আযদাহা পর্ব ১৩
সাবিলা সাবি
রাত গভীর হয়ে আসে, অন্ধকারে চারপাশে বিরূপ নিরবতায় বিরাজ করে। ফিওনা বিছানায় কষ্টে গা গুটিয়ে শুয়ে ছিল, অনুভূতিহীনতার মধ্যে তার শরীরের প্রতিটি অংশে অসহ্য ব্যথা দানা বেঁধে আছে। মাথায় অসহ্য চাপ অনুভব করছে,সমস্ত পৃথিবী তার উপর ভারী হয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত পেটের গুঞ্জনে তার সারা শরীর কাঁপছে।
হঠাৎ, নির্জন গভীর রাতের অন্ধকারে কারো আগমন ঘটে কক্ষের মধ্যে।
ফিওনা অবাক হয়ে চোখ মেলল, অস্পষ্ট কায়ায় ছায়ার মতো কিছু দেখতে পেল। সেই ছায়ার হাতে খাবার। আজকে জ্যাসপার ভারী কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। তীব্র ক্ষুধায় বুকের ভিতর কষ্ট অনুভব করলেও,ফিওনা উঠতে পারেনি।
জ্যাসপার, অদ্ভুতভাবে তার দুর্বলতার দিকে তাকিয়ে, মনে মনে বলল, উফ,দুর্বল মানবী। তার কণ্ঠস্বর কঠোরতম—অথচ একদিকে ফিওনার শরীরের অবস্থা দেখলে মনে হয়, তার অস্তিত্ব প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে।
খাবার আর পানি টেবিলে রেখে, জ্যাসপার পুনরায় চলে যায়,তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। খাবারটা ছিলো ফিওনার জন্য এক অনুপ্রেরণা। পেটের খিদের তীব্রতা চরম সীমায় পৌঁছেছে, কিন্তু জ্যাসপারের আগমন কেবল তার দুর্বলতা জাগিয়ে তোলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাতের পর সকালের আলো ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলো। মিস্টার চেন শিং তখনও গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত, ল্যাবের টেবিলে একাকী বসে আছেন। তার চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মন এখনো অটুট—প্রিয় নাতনীকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা তাকে প্রতিটি মুহূর্তে গ্রাস করছে। বারবার বিভিন্ন ডেটা পরীক্ষা করছেন, কোথাও যদি কোন সূত্র খুঁজে পান।
এই সময় হসপিটাল থেকে খবর এলো—মিস ঝাংকে রিলিজ দেওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু মিস্টার চেন শিং তাকে এখনই বাসায় ফিরিয়ে নিতে চান না। “মিস ঝাং এর কিছুদিন আরো বিশ্রাম করা দরকার,” নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বলে উঠলেন তিনি।”
হসপিটালেই রাখতে হবে মিস ঝাংকে নার্সেরাই যত্ন নেবে। তার নিজের হাতে এখন কোন সময় নেই, কারণ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে, পিকিং ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে লিয়া আর লিন ক্লাসরুমে বসে আছে। দুইজনেই ফিওনার অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ফিওনা কেনো কয়েকদিন ধরে ভার্সিটিতে আসছে না, তার কোন খবর নেই। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই এক নীরব সংকল্প হলো।
“আমরা ফিওনার বাসায় যাবো,” লিয়া স্থির কণ্ঠে বললো।
লিন মাথা নাড়ল, সম্মতি জানিয়ে। “হ্যাঁ, ওর খোজ নেয়াটা জরুরী।”
এদিকে সকালের নরম আলো ধীরে ধীরে ফিওনার চোখেমুখে এসে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। প্রতিটি পেশি, প্রতিটি অস্থি অবশ হয়ে আছে। মাথা ভারী লাগছে, শরীরে গভীর ব্যথা। আস্তে করে উঠে বসার চেষ্টা করলো,তবে প্রতিটি নড়াচড়াই কষ্টের। তার মনের ভেতরকার যুদ্ধ আরও গভীর হলো।
ফিওনা নিজের চারপাশে তাকিয়ে কোন উপায় খুঁজতে চেষ্টা করে, কিন্তু নিজেকে এতটাই নিঃস্ব অনুভব করছে যে এক মুহূর্তের জন্য সবকিছুই স্থির হয়ে যায়।
জ্যাসপার মাত্রই কোন দূরবর্তী জায়গা থেকে ফিরে এসেছে। গ্লাস হাউজের গভীর নীরবতা তাকে ঘিরে ধরেছে। ক্লান্ত দেহ নিয়ে সোজা নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো। কিন্তু মাথায় কিছু অস্থির চিন্তা কিলবিল করছে। দীর্ঘ সময় রুমের এক কোণে স্থির দাঁড়িয়ে রইল, চিন্তার জালে আবদ্ধ—কি যেন একটা ঠিক মিলছে না। আচমকাই উঠে দাঁড়ালো, মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।
ফলমূল আর পানির বোতল হাতে নিয়ে পুনরায় ফিওনার রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজায় হালকা শব্দ করে স্লাইডিং হয়ে খুলে গেল। ধীরে ধীরে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো।
ফিওনা বিছানার এক কোণায় পেট চেপে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার শরীরের ভঙ্গিতে দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু জ্যাসপারের দৃষ্টি সরাসরি তার দিকে নয়, বরং বিছানার সাদা চাদরে আটকে গেল। সফেদ রঙের চাদরের জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ স্পষ্ট।
জ্যাসপারের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে কিছুক্ষণ র’ক্তে’র দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখল। চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,
“এটা কিসের র’ক্ত?”
ফিওনা তার দুর্বল হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে থাকল, কোনো উত্তর দেয়ার শক্তি তার নেই। মুখ বুজে আছে, দেহটা কাঁপছে। জ্যাসপারের মনে একটু ধাক্কা লাগলো। যতদূর মনে আছে, কাল রাতে ফিওনাকে এমন কোনো আঘাত করেনি যাতে র’ক্ত ঝরে।
“তুমি…. র*ক্তে চাদর ভরে আছে কেনো?” তার কণ্ঠে চিন্তার আভাস। “তোমাকে আমি তো সেরকম কিছু করিনি যাতে… র*ক্ত বের হয়।”
ফিওনা কষ্টে ফিসফিস করে বলল, “আমি জানি না… আমার মনে হচ্ছে আমি অসুস্থ।”
জ্যাসপারের চিন্ত আরো জটিল হয়ে উঠলো। একদিকে তার ভেতরে ক্রোধ, অন্যদিকে ফিওনার দুর্বলতা তাকে কেমন অস্বস্তিতে ফেলেছে।
জ্যাসপার ফল আর পানি টেবিলে রেখে দ্রুত ফিওনার দিকে এগিয়ে গেল। শক্ত হাতে তাকে বিছানা থেকে টেনে নামাল। ফিওনা এতটাই দুর্বল যে কোনো প্রতিরোধ করতে পারল না। জ্যাসপার তার চোখে গভীর দৃষ্টি নিয়ে একটুখানি স্থির হলো—সে পর্যবেক্ষণ করছে। কোথায় সেই ক্ষত? কোথা থেকে এই র’ক্ত বের হচ্ছে? র’ক্ত যদি এইভাবে অব্যা’হত’ভাবে ঝরতে থাকে, তবে ফিওনা মা’রা যাবে আর ফিওনা মা’রা গেলে তার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভে’স্তে যেতে পারে।
ফিওনার শরীরটা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার চোখে পড়লো ফিওনার সাদা স্কার্টের পেছন দিকটা ভিজে গেছে র’ক্তে। তার কপালে ভাঁজ পড়লো, চোখে বিরক্তির ছাপ। কিছুই বুঝতে পারছে না, সে তো মনে করতে পারছে না ফিওনাকে এমন কোনো আঘাত করেছে যেখানে এমন ক্ষ’ত হতে পারে।
ফিওনাকে আবারও নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল, দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আমি তো কাল রাতে তোমাকে এমন কোনো আঘাত করিনি যা থেকে র’ক্ত ঝরবে! তবে এটা কীভাবে হলো?”
ফিওনা কোনো উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে নিস্তব্ধ হয়ে থাকল। তার ক্লান্ত চোখ মাটির দিকে স্থির হয়ে আছে, সমস্ত কথা তার গলায় আটকে গেছে।
জ্যাসপার এবার বিরক্তির সঙ্গে ধমকে উঠল, “শুনছো না আমি কী বলছি? উত্তর দাও! এভাবে চুপ করে থাকলে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। তুমি কি সুই’সাই’ড করার চেষ্টা করেছিলে? এই ঘরে তো তেমন কিছু ছিল না, যা দিয়ে তুমি সুই*সাইড করবে!”
ফিওনা ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। জ্যাসপারের চোখে তীব্র কৌতূহল। ফিওনা কষ্টে কথা বলতে শুরু করল, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, “আসলে… আমার… আমার পিরিয়ড হয়েছে।”
এই কথা বলেই ফিওনার মুখে কেমন সংকোচ দেখা দিল, চোখ বন্ধ করে ফেলল, লজ্জার ভার সহ্য করতে পারছে না।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তার ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। “পিরিয়ড? এটা আবার কী?”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল। বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”আপনি জানেন না?”
“না। জানলে কি আর জিজ্ঞাসা করতাম?” জ্যাসপার বললো।
ফিওনা কিছুটা বিব্রত হয়ে ধীরে ধীরে বলল, “এটা… এটা মেয়েদের হয়।”
জ্যাসপার তার কথা কিছুতেই বুঝতে পারল না। মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে খাবার রেখে দ্রুত চলে গেল।
ফিওনা কয়েকবার পেছন থেকে জ্যাসপারকে ডাকল, কিন্তু জ্যাসপার কোনো সাড়া দিল না, একবারও ফিরে তাকাল না।
ফিওনা বিষণ্ণ হয়ে পুনরায় বিছানায় পুনরায় গুটিসুটি মেরে বসে রইল। শীতল, নির্জন ঘরে বাতাসের নিঃশ্বাসটা ওর অনুভূতিগুলোকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলছে। রুমে শুধু একটা ছোট বাথরুম আছে, যার মধ্যে মাত্র একটি কমোড—গোসলের কোনো ব্যবস্থাই নেই সেখানে। এই নিঃসঙ্গ বন্দিদশায় শারীরিক আর মানসিক ক্লান্তি তাকে আরও অবসন্ন করে তুলছে।
এদিকে, জ্যাসপার দ্রুত লিভিং রুমে প্রবেশ করল।
তার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সে থারিনিয়াস আর আলবিরাকে ডাকার জন্য সংকেত দিল। তারা দুইজন তৎক্ষণাৎ হাজির হলো, মুখে ধোঁয়াশামাখা ভাব।
জ্যাসপার গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, ‘পিরিয়ড’ কি? তোমাদের কেউ কি এর সম্পর্কে কিছু জানো?”
থারিনিয়াস আর আলবিরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে ঠোঁট কাম*ড়াল। থারিনিয়াস ধীরস্বরে বলল, “প্রিন্স অরিজিন, আপনি কোন বিষয়ের কথা বলছেন? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
জ্যাসপার বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার মনে সন্দেহ। সে আলবিরার দিকে ঘুরল, “আচ্ছা, যেহেতু এটা মেয়েদের হয়, তোমার তো জানার কথা, আলবিরা। তুমি কি কিছু জানো?”
আলবিরা মাথা ঝাঁকাল, “প্রিন্স, আমি কিছুই জানি না। আমার তো এমন কোনো অভিজ্ঞতাই হয়নি।”
জ্যাসপার হতবুদ্ধি হয়ে ভাবতে থাকল। চারপাশের কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার আশা নেই দেখে সে মনস্থির করল। এক মুহূর্তের জন্য গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলো, তারপর ধীরপদক্ষেপে নিজের ল্যাবের দিকে রওনা হলো
ল্যাবে পোঁছে সে দ্রুত টার্মিনাল চালু করল, নিজে থেকেই ফাইল অনুসন্ধান শুরু করল—’পিরিয়ড’ শব্দটি সম্পর্কে তথ্য জানতে।
কিছুক্ষণ পরে,সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, মানুষের জীবনে নারীদের মধ্যে মা*সিক চক্রের এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রাকৃতিক, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা কিংবা ধারণার বাইরে। এই ধারণা তাকে নতুন এক প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিল—এই জৈবিক বাস্তবতা, যা এতটাই স্বাভাবিক, সে কি আদৌ এই মানবজীবনের সরলতাকে কখনো অনুভব করেছে?
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, টার্মিনাল থেকে চোখ সরিয়ে নিল। “উফ! এই মানব জাতির জীবনে আর কত জটিলতা আছে কে জানে?” সে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল। মানুষের শরীরের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা তার কাছে এতটাই অপরিচিত, এখন এক নতুন ধাঁধার মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই মুহূর্তে ফিওনার যন্ত্রণাগ্রস্ত অবস্থা তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলতে পারছে না।
যন্ত্রণা সম্পর্কে আরও জানতে পেরে আর কীভাবে সেই যন্ত্রণাকে লাঘব করা যায়, সেই নির্দেশনাগুলো পড়ে জ্যাসপার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ফিওনার এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় জিনিস দরকার। সে জানে,তার পরিকল্পনা টিকিয়ে রাখতে ফিওনার সুস্থ থাকা অত্যাবশ্যক।
জ্যাসপার ল্যাবের শেলফগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পেল না। মানুষের এমন অদ্ভুত সমস্যার জন্য কোনো প্রস্তুতিই তার ছিল না। হতাশ মনে গ্লাস হাউজে ফিরে আসার পর, সে দ্রুত আলবিরাকে ডেকে পাঠালো।
“আলবিরা!” গম্ভীর স্বরে জ্যাসপার ডাক দিলো।
“প্রিন্স, আপনি আমাকে ডেকেছেন?” আলবিরা অবাক হয়ে এগিয়ে এলো।
“তুমি শহরের দিকে যাও। পিরিয়ডের জন্য যা যা লাগে, যেমন প্যাড আর কিছু ওষুধ—এসব দ্রুত নিয়ে এসো।”
আলবিরা একটু বিভ্রান্ত হলেও কিছু না বলেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তার জানা ছিল না মানুষের এই প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, কিন্তু প্রিন্সের নির্দেশ মেনে দ্রুত রওনা দিলো।
মিস্টার চেন শিং ল্যাবে একাকী বসে আছেন, চিন্তার ভারে ক্লান্ত, কিন্তু আজ তার সিদ্ধান্ত দৃঢ়। দিন যত গড়াচ্ছে, ততই ওয়াং লির সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছেন। তিনি জানেন, এথিরিয়নকে মুক্তি না দিলে জ্যাসপারের প্রতিশোধ আর বেশি দিন ঠেকানো যাবে না।
কিন্তু হৃদয়ের গোপন কোণে একটাই চিন্তা ঘুরছে—তার প্রিয় নাতনি ফিওনার নিরাপত্তা। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা, গবেষণা, আর আবিষ্কার তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, কারণ ফিওনাই তার জীবনের শেষ আশ্রয়। অথচ এখন, এই দুঃসময়ে, জ্যাসপারের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছেন না। তার প্রযুক্তি, বুদ্ধি, কোনো কিছুই কাজে আসছে না।
মিস্টার চেন শিং একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মনে মনে বললেন, “ফিওনার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতেও আমি প্রস্তুত। পৃথিবীর সমস্ত প্রাপ্তি আর সফলতা তুচ্ছ, যদি আমার নাতনির জীবন বিপন্ন হয়।”
আলবিরা নিঃশব্দে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, হাতে প্যাড ও কিছু ওষুধ। তার মুখে কোনো কথা নেই,শুধু চোখে চিন্তার রেখা। জ্যাসপার তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ে, আলবিরা দ্রুত সবকিছু তার হাতে তুলে দেয়।
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে ফিওনার রুমের দিকে এগিয়ে যায়। পায়ের পদক্ষেপগুলো ভারী, মনে হচ্ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে।
ফিওনাকে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে, অথচ তার প্রতি জ্যাসপারের মনোভাব কঠোর—সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন এই মেয়েটির জন্য কিছু করতে হচ্ছে। তার হাতে প্যাড আর ওষুধ, কিন্তু মন এক অজানা প্রশ্নে ভরে আছে—মানব জাতির এ কেমন দুর্বলতা?
রুমের দরজার সামনে এসে সে মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। এরপর এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে, ফিওনার দিকে পা বাড়ায়, মনে মনে প্রস্তুত হয় সেই অচেনা মানবিক অনুভূতির মুখোমুখি হতে।
জ্যাসপার রুমে প্রবেশ করতেই চোখ আটকে গেল ফাঁকা বিছানার দিকে। ফিওনা কোথায়? দৃষ্টিটা দ্রুত ঘুরে গেলো বাথরুমের দিকে। দরজা আধখোলা, আর ফিওনাকে দেখা গেল স্ল্যাবের ওপরে দাঁড়িয়ে, পেছনের দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শাওয়ারের পানি দিয়ে তার র’ক্তমাখা স্কার্ট ধুচ্ছে।
এক মুহূর্তের জন্য জ্যাসপার স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে বিরক্তির ছায়া ফুটে ওঠে, তবে তার গলা বরফের মতো ঠান্ডা, শক্ত আর থমথমে:
“তোমার জিনিসপত্র,” জ্যাসপার বললো, এক হাতে প্যাড আর ওষুধ এগিয়ে দিয়ে।
ফিওনা চমকে উঠলো, শাওয়ার বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিচে নামতে চেষ্টা করলো। মাথা নিচু করে জ্যাসপারের সামনে এসে দাঁড়ালো, মাটির দিকে তাকিয়ে। ওর শরীর তখনও ক্লান্ত, দুর্বল, কিন্তু মুখে একটা কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে ওঠে।
জ্যাসপার তার দৃষ্টিতে কোনো আবেগ বা সহানুভূতির লেশমাত্র দেখাতে চায় না, তবে ভেতরে ভেতরে সে উপলব্ধি করছে, এই মানবীর দুর্বলতা তার কাছে এক রহস্যময় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জ্যাসপার রুম ত্যাগ করার আগমুহূর্তে ফিওনার কণ্ঠ ভাঙা, ক্লান্ত।
“শুনুন,” ফিওনা ধীরে ধীরে বলল, “আমাকে শাওয়ার নিতে হবে, আর ড্রেসও পাল্টাতে হবে। দু’দিন ধরে একই জামা পরে আছি, এখনতো দাগও লেগেছে। আমার এলার্জির সমস্যা আছে… ড্রেস চেঞ্জ না করলে সমস্যা বাড়বে। আর এখানে তো শাওয়ারও নিতে পারব না।”
জ্যাসপার থমকে দাঁড়ায়, ঘাড় ঘুরিয়ে ফিওনার দিকে তাকায়। তার চোখের গভীরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, মানব জীবনের এইসব প্রয়োজনীয়তার সামনে সে এক নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
“ব্যবস্থা করছি,” বলল সে সংক্ষিপ্ত অথচ নিশ্চিত ভঙ্গিতেতারপর পুনরায় ঘুরে দ্রুত রুম ত্যাগ করল, দরজার শব্দটি ফিওনার কানে একধরনের আশ্বাসের প্রতিধ্বনি তুলে দিয়ে গেল।
জ্যাসপার দ্রুত লিভিং রুমে প্রবেশ করেই সবাইকে একত্রিত করল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আলবিরা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওই মানবী মেয়েটা এখন থেকে রুমের মধ্যে বন্দি থাকবেনা। সে বাইরে বের হবে,তবে আমাদের নিয়ম মেনে। আর এত দূর থেকে খাবার আনার প্রয়োজনও হবে না আমাদের পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আমাদের এখানকার খাবারই খেতে হবে, তাই সে মেয়েটাই আমাদের জন্য রান্না-বান্নার সমস্ত কাজ করবে। এই গ্লাস হাউজের সমস্ত কাজকর্মও তার দায়িত্বে থাকবে।”
আলবিরার চোখে শঙ্কার ছায়া পড়ল। “কিন্তু প্রিন্স, যদি সে পালিয়ে যায়?”
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে এক নির্মম হাসি ফুটে উঠল। “আলবিরা, তুমি কি ভুলে যাচ্ছো আমরা কোথায় আছি? এটা পুষ্পরাজ পাহাড়। এখানে কোনো মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। আজ পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীও এই স্থানে আসতে পারেনি। এখান থেকে পালানো এতো সহজ নয়, বিশেষ করে যখন এই পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে এক গভীর সমুদ্র আর প্রলয়ংকরী জলপ্রপাত।”
তার কণ্ঠে ছিল অমোঘ শক্তি,তার কথায় কোনো প্রতিরোধের সুযোগ নেই।
জ্যাসপার তার নির্দেশগুলো একে একে দিতে লাগল। গভীর কণ্ঠে বলল, “থারোনিয়াস, তুমি শহরের দিকে যাও। মেয়েদের জন্য কিছু পোশাক আর জুতো নিয়ে আসো। ওই মেয়েটা শাওয়ার নিতে চাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করে ফিরে এসো।”
তারপর আলবিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আলবিরা, তুমি মেয়েটিকে পাহাড়ের ডান পাশের হ্রদে নিয়ে যাবে। ওখানে শাওয়ার নিতে পারবে। আর খেয়াল রাখবে কোথাও যাওয়ার সুযোগ না পায়।”
জ্যাসপারের কণ্ঠে ছিল অমোঘ আদেশ, প্রতিটি শব্দ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। থারোনিয়াস আর আলবিরা তার আদেশ মেনে নীরবে মাথা নাড়ল, প্রত্যেকে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ল।
জ্যাসপার আলবিরাকে নিয়ে ফিওনার রুমের দিকে পা বাড়ালো, আলবিরাকে দরজার সামনে দাড় করিয়ে, জ্যসপার প্রথমে একাই কক্ষে প্রবেশ করলো।
জ্যাসপার কণ্ঠে কঠোরতা ছিল, তার প্রতিটি শব্দ ফিওনার কানে শূলের মতো বিঁধছিল। সে ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করে বললো,য়”এই বোকা মানবী, শোনো। তোমার গোসলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সবকিছু শেষ করে তৈরি হও। তোমার জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। এই গ্লাস হাউজের ধুলো মোছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করা আর আমাদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে।”
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, “কী! আমি এসব কখনোই করিনি, পারিও না!”
জ্যাসপার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, “তোমার কি মনে হয়, আমি তোমায় এখানে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো? তিন বেলা খাবার এনে দেবো? আমি তোমার চাকর নাকি?”
ফিওনার চোখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। কিন্তু জ্যাসপারের চোখে কোনো দয়া বা নম্রতার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছিল না। সে কঠোরতার প্রতিমূর্তি।
ফিওনা মনে মনে ভাবতে থাকে, এই রুমে বন্দি থাকার চেয়ে বাইরে যাওয়াটা অনেক বেশি উপকারী। সুযোগ বুঝে পালানোর পরিকল্পনা সে মনে মনে গঠন করতে থাকে। তার ভিতরে এক অদৃশ্য শক্তি জন্ম নিতে থাকে—একটি সাহসী সিদ্ধান্তের বুদ্ধি।
জ্যসপার সিগন্যাল পাঠাতেই আলবিরা রুমে প্রবেশ করে। জ্যাসপার আলবিরাকে নির্দেশ দিলো, “আলবিরা, এই মেয়েটাকে গ্লাস হাউজের বাইরের হ্রদে নিয়ে যাও।”
ফিওনা আলবিরাকে দেখে কিছুটা
অবাক হয়ে যায়। অতিব সুন্দরী একজন রমনী আলবিরা, চোখমুখে কিছুটা গাম্ভীর্যতা।
নবনীতা নিকুঞ্জ পোশাক পরিহিত মেয়েটি হালকা লুজ সবুজ রঙের গাউন জাতীয় এই পোশাক। ছোট ছোট কাঁধ পর্যন্ত চুল ধুসর সোনালী রঙের চুল তবে অদ্ভুত সুন্দর।
“এই মেয়েটা কে? এখানে কেন?” ফিওনার কণ্ঠে এক ধরনের বিস্ময়।
“ওর নাম আলবিরা, ও তোমাকে গোসলের জায়গায় নিয়ে যাবে।
ফিওনার মনে একরকম দ্বিধা ছিল—একদিকে মুক্তির আশায়, অন্যদিকে জ্যাসপারের কঠোর নির্দেশনার ভয়ে। কিন্তু সে জানত, এই সুযোগটা হারানো যাবে না।
ফিওনা আলবিরার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করে। ধীরে ধীরে করিডোরের শেষে পৌঁছতেই তার চোখে পড়লো লিভিং রুমের বিস্তৃতি। সেখানে অবস্থানরত গ্লাস হাউজের আভিজাত্য তাকে অভিভূত করে।
গ্লাসের দেওয়ালগুলো সূর্যের আলোতে রাঙিয়ে উঠেছে, প্রতিটি কোণ থেকে আলো ঝরে পড়ছে। সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গ্লাস হাউজটি মনে হচ্ছে স্বপ্নের রাজ্য। ফিওনার মনে মনে অনুভব করে, এই বিশাল মাউন্টেন গ্লাস হাউজেটা সত্যি সুন্দর।
“এটা তো একদম স্বর্গের মতো!” ফিওনা কৌতূহলের সঙ্গে বলে। “এভাবে এত বড় জায়গা… সবকিছু এত সুন্দর!” ফিওনা মনে মনে আওড়ালো।
ফিওনার গাঢ় তাকান দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে গ্লাস হাউজের প্রতি আগ্রহী। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে লিভিং রুমে চারদিকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ফিওনা গ্লাস হাউজের বাইরে পা রাখলো।
গ্লাস হাউজের বাইরে যখন ফিওনা পা রাখে, তখন সে এক অপূর্ব দৃশ্যের মুখোমুখি হয়।
পাহাড়টি মহিমান্বিতভাবে উঁচু, যা মেঘের ওপর প্রসারিত,আর তার মাথায় সূর্যের আলো ঝলমল করছে। চারপাশে সবুজ গাছপালা, যা পাহাড়ের তলদেশে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক চাদরের মতো। সেখানে থাকা ফুলের নানা রঙ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে।
ফিওনার পা যখন মাটিতে পড়ে, তখন সে অনুভব করে মাটির তাজা গন্ধ, পাহাড়ের আকাশ-বাতাসও তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। পাহাড়ের পাথুরে অংশে ছোট ছোট ঝর্ণার পানি ঝরে পড়ছে, তার আওয়াজ প্রকৃতির মধুর সঙ্গীত।
আলবিরা বাম পাশের হ্রদের দিকে এগিয়ে যায়, ফিওনা ও তার পেছন পেছন এগিয়ে যায় হ্রদের দিকে সোজা। মেঘলা পানির মাঝে নিজেকে হারানোর জন্য। কিছুক্ষণ হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে, ফিওনা গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। হ্রদের জলরাশির দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা, তুমিও কি ড্রাগন?”
আলবিরা সপ্রাণ গলায় উত্তর দেয়, “হ্যাঁ,আমি রুপালি ড্রাগন, ড্রাগন আলবিরা।”
ফিওনা আর কিছু বলেনা, কেবল সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে উদ্ভাসিত হয় এক অদ্ভুত ভাবনা — আগে মনে হতো ড্রাগন কেবল গল্পের কাল্পনিক চরিত্র আর এখন বুঝতে পারলো বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব আছে।
আস্তে আস্তে ফিওনা হ্রদে নামতে থাকে। জলটা হালকা ঠান্ডা, কিন্তু সুর্যের তাপে কিছুটা গরম অনুভব হচ্ছে। যখন সে হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে পড়ে, তখন মনে হয় সে এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। ঝর্নার পানি জমে জমে এই হ্রদ তৈরি হয়েছে, আর ফিওনা সেই জলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।
আলবিরা হ্রদের কিনারায় দাড়িয়ে আছে, ফিওনাকে পাহাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে।
“হ্রদটা খুব সুন্দর!” ফিওনা অবাক হয়ে মনে মনে বলে। পানির স্পর্শ তার চিন্তাগুলোকে পরিষ্কার করে, সমস্ত দুর্ভাবনা দূরে ঠেলে দেয়।
কোমড় পর্যন্ত পানিতে নেমে পড়ার পর, ফিওনা ধীরে ধীরে শরীরের পানি লাগাতে থাকে। পানির শীতলতা তার মনে কিছুটা সতেজতা নিয়ে আসে, সে অনুভব করে, এই মুহূর্তে সে শুধুই সে, পৃথিবীর একটি সাধারণ মেয়ে, যে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছে।
এদিকে, থারিনিয়াস পোশাক নিয়ে হাজির হয়, সে চুপচাপ পোশাকের ব্যাগ গুলো জ্যাসপারের হাতে দিয়ে দেয়। জ্যাসপার পোশাক আর জুতোগুলো ফিওনার রুমে রেখে দেয়। আর অন্য একটি ড্রাগন যার নাম ডরাডো সোনালী রঙের ড্রাগন তাকে আদেশ দেন,
“তুমি গিয়ে ফিওনার রুম পরিষ্কার করে আসো।
সেখানে কোনও জিনিস যেন অগোছালো না থাকে।” ডোরাডো মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।
ফিওনা কিছুটা বিচলিত হয়ে উঁচু পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে, আলবিরার দিকে তাকায়। “আমি এখন পোশাক কোথায় পাল্টাবো? আর আমার পোশাক কোথায়?… ” সে প্রশ্ন করে কিছুটা সংকোচে।
“তোমার পোশাক তোমার কক্ষে, সেখানেই তোমাকে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। আলবিরা সোজাসাপ্টা উওর দেয়।
ফিওনা কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, কিন্তু তারপরই সে পানি থেকে উঠে আসে।
ফিওনা পানির ভিজা থেকে উঠে এসে হাউজের দিকে অগ্রসর হয় আলবিরার সাথে।
ফিওনা গোসল করা ভেজা অবস্থায় আলবিরার সাথে গ্লাস হাউজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের সামনে দাঁড়ায়। দরজা স্লাইডিং হয়ে খুলতেই ফিওনা ভেতরে প্রবেশ করে আর তার চোখের সামনে এক অন্যরকম দৃশ্য খুলে যায়। তার কামরাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গোছানো। নতুন চকচকে সফেদ রঙের চাদর। কাঁচের দেয়ালে সূর্যের আলো মিশে সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়েছে কক্ষে।
বিছানার উপর “সুশৃঙ্খলভাবে রাখা কয়েকটি সুন্দর ড্রেস আর জুতা,যা তার জন্য প্রস্তুত।
কিছুটা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ফিওনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। বিছানার কাছে গিয়ে একটি জামা হাতে তুলে নিয়ে সে অনুভব করে একটি নতুন পরিচয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে।এরপর একটি প্যাডও নিয়ে, তার মন থেকে কিছুটা চিন্তা-ভাবনা দূর হয়ে যায়।
এখন তার হৃদয়ে সামান্য প্রশান্তির বাণী বাজতে থাকে।
কিছুক্ষণ বাদে জ্যাসপার আলবিরাকে পুনরায় নির্দেশ দিয়ে বললো,, “আলবিরা, তুমি ফিওনার রুমে যাও। তাকে বলো যেনো রান্নার প্রস্তুতি নেয়। বাজার কিচেনে রাখা আছে ”
আলবিরা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আর ফিওনার রুমের দিকে পদক্ষেপ করে। দরজা খোলার পর, সে ভিতরে প্রবেশ করে আর ফিওনাকে দেখার সাথে সাথে গম্ভীর ভাবে বলে,”ফিওনা, প্রিন্স জ্যাসপার তোমাকে দুপুরের রান্নার করার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।”
ফিওনা জামাটি পরতে পেরে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সে মাথা তুলে আলবিরার দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু আমি রান্না করতে পারি না।”
আলবিরা ধার গলায় বলে, “এটা সম্পুর্ন তোমার ব্যাপার প্রিন্স আমাকে যা হুকুম করছেন আমি শুধু সেটুকু পালন করতে পারি। আমার সাথে চলো তোমাকে কিচেন দেখিয়ে দিচ্ছি”।
ফিওনা কিছুটা হতাশ হয়ে আলবিরার সাথে পা বাড়ায়।
সিঁড়ি বেয়ে লিভিং রুমে নামার পরে ডান পাশে রয়েছে কিচেন। তারা একসঙ্গে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়, আর সেখানে পৌঁছালে ফিওনা দেখতে পায়।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের রান্নাঘর আধুনিক আর প্রশস্ত স্থান, যেখানে সৌন্দর্য আর কার্যকারিতা একত্রিত হয়েছে। রান্নাঘরের দেয়াল আর ছাদ সম্পূর্ণ গ্লাসের তৈরি, যা প্রাকৃতিক আলো প্রবাহিত করে আর চারপাশের পাহাড়ের দৃশ্যকে উন্মোচন করে।
রান্নাঘরের কেন্দ্রে একটি বিশাল আয়তাকার কাউন্টার রয়েছে, যা সাদা মার্বেল পাথর দ্বারা তৈরি। কাউন্টারের উপর রাখা আছে নানা ধরনের রান্নার সরঞ্জাম, যেমন হাঁড়ি, কড়াই, আর প্যান। ডাইনিং এলাকার পাশে একটি আধুনিক রান্নার কল রয়েছে, যা ক্রোমিয়াম লেভার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কলের নিচে সজীব ও তাজা সবজি ও মশলা সাজানো আছে, যা রান্নার জন্য প্রস্তুত।
রান্নাঘরের পাশে একটি বড় প্যান্ট্রি রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেয়ালে রয়েছে গাছের টব, যেখানে তাজা হার্বস যেমন তুলসী, ধনে, আর পুদিনা গজিয়ে উঠেছে, যা রান্নার জন্য সহজে ব্যবহার করা যায়।
রান্নাঘরের প্রতিটি কোণ আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে প্রকৃতির স্পর্শ নিয়ে এসেছে। রান্নাঘরে থাকা বড় জানালাগুলি থেকে বাহিরের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখা যায়, যা রান্নার সময়কে আরও উপভোগ্য করে তোলে।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের রান্নাঘর সত্যিই একটি স্থাপত্যের নূতন উদাহরণ, যেখানে আধুনিকতা আর প্রকৃতি একসাথে মিলিত হয়েছে। এখানে রান্না করা যেন আনন্দের উৎসব, যেখানে স্বাদ আর সৌন্দর্য একসাথে মিশে যায়।
ফিওনার মনে নতুন এক উদ্দীপনা অনুভব হয়। সে রান্নাঘরের প্রতি মুগ্ধ হয়।যা তার রান্নার করার আগ্রহ বাড়িয়ে তুললো।
আলবিরা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি তাহলে আসছি, তুমি কাজ শুরু করো” বলেই আলবিরা রান্নাঘর ত্যাগ করলো। আলবিরা যাওয়ার সাথে সাথে ফিওনা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগল।
ফিওনা রান্নাঘরের সৌন্দর্যে মোহীত থাকলেও কিয়ৎক্ষন বাদেই অবাক হয়ে যায়।
চৌকিতে রাখা সবজি আর মশলাপত্রের বিশাল সম্ভার দেখে তার মনে শঙ্কা জাগে।
বিভিন্ন ধরনের অনেক তাজা সবজি,মসলা সুশৃংখলা ভাবে সাজানো রয়েছে মনে হচ্ছে কোনো ভিন্ন জগতের খাবারের স্বপ্ন সাজানো হয়েছে।
“এতো সবজি আর বাজার কেন?”—মনে মনে চিন্তা করে ফিওনা। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন, “এতো কিছু রান্না করতে হবে? কিন্তু আমি তো জানি না কিভাবে রান্না করতে হয়।”
একটু হতাশায় ভেঙে পড়ে সে। আলবিরা তো কিছুই বলে যায়নি। রান্নার জন্য কোন বিশেষ পদ ঠিক করে দিয়েছে কি না, সে বিষয়েও কিছু জানায়নি। সে কেবল কিচেনে দেখিয়ে দিয়ে বলে গেলো , “শুরু করো,” কিন্তু শুরুটা কীভাবে করবো? ফিওনা মনে মনে বিরক্ত হয়।
ফিওনার মনে হয়, এখানে অনেক কিছু রান্না করা হবে, অথচ তার হাতে কোনো নির্দেশনা নেই। সে জানে না, কোন পদটি প্রাধান্য পাবে, কিভাবে শুরু করবে, বা কিভাবে সঠিকভাবে প্রস্তুত করবে।
ফিওনা এক হাত দিয়ে মাথা চুলকে নেয়, আর মনে মনে চিন্তা করে, “এখন কি করবো, কাকে জিজ্ঞাসা করবো?” তবে ফিওনা জানে, পিছু হটলে জ্যাসপারের হাত থেকে রক্ষা নেই। তাই সে গভীর শ্বাস নিয়ে কিচেনের কোণে গিয়ে দাঁড়ায়।
আযদাহা পর্ব ১২
“ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করি,” বলে সে তাজা সবজিগুলো ঘেঁটে দেখে, কোনটি কোন রান্নার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আশা জাগানিয়া চিন্তা তার মনে কেঁদে ওঠে, “ড্রাগনদের রান্না, খাবার সম্পর্কে কিছুই ধারনা নেই তার।
মনের মধ্যে বিভিন্ন উপকরণের সমাহার নিয়ে সে পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করে ইউটিউব দেখারও উপায় নেই। হাতে স্মার্ট ফোনটাও নেই।
