আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৫
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
আবির প্রজেক্টের কাজে অত্যধিক ব্যস্ত। মোজাম্মেল খানের সাথে কাজের ব্যাপারে প্রতিনিয়ত কথা হয় তবে ইদানীং আলী আহমদ খানের মন ভীষণ খারাপ। বাড়িতে কিংবা অফিসে কোথাও কারো সাথে বেশি কথা বলেন না। তানভির নিজের কাজের পাশাপাশি সময় পেলে মাঝেমধ্যেই আবিরের অফিসে যায়। রাকিব আর রাসেলকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করে। বিগত সাত বছরের ন্যায় বর্তমানে আবির ব্যতীত খান বাড়ির পরিবেশ ততটা নিস্তব্ধ নয়।
দেড় বছরেরও বেশি সময় আবির বাসায় থাকাতে সবার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ মজবুত হয়েছে। আবির নিজের কাজ শেষ করে রুমে এসে ফ্রেশ হয়েই বাসায় কল দেয়। সারাদিনে ২-৪ মিনিট কথা হোক বা না হোক নিয়ম করে সন্ধ্যার পর ঘন্টাখানেক কথা বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। আবিরের অনুপস্থিতিতে ১৭ দিন কেটে গেছে অথচ এতদিনেও মেঘের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রথম ৮-১০ দিনের মতো মেঘ আর কান্নাকাটি করে না বরং প্রতিনিয়ত আবিরকে জ্বালানোর নতুন নতুন পরিকল্পনা করে। আবির কাজের ফাঁকে মেঘের এসব কর্মকান্ড দেখে একা একায় হাসে। আবিরের হাসি দেখে কেউ কেউ হয়তোবা আবিরকে উন্মাদ ভাবে তবে আবিরের সেদিকে বিশেষ মনোযোগ নেই। প্রজেক্ট আর মেঘ ব্যতীত আপাতত আবিরের মস্তিষ্কে অন্য কিছুই নেই। প্রাত্যহিক সকালে ঘুম ভাঙার পর মেঘের প্রথম কাজ ক্যালেন্ডারে গত হওয়া এক একটা দিন মার্ক করা। মেঘের মতো আবিরও প্রেয়সীর ক্রন্দনরত আদলে হাসি ফুটানোর তাগিদে সর্বক্ষণ দিন গুনছে।
আজ সকাল থেকে মালিহা খান আর হালিমা খান রান্নাঘরে ব্যস্ত। আবিরের বড় মামিকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় নিয়ে আসবে সাথে বড় মামা আর মালাও আসবে। তাছাড়া মাইশা আর তার হাসবেন্ডকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। ইকবাল খান বেশকিছু দিন যাবৎ চট্টগ্রামে আছেন তাই মীম, আদিকে নিয়ে আকলিমা খান নিজেই স্কুলের মিটিং এ গেছেন। মেঘ ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে কেবল শুয়েছে এরমধ্যে বড় মামি আর মালা বাসায় আসছে। ওনাদের কন্ঠ শুনে মেঘ তাড়াতাড়ি নিচে আসছে। সালাম দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছে। মামি হাসিমুখে কথা বললেও মালা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। মেঘ মালার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক জিজ্ঞেস করল,
” আপু কেমন আছেন?”
মালা এবার বাধ্য হয়ে উত্তর দিল,
“ভালো। তুমি?”
মেঘ মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো।”
মেঘ মালাদের পাশের সোফায় বসে চোখ বন্ধ করতেই গতবছর মাইশা আপুর বিয়ের প্রতিটা ঘটনা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। তখন মালাকে নিয়ে মেঘের মনে অভিযোগের কমতি ছিল না। আবির একজন দায়িত্বশীল প্রেমিক হিসেবে কত সুন্দর ভাবে সবগুলো ঘটনার সমাধান করেছিলো। বোকা মেঘ আবিরের উদ্বীগ্নতা তখন বুঝতেই পারে নি।
মাইশা আপুর গায়ে হলুদের দিন সকালে মেঘের উন্মুক্ত পৃষ্ঠে আবিরের হাতের স্পর্শের কথা মনে পড়তেই মেঘের শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে, সেই সঙ্গে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। আবিরকে দেখার জন্য মনটা আনচান করছে। মেঘ চোখ মেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো। মালা আড়চোখে মেঘকে দেখছে, মেঘের পড়নে একটা সাদামাটা থ্রিপিস, বিনুনি করা চুলগুলোও কোমড় ছাড়িয়েছে, সামনের দিকের ছোট ছোট চুলে কপাল ঢেকে আছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে দেয়া গোলাপি রঙের লিপস্টিকের অল্পস্বল্প এখনও ঠোঁটে লেগে আছে। মালা অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
“মেঘের মধ্যে স্পেশাল কি গুণ আছে যা আমার মধ্যে নেই। আমি কি তোমার প্রেমিকা হতে পারতাম না? এই বাড়ির বড় বউ হওয়ার জন্য আমি কি একেবারেই যোগ্য ছিলাম না?”
হালিমা খান রান্নাঘর থেকে উচ্চস্বরে ডাকলেন,
“এই মেঘ, তুই ও কি মেহমান হয়ে গেছিস?”
মেঘ তড়িঘড়ি করে উঠে রান্নাঘরে গেলো। বড় মামা এখনও আসে নি। মাইশা আপু আর ওনার হাসবেন্ড কে নিয়ে আসবেন। তাই আপাতত মামি আর মালার জন্য শরবত করা হয়েছে। মালাকে শরবত সাধতেই মালা বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
“শরবত খাবো না আমি।”
মেঘ স্বাভাবিক ভাবেই শরবত রেখে দিয়েছে। মালিহা খান আর আবিরের বড় মামি নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। মালা সোফা থেকে উঠে সারা বাড়ি ঘুরে দেখছে, হয়তো আবিরের রুমে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তালা দেখে আবারও নিচে আসছে। মেঘকে উদ্দেশ্য করে ঠাট্টার স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আবির ভাইয়ার রুমে তালা কেনো? তোমার জন্য নাকি?”
অতি সামান্য কথাতেই অভিমানী মেঘের মনে ভীষণ ক্ষোভ জমেছে। গম্ভীরমুখের গাম্ভীর্যতা সরিয়ে ক্ষীণ হেসে ধীর কন্ঠে বলল,
” উফফ, ভাবতেই ভালো লাগছে যে ওনি আমার জন্য এতটা উদ্বিগ্ন। আমার ভয়ে ওনি নিজের রুমে তালা দিয়ে গেছেন। আবির ভাই আমাকে এত ভয় পায়। ওয়াও!”
মেঘের মুখে উল্টাপাল্টা কথা শুনে মালা বেশ বিরক্ত হলো। মেঘ ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে ফের বলল,
“রুমে তালা থাকুক কিংবা না থাকুক, ওনার শূন্য রুমের পূর্ণতা ওনাকে ছাড়া অসম্ভব। তাছাড়া রুমে তালা দিয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিলেও ওনার মনটা তো আমার কাছেই রেখে গেছেন।”
মালা রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,
“মানে?”
“নাথিং।”
ইদানীং আবিরকে জ্বালাতে জ্বালাতে মেঘের স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। মালাকে দেখেও খুব জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। যেই ভাবনা সেই কাজ। মেঘ সোফায় বসে দুহাতে মালিহা খানের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধ বরাবর মাথা এলিয়ে দিয়েছে। মালিহা খান কথা থামিয়ে ডানহাতে মেঘের কপালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
“কিরে শরীর খারাপ নাকি?”
মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“নাহ। তোমার আদর খেতে খুব ইচ্ছে করছে।”
মালা ভেতরে ভেতরে রাগে কটকট করছে। মালিহা খান মেঘকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আবিরের মামীর সঙ্গে কথা বলছেন। অন্যান্য কথোপকথন শেষে দুজনেই আবিরের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছেন। আবিরের মামি ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“আবিরের জন্য মেয়ে কি পছন্দ করে রাখছো?”
মালিহা খান মলিন হেসে বললেন,
“মেয়ে কিভাবে পছন্দ করবো। ছেলে তো বিয়ের জন্য রাজি ই হয় না।”
“আবিরের পছন্দ আছে নাকি?”
মালিহা খান উদাস ভঙ্গিতে বললেন,
“আমি আবিরকে জিজ্ঞেস করেছি ভাবি। আবিরের আব্বু সরাসরি কিছু না বললেও ছেলের পছন্দ আছে কি না এ বিষয়ে ওনি নিজেও কয়েকবার জানতে চেয়েছেন কিন্তু আবির কিছুই বলে নি। উল্টো দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করছে।”
“কি করেছে?”
“একদিকে আবির বিয়েতে রাজি হয় না, অন্যদিকে মেঘের আব্বু মেঘের জন্য সম্বন্ধ দেখছে এসব নিয়ে আবিরের আব্বু আর মেঘের আব্বুর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়ছে। এরপর থেকে দুই ভাই ই নিরব। বিয়ে বিষয়ক আলোচনা বন্ধ।”
মেঘ বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল, “বড় আব্বু আর আব্বুর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে? কবে?আমি কোথায় ছিলাম?”
“তেমন সিরিয়াস ঝগড়া না। কথা কাটাকাটি হয়ছিল। তোরা বাহিরে ছিলি। আমিও বিস্তারিত শুনি নি আর তোর বড় আব্বু আমাকে তেমন কিছু বলেও নি।”
মেঘ বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবছে,
“এজন্যই কি আম্মু সেদিন বিয়ের কথা বলতে নিষেধ করেছিলো?”
আবিরের আম্মু আর মামি আবারও নিজেদের মতো গল্প করছেন। মেঘ সোফার পাশ থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে লুকিয়ে আবিরকে মেসেজ লিখেছে,
” বড় মামি আর মালা আপু আমাদের বাসায় আসছেন। বড় মামি আপনার বিয়ের…..”
লেখা অসমাপ্ত রেখেই মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। ফোন উল্টিয়ে রেখে পূর্বের ন্যায় আবারও বড় আম্মুর গা ঘেঁষে বসেছে। মালিহা খান ধীরেসুস্থে মেঘের চুলে হাত বুলাচ্ছেন। ৪ থেকে ৫ মিনিট পরেই মেঘের হাতে থাকা ঘড়ি কম্পিত হচ্ছে। ঘড়ির স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে,
You received
1 message from
Amar Abir…..
মেঘ বুঝে উঠার আগেই মালার নজর ঘড়িতে পড়লো। মালা কপাল গুটিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে মেঘের ঘড়ির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। মেঘ ঘড়ির স্ক্রিনে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই লাফিয়ে উঠেছে। আজ ১৭ দিন পর আবির মেসেজের রিপ্লাই করেছে মহানন্দে মেঘের বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ছটফট করছে। খুশিতে চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। প্রিয় মানুষটার নিজের হাতে কিনে পড়িয়ে দেয়া ঘড়িটায় আজ সেই মানুষটার নাম ভেসে ওঠায় মেঘের উজ্জ্বল মুখশ্রী আরও বেশি ঝলমল করছে। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি পেরিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটছে। মালা নির্বাক চোখে মেঘকে দেখছে। মালিহা খান তপ্ত স্বরে বললেন,
“আস্তে যা। পড়ে যাবি তো।”
আবিরের মামি কপাল গুটিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“মেঘের হঠাৎ কি হলো? এভাবে ছুটছে কেনো?”
মালিহা খান মৃদু হেসে বললেন,
“ও এমনই। ওর ছোটাছুটির কারণ লাগে না। হয়তো কিছু একটা মনে পড়ছে এজন্য এভাবে ছুটছে। একটু পরেই চলে আসবে।”
মেঘ রুমে ঢুকেই উত্তেজিত হস্তে মেসেজ সীন করলো। আবিরের ছোট রিপ্লাই আসছে,
“আমার বিয়ের ব্যাপারে কি বলছে?”
মেঘের শরীর রীতিমতো কাঁপছে, ঠোঁটে স্মিথ হাসি ফুটে উঠেছে, দুচোখ জ্বলজ্বল করছে। মেঘ গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে করে বলল,
“মি. খান আমি ঠিক জানতাম, এই কথা বললে আপনার রিপ্লাই আসবেই আসবে।”
মেঘ কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ লিখছে,
“আপনার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার কথা বলছে। তাছাড়া মালা আপু……..”
আবিরের তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই,
“মালা কি করছে?”
“আপনাকে মিস করছে।”
আবির রাগী ইমোজি পাঠিয়ে পরপর মেসেজ পাঠালো,
“ফাজলামো করবি না। মালা কি আজেবাজে কিছু বলছে?”
“হুমমমম।”
“কি বলছে?”
মেঘের আর কোনো রিপ্লাই নেই। আবির পর পর মেসেজ দিচ্ছে, মেঘ রিপ্লাই করছে না। বাধ্য হয়ে আবির কল দিয়েছে। মেঘের বামহাতে থাকা ঘড়ি আর ডানহাতে থাকা ফোন একসঙ্গে ভাইব্রেশন হচ্ছে। আবিরের কল দেখে মেঘ কিছু সময়ের জন্য থমকালো। বুকের বা পাশের তীব্র কম্পন উপেক্ষা করে চোখ পিটপিট করে কল রিসিভ। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে আবিরের রাগান্বিত কন্ঠস্বর ভেসে আসছে,
“সমস্যা কি তোর? ত্যাড়ামি করাটা কি তোর স্বভাব হয়ে গেছে? আমার অপছন্দ জেনেও অনবরত এই কাজগুলো করেই যাচ্ছিস। কথা অসম্পূর্ণ রাখার অভ্যাস টা কবে ত্যাগ করবি?”
মেঘ মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“কেমন আছেন?”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
“তুই কি ভালো থাকতে দিচ্ছিস?”
মেঘ অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমি কি আপনাকে খুব বেশি জ্বালাতন করি?”
আবির উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
“মালা কি বলছে?”
মেঘ ঢোক গিলে ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি আপনাকে খুব বেশি জ্বালায়। আমার অত্যাচারে আপনি নিজের রুমে তালা দিয়ে গেছেন। এমনটায় বুঝিয়েছে।”
আবির দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে রাশভারি কন্ঠে বলতে শুরু
করল,
“রুমে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র এলোমেলো করে রেখে আসছি। রুম খোলা রেখে আসলে যে যার মতো ঢুকে কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলতো। আর হ্যাঁ তানভিরের কাছে চাবি আছে যখন ইচ্ছে রুমে যাস তবুও দয়া করে মানুষের কথায় গাল ফুলিয়ে কান্না করিস না, প্লিজ।”
মেঘ আকুল কন্ঠে বলে উঠল,
“আমার কান্না নিয়ে আপনার এত চিন্তা তাহলে এতদিন কথা কেনো বলেন নি?”
“তোকে বারবার বারণ করা স্বত্তেও আমার কথা অমান্য করেছিলি কেনো? তুই ভালোভাবেই জানিস, আমি যা বলি তাই করি। তোকে এত বুঝানোর পরও যেহেতু আমার কথা অমান্য করেছিস তাই আমিও কথা বলি নি।”
মেঘ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“আপনি যাওয়ার সময় আমায় ডাকলেন না কেনো? আমায় ঘুমের মধ্যে রেখে কেনো চলে গিয়েছিলেন? এতটা হৃদয়হীন কিভাবে হতে পারলেন? আপনার বুক কি একটুও কাঁপলো না?”
আবির ঢোক গিলে শীতল কণ্ঠে জবাব দিল,
“কেউ কি জানে, তার একজোড়া ক্রন্দিত নেত্র আমার সুস্থির ব্রহ্মাণ্ডে তোলপাড় চালাতে সক্ষম। কান্নাভেজা ঐ আঁখি যুগলের মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে হৃদয়হীনের মতো ই পালিয়ে এসেছি।”
আবিরের ভেজা কন্ঠস্বর কানে বাজতেই মেঘ নিজের চোখ মুছে আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠল,
“কেউ কি জানে, তার জন্য আমি কি পরিমাণ কান্না করেছি?”
“কান্নারও পরিমাণ হয় বুঝি? তা কত বালতি পানি জমেছিল?”
মেঘ তড়িৎ বেগে জবাব দিল,
“৯ বালতি।”
আবির মলিন হেসে বলল,
” ইসস আর এক বালতি হলে ভালো হতো।”
মেঘ আচমকা কান্না শুরু করেছে। আবির অতর্কিতে প্রশ্ন করল,
“এই কি হয়েছে? কান্না করছিস কেনো?”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,
“আপনি না বললেন, আর এক বালতি পানি জমালে ভালো হতো।”
আবির শক্ত কন্ঠে ধমক দিল,
“এ বেলায় কথা মানতে উঠেপড়ে লাগিস। অন্য বেলায় কি হয়?”
মেঘ ভেজা চোখে ফিক করে হেসে উত্তর দিল,
“ভূ*তে পায়।”
“আমারও তাই মনে হয়। বাসায় ফিরে আগে আপনার ভূ*ত টাকে বিদায় করতে হবে। মামির শরীর কেমন?”
“এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো। সিরিয়াস কোনো সমস্যা নেই। আপাতত ডাক্তার কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছেন।”
আবির ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,
“আপনার শরীর কেমন?”
মেঘের ঠোঁটে আবারও হাসি ফুটলো। আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো ছিল তবে এখন খুব ভালো।”
“সাবধানে থাকবেন। আর একটা কথা।”
“জ্বি বলুন।”
“মালা পর্যন্ত আমার নাম্বারটা যেন না পৌঁছায়।”
“পৌঁছালে কি হবে?”
“তেমন কিছু না। হোয়াটসঅ্যাপে দিনে কমপক্ষে ১০-১৫ বার কল আসবে, আমি বসে বসে কল রিসিভ করবো। প্রতিবার ১ ঘন্টা করে কথা বললে জাস্ট ১০ থেকে ১৫ ঘন্টা কথা হবে। তারপর ৮ ঘন্টা ঘুমাবো আর ১ থেকে ২ ঘন্টা অন্যান্য কাজ করব।”
মেঘ দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
“আর আমি পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে আপনাদের কলিজা ভুনা করে এলাকার কুকুরগুলোকে খাওয়াবো।”
আবির নিঃশব্দে হেসে শুধালো,
“কিছু বলছেন?”
মেঘ দাঁতে দাঁত চেপে রাগী স্বরে জবাব দিল,
“বলছিলাম মাত্র ১৫ ঘন্টা কেনো কথা বলবেন, বললে পুরো ২৪ ঘন্টায় কথা বলিয়েন। ঠিক আছে?”
আবির এবার শব্দ করে হাসলো। পরপর উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল,
” মনে হচ্ছে কিছু পুড়তেছে। আমি এখান থেকেও পুড়া পুড়া গন্ধ পাচ্ছি। কি পুড়ছে?”
মেঘ রাগান্বিত কন্ঠে জবাব দিল,
“আপনার নাক একটু বেশিই এডভান্স। কলিজা ভুনা এখনও বসায় নি, ওয়েট একটু পর বসাবো।”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবির মৃদুস্বরে বলল,
“ম্যাম, কলিজা ভুনায় মনে করে লবণ দিয়েন।”
মেঘ ফোঁস করে উঠল,
“আরও বেশি টেস্টি করতে একটু বিষও দিব নে।”
বলেই মেঘ কল কেটে দিয়েছে, রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আবিরের হাসি থামছেই না, হাসতে হাসতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। আজ অফ ডে বলে আবিরের কাজের তেমন চাপ নেই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে খানিক বাদে আবারও মেঘকে কল দিল। কল বাজতে বাজতে শেষ পর্যায়ে মেঘ কল রিসিভ করল সঙ্গে সঙ্গে আবির মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো,
“ম্যাম।”
মেঘ নিশ্চুপ। আবির আদুরে কন্ঠে আবারও ডাকল,
“ম্যা….ম”
আবিরের কন্ঠে আদুরে ডাক শুনে মেঘের বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। মন খারাপ, রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা মুহুর্তেই সব উধাও। অনুভূতিদের পাশ কাটিয়ে মেঘ কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করল,
“কিছু বলবেন?”
“হুমমমমম।”
“বলুন।”
“বলছিলাম, রান্নার টেস্ট বাড়াতে বি*ষ টা ব্যবহার না করলে হয় না?”
“বি*ষ ব্যবহার করলে কি হবে?”
“না মানে, কেউ লবণ চেক করতে গেলে তো সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
মেঘ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“আপনি এসব বলতে আবারও কল দিয়েছেন? রাখছি আমি। ”
আবির তড়িৎ বেগে ডাকলো,
“শুনো…!”
আবিরের মুখে তুমি সম্বোধন শুনামাত্রই মেঘের দু চোখ প্রশস্ত হয়ে গেছে। মুহুর্তেই শ্বাস থেমে গেছে,হতভম্ব মেঘের মস্তিষ্কে অনুভূতিদের তোলপাড় চলছে। চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করছে আবিরের হাস্যোজ্জ্বল আদলখানা। । দুরুদুরু কাঁপছে বুক, চোখে মুখে রাগের রেশ মাত্র নেই। আবির তৎক্ষনাৎ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“অতি সামান্য কারণে যেভাবে রেগে যান ভবিষ্যতে কি হবে, ম্যাম? ”
মেঘ চোখ কুঁচকে জানতে চাইলো,
“কি হবে?”
“সদা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে থাকতে হবে।”
আবির চটজলদি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
” আবারও বলছি, মালা পর্যন্ত আমার নাম্বার পৌঁছালে সব দায়ভার আপনার। মনে থাকে যেনো।”
মেঘ চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“বড় আম্মুর থেকে নাম্বার নিয়ে নিলে?”
“আমি আম্মুকে বারণ করেছি আম্মু কাউকে নাম্বার দিবে না। অন্য কারো কাছে নাম্বার চাওয়ার সাহস মালার হবে না। একমাত্র আপনি আছেন, অনুগ্রহ করে আপনিও দিবেন না।”
“ওহ আচ্ছা। এজন্যই বড় আম্মু আমাকে নাম্বার দিচ্ছিলো না। তাতে কি আমি তো নাম্বার দেখেই মুখস্থ করে ফেলেছি।”
“আমি কারো নাম উল্লেখ করি নি তাই আম্মুও বুঝতে পারে নি। আপনি যে নাম্বার মুখস্থ করার পাবলিক এটা আমি জানি৷ তাছাড়া আমি নিজেই আপনাকে কল দিতাম। কিন্তু আপনার অসুস্থতার কথা শুনে… ”
“কোনো ব্যাপার না। কিন্তু মালা আপু আমার কাছে নাম্বার চাইলে কি বলবো?”
“এটাও আমার শিখিয়ে দিতে হবে?”
“না, একদম না। এখন রাখি?”
” আচ্ছা।”
মেঘ ফের বলল,
“শুনুন। ”
“জ্বি ম্যাম, বলুন”
“রাতে কল দিলে রিসিভ করবেন? নাকি আবারও রাগ করে বসে থাকবেন ?”
আবির কপাল গুটিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“ফ্রী হয়ে মেসেজ দিয়েন। ”
“আর একটা কথা। ”
“হুমমমমম।”
মেঘ কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে করে বলল,
“মিস ইউ।”
বলেই কল কেটে দিয়েছে। আবির মলিন হেসে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। মেঘের শাড়ি পড়া একটা ছবি ফোনের ওয়ালপেপার দেয়া, আবির অপলক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। অতর্কিতে হাসি থামিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“My dear sparrow,
I feel empty without you.”
কথা শেষ করে মেঘ আবারও নিচে নামলো। ততক্ষণে মাইশারা চলে আসছে৷ মাইশাকে দেখেই মেঘ ছুটে গেল। মাইশা হালকা রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়ে এসেছে, ৪ মাসের অন্ত:সত্ত্বা হওয়ায় আগের থেকেও বেশ কিউট লাগছে। মেঘ আপুকে ভালোভাবে পরখ করে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া- আপু, ভাইগ্না অথবা ভাগ্নীকে সর্বপ্রথম আমি কোলে নিতে চাই। আদির পরে আমি এখনও কোনো ছোট বাবু কাছ থেকে দেখি নি। আমাকে জানাবেন, প্লিজ।”
মাইশা আর তার হাসবেন্ড একসঙ্গে হেসে উঠলো। ভাইয়া বললেন,
“ইনশাআল্লাহ, বাবুকে প্রথমেই তোমার কোলে দিব। ”
” ইনশাআল্লাহ। ”
মাইশারা সারাদিন শেষে বিকেল দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মামা, মামিরাও বাড়িতে চলে যাবেন। আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান অফিসে থাকলেও দুপুরে বাসায় এসে সবার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছেন। যাওয়ার আগে আগে মালা হঠাৎ মেঘকে ডেকে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আবির ভাইয়ার নাম্বারটা দাও তো।”
মেঘ কপাল গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” ওনার নাম্বার দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“কথা বলবো।”
মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“ওনি প্রজেক্টের কাজে ব্যস্ত আছেন। আপাতত আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলার সময় নেই ওনার।”
মালা বিরক্ত হয়ে শুধালো,
“তোমার সাথে কথা বলার সময় আছে?”
মেঘ কপালের মাঝ বরাবর ভাজ ফেলে মেকি স্বরে বলল,
” আমার সাথে কথা না বললে ওনার রাতে ঘুম ই হয় না।”
মেঘ যে ইচ্ছেকৃত রাগানোর জন্য এসব বলছে এটা বুঝতে মালার বেশি সময় লাগলো না। মালা তৎক্ষনাৎ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” যত যাই বলো, ভাইয়ার নাম্বার আমি সংগ্রহ করেই নিব। আগেও কত রাত ভাইয়ার সাথে আনলিমিটেড কথা বলেছি তার হিসেব নেই, এবারও তাই হবে। ঘুম পাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে ভাইয়াকে ঘুমের ঔষধ সাজেস্ট করবো।”
মেঘ ভেতরে ভেতরে রাগলেও রাগটা প্রকাশ করল না। ফিক করে হেসে বলল,
“চেষ্টা করে দেখতে পারেন। হতেও পারে ওনার হার্টবিট আপনার দেয়া ঘুমের ঔষধের পাওয়ারকেও হার মানিয়ে দিল।”
মালা কটমট করে বলল,
“তুমি যে কোন ভরসায় এসব বলো আল্লাহ ই ভালো জানেন। ”
অকস্মাৎ মেঘের ঘড়িতে আবিরের মেসেজ আসছে,
“All okay? ”
মেঘ মালার দিকে ঘড়ি টা এগিয়ে দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিল,
“এই ভরসায়।”
নামের জায়গায় শুধু Amar Abir লেখাটায় ভাসছে। মালা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিনমিন করে বলল,
“ফোনে আমার আবির লিখে রাখলেই আবির ভাইয়া তোমার হয়ে যাবে না।”
আরও কি কি বিড়বিড় করতে করতে মালা বেড়িয়ে গেছে। মেঘ মুখ ফুলিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিই তো, ফোনে আমার আবির…… ভাই নামটা গত দের বছর যাবৎ ই সেইভ করে রেখেছে। নতুন নাম্বারটাও একই নামে সেইভ করেছে কিন্তু তাতে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আবিরের অন্তর্নিহিত অনুভূতি বুঝার সক্ষমতা মেঘের হয়েছে ঠিকই কিন্তু আবির যতদিন না নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছে ততদিন মেঘের আত্মবিশ্বাস আসবে না। জোর গলায় নিজেকে যতই আবিরের প্রেমিকা বলুক না কেনো, দিনশেষে এটায় সত্যি আবির তাকে কোনো প্রকার প্রতিশ্রুতি দেয় নি। মেঘ মুখ ফুলিয়ে রুমে চলে গেছে।
শেষ বিকেলের দিকে একটা হ্যান্ড পার্টস আর সাথে দুটা ফাইল আর কিছু কাগজপত্র নিয়ে বন্যা আপনমনে হাঁটছে। আচমকা নজর পরে অনেকটা সামনে তানভিরের মতো কেউ একজন ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। সিউর হওয়ার জন্য বন্যা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেদের হাঁটার স্বাভাবিক গতির সাথে মেয়েদের দৌড়ের গতি মোটামুটি সমান ধরা যায়। রাস্তায় দৌড়াতে পারছে না তবে যথাসাধ্য দ্রুত হেঁটে তানভিরের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। পেছন থেকে ২-৪ বার ডেকেওছে কিন্তু সেই ডাক তানভিরের কর্ণকুহরে পৌছায় নি। বন্যা এবার থেমে শ্বাস টেনে উচ্চস্বরে ডাকল,
” ঐ ভিলেন। ”
মেয়েলী কণ্ঠস্বর কানে বাজতেই তানভির উদ্দেশ্যহীনভাবে পেছনে ঘুরলো। বন্যাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে কল কেটে কপট রাগী স্বরে জানতে চাইল,
“কোনদিক থেকে ভিলেন মনে হয় আমায়?”
“কখন থেকে ডাকছিলাম, আপনি শুনছিলেন ই না। তাই বাধ্য হয়ে ডাকলাম।”
“হঠাৎ আমাকে ডাকার কারণ?”
“এমনি। আপনার বাইক কোথায়?”
“একটা ছোটভাই নিয়ে গেছে। কোনো?”
“এমনি। জিজ্ঞেস করতে পারি না?”
তানভির মলিন হাসলো৷ কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, বাসায় চলে যেও৷ আসছি।”
তানভিরের এমন ব্যবহারের আগামাথাও বন্যা বুঝলো না। কিছুক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ পূর্বের ঘটনাগুলো মনে পড়লো। বন্যা সহসা ডাকল,
“এইযে”
তানভির ঘাড় ঘুরিয়ে বিমুঢ় দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকালো। বন্যার মুখের মায়াবী হাসিতেই তানভিরের হৃদয় দুরুদুরু কাঁপছে। তানভির উত্তর না দিয়ে খানিক ভ্রু নাচালো। বন্যা এক গাল হেসে বলল,
“ঝালমুড়ি খাবেন?”
তানভিরের তাৎক্ষণিক উত্তর,
“নাহ।”
“তাহলে ফুচকা?”
“না।”
“চটপটি?”
“না।”
“চা?”
“না।”
বন্যা এবার খানিক রেগে গেছে। চোখের পাতা ঝাপটে আনমনেই বলে উঠল,
“তাহলে কি সিগারেট খাবেন?”
তানভির প্রশস্ত নেত্রে বন্যার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে শুধালো,
“কি বললে?”
বন্যা উত্তর না দিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে লজ্জায় আর আতঙ্কে নিজের মুখ চেপে ধরেছে। নিজের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তানভির স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, বন্যাকে আপাদমস্তক দেখে মুচকি হেসে বলল,
” সিগারেট খেতে পারি যদি তুমি আমার সঙ্গে খাও।”
অপ্রত্যাশিত কথায় বন্যা স্যাট করে তানভিরের অভিমুখে তাকালো। চোখ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বড় আকার ধারণ করেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেসামাল পরিস্থিতি সামলে বন্যা দৃঢ় কন্ঠে শুধালো,
“ছিঃ! আপনি সিগারেটও খান?”
“তুমি খাওয়াতে চাচ্ছো তাহলে আমার খেতে সমস্যা কোথায়?”
বন্যা মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বলল,
” মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে, সরি। ”
“এতদিন মানুষকে মুখ ফস্কে অনেককিছু বলতে শুনেছি। আজ প্রথমবার কোনো মেয়ে মুখ ফস্কে সিগারেট অফার করছে। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। চলো, সামনে থেকে দুটা সিগারেট নিচ্ছি। ”
বন্যা আতঙ্কিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“নাহ, আমি যাব না।”
বন্যার চেঁচানোর শব্দে তানভির আঁতকে উঠে বুকে হাত রেখে আশেপাশে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“যেভাবে চিৎকার করছো, মানুষ তো অন্যকিছু ভাববে।”
বন্যা আস্তে করে বলল,
“যার যা খুশি ভাবুক, আমি সিগারেট খাব না।”
তানভির স্ব শব্দে হেসে বলল,
“ঠিক আছে। এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। এরপর মুখ ফস্কে সিগারেটের কথা বললে সত্যি সত্যি টেস্ট করাবো।”
“এগুলো ঠিক না। আপনি এসব করতে পারেন না।”
“বাহ রে! ডাকবা ভিলেন আর কিছু বললে ই ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান দিবা তা তো মানবো না।”
বন্যা বিরক্ত হয়ে বলল,
“দেখুন, আমি আপনাকে ট্রিট দিতে ডেকেছিলাম। আপনি ইচ্ছেকৃত আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন। ”
তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে শুধালো,
“আমি আবার কি করলাম?”
” যাই অফার করছি শুধু না ই করে যাচ্ছেন।”
” আমার সাথে চলাচলে যার অস্বস্তিবোধ হয়, আমাকে যার অসহ্য লাগে। আমি তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করি।”
বন্যা উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি একবারও বলেছি আপনাকে অসহ্য লাগে? নাকি বলেছি আপনি আমার অস্বস্তির কারণ?”
তানভির স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অকস্মাৎ হেসে বলল,
” চলো।”
“কোথায়?”
“বাহ! ট্রিট না দিবা বললা। এখন এটা বলো না যে মুড
নেই বা সময় নেই। ”
বন্যা ঠিক এই কথাটায় বলতে চেয়েছিল। মুখের কথাটা গিলে শান্ত স্বরে বলল,
” কি খাবেন?”
“ঝালমুড়ি, ফুচকা, চটপটি এনিথিং।”
বন্যা ভ্রু গুটিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে তানভিরকে অল্পস্বল্প বকেও নিলো। মেঘ আর তার ভাইয়ের স্বভাবে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দুজনই বেশ অভিমানী, মেঘ মেয়ে বলে অভিমান টা একটু বেশিই প্রকাশ পায়। ঝালমুড়ি হাতে দুজনেই পাশাপাশি দুটা চেয়ারে বসা। এক প্লেট ফুচকা আর একটা চটপটিও অর্ডারও দিয়েছে। তানভির ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,
“হঠাৎ আমাকে ট্রিট দেয়ার কারণ কি?”
বন্যা ঢোক গিলে আস্তে করে বলল,
” সেদিন আপনাকে চা খেতে বলি নি বলে আপনার বোন আমায় কতগুলো কথা শুনিয়েছে তাই আজ…”
তানভির ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে জানতে চাইল,
” বনু তোমায় কথা শুনিয়েছে? কি বলেছে?”
তানভির নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানভিরের দৃষ্টি দেখে বন্যা থতমত খেয়ে হাসার চেষ্টা করল। হাসিমুখে বলল,
“তেমন কিছু না৷ আসলে সেদিন আমার তরফ থেকে সবাইকে চায়ের ট্রিট ছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার আপনাকে চা অফার করা উচিত ছিল।কিন্তু আমি সেটা করি নি তাছাড়া বিল দেয়ার বিষয়টা নিয়ে মেঘ একটু রেগে গেছিলো।”
“বনুর কথায় কিছু মনে করো না, প্লিজ।”
বন্যা ঠোঁট উল্টিয়ে বিদ্রূপের ভঙ্গিতে বলে উঠল,
” ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে। কিছু মনে করলাম না৷ ওকে?”
“কি সমস্যা? এভাবে কথা বলছো কেন?”
” এমনি। ”
তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে শুধালো,
“এমনি বলাটা কি তোমার স্বভাব? ”
বন্যা উপর নিচ মাথা নাড়লো। তখনি বন্যার বড় আপুর কল আসছে। বন্যা স্বাভাবিকভাবেই কল রিসিভ করে কথা বলছে। ইতিমধ্যে ফুচকা আর চটপটি দিয়ে গেছে। বন্যা কথা শেষ করে চটজলদি ২-৩ টা শিট বের করে তানভিরের হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো মেঘকে দিয়ে দিয়েন। কাল ভার্সিটি বন্ধ, পরশু একটা ক্লাস টেস্ট আছে। পড়ে নিতে বলবেন।”
তানভির গাল ফুলিয়ে নির্বোধের মতো বন্যাকে খানিক দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
” এত সমাদরের রহস্য তবে এই ছিল? স্বার্থপর মেয়ে কোথাকার। ”
বন্যা ফুচকা খেতে খেতে আড়চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
” একদম স্বার্থপর বলবেন না। নিজের বোনকে তো ঠিকই যত্নে রাখেন, প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের ই হতে দেন না। ২-৩ টা শিটের জন্য এতটা রাস্তা পেরিয়ে আমাকেই আপনাদের বাসায় যেতে হতো আর নয়তো পিডিএফ দিতে হতো। সেই পিডিএফ আবার আপনাকেই প্রিন্ট আউট করে আনতে হতো। যেহেতু আপনাকে পেয়েছি, তাই আপনাকে দিয়ে দেয়াটায় বেস্ট অপশন ছিল। আমি চাইলেই রাস্তায় ডেকে ২ টা শিট আপনাকে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারতাম। যদি সেই কাজটা করতাম তবে স্বার্থপর বলতে পারতেন৷ আমি আপনাকে ট্রিট অফার করলাম, ৪০ মিনিট সময় দিলাম অতঃপর সেই শিটগুলো দিচ্ছি। তারথেকেও বড় কথা শিটগুলো আপনার বনুর প্রয়োজন। তাহলে আমি স্বার্থপর কিভাবে হলাম?”
“যেভাবে যুক্তি দেখিয়ে ঝগড়া করছ, আমার মনে হচ্ছে তোমার উদ্ভিদবিজ্ঞান সাবজেক্ট না নিয়ে দর্শন সাবজেক্টে অনার্স করা উচিত ছিল।”
বন্যা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“আমি ঝগড়া করছি?”
তানভির ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“এটাকে অবশ্য ঝগড়া বলে না তবে তর্কের বিবাদ বলা যায়।”
বন্যা সেসবে পাত্তা না দিয়ে ফুচকা খাচ্ছে। তানভির টুকটাক ফুচকা খেতে পারলেও আজ চটপটি নিয়েছে। কারণ এক প্লেট ফুচকা একা শেষ করা তানভিরের পক্ষে সম্ভব না। মেঘদের সাথে বের হলে, মেঘ, মীম আর আদির থেকে অল্প কয়টা খায়। আজ আগেভাগেই চটপটিটা বেছে নিয়েছে। বন্যা ফুচকা শেষ করে উঠতে উঠতে বলল,
“আপুদের জন্য একটা পার্সেল নিয়ে বিলটা দিয়ে আসছি, আপনি বসুন।”
তানভির তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“বিলটা আমি দেয়?”
বন্যা রাগী রাগী মুখ করে তাকাতেই তানভির ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছে। আমি বসছি, বিলটা তুমিই দিয়ে আসো।”
বন্যা মুচকি হেসে চলে গেছে। বিল দিয়ে এসে তানভিরের হাতের শিটগুলো আবারও দেখে নিল। পার্টস আর শিটগুলো হাতে নিতে নিতে শীতল কন্ঠে বলল,
” সরি,সময়ের অভাবে চা খাওয়াতে পারছি না। অন্য কোনোদিন খাওয়াবো, ইনশাআল্লাহ।”
তানভির মুচকি হেসে বলল বলল,
” চা কিন্তু তোমার হাতের বানানো হতে হবে।”
“দেখা যাক। আসছি।”
“আমি এগিয়ে দিয়ে আসি?”
” তার কোনো দরকার নেই। আপু নিয়ে যাবে আমাকে।”
“সাবধানে যেও।”
“আচ্ছা,আপনিও।”
বন্যা রাগ করেছে ভেবে, সেদিনের ঘটনা জানতে মেঘকে জিজ্ঞেস করার জন্য মেঘের রুমের সামনে আসতেই তানভির থমকে দাঁড়ালো। মেঘ আপনমনে বন্যার সাথে ফোনে কথা বলছে, দুজনের আবোলতাবোল কথা আর হাসির শব্দে তানভির থম মেরে দাঁড়িয়ে পরেছে। কোথায় ভেবেছিল মেঘ আর বন্যার মধ্যে মান অভিমান চলছে, মেঘের থেকে কারণ জেনে সমাধান করার চেষ্টা করবে কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। তানভির আস্তে করে গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে এসে শিট রেখে চলে যাচ্ছে। মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,
“ভাইয়া, কিছু বলবা?”
“না”
তানভির বিড়বিড় করতে করতে যাচ্ছে,
“মায়ের কাছে মাসির গল্প বলে আর কি হবে!”
রাত ৯ টা বেজে গেছে। মেঘ আবিরকে কোনো মেসেজ করে নি। কিছুক্ষণ পর আবির ই মেসেজ দিল,
“Busy?”
মেঘের ছোট রিপ্লাই,
“No”
তৎক্ষনাৎ আবিরের কল আসছে। মেঘ কল রিসিভ করে চুপচাপ বসে আছে। ওপাশ থেকে আবির বলছে,
” ফ্রী হয়ে মেসেজ দিতে বলছিলাম। বিকেল থেকে মুখ ফুলিয়ে রুমে বসে আছেন, কিছু খানও নি শুনলাম, একটা টেক্সট পর্যন্ত করেন নি। কি সমস্যা? ”
“কোনো সমস্যা নেই।”
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৬৪
“মালা কি আবারও আজেবাজে কথা বলছে?”
মেঘ মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
“চরিত্রের সমস্যা আপনার, মালা আপু কি বলবে?”
আবির উত্তেজিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“কি? আমার চরিত্রে সমস্যা?কে বলছে? প্রমাণ কি?”