আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭১ (২)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
আবির দু*র্বোধ্য দৃষ্টিতে আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খানকে দেখছে। ওনাদের স্বাভাবিক মুখো ভঙ্গি দেখে আবিরের কৃশ লাল চোখ দুটা আ*গ্নে*য়গি*রির লা*ভা*র ন্যায় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের বাম পাশে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ প্রায় ৩০০ গ্রামের হৃদপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
আচমকা দুঃস্বপ্নগুলো মস্তিষ্কে হুমকি খেয়ে পরেছে, এলোপাতাড়ি ছুটছে ভয়ংকর সব নিষিদ্ধ চিন্তা। চোখের সামনে বারবার মেঘের আদুরে আদলখানা ভাসতেছে। ১৯ ঘন্টা ধরে ঠিকমতো খাওয়া নেই আবিরের, বাসার কারো সাথে কোনো যোগাযোগও ছিল না। তানভিরকে শ খানেক কল দিয়েছে কিন্তু রিসিভ হয় নি একটা কলও। বাসার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেখে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। আবির দুহাতে মাথা চেপে অগ্নি ঝরা কন্ঠে চিৎকার করল,
” আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। সত্যি করে বলুন, মেঘ কোথায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মোজাম্মেল খান রাগী স্বরে বললেন,
” এক কথা তোমাকে কতবার বলতে হবে?”
হালিমা খান ডাইনিং টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়িতে আর একটা মানুষও নেই। বাহিরে ডেকোরেশনের লোকজনদের হাউকাউ শুনা যাচ্ছে। আবির ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, আশেপাশে তাকিয়ে জোরে শ্বাস টেনে শক্ত কন্ঠে বলল,
” যতক্ষণ না আপনারা সত্যি কথা বলছেন ততক্ষণ আমি এক কথায় জিজ্ঞেস করবো।”
” সত্যি এটায়, আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমার মেয়ে সুখে আছে। ”
আবিরের হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে, পরপর অপ্রতিভ কন্ঠে বলে উঠল,
“কোন সুখে কথা বলছেন আপনি? ওর জীবনের সব সুখ জড়িয়ে আছে আমার সাথে৷ মেঘ শুধু আমার। ওকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। আপনারা যে মিথ্যা নাটক টা সাজিয়েছেন সেই নাটকের মঞ্চ ভেঙে আমি আমার মেঘকে ঠিক আমার করে নিব।”
মোজাম্মেল খান আর কিছু বললেন না। ওনি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। আলী আহমদ গুরুভার কন্ঠে বলে উঠলেন,
” কি সব আবোলতাবোল কথা বলছো। তোমার মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে? ”
আবির ভেজা কন্ঠে বলে উঠল,
” হ্যাঁ। আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের এই তালবাহানা আমি আর নিতে পারছি নি। আব্বু- চাচ্চু আমি আপনাদের দু’জনকেই বলছি, আমি মেঘকে ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনের সবটুকু জুড়ে শুধু মেঘের অবস্থান। ও কে ছাড়া আমি আমার পৃথিবী কল্পনাও করতে পারবো না। আপনাদের কাছে আমার একটায় রিকুয়েষ্ট প্লিজ মেঘকে আমায় দিয়ে দেন। আমি ও কে রানী বানিয়ে রাখবো আমি, ওর গায়ে কোনোদিন কোনো আঁচড়ও পড়তে দিব না, প্লিজ।”
আলী আহমদ খান কপাল গুটিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“তুমি মেঘ মামনিকে ভালোবাসো এটা কোনোদিন বলেছো আমাদের? এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই। তুমি তোমার জীবনে ফোকাস করো, মেঘ মামনি তার জীবন নিয়ে খুব ভালো আছে৷ ”
প্রায় ৫-৭ মিনিট আবির আর আলী আহমদ খানের কথোপকথন চললো। আবিরের রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে তবুও বার বার নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, মন কে বুঝাচ্ছে, মেঘের কিছু হয় নি, সব ঠিক আছে, মেঘের বিয়ে হতেই পারে না, তানভির সবকিছু সামলে নিয়েছে। আবির শান্ত থাকলেও আলী আহমদ খান বেশ ক্ষুব্ধ। মোজাম্মেল খান ফোন হাতে নিয়ে নিশ্চুপ বসে আছেন। আলী আহমদ খান একায় আবিরের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন। বাবা- ছেলের মাঝে হালিমা খানও কিছু বলতে পারছেন না। আবির এক পর্যায়ে হালিমা খানের কাছে ছুটে গেল। শীতল চোখে হালিমা খানের দিকে তাকিয়ে হিমশীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” মামনি, তুমি তো জানো, মেঘ কোথায় প্লিজ বলো। বিশ্বাস করো আমি তোমার মেয়েকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”
আবিরের চোখে পানি জমে আছে, হালিমা খান আবিরের কব্জিতে হাত রেখে শীতল চোখে তাকালেন। কিছু বলার আগেই আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” তুমি কি আমাদের ম*রার ভয় দেখাচ্ছো? এক মেয়ের জন্য তুমি ম*রে যাবে?”
আবির রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচাল,
” আব্বু, মেঘ এক মেয়ে না। ও আমার জীবনে আসা একমাত্র মেয়ে যার জন্য আমি যা খুশি করতে পারি। আজ আমি যে অবস্থানে আছি সবটায় তার জন্য। গত ৯ টা বছর বুকের উপর পাথর রেখে নিজের আবেগকে চেপে রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি শুধুমাত্র আপনাদের চোখে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার জন্য । আর সেই যোগ্যতা দিয়ে মেঘকে আমার করে নেয়ার জন্য।”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
” এখন এগুলো বললে আর কি হবে। তার থেকে বরং ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করো। তোমার এই অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছে না।”
আবির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করল,
” আমি অন্যকিছু শুনতে চাচ্ছি না, শুধুু বলুন আমার মেঘ কোথায়?”
আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” মেঘ এখন আর তোমার নেই।”
কথাটা কানে ঢুকামাত্র আবির ডানহাতের কব্জি দিয়ে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগে শক্ত করে ধাক্কা মেরে মাত্রাতিরিক্ত রাগে চিৎকার করল,
” মেঘ আমার মানে আমার ই। আমৃত্যু মেঘ আমার ই থাকবে।”
আবিরের শক্ত হাতের ধাক্কায় পানি ভর্তি কাঁচে জগ সাথে থাকা দুটা গ্লাস ফ্লোরে পড়ে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে হুমকি দিলেন,
” জিনিসপত্র ভাঙচুর করছো কেনো? তুমি কি..”
আবিরের অগ্নি ঝরা দুচোখ দেখে থেমে গেলেন স্বয়ং আলী আহমদ খান।আবিরের হৃদয় ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে বিষয়টা সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি আবির। কিন্তু আব্বুর অনবরত অসন্তোষজনক কথায় আবির আর টিকতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, গতকাল থেকে খাওয়া নেই, শরীরে তেমন জোরও পাচ্ছে না। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। আবওর আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খানের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মোজাম্মেল খান এখন নির্বাক, যেন এখানে কিছুই ঘটে নি বা ঘটছে না। ওনি গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছেন। আলী আহমদ খান কপালে ভাজ ফেলে আবিরকে দেখছেন।আবির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। অকস্মাৎ এলোপাতাড়ি ছুটলো নিজের রুমের দিকে। ১ মিনিটের মধ্যে পুনরায় নিচে নামলো। দু’হাত পেছনে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়িয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,
” আমি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, মেঘ কোথায় বলুন, নয়তো…”
মোজাম্মেল খান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আবিরের দিকে তাকালেন। আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইলেন,
” নয়তো কি? ম*রে যাবে?”
“জ্বি।”
মোজাম্মেল খান দীর্ঘসময় পর মুখ খুললেন। ছোট করে বললেন,
” আবির, মাথা ঠান্ডা করো।”
“আমি পারছি না, চাচ্চু। মেঘকে….”
আবিরের কথা সম্পন্ন হবার আগেই আলী আহমদ খান রাগী স্বরে বললেন,
” ঠিক আছে। ম*রে যাও। ”
মোজাম্মেল খান তপ্ত স্বরে বলে উঠলেন,
” কি বলছো কি ভাইজান।”
আবির নিরেট দৃষ্টিতে আব্বুর মুখের পানে চেয়ে আছে। আলী আহমদ খানও বরাবরের ন্যায় কঠোর রূপে বসে আছেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আবির পেছন থেকে হাত সামনে এনে কপালের প্বার্শদেশে রি*ভ*ল*ভর ধরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে তেজঃপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“১০ মিনিটের মধ্যে মেঘ আমার সামনে না আসলে….”
বাকি কথা বলার আগেই আলী আহমদ খান আঁতকে উঠে বললেন,
“কি হচ্ছে কি ! তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”
আবিরের হাতে রি*ভ*ল*ভর দেখে আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান আর হালিমা খান একসঙ্গে কেঁপে উঠলেন। সবার চোখে আতঙ্ক।
“হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। এতগুলো বছর যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি, যাকে নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে আগলে রেখেছি তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। হয় মেঘকে এনে দিবেন নয়তো আমার লা*শ দাফনের ব্যবস্থা করবেন।”
মোজাম্মেল খান মেরুদণ্ড সোজা করে বসে চটজলদি তানভিরকে কল দিচ্ছেন আর উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলছেন,
” আবির, প্লিজ, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। মেঘ এখনি আসতেছে।”
আলী আহমদ খান আবিরের কাছে যেতে নিলে আবির দু পা পিছিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
” আমাকে আটকানোর চেষ্টা করবেন না, প্লিজ।”
মোজাম্মেল খান আলী আহমদ খানকে টেনে সোফায় বসিয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বললেন,
” আবির, আমি জানি তুমি এত দূর্বল মনমানসিকতার ছেলে নও। ভাইজানের মতো তুমিও খুব বিচক্ষণ। তাই বোকার মতো এমন কোনো কাজ করো না যেটা তোমার সাথে সাথে এই পরিবারের সব সুখ-শান্তি নষ্ট করে দেয়।”
আবিরের দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। গলা অব্দি শুকনো মুখ, তবুও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করল। মোজাম্মেল খানের দিকে অদম্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুস্থির কন্ঠে বলতে শুরু করল,
“চাচ্চু,আপনি আমাকে যতই চতুর ভাবুন না কেন সত্যি এটায় আমি বড্ড বোকা। যখন ৬ বছরের অবুঝ মেয়েটা আকুল কন্ঠে আমায় বলেছিল ‘কখনো আমায় ছেড়ে যেতে পারবা না’ আমিও বোকার মতো তাকে ছুঁয়ে প্রমিস করেছিলাম যাই হয়ে যাক না কেনো আমি বেঁচে থাকলে কোনোদিনও ওকে ছেড়ে যাব না। আমি যদি বোকা না হতাম তাহলে সেদিন ওকে প্রমিস করতাম না। আর আজ আপনাদের সামনে চিৎকার করে বলতামও না যে, আমার ওকেই লাগবে। হয়তো আমার জীবনটা মেঘ কেন্দ্রিক হতোই না। আর আমার জন্য আপনাদের এত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানসম্মানও এভাবে নষ্ট হতো না।”
আবির শ্বাস ছেড়ে আলী আহমদ খানের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
“আব্বু, আমি সত্যি দুঃখিত। আপনার মতো একদম বিচক্ষণ মানুষের সন্তান হয়েও আমি এত বোকা হয়েছি, নয়তো একটা মেয়ের জন্য নিজের জীবন দিতে একবার হলেও ভাবতাম। সবসময় আপনিই বলে এসেছেন, কখনো কাউকে কথা দিলে নিজের জীবন থাকা পর্যন্ত সেই কথা রাখার চেষ্টা করতে হয়। যেই মেঘের মোহে জর্জরিত আবিরের হৃদয় সেই মেঘকে দেয়া কথা রাখতে না পারলে আমার এই জীবন রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি না হয় বোকা হয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবো।”
আবিরের দু’চোখ বেয়ে স্বচ্ছন্দগতিতে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে হালিমা খানও নিরবে কাঁদছেন। আলী আহমদ খান অবাক লোচনে ছেলের মুখের পানে চেয়ে আছেন, এই আবিরকে ওনি চিনতে পারছেন না। বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে আবিরকে কোনোদিনও এভাবে কাঁদতে দেখেন নি তিনি। আলী আহমদ খান নিজের বন্ধুমহলে বরাবরই নিজের ছেলেকে একজন সাহসী, বুদ্ধিমান, দৃঢ় মনমানসিকতার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। আজ আবিরের এই রূপ দেখে নিজেই আঁতকে উঠছেন। মোজাম্মেল খানের চোখ ছলছল করছে, অতি সন্তর্পণে নিজের চোখ মুছে নিয়েছেন। আবির চোখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল,
” ১০ মিনিট সময় শেষ।”
আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খান একসঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকালেন। মোজাম্মেল খান ব্যস্ত হাতে তানভিরকে কল দিচ্ছেন। আলী আহমদ খান আবিরকে বুঝাতে ব্যস্ত। আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো এরমধ্যে মেঘ আমার চোখের সামনে না আসলে……
“১”
মোজাম্মেল খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
” ওরা চলে আসছে প্লিজ, থামো।”
“২”
মোজাম্মেল খান আর্তনাদ করছেন, অকস্মাৎ আলী আহমদ খানের নজর মেইন গেইটের দিকে পরে। মেইন গেইট থেকে কিছুটা ভেতরে মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রশস্ত আঁখিতে উদ্বেগ স্পষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মেঘ এসেছে আরও কয়েক সেকেন্ড আগে। আবিরের মাথায় রি*ভ*ল*বার দেখে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা প্রচন্ড বেগে দপদপ করে কাঁপছিল। কয়েক সেকেন্ডেই মস্তিষ্কে একেরপর এক ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আজ থেকে আরও ৭-৮ মাস আগেই মিনহাজ বলেছিল আবিরের কাছে রি*ভ*লবা*র আছে। মেঘ তখন মিনজাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল, ইচ্ছেমতো ঝেড়েছিল। আজ চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে মেঘের দম বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে কেউ শক্ত হাতে গলা চেপে ধরে আছে, নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না৷ এমনকি জোরে চিৎকার করে কিছু বলতেও পারছিল না। আলী আহমদ খানের নজর পড়তেই উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,
“ঐ তো মেঘ। ”
আবির পূর্বের ন্যায় রি*ভ*ল*বার ধরে ঘাড় ঘুরালো। সহসা নজর আটকালো এক অপরূপার পানে। বিস্ময় সমেত তাকালো আবির, মোহনীয় সেই দৃষ্টি। মেঘের পড়নে গাঢ় হলুদ আর রানী গোলাপী পাড়ের শাড়ি, কাঁচা ফুলের গহনায় পুরো গা ভর্তি, কপালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা গাঢ় গোলাপী রঙের জারবেরা ফুলের কারণে মেঘের মায়াবী আদল আরও বেশি রমণীয় লাগছে। মুখে বেশ ভারী মেকআপ, মনোমুগ্ধকর চোখ আর ঠোঁটের আর্ট দেখে আবির কয়েক মুহুর্তের জন্য অবিক্ষুব্ধ হয়ে রইলো।
অন্যমনস্কতায় আবিরের দুচোখ বেয়ে তখনও নিরবধি অশ্রু ঝড়ছে। অলক্ষিতভাবে হাত থেকে রিভলবার পড়তেই আবির আত্মজ্ঞানে ফিরল। মেঘ তখনও পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম্মেল খানের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলেও আলী আহমদ খান গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আবির অব্যবহিতভাবে ছুটলো, মেঘের ঠিক সামনে গিয়ে দুই হাঁটুতে ভর ফেলে ধপ করে বসে পড়লো। অকস্মাৎ মেঘের পেট বরাবর বলিষ্ঠ হস্তে ঝাপটে ধরে উচ্চৈঃস্বরে কান্না শুরু করল। আবিরের নিরন্তর কান্না দেখে মেঘ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
পর পর আব্বু, বড় আব্বু আর ঘাড় ঘুরিয়ে আম্মুর পানে তাকালো, সকলেই নির্বাক চোখে তাকিয়ে আবিরের কান্নার গভীরতা বুঝার চেষ্টা করছেন। মেঘের ভেতরে চলমান তোলপাড় সামলে, নিজেকে শান্ত করে চোখ নামিয়ে আবিরের পানে তাকিয়ে মোলায়েম হাতে আবিরের মাথা জড়িয়ে ধরলো। মেঘের আদুরে স্পর্শে আবির যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবিরের কান্নার শব্দে মেঘের বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর কম্পন শুরু হয়ে গেছে। মেঘ বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে আকুল কন্ঠে বলল,
” আপনি কাঁদবেন না, প্লিজ। ”
আবিরের কান্না থামার নাম ই নিচ্ছে না। গত ৩-৪ দিনে
বুকের ভেতর যে ঝড় চলছিল সেই ঝড়ের সমাপ্তি ঘটছে আজ। কাদম্বিনীকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, কন্ঠ শুনার প্রখরতা, ছুঁয়ে দেখার উমেদ আবিরের অস্তিত্বকে উধাত্ত করে তুলেছিল। তারউপর বাসার অবস্থা দেখে সারাজীবনের জন্য ইহজগতের সমস্ত মায়া ত্যাগ করতে বসেছিল। মেঘ বার বার ঢোক গিলছে, বুক খুঁড়ে কান্না বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। অকস্মাৎ তানভির বাহির থেকে এসে মেঘের কাঁধে হাত রেখে উষ্ণ স্বরে বলল,
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭১
” চোখ বেয়ে যদি এক ফোঁটা পানি পরে আর কিঞ্চিৎ মেকআপও নষ্ট হয় তাহলে তোর খবর ই আছে। দুই ঘন্টা রাস্তায় বসে থেকে তোকে সাজিয়ে নিয়ে আসছি, আমি কিন্তু আর পার্লারে নিয়ে যেতে পারব না। ”