আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬২

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬২
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবিরের কথা শুনে মেঘের কোমলপ্রাণ হৃদয় মুষড়ে উঠলো, সহসা উদাস চোখে তাকালো আবিরের পরিশ্রান্ত ধৃষ্টতায়। আবিরের দুচোখ বন্ধ, ব্যর্থতার গ্লানি মুখে ফুটে উঠেছে। কোনো এক অজ্ঞাত ক্লেশে আবিরের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। মেঘ রাশভারি কন্ঠে বিড়বিড় করল,

“আপনি পাশে থাকলে আমি সব ঝড় নিরবে সয়ে যাব।”
আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ খুললো। একপলক মেঘের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
“নগর জুড়ে বৃষ্টি নামুক, আমায় সুরে ভাসিয়ে ফেলুক। তবুও সহিষ্ণুতায় তোকে পরিপূর্ণ রাখুক।”
আবির মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। মেঘ মুখ ভার করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সময় যত এগুচ্ছে পরিস্থিতি ততই বেসামাল হচ্ছে। মনের আড়ালে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো বি*ষা*ক্ত হতে শুরু করেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে, আবিরের ভাব-গতিকে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। বাসায় ফেরার পর থেকে আবির একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আব্বু, চাচ্চুদের সাথে কোনো প্রকার কথা বলে না। এমনকি ঠিকমতো বাসায়ও ফিরে না। তিনটা প্রজেক্ট শেষ হয়েছে বাকি দুটার কাজ একা হাতে সামলাচ্ছে। কখনো রাত ২-৩ টায় বাসায় ফিরে কখনো বা ফিরেও না। মেঘ দিনে কয়েকবার করে কল দিয়ে আবিরের খোঁজ নেয় তবে ইদানীং আবির মেঘের সাথেও তেমন কথা বলে না। সবসময় দায়সারা ভাব নিয়ে কথা বলে। মেঘ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু উত্তর দেয়, নিজ থেকে কিছুই বলে না৷ মেঘও কিছুদিন যাবৎ বিষয়টা খেয়াল করছে। আবিরকে জিজ্ঞেসও করেছে কিন্তু আশানুরূপ কোনো উত্তর পায় নি। আবিরের নিস্তব্ধতা আর সহ্য করতে পারছে না মেয়েটা । মোজাম্মেল খানও ইদানীং আবিরের সাথে বেশ শান্ত স্বরে কথা বলেন। কিন্তু আলী আহমদ খানের মনে আবিরের প্রতি ক্ষোভের অন্ত নেই।
আজ সকালে খাবার টেবিলে সবার উপস্থিতিতে আলী আহমদ খান আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

” তোমার যে আগামীকাল ফ্লাইট এটা কি সবাই জানে?”
বড় আব্বুর মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে মেঘ অতর্কিতে
চোখ বড় করে তাকালো। আবির এক নজর মেঘকে দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
“নাহ। বলা হয় নি এখনও।”
মালিহা খান কথাটা শুনামাত্রই রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিসের ফ্লাইট? ”

আলী আহমদ খান মেকি স্বরে বললেন,
“কেনো তোমার আদরের ছেলে তোমাকে কিছু জানায় নি?”
মালিহা খান ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“আবির, কিছু বলছিস না কেনো?”
আবির মাথা নিচু করে গাম্ভীর্যের স্বরে জবাব দিল,
” একটা প্রজেক্টের কাজে কয়েকমাসের জন্য দেশের বাহিরে যেতে হবে।”

অপ্রত্যাশিত বাক্য কর্ণকুহরে প্রবৃত্ত হওয়া মাত্রই মেঘের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আঁখি যুগল পূর্বের তুলনায় আরও বেশি প্রশস্ত হয়ে গেছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়েছে৷ মনে হচ্ছে, মেঘের হৃদয়ের উষ্ণ অনুভূতিরা মেঘের গলা চেপে ধরেছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। বুকের ভেতরের তোলপাড় চোখে মুখে ফোটে উঠতে বেশি সময় লাগলো না। মেঘের দৃষ্টি নিরেট, চোখে নেই কোনো লুকোচুরি, ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে। দৃষ্টি জুড়ে আহাজারি, দুচোখ ছলছল করছে। মালিহা খান আর্তনাদ করে উঠলেন,
” পড়াশোনার নাম করে ৭ টা বছর দূরে ছিলি কিচ্ছু বলি নি আমি। আর সহ্য করতে পারবো না, কোথাও যাবি না তুই।”

মালিহা খান আলী আহমদ খানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
” আপনারা কি শুরু করেছেন? ব্যবসার নাম করে প্রতিনিয়ত আমার ছেলেটার সাথে যা তা আচরণ করছেন। আমার ছেলে কোথাও যাবে না। টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই, আমি চাই আমার ছেলে আমার চোখের সামনে থাকুক।”
আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” আমি তোমার ছেলেকে জোর করি নি, তোমার ছেলে নিজে বুঝে শুনে প্রজেক্ট নিয়েছে। তাছাড়া এই সিদ্ধান্ত আরও ৪-৫ মাস আগেই নেয়া হয়েছে। তোমার ছেলে বাসায় কাউকে বলতে বারণ করেছিলো তাই বলি নি। আগামীকাল ফ্লাইট এজন্য বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। ”

মালিহা খান রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
” তোর আব্বু কি বলছে আবির? ”
আবির মায়ের হাতে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,
” মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার আম্মু। এবার তোমার অপেক্ষা দীর্ঘ হবে না,কথা দিচ্ছি।”
আবিরের ভেজা কন্ঠের কথা শুনেও মালিহা খান নিজেকে সামলে নিতে পারলেন না৷ কান্নারত কন্ঠে বললেন,
” তোদের যা ইচ্ছে কর। আমি আর কিছুই বলবো না। ”

মালিহা খান নিজের রুমে চলে গেছেন। হালিমা খান আর আকলিমা খানও সেদিকেই ছুটলেন। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে মালিহা খানের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে অথচ মেঘের নজর আবিরের অভিমুখে। আশপাশের ভ্যাপসা গরমে মেঘের শরীর ঘেমে যাচ্ছে তবুও ভাতের প্লেটে হাত রেখে নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে। আবির মেঘকে দেখে সেকেন্ডের মধ্যে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। গত এক সপ্তাহ যাবৎ আবির মেঘের চোখে চোখ রাখে না, সামনাসামনি দেখা হলেও মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

তাছাড়া যথাসম্ভব বাসা থেকে দূরেই থেকেছে। আজও আবির সেই চোখে তাকাতে পারছে না। ঐ দুচোখে তাকালেই আবির বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। যখন থেকে প্রজেক্ট বিষয়ে কথা হয়েছে তখন থেকেই আবির মেঘকে অল্প বিস্তর বুঝাতে শুরু করেছে। সরাসরি না বললেও কৌশলে অনেকবার ই বুঝিয়েছে। যেই মিনহাজের প্রতি আবিরের এক রাশ আক্রোশ ছিল, যারা মেঘের আশেপাশে ভিড়লেও আবিরের মেজাজ গরম হয়ে যেতো সেই মিনহাজদের সাথে জোরপূর্বক মেঘের সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করেছে। যাতে আবিরের অবর্তমানে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে না হয়। মেঘকে সর্বক্ষণ সহিষ্ণু আর ধৈর্যের কথায় বলে এসেছে।
আলী আহমদ খান হঠাৎ ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস কেন,

” আবির, তুমি কি কোনো বিষয়ে কিছু বলতে চাও?”
আবির সটান দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে জবাব দিল,
” নাহ, আমার কিছুই বলার নেই। ”
আবির বেসিন থেকে হাত ধৌয়ে সরাসরি আম্মুর রুমে চলে গেছে। একে একে সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে অথচ মেঘ তখনও থম মেরে বসে আছে। মেঘের নিরবতায় চারপাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। তানভির এক পলক মেঘকে দখে কিছু না বলেই উঠে গেছে। মীম দু-তিন বার মেঘকে ডেকেছে কিন্তু মেঘ পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। এতক্ষণ যাবৎ বুকের ভেতরে যে তোলপাড় চলছিল এখন তার ছিটেফোঁটাও বাহিরে প্রকাশ পাচ্ছে না। ছলছল করা দু চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, গলায় আঁটকে যাওয়া নিঃশ্বাসটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে গেছে।

আবির, আলী আহমদ খানরা সবাই অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে সেই যে দেয়াল ঘেঁষে বেলকনিতে বসেছিল সারাদিনে এক ইঞ্চিও নড়ে নি৷ সূর্যের প্রখর উত্তাপ নিরবে সহ্য করে নিয়েছে আর মনে মনে আবিরের কথা ভাবছে। আবির বলেছিল, “কাউকে অনেক বেশি সহিষ্ণু হতে হবে।” মেঘ সেদিনই কোনো এক ঝড়ের আশঙ্কা করেছিল তবে সেই ঝড় টা যে তাকে প্রস্তরে পরিণত করে ফেলবে সেটা বুঝতে পারে নি। মেঘের ফোনে একের পর এক কল বাজতেছে, মীম কিছুক্ষণ পর পর দরজায় এসে ডাকছে কিন্তু মেঘ বেলকনি থেকে একবারের জন্যও উঠছে না।

সরাসরি রোদের প্রখরতা কখনই সহ্য করতে পারে না মেয়েটা, অল্পতেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় অথচ আজ দিব্যি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছে৷ মাথা ব্যথা অনুভব করার মতো শক্তি পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই দেখলো আবিরের নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল আসছে। অন্য সময় আবিরের নাম্বার থেকে একটা কল আসলেই আনন্দে মেঘের মন নেচে উঠতো অথচ আজ এতগুলো কল আসার পরও চোখে কোনো উজ্জ্বলতা নেই, শুকনো ঠোঁটে হাসির রেশ মাত্র নেই৷ কান্নায় মেঘের বুক ভেঙে আসছে তবুও কাঁদতে পারছে না। এমন সময় আবির আবারও কল দিয়েছে। মেঘ কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আবিরের হুঙ্কার আসলো,
” তুই কি আমাকে বাঁচতে দিবি না?”

আবিরের এমন হুঙ্কারে মেঘ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। দীর্ঘসময় নিশ্চুপ থাকায় মেঘের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। আবির গম্ভীর কণ্ঠে আবারও বলল,
” আমি মা*রা গেলে শান্তি পাবি?”
মেঘ গলা খাঁকারি দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,
” বাজে কথা বলবেন না, প্লিজ। ”
আবির নিচু স্বরে বলল,
“এতগুলো কল দিলাম একবারের জন্য রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করলি না। এটা কি ঠিক?”
মেঘ আমতা আমতা করে বলল,

” ফোনের কাছে ছিলাম না। ”
“কোথায় ছিলি?”
মেঘ নিশ্চুপ। আবির কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারও প্রশ্ন করলো,
” দুপুরে খেয়েছিস?”
“নাহ।”
আবির শক্ত কন্ঠে বলল,

” তোকে ১ ঘন্টা সময় দিচ্ছি এরমধ্যে যাবতীয় কাজ শেষ করে একেবারে রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হবি। আমার যেন অপেক্ষা করতে না হয়।”
মেঘ ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আমি বের হবো না।”
আবির খানিকটা রাগী স্বরে বলে উঠল,
” আমি সিদ্ধান্ত চাই নি মেঘ, তোকে এক ঘন্টার মধ্যে আমার সামনে দেখছে চাইছি।”

মেঘ আর কিছুই বলতে পারলো না। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক ঘন্টার আগেই বাসা থেকে বেড়িয়ে রিক্সায় করে রওনা দিল। বাসায় একমাত্র মীম কে বলে বেড়িয়েছে। মালিহা খান সারাদিন কান্নাকাটি করে ঘুমিয়েছেন, হালিমা খান সেখানেই বসে আছেন। আকলিমা খান আদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমিয়েছেন। মেঘ কিছুটা সামনে এগুতেই আবিরকে দেখলো। মেঘকে দেখেই আবির জিজ্ঞেস করল,
” খেয়ে আসছিস?”

মেঘ উপর নিচ মাথা নাড়ালো। পশ্চিমা আকাশ সূর্যের রক্তিম আভায় ছেঁয়ে আছে, আবির যথারীতি মেঘের পাশে রিক্সাতে বসলো। ব্যস্ততম শহরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার কোনো স্থান নেই। উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে রিক্সা চলছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছুটা নির্জন জায়গায় আবির রিক্সা থামাতে বলল। রিক্সা থেকে নেমে দু’জনেই হাঁটতে শুরু করলো।মেঘের চিবুক নামানো৷ কিছুটা এগুতেই আবির খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
” সবাই শুনলে কষ্ট পেতো তাই আমি আগে কাউকে কিছু বলি নি। কিন্তু আমার এখন যাওয়াটা খুব প্রয়োজন। আশা করি তুই অন্ততপক্ষে বুঝবি।”

মেঘ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু স্বরে বলল,
” প্রয়োজন হলে অবশ্যই যাবেন। ”
আবির ভ্রু কুঁচকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
“তুই কি এখনও রেগে আছিস?”
মেঘ হালকা হেসে বলল,
“নাহ। ”

সামনাসামনি দুটা চেয়ারে দুজন বসেছে, দুকাপ চাও অর্ডার করেছে। আবিরের চোখ মাটিতে স্থির হয়ে আছে। মেঘের চোখের দিকে এক সেকেন্ডের জন্যও তাকাতে পারছে না। মেঘ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার কি শরীর খারাপ? ”
আবির চোখ মুখ মুছে ঠিক করে বসলো। ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে কাঁধ উঁচিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
” চল উঠি৷ ”

আবিরের অস্বস্তি বুঝতে পেরে মেঘ আর কিছু বলল না। কাপে তখনও অর্ধেক চা আছে, সেভাবেই কাপ রেখে দিয়েছে৷ মেঘের মন ভালো করতে বাসা থেকে বের করে এনেছিলো আবির অথচ বুকের ভেতরের হাহাকারে নিজেই অস্বস্তিতে পরে গেছে। সময় নষ্ট না করে মেঘকে নিয়ে সরাসরি শপিং করতে গেল। বেশ কয়েকটা শপ ঘুরে মেঘের জন্য একটা স্মার্ট ওয়াচ নিয়েছে। ফোনের সাথে কানেক্ট করে মেঘের হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে গুরুভার কন্ঠে বলল,
“আজকের পর থেকে ঘুম আর গোসল ব্যতীত সর্বক্ষণ এটা পড়ে রাখবি৷ তোর অবহেলায় আমার একটা কল যদি মিস হয় তারপর বুঝাবো।”

মেঘ নীরবে চোখ তুলে তাকাতেই আবিরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। অতর্কিতেই আবির নিজের চোখ নামিয়ে নিয়েছে। মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
” ওখানে গেলে কি আপনার আমার কথা মনে থাকবে?”
আবির চটজলদি বলে উঠল,
“মনে থাকবে না কেনো?”
মেঘ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো,
” বাসায় যাব না?”
আবির ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” কেবল আজকের রাতটায়, কাল থেকে হুটহাট জোর করার মতো কেউ থাকবে না৷ তুই তোর মতো থাকতে পারবি। ”

মেঘ চোখ গোল গোল করে তাকালো ততক্ষণে আবির সামনে চলে গেছে, মেঘও পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলো৷ টুকিটাকি কেনাকাটা শেষে বেড়িয়েছে। আজ কারো মুখেই তেমন কোনো কথা নেই। অনেকটা সামনে এগুতেই দেখলো মেলা চলছে। সন্ধ্যার পর পর রাস্তায় বেশ ভিড় জমেছে। আবির মেঘের ডানহাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মেঘ উদাস ভঙ্গিতে আশপাশের মানুষজন দেখছে, কত কত কাপল ম্যাচিং শাড়ি পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরছে, একসঙ্গে বসে খাচ্ছে। এসব দেখে মেঘের বুক খুঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। আচমকা তাকালো হাতের দিকে। নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে বলল,

” নিয়তির নির্দয়তার নিমিত্তে এই মানুষটা
আমার হয়েও আমার নয়।”
মেঘের আনমনে আশপাশে তাকানো দেখে আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” মেলায় যাবি?”
মেঘ ডানে বামে মাথা নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখেও বলল,
“যাব না।”

আবির মৃদু হেসে সামনে থেকে দুটা টিকিট কেটে মেঘকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। আবির অতি সন্তপর্ণে মেঘকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বাসায় এত এত কাঁচের চুড়ি থাকা স্বত্তেও মেঘ একটা দোকানে দাঁড়িয়ে নতুন ডিজাইনের কাঁচের চুড়ি দেখছে। মেঘের চুড়ির প্রতি কৌতূহল দেখে আবির খুব যত্ন সহকারে চুড়ির ভেতর তিন আঙুল ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে সুন্দর ডিজাইনের তিনসেট চুড়ি মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এগুলো দেখ।”
মেঘের হাতে অলরেডি সেইম ডিজাইনের এক সেট চুড়ি। আবির সেটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে বলল,
“এগুলো তোর হাতে বড় হবে। ঐগুলো পড়।”
মেঘ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
“কে বলছে বড় হবে? এগুলো ঠিকঠাক মতো লাগবে।”
আবির মলিন হেসে বলল,
” ওয়েট। ”

আবির দুই সেট চুড়ি খুলে আলতোভাবে মেঘের দু’হাতে পড়িয়ে দিচ্ছে। বড় চুড়িগুলো ডানহাতে পড়িয়েছে। মেঘ অপলক দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির চুড়ি আগে গিফট করলেও এই প্রথমবার নিজের হাতে পড়িয়ে দিচ্ছে। চুড়ি পড়ানো শেষে মেঘ দুহাত নাড়িয়ে দেখতে লাগলো। আবিরের দেয়া চুড়ির সেট খুব সুন্দর মতো লেগেছে অন্যটা একটু বড় হওয়ায় মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাবে। মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

” আমার হাতে ঐ চুড়িটায় লাগবে এটা আপনি কিভাবে বুঝছেন?”
আবির দুচোখ ছোট করে হাসল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আশপাশে তাকিয়ে মেকি স্বরে বলল,
” থাক, এখানে কিছু না বলি। ”
আবিরের মুখে দুষ্টু হাসি দেখেই মেঘ ভ্রু কুঁচকালো। সঙ্গে সঙ্গে তাকালো দোকানের ছেলেটার দিকে, ছেলেটাও কেমন করে হাসছে। বিরক্তিতে মেঘ বলল,

“চলুন এখান থেকে।”
“আর কিছু নিবি না?”
“এই দোকান থেকে নিব না।”
ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ করে বলল,
” সরি ভাবি, আমি আর হাসবো না। আপনার যা পছন্দ হয় নিন।”
অপরিচিত এক ছেলের মুখে ভাবি ডাক শুনে মেঘ অপ্রত্যাশিতভাবে তাকালো, পরপর চোখ তুলে তাকালো আবিরের মুখের পানে। আবিরের ঠোঁটে তখনও হাসি লেগেই আছে। মেঘ এক মুহুর্তের জন্য আবিরের যাওয়ার ঘটনা বেমালুম ভুলে গেল। আবিরের হাস্যোজ্জ্বল মুখের পানে তাকিয়ে নিজেও হাসলো তারপর আদুরে ভঙ্গিতে শুধালো,

“আর কি নিবো?”
আবির ওষ্ঠ যুগল আরও প্রশস্ত করে বলল,
” হায়রে মেয়ে মানুষ! এক সেকেন্ডেই সব ক্রোধ গায়েব।”
মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ঠিক আছে। চলে যাচ্ছি। ”
আবির সঙ্গে সঙ্গে মেঘের বাহু চেপে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” এই নাহ। তোর যা ভালো লাগে সব নিতে পারিস। ”
আবিরের হাতে থাকা মেঘের বাহু দুই আঙুলে পরখ করে মেঘের হাতটা উপরে তুলে মেঘকে দেখিয়ে আবির অকস্মাৎ শক্ত কন্ঠে বলল,

” এখন যেমন রেখে যাচ্ছি ফিরে এসে যেন তেমনই পায়। এক ইঞ্চি এদিক-সেদিক হলে সোজা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসবো।”
মেঘ ওষ্ঠ উল্টে বিড়বিড় করে বলল,
“কেনো?”
আবির নিরেট কন্ঠে বলল,
” আমার বাড়িতে কোনো কংকালের জায়গা হবে না। ”
মেঘ মুখ ফুলিয়ে আবিরের দিকে চেয়ে আছে। আবির দোকান থেকে দুটা টিকলি হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে একটা মেঘের কপালে ধরে মৃদু হেসে বলল,
“এটা একদম ঠিকঠাক। ”

বেশ কয়েকটা আংটিও দেখে নিল। মেঘের আঙুলে পড়িয়ে পড়িয়ে দেখছে। মেঘ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের কর্মকাণ্ড দেখছে। আবির খুব যত্ন নিয়ে প্রতিটা জিনিস পর্যবেক্ষণ করছে। একটা মেয়ের জীবনে এর থেকে বেশি চাওয়া বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না। স্বর্ণ কিংবা হীরার চেয়েও অধিক মূল্যবান প্রিয় মানুষের থেকে প্রাপ্ত সময়, তার মনোযোগ আর ভালোবাসা। মেলা থেকে কেনা প্রতিটা জিনিসের মূল্য অতি নগন্য অথচ মেঘের কাছে সেগুলোই খুব মূল্যবান। মেঘের জন্য কেনাকাটা শেষ করে, মীম আর আদির জন্যও মেলা থেকে কিছু কিছু জিনিস নিয়েছে। মেলা থেকে বেড়িয়ে দু’জন আবারও হাঁটতে শুরু করলো। এরমধ্যে তানভিরকে কল দিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলেছে। ভিড় ঠেলে আবির মেঘের হাত ধরে হাঁটছে, আবির অবশ্য রিক্সা নিতে চেয়েছিল কিন্তু মেঘের আবিরের সঙ্গে হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছিল তাই রিক্সায় উঠে নি। এইযে আবির মেঘের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে এতেই মেঘের বিষাদে ঢাকা মন ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু রিক্সায় উঠলে আবারও সেই কোমল মনে বিষাদ ভরে যাবে তাই সে কোনোভাবেই রিক্সায় উঠবে না। আবির আর মেঘ একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। মেঘকে একটা টেবিল দেখিয়ে আবির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,

“তুই একটু বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আবির চলে যেতেই তিনটা মেয়ে মেঘের সামনে হাজির হলো। মেয়েগুলো দেখতে মাশাআল্লাহ বেশ সুন্দরী আবার সাজুগুজুও করেছে তবে বয়সে মেঘের থেকে অনেক বড় হবে। মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তিনটা মেয়ের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
” তোমার পাশে ছেলেটা আবির ছিল না?”
মেঘ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরেট কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ। কেনো?”
আরেকটা মেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি বুঝি আবিরের গার্লফ্রেন্ড? ”
মেঘ ঢোক গিলল। আবিরের প্রতি মেঘের তীব্র প্রেমানুভূতি সেই সাথে আবিরের যত্নে দুজনের সুপ্ত প্রেমের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই। আবির মুখ ফুটে এখনও কিছু না বললেও মেঘ মেয়েগুলোর সামনে শান্ত স্বরে বলল,
“জ্বি।”

মেয়ে গুলো একজন আরেকজকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“বলছিলাম না গার্লফ্রেন্ড৷ দেখলি তো?”
মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“আপনারা কারা? আর আবির ভাইকে কিভাবে চিনেন?”
একটা মেয়ে কপাল গুটিয়ে বলল,
” আবিরকে ভাই ডাকছো কেনো? বয়ফ্রেন্ড কে কেউ ভাই ডাকে?”
মেঘ চিবুক নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“ওনি আমার চাচাতো ভাই। কিন্তু আপনারা কারা?”
এবার মেয়েগুলোর ধাক্কাধাক্কি বেড়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন মিষ্টি করে হেসে বলল,

” ওহ আচ্ছা। তুমিই তবে সে যার জন্য আবির কলেজে কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখে নি? বাড়িতে পরী থাকলে বাহিরে পেত্নী দেখার তো প্রশ্নই আসে না।”
মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আরেকটা মেয়ে বলে উঠল,
“আমরা তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একই কলেজে পড়তাম। আজ এতবছর পর হঠাৎ মেলার মধ্যে আবিরকে দেখলাম তারপাশে তুমি ছিলে। আবিরের যত্ন দেখেই সন্দেহ করেছিলাম তুমি নিশ্চয় আবিরের প্রেমিকা হবে। তাই সিউর হতে তোমাদের ফলো করে এখান পর্যন্ত এসেছি। বাই দ্য ওয়ে, তুমি খুব লাকি যে আবিরের মতো একজন মানুষ পেয়েছো।”

আরেকটা মেয়ে চাপা স্বরে বলল,
“যত্নে রেখো আমার অতীতের ক্রাশকে।”
মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” জ্বি ইনশাআল্লাহ। আপনারা দোয়া করবেন।”
“ফি আমানিল্লাহ। এখন আসি।”
মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“চলে যাবেন কেনো? ওনি এখনি চলে আসবে, বসুন আপনারা। আমাদের সাথে ডিনার করুন।”
মেয়েগুলো উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“আবির যদি এসে আমাদের এখানে দেখে নিশ্চিত ভাবতে তোমার কাছে উল্টাপাল্টা কথা লাগাচ্ছি। থাক তোমরা আনন্দ করো,আসি।”

পাশের মেয়েটা আবারও বিড়বিড় করে বলল,
” ক্রাশের প্রেমিকাকে দেখেই পেট ভরে গেছে। আজ রাতে কিছু না খেলেও চলবে। ”
যেতে যেতে পাশের জন ধমক দিল,
” মুখ টা বন্ধ রাখ তোর, মেয়েটা কি ভাবছে কে জানে।”
মেয়েগুলো রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে আবির হাত মুখ ধৌয়ে চলে আসছে। টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ তখনও সেদিকে তাকিয়ে আনমনে হাসছে। আবির পেছনে ঘুরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে?এভাবে হাসছিস কেনো?পরিচিত কেউ আসছিলো?”
মেঘ হেলান দিয়ে বসে আবিরের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড আসছিলো।”
আবির কপালে কয়েক স্তর ভাঁজ ফেলে প্রখর তপ্ত স্বরে শুধালো,
“আমার গার্লফ্রেন্ড মানে?”
মেঘ হেসে আবারও বলল,
“আহারে মেয়েটা আপনাকে কত ভালো..”

বলতেই আবিরের চোখে চোখ পরলো। আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে শাণিত কন্ঠে বলল,
” আজেবাজে কথা একদম বলবি না।”
এমন সময় তানভির এসে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“সমস্যা কি তোমার? আমার বনুটাকে বকা দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার? ”
আবির মুখে পূর্বের মতো গাম্ভীর্যতা রেখে আবারও বলল,
” আমাকে বলছিস কেন, তোর বোনকে জিজ্ঞেস কর।”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কি হয়েছে বনু?”
মেঘ সাফাই দেয়ার স্বরে বলল,
” এক মেয়ে বলছে আবির ভাই নাকি তার ক্রাশ ছিল তাই আমি মজা করছিলাম।”
তানভির সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কোনটা আসছিলো?”
মেঘ চোখ বড় করে বিস্ময় সমেত তাকিয়ে বলল,
“কোনটা মানে? কয়জনের ক্রাশ ওনি?”
আবির অকস্মাৎ টেবিলের নিচে তানভিরের পায়ে পা চেপে ধরে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। তানভির মজার ছলে বলল,
“আসলে ভাইয়াকে তো অনেক মেয়েই পছন্দ করে কিন্তু ভাইয়া কাউকে পাত্তা দেয় না। ”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, জানি। ”

আবির আর তানভির দুজনেই মেঘের দিকে সূক্ষ্ণ নেত্রে তাকিয়ে আছে। কোন মেয়ে আসছিল, কি বলছে এসব ভেবেই দুই ভাই আঁতকে উঠছে। তানভিরের সাথে ইদানীং সম্পর্ক ভালো হওয়ায় মেঘ অনেক কথায় তানভিরের সামনে বলে দেয় কিন্তু তাই বলে এই না যে প্রেমিকের এক্স ফ্যানের কথাও অতর্কিতে ভাইয়ের সামনে বলতে থাকবে। তিনজন একসাথে খাওয়াদাওয়া করে বেড়িয়েছে। আবির তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই ও কে নিয়ে বাসায় যা।”
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি বাসায় যাবেন না?”
তানভির মিটিমিটি হেসে বাইক স্টার্ট দিতে চলে গেছে। আবির মলিন হেসে বলল,
“রাকিবদের সাথে দেখা করে বাসায় ফিরবো।”
মেঘ আস্তে করে বলল,

“তাড়াতাড়ি ফিরবেন।”
মেঘ বাসার মেইন গেইট পার হতেই সবাই এক দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে তানভির এসে বলল,
“কিরে বনু, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তুই না মীম আর আদির জন্য জিনিস কিনলি। ওদের দে।”
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে আদিকে নিয়ে মীমের রুমে চলে গেছে। আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

তানভির তড়িৎ বেগে জবাব দিল,
” মেলা হইতেছে তাই বনুকে নিয়ে মেলায় গিয়েছিলাম।”
মোজাম্মেল খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” তোমরা দুই ভাইবোন একসঙ্গে বের হতে না বারণ করেছিলাম”
তানভির ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” মনে ছিল না, এরপর থেকে বনুকে রিক্সায় পাঠিয়ে আমি বাইকে আসবো। তাহলে হবে তো?”
আলী আহমদ খান হেসে বললেন,

” বোনকে একা নিয়ে গেলে। মীম আর আদিকে নিলে না কেনো?”
তানভির মেকি স্বরে বলল,
” তিনজনকে একা সামলানো সম্ভব না। পরবর্তীতে বাসার সবাই মিলে একদিন যাব।”
আলী আহমদ খান আবারও প্রশ্ন করলেন,
“আবির কোথায়?”
তানভিরের স্বাভাবিক জবাব,
“রাকিব ভাইয়াদের সাথে অফিসিয়াল মিটিং করছে। ”
মোজাম্মেল খান ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” অফিসিয়াল মিটিং। ”
তানভির রাশভারি কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া চলে গেলে সম্পূর্ণ দায়িত্ব তো রাকিব ভাইয়া আর রাসেল ভাইয়াকেই নিতে হবে। তারজন্য মিটিং প্রয়োজন না?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই প্রয়োজন। বাসায় কখন ফিরবে?”
“মিটিং শেষ হলে।”
“ঠিক আছে তুমি রুমে যাও।”
তানভির স্বাভাবিক ভাবেই রুমে চলে গেছে। মীমদের জিনিস পত্র দিয়ে মেঘ নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে চুল খুলে মাথায় টিকলি, নতুন কেনা বড় বড় ঝুমকা, হাত ভর্তি চুড়ি, কোমরে বিছা পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। আজকের পড়া প্রতিটা জিনিস ই আবির ভাইয়ের পছন্দ করে কেনা। মেঘ একবার ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিচ্ছে আবার ঘোমটা তুলে নিজের লাজুক মুখখানা দেখছে৷ আচমকা মেঘের মনে বিষাদের ছায়া নেমে আসলো, মনে পড়ে গেল আবির ভাইয়ের চলে যাওয়ার কথা।

ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সব খুলে ফেলেছে, চুলে হাত খোঁপা করে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে পরেছে। মনে মনে ভাবছে ছোট থেকে ফেলে আসা সব স্মৃতি। অকস্মাৎ মেঘের মনে পড়লো, আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগের কথা যখন প্রথমবারের মতো আবিরের দেশ ছাড়ার কথা হচ্ছিলো। আবির আকুল কন্ঠে বার বার মেঘকে জিজ্ঞেস করেছিল,
” তুই কি চাস আমি তোকে ছেড়ে চলে যাই? প্লিজ মেঘ, তুই একবার বল যেতে হবে না। আমি সত্যি সত্যি যাব না। কিছু তো বল, প্লিজ।”

অথচ মেঘ সেদিন একবারের জন্যও মুখ খুলে নি। এমনকি আবিরের আকুল কন্ঠে বলা কথাগুলোর মানেও বুঝার চেষ্টা করে নি। তীব্র অভিমান বুকে জমিয়ে রেখেছিল, যার জন্য বাধ্য হয়ে সেদিন আবিরকে কাঁটা বেছানো পথকেই বেছে নিতে হয়েছিলো। তখন আবির বাড়ি ছাড়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল মেঘ অথচ আজ সম্পূর্ণ উল্টো। আজ সবচেয়ে বেশি কষ্ট মেঘ ই পাচ্ছে। মালিহা খানকে বুঝানোর পর ওনিই মেনে নিয়েছেন কিন্তু মেঘ কোনোকিছু বুঝার অবস্থাতেই নেই। আবিরের উপস্থিতি ছাড়া মাত্র ৭ দিনেই মেয়েটা আধমরা হয়ে গিয়েছিলো। সেখানে সাত সমুদ্র পার হয়ে আবির চলে যাবে এটা সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। ঘন্টা দুয়েক যাবৎ মেঘ এলোপাতাড়ি ভাবনায় মগ্ন। হঠাৎ ভাবনার মাঝে আগমন ঘটে আবিরের তিন বান্ধবী। যাদের মধ্যে একজন বলেছিল,

“তুমিই তবে সে যার জন্য আবির কলেজে কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখে নি? বাড়িতে পরী থাকলে বাহিরে পেত্নী দেখার তো প্রশ্নই আসে না।”
এটুকু মনে পড়তেই মেঘ অকস্মাৎ সোজা হয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে বিষয়টা সেভাবে ভেবে দেখে নি তবে এখন এটার মানে বেশ বুঝতে পারছে। মেঘ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল,
“তবে কি আবির ভাই আমাকে তখন থেকেই ভালোবাসতেন?”

মেঘের হৃৎস্পন্দন জোড়ালো হতে শুরু করেছে, আচমকা বুকের বা পাশে তীব্র শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। ৯ বছর যাবৎ আবির ভাইকে কত কষ্ট দিয়েছে সেসব ভেবেই মেঘের কলিজা কাঁপছে। যদিও মেঘ সিউর না এটা কেবল সন্দেহ তবুও মেঘ স্তব্ধ হয়ে গেছে। কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে দ্রুত রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে ছুটলো আবিরের রুমের দিকে। ততক্ষণে রাত গভীর হয়ে গেছে। ঘড়ির কাটা ১১-১২ টার ঘরে। আবিরের রুমের দরজা চাপানো তবুও ইতস্তততা ছাড়াই মেঘ দরজা ধাক্কা দিল। ছুটে গেলো রুমের ভেতর কিন্তু আবির রুমে নেই। রুমে লাগেজ সাথে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছানো দেখেই মেঘের বুকটা আবারও ছ্যাৎ করে উঠলো৷ রুমে ফোন দেখে সিউর হলো আবির বাসায় ই আছে। রুমে আবিরকে না পেয়ে সোজা ছুটলো ছাদের দিকে। ছাদের কার্নিশে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে আবির। দৃষ্টি আকাশের পানে।

মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে তাকালো আবিরের দিকে৷ আবিরের পেছন সাইড দেখেই মেঘ বুঝতে পেরেছে । বুকের ভেতরে আঁটকে থাকা সবটুকু নিঃশ্বাস ছেড়ে মেঘ আবারও ছুটলো। আবির গভীর মনোযোগ সহকারে অসীম আকাশে তাকিয়ে আছে। মেঘের নুপুরের শব্দ আবিরের কর্ণকুহরে প্রবেশের আগেই মেঘ পেছন থেকে আবিরকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আকস্মিক ঘটনায় আবির এক পা সামনে এগিয়ে ছাদের সাইডের দেয়ালে হাত চেপে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। মেঘের ছোট্ট ছোট্ট দুটা হাত আবিরের বুকের উপর। মেঘের অবাধ কান্নায় আবিরের পিঠের দিকে টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে। আবির এক হাতে নিজের দুচোখ মুছে মেঘকে খানিকটা ছাড়িয়ে সামনে ঘুরল। মেঘ এবার অতর্কিতে আবিরের প্রশস্ত বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে।

মেঘের গগন বিদায়ী কান্নায় প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে গেছে, ছাদে বয়ে যাওয়া হিমশীতল হাওয়াও থেমে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদে আলোকিত ছাদে আবির আর মেঘ ব্যতীত কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ধীরে ধীরে মেঘের কান্নার মাত্রা বেড়েই চলেছে। আবিরের গলা দিয়েও কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না, মেঘকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষাও খোঁজে পাচ্ছে না। কয়েক মুহুর্ত নিস্তব্ধ থেকে আবির আচমকা নিজের একহাত মেঘের কোমরের কিছুটা উপরে, আরেক হাতে পিঠ বরাবর রেখে মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবিরের স্পর্শ অনুভব করা মাত্র মেঘ আবিরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, জোরে শব্দ করে কাকুতি শুরু করেছে। এই প্রথমবার আবির মেঘকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে, প্রশস্ত হাতের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে তার প্রেয়সীকে আলিঙ্গন করেছে।

এর আগে যে কয়বার ধরেছে ততবারই আবির দূরে থেকেছে। তবে আজ দুজনের মাঝে এক ইঞ্চির দূরত্বও নেই, দুটা নিষ্কলুষ হৃদয়ের মানুষের কান্নাতেই একে অন্যের হৃদয়ের ক্লেশ উপলব্ধি করছে। আবির কিছুটা নিচু হয়ে মেঘের মাথার উপর আলতোভাবে নিজের গাল ছোঁয়াতেই আবিরের চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে এক ফোঁটা অশ্রু মেঘের কেশরাজ ভেদ করে ভেতরে চলে গেছে। কান্নার তোপে মেঘ সেই নোনাজল উপলব্ধিও করতে পারে নি। আবির সঙ্গোপনে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মেঘের মাথায় নিজের মাথা কাত করে রাখতেই মেঘ আবিরের প্রশস্ত বুকে নিজের মুখ চেপে ধরেছে৷ অকস্মাৎ মেঘের খোঁপার বাঁধন খুলে আবিরের দুহাত ঢেকে মেঘের ঘন কালো চুল পৌছে গেছে হাঁটুর উপর পর্যন্ত। আবিরের সুপ্ত অনুরাগের মতো কেশরাজরাও যেন লুকিয়ে ফেলেছে আবিরের ভালোবাসার বন্ধনকে। মেঘ আবিরের বুকের বা পাশে মাথা রেখে অবাঁধে কাঁদছে, আবির নিরবে মেঘের কান্নার গভীরতা মাপছে। প্রায় ৪৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে অথচ মেঘ থামছেই না। আবির বাধ্য হয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

” এবার একটু থাম, প্লিজ।”
মেঘ আরও কিছুক্ষণ কেঁদে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো তবে তখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। খানিক স্থির হওয়ায় আবিরের বুকের বাম প্রকোষ্ঠে থাকা হৃদপিণ্ডের প্রবল স্পন্দন অনুভব করছে যা বাহির থেকে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। মেঘের কান্না থেমে গেছে, দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলও থমকে গেছে। মেঘ ফোঁপানো কন্ঠে বলে উঠলো,

” আবির ভাই, আপনি ব্যতীত আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো। আমাকে ছেড়ে যাবেন না, প্লিজ। ”
আবির একহাতে মেঘের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” এই বিস্তৃত নক্ষত্রমন্ডলকে সাক্ষী রেখে আবির মেঘকে কথা দিচ্ছে, আজ থেকে ঠিক পাঁচ মাস পর মেঘ যা চাইবে, ঠিক যেভাবে চাইবে সেভাবেই পাবে। মেঘের কোনো ইচ্ছে আমি আবির অপূর্ণ রাখবো না, কথা দিলাম। শুধু একটু ধৈর্য রাখ, প্লিজ।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬১

মেঘ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি এর বেশি ধৈর্য রাখতে পারছি না, আবির ভাই। আমার মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না। ”
আবির সহসা মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠল,
” তোর কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না। ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৩