতে আসলে তবেই সে সাজবে। এমনকি তাদের দেখানোর জন্য মেঘ সবকিছু রেডিও করে রেখেছে৷ ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাসায় মেহমান আসছে না। মালিহা খান আর আকলিমা খান মেঘের রুমে বসে আছেন তবে সেদিকে মীম, মেঘের কোনো মনোযোগ নেই। মীম মেঘের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে তার স্কুলের গল্প করছে আর মেঘ মীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গল্প শুনছে। মোজাম্মেল খান আর ইকবাল খান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন কিন্তু কেউ ই আসছে না। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো জ্যামে আঁটকে আছে এজন্য কল দেন নি কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে কল দিলেন সেই লোকের নাম্বারে। প্রথমবারেই কল রিসিভ হলো। মোজাম্মেল খান তপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনারা কোথায় আছেন?”
লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” আমি অফিসে আছি। ”
মোজাম্মেল খান বিরক্তভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাদের বাসায় আসার কথা কি ভুলে গেছেন?”
লোকটা ঢোক গিলে কিছুক্ষণ থেমে অতঃপর বললেন,
” নাহ ভাই ভুলি নাই কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
“কি সমস্যা? ”

লোকটা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মোজাম্মেল খান এবার হালকা রাগী স্বরে বললেন,
” কি হলো?”
“আসলে ভাই কিভাবে বলল, আমার ছেলে অন্য এক মেয়েকে পছন্দ করে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না বলছে। তাই শুধু শুধু… ”
মোজাম্মেল খান রাগে কটমট করে বললেন,
” আপনার ছেলে অন্য কাউকে পছন্দ করে কি না সে কথা কি আগে জানা উচিত ছিল না? আর সেদিন আপনার ছেলে তো সামনেই ছিল, আপনারা আগ্রহ না দেখালে আমি তো আপনাদের কখনোই জোর করতাম না। ”
লোকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললেন,

” আমাদের মাফ করে দিবেন ভাই আর পারলে দোয়া করবেন। ”
মোজাম্মেল খান রাগে কল কেটে দিয়েছেন। নিজে দায়িত্ব নিয়ে বাসায় এত এত আয়োজন করিয়েছেন সেখানে তারা আসবে না এটা তিনি মানতেই পারছেন না। আগের বার তানভিররা কিছু একটা করেছিল ভেবে এবার আবির তানভিরকে কিছু জানান ই নি। অথচ এবারও একই সমস্যা। মোজাম্মেল খান মনে মনে ভাবছেন,
“ছেলের যদি অন্য কোথাও পছন্দই থাকতো তাহলে সেদিন আমার মেয়ের ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখিয়েছিল কেন? আমার মেয়েকে দেখার জন্য এত উতলা হয়ে গেছিল কেন?”
ইকবাল খান মিটিমিটি হেসে বললেন,

” থাক ভাইয়া, মন খারাপ করো না।”
মোজাম্মেল খান ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন, চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন।ইকবাল খান উপরে গিয়ে মেঘের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তোমরা যে যার রুমে যাও, ওনারা আসবেন না। ”
মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
” আসবেন না কেন?”
“ছেলের অন্য কাউকে পছন্দ। ”
মেঘ ফিক করে হেসে ফেলল, মেঘের দেখাদেখি মীম ও হাসছে৷ মালিহা খান রাগী স্বরে বললেন,
” এই মেঘ হাসছিস কেন?”
আবারও বললেন,

“তোর আব্বু কোথায় কি ছেলে দেখে বলতো? আগের বার কি সব অজুহাত দেখালো এবার বলে ছেলে অন্য মেয়েকে পছন্দ করে৷ সকালেও তো শুনলাম ছেলে তোকে দেখার জন্য খুব আগ্রহী৷ এখন এসবের মানে কি?”
মেঘ বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মনে মনে আওড়ালো,
” শ্বাশুড়ি আম্মু, ঐ ছেলের আমাকে দেখার আগ্রহ থাকলে কি হবে তোমার ছেলের তো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমার ছেলে সবার সামনে যতই স্বাভাবিক থাকুক না কেন আড়ালে ঠিকই আমাকে নিয়ে ভাবে। আর আমি সিউর ঐ ছেলের গার্লফ্রেন্ড আজই আবিষ্কৃত হয়েছে আর সেটা তোমার ছেলেই করেছে। ”

মালিহা খান শীতল কণ্ঠে বললেন,
“কিরে কি ভাবছিস? ওনারা আসে নি বলে মন খারাপ করছিস?”
মেঘ স্ব শব্দে হেসে বলল,
” নাহ গো৷ আমি ভাবছি তোমরা কত কষ্ট করে সারাদিন রান্না করলে এই খাবারগুলো কিভাবে খেয়ে শেষ করবো। ”
মালিহা খান আর আকলিমা খান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। ইকবাল খান নিঃশব্দে হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছেন। মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমার ফোনটা দে তো, ভাইয়া আর আবির ভাইকে কল দিয়ে আসতে বলি, একসাথে খাবো। ”
মীম ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ফোন এনে মেঘকে দিল৷ মেঘ তানভির আর আবির দুজনকেই কল দিয়েছে তবে ছেলের ব্যাপারে কিছু বলে নি শুধু খাবার খেতে দাওয়াত দিয়েছে। মেঘের ফাজলামো দেখে মালিহা খান আর আকলিমা খান দুজনেই চুপচাপ বেড়িয়ে গেছেন। ওনারা চলে যেতেই মেঘ আর মীম নিজেদের মধ্যে ফিসফিস শুরু করে দিয়েছে।

সন্ধ্যের আগে আগে আবির বাসায় আসছে। পড়নে ছাই রঙের শার্টের হাতা কনুই অব্দি ফোল্ট করা, বুকের উপরের বোতাম টা খুলা, চুলগুলো অগোছালো, শ্যাম বর্ণের চেহারা ঘামে চিকচিক করছে, এক হাত পকেটে, অন্য হাত স্বাভাবিক রেখে বাসার ভেতরে ঢুকছে। সোফায় মোজাম্মেল খান বসে আছেন, ওনার পাশেই হালিমা খান দাঁড়িয়ে আছেন।মোজাম্মেল খান অতর্কিতে নিজের মনের ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আর হালিমা খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেসব শুনছেন৷ মালিহা খানরা যে যার রুমে, ইকবাল খান একটা কাজে বেড়িয়েছেন। আবির স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গেল। এক পলক মামনির দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,

” মামনি, এককাপ কফি করে দিবা প্লিজ?”
হালিমা খান আবিরকে খানিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
“তুই ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কফি বানিয়ে পাঠাচ্ছি।”
“পাঠাতে হবে না। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেছি।”
আবির সচরাচর নিজের কফি নিজেই করে, সকালে মাঝে মধ্যে মালিহা খান নয়তো হালিমা খান করে দেন। আজ মূলত মোজাম্মেল খানের জন্যই অসময়ে মামনির কাছে কফি চাইছে আবির যাতে মোজাম্মেল খানের চিল্লাচিল্লি টা কমে। আবির দুটা সিঁড়ি উঠতেই মোজাম্মেল খান আড়চোখে আবিরকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

” কোথায় ছিলে?”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“অফিসে। কেনো?”
“তানভির কোথায়?”
আবিরের ভাবলেশহীন জবাব,
“আমি কি জানি!”
মোজাম্মেল খান সূক্ষ্ম নেত্রে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আবির মৃদু হেসে বলল,
“আমি কি যাব, চাচ্চু?”
“যাও।”

হালিমা খান কফি করতে রান্নাঘরে চলে গেছেন। মোজাম্মেল খান সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আবিরের কথা বার্তা খুব স্বাভাবিক, সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে নি। তানভির জানলে এতক্ষণে সে অবশ্যই রিয়েক্ট করতো, অথচ তানভিরও এখন পর্যন্ত শান্ত। সারাদিন বাসায় ফেরে নি, বাসার কারো সাথে ফোনে কথা বলতেও তিনি দেখেন নি। তারমানে তানভিরও কিছু জানে না। মোজাম্মেল খান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললেন,
“তানভির, আবির কিছু না জানলে এমনটা হলো কিভাবে? তাহলে কি সত্যিই ঐ ছেলের অন্য জায়গায় পছন্দ আছে? ”

আবির কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে শার্ট পাল্টিয়ে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে নিচে আসছে। মোজাম্মেল খান তখনও সোফায় বসা। তাই আবির সোফায় না বসে সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেছে, কফির কাপ নিতে নিতে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কিছু হয়েছে নাকি?”
হালিমা খান তপ্ত স্বরে বললেন,
“নাহ। তেমন কিছু না। ”

মোজাম্মেল খানের কড়া নিষেধ আবির কিংবা তানভিরের সামনে মেঘের বিয়ে সম্পর্কিত কোনো আলোচনা যেন না হয়। আবির সবটায় জানে তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। আবির মোজাম্মেল খানকে খানিকক্ষণ পরখ করে শক্ত কন্ঠে বলল,
” চাচ্চুকে অতিরিক্ত টেনশন করতে বারণ করো৷ মেয়ের বিয়েই হলো না এখনি চুল পাকিয়ে ফেলতেছেন। লোকে কি বলবে? ”

আবিরের দুষ্টামী বুঝতে পেরে হালিমা খান মৃদু হেসে বললেন,
” আমাকে বলছিস কেনো? তুই গিয়ে বল।”
আবির হাতে কফির কাপ নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ডাকলো,
“চাচ্চু।”
মোজাম্মেল খান আবিরের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আস্তে করে বললেন,
“বলো। ”
আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,

” মামনি বলতেছে আপনার চুল নাকি পেকে যাচ্ছে। আপনাকে এখন আর আগের মতো ভালো লাগে না। ”
মোজাম্মেল খান অনচ্ছ হেসে বললেন,
” তাই নাকি?”
এরমধ্যে হালিমা খান রান্নাঘর থেকে তেড়ে এসে আবিরের হাতে আস্তে করে থা*প্প*ড় দিয়ে বললেন,
” এই ফাজিল, আমি কখন এই কথা বললাম?”
আবির অনিশ্চয়তার স্বরে জবাব দিল,
“তুমি মনে মনে ভাবছিলে। ঐটাই চাচ্চুকে জানালাম।”
হালিমা খান রাগী রাগী মুখ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মোজাম্মেল খান আবির আর হালিমা খান দুজনকেই কিছুক্ষণ দেখে গুরুভার কন্ঠে বলল,

” তাহলে আমার এখন কি করতে হবে?”
আবির ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল,
“সবসময় হাসিখুশি থাকবেন, সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবেন। নিজেকে সময় দিবেন সাথে মামনিকেও ৷ বাকিটা মামনি বলবে, আমি এখন পালায়”
আবির টেবিলের উপর কাপ রেখে সিঁড়ি দিকে ছুটছে। মোজাম্মেল খান ঠোঁটে অস্পৃশ্য হাসি রেখেই হালিমা খানের দিকে তাকালেন। আবিরের অকপটে বলা কথাগুলো হালিমা খানের মনের অন্তরালে লুকানো অব্যক্ত অনুভূতি। হালিমা খান স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আবিরের দৌড় দেখছেন৷ ২-৩ সিঁড়ি ফাঁক দিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠছে ছেলেটা, ওর উপরে ওঠার তাড়া দেখে মনে হচ্ছে,

“সবেমাত্র কাউকে আ*হত কিংবা নি*হত করে আসছে। ”
আশপাশের মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ছে। মোজাম্মেল খান বসা থেকে উঠে উচ্চ স্বরে ডাকল,
“আবির, নামাজে যাবে না?”
আবির নিজের রুমে যেতে যেতে বলল,
“টুপি নিয়ে আসছি।”

মোজাম্মেল খান ওজু করে আবিরের জন্য অপেক্ষা করছেন, আবিরও ওজু করে মাথায় টুপি দিতে দিতে নিচে আসছে। বাসায় আর কেউ নেই তাই আবির আর মোজাম্মেল খান একসঙ্গে নামাজের জন্য বেড়িয়েছেন। মোজাম্মেল খান যেতে যেতে হঠাৎ ই গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তানভির কি নামাজ পড়ে? ফজরে না হয় উঠতে পারে না বাকি ওয়াক্ত কি পড়ে?”
আবির নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল,
” আমি সমসময় নামাজের কথা বলি কিন্তু বাহিরে ঠিকমতো নামাজ পড়ে কি না জানি না।”
মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
” তুমি একটু বুঝিয়ে বলো৷”

মোজাম্মেল খানের ভারী কন্ঠে বলা কথাতে আবির কপাল কুঁচকালো৷ মোজাম্মেল খানের মস্তিষ্কে যখন যা আসে তাই। এতক্ষণ মেঘের ব্যাপারে ভাবছিল এখন সেই ভাবনায় এসেছে তানভির, তাও আবার তানভিরের নামাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। আবির মনে মনে আওড়ালো,
” তানভিরকে নামাজে নিয়মিত করার ঔষধ আমার জানা আছে। খুব শীঘ্রই ঔষধ দিতে হবে।”
মোজাম্মেল খানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবির বলল,
” আপনি চিন্তা করবেন না, ফজর থেকে তানভিরও আমাদের সাথেই নামাজে যাবে।”
“দেখো, যদি উঠাতে পারো।”
আবির মুচকি হেসে বলল,

” প্রয়োজনে সারারাত না ঘুমিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমাবে।”
মোজাম্মেল খান আবিরের কথা শুনে ক্ষীণ হাসলেন। নামাজ শেষে অফিসের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় আসছে দুজন। ততক্ষণে মেঘরা সবাই নামাজ শেষ করে নিচে চলে আসছে। তানভিরও বাসায় ফিরেছে। চার ভাই-বোন মিলে সিরিয়াস কোনো আলোচনায় ব্যস্ত তবে সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো খাবার। আবির আর মোজাম্মেল খানকে একসঙ্গে বাসায় ঢুকতে দেখে তানভির ভ্রু কুঁচকালো। সচরাচর সবাই একসঙ্গে নামাজে গেলে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান সামনে গল্প করতে করতে চলে যান, পেছনে আবির, তানভির আর ইকবাল খান টুকাটুকি কথা বলে৷ তানভির না থাকলে আবির আর ইকবাল খান একসঙ্গে যান। তবে এই প্রথমবার বাসায় কেউ না থাকাতে আবির আর তানভিরের আব্বু একসঙ্গে বাসায় আসছে তবুও এমন একটা দিনে। আবিররা আসতেই মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে আবিরকে দেখে নিল, আবিরের মাথায় টুপি, সাবলীল ভঙ্গিতে আব্বুর সাথে কথা বলছে তা দেখে মেঘের হৃদয়ের ধুকপুকানি তীব্র হতে শুরু করেছে। মালিহা খান খেতে ডাকছেন তাই আলী আহমদ খান আর ইকবাল খান ব্যতীত বাকি সবাই গিয়ে খেতে বসেছে। রাকিবের নাম্বার থেকে তানভিরের ফোনে বার বার কল আসতেছে। তানভির রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ রাকিব ভাইয়া,বলো।”
“আবির কোথায় রে?”
“আছে পাশেই। খেতে বসছে।”
“আবির বিকালে কাউকে না বলে হুট করে অফিস থেকে চলে গেছে। তারপর থেকে কল ধরছে না। কি হয়ছে? সবকিছু ঠিক আছে?”
” হ্যাঁ একদম। ভাইয়ার ফোন রুমে, মাত্র নামাজ থেকে এসে খেতে বসেছে।”
“তাহলে অফিস থেকে হুট করে চলে গেছিলো কেনো?”
“খাওয়াদাওয়া শেষ করি তারপর তোমার সাথে দেখা করে বলব। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে। ”

সবাই সবার মতো খাচ্ছে। কারো মুখেই প্রয়োজনের বাহিরে কোনো কথা নেই। তানভির একটু পর পর আবিরকে ইশারায় এটা সেটা বুঝাচ্ছে আবার প্রশ্নও করছে তবে মোজাম্মেল খান তাকালেই চুপ হয়ে যায়।খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবির আর তানভির বেড়িয়েছে যদিও আবির যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু তানভির একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেছে।

রাকিব আর রাসেল অফিস থেকে বেড়িয়ে প্রতি সপ্তাহের সেই সুপরিচিত আড্ডাখানায় আবিরদের জন্য অপেক্ষা করছে। আবির এসেই চুপচাপ বসে পরেছে, মালিহা খান জোর করে একটু বেশিই খাইয়েছেন তাই এত নড়াচড়া করতে ভালো লাগছে না। এমনকি আবির বাইকও নিয়ে আসে নি। তানভিরের বাইকে এসেছে।
রাকিব আবিরকে দেখেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে কি হয়েছে তোর? অফিস থেকে কোথায় চলে গেছিলি?”
আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আজ ও কে আবার দেখতে আসার কথা ছিল।”
রাকিব চেঁচিয়ে উঠল,
“কি? তারপর?”

এরমধ্যে তানভির বাইক পার্ক করে চলে আসছে। এসেই রাকিবের সামনে রাখা একটা চেয়ারের উপর নিজের ডান পা তুলে, ডানহাতের তিন আঙুল ভাঁজ করে বাকি দুই আঙুল রাকিবের কপালের কিছুটা উপরে মাথায় ধরে রাগান্বিত কন্ঠে চিৎকার করল,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৭

” হারামীর বাচ্চা, বিয়ে করার খুব শখ তোর? তাও আবার আমার Sparrow কে? বিয়ে তো বহু দূর তুই আমার মেঘকে কল্পনাতেও দেখতে পারবি না।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৮(২)