আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬১
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
মেঘ বন্যার গুরুগম্ভীর চেহারায় খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মুখভার করে বলে উঠল,
” এত বড় ঘটনা টা আমাকে না জানিয়ে তুই কিভাবে ছিলি ?”
বন্যা ইতস্ততভাবে জবাব দিল,
“অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গেছিলাম তখন অনীস্পিত ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ায় ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। তাছাড়া আমি তো তোকে খুব ভালো করে চিনি, এই রকম একটা ঘটনা শুনলে তুই নিজেই মানসিক ভাবে ভেঙে পরতি। যে আঘাত আমি পেয়েছি সেটা ইচ্ছেকৃত তোকে দিব এতটা নিষ্ঠুর আমি নয়।”
মেঘ ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” তারপর কি বিয়ে ভেঙে গেছে? ”
“আমি ভেঙে দিয়েছি যার কারণে আম্মু মামার বাড়িতে গেলে এখনও অনেক কথা শুনতে হয়। ওনাদের নজরে ওনাদের ছেলে একদম নিষ্পাপ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তারা না দেখার মতো আচরণ করে। তাই আমি নিজেকে অপকৃষ্ট মেনে নিয়েই মামার বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছি। ”
“বাসায় কেউ কিছু বলে নি?”
“আমার বাসার মানুষ সবটায় জানে বরং ঐ সময়টাতে আপু আর আম্মু ই আমাকে সাপোর্ট করেছে। তাছাড়া আব্বু আগে থেকেই এই সম্পর্কে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেঘ শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তুই কি ওনাকে এখনও মিস করিস?”
বন্যা মেঘের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলল,
” প্রয়োজনে দূর্বাঘাসে ফাঁ* স নিবো তবুও দুশ্চরিত্রা ব্যাটাকে মিস করবো না। ”
মেঘ আর বন্যা দুজনেই হাসছে৷ এরমধ্যে মীম পেছন থেকে শক্তপোক্ত গলায় বলে উঠল,
“বন্যাপু তুমি দূর্বাঘাসে ফাঁ *স নিবা কেনো?”
মেঘ আর বন্যা দু’জনে একসঙ্গে ঘুরে তাকালো। বন্যা হেসে বলল,
“আরে মজা করছিলাম।”
মীম বলল,
“আম্মু তোমাদের ডাকছে, চলো।”
তিনজনই একসঙ্গে নিচে আসছে। বন্যা সচরাচর মেঘদের বাসায় আসে না। হঠাৎ আসলে তার জন্য বাহারি নাস্তার আয়োজন করা হয় আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বন্যা অল্প নাস্তা করে মেঘের সাথে সোফায় বসে গল্প করছে এমন সময় তানভির বাসায় আসছে৷বন্যাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে সোজা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। কয়েকটা সিঁড়ি উঠতেই মেঘ ডাকল,
” ভাইয়া।”
তানভির আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“বল।”
“খেয়েছো কিছু?”
“না।”
“খেতে দেয়?”
“নাহ। খিদে নেই।”
তানভির যথারীতি উপরে চলে গেছে। বন্যা ভ্রু কুঁচকে ভারী কন্ঠে বলল,
“তোরা এসব কিভাবে সহ্য করিস?”
“কিসব?”
“এত অনিয়ম।”
মেঘ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আসলে এখন তুই আছিস যে তাই লজ্জা পেয়েছে। ”
বন্যা দৃঢ় কন্ঠে শুধালো,
” তোর ভাই লজ্জাও পায়?”
মেঘ কপালে কয়েক স্তর ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” তোর কি আমার ভাই কে ছ্যাঁচড়া মনে হয়?”
বন্যা রাশভারি কন্ঠে বলল,
” আমার ভুল হয়ে গেছে। তোর ভাইকে নিয়ে কথা বলে বড্ড অন্যায় করে ফেলছি। আমায় মাফ করে দে।”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
” করতে পারি তবে একটা শর্তে। ”
“কি শর্ত?”
“তুই আমার ভা…”
এটুকু বলেই মেঘ থেমে গেছে। ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল,
“কিছু না। ”
বন্যা আরও কিছুক্ষণ গল্প করে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ উপরে যেতেই তানভির ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বন্যা কোথায়?”
“চলে গেছে। ”
তানভির আস্তে করে বলল,
“আমায় ডাকতে পারতি, এগিয়ে দিয়ে আসতাম।”
মেঘ মৃদুস্বরে বলল,
” আমি বন্যাকে বলেছিলাম কিন্তু ও বারণ করলো।”
“ওহ।”
মেঘ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবারও থমকে দাঁড়ালো। বন্যার সামনে মেঘ কিছু না বললেও বন্যাকে ভাবি বানানোর সুপ্ত ইচ্ছে এখনও মেঘের মনে বর্তমান৷ তানভিরের অভিব্যক্তি বুঝার জন্য মেঘ ধীর কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া জানো, বন্যার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। ”
তানভির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কেনো?”
মেঘ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বুকে সাহস নিয়ে বলল,
“বন্যাকে একটা ছেলে খুব কষ্ট দিয়েছে।”
তানভিরের সহসা কপাল গুটিয়ে সূক্ষ্ণ নেত্রে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” ছেলের নাম কি? করে কি?”
“নাম ঠিকানা জানি না। বন্যার মামাতো ভাই। ওদের মধ্যে বিয়ের কথাও হয়েছিল৷ তারপর জানতে পারছে ছেলেটা ভালো না। তাই বিয়ে ভেঙে দিছে। ”
তানভির গুরুগম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
” কবে ভাঙছে?”
মেঘ আনমনে বলল,
“৩-৪ বছর আগে। ”
তানভির বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
“৪ বছর আগের ঘটনায় আজ মন খারাপ করার কি আছে? অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে জীবনে এগোবে কেমন করে?”
মেঘ মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল,
” আমাকে আজ ই শেয়ার করেছে। ”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” ৪ বছর যেহেতু তোকে শেয়ার করে নি তাহলে তোর ও বুঝতে হবে সে এই বিষয়টা ভুলে যেতে চাচ্ছে। তুই এটা নিয়ে কথা বলিস না। অতীত সবার জীবনেই থাকে, আমার জীবনেও আছে৷ তাই বলে আমি কি এখনও সেসব নিয়ে বসে আছি?”
মেঘ হুট করে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া, তুমি কি এখন কাউকে পছন্দ করো?”
তানভির চাপা স্বরে বলল,
” সময় হলে তোকে জানাবো।”
মেঘ নিঃশব্দে হেসে করিডোরে হাঁটছে আর মনে মনে ভাবছে,
” তুমি কিংবা বন্যা দুজনেই আমার খুব প্রিয় আর আমি কাউকে ঠকাবো না। তোমার অতীত যেমন বন্যাকে জানিয়েছি তেমন বন্যার অতীতও তোমাকে জানালাম। এখন তোমাদের মন পরীক্ষার পালা। তোমাদের মনে অনুভূতি জাগলেই এক করে দিব দু’জনকে। কিন্তু কিভাবে করবো? আমার আবির ভাই কই?”
মেঘের শান্ত মন আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে। অস্পষ্ট অভিমান বুকের ভেতর বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত অসংখ্যবার আবিরের নাম্বারে কল দেয়।
রাতের বেলা মেঘ মীমের রুমে গেল, মীম তখন পড়ছিল। মেঘ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
” আচ্ছা মীম বন্যাকে তোর কেমন লাগে?”
“বন্যাকে আপুকে আমার অনেক ভালো লাগে। এটা নতুন করে বলার কি আছে?”
মেঘ ধীর কন্ঠে বলল,
“এভাবে না। অন্যভাবে।”
মীম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“অন্যভাবে আবার কিভাবে?”
“আমাদের ভাবি হিসেবে কেমন লাগবে?”
মীম আঁতকে উঠে বলল,
“আবির ভাইয়ার…”
মেঘ মীমের মাথায় গাট্টা মেরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“আবির ভাই আমার।”
মীম মাথায় ঘষতে ঘষতে বলল,
“তানভির ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।”
মীম মাথা চুলকে আনমনে ভাবছে। মেঘ ফোঁস করে উঠে বলল,
“এত কি গবেষণা করছিস?”
মীম চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“বন্যা আপুকে কি ভাইয়া পছন্দ করবে?”
মেঘ মৃদুস্বরে বলল,
“জানি না রে। তবে আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা হতেও পারে।”
মীম উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“হলে খুব ভালো হবে আপু। বন্যা আপুকে আমার খুব ভালো লাগে। কত সুন্দর করে কথা বলে, আমাদের সাথে মিশে তাছাড়া ভাইয়ার পাশে দুজনকে মানাবেও ভালো।”
আবির বাসায় নেই এক সপ্তাহ হতে চললো৷ বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলে না, সবার ভেতরেই চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে। বিকেল দিকে হালিমা খান সোফায় বসে ছিলেন ওনাকে দেখে মালিহা খানও এসে বসলেন। হালিমা খানকে এক পলক দেখে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর কি শরীর খারাপ? ”
হালিমা খান মলিন হেসে জবাব দিলেন,
” মনটা খুব খারাপ। আবির এখনও বাসায় ফিরছে না। কোথায় আছে কি অবস্থায় আছে আল্লাহ ভালো জানেন।”
মালিহা খান শ্বাস ছেড়ে ভারী কণ্ঠে বললেন,
” ওদের বাবা ছেলের কর্মকাণ্ডে আমি আর কুলাতে পারছি না। মেঘের আব্বু যেভাবে রাগ দেখায়, আবিরের আব্বুও তেমন রাগ দেখায়। কেউ কিছু বুঝার চেষ্টা করে না। ছেলেটা এসব কত সহ্য করবে।”
হালিমা খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“মেঘের আব্বু কিছুদিন যাবৎ রাতে ঘুমায় ই না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করে। যত বন্ধু আর পরিচিত মানুষ আছে সবাইকে কল দিয়ে আবিরের কথা জিজ্ঞেস করে। ”
মালিহা খান মলিন হেসে বললেন,
” মেঘের আব্বুকে তো আমি চিনি। রাগ দেখানোর সময় কোনো কিছু ভাববে না অথচ পরে নিজেই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করবে। অন্যদিকে আবিরের আব্বু সম্পূর্ণ উল্টো। ওনার নিয়ম নীতির বাহিরে গেলেই ওনার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলে, বউ,ভাই-বোন কিছুই দেখে না। সেদিন মেঘের আব্বু চিল্লাচিল্লি করার পরও আবির বেশ শান্ত ছিল কিন্তু হুট করে ওর আব্বু যখন শুরু করলো তখন আর সহ্য করতে পারলো না। ”
হালিমা খান অনেকটা সময় নিশ্চুপ থেকে মালিহা খানের দিকে এক পলক তাকিয়ে নীরবতা ভেঙে বললেন,
“আফা, একটা কথা বলি?”
মালিহা খান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” কথার মধ্যে মাপামাপি কবে থেকে শুরু করলি? বল কি বলবি। ”
হালিমা খান কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন সহসা মৃদু হেসে বললেন,
“না থাক। কিছু না।”
“কি বলতে চাইছিলি বল ”
” বাসার নিয়ম নীতি ভুলে অলীক কল্পনায় ডুবে ছিলাম। যা কখনো সম্ভব না তা নিয়ে ভেবেছিলাম। ”
ঢোক গিলে শান্ত স্বরে আবারও বললেন,
“রাতে কি রান্না করবো?”
এরমধ্যে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান বাসায় ফিরেছেন। মালিহা খান বসা থেকে উঠতে উঠতে আচমকা মেঘ হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে। পেছন থেকে তানভির ডাকছে,
“বনু শুন। কি হয়েছে বল আমাকে।”
মেঘের হাতে তানভিরের ফোন। মেঘ নামতে নামতে আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খান মেঘের সামনে হাজির। মোজাম্মেল খান গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে তোর ?”
তানভির বলতে বলতে নামছে,
“কে কল দিছিলো বলবি তো?”
আব্বুকে দেখেই তানভিরের গতি কমে গেছে। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছে। তানভিরের পড়নে লুঙ্গি আর গলায় একটা গামছা ঝুলানো, সম্পূর্ণ শরীর ভেজা। আব্বু আর বড় আব্বুকে দেখেই তানভির গামছা দিয়ে মাথা মুছতে শুরু করেছে। একটু আগে মেঘ আবিরের খোঁজ নিতে তানভিরের রুমে গিয়েছিলো। তানভির ওয়াশরুমে থাকায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে নি। হঠাৎ তানভিরের ফোনে কল বাজতে শুরু করে। মেঘ উচ্চ স্বরে ডাকে,
“ভাইয়া, তোমার ফোনে কল আসতেছে। ”
” দেখ, কে কল দিয়েছে। ”
মেঘ ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। অপরিচিত নাম্বার দেখে তেমন পাত্তা দেয় নি। একবার রিং বন্ধ হয়ে গেছে। মেঘ দরজা পর্যন্ত যেতেই আবারও কল বাজতেছে। ওয়াশরুম থেকে তানভির বলছে,
“রিসিভ করে বল আমি ব্যস্ত।”
মেঘও যথারীতি কল রিসিভ করে বলতে নিলো,
“ভাইয়া ব্য..”
এটুকু বলতেই ওপাশ থেকে সুপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
“তানভির, আমি আবির। ”
মেঘ আর আবির দুজন একসঙ্গে কথা বলে অকস্মাৎ দু’জনই থেমে গেছে। মেঘ উত্তপ্ত কন্ঠে ডেকে উঠলো,
“আবির ভাই। ”
ততক্ষণে আবির কল কেটে দিয়েছে। এমন সময় তানভিরও ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। মেঘের হাতের কম্পন দেখে ধীর কন্ঠে শুধালো,
“কে কল দিছিলো?”
মেঘ উত্তর না দিয়েই রুম থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসছে।
মেঘের চোখ মুখ দেখে আলী আহমদ খান প্রশ্ন করলেন,
” কিছু হয়েছে? ”
মেঘ অতর্কিতে ভেঁজা কন্ঠে বলে উঠল,
” এইমাত্র ভাইয়ার ফোনে আবির ভাই কল দিয়েছিল। আমার কন্ঠ শুনে কল কেটে দিয়েছে। ”
তানভির ভারী কন্ঠে শুধালো,
“কি? ভাইয়া কল দিয়েছিল?”
আলী আহমদ খান সহ সবাই তানভিরের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানভির সবাইকে এক পলক দেখে সহসা বললো,
“আমার সাথে ভাইয়ার সত্যিই যোগাযোগ নেই। আমি জানি না কিছু।”
তানভির নেমে এসে মেঘের হাত থেকে ফোন নিয়ে নাম্বার টা চেক করতে লাগলো। মেঘ দুই সিঁড়ি উঠে তানভিরের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির কল ডিটেইলস বের করে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” দেখ তো আমার সাথে কথা হয়েছে কি না। তাছাড়া আমার সাথে যদি ভাইয়ার যোগাযোগ থাকতো ই তাহলে আমি এত খোঁজাখুঁজি কেনো করতাম?”
আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“তোমার সাথে আবিরের যোগাযোগ আছে কি নেই সেটা আমার জানার প্রয়োজন নেই। তুমি এই মুহুর্তে আমাদের সামনে আবিরকে কল দিবা। ”
তানভিরের হাত কাঁপছে, ভয়ে ভয়ে ডায়াল করল সেই নাম্বারে। মোজাম্মেল খানের কথা মতো কল লাউডস্পিকারে দিয়েছে। প্রথমবার কল রিসিভ হয় নি। দ্বিতীয়বার কল রিসিভ করে আবির গুরুভার কন্ঠে বলল,
” কিছু বলবি?”
আবিরের কন্ঠস্বর শুনেই মেঘের বুক কাঁপছে, দু চোখ ছলছল করছে। আব্বু, বড় আব্বু, আম্মুরা সামনে দাঁড়ানো। তাই বার বার ঢোক গিলে মেঘ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে৷ তানভির সহসা বললো,
“ভাইয়া, কোথায় তুমি?”
তানভিরের কন্ঠ শুনে আবির কিছুটা থতমত খেলো। কয়েক মুহুর্ত পর দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল,
” আছি। ”
আলী আহমদ খান অত্যন্ত গুরুতর কন্ঠে বলে উঠলেন,
” ও কে বলে দাও, যেখানেই আছে আজকের মধ্যে বাসায় ফিরতে। প্রজেক্টের দায়িত্ব যেমন নিয়েছে সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনও তাকেই করতে হবে। রাগ,জেদ দেখিয়ে আমার কোম্পানির ক্ষতি করবে তা আমি কখনোই সহ্য করবো না। ”
তানভির শক্ত কন্ঠে বলল,
“শুনেছো?”
“হ্যাঁ।”
মোজাম্মেল খান এবার রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” শুধু শুনলেই হবে না। যেখানেই আছো রাত ১০ টার মধ্যে বাসায় আসবে। ”
“আচ্ছা। ”
আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খান নিজেদের রুমে চলে গেছেন। মালিহা খান আর হালিমা খান তানভিরের ফোন নিয়ে হাহাকার শুরু করে দিয়েছেন। মেঘ সিঁড়ির সাথে ঠেস দিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের সাথে কথা শেষ করেই মালিহা খান নিজের রুমে গেলেন। আলী আহমদ খান বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। মালিহা খান কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
” ছেলেটা রাগ করে বাসা থেকে চলে গেছে, এক সপ্তাহ ধরে বাসায় ফিরছে না। তার সাথে আপনার এই ব্যবহার টা না করলে হতো না? ”
আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” শুনো, সে কোম্পানির দায়িত্বে আছে মানে এই নয় যে আমি আমার নিয়ম নীতি থেকে সরে যাব। তোমার ছেলে অফিসে মেইল করেছে। কিন্তু সে হয়তো জানে না আমার অফিসে মেইলের মাধ্যমে নেয়া ছুটির পরিমাণ মাত্র তিনদিন৷ এর বেশি ছুটি লাগলে সশরীরে উপস্থিত থেকে আবেদন করে তারপর নিতে হয়। কিন্তু তোমার ছেলে সেই কাজ করে নি। তারপরও আমি আরও তিনদিন ছাড় দিলাম। কিন্তু সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে যে প্রজেক্টগুলো শুরু করেছে, সেগুলোর কি হবে? প্রজেক্ট নেয়ার সময় যেমন রাগ, জেদের কথা মনে ছিল না, প্রজেক্ট শেষ করার ক্ষেত্রে আমিও এখন তার রাগ, জেদকে প্রাধান্য দিতে পারবো না। ”
“সারাজীবন শুধু ব্যবসা আর নিয়মনীতি ই করলেন। কখনো ছেলেটার সাথে একা বসে পাঁচ মিনিট কথা বলেছেন? ছেলেটা কি চায় না চায় জানতে চেয়েছেন?”
আলী আহমদ খান ভ্রু কুঁচকে শীতল চোখে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে বললেন,
“তুমি তো মা। তোমার কাছে কখনো কিছু চেয়েছে?”
মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“নাহ।”
“তাহলে বুঝো কেমন ছেলে তোমার।”
মালিহা খান হালকা রাগী স্বরে বললেন,
“আপনার জন্যই তো এমন হয়েছে।”
আলী আহমদ খান স্ব শব্দে হেসে বললেন,
” মন মতো কিছু হলেই আমার দোষ নাকি?”
মালিহা খান রেগেমেগে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছেন।খান বাড়ির মানুষদের মন বুঝা দুষ্কর, এই ভালো এই খারাপ। মালিহা খান আবিরের পছন্দ মতো খাবার রান্না করতে ব্যস্ত। মেঘ সোফায় বসে আছে, সামনে টিভি চলছে তবে মেঘের নজর মেইন গেইটে। অনেকক্ষণ পর আবির বাসায় আসছে। আবিরকে দেখেই মেঘ টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। মালিহা খান রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসছেন। আবির আম্মুর সাথে কথা বলার ফাঁকে মেঘকেও এক পলক দেখে নিলো। মেঘও নিরেট দৃষ্টিতে আবিরকে পরখ করছে৷ এই এক সপ্তাহেই আবিরের মুখটা শুকিয়ে গেছে, চোখগুলো ফুলা ফুলা। আবির বেশি কথা না বলেই ফ্রেশ হতে উপরে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে আলী আহমদ খান ডাকলেন, আবির নিচে আসতেই আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় গিয়েছিলে?”
” কাছেই। ”
“কেনো?”
“কাজ ছিলো।”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন,
” নিজেকে কি মনে করো তুমি? ”
আবির মৃদু হেসে বলল,
“আপাতত আপনার অযোগ্য সন্তান। ”
“মজা করতেছো?”
আবির তপ্ত স্বরে বলল,
“সরি আব্বু,আপনার সাথে মজা করার মতো যোগ্যতা আমার নেই।”
” তা এই এক সপ্তাহে কি নিরীক্ষণ করলে?”
“নিজের আদতে লাগাম দেয়া। আমার ব্যবহারে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে অনুগ্রহ করে আমাকে মাফ করবেন৷ আর তিনটা প্রজেক্ট এর কাজ মোটামুটি শেষ, আগামী তিনদিনে সম্পূর্ণ কমপ্লিট হয়ে যাবে ”
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
” ভাইজান তোমার মাথা কি ঠিক আছে? ছেলেটা এক সপ্তাহ পরে বাসায় ফিরেছে। কোথায় আগে খাওয়া দাওয়া করাবে তা না ব্যবসা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছো৷ ”
মোজাম্মেল খান আবিরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন,
“তোমার আব্বুর কথায় কিছু মনে করো না। চলো, খাবে চলো। ”
আবির ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল,
“সরি চাচ্চু৷ সেদিন আপনার সাথে ঐরকম ব্যবহার করা আমার একদম ই উচিত হয় নি। প্লিজ কিছু মনে রাখবেন না। ”
“দূর বোকা ছেলে। তুমি আমার সন্তান সমতুল্য। সন্তানরা ভুল করবে এটায় স্বাভাবিক। যা হয়েছে সব ভুলে যাও। চলো খাবে এসো।”
মেঘ আর মীম ড্রয়িং রুমের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে সব দেখছে৷ তানভির বাসায় নেই, ফিরতে একটু দেরি হবে বলেছে। ইকবাল খান দুদিন হলো সিলেট গেছেন। আদিও ঘুমিয়ে পরেছে। খাবার টেবিলে এখন আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান, আবির, মীম আর মেঘ। মেঘ আবিরের বিপরীতে বসায় স্বাভাবিক ভাবেই বার বার আবিরের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আবির প্রতিবার নিজের নজর সরিয়ে নিচ্ছে। আবিরের কর্মকাণ্ডে মেঘ একদিকে যেমন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে আব্বুর আচরণে বেশ অবাকও হচ্ছে। আলী আহমদ খান আজ অল্প বিস্তর রাগ দেখালেও মোজাম্মেল খান একবারের জন্য মুখ কালো করেও কথা বলেন নি৷ মেঘ খাবার শেষ করে এক মুহুর্ত দেরি না করেই নিজের রুমে চলে গেছে। বন্যাকে কল দিয়ে আবিরের ফেরার কথা বলেছে তারপর ফোন রেখে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। আচমকা পেছন থেকে আবির ডাকলো,
“ম্যাম”
মেঘ আঁতকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তবে কিছুই বললো না। আবির আবারও বলল,
” নিজেকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আপনার আর কোনো কাজ নেই তাই না?”
মেঘ আড়চোখে আবিরকে খানিক দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” নাহ।”
আবির মলিন কন্ঠে বলল,
” ভালো।”
মেঘ নিরেট কন্ঠে বলতে শুরু করল,
” বাসা থেকে চলে যাওয়ার আগে কেউ কি একবারের জন্য আমার কথা ভেবেছিল? আর যাওয়ার পরও একটা বারের জন্য কল দিয়ে নিজের অবস্থা জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না৷ এত নিষ্ঠুর কিভাবে হয় মানুষ? ”
আবির তপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন? ”
“বেঁচে আছি।”
আবির মলিন হেসে বলল,
” ঠিক আছে। ”
আবির চলে যেতে নিলেই মেঘ আবারও ডাকলো,
“আবির ভাই”
আবিরের চিরচেনা জবাব,
“হুমম।”
তবে আজ উত্তরে তেমন প্রাণ নেই। মেঘ ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কোথায় ছিলেন?”
“ছিলাম কোনো এক জায়গায়। ”
মেঘ হঠাৎ ই ভেঁজা কন্ঠে বলে উঠল,
“এক সপ্তাহ নিখোঁজ হয়ে কিভাবে ছিলেন আপনি ? আমি আপনাকে কতশত বার কল দিয়েছি। আর একটু হলে ম*রেই যেতাম। ”
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬০
আবির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনমরা হয়ে বলল,
” এক সপ্তাহে ই এত ক্লান্ত হয়ে পরেছেন? মনে জোর না থাকলে সামনের ঝড়টা কিভাবে সামলাবেন, ম্যাম?”