আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৭
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
আসিফ জান্নাতদের ব্রেকফাস্ট প্রায় শেষদিকে এমন সময় আবির আর মেঘ আসছে। আসিফের সাথে দু একটা কথা বলে খেতে বসেছে। আইরিন নিজের মতো খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে জান্নাতকে এটা সেটা বলছে। রিদ আর মীম পাশাপাশি বসেছে, দু’জনেই বিভিন্ন প্রকার খাবারের নাম নিয়ে দুষ্টামি করছে। কক্সবাজার আসতে আসতে রিদের সাথে মীমের খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। যদিও রিদ মীমের থেকে বয়সে কিছুটা ছোট তবুও তাদের বন্ডিং খুব ভালো।
দু’জন দু’জনকে তুই তুই করে বলে, রিদ যেখানেই যায় মীমকে ডেকে নিয়ে যায়, কিছু খেলে মীমকেও দেয়। আরিফ গতকাল ট্রেন থেকেই এসব দেখে আসছে, তখন সেভাবে কিছু মনে হয় নি৷ কিন্তু রাতের আড্ডার পর থেকে আরিফের মনটা ভার হয়ে আছে। কেনো? কি হয়েছে? এর কোনো উত্তর আরিফের কাছে নেই। ভোর থেকে মন খারাপ যেন রাগে পরিণত হয়েছে। মীম আর রিদকে একসঙ্গে দেখলেই মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মীম আরিফের সাথে কথা বলা তো দূর তাকিয়েও দেখে না আর এই বিষয়টায় আরিফের সহ্য হচ্ছে না। বেশ কয়েকবার মীমের সাথে কথা বলার চেষ্টাও করেছে কিন্তু মীম “আচ্ছা, হু, ওকে” বলে কথা কাটিয়েছে। আরিফ অনেকক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আচমকা খাবার রেখে উঠে গেছে। আবির চোখ তুলে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কিরে, খাবি না?”
“খিদে নেই ভাই।”
আরিফ হনহন করে চলে গেছে। আসিফ, জান্নাত, আইরিন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আনমনে বলে উঠল,
“ওর আবার কি হলো?”
আরিফকে ইচ্ছেকৃত খোঁচানো টা মীমের স্বভাব, আজও তেমন কিছু করেছে কি না সেটা বুঝতেই মেঘ কিছুটা ঝুঁকে মীমকে দেখে নিল। মীম তখনও রিদের সাথে গল্পে মেতে আছে। মেঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আবিরও বেশ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে, একেকটা আইটেম চেক করছে ভালো লাগলে মেঘকে দিচ্ছে আর ভালো না লাগলে আগেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আজ সবাই সেন্ট মার্টিন যাবে তাই খাওয়াদাওয়া শেষ করেই যে যার মতো রেডি হতে চলে গেছে। মেঘ লাগেজ খুলে একটা একটা করে শাড়ি আর ড্রেস বের করে আবিরকে দেখাচ্ছে। বন্যা আর তানভির কিছুটা দেরি করেই রিসোর্টে ফিরেছে, নাস্তা শেষ করে বন্যা যেই রুমে ঢুকবে ওমনি রিদের মুখোমুখি হলো। রিদ কপাল কুঁচকে জানতে চাইল,
“কোথায় গিয়েছিলে?”
“কাছেই।”
” আমাকে না নিয়ে তুমি কার সাথে গিয়েছিলে? ”
বন্যা উত্তর দেয়ার আগেই তানভির এসে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” বন্যা, রুমে যাও। আমার শালার সাথে বুঝাপড়া আমি করে নিচ্ছি।”
“কে কার শালা?”
” তোমার বোন আমার বউ হলে তুমি আমার কি হবে?”
“শালা কিন্তু আমার বোন তো আপনার বউ না।”
“আজ না হলেও ভবিষ্যতে তো হবে। ”
রিদ চোখ ঘুরিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে উচ্চ শব্দে ডাকল,
“আপু..”
বন্যা মৃদু হেসে রুমে চলে গেছে। রিদ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তানভির রিদকে নিয়ে রুমে গেছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে দু’জন একেবারে রেডি হয়ে বেড়িয়েছে। রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছে। মীম বের হতেই রিদ মীমের দিকে তাকালো। মীম আজ আকাশী রঙের একটা গর্জিয়াছ গাউন পড়েছে, দেখতে একদম পরীর মতো লাগছে। রিদ প্রশস্ত আঁখিতে তাকিয়ে বলে উঠল,
“বেয়াইন, তোকে তো পুরায় নায়িকা লাগছে।”
মীম এক গাল হেসে বলল,
” ধন্যবাদ। আমি যে তোর বেয়াইন হয় এটা তুই কিভাবে জানলি?”
” ছোট আপু তোর ভাইকে পছন্দ করে আর তোর ভাইও…”
“হ্যাঁ, জানি । আমি আর মেঘ আপুই তো ভাবিকে প্রপোজ করেছিলাম।”
রিদ শক্ত গলায় প্রশ্ন করল,
” তারমানে তুই আগে থেকে সব জানতি?”
“হ্যাঁ, আমি কেনো এখানের সবাই জানে। বন্যা ভাবি আর তোকে তো এই কারণেই আনা হয়েছে। ”
“কি?”
“জ্বি।”
রিদ অকস্মাৎ মীমের মাথায় গাট্টা মেরে রাগী স্বরে বলল,
” পঁচা মেয়ে কোথাকার। ”
আরিফ পেছন থেকে এসে রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
” রিদ, মীমকে একদম ছোঁবে না।”
মীম চমকে উঠে পেছনে ঘুরল, ওষ্ঠ উল্টে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরিফের দিকে তাকালো। আরিফের গম্ভীর মুখভঙ্গি দেখে মীম সহসা ভ্রু কুঁচকালো। রিদও কিছু বুঝতে পারছে না, নিরাধার মুখ করে বলল,
“সরি”
টেকনাফ থেকে মোটামুটি বড় একটা ট্রলার করে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মেঘ, বন্যা, জান্নাত তিনজন ই আজ শাড়ি পড়েছে, আবিররাও পাঞ্জাবি পড়েছে। আইরিন তাদের পার্সোনাল ফটোগ্রাফার, বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলে দিচ্ছে। মীম মেঘের ফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ভয়ে ফোন ব্যাগে রেখে চুপচাপ বসে পরেছে। রিদ আর আরিফ কাছাকাছি বসা। প্রথমে আনন্দে লাফিয়ে ট্রলারে উঠলেও মীম এখন ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পাচ্ছে। আবিররা ছবি তোলাতে মনোযোগী তাই মীম ওদের বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। ঢেউয়ের নিমিত্তে চলন্ত ট্রলার কম্পিত হলেই মীম বার বার কেঁপে উঠছে। আরিফ আর রিদ আশেপাশে তাকিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে। মীম ওদের কাছাকাছি এসে ভারি কন্ঠে বলল,
“ঐ রিদ, সর। আমি এখানে বসবো।”
রিদের সঙ্গে সঙ্গে আরিফও তাকিয়েছে। রিদ সরতে যাবে আরিফ তার আগেই বলে উঠল,
“এদিকে এসে বসো।”
মীম রিদের দিকেই তাকিয়ে আছে, ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলার কাঁপতেই মীম পড়ে যেতে নিল। আরিফ সঙ্গে সঙ্গে মীমের হাত ধরে নিজের পাশে বসালো। ভয়ে মীমের হাত পা সহ পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। আরিফ মীমের হাতটা ছেড়ে দিতে নিয়েও ছাড়ল না। মীমের কম্পিত হাতটা আর একটু শক্ত করে ধরে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
” ভয় লাগছে?”
“হ্যাঁ”
“কিছু হবে না, ভয় পেয়ো না।”
খানিক বাদে ট্রলার আবারও কেঁপে উঠল, মীম সহসা অপর হাতে শার্টের উপর দিয়েই আরিফের হাত খামচে ধরেছে। আরিফ শীতল চোখে মীমের উদগ্র আননে চেয়ে আছে। সর্বক্ষণ ছটফট করা মেয়েটার ভীতিকর চেহারা দেখে আরিফ মৃদু হাসলো। আস্তে করে বলল,
” তোমার না খুব সাহস? এই কি তবে সাহসের নমুনা?”
মীম আড়চোখে তাকালো, আরিফের ঠোঁটে হাসি দেখে মীমের খুব রাগ হলো। আরিফের হাত ছেড়ে সহসা উঠে যেতে চাইল। কিন্তু আরিফের হাতে বন্দি হাতটাকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো। মীম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমার হাত ছাড়ো।”
” এই হাত ছাড়া যাবে না।”
“কেনো?”
” তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে?”
মীম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“মানে?”
আরিফ গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে করে বলল,
” তুমি আমার ঝগড়া করার একান্ত সঙ্গী, তোমার জন্য আমার মন সর্বদা বন্দি।”
মীম কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করল,
” তোমার কি মাথায় সমস্যা? কি আবোলতাবোল বলছ?”
আরিফ মুচকি হেসে জবাব দিল,
” তুমি বললে পাগল হয়ে ঘুরবো সাজেক ভ্যালিতে, তুমি বললে নীল দিগন্তে উড়বো সাদা রঙের ঘুড়িতে।”
মীম বেকুবের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ বলে উঠল,
” তুমি ভাই যা খুশি করো, আগে আমার হাতটা ছাড়ো।”
” হাত ছাড়িয়ে যাবে কোথায়, চলোনা স্বপ্নপুরীতে গা ভাসায়।”
মীম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর্তনাদ করল,
” আমার হাতটা ছাড়ো।”
” হাত ছাড়লে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, বাবু।”
“আমি বাবু না ওকে? হাত ছাড়ো, আমি রিদের পাশে বসবো।”
আরিফের হাসিমুখে সহসা আঁধার নেমেছে। কন্ঠে রাগ ঢেলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তুমি ওর পাশে বসবে না, বসলে শুধু আমার পাশেই বসবে। ”
“কেনো? ও আমার বেয়াই, বন্ধু। ওর পাশে কেনো বসবো না?”
“আমি বারণ করছি তাই৷”
“তুমি আমাকে বারণ করার কে?”
“আমি তোমার ভাই। ”
” তানভির ভাইয়াও তো আমার ভাই। ভাইয়া তো কখনো কোনো কারণে আমাকে বারণ করে না। ”
” ভাইয়ের বারণ করার প্রয়োজন পড়ে নি তাই করে নি। আমার প্রয়োজন তাই বারণ করছি।”
“আজব তো, তোমার কি প্রয়োজন?”
“আমার তোমাকে প্রয়োজন। ”
“মানে?”
আরিফ মীমের মাথায় আস্তে করে গাট্টা দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
” ব্যাঙের মাথার মতো বুদ্ধি নিয়ে এত ঝগড়া করো কিভাবে?”
“আমি ঝগড়া করি?”
“না, কখনোই না। তুমি তো অবুঝ একটা বাবু, এখনও.. ”
“এখনও কি?”
“কিছু না।”
আবির মেঘ কম করে হলেও শখানেক ছবি তুলে ফেলেছে। আসিফ আর জান্নাতও বেশ কিছু ছবি তুলেছে। তবে বন্যা লজ্জায় তানভিরের দিকে ঠিকমতো তাকাতেই পারে না। যে কয়টা ছবি তুলেছে সবগুলোতেই বন্যা অন্যমনস্কভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে আছে৷ তানভির বন্যার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,
“এখন লজ্জায় আমার দিকে তাকাতেই পারছ না। সকালে এত মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরার সময় তোমার লজ্জা কোথায় ছিল বলো তো।”
বন্যা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“সকালে এত মানুষ থাকলেও আবির ভাইয়া আর আসিফ ভাইয়া ছিলেন না। ”
“হায় রে! তুমি ওদের দেখে লজ্জা পাচ্ছো অথচ বড় ভাই হয়েও ওদের মধ্যে মিনিমাম লজ্জাবোধ নেই। দেখেছো কত সুন্দর করে ছবি তুলছে। আর তুমি!”
বন্যা মৃদুস্বরে বলল,
” ওনারা বিবাহিত, যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ছবি তুলতে পারেন।”
তানভির নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” চলো, আজই বিয়ে করবো।”
“না।”
“কেনো?”
” পরিবারের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করব না আমি।”
“ইশশ, বিয়ে করব না বললেই হলো? ভালোই ভালোই রাজি না হলে কি*ডন্যা*প করে এনে বিয়ে করবো।”
বন্যা মুচকি হেসে বলল,
” আপনার এত সাহস?”
“নিজের সাহসে না কুলালে প্রয়োজনে আশেপাশের সবার থেকে সাহস ধার নিব তবুও তোমাকে আমার করেই ছাড়বো।”
এতটা পথ জার্নিতে আবির এক সেকেন্ডের জন্যও মেঘকে ছাড়ছে না। জান্নাত অনেকক্ষণ যাবৎ বিষয়টা লক্ষ্য করছে তবে কিছুই বলছে না। ছবি তোলা শেষে জান্নাত অনুষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
” ভাইয়া, তুমি মেঘকে নিয়ে এত ভয় পাও কেনো?”
আবির মেঘের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আজকের আকাশ টা দেখেছো? চারদিকে শুধু সাদা মেঘের উড়ুপ। সেই মেঘেদের ভিড়ে আমার মেঘ হারিয়ে গেলে অন্তর্ধানের বিজ্ঞপ্তি কোথায় দিব বলো?”
আসিফ মেকি স্বরে বলল,
“তুই বরং মেঘকে সিন্দুকে তালা দিয়ে রেখে দে৷ মাঝে মাঝে বের করে দেখবি আবার সযত্নে রেখে দিবি।”
আবির উচ্চ শব্দে হেসে বলল,
“বুদ্ধিটা কিন্তু খারাপ না। ”
” ফাজিল। ”
সারাদিনের ঘুরাঘুরি শেষে সন্ধ্যা নাগাদ ক্লান্ত হয়ে সবাই রিসোর্টে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে যে যার মতো রেস্ট নিচ্ছে। তানভির বন্যাকে বার বার মেসেজ দিচ্ছে। অবশেষে বাধ্য হয়ে বন্যা রুম থেকে বেড়িয়েছে। তানভির রুমের সামনেই দাঁড়ানো। বন্যা বের হতেই বলল,
“চলো।”
“কোথায়?”
“ঘুরতে।”
“খুব ক্লান্ত লাগছে।”
“কোলে নিতে হবে?”
বন্যার অকস্মাৎ সকালের ঘটনা মনে পড়ে গেছে। আবিরের মতো তানভিরও যদি একই কাজ করে বসে তারজন্য আগেভাগেই বলে উঠল,
” আমি একায় যেতে পারব। ”
“ঠিক আছে, চলো।”
সবার রাতের খাবার শেষ অথচ তানভিরদের আসার কোনো নাম নেই। বাধ্য হয়ে আবির তানভিরের নাম্বারে কল দিল। রিসিভ করতেই উষ্ণ স্বরে বলল,
” চাঁদ, সমুদ্র আর তাকে দেখা শেষ হলে রিসোর্টে ফিরে আসেন ভাই। এটা কিন্তু আমার আপনার এলাকা না।”
” ১০ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি।”
“ঠিক আছে।”
মাঝখানে একদিন কেটে গেছে। কক্সবাজারের আশেপাশের সবকিছুই মোটামুটিভাবে দেখা শেষ। বন্যা আর তানভিরের সম্পর্ক অনেকটায় স্বাভাবিক হয়েছে তবে আবির কাবাব মে হাড্ডির মতো তানভিরের পেছনে লেগে আছে৷ বন্যা আর তানভির আলাদাভাবে কোথাও গেলে ৩০ মিনিটের উপরে হলেই ওয়ার্নিং সরূপ কল দেয়া শুরু করে। অথচ আবির মেঘকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার আগেই ফোনটা বন্ধ করে ফেলে।
সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ করা মাত্রই বাসা থেকে কল আসছে৷ আজ মাইশা আপুর ডেলিভারি। আবির সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমাদের যেতে হবে, তোমরা চাইলে আরও ২-১ দিন থাকতে পারো।”
আসিফ শান্ত গলায় বলল,
” তার কোনো প্রয়োজন নেই, ঘুরতে আসছি ঘুরলাম। এখন আমাদের একসঙ্গে ফেরা উচিত। ”
“ঠিক আছে। ”
হুট করে ডিসিশন হওয়ায় ট্রেনের টিকিট ম্যানেজ করা সম্ভব হয় নি তাই বাসেই রওনা দিয়েছে। বন্যা আর রিদ একসঙ্গে বসেছে, তানভির আর আরিফ বন্যাদের পাশাপাশি বসেছে। তাদের সামনে মীম, আইরিন, আসিফ আর জান্নাত বসেছে। আবির আর মেঘ পেছন দিকে বসেছে।
মেঘ আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে থেকে শীতল কন্ঠে বলল,
” আমার বান্দরবান যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। ”
” কিছুদিন পর আবার আসবো। তখন সাজেক, বান্দরবান সব ঘুরবো।”
“আবার?”
“তো কি করব? তুমি যদি মাইশা আপুর বাবু কোলে নেয়ার জন্য বায়না না করতে তাহলে আজ আমাদের এভাবে যেতে হতো না। চট্টগ্রামের সব জেলা ঘুরে তারপর বাসায় ফিরতাম৷”
” আমি কি জানতাম নাকি?”
আবির হঠাৎ ই মেঘের দিকে কেমন করে চাইল। মিনিট খানেক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
আবির ঠোঁট কামড়ে হেসে আচমকা বলে উঠল,
” তোমার যে ছোট বাবু এত পছন্দ এটা তো আগে জানতাম না।”
“জানলে কি করতেন?”
আবির ফিসফিস করে বলল,
” মাইশা আপু মা হওয়ার আগে তোমাকে আম্মু ডাক শোনাতাম। ”
মেঘ রাগী স্বরে বলল,
” আপনার কি একটুও লজ্জা নেই?”
” লজ্জা থাকাটা কি জরুরি, বউ?”
“হ্যাঁ, খুব জরুরি। ”
“তুমি একটু দিবে?”
“আমি কি দিব?”
“লজ্জা ”
” উফফ, আমি আপনার সাথে বসবোই না।”
আবির নিঃশব্দে হেসে বলল,
” বাচ্চামি স্বভাব না ছাড়লে কিন্তু আম্মু হতে পারবে না। ”
মেঘ চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলল,
” দোহাই লাগে, বাসে অন্তত এমন কথা বলবেন না। ”
আবির উদাসীন কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছে, বাকি কথা রাতে হবে।”
মেঘ জানালার বাহিরে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে, আবির চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। কয়েক মিনিট যেতেই মেঘ অতর্কিতে আবিরের দিকে ঘুরলো। আবিরের কিছু সময়ের নিরবতায় মেঘের বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠেছে, মেঘ আবিরকে এক পলক দেখে আবিরের কাছাকাছি চেপে বসে আবিরের বুকে মাথা রাখলো। আবির তৎক্ষনাৎ মেঘকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। আবিরের দুষ্টামিতে অতিষ্ঠ হলেও মেঘ আবিরের নিরবতা একদমই সহ্য করতে পারে না। আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকলেই মেঘের মনে দুশ্চিন্তা হানা দেয়। মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে ডাকল,
“এই শুনছো?”
“বলো”
“একটা গান গাও”
“এখন?”
“হ্যাঁ”
“কি গান?”
“তোমার ইচ্ছে”
আবির আস্তে করে গলা ঝেড়ে গুনগুন করে গাইতে শুরু করল,
“তুমি সাগর নীলিমা নও
তুমি মেঘের বরষা নও
তুমি শুধু আবিরের ময়না
ময়না….. তুমি আবিরের ময়না”
এদিকে বন্যা আর রিদ দু’জনেই ঘুমাচ্ছে, তানভির ঘাড় কাত করে মুগ্ধ চোখে বন্যাকে দেখছে। অনেকক্ষণ পর বাসের ঝাঁকিতে বন্যার ঘুম কিছুটা কেটেছে। অর্ধ ঘুমে থেকে তানভিরের বিমোহিত চাহনি দেখে লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়েছে। তানভির তখনও এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পরিস্থিতির জন্য মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।
আবিররা বাসায় এসে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে সরাসরি হাসপাতালে চলে গেছে।
মাইশা আপুর হাসবেন্ড ওটি রুমের বাহিরে অপেক্ষা করছে। পাশেই একটা কেবিনে আবিরের মামা, মামি, আব্বু, আম্মু, মালা, সাকিব সহ মাইশার শ্বশুর বাড়ির কয়েকজন বসে আছে। আবিরের মামার বাড়ির দিকে মাইশার বেবিই প্রথম। সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ, মেঘ এতক্ষণ খুশিতে থাকলেও সবার অবস্থা দেখে এখন ভয় পাচ্ছে। মেঘের বোধশক্তি হওয়ার পর এই প্রথম বার কারো ডেলিভারির মুহুর্তে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভেতর থেকে বাবুর কান্না শুনা যাচ্ছে না, ভয়ে মেঘের কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে মাইশা আপুর জায়গায় চিন্তা করতেই অতর্কিতে মেঘের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। মেঘ কেবিনে ঢুকে মালিহা খানের পাশে বসে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল। মালিহা খান মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
” টেনশন করিস না।”
মেঘ শীতল চোখে তাকাতেই মালিহা খান মলিন হাসলেন৷ অকস্মাৎ পাশের রুম থেকে নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনা গেল। বেবির কান্নার শব্দে রুমে থাকা প্রতিটা মানুষের স্বস্তি ফিরেছে। নবজাতককে কোলে নেয়ার জন্য মেঘের ডাক পড়েছে কিন্তু মেঘ ভয়ে যেতে পারছে না। মেঘ কোনমতে শক্ত গলায় বলল,
” ভাইয়া, বাবুকে আপনি কোলে নেন প্লিজ। আমি নিতে পারবো না। ”
মাইশার হাসবেন্ড মেঘকে কয়েকবার ডেকেছে, কিন্তু মেঘের হাত পা সহ পুরো শরীর কাঁপছে। মাইশার হাসবেন্ড বাবুকে কোলে নিয়ে এসেই মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মেঘকে উদ্দেশ্য করে কোমল কন্ঠে বলল,
“মেঘ, তুমি বলেছিলে বাবুকে কোলে নিবে। অন্ততপক্ষে একবারের জন্য নাও।”
মেঘ আবিরের দিকে তাকালো, আবির মৃদু হেসে চোখে ইশারা দিল। মেঘ বিছানায় বসে দু’হাত বাড়িয়েছে। মাইশার হাসবেন্ড সঙ্গে সঙ্গে বাবুকে মেঘের কোলে দিলো, লাল টুকটুকে ছোট্ট একটা বাবু মেঘের কোলে অঝোরে কাঁদছে। দু একবার চোখ খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফের কাঁদতে শুরু করেছে৷ কিছু সময়ের জন্য মেঘের সর্বাঙ্গ কালবৈশাখী ঝড়ের মুখোমুখি হলো। অজানা এক ভয় আর আতঙ্কে মেঘের দুচোখ টলমল করছে, বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখে পানি জমে বাবুকে ঘোলাটে দেখা যাচ্ছে। মালিহা খান মেঘের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বাবুকে কোলে নিয়ে মাইশার আম্মু আর শ্বাশুড়ির কাছে নিয়ে গেছে। বাবুর কান্না, বাড়ির সবার হৈ-হুল্লোড় মেঘ সহ্য করতে পারছে না। মেঘ মাথা নিচু করে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেছে, আবিরও এক দৌড়ে বেড়িয়েছে। মেঘের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখ মুছে দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে ডাকল,
“এই মেঘ।”
কান্নার জন্য মেঘ কথায় বলতে পারছে না। আবির ফের বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল,
” মা হওয়া কত কষ্টের…”
আবির নিঃশব্দে হেসে বলল,
” এই কষ্টের আড়ালে সীমাহীন সুখ লুকিয়ে থাকে।”
মেঘ ক্রন্দিত নয়নে তাকাতেই আবির নড়ে উঠলো। সহসা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছে, সরি। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আমি বাবুর কথা আর বলব না। এবার তো কান্না থামাও, প্লিজ।”
তানভির, মীম, আরিফ, আসিফরা কিছুক্ষণ পরে হাসপাতালে আসছে। সবাই বাবুকে দেখছে আর যে যার মতো গিফট দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাইশা আপুকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মেঘের মনের অবস্থা অনেকটায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মেঘ বাবুকে কোলে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, এক সময় আবিরও মেঘের সঙ্গে সঙ্গ নিল। বাবুর নাম, চোখ, ঠোঁট কার মতো হয়েছে সেসব নিয়েই তর্ক বিতর্ক লেগেছে। আলী আহমদ খান বাহিরে ছিলেন, আবির মেঘের তর্ক বিতর্ক শুনে রুমে আসছেন। আলী আহমদ খান আসতেই আবির মাথা নিচু করে দূরে সরে দাঁড়ালো। আলী আহমদ খান কিছু বলতে চেয়েও সহসা কথা গিললেন। আবিরের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
” বাহিরে আসো, কথা আছে।”
আবির সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে গেছে। ১০ মিনিট পর কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তানভির, বাসায় গেলে সবাইকে নিয়ে যাস।”
রুম ভর্তি মানুষ তাই মেঘকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। মেঘরা বাসায় ফিরেছে ১০ টার দিকে। সবাই সবার মতো শুয়ে পরেছে। মেঘ আবিরের রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে হঠাৎ এক দৌড়ে নিচে চলে আসছে। আবিরের রুমটা অনেক বড় হওয়ায় মেঘের একা থাকতে ভয় লাগে তাই ড্রয়িং রুমে চলে আসছে। টিভি দেখতে দেখতে আবিরকে কয়েকবার কল দিয়েছে কিন্তু আবির কল রিসিভ করছে না। মেঘ এক এক পর্যায়ে সোফাতেই ঘুমিয়ে পরেছে। প্রায় ১২ টার দিকে মালিহা খান টিভির শব্দে রুম থেকে বেড়িয়ে আসছেন। মেঘকে সোফায় ঘুমাতে দেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন। আবিরের আব্বু, চাচ্চু কেউ ই এখনও বাসায় ফিরে নি। মালিহা খান মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলেন,
“মেঘ”
“এই মেঘ।”
“উমমম”
“এখানে ঘুমাচ্ছিস কেনো?”
“রুমে ভয় লাগে।”
“কেনো?”
“জানি না”
মালিহা খান সোফার একপাশে বসলেন, মেঘকে নিজের উরুতে শুইয়ে দিলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
” মাইশার বাবু দেখে ভয় পেয়েছিস?”
” হ্যাঁ।”
” সংসার জীবন বড়ই কঠিন মা, এই জীবনে ভয়কে জয় করেই চলতে হবে। আবির এখনও ফিরছে না কেনো?”
“জানি না, কল রিসিভ করছেন না। ”
“আচ্ছা, তুই ঘুমা আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
মেঘ কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করে হঠাৎ ই ডাকল,
” বড় আম্মু।”
” বল।”
“একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে তোমার কি আমাকে পছন্দ?”
” পছন্দ না হলে কি ছেলের বউ করতে রাজি হতাম নাকি? এখন ঘুমানোর চেষ্টা কর। না হয় মাথা ব্যথা করবে৷”
কিছু সময়ের মধ্যেই মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছে। ১০ -২০ মিনিটের মধ্যে আবির দৌড়ে বাসায় ঢুকেছে। মালিহা খানকে সোফায় বসে থাকতে দেখে পা থামিয়ে ধীর গতিতে আগায়। আম্মুর কোলে ঘুমন্ত মেঘকে দেখে আবির অপ্রত্যাশিতভাবে হেসে ফেলল। আবিরের হাসি দেখে মালিহা খান রাগী স্বরে হুঙ্কার দিলেন,
” তোর দায়িত্ববোধ কি কোনোদিনও আসবে না?”
“আসবে।”
“কবে আসবে? বিয়ের পর এত রাত করে কেউ বাসায় ফিরে? মেয়েটা এমনিতেই ভয় পায় তারউপর তুইও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিস। তোর বউকে দেখে রাখার দায়িত্ব কি আমার?”
আবির মুচকি হেসে বলল,
” সরি।”
“তুই যে বিয়ে করেছিস, এটা কি তোর মনে থাকে না?”
“থাকে তো”
” তাহলে? তোর আব্বু কোথায়? চাচ্চুরায় বা কোথায়?”
“আসতেছে।”
“কোথায় গিয়েছিলি?”
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৬ (২)
“আব্বু এসে সব বলবে। আমি আপাতত ওকে নিয়ে যায়। চাচ্চু এসে মেয়েকে এ অবস্থায় দেখলে আমার খবর ই আছে।”
আবির ঝটপট মেঘকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যাচ্ছে।