আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭০
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
অযাচিত পরিস্থিতিতে মেঘ সচকিত হয়ে আছে। নিষ্কলুষ মনে জমে থাকা ভয়, ভীতি আর অভিমানেরা অবিদিতে গুম হয়ে গেছে। আবির ভাইকে নিজের করে পাওয়ার যে উন্মাদনা এতদিন তাড়া করে বেড়াচ্ছিল সেই উন্মাদনার পরিসমাপ্তি ঘটেছে আজ। আবিরের অনুষঙ্গে নিজেকে হারাতে বসেছে। আবিরের অপলক দৃষ্টি, নেশাক্ত কন্ঠ, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর অনভিলাষিত ঘনিষ্ঠতা অবসহন করতে অনল্পে হিমসিম খেতে হচ্ছে। আবির মেঘকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে ঠিকই তবে মেঘের মায়াবী আদলে নজর আঁটকে আছে, আবিরের অত্যুষ্ণ চাহনিতে মেঘের বুকের ভেতরটা লজ্জায় হাস ফাঁস করছে, অতর্কিতে চিবুক নামিয়ে নিলো। আবির সঙ্গে সঙ্গে দু আঙুলে পুনরায় মেঘের চিবুক উঠিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” তুই জানিস তোকে আজ কতটা সুন্দর লাগছে?”
মেঘ চোখ তুলে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কতটা?”
” সমুদ্রের প্রভূত জলরাশি
যতটা সুন্দর ঠিক ততটা।
দেখতে প্রশান্ত হলেও
সঙ্গিন।”
মেঘ মলিন হাসলো। আবির পরপর শক্ত কন্ঠে শুধালো,
” তোকে শাস্তিটা কেনো দিয়েছি জানিস?”
“বাজে কথা বলেছি তাই।”
“জ্বি না। আপনি আমার সাজানো পরিকল্পনা নষ্ট করেছেন তারজন্য৷ ”
“আমি কি করেছি?”
আবির শ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ২ টা বছর ধৈর্য রাখতে পারলেন অথচ আর ২ টা দিন ধৈর্য রাখতে পারলেন না। আমি বলেছিলাম, আপনাকে আমি কোনো প্রকার প্রতিশ্রুতি দিব না,সরাসরি বিয়ে করব। মানে আজ আপনাকে বলব, কাল বিয়ে করব এমনটায় ভেবে রেখেছিলাম। আমার সবকিছু প্ল্যান করা, আজ থেকে দুদিন পর আপনাকে প্রপোজ করতাম, তার পরদিন গায়ে হলুদ আর সবশেষে বিয়ে। কিন্তু আপনি অধৈর্য হয়ে আজ ই চলে আসছেন। আপনাকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমার ছিল না, তাই নিজের সাজানো পরিকল্পনার কথা ভুলে আপনার ইচ্ছেকে প্রায়োরিটি দিলাম। আমার প্ল্যান ধ্বংস করার শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হতো।”
মেঘের চোখ নামিয়ে নিয়েছে, এখন কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না। এতদিন আত্মগোপনে থাকা অনুভূতিরা বার বার জানান দিচ্ছে, সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তির চোখে চোখ রাখলেই নিজের অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” তুই আমায় ভালোবাসিস?”
মেঘ ক্ষীণ স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি। আর আপনি?”
আবির উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
“কতটা ভালোবাসিস?”
“যতটা ভালোবাসলে আপনার হৃদয়ের প্রতিটা অনুনাদে আমার নাম শুনা যাবে ঠিক ততটা ভালোবাসি। ”
” আমার জন্য সব করতে পারবি?”
মেঘ কপাল কুঁচকে বলল,
“সব পারবো কিন্তু আপনাকে ছাড়তে পারবো না। ”
” আজ যদি আবির অথবা পরিবার দুটা থেকে যেকোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয়। তখন তুই কি করবি? বেছে নিতে পারবি আমাকে?”
মেঘ শীতল চোখে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল,
” পারবো। ”
আবির মলিন হেসে শুধালো,
” যদি বলা হয় আবিরকে ছাড়তে হবে তখন?”
মেঘ অতর্কিতে আবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি আপনাকে ছাড়তে পারবো না, প্লিজ। আর যাই বলেন আমি সব মেনে নিব, বাসায় মেনে না নিলে সারাজীবন আপনার সাথে থেকে যাব তবুও কারো কথায় আপনাকে ছাড়তে পারবো না৷”
আবির মেঘের চোখ মুছে ধীর কন্ঠে বলল,
” কাঁদতে বারণ করেছিনা তোকে?”
মেঘ ভেজা কন্ঠে বলল,
” বাসায় কি কোনোভাবেই আমাদের মেনে নিবে না?”
আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,
” শুধুমাত্র বাসায় মানানোর চেষ্টায় গত তিনবছর যাবৎ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র ভরসা৷ ওনারা আমাকে অনেক ভালোবাসেন, একজন দায়িত্বশীল ছেলে হিসেবে আমাকেও আজীবন ওনাদের পাশে থাকতে হবে। আমি স্বইচ্ছায় কোনোদিন আব্বু আম্মুর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করব না। তিনবছরে আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি এখনও করছি। শুধুমাত্র ওনাদের চোখে যোগ্য হওয়ার জন্য প্রাইভেট কার কিনেছি, আলাদা কোম্পানি দাঁড় করিয়েছি, বাসা পর্যন্ত করেছি। ওনারা যোগ্যতা চাইলে আমি আজ জোর গলায় বলতে পারব, হ্যাঁ আমি তোর জন্য যোগ্য। তোকে পাওয়ার জন্য ওনারা যদি শর্ত দেন, আমি আব্বু-চাচ্চুর দেয়া যেকোনো শর্ত মেনে নিতে রাজি। তবুুও তোকে আমার লাগবে।
কিন্তু ওনারা যদি আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেয় বা তোকে ছাড়ার কথা বলে তখন আমি চুপ থাকতে পারবো না। পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসতে হয় আমি চুপচাপ বাসা থেকে বেড়িয়ে আসবো কিন্তু তোকেও তখন আমার সঙ্গে বেড়িয়ে আসতে হবে। বিশ্বাস কর, আমি তোকে কষ্টে রাখবো না। আর তোকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নও করব না। কারণ আমি জানি আমার থেকেও তোর অনেক বেশি আবেগ জড়িয়ে আছে ঐ বাসায়। কিন্তু কি করব বল? আমার যে তোকে লাগবেই লাগবে। বাসায় মেনে না নিলে হয়তো কয়েকটা দিন একটু দূরে থাকতে হবে তারপর আমি সব ঠিক করে দিব। জাস্ট কয়েকটা দিন। ফুপ্পির মতো ২৮ বছর পরিবার ছেড়ে থাকতে হবে না তোকে। আব্বু ছাড়া বাকি সবাইকে মানিয়ে নিতে পারবো। হয়তো আব্বু একটু ঝামেলা করবেন। তবে যাই হোক, আজ তোকে আমার সাথে থাকতে হবে। থাকবি তো?”
মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“থাকবো।”
প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে আবির মেঘকে বুঝিয়েছে। কি কি করতে হবে, কি বলতে হবে সব বুঝিয়ে দিয়েছে। ততক্ষণে এশার আজানের সময় হয়ে গেছে। আবির পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নিল। বিকেল থেকে এই পর্যন্ত ২৪ টা কল আসছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় টের পায় নি, তানভির কলের পর কল দিচ্ছে। মেঘকে নিয়ে ফিরলে বাসায় যেতে হবে, এদিকে আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান তিনজন মিলে অনেকগুলো কল দিয়েছেন। দুপুরে মিটিং শেষে সিফাতের সঙ্গে আবিরের খুব রাগারাগি হয়েছে। আর একটুর জন্য হাতাহাতি হতে যাচ্ছিলো। সিফাতের চালচলন আবিরের একদম পছন্দ না, ছেলেটা যতই ভালো সাজার নাটক করুক না কেন, আবিরের সামনে বার বার ধরা পরেছে। কিন্তু আলী আহমদ খানের চোখে সিফাত খুবই ভদ্র ছেলে। আজ সকালেই আলী আহমদ খান ল্যাপটপে সিফাতকে ফ্যামিলি ফটো দেখাচ্ছিলেন। আবির অফিসে ঢুকতেই সিফাতের কন্ঠ কানে আসছে,
” মেঘ তে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর হয়েছে। বিয়ে দেন নি কেনো এখনও? একদিন সময় করে মেঘকে দেখতে যাব সাথে সবার সাথে পরিচয়ও হয়ে যাবে।”
আলী আহমদ খান কথাটা তেমনভাবে গুরুত্ব না দিলেও আবিরের শরীর রাগে জ্বলছিল। আব্বুর সামনে কিছু বলতে পারছিল না আবার চুপ ও থাকতে পারছিল না। তারউপর মিটিং থেকে বের হতেই দেখল, সিফাতের ফোনের স্ক্রিনে আবিরদের ফ্যামিলি ফটোতে থাকা মেঘের ছবিটা বড় করে দেখছে। ঐ ছবি দেখে আবিরের মেজাজ তুঙ্গে। রাগে চিৎকার করতেই সিফাত ছবি কেটে দিয়েছে, ইকবাল খান দ্রুত ছুটে আসেন,ওনি কিছু না বুঝলেও আবিরের অগ্নিমূর্তি ধারণকৃত রূপ দেখে টেনে হিঁচড়ে আবিরকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলী আহমদ খান তখনও নিশ্চুপ ছিলেন। সবকিছুতেই ওনার মনে হচ্ছিল, আবির সিফাতকে জব দিতে নিষেধ করেছিল আর সেই ক্ষোভেই সিফাতের সাথে রাগারাগি করে।
তারউপর আলী আহমদ খান বলে বসেন, সিফাতকে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। এই কথা শুনে আবিরের রাগ তিনগুণ বেড়ে গেছিল। আলী আহমদ খানের সাথে রাগারাগি করে আবির তখনই অফিস থেকে বেড়িয়ে আসছিলো। নিজের অফিসে এসে কেবিনে বসার ১০ মিনিটের মধ্যে কল আসে, মেঘ শাড়ি পড়ে বাসা থেকে বেড়িয়েছে। একে আব্বুর উপর মেজাজ খারাপ, সবকিছু মিলিয়ে বিরক্ত তারউপর মেঘের আকস্মিক কর্মকাণ্ডে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেয়সীর কথা ভেবে বেড়িয়েছিল। আর এখনও হাসিমুখে মেঘকে সময় দিচ্ছে। তবে সেই বিকেল থেকেই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। আজ যা হবে খান বাড়িতেই হবে।
আবির মেঘের সাথে কথা শেষ করে মেঘকে নিয়ে নিচে আসলো। ততক্ষণে স্টাফদের প্রায় সবাই চলে গেছে। মিরাজ আর তার দু-তিনজন ফ্রেন্ড বসে আছে। আবিরদের নামতে দেখে শান্ত কন্ঠে বলল,
” ভাইয়া সবার খাওয়া শেষ। ওনারা যে যার মতো চলে গেছেন।”
আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আচ্ছা, কিন্তু রাকিবরা কোথায়?”
মিরাজ রাশভারি কন্ঠে বলল,
” রিয়া ভাবি কল দিয়েছিল, ওনি বোধহয় অসুস্থ। রাসেল ভাইয়াকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে গেছেন, কল দিয়েছিলাম রিসিভ করেন নি। ”
“ওহ। রাকিবরা খেয়েছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সবার খাওয়া হয়েছে। ”
“তোমরা খেয়েছো?”
“না ভাইয়া, তোমরা খাওয়ার পর খাবো।”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” খেয়ে নিলেই পারতে। ”
আবির মেঘকে খাবার রেডি করে দিচ্ছে। আজকের সব খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে আনানো৷ সন্ধ্যার দিকে মিরাজের ফ্রেন্ডরায় খাবার নিয়ে আসছে, সাথে ওয়ান টাইম প্লেট আর গ্লাসও নিয়ে আসছিল। মেঘকেও সেই প্লেটেই খাবার দিয়েছে আবির। মিরাজ আর ওর ফ্রেন্ডরা ছাদে গেছে। মেঘ জিজ্ঞেস করল,
“আপনি খাবেন না?”
“খেতে ইচ্ছে করছে না। যতক্ষণ না সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে ততক্ষণ স্থির হতে পারছি না। ”
মেঘ আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” যা হবার হবে। সারাদিন খান নি, আগে খেয়ে নিন।
আমি খাইয়ে দেয়?”
আবির আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
” বাব্বাহ! বউ বউ ফিল এসে গেছে নাকি?”
মেঘ ভেঙচি কেটে বলল,
“দেখি, হা করেন। ”
আবির কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে নিল। খেতে খেতে তানভিরকে কল দিয়ে কথা বলে নিয়েছে। মিরাজকে আগেই বলেছিল আবির শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে আসার জন্য। আবির পাঞ্জাবি, পায়জামা পাল্টে শার্ট প্যান্ট পড়ে মিরাজদের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিল। আজ মিরাজরা এখানেই থাকবে আগামীকাল তানভির এসে সবকিছু গুছিয়ে রেখে যাবে। যাওয়ার আগে মেঘ হলুদ আর সাদা সবগুলো গোলাপ একসঙ্গে শপিং ব্যাগে করে নিয়ে গেছে৷ আসার সময় সময় কিছুটা দূরত্ব থাকলেও এখন বাইকে বসেই মেঘ পেছন থেকে আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে৷ আবির মুচকি হেসে নিজের একহাত মেঘের দু’হাতের উপর রেখে উদ্বেলহীন কন্ঠে বলল,
” বাসায় উল্টাপাল্টা কিছু বললে এভাবে জড়িয়ে ধরতে পারবেন তো?”
মেঘ আস্তে করে বলল,
“দেখা যাক। আপনি পারবেন?”
আবির মৃদু হেসে বলব,
” অবশ্যই, আমি একদম কোলে নিয়ে চলে আসবো।”
মেঘ মেকি স্বরে বলে উঠল,
“আমিও দেখব আপনার কেমন সাহস।”
“ওকে।”
আবির বাইক স্টার্ট দিল। মেঘ আবিরের প্রশস্ত পিঠে মাথা এলিয়ে আবিরের গায়ের গন্ধ উপলব্ধি করছে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর মেঘ আচমকা ডাকল,
“আবির ভাই… ”
আবির তৎক্ষনাৎ ব্রেক কষল। বাইক থেকে নেমে মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুরুতর কন্ঠে বলল,
” কথায় কথায় ভাই বলার অভ্যাস টা ত্যাগ করুন। আমি আপনার ভাই না, ওকে?”
মেঘ শান্ত স্বরে শুধালো,
“ভাই না ডাকলে কি ডাকব?”
“আবির ডাকবি।”
মেঘ চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,
“আমি পারব না।”
“কেনো?”
“স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই আপনি জানেন না?”
আবির হাসতে হাসতে বলল,
” হায় রে কুসংস্কার। গত দুই বছরে আবির ভাই, আবির ভাই ডাকতে ডাকতে কান তব্দা করে ফেলছিল৷ এখন বলতেছিস স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই। ”
মেঘ মুখ চেপে শক্ত কন্ঠে বলল,
“তখন আপনি আমার স্বামী ছিলেন না, চাচাতো ভাই ছিলেন। বুঝেছেন?”
“বুঝেছি। কিন্তু আর একবার যদি আবির ভাই বলেছিস তাহলে বামহাতে কানের নিচে এমন থা*প্পড় দিব, তিনদিন বেহুঁশ থাকবি।”
মেঘ হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
” তাহলে ডাকব কি আমি?”
আবির নির্দ্বিধায় বলল,
“আহিয়ার আব্বু।”
মেঘ উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করল,
” আহিয়া কে? ”
আবির মুচকি হেসে বলল,
“আমার মেয়ে।”
“হোয়াট? আপনার মেয়ে আসলো কোথা থেকে? ”
আবির দুষ্টামীর স্বরে বলল,
“মেয়ে আমার একার না, আমাদের দু’জনের মেয়ে আহিয়া৷”
“মেঘ নিজের পেটে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আমাদের মেয়ে মানে? আমার তো এখনও বিয়েই হয় নি। মেয়ে কোথা থেকে আসবে?”
আবির নিঃশব্দে হেসে মেঘের মাথায় আস্তে করে গাট্টা দিয়ে বলল,
“আরে বোকা মেয়ে, আমি আমাদের অনাগত সন্তানের কথা বলছি।”
মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে বলল,
” ছিঃ আপনার কি লজ্জা লাগে না?”
“ওমা, লজ্জা লাগবে কেনো?”
“এইযে আজেবাজে কথা বলছেন। ”
” হবু সন্তানের কথা বউকে বলতে গেলে যদি লজ্জা পেয়ে হয় তাহলে এ নির্লজ্জময় জীবন আমি রাখবো না।”
মেঘ বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
” ফাজলামি রেখে তাড়াতাড়ি বাসায় চলুন। আজ বাসায় যে কি হবে! দেখা যাবে আমার, আপনার জীবনই ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাবে। তখন এই আহিয়া, আবিহা হাজার কেঁদেও তার বাপকে পাবে না। ”
আবির দু আঙুলে আলতোভাবে মেঘের নাক চেপে হেসে বলল,
“তারমানে আপনি মেনে নিচ্ছেন, আহিয়া আমার মেয়ে আর আপনি তার মা। ”
মেঘ ফোঁস করে উঠে আবিরের হাতে চিমটি কেটে বলল,
“আপনি কি যাবেন?”
আবির “উফফফ” করতে করতে বাইকে বসলো। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে তপ্ত স্বরে বলল,
” অবোধ জামাইকে চিমটি কাটা মোটেই ভালো লক্ষণ না। ”
“আল্লাহ! বিয়ের খবর নাই আর ওনি জামাই জামাই করে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছেন। ”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বাসায় মানলে বিয়ে দুই তিনদিন পরে হবে আর বাসায় না মানলে রাতেই আপনাকে নিয়ে পালাবো।”
মেঘ আর কিছু না বলে আবারও আবিরকে জড়িয়ে ধরে বসলো। বুকের ভেতর চাপা কষ্টগুলো প্রকাশ করতে পারছে না, আজ বাসায় কি হতে চলেছে সেসব ভেবেই আঁতকে উঠছে বারবার। দীর্ঘসময় পর মেঘ আবিরের পিঠে মাথা রেখেই আস্তে করে ডাকল,
“এইযে…”
আবির নিরুত্তর। মেঘ আবারও ডাকল,
“এইযে শুনছেন…”
আবির এবারও নিরুত্তর। মেঘ গলা খাঁকারি দিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলল,
” আহিয়ার আব্বু…”
“হুমমমম আহিয়ার আম্মু, বলো।”
মেঘ উদাসীন কন্ঠে শুধালো,
” আমার জন্য এতকিছু করলেন অথচ একবারের জন্যও I Love You বা ভালোবাসি বললেন না। কেনো?”
“ভালোবাসি না বললে কি ভালোবাসা যায় না? দুজন দু’জনের অনুভূতি বুঝতে পারাটা কি ভালোবাসা নয়? দু’জন দু’জনকে পাগলের মতো ভালোবাসতে চাইলে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা কি বলতেই হবে?”
মেঘ উত্তর খোঁজে পেল না৷ সত্যি ই তো, একজন আরেকজনের অনুভূতি বুঝা, পাশে থাকা, চাওয়া পাওয়ার মূল্যায়ন করা, দু’জন দু’জনকে সম্মান করা এগুলোই তো ভালোবাসার প্রতীক। মুখ ফোটে ভালোবাসি না বলেও বাবা মায়েরা আমৃত্যু সন্তানদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যান, স্বামী- স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সারাজীবন পাশে থাকেন, ভাই-বোনের সম্পর্কেও কেউ কাউকে ভালোবাসি বলে না অথচ কারো কোনো সমস্যা হলে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে কেনো ভালোবাসি কিংবা I Love You শোনার এত প্রবণতা সবার মাঝে। প্রতিনিয়ত ‘ভালোবাসি’ বললেই কি সত্যিকারের ভালোবাসা খোঁজে পাওয়া যায়?
মেঘ আবিরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ আর কিছু বলার বা শুনার ইচ্ছে নেই মেঘের। বাসার কাছাকাছি আসতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে। বাসা থেকে কিছুটা দূরে বাইক থামিয়ে দুজনেই নামল। পরপর কল দিল তানভিরকে। তানভির অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ হলো একটা কাজে গেছে। আসতে একটু সময় লাগবে। কয়েক ঘন্টা শাড়ি পড়ে হাঁটা চলা করায় শাড়ির যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছে। আবির মেঘের শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বলল,
“একা যেতে পারবি নাকি তানভির আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি?”
“যেতে পারব।”
“শুন, কারো সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। সোজা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবি।”
“আচ্ছা। যাবো এখন ?”
“হুমমমম।”
মেঘ গোলাপগুলো হাতে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। আবির নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ কিছুদূর যেতেই আবির উচ্চস্বরে ডাকল,
“মাহদিবা খান মেঘ”
মেঘ সহসা থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল। আবির পূর্বের ন্যায় আবারও বলল,
” সাজ্জাদুল খান আবিরের মিসেস হবার প্রস্তুতি নিন। খুব শীঘ্রই আপনি আমার বেগম হচ্ছেন।”
মেঘ অবাক লোচনে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে সামনে ঘুরলো। একপা বাড়াতেই আবির উদ্ধত কন্ঠে আবার বলল,
“I Love You Megh. I Love You Infinity. ”
মেঘ অতর্কিতে ঘুরে দাঁড়ালো, আশ্চর্য নয়নে তাকালো আবিরের মুখের দিকে। I love you শুনার অণুমাত্র ইচ্ছেও মেঘের ছিল না। অনাঙ্ক্ষিত কথাটা শুনে নিজের আবেগ আঁটকে রাখতে পারলো না। এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আবিরকে। আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“I Love You Infinity.”
আবির মেঘের মুখটা তুলে কপাল বরাবর চুমু খেয়ে শান্ত স্বরে বলল,
” ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে। ”
মেঘের বিস্মিত আঁখি যুগল আবিরের চোখে নিবদ্ধ। ফাঁকা রাস্তা, কিছুটা দূরে থাকা ল্যামপোস্টের আলো আবিরের শ্যামলা চেহারায় পড়ছে মেঘ সেই মায়াময় আদলে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলে উঠল,
” আপনি এত কিউট কেন?”
আবির মৃদু হেসে বলল,
” এখন কিন্তু শাস্তি দিব।”
মেঘ তৎক্ষনাৎ আবিরকে ছেড়ে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। পরপর থমথমে কন্ঠে শুধালো,
“ভালোবাসি বলবেন না তো এখন বললেন কেনো?”
আবির তপ্ত স্বরে বলল,
” আমি তোর কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখব না তাই।”
মেঘ অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,
” আমার খুব ভয় হচ্ছে। ”
আবির হিজাবের উপর দিয়ে মেঘের দুগালে হাত রেখে চাপা স্বরে বলল,
” আমি আছি তো তোর পাশে। ভয় কিসের? আমি বেঁচে থাকতে তোর উপর একটা আঁচড়ও পড়তে দিব না। ”
মেঘ আবিরের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আবির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘের সামনে কিছু প্রকাশ করতে না পারলেও আবিরের বুকের ভেতর ভয়ংকর তোলপাড় চলছে। কি হবে বা হতে চলেছে সেসব ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে অনেক আগেই। তারউপর দুপুরে আব্বুর সাথে রাগারাগি করে অফিস থেকে বেড়িয়েছে, সারাদিন আব্বুর ফোনটা পর্যন্ত রিসিভ করে নি। মেঘ বাসায় ঢুকে গেছে। আবির পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখল আলী আহমদ খানের কল আসতেছে। আবির এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কলটা রিসিভ করল,আবির কিছু বলার আগেই আলী আহমদ খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
“আবির, তুমি কি শোধরাবে না? কলের পর কল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি অথচ তোমার কোনো খবর নেই। এত কিসের রাগ তোমার?”
আবির শান্তস্বরে বলল,
“বলুন।”
“আমি কি বলব? কি বলতে বাকি রাখছো তুমি? রাজশাহীর অফিসে সমস্যা হয়েছে। বিকেলের দিকে খুব মারামারি হয়েছে। এখনও পরিস্থিতি ভালো না। তোমার চাচ্চুর শরীর খারাপ অফিসেই আসে নি। এদিকে তুমি সারাদিন ধরে রাগ করে বসে আছো। বাধ্য হয়ে এখন আমাকেই যেতে হচ্ছে। ”
আবির উত্তেজিত কন্ঠেে বলল,
“আপনি যাচ্ছেন মানে? আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি এখনি আসছি। ”
আলী আহমদ খান রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,
” ব্যবসা যেহেতু আমায় সব দায়ও তো আমার ই। মরি আর বাঁচি ব্যবসায় করে যাবো। তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে থাকো।”
আবির কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
” আপনি কোথায় আছেন? ”
“বাসস্ট্যান্ডে।”
“আমি আসতেছি এখনি।”
“আসতে হবে না। ”
“আসতেছি আমি।”
এদিকে মেঘ শাড়ির আঁচলের নিচে ফুল আর আংটি পরিহিতা হাত লুকিয়ে বাসায় ঢুকলো। রান্নাঘরে মালিহা খান আর আকলিমা খান কাজ করছেন। আর কেউ নেই। এই সুযোগে মেঘ দ্রুত চলে যাচ্ছে। মালিহা খান অকস্মাৎ মেঘকে দেখে ডেকে উঠলেন,
” শাড়ি পরে কোথায় গিয়েছিলি তুই? এত রাত করে বাসায় আসছিস কেনো?”
মেঘ ছোট করে বলল,
“ঘুরতে গিয়েছিলাম।”
মেঘ আর কোনো কথা না বলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেছে। একদম শাওয়ার শেষ করে বিছানায় শুয়েছে। বন্যার কথা মনে হতেৎ সঙ্গে সঙ্গে বন্যাকে কল দিল। আজকের সব ঘটনা একে একে বলছে।
আবির দ্রুত বাসস্ট্যান্ড পৌছালো। আলী আহমদ খান ব্যাগ নিয়ে ব্রেঞ্চে বসে বসে চা খাচ্ছেন। আবির সামনে গিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আব্বু, আপনি বাসায় যান, আমি যাচ্ছি।”
“এভাবে কিভাবে যাবে? বিকেল থেকে অনবরত কল দিচ্ছি তোমাকে, ইকবাল এমনকি মোজাম্মেলকে দিয়েও কল দেয়ালাম ৷ আর তুমি কি করলে? কল রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করলে না। এখন এসে বলছো, তুমি যাবে৷ মজা করছো?”
“সরি আব্বু, আর এমন হবে না।”
আলী আহমদ খান রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিলেন,
” এখন সরি বলতে হবে না। যাও রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকো, প্রয়োজনে ৭ দিন বসে থাকো। আমি চলে যাচ্ছি, তোমাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। ”
আবির শীতল কন্ঠে বলল,
“সরি, আব্বু। আর এমন করবো না। রিয়েলি সরি। এই আমি কানে ধরছি..”
আলী আহমদ খান চায়ের কাপ রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবিরের হাত আঁটকে বললেন,
” কানে ধরতে হবে না। বাবা মায়ের কাছে সন্তানের হাজারটা ভুলও কিছুই না। ”
আবির মলিন হেসে বলল,
“রাজশাহী আমি যাচ্ছি, আপনার এই শরীর নিয়ে এতদূর যেতে হবে না।”
“তুমি তো জামাকাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসো নি। কিভাবে যাবে?”
“দু একটা জামাকাপড় কিনে নিব। সমস্যা নেই।”
“তোমার বাইক কি করবা?”
“তানভির এসে বাইক আর আপনাকে নিয়ে যাবে। কোনো সমস্যা নেই। আমি ওকে কল দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে, যাও। কিন্তু আজকের ঘটনার মতো যদি ওখানেও কারো সাথে রাগারাগি করেছো আর আমার কানে খবর আসছে, তাহলে তুমি কানে ধরেও মাফ পাবে না। এই আমি বলে দিলাম।”
আবির ধীর কন্ঠে বলল,
“কারো সঙ্গে রাগারাগি করবো না কিন্তু আমি ফেরার পর আপনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ”
আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ। কি বলবা এখনি বলো।”
আবির মৃদুস্বরে বলল,
” এখন না। রাজশাহী থেকে এসে বলল।”
“আচ্ছা। তোমার ইচ্ছে । ওখানে যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে জানিয়ো। মোজাম্মেল এর শরীর ভালো হলে ওকে পাঠাবো । ”
“আচ্ছা। ”
বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। আবির টিকেট নিয়ে বাসে ওঠে বসেছে। তানভির এসেছে অনেকক্ষণ পর। আবির রাজশাহী যাচ্ছে দেখে তানভির থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় আব্বুর সামনে মুখ ফোটে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে। আলী আহমদ খান তানভিরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“চলো, এখন।”
তানভির ভারী কন্ঠে বলল,
“জ্বি। ”
আবিরের বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই আবির মেঘকে কল দিল। মেঘ বন্যার কল কেটে আবিরের কল রিসিভ করে চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল,
“কোথায় আপনি? আর কখন আসবেন?”
আবির ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করল,
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে প্রপোজ স্পেশাল
” আমাকে ইমার্জেন্সি কাজে রাজশাহী যেতে হচ্ছে, বাস অলরেডি ছেড়ে দিয়েছে। তোকে যা বলি একটু শুন, হাতের আংটি টা খুলে কোথাও লুকিয়ে রেখে দে। আমি আসলে আবার পড়িয়ে দিব। আর এই ২-৩ দিন খুব বেশি সাবধানে থাকবি৷ প্রয়োজনে সারাদিন ঘুমাস, তবুও বাসার কারো মুখোমুখি হোস না। বাসায় কোনো মেহমান আসলে বা তোকে দেখার নাম করে কেউ আসলে ভুলেও সামনে যাস না। আর অবশ্যই আমাকে জানাবি। সামান্য কোনো বিষয়েও বাড়াবাড়ি করতে যাস না, সামান্য কোনো কারণে তোর গায়ে যেন কোনো আঁচড় না পড়ে। যেভাবে রেখে গেলাম তিনদিন পর যেন সেভাবেই পায়৷ একটা কথা মনে রাখিস, তোর কিছু হলে আমি সত্যি মরে যাব। আমি তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”