আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে শেষ পর্ব
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
আজ শুক্রবার, বন্যার বোনের কাবিন হবে তাই বন্যাদের বাসায় সকাল থেকেই রান্নার আয়োজন চলছে। কাছের আত্মীয়স্বজনরা ইতিমধ্যে চলে আসছেন। এতটা পথ জার্নি করে আসায় বন্যার শরীর খুব ক্লান্ত, এজন্য ঘুম থেকে উঠতেও একটু দেরি হয়ে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যেই নামতে যাবে ওমনি বন্যার মামাতো ভাইয়ের সাথে দেখা যার সাথে কোনো এক সময় বন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলেটা বন্যাকে দেখে মৃদুস্বরে বলল,
“কেমন আছো?”
বন্যা উত্তর না দিয়ে ফের নিজের রুমে চলে গেছে। দরজা চাপিয়ে আবারও শুয়ে পরেছে। বন্যার চোখে তীব্র আক্রোশ। মন আর মেজাজ দুটায় চরমভাবে খারাপ হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিট পরেই তানভিরের কল আসছে। বন্যা রিসিভ করবে না করবে না ভেবেও রিসিভ করল। তানভির মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” Good Morning, Mistress”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
“Good Morning.”
“ব্যস্ত?”
“না, বলুন।”
“কি করছো?”
” কিছু না, শুয়ে আছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তানভির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
” এত বেলা হয়ে গেছে এখনও শুয়ে আছো কেনো? শরীর কি বেশি খারাপ?”
“না।”
“কিছু হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। আপনি কল দিয়েছিলেন কেনো?”
বন্যার ভারী কন্ঠের কথাবার্তা শুনে তানভির শঙ্কিত হলো, পর পর ধীর কন্ঠে জানতে চাইল,
” বাসায় কি কোনো সমস্যা? ”
” না। ”
“বলো ”
তানভিরের গম্ভীর কন্ঠ শুনে বন্যা সহসা হাসার চেষ্টা করল। মৃদুহেসে বলল,
“আপনি অল্পতে এত সিরিয়াস হয়ে যান কেনো? আপুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেজন্যই মনটা একটু খারাপ ৷ এখন বলুন, মেঘ, মীমদের নিয়ে কখন আসছেন?”
“আমি বোধহয় আসতে পারবো না।”
“কেনো?”
“ভাইয়া বলল আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে হবে। তুমি চিন্তা করো না, বনুরা সময়মতো পৌঁছে যাবে।”
বন্যা মলিন কন্ঠে বলল,
“আপনি আসবেন না!”
“ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু ভাইয়ার কথা অমান্য করে যেতে পারবো না। তবে সুযোগ পেলে অবশ্যই আসব।”
“আচ্ছা।”
তানভির কল কেটে দিয়েছে, বন্যা ফোন থেকে গতকালের তোলা একটা ছবি বের করে শীতল চোখে তাকিয়ে তানভিরকে দেখছে। কিছুক্ষণ পর বন্যার বোন রুমে আসছে। আপুকে দেখে বন্যা আতঙ্কিত হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। বন্যার বোন বন্যার মাথার কাছে বসে আস্তে করে বললেন,
” কি হয়েছে তোর?”
“কিছু না।”
“মন খারাপ?”
বন্যা নিরবে ঢোক গিলছে৷ বন্যার বোন মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” মামারা তোর বিয়ের আলোচনা তুলেছে। তাদের ছেলের অতীত ভুলে আমরা যেন আবার চিন্তা করি।”
বন্যা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে, বুকে অজানা ভয় হানা দিচ্ছে। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। বন্যার বোন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোমল কন্ঠে ডাকল,
“বন্যা”
“হু”
“তুই কি তানভিরকে পছন্দ করিস?”
বোনের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে বন্যা কিছুটা ঘাবড়ে গেছে, কয়েক মুহুর্ত প্রশস্ত আঁখিতে তাকিয়ে রইল। বোনের এমন প্রশ্নের তোপে নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ ই বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। বন্যার বোন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ কি না বল।”
বন্যা তখনও অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। বন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি না চাইতেও ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আপু। আমি ওনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।”
বন্যার বোন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বলল,
” আমি জানতাম, অবশ্য সেদিনের আচরণ দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।”
বন্যা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। বন্যার বোন আবারও জিজ্ঞেস করল,
” মেঘ জানে?”
“মেঘ, মীম, আবির ভাইয়ারা সবাই জানে।”
“তাহলে মুখ ফুলিয়ে শুয়ে আছিস কেনো? নিচে চল।”
“মামারা…”
“আশ্চর্য! ওনাদের জন্য আমাদের জীবন থেমে থাকবে নাকি? ওনাদের হীরার টুকরা ছেলের জন্য হীরা খোঁজতে থাকুক৷ আমরা রূপা, রূপা নিয়েই সুখে থাকবো। কি বলিস?”
বন্যা আনম্র হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”
সকাল ১০ টার দিকে আরিফ আর আইরিন মেঘদের বাসায় আসছে৷ যদিও মাহমুদা খান এখনও খান বাড়িতেই আছেন। সবার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে আরিফ চুপিচুপি মীমের রুমের সামনে আসছে। দরজায় ঠোকা দিয়ে ধীর কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি আসতে পারি?”
মীম চোখে কাজল দিচ্ছিলো, কাজল দেয়া থামিয়ে কিছুটা ঝুঁকে আরিফকে দেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” তুমি?”
“আসবো কি না বলো”
“আসো”
আরিফ রুমে ঢুকে চারদিকে নজর বুলিয়ে মীমের দিকে তাকালো। মীম নিঃশব্দে ভ্রু নাচাতেই আরিফ মুচকি হাসলো। মীম ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমার রুমে কেনো আসছো? ঝগড়া করতে?”
“তোমার কি আমাকে এত ঝগড়ুটে মনে হয়?”
“হ্যাঁ, এখন বলো কেনো আসছো?”
“তোমাকে দেখতে।”
মীম দু’হাতে নিজের দুগালে হাত রেখে ঘনঘন পল্লব ঝাপ্টে বলল,
” দেখেছো?”
আরিফ মুচকি হেসে বলল,
” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
মীম সঙ্গে সঙ্গে হাত নামিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” ঐ তোমার মনে কি চলে? তোমার হাবভাব আমার একদম ভালো লাগছে না। আমি কিন্তু ভাইয়াকে বিচার দিব।”
“কি বিচার দিবে?”
“বলবো। বলবো যে তুমি আমার সাথে অসভ্যতা করো। ভাইয়া যখন তোমার পা ভেঙে হকি খেলবে তখন বুঝবা।”
আরিফ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,
“পা কবে ভাঙবে জানিয়ো তাহলে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হবে। ”
” ফাউল কথা বাদ দিয়ে যাও এখান থেকে নয়তো সত্যি সত্যি বিচার দিব।”
আরিফ পকেট থেকে দু ডজন লাল রঙের কাঁচের চুড়ি বের করে বিছানার উপর রেখে শান্ত গলায় বলল,
” খুব শখ করে তোমার জন্য চুড়িগুলো নিয়ে আসছি, তুমি পড়লে খুশি হবো।”
আরিফ দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও থামল, আড়চোখে মীমের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,
” তোমাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগে যেন!”
মীম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে, আরিফ চলে গেছে। মীম ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকালো, লজ্জা আর কুন্ঠায় মীমের উজ্জ্বল ধৃষ্টতা আরও বেশি ঝলমল করে উঠল। আরিফকে নিয়ে কখনো সেভাবে কিছু ভাবে নি মীম, দু’জনের সম্পর্কটাও খুব বেশি মধুর নয়। এ বেলায় দুটা ভালো কথা বললে ও বেলাতেই ঝগড়া লেগে যায়। তাই আরিফের এই হঠাৎ পরিবর্তন মীমের কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। মীম দু’জোড়া চুড়ি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে আবারও রেখে দিল।
প্রায় ৪ টার দিকে আবির তানভিরকে নিয়ে বন্যাদের বাসার সামনে আসছে৷ বাইক থেকে নামতেই আবির চটজলদি পকেট থেকে টিস্যু বের করে তানভিরের মুখ মুছে দিতে লাগল। আবিরের কাণ্ড দেখে তানভির হতবিহ্বল। কাজের নাম করে সকাল থেকে ২-৩ ঘন্টা তানভিরকে সেলুনে বসিয়ে রেখেছে। ১০০ হেয়ার স্টাইল দেখে অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিলেক্ট করে দিয়েছে, এমনকি তানভিরের পড়নের পাঞ্জাবিটাও আবিরের এর ই দেয়া। আবির তানভিরের চুল ঠিক করে দিতে দিতে মৃদুস্বরে বলল,
” ভদ্র ছেলের মতো থাকবি কেমন?”
তানভির ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আমার মনে হচ্ছে আমাকে মেহমানের থেকেও বেশি নতুন জামাই লাগছে। আমি কি বিয়ে করতে যাচ্ছি নাকি?”
আবির হাসল, সহসা বলে উঠল,
“করলে ক্ষতি কি?”
তানভির আড়চোখে তাকাতেই আবির তাড়া দিল৷ তানভিরকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। মেইন গেইটের ভেতরে এক পা রাখতেই তানভির আশ্চর্য বনে গেল। আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান সহ মীম, মেঘ, আদি, আইরিন, আরিফ, আসিফ, রাকিব সবাই উপস্থিত। তারা ছাড়াও বন্যার বড় আপুর শ্বশুর বাড়ির মানুষজন, বন্যাদের আত্মীয়স্বজনে ড্রয়িংরুম পরিপূর্ণ। বন্যার আব্বু হেসে বললেন,
” নতুন জামাইয়ের আসতে এত দেরি কেনো?”
তানভির শুকনো মুখে ঢোক গিলে আবিরের দিকে তাকালো। আবির মুচকি হেসে বিড়বিড় করল,
“সারপ্রাইজটা কেমন?”
” I’m Shocked. ”
মেঘ দ্রুত এগিয়ে এসে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”
তানভির মেঘকে আপাদমস্তক দেখে আবারও আবিরের দিকে তাকালো। মেঘের বিয়ের সময় এত এত শাড়ি আর লেহেঙ্গা দেখেছিল যে মেঘের জন্য শাড়ি, লেহেঙ্গা কেনা শেষে তানভিরকে টেনেও শপ থেকে বের করা যাচ্ছিলো না। একই ডিজাইনের দুটা লেহেঙ্গা তার খুব পছন্দ হয়েছিল এক পর্যায়ে খুব জোরাজোরি করেই দুইটা লেহেঙ্গা নিয়েছিল। তানভির ভেবেছিল, বন্যাকে যেদিন প্রপোজ করবে সেদিন মেঘ আর বন্যাকে এই লেহেঙ্গা দুটা দিবে। কিন্তু হুট করে কক্সবাজার যাওয়া, ওখানে পরিকল্পনা বিহীন প্রপোজ করা সব মিলিয়ে পরিকল্পনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেছিল। এদিকে মেঘের ইচ্ছে ছিল তানভিরের বিয়েতে বন্যা আর মেঘ দু’জনেই লেহেঙ্গা পড়বে তাই আবির বাধ্য হয়ে তানভিরের কেনা লেহেঙ্গা দুটায় দিয়ে দিয়েছিল। আবির ধীর কন্ঠে বলল,
” আমার কিছু করার ছিল না। তুই খুব ভালো করেই জানিস তোর বোনের বায়নার কাছে আমি আবির নাথিং।”
আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে ডাকলেন,
“ভেতরে আসো।”
তানভির কিছুটা সামনে এগিয়ে সবাইকে সালাম দিল। সবার কথায় সোফায় গিয়ে বসল। আশেপাশে সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তানভিরকে দেখছে। কি হচ্ছে, কি হতে চলেছে সেটা পুরোপুরি আন্দাজ করতে না পারলেও তানভির কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে। বন্যার আব্বু, চাচ্চু ওনারা তানভিরকে টুকটাক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন। তানভির ধীরস্থির কন্ঠে উত্তর দিচ্ছে তবে গলা প্রচন্ড বেগে কাঁপছে। আব্বু আর বড় আব্বুদের দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র সাহসও অবশিষ্ট নেই। আবির তানভিরের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো। বন্যার আব্বু সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
” পরিচয় করিয়ে দেয়, সে সাফিয়াদ্দীন খান তানভির ওরফে তানভির খান। সবার উপস্থিতিতে একটা কথা বলতে চাই, বড় মেয়ের সাথে সাথে আমি আমার ছোট মেয়ে মেহের্নাজ মুনতাহা বন্যার সাথে তানভিরের বাগদান সম্পন্ন করে রাখতে চাচ্ছি। গতকাল রাতে অলক্ষিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে সবাইকে আগে কিছু জানাতে পারি নি।”
বন্যার আব্বুর কথা শুনে তানভিরের বুক ধুকপুক করছে, মনে যত সাহস ছিল সব যেন সেকেন্ডের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে। তানভির মাথা নিচু করে আস্তে করে ঢোক গিলল। গতরাতে তানভিরকে বাসায় পাঠিয়ে সবাই যে আলোচনায় বসেছিল আর সেই আলোচনার সর্বাধিনায়ক যে আবির ছিল এটা বুঝতে সময় লাগল না। গত দুইদিনে আবিরের বলা কথাগুলো তানভিরের কানে বাজছে। আবির কয়েকবার সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বিয়ে করার মতো সাহস আছে তোর?’
তানভির তখন কথাগুলোকে সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও এখন সব বুঝতে পারছে। তানভিরের খুব ইচ্ছে করছে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে সেটাও করতে পারছে না। বন্যার মামাতো ভাই এক দৃষ্টিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে, সুপ্ত ক্রোধ চোখে উপচে পড়ছে তার। বিষয়টা তানভিরের চোখে না পড়লেও আবিরের চোখে ঠিকই পড়েছে। আবির ছেলেটাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ছেলেটার নজর আবিরের দিকে পড়তেই আবির সহসা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল।
ছেলেটা সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ সরিয়ে নিল। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের আলাপচারিতা শেষে বন্যা আর বন্যার বোনকে ডাকা হলো। দুই বোন একসঙ্গে নামছে, বন্যার বোনের পড়নে বেনারসি শাড়ি আর বন্যার পড়নে তানভিরের কিনে রাখা সেই লেহেঙ্গা। ওদের সাথে মীম, আইরিন আর মেঘও নামছে। তানভির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় জুড়ে হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। বন্যা ভারী মেকাপ না নিলেও লেহেঙ্গার সাথে মানানসই ভাবেই সেজেছে। মিষ্টি কালারের লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং চুড়ি, অল্পস্বল্প গহনাও পড়েছে। চোখে কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দিতেও কৃপণতা করে নি আজ। এই অকল্পনীয়, অপরূপ সাজে বন্যাকে দেখামাত্র নিজের অজান্তেই তানভিরের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটলো। হৃদয়ে বইছে বসন্তের প্রেমময় হাওয়া, মনের ভেতর থেকে শুধু একটা কথায় বের হচ্ছে,
“She is my better half.”
তানভিরের নিষ্পলক চাহনি দেখে আবির অতর্কিতে তানভিরের কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে আঙুল নাড়ালো। তানভির সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসেছে। একটা সোফায় বন্যারা দুই বোন পাশাপাশি বসা, তানভির বন্যার পাশে বসেছে আর বন্যার বোনের পাশে তার হবু হাসবেন্ড। মোজাম্মেল খান চোখে ইশারা দিতেই আবির পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করে দিল। মেঘ এতক্ষণ দূরে থাকলেও এখন আবিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আবির তাকাচ্ছে না দেখে মেঘ আবিরের হাতে চিমটি কাটল৷ আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাতেই মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
“আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো!”
মেঘের কপালের উল্টে যাওয়া টিকলিটা ঠিক করে দিয়ে আবির অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল,
“তুমি তমসার বুকে অনুদার আলোকচ্ছটা হলেও
আবিরের হৃদয়ে নিরন্তর দীপ্তির মেলা।”
মেঘ হালকা ধমকের স্বরে বলল,
“এটা প্রশংসা ছিল নাকি অবজ্ঞা?”
“আপাতত অবজ্ঞায় ভাবো, প্রশংসাটা না হয় রাতের জন্য তোলা থাকলো।”
আবির ঠোঁট কামড়ে হেসে আলগোছে চোখ টিপল। মেঘ মুখ ফুলিয়ে প্রশস্ত নেত্রে তাকিয়ে দু’হাতে আবিরের হাত খামচে ধরেছে। এরমধ্যে তানভির বন্যার বাগদান সম্পন্ন হয়ে গেছে। বন্যা বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে পরপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকালো, অন্তর্নিহিত অনুষঙ্গে বন্যার দুচোখ চিকচিক করছে। তানভিরের সাথে বিয়ের কথা সকাল পর্যন্তও জানতো না বন্যা।
বন্যার বোন রিদের মুখ থেকে তানভিরের কথা শুনেই বন্যাকে সকালে জিজ্ঞেস করেছিল। তবে এর কিছুক্ষণ পর মেঘ, মীমরা আসতেই বাড়ির পরিবেশ বদলে গিয়েছিল। পরিশেষে বন্যার আব্বু গতরাতের আলোচনার কথা বন্যাদের জানিয়েছে। এত সহজে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে হয়ে যাবে এটা বন্যা কল্পনাও করতে পারে নি। আপাতত বাগদান সম্পন্ন হলেও তানভিরের জব হওয়ার পর অনুষ্ঠান করা হবে।
তানভির সবার দিকে এক বার নজর বুলিয়ে অকস্মাৎ বন্যার কানের কাছে ফিসফিস করল,
“তোমাকে চেয়েছিলাম আমি
ভোরের স্বপ্নের মাঝে,
আবৃত অনুভবের নিমিত্তে পেয়ে গেছি
গোধূলি লগ্নের আগে।”
বন্যা আড়চোখে তানভিরের দিকে তাকালো। তানভিরের নেশাক্ত দৃষ্টি, মায়াবী আদল, অকৃপণ হাসি দেখে বন্যার ওষ্ঠ যুগল কিছুটা প্রশস্ত হলো। বন্যা চোখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“সরি”
” সরি বলছো কেনো?”
“আমার ফোন মেঘের কাছে তাই আপনাকে আগে জানাতে পারি নি।”
” ভালো হয়েছে জানাও নি। আগে জেনে গেলে হয়তো এত সুন্দর অনুভূতিটা মিস করে যেতাম।”
বন্যা শীতল চোখে ফের তাকালো,তানভিরের সাথে চোখাচোখি হতেই নিজের চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তানভির কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে উষ্ণ স্বরে বলল,
” দৃষ্টিকে জানিয়ে দাও,
তানভির আজ থেকে শুধুই বন্যার।
মনের সব ভয়,ভীতি শঙ্কা ভুলে,
যেতে চাই নিরালায়।”
ছাদে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বড়দের খাবার খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনের ভিড় কমতেই তানভির অকস্মাৎ উঠে গিয়ে আবিরকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিক ঘটনায় আবির কিছুটা অবাক হলো, কয়েক মুহুর্ত পর আবিরও জড়িয়ে ধরল। তানভির অধীর কন্ঠে বলল,
” ধন্যবাদ ভাইয়া, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি না চাইতেই তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে দামী গিফটটা আমাকে দিয়ে দিলে। তোমার এই আনুকূল্য আমি কোনোদিনও ভুলব না। ভালোবাসি ভাইয়া, খুব ভালোবাসি। ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” তুই আমার জন্য যত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করেছিস তার কাছে এই উপহার কিছুই না। তবে হ্যাঁ, দুই বছর আগে তোর বউকে আমাদের বাড়িতে নিচ্ছি না। আমার বউয়ের বউ বউ ফিল শেষ হলে তবেই তোর বউকে ঘরে তুলবো।”
“ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।”
তানভিরের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর আবেগী কন্ঠস্বর শুনে মেঘ অভিমানী কন্ঠে বলল,
” এখন সব ভালোবাসা ভাইয়ের জন্য। আমি যে এত বছর বান্ধবীটাকে আগলে রেখেছি, প্রপোজ করেছি, বিয়ের জন্য এত চিল্লাচিল্লি করেছি এগুলো কিছুই না।”
তানভির আবিরকে ছেড়ে হাসিমুখে মেঘের দিকে তাকালো, আলতো হাতে মেঘকে বুকে জড়িয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
” তুই তো আমার সবকিছু। তুই পৃথিবীতে আসছিলি বলেই আমি তানভির পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটা বোন পেয়েছি। তুই আসছিলি বলেই আমি আবির ভাইয়ার মতো ভাই পেয়েছি আর বন্যার মতো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছি। আমার জীবনে তুই সবচেয়ে দামী। সারাজীবন ভালোবাসি বললেও তোর প্রতি আমার ভালোবাসার অন্ত ঘটবে না। তবুও বলছি, বনু আমি তোকে সীমাহীন ভালোবাসি।”
মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সেরা ভাই। তুমি আমার জীবনে না থাকলে আমি বোধহয় ভালোবাসার সঠিক অর্থই বুঝতাম না। আমিও তোমাকে সীমাহীন ভালোবাসি, ভাইয়া।”
রাকিব শক্ত কন্ঠে বলল,
” হ ভাই, ভালোবাসা সব তোদের ই। আমরা ভাই বানের জলে ভেসে আসছি। নাকি বলো আসিফ?”
“জ্বি ভাই, আমারও তাই মনে হয়।”
তানভির মেঘকে ছেড়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি। ”
আরিফ ঠাট্টার স্বরে বলল,
” সবার মধ্যে কি ভাবিও আছে নাকি ভাই? তুমি সরাসরি বলতে পারছো না বলে আমাদের নাম নিচ্ছো, তাই না?”
তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে ভেংচি কাটার চেষ্টা করল। পরপর নিরেট কন্ঠে বলে উঠল,
” কেনো? আমি কি ভয় পায় নাকি?”
বন্যার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” I Love You, Bonna.”
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল, বন্যা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সবার মধ্য থেকে আইরিন বলে উঠল,
” মানি না, মানবো না। সবার বেলায় ভালোবাসি আর ভাবির বেলায় I love you.”
তানভির ভ্রু কুঁচকে ভারী কন্ঠে বলল,
” দাঁড়া, তোর বিয়েটাও খুব তাড়াতাড়ি ঠিক করছি।”
“না।”
মেঘ বন্যাকে টেনে এনে তানভিরের পাশে দাঁড় করিয়ে তানভিরের হাতের উপর বন্যার হাত রাখলো। তারউপর নিজের রেখে মোলায়েম কন্ঠে বলতে শুরু করল,
” আজ থেকে আমার বেবিটা তোমার তাই বলে এটা ভেবো না যে আমি আমার বেবিকে ছেড়ে দিব। তুমি যদি ইচ্ছেকৃত আমার বেবিকে কষ্ট দাও তাহলে এর ফল খুব খারাপ হবে। আর হ্যাঁ, আমার ভাইও আমার, আমার বেবিও আমার। তাই তোমাদের দু’জনের উপর আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। বুঝছো?”
বন্যা আর তানভির একসঙ্গে বলল,
“জ্বি আপু, বুঝেছি।”
আবির মেঘের হাতের উপর নিজের হাত রেখে নিরেট কন্ঠে বলল,
” আর আমার বউয়ের উপর আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। বুঝছো?”
মেঘ আড়চোখে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। তানভির, বন্যা ফের বলল,
“জ্বি ভাই, বুঝেছি।”
রাকিব হুট করে বলে বসল,
” মেঘের জন্মের পর থেকে মেঘের উপর তো তোর অধিকারই সবচেয়ে বেশি। মেঘের সাথে কেউ কথা বলা তো দূর, মেঘের দিকে কেউ তাকালেই তো তোর মেজাজ ৬২৬ হয়ে যেত। জয়ের কথা মনে হলে এখনও আমার কলিজা কেঁপে উঠে৷ রাগের বশবর্তী হয়ে মেঘকে ২-১ টা থাপ্পড় দিয়ে ফেলছিলি বলে মেঘ তোর উপর রাগ করেছিল। আর তুই সেই রাগ মিটিয়েছিলি জয়ের উপরে৷ ১১ বছরের ছেলেটার মাথায় তখনই ৭ টা সেলাই লাগছিলো। জয়কে মেরে নিজের রাগ কমাতে পারলেও মেঘের রাগ কমাতে পারলি না।
মেঘের রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করলি। তুই বাহির থেকে বদলে গেলি কিন্তু মেঘের প্রতি আবেগ আর নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলি না। যেই শুনলি সেই জয় আবারও মেঘের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, তুই সব প্ল্যান বাদ দিয়ে দেশে আসলি। কেনো? জয়কে মারতে। মারলি তো মারলি, একেবারে ২ মাসের জন্য হাসপাতালে পাঠালি। বাকিদের কথা না হয় না ই বললাম। এই তুই আবার অধিকার নিয়ে কথা বলিস। মেঘের দায়িত্ব নিতে চাইলে বা মেঘের যত্ন নিতে চাইলে আগেই তাদের আধমরা করে ফেলতি। আর এখন তো প্রকাশ্যে তোর বউ। কেউ কিছু বলা তো দূর তাকালেই তুই মাটিতে কু*পে দিবি।”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
” আমার বউ শুধু আমার। কেউ খারাপ নজরে তাকানোর দুঃসাহস দেখালে, আমি আবির তার জীবনকে দুঃস্বপ্ন বানিয়ে ছাড়বো।”
মেঘ নির্বাক চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে।মীম দূরে দাঁড়িতে সবার কান্ডকারখানা দেখছে। হঠাৎ আরিফের নজর পড়তেই মীমের কাছে এগিয়ে গেল। মীমের হাতের লাল চুড়িগুলো দেখে মুচকি হেসে বলল,
” আমার দেয়া চুড়িগুলো পড়ার জন্য ধন্যবাদ।”
” এত খুশি হওয়ার মতো কিছু হয় নি, জামার সাথে ম্যাচ হয়েছে তাই পড়েছি। ”
“মিথ্যে বলো না মীম, আর যাই হোক তোমার সাথে মিথ্যেটা যায় না।”
মীম চোখ তুলে তাকালো, আরিফের নিষ্পলক চাহনি দেখে আতঙ্ক আর কুন্ঠায় চোখ সরিয়ে নিল। মীম বার বার বলেছিল এই চুড়িগুলো পড়বে না তবুও শেষ পর্যন্ত পড়েছে। কেনো পড়েছে নিজেও বুঝতে পারছে না।
মাগরিবের নামাজের পর পর তানভিররা সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছে। বন্যার আব্বু আবিরের আব্বু, চাচ্চুকে এগিয়ে দিতে বেড়িয়েছেন। রিদ,আদি, মীম, আরিফরা আগেই বেড়িয়ে গেছে। মেঘ আর আবির বন্যার আম্মু, মামী আরও অন্যান্যদের সাথে কথা বলছে।
তানভিরদের এগিয়ে দিতে বন্যা গেইটের বাহিরের সরু গলিটা পর্যন্ত এসেছে। তানভির কিছুটা সামনে চলে গেছে, আচমকা কিছু ভেবে পেছনে ঘুরলো। বন্যাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক ছুটে এসে বন্যাকে জড়িয়ে ধরলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বন্যার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিকভাবে কম্পিত হচ্ছে। তানভির কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বন্যার কপালে, গালে অগণিত কিস করে ফেলেছে। বন্যা নিস্তব্ধ চোখে চেয়ে তানভিরের পাগলামি দেখছে। তানভির আচমকা বন্যার মাথায় দেয়া ঘোমটার একসাইড টেনে বন্যাসহ নিজের মাথা ঢেকে দিল। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে বন্যার ভীতিকর চেহারা অল্পবিস্তর দেখা যাচ্ছে, তানভির বন্যার কাছাকাছি আসতেই বন্যার নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তানভিরের নিঃশ্বাস বন্যার ঠোঁটে লাগছে, বন্যার ঠোঁট অপ্রত্যাশিতভাবে কাঁপছে। তানভির সহসা বন্যার কম্পিত অধর নিজের দখলে নিয়ে নিল, বন্যা সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে তানভিরের পেটের দুপাশ চেপে ধরেছে।
আবির আর মেঘ সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হতেই এই দৃশ্য দেখল। মেঘ ঠিকমতো বুঝার আগেই আবির একহাতে মেঘের চোখ ধরে নিয়ে সামনে নিয়ে গেছে। মেঘ তপ্ত স্বরে বলল,
” চোখ ধরেছেন কেনো?”
” এসব দৃশ্য দেখার বয়স হয় নি তোমার।”
“একটু দেখে ফেলি।”
“এই ফাজিল, তানভির তোমার বড় ভাই হয় না?”
” বন্যা তো আমার বান্ধবী হয়, দেখি না একটু।”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” নির্লজ্জের মতো কথা বলো না।”
“আপনি খুব খারাপ। ”
“তাই? ঠিক আছে। খারাপের রূপটা নাহয় রাতে দেখাবো, এখন চলো।”
বিয়ের পর থেকে আবিরের অফিস সম্পর্কিত কোনো মাথা ব্যথায় নেই। রাকিব আর রাসেল কোনোরকমে অফিস টানছে। আবিরকে কিছু বলার মতোও অবস্থা নেই কারণ আবির অন্য এক জগতে আছে। অবশেষে আবির আজ অফিসে যাবে যদিও স ইচ্ছায় না। আবির মেঘের বিয়ের আগে থেকেই একটা মিটিং আঁটকে আছে৷ সেই মিটিং এর জন্য আজ বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। আবির ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল বিছানার উপর আবিরের শার্ট, প্যান্ট, টাই সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা আছে অথচ মেঘ রুমে নেই।
আবির ভ্রু কুঁচকে রুম থেকে বেড়িয়ে বেলকনিতে গেল। মালিহা খান, হালিমা খান, মীম, আদির সাথে মেঘও গল্প করছে। মূলত তানভিরের বিয়ে নিয়েই আলোচনা চলছে। আবিরের বিয়ের বিষয়ে আগে থেকে কেউ না জানলেও তানভিরের বিষয় নিয়ে বাড়িতে আলোচনা আগেই হয়েছিলো। তানভির বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল তখন মাহমুদা খান বন্যার কথা জানিয়েছিলেন। অনেকবছর যাবৎ বন্যাকে চিনে জানে, আচার-আচরণও ভালো সবমিলিয়ে কারোর ই কোনো আপত্তি ছিল না। তানভিরের উপর অল্পবিস্তর অভিমানের কারণে সবাই ইচ্ছেকরে তানভিরকে আগে কিছু জানায় নি। আবির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অকস্মাৎ উচ্চশব্দে ডাকল,
“বউ”
মেঘ সহসা চোখ তুলে তাকালো, কিন্তু উঠে গেল না। আবির শক্ত কন্ঠে আবার ডাকল,
“রুমে আসো।”
মালিহা খান শান্ত গলায় বললেন,
“ডাকছে যা”
মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
” সবকিছু রেডি করে রেখে গেলাম, আবার ডাকছেন কেনো?”
” আমি অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে। এখন টাই টা পড়িয়ে দাও।”
মেঘ তখনও দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবির জিজ্ঞেস করল,
” টাই বাঁধতে পারো না?”
মেঘ মৃদু হেসে বলল,
” এই দায়িত্ব টা যে আমার নিতে হবে এটা খুব ভালোকরেই জানতাম তাই আগেভাগেই শিখে ফেলেছি।”
” গুড গার্ল। ”
আবির রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মেঘ আবিরকে এগিয়ে দিয়ে আবারও রুমে ঢুকল। বিয়ের ঝামেলা, কক্সবাজার, ভাইয়ের বিয়ে সব মিলিয়ে ব্যস্ততায় আবিরের রুমটাকে এখনও আপন করেই নিতে পারে নি। মেঘের জামাকাপড়ের প্রায় সবই এখনও মেঘের রুমে রয়ে গেছে। মেঘ সেগুলোই টুকটাক গুছাচ্ছে। সকাল থেকে তানভিরের কোনো খোঁজ নেই, আবির কিছুদূর যাওয়ার পর তানভিরের নাম্বারে কল দিল। তানভির কল রিসিভ করতেই আবির জানতে চাইল,
“কোথায় আছিস?”
“মুন্সিগঞ্জ।”
“ওখানে কি করিস?”
“বউ নিয়ে আসছি।”
“বাহ! অসাধারণ ”
“এটা অসাধারণ না ভাই, খুব সাধারণ। ”
“সাবধানে থাকিস।”
“ঠিক আছে।”
মেঘ গুনগুন করে গান গাইতেছে আর আপন মনে ওয়ারড্রবে জামা রাখছে। জামার মাঝখান থেকে একটা ওড়না নিচে পড়ে গেছে, ওড়না তুলতে গিয়ে অকস্মাৎ বেডের নিচে একটা বড় লাগেজ চোখে পরল। মেঘ তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে আবারও কাজে মনোযোগ দিল ৷ কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন কৌতূহল জাগছে। কিছুক্ষণ পর মেঘ বেডের নিচ থেকে লাগেজ টা বের করল, লাগেজে তালা দেখে চাবি খুঁজতে লাগলো। অবশেষে চাবির গোছা থেকে লাগেজের চাবি বের করে লাগেজ টা খুললো। লাগেজ ভর্তি জিনিসপত্র দেখে নিজের অজান্তেই কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলল। উপর থেকে দু একটা জিনিস সরাতেই আশ্চর্য নয়নে তাকালো। মেঘের ছোটবেলার জামা, ছোট ছোট কিছু খেলনা সহ আরও অনেক জিনিস। কয়েকটা জিনিস তুলতেই একটা শাড়ি চোখে পড়লো, গাঢ় নীল রঙের অসম্ভব সুন্দর একটা শাড়ি, যার উপরে একটা চিরকুট লেখা-
” আমি জানি না তুই দেখতে কেমন হয়েছিস তবে আমার কল্পনায় তুই পরী চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছিস। তুই ঠিক কতটা বড় হয়েছিস জানি না, শাড়ি পড়লে তোকে কেমন লাগবে সেটাও জানি না। কিন্তু আমি ঠিকই কল্পনা করে নিয়েছি। এই প্রথমবার নিজের টাকায় তোর জন্য শাড়ি কিনেছি। এই শাড়িতে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে।”
নিচে আজ থেকে আরও ৫ বছর আগের একটা তারিখ লেখা। মেঘ চিরকুট টা সরিয়ে জামার উপর দিয়েই কোনোরকমে শাড়িটা পড়ল।
গাঢ় নীল রঙের শাড়িতে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় সত্যি সত্যি একটা পরী দেখতে পেল। বাস্তবিক অর্থে পরী না হলেও আবিরের কল্পনার পরীর মতোই লাগছে। শাড়িটা অনেক বছর আগের হওয়ায় নতুনের মতো আর নেই তবুও মেঘের কাছে এটায় যেন আকাশ সম আবেগ কারণ এতে আবিরের আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। মেঘ ধীরে ধীরে বাকি জিনিসগুলো দেখতে লাগলো। লাগেজে বেশকিছু শাড়ি আছে যার প্রতিটাতেই তারিখ সহ আবিরের লেখা চিরকুট লাগানো আছে। বিদেশে থাকাকালীন ৭ বছরে মেঘের কথা ভেবে যা যা কিনেছে প্রতিটা জিনিস খুব যত্নের সাথে প্যাকিং করে রেখেছে।এক পাশের সব দেখে শেষ করার আগেই মেঘের নজর আটকায় অন্য পাশের হাজারো রঙিন কাগজের দিকে৷ মেঘ কয়েকটা রঙিন কাগজ হাতে নিল। প্রথম কাগজের উপরে এক কর্ণারে পৃষ্ঠা নাম্বার লেখা। প্রথম পৃষ্ঠাটাতে অগোছালো অক্ষরে লেখা,
” যদি এমন হতো, ঘুম ভাঙতেই তোর আমার দূরত্বের কথা মন থেকে মুছে যেত। আমি আমার মেঘকে আবার আমার করে পেতাম৷ তবে কতই না ভালো হতো! অন্ততপক্ষে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে তোকে না পাওয়ায় আক্ষেপ বুকে চেপে এক রাশ হাহাকার নিয়ে দেশ ছাড়তে হতো না।
Miss You koliza.”
২য় পৃষ্ঠাতে লেখা-
“এই শহরে সব আছে কিন্তু তোর গায়ের গন্ধ নেই। আবির যে তার মেঘকে ছাড়া একদমই ভালো নেই৷”
৩,৪, ৫…….. প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। অতঃপর ২৩ নাম্বার একটা পৃষ্ঠাতে আবার নজর স্থির হলো। পৃষ্ঠাতে লেখা,
” তুই এত নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারলি?
আমাকে দূরে ঠেলে সত্যিই কি ভালো আছিস? কিন্তু
আমি কেনো পারছি না? ২৩ দিনেও কেন একবারের জন্য হাসতে পারছি না? চোখের সামনে শুধু তোর অভিমানী মুখটা ভেসে উঠছে, মেঘ। মানুষ তো কত ভুল করে, কই এত বড় শাস্তি কি কেউ পায়? আমাকে কেন এত বড় শাস্তি দিলি?”
কয়েকটা পৃষ্ঠা পর আরেকটাতে লেখা-
“এই দেশ আমার সব কেড়ে নিয়েছে, মেঘ। আমার আমি টাকে হারিয়ে ফেলতেছি৷ আমার জীবন বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে৷ চারদিকের সবেতে বিরক্তি জন্মে গেছে।”
মেঘের দুচোখ টলমল করছে,মেঘের হাতে থাকা সব কাগজ পড়ে গেছে। বাতাসে উড়ে পৃষ্ঠাগুলো চলে যাচ্ছে। মেঘ কাছের পৃষ্ঠা গুলো তুলে তাড়াতাড়ি করে লাগেজে রেখে লাগেজ আটকালো। দু একটা পৃষ্ঠা দূরে চলে যাচ্ছে। মেঘ পৃষ্ঠা গুলো উঠাতে উঠাতে রুমের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া পৃষ্ঠাটা উঠালো।
ঐটাতে লেখা-
” পৃথিবীতে আমার প্রাপ্য সবকিছুর বিনিময়ে হলেও যদি তোর অভিমান ভাঙানো যেত, আমি আবির সব ছেড়ে আজই দেশে চলে আসতাম। বিশ্বাস কর, আমি আজই চলে আসতাম। আমি যদি একবারের জন্যেও বুঝতে পারতাম, তোর গায়ে হাত তুললে তুই এতটা অভিমান করবি তাহলে কোনোদিন তোর গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস দেখাতাম না। তোর অভিমান আমাকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে ফেলতেছে। এসব সহ্য করতে না পেরে যদি কখনো মা*রা যাই তবে জেনে রাখিস, আমি আবির আমৃত্যু তোকে ভালোবেসেছি আর তোর অভিমানের কারণেই ম*রেছি। ”
মেঘের দুচোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে পৃষ্ঠা উঠিয়ে যেই উঠতে যাবে তখন নজর পরে সামনের দেয়ালের দিকে। আগে রুমে অনেক জিনিসপত্র থাকায় এই দেয়ালের প্রতি নজর ই পড়ে নি। এখন রুম সম্পূর্ণ পরিষ্কার হওয়ায় দেয়ালের কালো পর্দার উপর মেঘের নজর আঁটকে গেছে। মেঘ মনে মনে ভীত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কিছুটা কৌতূহলও কাজ করছে। জোরে নিঃশ্বাস টেনে এগিয়ে গেল পর্দার কাছে। একসাইড থেকে পর্দা টেনে দেয়াল উন্মুক্ত করে দিল। দেয়ালে কিছু একটা ছবি আকাঁ, কাছাকাছি থাকায় মেঘ ঠিকমতো বুঝতে পারছে না তাই পেছাতে লাগল। কিছুটা পেছাতেই থমকে দাঁড়ালো। পুরো দেয়াল জুড়ে বড় করে মেঘের একটা হাস্যোজ্জল ছবি আঁকা যার পাশে লেখা
“আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে”
নিচে গতবছর জানুয়ারির দিকের তারিখ লেখা। যখন আবিরের রুমে রঙ করানো হয়েছিল তখনই ছবিটা আঁকিয়েছিল যেটা একবছর যাবৎ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। আবিরের রুমে তালা দিয়ে রাখার কারণটাও মেঘ আজ বুঝে গেছে। মেঘ দুচোখ বেয়ে পানিই পড়ছে। বার বার শুধু মনে হচ্ছে,
” একটা মানুষ এতটা ভালো কিভাবে বাসতে পারেন?”
মেঘ একপা একপা করে পেছাতে পেছাতে হঠাৎ শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেল। পেছনের ঘুরার আগেই আবিরের ঠান্ডা কন্ঠ শুনা গেল,
” সব রহস্য উদঘাটন করা শেষ?”
মেঘ আবিরের দিকে তাকাতেই আবির মেঘের চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বলল,
” কাঁদলে যদি তোমাকে পাওয়া যেত তাহলে আমি আবির গত ১১ বছরে তোমাকে শতকোটি বার আমার করে পেতাম।”
মেঘ অতর্কিতে আবিরের প্রশস্ত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবাঁধে কাঁদতে লাগল। যেই কান্নায় কোনো অভিযোগ নেই, না পাওয়ার আক্ষেপ নেই। আছে শুধু আবিরের সীমাহীন ভালোবাসা। এই কান্না কষ্টের নয়, এই কান্না সুখের। পৃথিবীর বুকে আবিরের মতো একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার সুখ। আবিরও মেঘকে বারণ করছে না বরং শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” ভালোবাসি মেঘ, আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে।”
মিনিট দশেক পর রাকিবের কল আসছে। আবির কল রিসিভ করতেই রাকিব বলে উঠল,
” মিটিং এর আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি। কোথায় আছিস?”
” লাঞ্চের পর মিটিং দে। ”
“হোয়াট? তুই না বের হয়েছিলি? এখন কোথায়?”
” বউকে মিস করছিলাম তাই বাসায় চলে আসছি। এখন রাখছি, কল দিয়ে বিরক্ত করবি না। অবশ্য কল দিলেও পাবি না, বাই।”
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৭৭
আবির মেঘের কপালে নিগূঢ় চুমু খেয়ে পুনরায় জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি, আহিয়ার আম্মু।”
মেঘ নাক টেনে ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমিও ভালোবাসি, আহিয়ার আব্বু।”
