আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৬ (২)

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৬ (২)
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আকাশ জুড়ে রগরগে তারার মেলা, প্রকৃতি ছেয়ে আছে অদ্ভুত শীতলতায়। সমুদ্রের ঊর্মিল ঢেউ শরীরের সাথে সাথে মনকেও প্রাণবন্ত করে তুলছে। মেঘ আবিরের হাতে হাত রেখে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছে, চোখে মুখে উজ্জ্বলতা৷ অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মন অশান্ত হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের পানি আপন বেগে এসে দু’জনের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মেঘ সীমাহীন সমুদ্রের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা আবিরের অভিমুখে তাকায়। আবির মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উদ্দীপ্ত কন্ঠে বলল,

” আমি যেদিন প্রথমবারের মতো কক্সবাজার এসেছিলাম, সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এরপর আসলে তোমাকে নিয়েই আসবো। তানভির অবশ্য আগেও কয়েকবার বলেছিল, তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমিই রাজি হয় নি।”
“কেনো?”
” বাড়িতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছি বলে এই না যে আমি অনুভূতিহীন ছিলাম। বউয়ের সাথে বোনের মতো আচরণ করা কতটা শাস্তিস্বরূপ, এটা তুমি কি বুঝবে! তখন তোমাদের নিয়ে আসলে নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।ঘন্টাখানেক ঘুরে ডিনার করে দু’জন একটু রাত করেই রিসোর্টে ফিরেছে। আবির মেঘের ফোন থেকে বন্যার নাম্বার বের করতে যাবে অকস্মাৎ আবিরের নাম্বার টা চোখে পড়ল। আবির মৃদু হেসে ‘আমার আবির’ এর পেছন থেকে ভাই শব্দটা ডিলিট করে দিয়েছে। বন্যার নাম্বার বের করে একটা মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেঘ বিকেল থেকে বন্যার বোনকে কম করে হলেও ৫০ বার কল দিয়েছে, রিদকে বলামাত্রই কক্সবাজার আসতে রাজি হয়ে গেছে।

বন্যার বোন শুরুতে রাজি না হলেও মেঘের তুমুল জোরাজোরিতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বন্যাকে পাঠাতে রাজি হয়েছে। মেঘ বলেছিল, বন্যার আপুও যেন তাদের সাথে আসে কিন্তু সময়ের অভাবে ওনি যেতে পারছেন না। বন্যার বাসার সবাই রাজি হলেও বন্যা কক্সবাজার যেতে একদম ই রাজি না। মেঘের অতিরিক্ত জোরাজোরির জন্য এক পর্যায়ে মেঘের কল রিসিভ করাও বন্ধ করে দিয়েছে। মেঘ শুয়ে শুয়ে অনর্গল তানভির আর বন্যার কথা বলেই চলেছে। আবির অনেকক্ষণ যাবৎ ট্রাই করতে করতে একসময় তানভিরের ফোনে কল ঢুকেছে। তানভির কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,

” তোমরা কেমন আছো?”
আবির উত্তর না দিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
” আগামীকাল ভোরে আসিফ ভাইয়া, ভাবি, আইরিন, মীমরা সবাই কক্সবাজার আসছে। তোর ইচ্ছে হলে তাদের সাথে আসতে পারিস।”
তানভির শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমার আপাতত ইচ্ছে নেই, তোমরা আনন্দ করো।”
আবির ভারী কন্ঠে বলে উঠল,
” সমস্যা নেই, তোর ইচ্ছে না থাকলে মনের বিরুদ্ধে আসতে হবে না। বন্যা আর তার ভাইও আসবে এই আর কি! ঠিক আছে। রাখি তাহলে।”

“বন্যা কক্সবাজার যাবে?”
“হ্যাঁ”
“আমাদের সাথে? মানে আসিফ ভাইয়া, মীম, আইরিন ওদের সাথে?”
“হ্যাঁ, তুই তো আসবি না। থাক তাহলে।”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,
“কয়টায় রওনা দিবে?”
“আমি জানি না, আসিফ ভাইয়া জানে।”
“আমি আসিফ ভাইয়াকে কল দিচ্ছি।”
“তোর ইচ্ছা। ”

আবির কল কেটে মেঘের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। মেঘ সহাস্যে বলে উঠল,
” আপনার মাথায় এত বুদ্ধি কোথা থেকে আসে?”
” এসব তো কিছুই না, আমার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।”
“কি?”
“এখন বলবো না, আগে ওদের অবস্থা টা বুঝি তারপর। ”
“আপনি যে ভাইয়াকে বলে দিলেন, বন্যা আসবে। বন্যা যদি না আসে?”
“তোমার বান্ধবীকে এমন এক মেসেজ পাঠিয়েছি তার ইচ্ছে না থাকলেও আসতে বাধ্য। ”
“কি মেসেজ?”
আবির মেঘের ফোন মেঘের হাতে দিয়ে বলল,
“দেখো।”
মেসেজে লেখা,

” শুরুতেই সরি বলে নিচ্ছি কারণ খুব সম্ভবত আমি আমার দেয়া কথা রাখতে পারবো না। আপনাকে ভাবি বানানোর ইচ্ছে অচিরেই ভুলে যেতে হবে। আপনি ভাইয়াকে কি বলেছেন আমি জানি না, কিন্তু তারপর থেকে ভাইয়ার মনের অবস্থা খুব খারাপ। ভাইয়ার অবস্থা দেখে বাসার সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাইয়ার মন ভালো না হলে, ৭২ ঘন্টা পরে ভাইয়াকে বিয়ে করাবে। পাত্রীও রেডি আছে। আপনি সম্মতি না দিলে আমরা কিছুই করতে পারছি না। ভাইয়া রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। তবে ৭২ ঘন্টার মধ্যে সঠিক সমাধানে না আসতে পারলে ৭২ ঘন্টা পর পরিবারের পছন্দকেই মেনে নিতে হবে৷ আপনি যদি আমার ভাইকে পছন্দ করেন তাহলে আগামীকাল তাদের সাথে কক্সবাজার আসবেন, আর যদি মনে করেন আপনার আমার ভাইয়াকে প্রয়োজন নেই তাহলে ৭২ ঘন্টা পর আপনার আমাদের বাসায় বিয়ের দাওয়াত রইল। আপন ভাবি হতে না পারলেও দূরসম্পর্কের ভাবির সমান মূল্যায়ন করবো। আপনার জীবন আপনার সিদ্ধান্ত। ভালো থাকবেন, আপন ভাবি বলতে পারছি না তাই আবারও সরি।”

মেঘ মেসেজ পড়ে হাসবে নাকি মন খারাপ করবে সেটাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ই প্রশ্ন করল,
” আপনি যে মেসেজ পাঠিয়েছেন, বন্যা যদি বুঝে যায়?”
“বুঝলে বুঝবে। আজ না হয় কাল সে আমাদের বাড়ির বউ হলে সবকিছুই জানবে। কিন্তু আপাতত তাদের মধ্যেকার ঝামেলা মেটানো প্রয়োজন। ”
মেঘ অকস্মাৎ আহ্লাদী কন্ঠে বললে উঠল,
” বন্যাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাবি বানানোর ব্যবস্থা করুন, প্লিজ। আমার আর ভালো লাগছে না।”
আবির মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইল,
” তুমি তাই চাও?”
“হুমম।”
” ঠিক আছে, ম্যাডাম। তুমি যা চাইবে তাই হবে।”

বন্যা কাঁথা দিয়ে চোখমুখ ঢেকে শুয়ে আছে। সব কাজ শেষ করে বন্যার বোন রুমে আসছে। বন্যাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে শক্ত কন্ঠে বলল,
” কি হয়েছে তোর?”
বন্যা নাক বরাবর কাঁথা নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
” কিছু হয় নি।”
“ব্যাগ গুছিয়েছিস?”
“না।”
“কেনো?”
“আমি যাব না।”
বন্যার বোন বন্যার পাশে বসে কোমল কন্ঠে বলতে শুরু করল,
” ওদের বাসার কেউ কি তোর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে? বিয়েতে কি কোনোরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে?”
“না ”

“তাহলে মন খারাপ করে আছিস কেনো?”
” মন খারাপ না।”
“মেঘ, ওর হাসবেন্ড দু’জনেই খুব করে রিকুয়েষ্ট করছে। আব্বুর সাথে কথা বলে রাজিও করিয়েছে। তোর এখন কি হলো? আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, রিদ আর তোর যত খরচ লাগে সব এখান থেকে করিস। উঠে প্যাকিং কর।”
বন্যার শীতল চোখে বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বন্যার বোন ঠান্ডা কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
“কি বললাম তোকে?”
বন্যা উঠে বসেছে। বন্যার বোন শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“তুই মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না, কোনো বুঝিস না তুই? তিনদিনের মধ্যে ঘুরেফিরে মন ভালো করে বাসায় আসবি। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে জানিস তো? এই অবস্থাতেও তোকে ঘুরতে যেতে দিচ্ছি শুধুমাত্র তোর মন ভালো করার জন্য। তাই কোনোভাবেই মন খারাপ করে থাকা যাবে না, ওকে?”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
“ওকে”

সকাল সকাল সবাই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মীম, আইরিন আর বন্যা পাশাপাশি বসেছে। তানভির, রিদ আর আরিফ বিপরীত পাশে। আসিফ আর জান্নাত আলাদা বসেছে। মীম, আইরিন, আরিফ মিলে রিদের সাথে টুকটাক দুষ্টামি করছে। রিদ বয়সে আইরিন আর মীমের মতোই। বন্যা কারো সাথে তেমন কোনো কথায় বলছে না, নির্বাক চোখে শুধু তানভিরকেই দেখছে। তানভির প্রায় পুরো রাস্তায় চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। দু একটা কথা বললেও বন্যার সাথে না কোনো কথা বলেছে আর না একবারের জন্যও তাকিয়েছে। মেঘ আর আবির আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। মেঘ আজ সবুজ রঙের মোটামুটি গর্জিয়াছ একটা শাড়ি পড়েছে, যদিও শাড়িটা আবিরই পড়িয়ে দিয়েছে। মেঘের শাড়ির সাথে মোটামুটি ম্যাচিং করে আবিরও একটা সবুজ পাঞ্জাবি পড়েছে। মীম, আইরিনরা নেমেই ছুটে মেঘের কাছে চলে গেছে। তাদের সাথে সাথে রিদও মেঘের সাথে কথা বলতে চলে গেছে। তানভির নামতেই আবির এগিয়ে এসে তানভিরকে জড়িয়ে ধরল। তানভির জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে ভাইয়া?”
“তোকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো।”
মনের ভেতরের চাপা কষ্টের জন্য মন খুলে হাসতেও পারছে না তবুও তানভির মলিন হাসার চেষ্টা করল। সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেই ঘুরতে বেড়িয়েছে। আইরিন আর আরিফ দুই ভাই বোন এটা সেটা নিয়ে ফাজলামো করছে আবার বড় আপুকে ভিডিও কল দিয়ে সমুদ্র সৈকত দেখাচ্ছে। মীম আর রিদ টুকটাক কথা বলছে। রিদ এর আগে কোথায় কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল, কার সাথে গিয়েছিল, এখানে কেন আসছে সেসব নিয়েই গল্প করছে। মেঘ আর বন্যা কিছুটা দূরে, মেঘ ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” তোর আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছে? ”
“কিছু না।”
“কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। ভাইয়া কি তোর সাথে রাগারাগি করেছে?”
“না।”
“তাহলে?”
” আমি ওনার সাথে রাগ দেখিয়েছি।”
“কেনো?”
“জানি না।”

এদিকে আবিরও তানভিরকে বার বার জিজ্ঞেস করছে কিন্তু তানভির সরাসরি কোনো উত্তর ই দিচ্ছে না। তানভিরের নিস্তব্ধতায় আবিরের মেজাজ চরমভাবে খারাপ হচ্ছে। ঘুরাঘুরি শেষে যে যার মতো রুমে গেলেও আবির আর তানভির যায় নি। আবির তানভিরের কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইল,
” তুই কি ভেবেছিস, নিজের মধ্যে কষ্ট চাপিয়ে রাখলে সব ঠিক হয়ে যাবে?”
“ঠিক হবে না জানি তবুও আমি কারো সুখের সময়ে দুঃস্বপ্ন হতে চাই না।”

” কোন দুঃস্বপ্নের কথা বলছিস? তুই খুব ভালো করেই জানিস তুই না থাকলে আমার সুখের স্বপ্নগুলো এখনও দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকতো। তুই আমার ভাই হয়ে আমাকে না জানিয়ে এত বড় কাজ করেছিলি বলে আমি অভিমান করে তোকে না জানিয়ে তোর বোনকে এখানে নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু তোর দুঃখ ভুলে আমি সুখের সময় কাটাতে পারতাম না ভাই। তাই বাধ্য হয়ে তোদের জোর করে এখানে আনিয়েছি। এখন বল তোর কি হয়েছে?”
“আমি নিয়তির কাছে আবারও হেরে গেলাম ভাইয়া। বন্যার চোখে আমি তানভির অযোগ্য ই রয়ে গেলাম। আমি ভাই হিসেবে যথাযথ হলেও প্রেমিক হিসেবে পরিত্যক্ত। ”

“বন্যা কি বলেছে?”
” আমাকে বাস্তবতার তিনপাতা অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি বুঝিয়ে।”
আবির মৃদু হেসে বলল,
” এটা আর এমন কি! প্রেমিকার চোখে নিজের প্রেমিক সবসময় নিষ্কর্মা আর অযোগ্যই থাকে৷ ”
“ও ওর পরিবারের সিদ্ধান্তের বাহিরে কিছু করতে পারবে না।”
” পরিবারের সিদ্ধান্তের বাহিরে কিছু করতে বলেছে কে?”
তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী স্বরে বলল,
” ও আমাকে রিজেক্ট করেছে।”
আবির উচ্চ শব্দে হেসে বলল,

” রিজেক্ট তাকেই করা যায় যার অবস্থান মন আর মস্তিষ্ক কোথাও নেই। হৃদয়ে জায়গা দেয়া মানুষকে রিজেক্ট করা অসম্ভব। তুই তার উপর রাগ করে ফোন বন্ধ করেছিস আর সেই রাগ সে আমার বউয়ের উপর ঝেড়েছে। কারণ বন্যার প্রিয়মানুষ তুই আর তোর কাছের মানুষ মেঘ। অধিকারবোধ না থাকলে কেউ কারো উপর রাগ দেখায় না তানভির। তুই খুব ভালোভাবেই জানিস, বন্যা বাস্তববাদী একটা মেয়ে। সে তোকে বাস্তবতা নিয়েই জ্ঞান দিবে, এই নিয়ে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না। ”
তানভির কিছু বলছে না দেখে আবির আবারও বলল,

” তুই বন্যার জন্য রাজনীতি ছেড়েছিস এটা কি সে জানে?”
“না।”
“তুই চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিস, এটা কি জানে?”
“না।”
আবির চোখ রাঙিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ই বলে উঠল,
” শুক্রবারে বন্যার বড় আপুর বিয়ে, জানিস কিছু?”
” হ্যাঁ, আপাতত শুধু কাবিন হবে। ৫ থেকে ৬ মাস পর অনুষ্ঠান হবে শুনেছি।”
“তোকে কে বলল?”

“রিদ।”
“বাহ! এখনই শালার সাথে এত মিল। ”
“এত মিলের কিছু নেই। আসার সময় বলেছে তাই শুনেছি। ”
আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আচমকা ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করল,
” তোকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, তুই কি বন্যাকে ভালোবাসিস?”
তানভির আবিরের দিকে তাকিয়ে নিরেট কন্ঠে জবাব দিল,
” হ্যাঁ।”

” এক মুহুর্তের জন্য মেনে নিলাম তুই অযোগ্য কিন্তু তোর ভালোবাসা কি বিয়ের যোগ্য? নাকি এখনও মনে দুটানা আছে? মনের কোণে অভিশঙ্কা নিয়ে প্রেম হয় কিন্তু সারাজীবন পাশে থাকার সাহস হয় না। তোকে
নির্ভীক ভঙ্গিতে বলতে হবে, যেকোনো মূল্যেই হোক বন্যাকে তোর চাই। প্রেমিকা কোনো কারণে রাগ দেখালে প্রেমিকার উপর রাগ করে ফোন বন্ধ করাটা বোকামি বরং প্রেমিকার রাগের কারণ উদঘাটন করাটা একজন আদর্শ প্রেমিকের কর্তব্য। বন্যা তোকে ভালোবাসে তাই ওর রাগ অভিমান প্রকাশের একমাত্র জায়গা তুই। হয়তো মেঘের মতো ও সরাসরি কিছু বলতে পারে না কিন্তু তোর উচিত তার কথার সঠিক মানে বুঝা। ভাই, ভালোবাসার মূল্য ভালোবেসেই দিতে হয়।”

তানভির ঢোক গিলে অক্লিষ্ট কন্ঠে শুধালো,
” এখন আমার কি করা উচিত?”
আবির মেকি স্বরে বলল,
” সামনে সমুদ্র আছে, যা এক বালতি পানি খেয়ে আয়।”
“ফাজলামো করো না, প্লিজ।”
” সকালে বন্যার সাথে আমি কথা বলবো। তারপর তোর যা ইচ্ছে করিস।”
“যা ইচ্ছে? ”
আবির আড়চোখে তাকিয়ে গুরুভার কন্ঠে বলল,
” রিলাক্স। ”

তানভির নিঃশব্দে হাসল, সাথে আবিরও হাসল। দুই ভাইয়ের কথাবার্তা শেষ করে রিসোর্টে ফিরতে অনেকটায় দেরি হয়ে গেছে। মেঘ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আবির রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়েছে। ঘুমন্ত মেঘের শান্ত আদলখানা আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে৷ আবির আবেশিত নয়নে মেঘকে দেখছে, এই দেখার কোনো অন্ত নেই। আবিরের হৃদয় জুড়ে যার অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত ত*র্জনগ*র্জন দিয়ে উঠে তার সংস্পর্শ পেলেই আবিরের হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। দিনশেষে প্রতিটা মানুষ কারো না কারো কাছে দায়বদ্ধ, কারো ভালোবাসায় পরিতৃপ্ত। মেঘের পূর্ণতা যেমন আবির তেমনি আবিরের পূর্ণতাও মেঘ। সুদীর্ঘ সময়ের নিরীক্ষণ শেষে আবির আলতো হাতে মেঘের মসৃণ গাল স্পর্শ করল। মেঘ ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠেছে। কুণ্ঠায় চোখ মেলতেই আবিরকে দেখতে পেল। আবির সস্নেহে প্রশ্ন করল,

” ভয় পেয়েছো?”
মেঘ শুকনো ঢোক গিলে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করল। কোনো কথা না বলে আচমকা আবিরের চত্তড়া বক্ষস্থলে নিজের জায়গা করে নিল। আবির মুচকি হেসে মেঘকে জড়িয়ে ধরে মেঘের চুলে হাত বুলাতে লাগলো। কিছু সময় নিরবতায় কেটে গেল। মেঘ হঠাৎ ই আবিরের উন্মুক্ত বুকে নখ দিয়ে আঁচড় দিতে দিতে ডাকল,
” শুনছেন..!”
আবির শক্ত কন্ঠে বলল,
” তুমি ডাক শুনার যোগ্যতা কি আমার নেই?”
” আছে, কিন্তু ”

“কিন্তু কি? আমি যদি তুই থেকে তুমিতে আসতে পারি তুমি কেনো আপনি থেকে তুমিতে নামতে পারছো না?”
মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠল,
” তুমি তুমি তুমি। হয়েছে? ”
“হুমমমমম। এখন বলো আবির ”
“আবির ভাই।”
আবির মেঘের মাথায় আস্তে করে গাট্টা দিয়ে ভারী কন্ঠে বলল,

” আবিরের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক ম*রে গেছে। এখন শুধু আবির আছে। বলো আবির”
মেঘ কিছুই বলছে না, তর্জনী আঙুলের নখ দিয়ে আবিরের বুকের উপর A+ M লেখায় ব্যস্ত। মেঘের লেখা শেষ হতেই আবির মেঘের হাত চেপে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” বুকের উপর A + M লিখতে হবে না, ম্যাডাম। এই নাম হৃদয়ে স্থায়ীভাবে লেখা হয়ে গেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই নাম অক্ষত থাকবে। আপনাকে যেটা বলেছি সেটা বলুন ।”
মেঘ বলল,

“কি বলব?”
” আবির।”
” আ.. আবির। ”
“গুড গার্ল, আবার বলো।”
“ইশশ, আর পারবো না। আমি কি স্কুলে পড়তে আসছি নাকি?”
“হ্যাঁ, তুমি আবিরের স্কুলে ভালোবাসার ট্রেনিং করতে আসছো, বলো।”
“আবির”
“এখন পুরোটা বলো”
মেঘ শীতল কন্ঠে বলল,
“আবির শুনছো?”
আবির নিঃশব্দে হেসে বলল,

” উফফ! তুমি এভাবে ডাকলে আমি বিনাশের দোরগোড়া থেকেও ফিরে আসতে সক্ষম হবো।”
মেঘ অতর্কিতে আবিরের বুকে চিমটি কাটল। আবির মৃদুস্বরে ফের বলল,
” কি বলতে চেয়েছিলে, বলো।”
“আমি একবার আপনার অফিসে গিয়েছিলাম। আপনার রুমের দেয়ালে D লেখা ছিল। তখন আপনি আমাকে D এর মানে বলেন নি। আপনার বেশকিছু ফেসবুক পোস্টেও D লেখা দেখেছি। এই D এর মানে কি?”
“দিলশা।”
“দিলশা মানে কি?”

“হৃদয়ের রাণী। ছোটবেলা স্কুলে কারো মুখে এই নামটা আমি প্রথম শুনেছিলাম। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করায় সে এই অর্থটায় বলেছিল। বাসায় এসে আমার সে কি বায়না, তোমার নাম যেন দিলশা রাখে। এমন আজগুবি নাম শুনে বাসার মানুষ আমার কথা কানেই তুলে নি। তখন মনেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, আমার হৃদয়ের রাণীকে শুধু আমিই দিলশা ডাকব। নামটা সুন্দর না?”
মেঘ অনুষ্ণ কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ, খুব সুন্দর। ”
“তোমাকে দিলশা ডাকলে রাগ করবে না তো?”
“একদম ই না। আপনার যা ইচ্ছে তাই ডাকতে পারেন। আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে।”
“কি?”

“বাসায় যখন আমার বিয়ের আলোচনা চলছিল তখন কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনি প্রথম বিয়েটা ভেঙেছিলেন, দ্বিতীয়বার মীম আপনাকে জানিয়েছিলো। কিন্তু তৃতীয় বার তো মীম বাসায় ছিল না আর আমার কাছেও ফোন ছিল না। আমার জানামতে বাসার কেউই আপনাকে জানায় নি।তখন আপনাকে কি বাহিরের কেউ বলেছিল?”
” বাহিরের মানুষ শুধু বাহিরের নিউজ দিতে পারে। বাড়ির ভেতর কি চলে এটা কিন্তু তারা জানে না।”
“তাহলে আপনি কিভাবে জেনেছিলেন?”
“তোমার আব্বু আমাকে মেসেজ দিয়েছিলেন।”
“আব্বু?”
“হ্যাঁ”

“কিন্তু তখন তো আব্বু খুব রাগারাগি করছিলেন৷ আমাকে ছেলের সামনে যেতে জোরাজোরি করছিলেন।”
” সেসব ওনার প্ল্যান ছিল, আমি বাসায় পৌঁছানোর আগে তোমাকে ছেলেপক্ষের সামনে আনতে পারলে আমি কিভাবে রিয়েক্ট করি সেটায় দেখতে চেয়েছিলেন। সেদিন শুনোনি সবই ওনার পরিকল্পনা ছিল।”
“আব্বু মেসেজ দিয়েছে জানার পরও আপনি এত ভীত ছিলেন কেনো?”

“মেসেজ যে তোমার আব্বু দিয়েছেন সেটা আমি প্রথমে জানতাম না। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ আসছিল। আমি দেশ ছাড়ার আগের দিন তোমাকে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে রাকিবদের সাথে বসেছিলাম সেখানেই এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। ওনি এই সেক্টরে জব করেন। নরমাললি ফেসবুকে এড হয়েছিলাম। বাহিরে থাকাকালীন হঠাৎ আমার ঐ নাম্বারটার কথা মনে পড়ে, কৌতূহল বশত নাম্বার টা ভাইকে পাঠিয়ে বলেছিলেন ডিটেইলস সংগ্রহ করে দিতে পারবে কি না। একদিনের মধ্যে ওনি ডিটেইলস সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। সিমটা তোমার আব্বু মানে আমার শ্বশুরের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা ছিল। আমি সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। ৫০% সিউর ছিলাম ওনি আমাদের কথা জানেন আবার ৫০% সন্দেহও ছিল। তাই তখন বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি।”

” ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?”
“সকালে তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলব তারপর যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নিব। তুমি আমার সাথে থাকবে।”
“আচ্ছা। ”
“এখন ঘুমাও, ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখতে হবে তো?”
“হ্যাঁ, শুভ রাত্রি। ”
“শুভ রাত্রি।”

সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও পাশাপাশি দুটা রুমে দুই কপোত-কপোতীর চোখে ঘুম নেই। বন্যা, মীম, আইরিনের জন্য একটা রুম নেয়া হয়েছে। মীম, আইরিন ঘুমে তলিয়ে আছে। বন্যা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে আর বার বার ফোন হাতে নিচ্ছে। তানভিরের নাম্বার বের করে দু একবার কল দেয়ার চেষ্টা করেছে আবার ফোন রেখে দিয়েছে। পাশের রুমে থাকা তানভিরও একইভাবে ছটফট করছে।
ভোরে আলো ফোটার আগেই সবাই সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে গেছে। তবে জান্নাত আর আসিফকে কেউ ই ডাকে নি। আবির আগেই বলেছিল তাদের বিরক্ত করবে না তাই ইচ্ছে করেই ডাকে নি। তানভির কিছুক্ষণ দাঁড়ালো, মেঘ আর আবিরকে একসঙ্গে কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে চুপচাপ চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই আসিফ আর জান্নাত আসছে। আবিরের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

” আমাদের ডাকলি না কেনো?”
“তোমাদের হানিমুনের সুযোগ দিলাম।”
“বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এখন আর আমাদের সেই সুযোগ দরকার নেই ভাই। তোরা নবদম্পতি, এখন সুযোগ তোদের লাগবে।”
আবির মেকি স্বরে বলল,
“আমাদের সুযোগ করে দিতে হবে না, নিজেরায় করে নিতে পারব।”
” এই জন্যই তো বাসর রাতে বউ নিয়ে পালাইছিস।”
আবির শব্দ করে হাসল। সাথে আসিফও। মেঘ, মীম, বন্যা, আইরিন, জান্নাত সবাই সমুদ্রে পা ভেজাচ্ছে। ঢেউয়ের গতিতে ছুটোছুটি করছে। আরিফ আর রিদও তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। আবির আর আসিফ তানভিরের বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল। একসময় আসিফ সবাইকে নিয়ে নাস্তা করতে চলে গেছে। বন্যা তাদের সঙ্গে যেতে নিলে আবির গম্ভীর কন্ঠে ডাকে,

“বন্যা,দাঁড়াও”
“জ্বি ভাইয়া।”
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
মেঘ চুপচাপ আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবির এক পলক মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ চোখের ইশারায় বলতে বলল। আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলতে শুরু করল,

“তোমার তানভিরের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে আমি জানি না আর জানতেও চাই না। আজ আমি তানভিরের ভাই না বন্ধু হয়ে কয়েকটা কথা বলব। তুমি ইতোমধ্যে জানো তানভিরের জীবনে কেউ একজন ছিল, তুমি তাকে দেখেওছো। সেসব কৈশোরের আবেগ ছিল। এখন সে আগের থেকে অনেক বেশি ম্যাচিউর হয়েছে। তোমাকে তানভির ছোট থেকে চিনলেও কখনো তোমাকে নিয়ে সেভাবে ভাবে নি। যেদিন প্রথমবারের মতো ও তোমাকে নিয়ে ভেবেছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ও শুধু নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টায় আছে। ওর লাইফস্টাইল বরাবরই ছন্নছাড়া, শুধু তোমার জন্য সেই লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এনেছে। আমি এখন পর্যন্ত তানভিরকে কম করে হলেও ৫০ টা ঘড়ি কিনে দিয়েছি কিন্তু ও কোনোদিন ভুলেও একটা ঘড়ি পড়ে নি। অথচ তুমি একবার তাকে একটা ঘড়ি দিয়েছিলে, সে ঐ ঘড়িটা ঠিকই পড়েছে। এমন ছোটখাটো হাজারো পরিবর্তন ওর মধ্যে এসেছে। প্রথম প্রথম আমি ও কে বলে বলে সব কাজ করাতাম, এখন সে আমার থেকেও বেশি বুঝে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা ও একা হাতে সামলিয়েছে।

তানভিরের জেদ সম্পর্কে তোমার কিছুটা হলেও ধারণা হয়তো আছে। তোমার মুখ থেকে কোনো একদিন শুনেছিল, তোমার আব্বু তোমাদের সরকারি চাকরিজীবী ছেলের কাছে বিয়ে দিবে, সেদিনই রাজনীতি ছেড়ে চাকরি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বই কিনে পড়াশোনাও শুরু করে দিয়েছে। তুমি যেমন বাস্তববাদী তানভিরও নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করতে চেয়েছে। তবে প্রতিটা মানুষের আবেগ, অনুভূতি ভিন্নরকম। হয়তো ওর মনে হয়েছিল তোমাকে তার অনুভূতি জানিয়ে রাখবে তাই তোমার সামনে নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে চেয়েছিল। তোমাকে আমি ছোট করে কথা বলছি না কিংবা দোষারোপও করছি না, শুধু তানভির অবস্থান টা বুঝানোর চেষ্টা করছি।

তানভির যদি একবার বলে সে চাকরি, ব্যবসা কিছুই করবে না তবুও তাকে কেউ কিছু বলবে না অন্ততপক্ষে আমি তো নয় ই। ও চাইলে আমি ওকে সারাজীবন বসিয়ে খাওয়াতে পারব। আমার টাকায় নয় বরং ওর নিজের টাকায় বসে খেতে পারবে। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা, তানভিরের ব্যাংক ব্যালেন্স বাদ দিলাম। সবাই জানে আমার ছোটখাটো বিজনেসের ৭০% শেয়ার আমার নামে।

কিন্তু তারা কেউ এটা জানে না এই ৭০% শেয়ারের মধ্যে ২০% শেয়ার তানভিরের, ২০% মেঘের, ২০% আমার আর বাকি ১০% মীম আর আদির। এই কথা তানভির পর্যন্ত জানে না। আমি কোনোদিন ও কে জানানোর প্রয়োজনও মনে করি নি। আমি তানভিরকে সবসময় সুযোগ দিয়েছি, ও যখন যা চেয়েছে তাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। তানভির ব্যবসায় অমনোযোগী বলে চাচ্চু প্রায় প্রায়ই রাগারাগি করেন। কিন্তু মেঘ, আমি আমরা দু’জনেই তানভিরকে পুরোপুরি সাপোর্ট করছি যেন পড়াশোনা করে একটা জব নিতে পারে। তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই তানভির সবকিছু ছেড়েছে, সেই তুমিই যদি তার হাত ছেড়ে দেও। ও কি করবে বলো?”
বন্যা ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,

” ওনি আমার কথাতে এতটা কষ্ট পাবেন আমি বুঝতে পারি নি। ওনি আমার জন্য রাজনীতি ছেড়েছেন, চাকরির চেষ্টা করছেন এগুলোর কিছুই আমি জানতাম না৷ আমার আব্বু রাজনীতি পছন্দ করেন না, এমন অগোছালো জীবনযাপনও পছন্দ করেন না। আমি আমার পরিবারের সম্মতি ছাড়া কিছু করতে পারবো না এমনটায় বুঝিয়েছিলাম।”
“তোমার পরিবারের সম্মতি থাকলে তো তোমার কোনো সমস্যা নেই?”
” না।”
“ঠিক আছে। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, তানভিরকে পাঠাচ্ছি। যত দ্রুত সম্ভব মনোমালিন্য ভেঙে মন হালকা করো।”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,

“বউ, চলো।”
বন্যা শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
” মেঘ এখানে থাকুক।”
আবির ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা দিল, মেঘ সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথা চেপে ধরে বলতে শুরু করল,
” আমার মাথাটা জানি কেমন করে ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছি। প্রেশারটা মনে হয় ২০ এ নেমে গেছে। ”
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
” হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? তাড়াতাড়ি রুমে চলো। এখানে আর থাকা যাবে না। তোমাকে কি কোলে নিতে হবে?”
মেঘ কিছু বলার আগেই আবির মেঘকে কোলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্যা থ হয়ে তাকিয়ে আছে।আশেপাশে অনেক মানুষের ভিড়, বন্যা একা একা হাঁটছে আর মনে মনে ভাবছে। মেঘ গতকাল কতগুলো ফুল কিনেছিল সেগুলো যত্ন করে পানির বোতলে ভিজিয়ে রেখেছিল। মেঘ দ্রুত রুম থেকে সেই ফুলগুলো নিয়ে আসছে। তানভিরের হাত ফুলগুলো দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

” ঠিকমতো প্রপোজ করতে না পারলে আজকের পর আমার ভাবির দিকে ভুলেও তাকাতে পারবে না এই আমি বলে রাখলাম। এইযে আমার ওনি সাক্ষী। ”
আবির নিরেট কন্ঠে বলল,
” একদম ঠিক, আজকেই তোর জন্য লাস্ট চান্স। আজকের পর আমরা কেউ তোর সাথে নেই। ”
তানভির মলিন হেসে বলে উঠল,
” আজ আবার কোন যুদ্ধ হতে চলেছে কে জানে”
মেঘ ফের বলল,
“এক্সেপ্ট না করা পর্যন্ত ফিরে আসবে না। খিদায় বেহুশ হয়ে গেলেও না৷ ”
“ঠিক আছে বোন আমার। আপনি যা বলবেন তাই হবে।”

তানভির ফুলগুলো হাতে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে আসলো। এত এত মানুষের ভিড়ে বন্যাকে খোঁজে পেতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। বন্যা সমুদ্রের পাড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তানভির বন্যার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই বন্যা চমকে উঠে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। এক পলক তাকিয়ে তানভিরকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তানভির বন্যার কান্ড দেখে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল,
“নিষ্করুণ এই পৃথিবীতে অপ্রিয় কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে শরীর ছুঁয়ে গেলেও একটা মেয়ে যেভাবে রিয়েক্ট করে, সেই রিয়েক্ট টা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে কখনোই করতে পারে না। হৃদয়টাকে আজীবন বেঁধে রাখবে বলা মেয়েটাও একটা সময় কারোর প্রতি অস্বাভাবিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে৷ তাই না বন্যা?”
বন্যা মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,

” সেদিন আপনার সাথে এভাবে রিয়েক্ট করা আমার একদমই উচিত হয় নি। আমি সত্যি দুঃখিত। মেঘের বিষয়, বাসার সব বিষয় নিয়ে সেদিন একটু বেশিই চিন্তিত ছিলাম। বার বার বলেছিলাম আমি কথা বলতে চাইছি না তবুও আপনি জোর করছিলেন তাই না চাইতেও রাগ দেখিয়ে ফেলেছিলাম। আমি শুধু আমার পরিস্থিতিটা বুঝাতে চেয়েছিলাম আপনি সেটা না বুঝেই রাগ করে ফোন বন্ধ করে দিলেন। আপনার কি একবারের জন্যও আমার কথা মনে হয় নি? একবারও আমার কথা ভাবলেন না৷ আমি সবসময় দেখে আসছি আপনি খুব দায়িত্বশীল একটা ছেলে, আপনার দায়িত্ববোধ আর অপ্রকাশিত যত্ন দেখে আমি বার বার মুগ্ধ হয়েছি সেই আপনি কি না আমার সাথে এমন কাজ করলেন? মেঘের বিয়ের আগেও ২-৩ দিন আমার কল রিসিভ করেন নি, নাম্বার ব্লক করে রেখেছিলেন, এখন একদম বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন৷ এই আপনার দায়িত্ববোধ?”

বন্যা শেষ কথাগুলো বলতে বলতে কান্না করে দিয়েছে। তানভির আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, বেশকয়েকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির সহসা বন্যার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” কান্না করো না, প্লিজ। আমি সেদিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। আর কখনো এমন হবে না, সরি। ”
বন্যা কাঁদতে কাঁদতে ফের বলতে শুরু করল,
” আপনি একটা পাষাণ, নিষ্ঠুর। আমার উপর রাগ করে আমাকেই কষ্ট দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। আপনি বাড়ি থেকে না গেলে তো আপনার বিয়ে ঠিক হতো না। আপনি এমনটা কেনো করলেন? ভালো হয় বিয়ে করার আগে আমাকে এই সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে মে*রে ফেলুন।”

বন্যার দুচোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ একহাতে বন্যার চোখের পানি মুছতে মুছতে শঙ্কাজনক কন্ঠে বলতে শুরু করল,
“এই মেয়ে চুপ করো। কি সব বাজে কথা বলছো! আমার আবার কিসের বিয়ে? বিয়ে যদি করতেই হয় আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তুমি রাজি হলেও তোমাকে করবো না হলেও তোমাকেই বিয়ে করবো। হয় হিরোর মতো বিয়ে করবো নয়তো ভিলেনের মতো করবো। তবুও তোমাকেই বিয়ে করবো। এই তানভির শুধু বন্যার, আজ এই মুহুর্ত থেকে তুমি শত রাগ করলেও আমি সব সহ্য করে নিব। আমি নিষ্ঠুর হলেও তোমারই থাকবো, পাষাণ হলেও তোমারই থাকবো। বুঝেছো মেয়ে?”

বন্যা শীতল চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আচমকা তানভিরকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিক ঘটনায় তানভির কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। আশেপাশে অবেক্ষণ করে কাঁপা কাঁপা হাতে বন্যার পিঠে হাত রাখলো। প্রথমবারের মতো তানভির বন্যার ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করতে পারছে। তানভিরের হৃৎস্পন্দনের সাথে সাথে পেটের নাড়িগুলোর ধপধপ করে কাঁপছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগাচ্ছে। এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ অসম্ভব। মেঘদের বন্ধুমহলের সবচেয়ে ম্যাচিউর মেয়েটা আজ বিবেক ভুলে আবেগের কাছে ধরা দিতে বাধ্য হলো। খোলা আকাশের নিচে, শত শত মানুষের মাঝে পরিপক্কতা ভুলে ছোট বাচ্চার মতো তানভিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বেশ কিছুটা সময় তানভির নিজেও বন্যার আবেশে আবদ্ধ ছিল, সেই আবেশ কাটিয়ে বন্যার কানের কাছে ফিসফিস করল,

” এভাবে কেঁদো না প্লিজ, মানুষ উল্টাপাল্টা ভাববে । ”
বন্যা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
” ভাবুক। ”
বন্যা তানভিরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যা হবে দেখা যাবে ভেবে তানভিরও বন্যাকে বলিষ্ঠ হাতে জড়িয়ে ধরল। তানভিরের হাতে থাকা ফুলগুলো বন্যার পিঠে লাগছে, ফুলে থাকা পানিতে বন্যার জামা ভিজে যাচ্ছে। বন্যা বুঝতে পেরে তানভির ছেড়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করল। তানভির বন্যার পিঠ থেকে হাত সরাতেই ফুলগুলো দেখতে দেখতে পেল। বন্যা তানভিরের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

” এগুলো কার জন্য এনেছিলেন?”
“আসার সময় বনু দিল, তোমাকে দেয়ার জন্য। ”
“দিচ্ছেন না কেনো? নাকি অন্য কাউকে দিতে চান?”
তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” তানভিরের জীবনে বন্যা এক এবং অনন্য নারী। দিলে তোমাকেই দিব। কিন্তু কথা হলো, হাঁটু গেড়ে না দিয়ে এমনি দিয়ে দিলে কি তুমি রাগ করবে? না মানে, আশেপাশে অনেক মানুষ আছে হাঁটু পানিতে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করলে যদি হাসাহাসি শুরু করে তখন তো নিজেকে জোকার মনে হবে।”
বন্যা চারপাশে নজর বুলিয়ে নিঃশব্দে হেসে বলল,
” ঠিক আছে, এমনি দেন।”

তানভির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,
” তোমার নামটা বন্যা হলেও আমার জীবনে তোমার কর্মকাণ্ড পুরো অগ্নিকান্ডের মতন। তুমি আমার চোখে মুগ্ধতার আনন, হৃদয়ের উষ্ণ প্লাবন। আমার ছায়াবৃত জীবনের দীপ্তি তুমি, স্বপ্নহীন জীবনের স্বপ্ন। তুমি আমার ছন্নছাড়া জীবনের সুনিপুণ নাটাই। এই বিস্তৃত জলরাশিতে দাঁড়িতে বলতে চাই,
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় যার কোনো অন্ত নেই। আমাদের জীবনে যত ভাটায় আসুক না কেনো সব ভাটা উপেক্ষা করে আমার ভালোবাসা জোয়ারের মতো সীমাহীন গতিতে বাড়তেই থাকবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বন্যা, খুব বেশি ভালোবাসি।”
বন্যা তানভিরের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে মুচকি হেসে বলল,

” ওহ আচ্ছা। আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন? আমি তো জানতাম ই না। যাই হোক, ফুল দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ”
তানভির হুঙ্কার দিল,
“ভালোবাসি বলো”
“না বললে কি করবেন?”
” এতক্ষণ হিরো ছিলাম এখন ভিলেন হয়ে যাবো। ”
“মানে?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৬

তানভির ঠোঁট কামড়ে হেসে বন্যার কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে, বন্যা একপা দু’পা করে পেছাতে পেছাতে একপর্যায়ে আতঙ্কে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
” আমিও আপনাকে ভালোবাসি।”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৭