আযদাহা পর্ব ১০
সাবিলা সাবি
ফিওনা চেতনাহীন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে, তার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।তবু,মস্তিষ্কের কোনো গভীর কোণ থেকে ক্ষীণ সিগন্যাল আসছে, যা তাকে মৃদুভাবে আশ্চর্য অনুভূতি দিচ্ছে।
সেই অনুভূতিতে মনে হচ্ছে সে শূন্যতায় ভাসছে—কোনো নির্দিষ্ট বোধ ছাড়াই।তার শরীরকে ঘিরে রয়েছে এক ঠান্ডা,শীতল বাতাসের স্পর্শ,যা তার স্নায়ুগুলোতে হালকা শিরশিরানি এনে দিচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন কোনো কিংবদন্তির পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে, চারপাশে অসীম মেঘের সমুদ্র তাকে ঘিরে রেখেছে।
তবে, এই সবই ফিওনার জন্য এক স্বপ্নের মতো, এক কাল্পনিক দৃশ্য ,অথচ এই অনুভূতিগুলো বাস্তবের চেয়েও বেশি জীবন্ত,ফিওনার ধারণার বাইরে।
আসলে,ফিওনা শুয়ে আছে জ্যাসপারের ড্রাগন রূপের কঠিন,ধাতব আঁশের পিঠে। তার বিশাল,শক্তিশালী ডানা বাতাসকে চিরে দিচ্ছে, আর ফিওনাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে অজানার দিকে। জ্যাসপারের দানবীয় ড্রাগন সত্তা এখন প্রখরভাবে উপস্থিত, তার কণ্ঠহীন প্রতিশ্রুতি একমাত্র এটাই—এক অনন্ত যাত্রা, যেখানে কোনো গন্তব্য নেই, শুধু মেঘমালা আর অসীম আকাশ। ফিওনা সেই পিঠে শুয়ে আছে,তার শরীর মেঘের শীতল বায়ুর নিচে সমর্পিত,অথচ তার মন এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সামনে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেঘের রাজ্যের সেই অসীম আকাশের মাঝ দিয়ে অভিজাত জ্যাসপার ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে। এক মুহূর্তে তার বিশাল ড্রাগন রূপ গৌরবময়ী কল্পনার ছায়া রূপান্তরিত হয়ে যায় মানব রূপে।এক অলৌকিক পরিবর্তন, সে উজ্জ্বল আকাশের নিচে শুস্ক মাটির স্পর্শ অনুভব করে।
ফিওনাকে পাঁজায় কোলে তুলে নিয়ে সে অগ্রসর হয় সামনের দিকে,তার দেহে অলসতা অশ্রাব্য। ফিওনার হাত দুটো ঝুলে আছে,সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে জ্যাসপারের ওপর। অসহায়ত্বে তার নিথর শরীর এক পশমী বালিশের মতো, কিন্তু সে নিজেকে অসার মনে করলেও, এই মুহূর্তে সে জ্যাসপারের শক্তি আর সাহসে শেল্ফায়িত।
জ্যাসপারের মুখে নিবিড় সংকল্প ফুটে ওঠে। সে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেয়, পায়ের তলে পৃথিবীকে আলিঙ্গন করে।তার অনবদ্য দৃষ্টি সামনে,এ ক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে, যেখানে ফিওনার অসহায়তার পেছনে এক নতুন শুরু অপেক্ষা করছে।
রাত প্রায় ১টা ছুঁইছুঁই। ডক্টর লিউ ঝানের ডিউটি শেষ হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু ফিওনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। হসপিটালের ভেতর বারবার সময় দেখতে দেখতে মনে হয় সময় থেমে গেছে। আজ মিস ঝাং-এর ফিওনাকে দেখতে আসার কথা ছিল, তাই তার চোখের মণি হয়ে ওঠে অপেক্ষা। ডক্টর লিউ ঝান ভেতরে ভেতরে আশা করে, কিন্তু ফিওনার মোবাইল ফোনে কল করতেই শুনতে পায়,ফোনটি বন্ধ।
এদিকে, লিয়া মনমরা হয়ে ফিওনার চিন্তায় আছে।
“মেয়েটা এত রাতে ডরমিটরিতে ফিরে আসেনি,” সে ভাবতে থাকে। তার মনে হয়,হয়তো সে হাসপাতালে রয়েছে অথবা নিজের বাড়িতে। কিন্তু ফোন করে তো জানাবে, তাই না? লিয়া মন থেকেই বলল।
চেন শিং কয়েকবার ফিওনার ফোনে কল দেয়,কিন্তু প্রতিবারই ফোনটি বন্ধ পায়।মিস ঝাং-এর বর্তমান অবস্থার খবর জানার জন্য ফোন করেন, তবে মনে মনে ভাবেন, “হয়তো ফিওনা ঘুমিয়ে পড়েছে।” তাই আর ফোন করলো না।
মিস্টার চেন শিং আর ওয়াং লি আগামীকালকেই চীনে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তাদের মনেও চিন্তার মেঘ। এথিরিয়নকে ভালোই ভালোই লন্ডনের ল্যাবে ট্রান্সফার করতে হবে। এই সব চিন্তা যা সবকিছুকে গাঢ় রঙে রাঙিয়ে তোলে।
অবশেষে রাতের গভীরতা ভেঙে ভোরের আলোর সিঁড়ি বেয়ে ঢুকতে শুরু করেছে। ঘরের প্রতিটি কোণ সুর্যের সোনালী আলোতে ভরে গেছে,অথচ এই আলোর মাঝে ফিওনার শরীরের ওপর শীতলতা আলিঙ্গন করেছে।সূর্যের কিরণগুলো যে কতটা তেজস্বী,তা অনুভব করতেই ফিওনার ঘুম ভেঙে যায়। তার জ্ঞান ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করে; চোখ খুলে ফিওনা পিটপিট করে তাকায়। কিন্তু মুহূর্তের জন্য,চারপাশের দৃশ্য তার কাছে অস্পষ্ট।
“আমি কি নিজের রুমে আছি এই মুহূর্তে?”—এই ভেবে ধীরে ধীরে বিছানার ওপর বসে পড়ে। চোখ ভালোভাবে মেলতেই ফিওনার রক্তচাপ বাড়তে থাকে; চারিদিকে যে দৃশ্য তার দেখা নয়। এটা তার রুম নয়—এটা কোন স্থান, কার কক্ষ? আশেপাশে কেবল কাচ আর কাচ; দরজা কিংবা জানালা কিছুই নেই—শুধু পুরু কাঁচের দেয়াল।
ফিওনার চোখে পড়ে, সেই দেয়ালের অপর পাশে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য। আকাশ তার মাথার ঠিক ওপরে, সুদূরবর্তী মেঘগুলোর সান্নিধ্যে। হঠাৎ করেই কর্নকুহরে আসে ঝর্নার পানি প্রবাহের মৃদু আওয়াজ, কিন্তু তার মন এখনও বুঝতে পারছে না সে আসলে কোথায় অবস্থান করছে।
অজানা আশঙ্কা তাকে তাড়িত করে, ফিওনা দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামতে থাকে। বিছানার ডান পাশের কাঁচের দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে, সে উঁকি দেয়। নিচে কি আছে, তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না—মনে হচ্ছে, সে এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, অসীম গভীরতার দিকে তাকিয়ে। আতঙ্কের শিহরণ ফিওনার শরীরে বইতে থাকে, সে বোধগম্য করতে পারে না—এটা তো কোনো মাউন্টেন?
ল্যাবের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ধীরে ধীরে ফিওনার স্মৃতিতে ফিরে আসে, একেকটি পাথর তার মনে জড়ো হলো।ভয়ের আবহে কাঁচের দেয়ালের পাশে নিঃশব্দে বসে পড়ে ফিওনা। তার হাঁটু দুটো একসাথে জড়ো করে, দুহাত দিয়ে শক্তভাবে পেঁচিয়ে রাখে।
তন্ময় চোখে, সে কাঁপতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, জ্যাসপার সেই ড্রাগন—অর্থাৎ, সে এখন সেই ভয়ঙ্কর আগুনের মনস্টা*রের কবলে।
“আমি এখন কিভাবে বাসায় যাবো?”—মনে মনে উচ্চারণ করে সে।সঙ্কটের মুহূর্তে, তার হৃদয়ে এক দানা আশা খোঁজার চেষ্টা করে। “গ্র্যান্ডপা, তুমি কোথায়? আমাকে উদ্ধার করো!”
আকাশের নীচে, নিঃশব্দে আকাশের বিশালতা অনুভব করতে করতেই, তার কল্পনায় এক গাঢ় অন্ধকার ভেসে ওঠে। মনে হয়, সেই ড্রাগন তার ওপর নজর রাখছে, তার দৃষ্টির তলায়।এভাবেই ফিওনার অন্তরে বয়ে চলে এক বিশাল উত্তেজনা, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়—কিন্তু তার চেতনা দৃঢ়, সে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পেতে চায়।
জ্যাসপার অরিজিন মুহূর্তের জন্যই নয়, বরং দীর্ঘকালের জন্য ফিওনাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে “পুষ্পরাজ” পাহাড়ের চূড়ায়, যেখান থেকে ফিওনা জ্যাসপারের ইচ্ছা ব্যতীত ফিরে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারবেন না। এটা এক গোপন পৃথিবী, যেখানে প্রবেশ করতে হলে একজন মানুষকে অতিক্রম করতে হয় অজানা বিপদ আর অসীম বাধা। গভীর সমুদ্রের ওপরে অবস্থানরত এই পাহাড়,এমন এক রহস্যময় স্থান যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিপদের পরস্পর বিয়োগান্তক সমন্বয় ঘটেছে।
পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত “মাউন্টেন গ্লাস হাউজ,” এক অনন্য সৃষ্টির উদাহরণ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ ফুট আর প্রস্থ ৪০ ফুট, দুই তলা বিশিষ্ট। বাড়িটির দেয়াল সম্পূর্ণ কাঁচের, যা বাহিরের প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ভেতরে ধারণ করে। প্রথম তলার উচ্চতা ৩০ফুট, আর দ্বিতীয় তলার ২৫ ফুট, যা পেছনের দেয়ালকে উন্মুক্ত ছাদে রূপান্তরিত করেছে।এখানে প্রতিটি ভোরের সূর্যের আলো আর রাতের চাঁদের প্রতিফলন এক বিমূর্ত শিল্পকর্মের মতো, যা মনকে জুড়িয়ে দেয়।
প্রথম তলায় প্রবেশ করলেই একটি বিশাল লিভিং রুম সবার চোখে পড়ে। এখানে একটি বড় কাঁচের টেবিল, আরামদায়ক সোফা,আর বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন আসবাব রয়েছে। আসবাবপত্রগুলি সাদা আর নীল রঙের মিশ্রণে সাজানো, যা শান্তিআর প্রশান্তির অনুভূতি প্রদান করে। চারপাশের দেয়ালগুলি শোভিত হয়েছে নানা রকম ফুলের পেইন্টিং আর আধুনিক শিল্পকর্মে, যা বাড়িটিকে কাল্পনিক গ্যালারির রূপ দিয়েছে।
দ্বিতীয় তলায় উঠলেই দেখা যায় এক অপূর্ব দর্শনীয় স্থান, যেখানে কাঁচের দেয়াল দিয়ে সারা দুনিয়ার প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এখানে কিছু টব রাখা হয়েছে, যেখানে জীবন্ত ফুলের বাগান সাজানো হয়েছে,যা বাড়িটিকে প্রাণবন্ত আর রঙিন করে তুলেছে। জানালার বাইরের ঝর্ণার ধারা জীবনের সঙ্গীত, যাকে শুনতে শুনতে মানুষ অথবা যেকোনো জীব জ’ন্তু উভয়েই বিমোহিত হয়ে পড়বে।
এই গ্লাস হাউজের একটি বিশেষত্ব হলো,এটি আসলে প্রকৃতির এক অভিজ্ঞান, যেখানে বৃষ্টি পড়লে কাঁচের ওপর চিকন চিকন জলকণার অর্কেস্ট্রা গায়। আর ঝর্ণার জলপ্রপাতের আওয়াজ এক আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, যা তাদের চারপাশকে এক অনন্য পরিবেশে নিয়ে যায়। এখানে থাকা মানে প্রকৃতির একটি অংশ হয়ে যাওয়া, যেখানে সময়ের কোনো সীমানা নেই।
এই মুহূর্তে “মাউন্টেন গ্লাস হাউস”-এর দ্বিতীয় তলার মাঝের রুমে অবস্থান করছে ফিওনা। রুমটি সামান্য হলেও তার উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট,দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ কাঁচের, যা বাইরের ঝর্ণার পানি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভ্যুত্থানের প্রতিফলন ঘটায়।যেখানে পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে দূরে, এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি ঘটে।
রুমটির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বিশাল কুইন সাইজের বিছানা,যার সাদা চাদরগুলো মেঘের বিশ্রামস্থল। বিছানার পাশে দুটি চকচকে সাদা টেবিল, যা সম্পূর্ণরূপে সাদা রঙে রঞ্জিত,অতি যত্নে তৈরি।
সেখানে একটি বিশাল কাঁচের আয়না,যা কেবল রুমটির আকারকে প্রসারিত করে না, বরং যে কারো আত্মাকে উপলব্ধি করার এক অদ্ভুত সুযোগ দেয়।
এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছে জ্যাসপারের পূর্বপুরুষদের হাতে, যারা পৃথিবীতে অবস্থান করার জন্য এই স্থানটিকে এক বিশেষ কাজে প্রস্তুত করেছিলেন। তাঁদের প্রজ্ঞা আর দক্ষতায় তৈরি এই বাড়িটি একটি আদর্শ বাসস্থান, যা মানবজাতির অবাধ প্রবেশকে সম্ভাব্য করে তুলেছে। এখানে অবস্থান করলেই মনে হয়, সময় ও স্থান কেবল এক প্রবাহিত নদীর মতো—অস্থির, অথচ প্রশান্ত।
আরো গভীরে গেলে,এই ঝর্ণার গুহার অন্তরালে একটি বিশাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়েছে।সেখানে বিদ্যমান প্রযুক্তি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা মেলবন্ধন ঘটায়,এই ল্যাবরেটরিতে রয়েছে গবেষণার অসংখ্য উপকরণ, যা জীবন ও মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করতে উৎসুক।
ফিওনা এখনও জড়সড় হয়ে বসে আছে,তার দৃষ্টি একদিকে স্থির হয়ে গেছে, পৃথিবী তাঁর চারপাশে থমকে গেছে।অশ্রু তাঁর গাল বেয়ে পড়ে যাচ্ছে,কান্না করে যাচ্ছে সে অনবরত। জ্যাসপারের রূপে ভাসমান সেই ভয়ঙ্কর ড্রাগনের চেহারা তার মনের পটে ঘুরছে—ময়নাকে ধারন করা সেই মনিষী, যে তার আশ্রয়, নিরাপত্তা আর বন্ধুতের প্রতীক ছিল।
হঠাৎ,একটি প্রবল ধ্বনিতে ভেঙে ওঠে শান্ত পরিবেশ। কোথাও একটি বিশাল কিছু পাহাড়ের মাটিতে ধপ করে পড়ার আওয়াজ। ভূমিকম্পের মতো সেই প্রবল ঝাঁকুনি ফিওনাকে কেঁপে ওঠার জন্য বাধ্য করে। বুকের ভেতর এক ভয়ের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, তাঁর হৃদয় লড়াই করছে—পালাতে চাইছে, কিন্তু শরীরের কোন অঙ্গ অবশ হয়ে গেছে।
ফিওনা, যে ছিল স্ট্রং গার্ল অথচ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতু আর অসহায় অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করছে। চারপাশে শুধু ভয়ংকর প্রাণীর উপস্থিতি তাকে গ্রাস করছে। এই অদ্ভুত পরিবেশে প্রতিটি নিঃশ্বাস তার গলায় আটকে যাচ্ছে।
তার কল্পনায় উঁকি দিয়ে উঠে সেই মায়াবী ড্রাগনের মুখ—ফিওনার এই মুহূর্তে কেবল একটি চিন্তা—কিভাবে সে এই ভয়ের জায়গা থেকে মুক্তি পাবে? তার গ্ৰান্ডপা কি কোনোদিন ও জানতে পারবে ফিওনা এখানে রয়েছে।
জ্যাসপার গ্লাস হাউজের নিচ তলায় লিভিং রুমে বিশাল সোফায় আরাম করে বসে ছিল।সে মিষ্টি তৃপ্তির ভাব নিয়ে সারা কক্ষ পর্যবেক্ষণ করছিল, যখন হঠাৎ করেই হাউজের দরজা খুলে প্রবেশ করে আলবিরা, রুপালি ড্রাগন মেয়েটি। তার মুখশ্রী তাজা তুষারপাতের মতো সাদা, তার উপস্থিতি মুহূর্তে চারপাশের বাতাসে অন্যরকম শীতলতা এনে দিল।
“প্রিন্স অরিজিন,” আলবিরা মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শন করে বলল, “আপনাকে এই মুহূর্তে ল্যাবে যেতে হবে। কিং ড্রাকোনিস আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চান।”
জ্যাসপার গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আলবিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আলবিরা। তুমি এখন চলে যাও, আমি আসছি। আর তোমাকে পরে বিশেষ প্রয়োজন হলে ডাকতে হতে পারে, প্রস্তুত থেকো।”
“যেমনটি বলবেন, প্রিন্স অরিজিন।” আলবিরা সম্মান আর কর্তব্যবোধ নিয়ে উত্তর দিল।
অতঃপর, সম্মান প্রদর্শন করে আলবিরা হাউজ ত্যাগ করল।
জ্যাসপার ল্যাবে প্রবেশ করে,তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ড্রাকোনিসের দিকে।কক্ষটি ছিল গাঢ় নীল আলোতে আলোকিত, যেখানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির মাঝে সঙ্কীর্ণ পথ তৈরি করেছে। জ্যাসপারের চোখে উজ্জ্বলতার আভা সে আগ্রহে আর আশায় ঊর্ধ্বমুখী।
“বলুন, ড্রাকোনিস!” সে বলল, কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি।
ড্রাকোনিস সেদিকে তাকিয়ে, তার মৃদু গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “জ্যাসপার,মাই সান! তোমার মিশনের কতদুর এগোলো? এথিরিয়ন কোন অবস্থায় রয়েছে ?”
“চিন্তা করবেন না, খুব শীঘ্রই এথিরিয়ন মুক্তি পাবে,” জ্যাসপার বলল, তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের রেশ। “মুক্তির পর, আমাদের দ্বিতীয় মিশন শুরু করার পালা।”
“সঠিক বলেছ, তবে মনে রেখো, ড্রাগন রাজ্যের নিয়ম ভঙ্গ না করাই আমাদের মূল কর্তব্য,” ড্রাকোনিস সতর্কভাবে বললেন। “অযথা কোন মানবের ক্ষতি যেন না হয়।”
“আমার ওপর ভরসা রাখুন, ড্রাকোনিস। আমি কখনো খামখেয়ালি হয়ে কাউকে শাস্তি দিই না। আপনি তো ভালো করেই জানেন আমাকে।”
“আমি জানি, মাই সান!এজন্যই তোমাকে ভেনাসের প্রিন্স হিসেবে আখ্যায়িত করেছি,” ড্রাকোনিস বললেন, তার গম্ভীর কিন্তু স্নেহময় কণ্ঠে।
এই কথাগুলোতে এক নতুন প্রত্যয়ের সূচনা হলো। জ্যাসপার নীরবতা ভেঙে মনে মনে বলল, “আমার এই মিশনে আমার ড্রাগন বংশের গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে কতদিন পারবো জানিনা।”
জ্যাসপার গ্লাস হাউজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, তার পদক্ষেপে এক রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়ে। শীতল কাচের দেয়ালগুলো আকাশের নীলতায় প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর ভেতরে প্রবাহিত বাতাসে ছিল গম্ভীরতা। সে নীরবভাবে সবাইকে একত্রিত করার নির্দেশ দিল। আলবিরা থারিনিয়াস আর অন্যান্য ড্রাগন সদস্যদের চোখে উদ্বেগ আর কৌতূহল।
“শোনো, সবাই,” জ্যাসপার শুরু করল, তার কণ্ঠে গম্ভীর সুর। “আমাদের একটা জরুরি বিষয় আলোচনা করতে হবে।”
সকলের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হলো। “আমি আজকে সবাইকে একটা বিষয়ে নিষেধ করে দিচ্ছি । আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো এথিরিয়নকে মুক্ত করা, আর তাকে মুক্ত করতে অনেক কিছুই এমন করতে হবে যা আমাদের ড্রাগন রাজ্যের রুলস ভঙ্গ করতে হবে তবে সাবধান ড্রাকোনিস যেন এই মানবী মেয়েটির কথা কোনোভাবেই জানতে না পারে। যতদূর সম্ভব, তার অবস্থান গোপন রাখতে হবে। এথিরিয়নের মুক্তি নিশ্চিত করা জরুরি, তাই আমি বারবার সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছি”
“কিন্তু প্রিন্স,” আলবিরা দ্বিধা প্রকাশ করল, “মানব মেয়েটি যাকে আপনি তুলে এনেছেন কি যেনো নাম ফিওনা তার প্রতি আমাদের কি করণীয়?সে কি আমাদের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠতে পারে?”
“তাকে বিপন্ন মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই সে একজন সাধারণ মানবী তবে আমাদের অস্তিত্বের জন্য যে কোনো দুর্বলতার সম্ভাবনা আমাদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে,” জ্যাসপার বলল, তার চোখে তীব্র দৃঢ়তা। “যদি ড্রাকোনিস জানে আমরা কোনো সাধারন মানুষকে ব*ন্দি করে রেখেছি তবে আমাদের পরিকল্পনাগুলি বিপর্যস্ত হবে। তাই, আমাদের চুপচাপ থাকতে হবে, আর ওই মেয়েটিকে আপাতত আমার ওপর ছেড়ে দাও, যখন দরকার হবে তখন জানাবো কি করতে হবে সবাইকে”।
আযদাহা পর্ব ৯
“আমরা আপনার নির্দেশ মান্য করব, প্রিন্স,” থারোনিয়াস সম্মতি জানালো। “আপনার জন্য আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সমর্থন থাকবে।”
“আমরা একসাথে থাকলে, কোনো বাধাই আমাদের আটকাতে পারবে না। এখন চলো আমরা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা করি, জ্যাসপার বললো, গম্ভীর কন্ঠে।
 
