আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬০
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
দেখতে দেখতে মাসখানেক কেটে গেছে। এরমধ্যে মেঘের প্র্যাক্টিকেল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবিরের ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়েছে, সকালে নাস্তা করে বাসা থেকে বের হয় ফিরতে ফিরতে প্রায় ১০/১১ টা বেজে যায়। মেঘ প্রায় প্রতি রাতেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবিরের জন্য অপেক্ষা করে। প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে কখনও ক্লান্ত হয় না মেয়েটা।
আজ শুক্রবার। স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ।মেঘের ঘুম ভাঙে প্রায় ১০ টার দিকে। ফ্রেশ হয়ে আপন মনেই নিচে যাচ্ছিলো। আচমকা সিঁড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো। তানভিরের রুমের ভেতর থেকে আসা পড়ার শব্দে মেঘ সহসা ভ্রু কুঁচকে তানভিরের রুমের দিকে তাকালো। এক সেকেন্ড দেরি না করে তানভিরের রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে দেখলো। মেঘকে দেখে তানভির পড়া থামিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কিছু বলবি?”
মেঘ হা করে দুহাতে মুখ ঢেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“তুমি পড়তে বসছো?”
তানভির নম্র স্বরে বলল,
” সামনে পরীক্ষা।”
মেঘ বিস্ময় সমেত তানভিরকে দেখছে। বাসায় মেয়ে সংগঠিত ঘটনার পর থেকে বাবা ছেলের সম্পর্কে যেমন ফাটল ধরেছে তেমনই ফাটল ধরেছে পড়াশোনার সাথেও ৷ রাজনীতিতে জড়ানোর পর পড়াশোনাটা কেবল সার্টিফিকেটের জন্য ই চালিয়ে গেছে। পরীক্ষা ব্যতীত কখনো কলেজের গন্ডিও পার হয় না। এত বছর পর হঠাৎ তানভিরকে পড়তে বসতে দেখে মেঘের বিস্ময় যেন কমছেই না, এক ছুটে গেল হালিমা খানের কাছে। একে একে সবাইকে তানভিরের পড়ার কথা বলেছে,সেসব শুনে মীম আর আদিও তানভিরকে এক নজর দেখে গেছে। মেঘ রুমে এসেই দেখে বন্যা কল দিচ্ছে। বন্যার কল রিসিভ করেই মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” জানিস কি হয়েছে?”
বন্যা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে?”
“ভাইয়া পড়তে বসছে।”
বন্যা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এমনভাবে বলছিস, আমি তো মনে করছিলাম কাউকে মা**র্ডা*র করে ফেলছেন। অবশ্য বলা যায় না,করতেও পারেন।”
মেঘের হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় মুহুর্তেই বেদনার ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। উজ্জ্বল ধৃষ্টতা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ভারী কন্ঠে বলল,
” সরি, আমি ভাইয়ার ব্যাপারে তোকে কিছু বলবো না ভেবেছিলাম তারপরও মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। কিছু মনে করিস না, প্লিজ। ”
বন্যা ভাব নিয়ে বলল,
“অনেক রাগ দেখানো হয়েছে, থাক বেবি আর রাগ করতে হবে না। আর আমিও সরি, আসলে এভাবে তোর কলিজার টুকরা ভাইকে নিয়ে কথা বলা উচিত হয় নি৷ ”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,
” বাদ দে এসব কথা। এখন তুই বল, কেনো কল দিয়েছিলি?”
” শুনলাম মিনহাজের পা ভেঙ্গে গেছে…।”
বন্যা কথা শেষ করার আগেই মেঘ ফোঁস করে উঠে রাগী স্বরে বলল,
“তুই কি বলতে চাচ্ছিস, আমার ভাই ওর পা ভেঙ্গে ফেলছে?”
বন্যা রাশভারি কন্ঠে বলল,
” আমি এ কথা বলবো কেন? বুঝলাম ভাইকে খুব ভালোবাসিস তাই বলে আমার কথা শেষ করার আগেই চিৎকার দিয়ে উঠবি?”
“ঠিক আছে, বল।”
“ফুটবল খেলতে গিয়ে কিভাবে যেন পা ভেঙ্গে গেছে। এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। মিষ্টিরা সবাই দেখতে যেতে চাচ্ছে। তুই তাদের নাম্বার ব্লক করে রাখছিস তাই আমাকে বার বার কল দিচ্ছে। তুই কি যাবি?”
মেঘ ধীর কন্ঠে বলল,
“আজ শুক্রবার, আব্বু, বড় আব্বু সবাই বাসায়। দেখি যেতে দেন কি না। ”
“আচ্ছা আমাকে জানাইস।”
“ঠিক আছে। ”
মেঘ নিচে আসতেই আব্বুর সাথে দেখা, মেঘ ভয়ে ভয়ে বলল,
“আব্বু, আমার একটা ফ্রেন্ড পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সবাই দেখতে যাবে৷ আমিও যাই?”
মোজাম্মেল খান মেয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললেন,
“ঠিক আছে যাও। তানভিরকে নিয়ে যেতে বলো।”
“ভাইয়া পড়তেছে।”
মোজাম্মেল খান আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকিয়ে বললেন,
” কি? তোমার ভাই পড়তে বসছে?”
মেঘ নিঃশব্দে হেসে বলল,
“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ যাবৎ পড়তেছে।”
” হঠাৎ পড়তে বসার কারণ কি?”
“জানি না। ভাইয়াকে ডাকবো?”
মোজাম্মেল খান ধীর কন্ঠে বললেন,
“না থাক। পড়তে যেহেতু বসেছে পড়ুক। তুমি বরং আবিরকে বলো নিয়ে যেতে।”
আবিরের নাম শুনেই মেঘ আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
” নাহ৷ আমি একায় যেতে পারবো। ”
মেঘ মনে মনে ভাবছে, “আবির ভাই যদি জানতে পারে আমি মিনহাজকে দেখতে যেতে চাচ্ছি তাহলে তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে।”
মোজাম্মেল খান হালকা ধমকের স্বরে বললেন,
” একা যেতে হবে না আবিরকে নিয়ে যাও। ”
“আবির ভাই ঘুমাচ্ছেন।”
“এত বেলা হয়ে গেছে এখনও ঘুমাচ্ছে।
আবিরের ঘুম ভাঙিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে বলো । আর আবির রাজি না হলে আমিই নিয়ে যাবো।”
মেঘ বিড়বিড় করতে করতে আবিরের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ভেতরে ঢুকলো। আবিরের মায়াময় ঘুমন্ত চেহারায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, আস্তে করে ডাকলো,
“আবির ভাই..”
আবির ঘুমের মধ্যেই জবাব দিল,
“হুমমমম।”
মেঘ খানিক থেমে, মৃদুস্বরে আবারও ডাকলো,
“আবির ভাই..”
আবির ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে মেঘকে দেখেই মুচকি হাসলো। আবিরের সদ্য ভাঙা স্বপ্ন টা আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। মেঘের মায়াবী আদলে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“জ্বি ম্যাম, বলুন।”
মিনহাজের কথা শুনে কি না কি করে বসবে। সেসব ভেবেই ভয়ে মেঘের বুক কাঁপছে। তবুও সাহস নিয়ে বলল,
“আব্বু বলছেন আমাকে নিয়ে একটু বাহিরে যেতে।”
আবির শুয়া থেকে এক লাফে বসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“চাচ্চু বলেছে?”
“জ্বি। ”
“কোথায়?”
“মিনহাজ পায়ে ব্যথা পেয়েছে। দেখতে যাব।”
আবির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” পায়ে ব্যথা কিভাবে পেয়েছে?”
“ফুটবল খেলতে গিয়ে। আপনি যাবেন?”
“যাব না কেন? চাচ্চু বলেছেন যেতে তো হবেই।”
আবির রেডি হয়ে নিচে নামতেই মোজাম্মেল খানের সাথে দেখা। মোজাম্মেল খান শান্ত স্বরে বললেন,
” যাওয়ার সময় ফলমূল কিনে নিয়ে যেও ”
“জ্বি আচ্ছা। ”
“আর হ্যাঁ, নাস্তা করে বের হও। ”
আবির বলতে নিলো,
“পড়ে খাবো।”
কিন্তু বলতে পারলো না। মেঘ রেডি হয়ে নামতে নামতে আবির অল্প নাস্তা করে নিয়েছে। রাস্তা থেকে ফল আর কিছু খাবার নিয়ে মিনহাজকে দেখতে গেল। আবির কে দেখেই মিনহাজ শুয়া থেকে উঠতে নিলো। আবির তাকে থামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
” এত চাপ নিও না। শুয়ে থাকো।”
বন্যা, মিষ্টিরাও পাশে দাঁড়ানো। আবির মিনহাজের সাথে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। তামিমও তাতে সঙ্গ দিচ্ছে কন্তু মেঘের বিষয়টা একদম ভালো লাগছে না। মেঘ এখন পর্যন্ত আবিরকে যতটা চিনেছে, আবির মোটেই এরকম নয়। মিনহাজদের সাথে আবিরের কথোপকথন শুনে মনেই হচ্ছে না যে দুদিন আগে তাদের ভেতরে এত বিদ্বেষ ছিল৷ মেঘ বন্যার হাতে চিমটি কেটে বিড়বিড় করে বলল,
” আবির ভাইয়ের হঠাৎ মিনহাজদের প্রতি এত উদার কেন হলো বলতো? রাস্তায় এক ছেলে আমার হাত ধরেছিল বলে যা তা অবস্থা করছিল। আর এখন এত বড় ঘটনার পরও ওনি এত স্বাভাবিক কেনো?”
বন্যা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আবির ভাইয়া কি আমার নাকি তোর? আমি কিভাবে জানবো?”
আবির কিছুক্ষণ কথা বলে বেড়িয়ে গেছে। মেঘরা বেশকিছু সময় কথাবার্তা বললো। এরমধ্যে মিনহাজের বাড়ি থেকে মানুষ আসছে, এ অবস্থায় হোস্টেলে থাকতে কষ্ট হয়ে যাবে তাই কিছুদিনের জন্য ও কে বাড়িতে নিয়ে যাবে। মিনহাজকে বিদায় দিয়ে মেঘ, বন্যারা বিভিন্ন বিষয়ে কতক্ষণ আলোচনা করলো। আবিরকে কল দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবির চলে আসছে। মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“একটু কাজ ছিল।”
“একটা কথা বলবো?”
“হুমমম।”
“আপনার এত পরিবর্তনের কারণ কি?”
আবির ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে শুধালো,
“কিসের পরিবর্তন? ”
“আপনি তো আগে এমন ছিলেন না। তাহলে এখন এমন হয়ে যাচ্ছেন কেনো?”
আবির মলিন হেসে বলল,
” আপনার ভালোর জন্য। ”
“আমার ভালো মানে?”
আবির বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
” সময় হলে বুঝবেন।”
মেঘ শঙ্কায় আর কিছুই বলতে পারলো না। চুপচাপ দুজনেই বাসায় ফিরেছে।
তিনদিন কেটে গেছে। তানভির গতকালই বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছে ফিরতে আরও এক-দুদিন লাগবে। আজ মীমের স্কুলে পোগ্রাম তাই সকাল থেকে মেঘের কাছে বায়না ধরেছে, পোগ্রামে মেঘের ফোনটা নেয়ার জন্য। মেঘও তেমন আপত্তি করে নি, মীমকে ফোন দিয়ে দিয়েছে। বিকেল দিকে মেঘ ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ হালিমা খান আর আকলিমা খান এসে ডাকতে শুরু করেছেন। মেঘ ঘুমের মধ্যেই কোনোরকমে বলল,
“ডাকছো কোনো আম্মু?”
“তোকে দেখতে মানুষ আসছে। তাড়াতাড়ি উঠ।”
সেকেন্ডের মধ্যেই মেঘের ঘুম উধাও। তড়িৎ বেগে উঠে বসে চেঁচিয়ে উঠল,
“কি?”
আকলিমা খান চাপা স্বরে বললেন,
“আস্তে কথা বল, নিচে লোকজন বসে আছেন।”
মেঘ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আবারও চেঁচালো,
” আমি কোথাও যাব না।”
মেঘ আশেপাশে ফোন খোঁজতে নিলো হঠাৎ মনে পড়েছে মীমের ফোন নিয়ে যাওয়ার কথা। হুট করে ঘটা ঘটনাগুলো মেঘের মস্তিষ্ক অকেজো করে তুলেছে কি করবে তার দিশাবিশা পাচ্ছে না। আজ বাসায় তানভির, মীম কেউ নেই। কে বাঁচাবে মেঘকে? কিভাবে যাবে পাত্রপক্ষের সামনে? আবির ব্যতীত কাউকেই পাত্র হিসেবে দেখতেই চাই না মেঘ। যেভাবেই হোক আবির ভাইকে জানাতে হবে। মেঘ হুট করে বিছানা থেকে নেমেই দরজার দিকে ছুটলো, আম্মু বা কাকিয়া কারোর নাম্বার থেকে কল দিয়ে হলেও আবিরকে জানাতে হবে। দরজা পর্যন্ত যেতেই মোজাম্মেল খানকে দাঁড়ানো দেখে আতঙ্কে মেঘের পা যুগল থেমে গেছে। হালিমা খান আর আকলিমা খান দুজনেই হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন। মোজাম্মেল খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” চুপচাপ রেডি হয়ে নিচে আসো। ওনারা তোমার জন্য সারাদিন বসে থাকবেন না। ”
মোজাম্মেল খান আবারও নিচে চলে গেছেন। মেঘকে দেখতে ছেলে, ছেলের বাবা আর ছেলের মা আসছে। ছেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেখতে শুনতে খুব ই ভালো। মোজাম্মেল খানের পরিচিত একজন এই সম্বন্ধের কথা বলেছেন। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, উত্তরাতে নিজস্ব বাসা আছে, এলাকায় বেশ নামডাকও আছে।
ওনাদের একটাই ইচ্ছে মেয়েকে হতে হবে সুন্দরী যাতে ছেলের সঙ্গে মানায়৷ বাড়িতে কোনো কাজ করতে হবে না,যখন যা ইচ্ছে করতে পারবে। এসব শুনেই মোজাম্মেল খান মোটামুটি রাজি হয়ে গেছেন। মোজাম্মেল খান একায় ছেলের বাড়িতে গিয়ে ছেলে দেখে আবার তাদের নিজের সাথে করে বাসায়ও নিয়ে আসছেন। মোজাম্মেল খান ছেলের বাসায় থাকতেই আলী আহমদ খানকে কল দিয়ে বাসায় আসতে বলছেন। মালিহা খান আর বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডরা মিলে তাদের জন্য নাস্তা রেডি করছেন৷ উপরে হালিমা খান আর আকলিমা খান মেঘকে শাড়ি পড়ার জন্য জোরাজোরি করছেন। মেঘ শাড়ি ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বলছে,
” তোমরা আমার সাথে এমন কেনো করছো? তোমরা কি চাও আমি ম*রে যায়?”
হালিমা খান মেঘের মুখ চেপে ধরে আর্তনাদ করে বললেন,
” আজেবাজে কথা একদম বলবি না। ছেলে দেখা বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তোর আব্বু হুট করে তাদের নিয়ে বাসায় হাজির হয়েছেন। এখন তুই রেডি না হলে বাড়িতে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যাবে। মা রে আমার কথা মান একটু।”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি বিয়ে করবো না আম্মু।”
আকলিমা খান মেঘের চোখ মুছে শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ছেলে পছন্দ না হলে তোকে বিয়ে করতে হবে না।
তুই শুধু রেডি হয়ে নিচে যাবি আর আসবি। ঠিক আছে? ”
মেঘ আবারও বলল,
” আব্বুর দেখানো কোনো ছেলেকেই আমার পছন্দ হবে না। আমি বিয়ে করবো না। ”
মোজাম্মেল খান নিচ থেকেই উচ্চস্বরে ডাকলেন,
“কি হলো? তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?”
হালিমা খান আর আকলিমা খান দুজনে মেঘের চোখ মুখ মুছে মেঘকে সাজাতে শুরু করেছেন। মেঘের দু চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে, বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। আবির ই মেঘের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন পুরুষ, আবির ব্যতীত এই দেড় বছরে কাউকে নিয়ে এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবে নি। অথচ আজ সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটা চিৎকার করে বলছে,
” আমি আবির ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।”
অথচ মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না। কান্না গলায় আঁটকে মেঘের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কাশতে কাশতে চোখ লাল হয়ে গেছে তবুও কান্না থামছেই না। ২০-২৫ মিনিট পর মোজাম্মেল খান আবারও উপরে আসছেন। ততক্ষণে মেহমানদের নাস্তা খাওয়া শেষ। আলী আহমদ খান বাসায় ফিরে কেবলই ফ্রেশ হতে গেছেন। মালিহা খানও নিজের রুমেই বসা। মেঘকে অনেক জোরাজোরি করেও শাড়ি পড়াতে পারে নি তাই সবুজ রঙের একটা থ্রিপিস পড়িয়ে আকলিমা খান মোটামুটি সাজিয়ে দিয়েছেন। চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিলেই মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। আকলিমা খানও সেটায় করেছেন। মোজাম্মেল খান খান দরজা থেকে মেঘকে দেখেই কপাল গুটালো। ভেতরে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কি শুরু করেছো তুমি? আর কতক্ষণ ওনাদের বসিয়ে রাখবো?”
মেঘ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
” আমাকে ভাইজান বলেছিলো পাত্রপক্ষ বাসায় এনে তারপর কথা বলতে। আমি তাই করেছি। এখন দেখি কে আটকায়।”
মেঘ মনে মনে আওড়াল,
” আমার আবির ভাই আসলে এক মুহুর্তেই সবকিছু ছারখার করে দিবে তারপর বুঝবা কে আটকায়। ”
অকস্মাৎ নিচ থেকে আবিরের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। আবিরের কন্ঠ কানে বাজতেই মেঘ সহসা বিপুল চোখে তাকালো। সর্বাঙ্গে হিমশীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, দুচোখ চিকচিক করছে।আবিরের কন্ঠে একের পর এক হুঙ্কার আসছে। মোজাম্মেল খান দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। ওনার পেছন পেছন হালিমা খান ও আকলিমা খানও ছুটলেন। মেঘের দুচোখ বেয়ে তখনও পানি পড়ছে কিন্তু ঠোঁট জুড়ে প্রশান্তির হাসি ফুটেছে। মেঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আপনি আমার অভয়, আপনিই আমার প্রণয়। তাইতো দণ্ডে দণ্ডে আপনার অনুষঙ্গে ডুবে যেতে চাই।”
মোজাম্মেল খান রুম থেকে বের হয়ে বেলকনি থেকে নিচে তাকাতেই চোখে পরলো আবির একটা ফুলদানি ফ্লোরে ছুঁড়ে চিৎকার করে বলছে,
” আর কোনোদিন যদি এই বাসার চৌকাঠ পার করার চেষ্টা করেন তাহলে জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন না।”
পাত্রপক্ষ ভয়ে একপ্রকার জীবন বাঁচাতে পালিয়েছে। মোজাম্মেল খান সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করে বললেন,
” সমস্যাটা কি তোমার?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“তুমি বিয়ে করবে না বলে কি এই বাড়ির কারো বিয়ে হবে না?”
আবির উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
“নাহ, হবে না। আগামী ছয় মাস এই বাড়িতে কোনো বিয়ে হবে না। ”
” তোমার কথায় শেষ কথা?”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে পুনরায় বলল,
“হ্যাঁ, এই ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। ”
মোজাম্মেল খান রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন। অতিরিক্ত রাগে আবিরের চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। মালিহা খান, আকলিমা খান আর হালিমা খান তিনজনেই আবিরকে থামানোর চেষ্টা করছেন। আজ আবির কে থামানো সম্ভব না। মোজাম্মেল খানও রাগের চোটে যা তা বলছে, আবিরও প্রতিত্তোরে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেই চলেছে। আবির রাগে সবার পাশ কাটিয়ে উপরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,
” এরপর পাত্রী দেখার নাম করে কেউ এই বাসায় আসলে চৌকাঠ পার হওয়ার আগেই দু’পা ভেঙে দিব।”
অতিরিক্ত রাগে আবিরের শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে একটু এগুতেই মেঘের সঙ্গে দেখা। ডাগর ডাগর দু চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁট ভর্তি লিপস্টিক দেখে আবিরের মেজাজ তুঙ্গে। মেঘ ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। এমন সময় আলী আহমদ খান নিজের রুম থেকে বের হয়েছেন। মোজাম্মেল খান তখনও নিজের মতো বকবক করেই যাচ্ছেন। আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মেঘের দু চোখের কাজল লেপ্টে দিয়েছে, সাথে সাথে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে মেঘের ঠোঁটে ঘষা দিয়ে লাল টকটকে লিপস্টিক গাল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে। মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” নিচে তোর শ্বশুর অপেক্ষা করছে যা নিজের রূপটা দেখিয়ে আয়।”
আবির ফোঁস ফোঁস করে নিজের রুমে চলে গেছে। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে কতক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ নিচ থেকে আলী আহমদ খানের ধমকের শব্দে মেঘ লাফ দিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ড্রেসিং টেবিলে নজর পড়তেই মেঘ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল। লেপ্টে যাওয়া কাজল আর গাল পর্যন্ত ছড়ানো লিপস্টিক দেখে মেঘ মুচকি হেসে বলল,
” আবির ভাই, আপনি বড্ড হিংসুটে। তবে এই হিংসুটে মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি।”
নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে। মেঘ ভয়ে গুটিসুটি মেরে বিছানার এক কর্ণারে বসে আছে। দু একবার উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এসেছে৷ আবিরের প্রতি মেঘের অগাধ বিশ্বাস,নআবির একায় সবকিছু সামলে নিতে পারবে। কিন্তু আজ আর তা হলো না। দুই ভাই এর পীড়নে আবির আঁটকে গেল।
আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” তোমাদের জন্য কি এলাকায় মানসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবো না?”
আবির শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ভাবলেশহীন জবাব দিল,
” মান সম্মান যাওয়ার মতো কাজ না করলেই হয়।”
আলী আহমদ খান আবারও চেঁচালেন,
” আমরা কি করবো কি করবো না তা কি তোমাদেরকে বলে করতে হবে?”
আবির নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম্মেল খান দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন। আলী আহমদ খান আবারও বলতে শুরু করলেন,
” শুধু হাতে পায়ে বড় ই হয়েছো কিন্তু মানুষের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় তা শিখো নি। এই মানুষগুলো যখন বাহিরে আমার উপর আঙুল তুলবে তখন কি জবাব দিব আমি? আমার ছেলে হয়ে তোমার এই আচরণ কিভাবে হতে পারে? তোমরা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করছো, তোমরা কারো ভরসার যোগ্য নও।
তোমাদের উপর ভরসা করলে একদিনে ই আমার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে ফেলবে।”
আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীর কন্ঠে বলল,
” আব্বু, প্লিজ মাথা ঠান্ডা করুন। আপনি অসুস্থ.. ”
“আমার অসুস্থতা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তোমার আচরণ ই সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।”
আবির ভেতরের ক্রোধ কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না৷ রাগী স্বরে বলল,
” ঠিক আছে৷ আমিই যেহেতু আপনার সাম্রাজ্যের একমাত্র সমস্যা, সেই সাম্রাজ্য আর কলঙ্কিত না করি। ”
আবির দীর্ঘ কদম ফেলে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আলী আহমদ খান পেছন থেকে আবারও হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। এই বাড়িতে কোনো গু*ন্ডা বদ-মা* শের জায়গা নেই।”
আবির কথাটা শুনেও ফিরে তাকায় নি। বাড়ির তিন কর্তী এক কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খানের রাগে তারা বরাবরই চুপ থাকে। আবির বেড়িয়ে গেলেও দুই ভাই এখনও থামতে পারছে না। বুকের ভেতরের ক্রোধ থেমে থাকার নয়। কোনো ব্যক্তি আলী আহমদ খানের যতই প্রিয় হোক না কেনো খান বাড়ির মান সম্মানে আঘাত করলে আলী আহমদ খান তাকে কখনোই ছেড়ে দেন না। হোক সেটা আবির কিংবা ২৮ বছর পূর্বে আবিরের ফুপ্পি। প্রিয় এর চেয়েও প্রিয় মানুষকেও ক্ষণিকের ব্যবধানে অপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম। ঘন্টা খানেকের মধ্যে খান বাড়ির পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। যে যার রুমে চলে গেছেন। আলী আহমদ খান প্রেশারের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পরেছেন। মালিহা খান ওনার পাশে বসে আস্তে করে বললেন,
“ছেলে টাকে এভাবে কথা বলা আপনার ঠিক হয় নি। আপনি ভাববেন না যে, আমি আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছি। আবির, তানভির দু’জনেই মেঘকে অনেক বেশি আদর করে। তাই মেঘের বিয়ের ব্যাপারটা ওরা কিছুতেই মানতে পারছে না। এদিকে মেঘের আব্বু একের পর এক ছেলে দেখেই যাচ্ছে।ওদের কি দোষ?”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“ছেলেকে কল দিয়ে বাসায় আসতে বলো।”
মালিহা খান সঙ্গে সঙ্গে নিজের ফোন থেকে আবিরের নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু আবিরের ফোন বন্ধ। টানা দু-তিনবার কল দেয়ার পরও বন্ধ পেয়ে মালিহা খান ভয়ে সিটিয়ে পরেছেন। ততক্ষণে আলী আহমদ খান ঘুমিয়ে পরেছেন। মালিহা খান রুম থেকে বেড়িয়ে দ্রুত হালিমা খানকে ডাকলেন। মোজাম্মেল খান রুমেই বসা। ভাবির আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে ভাবি? ভাইজানের কিছু হয়েছে?”
“নাহ। আবিরের ফোন বন্ধ, কল দিয়ে পাচ্ছি না।”
মোজাম্মেল খান নিজের ফোন থেকেও একবার চেষ্টা করলেন। বন্ধ পেয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
” রাগ করে বেড়িয়েছে তাই হয়তো ফোন বন্ধ। খুলে ফেলবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আপনি রেস্ট নিন।”
হালিমা খানও বেশকিছুক্ষণ বুঝিয়েছেন কিন্তু মালিহা খানের আতঙ্ক কমছেই না। তানভিরকে কল দিয়েছে বলেছে৷ তানভির ওখানে থেকেই পরিচিত সবার সাথে যোগাযোগ করেছে কিন্তু আবিরের সাথে কারো কথা হয় নি। রাকিবকে কল দেয়ায় রাকিব বলল,
” আবির যাওয়ার সময় আমাকে বলেছে, প্রয়োজনে আজই আব্বু-চাচ্চুকে সব বলে দিব। তবুও এত প্যারা নিতে পারবো না।”
তানভির বাসার ঘটনা যা জানে সবটায় রাকিবকে জানিয়েছে। সব জায়গায় খোঁজখবর নিতে বলেছে। এত ঘটনার মাঝে মেঘের কোনো হদিস নেই। ইকবাল খান সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফেরার পথে মীমকে পোগ্রাম থেকে নিয়ে আসছে। বাসায় এসে এসব ঘটনা শুনে ইকবাল খান স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মীম সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো মেঘের রুমের দিকে। মেঘের রুমের দরজা বন্ধ, অনেকক্ষণ ডাকার পর মেঘ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়েছে। মেঘের চোখ আর ঠোঁট এখনও আগের মতোই আছে। মীম ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার এই অবস্থা কেনো?”
মেঘ আয়নায় নিজের মুখটা দেখে মুচকি হেসে বলল,
” এমনি। ”
মীম মেঘের ফোন মেঘকে দিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
” তুমি হাসছো? ভাইয়া যে রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে তা কি তুমি জানো? এমনকি ভাইয়ার ফোনও নাকি বন্ধ। ”
মেঘ আঁতকে উঠে বলল,
“কি? ”
মেঘ তাড়াতাড়ি আবিরের নাম্বারে ডায়াল করলো, সত্যি সত্যি নাম্বার বন্ধ। ইন্টারনেটে সব জায়গা থেকে মেসেজ দিয়েছে কিন্তু আবির কোথাও নেই। মেঘের চোখ মুখ মুহুর্তেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে।বুকের ভেতর আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। মেঘের এখন নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে, না ঘুমিয়ে তখন রুম থেকে বের হলেই পরিস্থিতি বুঝতে পারতো। অন্তত আব্বু আর বড় আব্বুর সামনে কিছু একটা বলতে পারতো। মীম শীতল কণ্ঠে বলল,
” আজ তোমার ফোনটা নেয়া একেবারেই উচিত হয় নি। সরি আপু।”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,
” তোর কোনো দোষ নাই। সব দোষ আমার কপালের। তুই রুমে যা। ”
মেঘ অনবরত আবিরের নাম্বারে কল দিয়েই যাচ্ছে। ফুপ্পি, জান্নাত আপু, আসিফ ভাইয়া সবার সাথে কথা বলেছে কিন্তু কেউ কিছু জানে না। মেঘ নিচে নামতে পারছে না কারণ আজকের এই ঘটনার জন্য মেঘ নিজেকেই দায়ী করছে। মেঘ উপায় না পেয়ে বন্যাকে কল দিল। বন্যা কল রিসিভ করতেই মেঘ একে একে সব বর্ণনা করেছে। বন্যা শান্ত স্বরে বলল,
“আচ্ছা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা কর। দেখ ওনি আসেন কি না। ”
ফোন বন্ধ জেনেও মেঘ একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। রাত ৯ টার দিকে তানভির মেঘকে কল দিল। মেঘ কান্না ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া, আবির ভাই কোথায়?”
তানভির মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“আমি খোঁজ নিচ্ছি, যোগাযোগ হলে জানাবো। তাছাড়া আগামীকাল আমি বাসায় ফিরবো। তুই মন খারাপ করে থাকিস না৷ ”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমার জন্যই তোমাদের এত ঝামেলা
আমি যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাব। ”
তানভির ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” পাগলামি করিস না বনু। একটু বুঝার চেষ্টা কর। ”
মেঘ কল কেটে দিয়েছে। রাতে কারো খাওয়াদাওয়া নেই। যে যার মতো আবিরকে কল দিচ্ছে, পরিচিত সবার সাথে বার বার যোগাযোগ করেছে কিন্তু কেউ কিছুই জানে না। বন্যা রাতে আবারও কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছে।
দু’দিন কেটে গেছে, আবির এখনও বাসায় ফিরে নি৷ দুদিন ধরে কোনো অফিসেও যাচ্ছে না। আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান নিজেদের মতো খোঁজখবর নিয়েই যাচ্ছেন কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছেন না।
আজ বিকেলে বন্যা মেঘদের বাসায় আসছে। মেঘকে রুমে না পেয়ে সরাসরি ছাদে গেল। মেঘ চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল। বন্যা মৃদু স্বরে ডাকলো,
“মেঘ। ”
মেঘ বন্যাকে দেখেই বসা থেকে উঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার জীবনে এত কষ্ট কেন?”
বন্যা মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
“কষ্ট সবার জীবনেই থাকে কেউ মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারে আবার কেউ পারে না। মন খারাপ করিস না। দোয়া করি আবির ভাইয়া যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন।”
মেঘকে বেশকিছু ক্ষণ বুঝানোর পর মেঘ শান্ত হয়েছে। দুই বান্ধবী পাশাপাশি বসা৷ বন্যা হঠাৎ ধীর কন্ঠে বলল,
” একদিক থেকে তুই খুব ভাগ্যবতী।”
“কোন দিকে?”
“এইযে আবির ভাইয়ার প্রেয়সী হিসেবে৷ দুনিয়া উল্টে যাক আর যা ই হয়ে যাক তোর বিপদে ওনি ঠিকই তোকে বাঁচিয়ে নেন। এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।”
“সেই ভাগ্য টাকে তো কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারছি না আর নিজেকে শক্তও রাখতে পারছি না। তুই কিভাবে এত শক্ত থাকিস ? ”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
“শক্ত থাকি না তবে শক্ত থাকার চেষ্টা করি। ”
“কিভাবে?”
“তুই একদিন বলেছিলি, মানুষ নিরন্তর সুখের নীড় খুঁজে, কষ্ট আড়াল করে প্রতিনিয়ত স্বভাবসিদ্ধ হাসে৷ সত্যি বলতে এটায় বাস্তবতা। জীবনে চলার পথে প্রতিটা মানুষ ই মানসিক শান্তি খোঁজে যেখানে সে সর্বোচ্চ ভালো থাকতে পারবে কিন্তু সেই সুখের স্থান সবার ভাগ্যে জুটে না। তখন বাধ্য হয়ে ভালো থাকার অভিনয় করতে হয়।”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“তোর আবার কি হয়েছে যে তোকে অভিনয় করতে হয়?”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
” তেমন কিছু না। বাদ দে। ”
মেঘ ভারী কন্ঠে বলল,
“আমি বাদ দিব না। তোকে আজ বলতেই হবে। আমি প্রায় ই খেয়াল করি তুই মাঝে মাঝে মন মরা হয়ে থাকিস৷ জিজ্ঞেস করলে ইগ্নোর করিস। আজকে তোকে বলতেই হবে।”
” জানি কথাগুলো শুনলে তোর কষ্ট লাগছে, কারণ আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও তোর কাছে এত বড় সত্যিটা লুকিয়েছি। ”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে আতঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে তোর?”
বন্যা ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলতে শুরু করলো,
” আমাদের এসএসসি পরীক্ষার পর অনেকদিন তোর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না তখন হাতে ফোন ও ছিল না। ঐ সময় মামা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে এক মামাতো ভাইয়ের সাথে মোটামুটি ভালো মিল হয়েছিল৷ ভাইয়া তখন রাবিতে পড়তো, ছুটিতে বাড়ি আসছিলো।আর যেহেতু ভাইয়াদের বাসাতেই আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম সেই সুবাদে দুষ্টামি, ফাজলামো করতাম৷ একদিন আম্মু, মামা, মামি কথা বলছিল, কথার মাঝখানে আমাদের দু’জনের কথা উঠে আর মোটামুটি বিয়ের আলোচনা শুরু হয়ে যায় ।
তখন আমি আর ভাইয়া দুজনেই রুমে উপস্থিত। আমি ফাজলামো করলেও সেটা ভাই হিসেবে করতাম কিন্তু আম্মুদের আলোচনায় তা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ভাইয়ার সাথে আমার ঐরকম কিছু নেই এটা আম্মুকে বলার পর আম্মু বলছে, এই বিয়ের আলোচনা আরও একবছর আগেই হয়েছিল যেটা এতদিনে প্রকাশ পেয়েছে। মূলকথা তারা দেখতে চেয়েছিল আমার আর ভাইয়ার বন্ডিং টা কেমন হয়। এসব জানার পর আমি আরও বেশি হতাশ হয়ে গেছিলাম বাধ্য হয়ে সুযোগে ভাইয়াকে সবকিছু খুলে বলি।
ভাইয়া সাহায্য করার বদলে আমায় প্রপোজ করে বসেন৷ তখন রাগ করে মামা বাড়ি থেকে চলে আসি। এরপর থেকে ভাইয়া মাঝে মাঝে আম্মুর নাম্বারে কল দিতো, যেহেতু প্রাথমিকভাবে বিয়ের আলোচনা হয়েই ছিল তাই আম্মুও আমাকে ফোন দিতেন, আমি না চাইতেও ওনার সাথে কথা বলতাম। ধীরে ধীরে আমিও মানসিকভাবে সেই মানুষটার সাথে জড়াতে শুরু করি। আমার যেহেতু আলাদা ফোন ছিল না ঐ ভাবে কথাও হতো না।
একদিন আপুর ফোন থেকে ফেসবুকে ওনার আইডি চেক করি যা দেখে আমি রীতিমতো টাশকি খেয়েছিলাম। ওনার আইডিতে একের পর মেয়ের ছবি। ওনার বন্ধু তালিকায় ছেলে নেই বললেই চলে৷ তারমধ্যে একজনের সাথে বেশ কিছু ছবিও পোস্ট করা যার সবগুলোতেই রোমান্টিক ক্যাপশন দেয়া। আমি সেসব সহ্য করতে না পেরে ওনাকে কল দিয়ে রাগারাগি করি। এক পর্যায়ে ওনি স্বীকার করেন যে সেই মেয়ে তার গার্লফ্রেন্ড শুধুমাত্র পরিবারের মানুষের সামনে ভালো সাজার জন্য এমন কাজটা করেছে। তাছাড়া ওনি আমার চেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন। আরও কত কি!”
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৫৯
বন্যা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও বলল,
“সেদিনের পর একটা কথায় মাথায় ঢুকেছে জীবনে বহুরূপী মানুষের চেয়ে একজন অতি সাধারণ মানুষও ঢের ভালো। মানুষটা নিষ্ঠুর কিংবা পাষাণ হোক তবুও একান্ত আমার হোক।”