আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৪

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৪
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

মোজাম্মেল খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
“বাইক নিতে হবে না। তোমাকে আমি একটুও বিশ্বাস করি না। এক্সিডেন্ট করবা একা করো, আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু তোমার অসাবধানতার জন্য অন্য কারো হাত-পা ভা*ঙবে এসব আমি সহ্য করব না। গাড়ি নিয়ে যাও।”
মোজাম্মেল খানের কথা শুনে বন্যা না চাইতেও হেসে ফেলল। তানভির ভ্রু গুটিয়ে চাবি আনতে চলে গেছে। মোজাম্মেল খান বন্যার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন,

“তুমি কিছু মনে করো না, আমাদের বাবা ছেলের সম্পর্কটাই এমন। এখন কিছু না বললে ওর বেপরোয়া স্বভাব কখনো ঠিক হবে না।”
বন্যা মৃদু হেসে বলল,
“আমি কিছু মনে করি নি আংকেল।”
“ঠিক আছে। সময় করে মাঝে মাঝে বেড়াতে এসো।”
“জ্বি আচ্ছা আংকেল।”
বন্যা তানভিরের পিছন পিছন বাসা থেকে বেড়িয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“আমি গাড়িতে যাব না।”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বাইকে যাবে?”
“নাহ।”
“তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি রিক্সায় চলে যেতে পারবো আপনার যেতে হবে না।”
তানভির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব আর সেই দায়িত্ব টা স্বয়ং মোজাম্মেল খান আমাকে দিয়েছেন। ওনার কথা অমান্য করলে আমাকে বাসায় জায়গা দিবেন না। তুমি কি তাই চাও?”
বন্যা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল,
“না, আমার জন্য আপনার কোনো সমস্যা হোক তা আমি কখনোই চাইবো না। কিন্তু….”
“কোনো কিন্তু নেই। তুমি রিক্সায় যেতে চাইলে তাই যাব। চলো।”
“আংকেল যে গাড়ি নিতে বললো..”

“তোমার আংকেল নিশ্চয় এও বলছেন, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেপরোয়া স্বভাবের ছেলে। গাড়ি না নেয়ার অপরাধে না হয় ২-১ টা বকা খেয়ে নিবো।”
বন্যা আড়চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“সব বুঝেন তাহলে বেপরোয়া চলাফেরা কেনো করেন?”
তানভির উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আব্বুর মতো তোমারও কি তাই মনে হয়?”

তানভির সামনে চলে গেছে। বন্যা অবাক লোচনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কি বলবে তার উত্তর খোঁজে পেল না, খানিক বাদে মেইনগেইটের দিকে এগিয়ে গেল। প্রথমবারের মতো এক রিক্সায় দুজন পাশাপাশি বসেছে। স্বভাবতই বন্যা এক সাইড হয়ে বসেছে তবুও চলন্ত রিক্সায় তানভিরের শক্তপোক্ত বাহু বারবার বন্যার কাঁধের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। আচমকা বন্যার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। শুকনো গলায় বার বার ঢোক গিলছে, নিজেকে যতটা সম্ভব এক পাশে সরিয়ে নিচ্ছে যেনো কোনোভাবেই তানভিরের সঙ্গে ধাক্কা না খায়।

বন্যা ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছে, ভেবেছিল রিক্সায় একা চলে যাবে তাহলে বাইক, গাড়ির ঝামেলাও পোহাতে হবে না। গাড়িতে চলাচল করতে বন্যার একদম ই ভালো লাগে না। তারউপর মাঝেমধ্যে গলির রাস্তায় গাড়ি থেকে নামলে আশেপাশের মানুষজন কেমন করে চেয়ে থাকে, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে এগুলো বন্যার সহ্য হয় না তাই সবসময় সাদামাটা চলতেই পছন্দ করে। বন্যার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখে তানভির আচমকা নিজের হাত বন্যার পেছন দিকে ঘুরিয়ে বন্যার কাঁধ বরাবর রিক্সাতে রেখেছে। একবার তানভিরের হাতের স্পর্শ অনুভব হওয়ামাত্র বন্যা সঙ্গে সঙ্গে তানভিরের হাতের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

“হাতটা সরান, প্লিজ।”
তানভির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“যেভাবে সাইডে যাচ্ছ, কখন জানি রিক্সা থেকে পরে যাও। আমার আব্বাজান বাইক আনতে নিষেধ করেছেন যাতে তুমি ব্যথা না পাও সেখানে রিক্সা থেকে পরে যদি ব্যথা পাও, আব্বু কি আমাকে আস্ত রাখবেন? তুমিই বলো।”
বন্যা পূর্বের ন্যায় আবারও বলল,
“আমি পড়বো না, প্লিজ হাতটা সরান। আমার অস্বস্তি লাগছে।”
তানভির উদাস ভঙ্গিতে বলল,

“আমার পাশে বসে কেউ এমন আচরণ করলে আমারও অস্বস্তি লাগে।”
মেঘের মতো তানভিরও খুব জেদী এটা বন্যার অজানা নয়। তানভির হাত সরাবে না এটা বুঝতে পেরে বন্যা দুহাতে নিজের ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে গুটিশুটি মেরে বসে বুকের বা পাশে অবস্থিত হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি অনুভব করছে। ইদানীং বন্যার মাথায় হুটহাট তানভিরের চিন্তা চলে আসে। বিশেষ করে তানভিরের জীবন কাহিনী শুনার পর থেকে বন্যা মাঝে মাঝেই সেই ভাবনায় মগ্ন থাকে। না চাইতেও তানভিরের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। তানভির সামনে আসলে নিজের অজান্তেই সেই অবিদিত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। বন্যা বার বার ঘড়ি দেখছে আর রাস্তা কতদূর বুঝার চেষ্টা করছে। তানভির কপাল গুটিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির আচমকা মৃদুস্বরে ডাকল,

“বন্যা।”
বন্যা তৎক্ষনাৎ চোখ বড় করে তানভিরের দিকে তাকালো। বাতাসে চুল এলোমেলো উড়ছে, ভ্রু যুগল
কুঁচকানো, নাক স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা ফোলা,
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তানভির প্রশ্ন করল,
“তোমার জীবনের একমাত্র অস্বস্তিকর ব্যক্তি টা কি আমি ই?”
বন্যা তখনও নিরেট দৃষ্টিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির বন্যার পাশ থেকে হাত সরিয়ে এনে চোখ নামিয়ে আবারও বলল,

“যদি তাই হয় তবে আজকের পর তোমার অস্বস্তির কারণ আমি হবো না।”
তানভির পকেট থেকে ফোন বের করে কারো সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। বন্যা অবাক চোখে তানভিরকে দেখছে। তানভিরের মনোযোগ ফোনে, অন্যদিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে কথা বলেই চলেছে। বন্যার নজর আঁটকে আছে তানভিরের গাল ভর্তি কিছুটা লম্বা দাঁড়িতে, সেই সঙ্গে বাতাসের সাথে সাথে চুলের নড়াচড়াও খেয়াল করছে। বন্যার শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলেছে। বাকি রাস্তা তানভির একবারের জন্যও বন্যার দিকে তাকায় নি। অথচ বন্যা পুরো রাস্তা তানভিরের ঘোরে বন্দি ছিল। গলির মোড় পর্যন্ত আসতেই মাগরিবের আজান পড়ছে। তানভির চাপা স্বরে বলল,

“মামা রিক্সা থামান।”
তানভির রিক্সা থেকে নেমে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে রিক্সা ভাড়া দিয়ে এক পলক বন্যার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“সাবধানে যেও।”
তানভির মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল। বন্যা থম মেরে রিক্সায় বসে আছে। তানভিরের আকস্মিক পরিবর্তন বন্যার মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে মেঘ দিনে কম করে হলেও আবিরকে ১০০ মেসেজ পাঠায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কিন্তু আবিরের কোনো রিপ্লাই আসে না। সন্ধ্যা থেকে একের পর এক কল দিচ্ছে আবির কল রিসিভও করছে না। মনের ভেতরে জমে থাকা অভিমানে মেঘের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবিরকে চিঠি লিখছে,
“প্রিয় নিষ্ঠুর মানব,

কেমন আছেন? আমি জানি খুব ভালো আছেন। অবশ্য ভালো থাকার ই কথা কারণ মেঘ নামক এক উন্মাদের থেকে মুক্তি পেয়ে গেছেন। কিন্তু আমি ভালো নেই, একটুও ভালো নেই। আজ থেকে দেড় বছর আগ পর্যন্ত আমি খুব ভালো ছিলাম। কারণ তখন আবির নামক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব আমার হৃদয়ে ছিল না। কিন্তু এই দেড় বছরে সবকিছু বদলে গেছে, সেই সঙ্গে বদলে গেছে আমার অভিপ্রায়ও। আবির নামক নিষ্ঠুর মানবের প্রতি আমার তীব্র আসক্তি জন্মেছে। প্রতিনিয়ত ওনাকে দেখার জন্য উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছি। ওনার আকস্মিক দূরত্ব মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

তারউপর আমার অবিদ্যমানতায় ওনার চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারি নি। তাই ওনার আদেশ মেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।ওনাকে জানিয়ে দিয়েন, আমি এখন আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি। খাওয়াদাওয়া, ঔষধ সবকিছু ঠিকমতো খাচ্ছি। যদি সম্ভব হয় তবে আমায় যেন ক্ষমা করে দেন। ওনি আমার মেসেজের রিপ্লাই করছেন না তাই বাধ্য হয়ে চিঠি লিখছি। আমার একটা কবুতর থাকলে তার পায়ে বেঁধেই চিঠিটা পাঠাতাম। কিন্তু আপসোস আমার এমন কোনো মাধ্যম নেই তাই বাধ্য হয়ে চিঠিটা ইনবক্সে পাঠাতে হচ্ছে। ওনার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

আজ আর কোনো মেসেজ দিব না। ওনাকে সাবধানে থাকতে বলবেন।
ইতি ওনার অবাধ্য ডোনা,
মেঘ
আবির ল্যাপটপে কাজ করছিলো। মেঘের আইডি থেকে মেসেজটা আসা মাত্রই ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ টা পড়েছে। দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তানভিরকে কল দিল। তানভির কল রিসিভ করে একদমে সরি সরি সরি সরি বলেই যাচ্ছে। আবির ঠান্ডা কন্ঠে ধমক দিল,

” হয়েছে থাম। এখন সরি বললে আর কি হবে?”
তানভির মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“বনুর সাথে কথা হয়েছে?”
“না।”
“রাগটা সাইডে সরিয়ে বনুর সাথে একটু কথা বলো। ওর মনের অবস্থা খুব খারাপ।”
আবির কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“এত সহজে তোর বোনকে ছাড় দিচ্ছি না। ওর জন্য কি পরিমাণ কষ্ট প্রতিনিয়ত আমি অনুভব করি কমপক্ষে তার একাংশ উপলব্ধি করুক তারপর না হয় ভেবে দেখবো।”
তানভির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমার বোনের চোখে তোমার জন্য আর এক ফোঁটা অশ্রুও দেখতে চাই না আমি।”
আবির মেকি স্বরে বলল,
“আপসোস, আজ একটা বোন নেই বলে আমার পক্ষ ধরে কেউ কথা বলতে পারে না।”
তানভির মুচকি হেসে শুধালো,
“বড় আব্বুকে কি বলবো?”
আবির আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠল,
“আপাতত দাদা-দাদু হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলিস। এখন আর বোন লাগবে না আমার মেয়ে বড় হয়েই আমার পক্ষে কথা বলবে।”
“আহাগো। শখ কত!”

আবির হাসি থামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“শুন, তোর বোন সুস্থ হলে ভার্সিটিতে যেতে বলিস। সারাদিন বাসায় থেকে উল্টাপাল্টা চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“তুমি কি বনুর সাথে কথা বলবাই না?”
আবির মুচকি হেসে বলল,
“তোর বোনের সাথে কথা না বলে থাকতেই পারবো না আমি। শুধু কয়েকটা দিন দেখব, এই আর কি! রাখছি এখন, সাবধানে থাকিস।”
“তুমিও সাবধানে থেকো, আল্লাহ হাফেজ।”

প্রতিদিনের ন্যায় আজ বিকেলেও মেঘ ঘুম থেকে উঠে ছাদে আসছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এক জায়গায়
স্থির দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে আনমনে কিছু ভাবছে। হঠাৎ পেছন থেকে তানভির ডাকল,
” বনু, তোর কি মন খারাপ?”
মেঘ থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুখ মুছে ভেজা কন্ঠে বলল,
“কই না তো।”

তানভির মেঘের থেকে কিছুটা দূরে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“কাঁদলেই যদি সব পাওয়া যেতো তবে সবাই তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে দিনরাত এক করে কাঁদতো। বুঝলি?”
মেঘ উপর-নিচ মাথা নাড়লো। মেঘ কেন কাদঁছে তা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করল না। মেঘও কিছু বুঝানোর চেষ্টা করল না। তানভির মলিন হেসে বলল,

“জানিস তো আল্লাহ ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে অনেক বেশি পছন্দ করেন। ধৈর্য রাখ, ইনশাআল্লাহ ভালো ফলাফল পাবি।”
মেঘ ভেজা চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া, আবির ভাই কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন।”
“তোমার সাথে রেগুলার কথা হয়?”
“না। ভাইয়া একটু ব্যস্ত আছে।”
“ওহ।”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,

“তুই ঠিক আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“ভার্সিটিতে যাচ্ছিস না কোনো?’
মেঘ মন খারাপ করে উত্তর দিল,
“ভালো লাগে না।”
তানভির মুচকি হেসে বলল,
“ক্লাসে গেলেই মন ভালো হয়ে যাবে। সকালে রেডি থাকিস, তোকে নিয়ে বের হবো।”
মেঘ ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। তানভির পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মেঘের সামনে রেখে ধীর কন্ঠে বলল,

“সন্ধ্যের আগে রুমে চলে যাস।”
তানভির চলে গেছে। একটু পরেই মেঘকে খোঁজে মীম ছাদে আসছে। মেঘ নিজের চকলেট থেকে অর্ধেকটা ভেঙে মীমকে দিয়েছে। মীম উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“আবির ভাইয়া কি তোমার সাথে এখনও কথা বলেন না?”
“না।”
“কিন্তু কেনো?”
“জানি না।”
“এখন কি করবা?”
মেঘ খানিক ভেবে হঠাৎ নিঃশব্দে হেসে বলল,
“কাল পরশু শাড়ি পড়ব। আমায় ছবি তুলে দিস।”
“আচ্ছা।”

দিন কাটছে শম্বুকগতিতে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর মালিহা খান অথবা হালিমা খানের ফোনে আবিবের কল আসে। একে একে সবার সাথেই ভিডিও কলে কথা বলে কিন্তু মেঘের কন্ঠস্বর শোনামাত্রই ব্যস্ততার ভান করে কল কেটে দেয়। প্রথম প্রথম মেঘ কথা বলতে চাইলেও আবির কথা বলতো না। এখন মেঘও তেমন আগ্রহ দেখায় না। আজ সন্ধ্যার পরপর মীম, আদি আর মেঘ সোফায় বসে গল্প করছে আর স্যুপ খাচ্ছে। এমন সময় মালিহা খানের ফোনে আবিরের নাম্বার থেকে ভিডিও কল আসছে।
মেঘ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

“বড় আম্মু, তোমার বাবু কান্না করছে।”
মালিহা খান রান্নাঘর থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে কান্না করছে?”
মেঘ ফিক করে হেসে উত্তর দিল,
“তোমার ছেলে কল দিচ্ছে।”
“তুই রিসিভ করতে পারিস না?”
মেঘ উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“তোমার বাবুর কি আমার সাথে কথা বলার মতো সময় আছে নাকি? কত ব্যস্ত মানুষ। তুমি ই কথা বলো।”
দ্বিতীয়বার কল বাজতেছে। মেঘ ফোন নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মালিহা খান রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে কল রিসিভ করে মেকি স্বরে প্রশ্ন করলেন,

“কি হয়েছে বাবু? কান্না করছিস কেনো?”
আবির কি বলতে চেয়েও থেমে গেছে। ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে শুধালো,
“কান্না করলাম কোথায়? আর হঠাৎ বাবু ই বা ডাকছো কেনো?”
“আমি নিজে থেকে ডাকি নি। মেঘ বলতাছে আমার বাবু নাকি কান্না করছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তোমাদের আদরের মেয়েকে বাড়াবাড়ি কম করতে বলো।”

মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছে। মালিহা খান মেঘকে এক নজর দেখে সহসা রান্নাঘরের দিকে তাকালেন। মেঘের হাতে ফোন দিতে দিতে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
“নে মেঘের সাথে কথা বল, তরকারি পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়। আসছি আমি।”
তাৎক্ষণিক ঘটনায় মেঘ থতমত খেয়ে কোনোরকমে ফোন মুখের সামনে ধরেছে। আবিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আবির চোখ নামিয়ে নিয়েছে। টেবিলের উপর ফোন রেখে পাশে ল্যাপটপে কাজ করছে। মেঘ অপলক দৃষ্টিতে আবিরকে দেখছে, সহসা ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটেছে। কতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখছে, আজ মুখের উপর কলও কাটছে না। মেঘ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে আহ্লাদী কন্ঠে ডাকল,

“বাবু”
আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঘের হাসি দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। মেঘ দুষ্টামির ছলে আবারও ডাকল,
“বাবু……”
আবির এবার ফোন কাছে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “এইযে বাবু বাবু ডাকছেন। বাবুর মতো আচরণ করলে সামলাতে পারবেন?”
আবিরের মুখে এমন কথা শুনে মেঘের আঁখি যুগল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি প্রশস্ত হয়ে গেছে। নিষ্পলক চোখে আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে আছে। ফোন আগের জায়গায় রেখে আবির আবারও কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তবে মুখে গাম্ভীর্যতার বদলে ক্ষীণ হাসি ফুটেছে। মালিহা খান এগিয়ে এসে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,
“বাসায় থাকাকালীন সারাক্ষণ ই বকবক করতিস আর এখন মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। আগের রূপে ফিরে গেছিস? দেখি দে ফোন।”

মেঘ বড় আম্মুকে ফোন দিয়ে আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। খানিক বাদে মাথা নিচু করে রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। মালিহা খান সোফার কাছে আসতেই মীম আর আদিও আবিরের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। এরমধ্যে হালিমা খানও রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছেন। মেঘ নিজের রুমে গিয়ে আবিরের একটা ছবি বের করে কিছুক্ষণ পরখ করে চোখ জোড়া বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আই মিস ইউ।”

আজ সকাল সকাল মেঘ শাওয়ার নিয়ে একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। নাস্তা করে তানভিরের সাথে বেড়িয়েছে। মোজাম্মেল খানের নির্দেশ মতই বোনকে গাড়ি দিয়ে নিয়ে গেছে। অনিবার্য কারণ বশত প্রথম ক্লাস হবে না তাই মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি, বন্যা চারজন চা খেতে বেড়িয়েছে। মেঘ ওদের দেখেই উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, গাড়ি থামাও। বন্যারা চা খাচ্ছে।”

তানভির ওদের দিকে একবার তাকিয়ে পর পর মেঘের হাস্যোজ্জ্বল মুখের পানে তাকিয়ে হেসে বলল,
“কে জানি বলছিলো ভার্সিটিতে আসতে ভালো লাগে না?”
মেঘ তানভিরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে বলল, “কে জানি বলছিলো, মনে নেই।”
তানভির মুখে হাসি রেখেই বলল,
“ঠিক আছে যা। ক্লাস শেষে কল দিস। ফ্রি থাকলে এসে নিয়ে যাব।”
মেঘ কোমল কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া, আসো। এক কাপ চা খেয়ে যাও।”
“আজ না। অন্য কোনো দিন।”
“প্লিজ ভাইয়া, চলো।”
মিনহাজ, তামিম মেঘকে দেখেই এগিয়ে আসছে। তানভিরকে রিকুয়েষ্ট করে চা খেতে নিয়ে গেছে। বন্যা চোখ তোলে তানভিরকে দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। মাথা নিচু করে মেঘের সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছে। তানভির, মিনহাজ আর তামিমের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে এক কাপ চা খেয়েছে। বন্যার দিকে এক বারের জন্যও তাকায় নি। মিনহাজ বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ভাবি, আজকের ট্রিট যে আপনার পক্ষ থেকে এটা ভাইকে বললেন না?”
বন্যা রাগী স্বরে বলল,
” ভাবি ডাকটা বন্ধ করবি?”
তানভির টাকা বের করে বিল পরিশোধ করতে যাবে ওমনি বন্যা তানভিরের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে শমিত কন্ঠে বলল,
“আজকের বিল আমি দিব।”
তানভির উষ্ণ স্বরে জানাল,
“তোমার লিস্টে নিশ্চয় আমি ছিলাম না। আমার বিল টা আমি দিয়ে দিচ্ছি।’
বন্যা এবার শক্ত কন্ঠে বলল,
” বললাম তো আমি বিল দিব।”

মিষ্টি আর মেঘ কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলছে। মেঘ একহাতে মুখ চেপে হাসছে আর দুজনকে দেখছে। মিনহাজ আর তামিমও তাদের দেখছে। মিনহাজ ইচ্ছেকৃত গলা খাঁকারি দিতেই তানভির সেদিকে তাকালো। বন্যা তখনও তানভিরের হাত ধরে আছে। বন্যার নজর মেঘদের দিকে পড়তেই তড়িৎ বেগে হাত সরিয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। তানভির টাকা পকেটে রেখে স্বাভাবিক ভাবে মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। বন্যা টাকা পরিশোধ করে সামনে চলে গেছে। মেঘ আর মিষ্টি পেছন পেছন যাচ্ছে। মেঘ পেছন থেকে সর্বশক্তি দিয়ে বলে উঠলো,

“তোর সাহস তো কম না, তুই আমার ভাইয়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলিস।”
বন্যা থেমে ক্ষীণ ক্রোধ দেখিয়ে বলল,
“সামান্য এক কাপ চায়ের জন্য যে তোর ভাই টাকার
গরিমা দেখালো সে বেলায়।”
“আমার ভাই টাকার গরিমা দেখায় নি। মিনহাজ, তামিম এমনকি আমি ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি। আসার পর তুই ভাইয়ার সাথে কোনো কথা বলিস নি, কথা না ই বলতে পারিস। চা পর্যন্ত খেতে বলিস নি অথচ ট্রিট তুই দিচ্ছিস। ভাইয়ার নিজের বিল পরিশোধ করাটা কি অন্যায় ছিল?”

“তুই তো তোর ভাইয়ের পক্ষ ই নিবি।”
মেঘ এক গাল হেসে বিড়বিড় করে বলল,
“তুই আমার ভাবি হলে, তোর পক্ষ ই নিতাম।”
বন্যা রাগী স্বরে বলল,
“বিড়বিড় করে কি বলছিস?”
“কিছু না।”

মেঘ বিকেলে একা একায় শাড়ি পড়ে মীমকে নিয়ে ছাদে গেছে। মাথায় ঘোমটা দেয়া ছবি থেকে শুরু করে, স্টাইল করে বেশ কিছু ছবি তুলেছে। রুমে বসে বসে ছবিগুলো দেখছে। একা একা শাড়ি পড়ায় কুঁচির যাচ্ছেতাই অবস্থা। তবুও অনেক খোঁজাখুঁজি করে ৩ টা ছবি আবিরকে পাঠিয়েছে। প্রথম ২ টা ঘোমটা ছাড়া ছবি, তৃতীয় টা মাথায় ঘোমটা দেয়া ছবি। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই আবির মেসেজ সীন করেছে। ছবিগুলো দেখামাত্র আবিরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। মেঘের মায়াবী আদলে তাকিয়ে আবির মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠল,

“মাশাআল্লাহ। দেখি, আবিরের দরুন তার প্রেয়সীর মন ঠিক কতখানি উত্তপ্ত হতে পারে।”
কাছে টেনে ছবিগুলো দেখতে দেখতে আবির হঠাৎ ই কপাল গুটালো। শাড়ির কুঁচিতে নজর আটকে আছে। আবির মুচকি হেসে আকুল কন্ঠে বলল,
“ইশশ, আমি কাছে থাকলে কুঁচির বেহাল দশা হতেই দিতাম না।”

আবিরের রিপ্লাই পাবার আশায় মেঘ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট হয়ে গেছে অথচ কোনো রিপ্লাই আসছে না। মেঘের ব্যাকুল মন কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশকিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ ই মুচকি হেসে বলল,
“কথায় আছে, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। এতদিন আপনার বহু তালবাহানা সহ্য করেছি এবার আমার ভিন্ন রূপ দেখাবো।”

মেঘ নিজের তোলা শাড়ি পড়া ছবিগুলো থেকে ২ টা ছবি ফেসবুকে ডে পোস্ট দিয়ে অপেক্ষা করছে। যেই ভাবনা সেই কাজ। পোস্ট করার ১০ মিনিটের মধ্যে আবির পোস্ট সীন করেছে। মেঘ মিটিমিটি হাসছে, আবিরকে জ্বালানোর এর থেকে উত্তম উপায় আর নেই। হাতে গুনা ২ মিনিটের মধ্যে মেঘের আইডি থেকে ছবিগুলো ডিলিট হয়ে গেছে। মেঘ নিঃশব্দে হেসে বিড়বিড় করল,

“মি. খান আপনি ধরা পরে গেছেন। আপনার রাগ, জেদের আড়ালে লুকানো অনুভূতি প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনি সবকিছু আড়াল করতে পারলেও আপনার অন্তরের হিংসুটে মনোভাবকে কোনোভাবেই আড়াল করতে পারলেন না।”
একদিনের ব্যবধানে আবিরকে পাঠানো মেসেজের পরিমাণ কমে এসেছে। ছবি পাঠানোর পর ২ দিনে আবিরকে একটাও মেসেজ করে নি। এমনকি একবারের জন্য কলও করে নি। সন্ধ্যায় কল দিলে আবিরকে শুনিয়ে শুনিয়ে মেঘ ইচ্ছেকৃত ব্যস্ততার ভান করে।

আবিরের বড় মামী অসুস্থ তাই আজ সকাল সকাল আলী আহমদ খান আর মালিহা খান ত্রিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। বিকেল দিকে মেঘ কল দিয়ে মামির খোঁজ নিয়েছে। মালিহা খানরা এক রাত থাকবেন সেই সুবাদে নিশ্চিতভাবে বলা যায় আজ আবির হালিমা খানের নাম্বারে কল দিবেই দিবে। এজন্য সন্ধ্যার পর পর মেঘ নিজের নাম্বার থেকে হালিমা খানের নাম্বারে কল দিয়ে দুই ফোন বিছানার উপর রেখে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতেছে। মীমকে আগে থেকেই সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে। মামনির নাম্বার ওয়েটিং পেয়ে আবির বাধ্য হয়ে কাকিয়ার নাম্বারে কল দিয়েছে। যথারীতি মীম কল রিসিভ করে মেঘের শেখানো কথাগুলো বলতে শুরু করেছে। আবির সেসব কথায় পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“মামনি কি বেশি ব্যস্ত?”
মীমের সরল স্বীকারোক্তি,
“মামনি সম্পূর্ণ ফ্রী। আম্মুর সঙ্গে গল্প করছেন। কেনো ভাইয়া?”
আবির ভ্রু গুটিয়ে ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“মামনির ফোন ওয়েটিং কেনো?”
“ওহ আচ্ছা। মামনির ফোন দিয়ে আপু কার সঙ্গে যেন কথা বলতেছে।”
আবির তড়িৎ গতিতে বলে উঠল,

“৩০ মিনিট যাবৎ ওয়েটিং। এতসময় ধরে কার সাথে কথা বলছে?”
“আমি জানি না। আমাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে।”
আবিরের কপাল কুঁচকানো। মুহুর্তেই চেহারা অন্ধকার হয়ে গেছে। ঢোক গিলে নিজেকে সংযত করে ধীর কন্ঠে বলল,
“ফোনটা মামনি না হয় কাকিয়াকে দে।”
“ঠিক আছে।”

মীম ফোন দিয়ে দৌড়ে মেঘের রুমে চলে গেছে। মেঘকে ঘটনা বলতেই মেঘ শুধু মুচকি হাসলো। মামনি আর কাকিয়ার সাথে কথা শেষ করে আবির তৎক্ষনাৎ তানভিরকে কল দিয়েছে। যথারীতি তানভিরও মিনহাজ, তামিমকে কল দিয়ে পরপর বন্যাকে কল দিয়েছে। বন্যা কল রিসিভ করতেই তানভির প্রশ্ন করল,
“সন্ধ্যার পর বনুর সাথে কথা হয়েছে তোমার?”
বন্যা স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিল,

“আজ ফোনে কথা হয় নি।”
“কথা হয়নি?”
“নাহ। কেনো?”
“তেমন কিছু না, রাখছি।”
তানভির বাসায় ফিরে আম্মুর ফোনও চেক করেছে অথচ কারো নাম্বার নেই। মেঘকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না।

আলী আহমদ খান আর মালিহা খান একরাত থেকে পরদিন ই বাসায় চলে আসছেন। আলী আহমদ খান বাসায় ফিরে বিকেল থেকে মন খারাপ করে সোফায় বসে আছেন। মালিহা খান শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার কি শরীর খারাপ?”
আলী আহমদ খান এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন। মোজাম্মেল খান নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে বললেন,

“ভাবি, ভাইজানের শরীর নয়, মন খারাপ। এই মন আর ভালো হবে না।”
মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
“কেনো? কি হয়েছে?”
মোজাম্মেল খান ঠাট্টার স্বরে বললেন,
“ভাইজান, ভাবিকে বলবো?”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে হুঙ্কার দিতেই মোজাম্মেল খান থেমে গেছেন। মোজাম্মেল খান হালিমা খানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” দু’কাপ চা দিও।”
মেঘ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “আব্বু, চা আমি করি?”
মোজাম্মেল খান আর আলী আহমদ খান দু’জনেই একসঙ্গে মেঘের দিকে তাকালেন। আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“চা করতে পারবা?”
“পারবো।”

মোজাম্মেল খান রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আমার মেয়ের হাতের রান্না খাওয়ার পর, সামান্য চা নিয়ে ডাউট করা শোভা পায় না। আমার মেয়ে সব পারবে, প্রয়োজনে আমি শিখিয়ে দিব।”
আলী আহমদ খান শুকনো গলায় কেশে উঠলেন। আব্বুর ওভার কনফিডেন্স দেখে মেঘ মৃদু হেসে রান্নাঘরে চলে গেছে। আলী আহমদ খান মেকি স্বরে বললেন,
“তুই রান্না শেখাবি?”
“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। তাহলে আগে তুই ই বল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি কিভাবে রান্না করে?”
মোজাম্মেল খান ঝটপট উত্তর দিলেন,
“জানি না।”
আলী আহমদ খান আবারও প্রশ্ন করলেন,
“পায়েস তো রান্না করতে পারবি নাকি?”
“পারবো না।”
আলী আহমদ খান তপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই জীবনে শখেও কোনোদিন রান্নাঘরে পা রাখছিলি?”
মোজাম্মেল খান মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি না হয় জীবনেও পা রাখি নি। গত ২০ বছরে তুমি পা রেখেছো?”

এরমধ্যে মেঘ দুই কাপ চা নিয়ে আসছে। আলী আহমদ খান চায়ে চুমুক দিয়ে ভারী কন্ঠে বললেন,
“আমাকে তো তোর ভাবি রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না। তাছাড়া আমি গত ২০ বছর পা না রাখলেও রান্না সম্পর্কে তোর মতো অজ্ঞ না। খুব তো বলছিস তোর মেয়েকে তুই রান্না শিখাবি। সামান্য পায়েসের রেসিপি বলতে পারছিস না আবার সব শেখাবি।”
মোজাম্মেল খান রাগী স্বরে বললেন,
“তুমি বলো তাহলে।”
আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বলে উঠলেন,
“তুই কি কোনোভাবে আমায় চ্যালেঞ্জ করছিস?”
“হ্যাঁ করছি।”

আব্বু আর বড় আব্বুর কথোপকথনের মাঝে মেঘ থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই-তিনবার থামানোর চেষ্টাও করেছে কিন্তু থামাতে পারে নি। মালিহা খান নিজেও ব্যর্থ হয়েছেন। আলী আহমদ খান আচমকা বসা থেকে উঠে মোজাম্মেল খানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আমি মুখের কথায় বিশ্বাসী না। তুই অপেক্ষা কর, রান্না করে তোর সামনে হাজির করবো।”
হালিমা খান, মালিহা খান আর মেঘ তিনজনই আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। আলী আহমদ খান মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“চলো, আজ আমি তোমাকে দিক নির্দেশনা দিব। যেভাবেই হোক তোমার আব্বুকে চ্যালেঞ্জে হারাতেই হবে।”
মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন,
” দয়া করে আমার সাজানো রান্নাঘরটাকে ছেড়ে দেন। পায়েস আমি করে দিচ্ছি।”
আলী আহমদ খান উদাসীন কন্ঠে বলে উঠলেন,
“তুমিও আমায় ভরসা করো না?”

মালিহা খান উত্তর খোঁজে পেলেন না। একবার উপর নিচ মাথা নাড়ছেন আবার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ছেন। যত যাই হোক পুরুষ মানুষ রান্নাঘরে গেলে সেই রান্নাঘরের নাজেহাল অবস্থা হতে বাধ্য। আবিবের জন্মের আগে-পরে আলী আহমদ খান মাঝে মাঝে শখ করে রান্না করতেন। রান্না যেমন তেমন, কিন্তু পরবর্তীতে রান্নাঘরে ঢোকার মতো অবস্থা থাকতো না। তারজন্য একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মালিহা খান খুব করে অনুরোধ করেছেন যাতে আলী আহমদ খান রান্নাঘরে পা না রাখেন। সেই থেকে আলী আহমদ খান রান্নাঘরে পা রাখেন না। এত বছর পর ছোট ভাইয়ের সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছেন।

তবে আজ রান্না মেঘ করবে, ওনি কেবল মেঘকে সাহায্য করবেন। এরমধ্যে হালিমা খান তানভিরকে কল দিয়ে জানিয়েছে। আলী আহমদ খান নিজেই ফ্রিজ থেকে চিংড়ি মাছ, দুধ সহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করছেন। এদিকে ভয়ে মেঘের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আলী আহমদ খান মানেই আতঙ্ক, আব্বুর থেকেও মেঘ বড় আব্বুকে বেশি ভয় পায়। রান্নায় গন্ডগোল করলে আজ মেঘের খবর ই আছে, এই ভয়ে বার বার ঢোক গিলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তানভির আসছে। হালিমা খান, মালিহা খান দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘদের কর্মকাণ্ড দেখছেন। তানভির রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,

“আমি কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”
আলী আহমদ খান রাগী স্বরে বললেন,
“তোমার আব্বু পাঠিয়েছে নাকি?”
“না না।”
“সাহায্য লাগবে না।”
তানভির ঠোঁট চেপে হাসছে আর ফোন দিয়ে ভিডিও করছে। মোজাম্মেল খান সোফায় বসে আছেন। ঘন্টাখানেক পর আবির কল দিয়েছে। কল
রিসিভ করতেই আবির বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।

প্রজেক্টের কিছু ডিটেইলস লাগতো। আগামীকাল সকালের মধ্যে দিলে ভালো হতো।”
মোজাম্মেল খান ঠাট্টার স্বরে বললেন,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। প্রজেক্ট নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত ভিডিও কল দাও।”
আবির ভ্রু কুঁচকে ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ভিডিও কল কেনো?’
“আরে দাও আগে।”

সচরাচর মোজাম্মেল খানের সাথে ভিডিও কলে কথা হয় না বললেই চলে। প্রয়োজনে ২-৪ মিনিট ফোনেই কথা বলে। আবির ভয়ে ভয়ে ভিডিও কল দিল। মোজাম্মেল খান কল রিসিভ করে হাসতে হাসতে বললেন,
“তোমার আব্বুর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
আবির ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে আছে। চাচ্চুর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। মোজাম্মেল খান রান্নাঘরের কাছে গিয়ে ফোন ওদের দিকে ঘুরিয়ে হাসতে শুরু করেছেন। আলী আহমদ খান আবিরকে এক নজর দেখে শক্ত কন্ঠে বললেন,

“তোমার চাচ্চু আমায় চ্যালেঞ্জ দিয়েছে আমি নাকি রান্না পারি না।”
আবির শুকনো গলায় ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে বলল, “আপনার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তারমধ্যে আজ ই এতটা পথ জার্নি করে আসছেন।এই অবস্থায় এসব চ্যালেঞ্জের কোনো মানে হয় না।”
আলী আহমদ খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“আমি বেশি কিছু করছি না। মেঘ মামনিই সবটা দেখছে।”
মেঘের দিকে ফোন ঘুরাতেই আবিরের চোখ কপালে উঠার অবস্থা। মেঘের কপালে কাপড় বাঁধা, চুল গুলো শক্ত করে খোঁপা করা, ওড়না পেঁচিয়ে কোমড়ে বেঁধে রেখেছে। মেঘকে এ অবস্থায় দেখে আবির শুকনো মুখেই বিষম খেয়ে উঠেছে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,

“এই পাগ…”
আবির মুখে আসা কথাটা গিলে দু চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে উষ্ণ স্বরে বলল,
“ও এখানে কি করে?”
মোজাম্মেল খান মেকি ভঙ্গিতে বললেন,
“তোমার আব্বু আমার মেয়েকে রান্না শেখাচ্ছে।”
আবির মনে মনে বিড়বিড় করল,
“তোমাদের পাগলামির মাঝে আমার অবুঝ বউটাকে কেনো টানো?”
আলী আহমদ খান মৃদুস্বরে বললেন,
“আবির, তুমি আমার স্পেশাল রেসিপিগুলো মিস করবে।”
আবির না চাইতেও মলিন হেসে শুধালো,
“তা কি কি রান্না হচ্ছে?”

“চিংড়ি মাছের মালাইকারি, বেগুন ভর্তা, পাবদা মাছ ভুনা, আমার স্পেশাল ডালের রেসিপি সাথে পায়েস।”
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল,
“এত কিছু করার কি দরকার। আর আম্মু কোথায়?”
মীম মালিহা খানের কাছে ফোন নিয়ে গেছে। আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,
“আম্মু, এসব কি হচ্ছে? তুমি কিছু বলছো না কেনো?”
“আমি অনেকবার বারণ করেছি। তোর আব্বু কি কথা শোনার মানুষ নাকি?”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

“আব্বুর এই শরীর নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে দিলে কেনো? আর তোমরা কি এটুকু বুঝো না, মেঘ কি বেগুন পুড়াতে পারবে নাকি? হাত পা পুড়ে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলবে। ওনাদের উল্টাপাল্টা চ্যালেঞ্জকে তোমরা কিভাবে সাপোর্ট করছো?”
মালিহা খান শান্ত স্বরে বললেন,
“কারো কিছু হবে না তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। তাছাড়া ওদের রান্না প্রায় শেষ দিকে।”
আবির রাগী স্বরে বলল,
“যা ইচ্ছে করো আমার কি!”

আবির রাগে কল কেটে দিয়েছে। মেঘদের রান্না প্রায় শেষ দিকে। তানভির ছবি তুলে আবিরকে পাঠিয়েছে। আবির ছবিগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে রাগী ইমোজি পাঠিয়েছে। খাবার টেবিলে মুখোমুখি দুই ভাই বসা। মেঘ দু’জনকেই খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মোজাম্মেল খান চুপচাপ খাবার শেষ করে উঠে যেতে যেতে বললেন,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৩

“ভাইজান, তুমি জিতেছো। এবার মন ভালো হয়েছে?”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমার মন ভালো করার অযথা উদ্যমটা খুব ভালো ছিল, ধন্যবাদ।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৫