আযদাহা পর্ব ১৬
সাবিলা সাবি
ফিওনার চোখে তখ আতঙ্কের ঝিলমিল জ্যাসপারের অতি কাছে আসার সাথে সাথে মনে হলো, তার চারপাশের সবকিছু হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে, সে অনুভব করলো জ্যাসপার তার শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।
জ্যাসপার ফিওনার কাছে এসে দাঁড়ালো, তার উচ্চতা এক উঁচু পাহাড়ের মতো, যেখানে ফিওনার মতো ছোট্ট একজন মানুষের জন্য সবকিছু অতি বিশাল আর ভীতিকর। তার শরীরকে কিছুটা সামনে ঝুঁকিয়ে ফিওনার দিকে নজর রাখল,মনে হলো পেশীবহুল শিকারী তার শিকারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
ফিওনার মাথার দুই পাশের কাঁচের দেয়ালের বিরুদ্ধে জ্যাসপারের শক্তিশালী হাত দুটি স্থাপন হলো ফিওনাকে তার গ্রাসে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত।
কাঁচের পৃষ্ঠের ঠান্ডা স্পর্শ তার পিঠে লাগছিল, প্রতিটি শ্বাসে ফিওনার মনে অশুভ অনুভূতি তৈরি করছিল। জ্যাসপারের স্নিগ্ধ অথচ ভয়ঙ্কর দৃষ্টি তার প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে তুলছিল।
ফিওনার দৃষ্টি জ্যাসপারের দিকে নিবদ্ধ হলো,কিন্তু সে কোনোরকম শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিল না।
জ্যাসপার মাথা কিছুটা ঝুঁকে ফিওনার সামনে এসে বললো, “ইউ আর সাচ আ ব্লাডি ফুলিশ হিউম্যান! এন্ড আই হেইট হিউম্যান।”
জ্যাসপারের গম্ভীর কণ্ঠস্বর প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্বাভাস দিলো, তার কথায় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। “কারণ, তোমরা হিউম্যানরা অনেক সেলফিশ আর বেইমান হয়ে থাকো। তোমার মনে হয় আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো? বোকা দুর্বল মানবী।”
ফিওনার দৃষ্টি জ্যাসপারের চোখের গভীরতায় তলিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে জ্যাসপারের অভিব্যক্তিতে এক নির্দয় সত্তা দাঁতে ফেলো —যা তাকে আরো বিভ্রান্ত আর হতাশ করে তুললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার পুনরায় তার গভীর, গম্ভীর কণ্ঠস্বর তুলল, “কি হলো, এখন কথা বলছো না কেন? শেষ সব কথা?” তাঁর কথায় ছিল বিদ্রূপের রেশ, যা ফিওনার হৃদয়ে র*ক্তপাতের মতো অনুভূত হচ্ছিল।
ফিওনা নিজের মাথা নিচু করে নিল মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা তার জন্য নিরাপত্তার আড়াল। সেই সময়, জ্যাসপার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে যায়, তাঁর গরম নিঃশ্বাস ফিওনার কানে উষ্ণ হাওয়ার ঝাপটা নিয়ে আসলো।
“আগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো, বোকা মানবী।আমি কাছে আসলে তো দুনিয়াই ভুলে যাও।”
ফিওনার মধ্যে যে আতঙ্ক কাজ করছিল, জ্যাসপারের কথার ভারে আরও বাড়তে লাগল। জ্যাসপারের এই হাস্কি স্বরের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত ক্ষমতা, যা ফিওনার হৃদয়ে প্রবেশ করে তাকে এক অসাধারণ, ভয়ঙ্কর আকর্ষণের আবহে বাঁধছিল।
সে জানতো, এই ভয়ঙ্কর ড্রাগন রাজপুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানে এক কঠিন যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া।
জ্যাসপার ফিওনার থেকে কিছুটা দূরে সরে এলো তাঁর বিরূপ আচরণের ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করলো।এদিকে, ফিওনা দাঁড়িয়ে ছিল মাথা নিচু করে।
হঠাৎ, জ্যাসপার কফির মগ হাতে নিয়ে এক চুমুক দিল, কফি একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাতে তার রাগের আগুন প্রজ্বলিত হলো। সে ক্ষোভে কফি সজোরে ফিওনার দিকে ছুঁড়ে মারলো।
কফির তরল আকাশের বৃষ্টির মতো ফিওনার গায়ে ঝরে পড়ল। ফিওনার মুখ থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত ভিজে গেলো সেই কালো কফির রস দিয়ে। তার সাদা গাউনটি কফির স্রোতে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল,মনে হলো নির্মলতার প্রতীকের পবিত্র স্থান অপবিত্র হয়ে পড়ল।
ফিওনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো, সে উপলব্ধি করতে পারছে না—এতো বড় অপমান সে সহ্য করতে পারে না। তার চোখে অশ্রুর জল জ্বলে উঠল।রাগ,দুঃখ,আর লজ্জা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, ফলে তার হৃদয়ের গভীরতা থেকে কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
জ্যাসপার অমানবিকভাবে বললো, “এই মেয়ে, এই কফির মগটা নিয়ে এখনি আমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাও। তোমার জন্য আমার কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।” তার স্বরে ছিল নিষ্ঠুর অথচ ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্কশতা।
ফিওনার হৃদয়ে তখন অদ্ভুত ক্ষোভ জাগ্রত হলো।সে কেবলমাত্র কফির জন্য কষ্ট পাচ্ছিল না; বরং তার আত্মসম্মানের প্রতি এমন নৃশংস আঘাত সে সহ্য করতে পারছিল না।
ফিওনা মগটি হাতে নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তার চোখে জল আর হৃদয়ে দগ্ধ বিষণ্ণতা,প্রতিটি পদক্ষেপে কষ্টের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে, তার মন কেবলমাত্র জ্যাসপারের অমানবিক আচরণের বিষণ্ণ স্মৃতি দ্বারা গ্রাসিত ছিল।
কিচেনে প্রবেশ করে, অ্যাকুয়ারা তাকে দেখে আঁতকে ওঠে। ফিওনার হাতে কফির মগ, আর তার মুখ আর গলায় কফির দাগে ঢাকা পড়েছে। চমকিত হয়ে অ্যাকুয়ারা প্রশ্ন করলো,“একি, ফিওনা? তোমার এই অবস্থা কেন? কফি নিয়ে পড়ে গিয়েছিলে নাকি?”
ফিওনা কাঁদতে কাঁদতে উত্তরে বলে, “তোমাদের প্রিন্স আমার ওপর কফি ছুড়ে মেরেছে।”
অ্যাকুয়ারা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করে, “কি বলছো?প্রিন্স এটা করেছে? কিভাবে সম্ভব? আমাদের রাজ্যের রুলসে এসব করা তো নিষিদ্ধ!তাহলে উনি তোমার সঙ্গে এমন আচরণ কেন করলো, ফিওনা?”
ফিওনার চোখে শুধুই জল সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে, কোনো উত্তর দেওয়ার শক্তি তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তার মন খারাপ, পুরো পরিস্থিতি তাকে অতল অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে। শেষে,কফির মগ কিচেনে রেখে, ফিওনা এক প্রকার দৌড়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য একটিই—নিজের কক্ষে ফিরে যাওয়া, যেখানে অন্তত কিছুক্ষণ একাকিত্বের নিরাপদ আশ্রয় পাবে।
রাতের আকাশে নক্ষত্রেরা জ্বলে উঠেছে, কিন্তু বাড়ির ভেতরে গভীর এক নীরবতা বিরাজমান। রান্নাঘরের চারপাশে অ্যকুয়ারা ব্যস্ত হাতে খাবারের পাতিল গুছিয়ে রাখছে, তার নিখুঁত নৈপুণ্য এই মহলের জন্য এক শৃঙ্খলিত কাজ। অপরদিকে, ফিওনা ডাইনিং টেবিলে ধীরে ধীরে থালা-বাসন সাজাচ্ছে, তার মনোজগতে আজকের দিনের অপমানের কালো ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে।
টেবিলের কেন্দ্রে, হৃষ্টপুষ্ট খোদাই করা এক সিংহাসনের মতো বিশাল চেয়ার জ্যাসপারের জন্য রাখা হয়েছে, এক রাজপুত্রের উপযোগী আসন।মোমের আলোর নরম আভা টেবিলের ওপরে পড়ে থালাগুলোর রুপালি প্রান্তগুলোকে দ্যুতি দিচ্ছে। ফিওনা একটার পর একটা পদ সাবধানে টেবিলে রাখছে, তার হাতে কাঁপুনি নেই, কিন্তু তার মন বিক্ষিপ্ত।
আজকে হঠাৎ, জ্যাসপারের উপস্থিতির সংবাদ এসে পৌঁছায়। তার আজকের নির্দেশ—ডাইনিং আজকে সবার সাথে বসে খাবার খাবে তাই এই রাজকীয় চেয়ারের আয়োজন। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষিত শক্তিমান পুরুষটি যখন তার রাজকীয় আসনে বসবে, তখন টেবিলের ওপর চাপা,অথচ অসহনীয় এক পরিবেশ ভর করবে।
আসবাবপত্র, থালাবাটি, খাবারের প্রতিটি থালা, অপেক্ষা করছে সেই সর্বশক্তিমান ড্রাগন রাজপুত্ররের প্রবেশের।
ফিওনার মনোজগতে আজ ভয় আর দ্বিধার ঢেউ চলছে। বারবার মনে পড়ছে জ্যাসপারের হাত থেকে তার উপর বর্ষিত সেই কফির মুহূর্ত, তার আত্মসম্মানের মর্মান্তিক আঘাত। এখন আবার তার সম্মুখীন হতে হবে? সবার সামনে তাকে পুনরায় অপমান করবে কিনা—এই ভাবনাই তাড়া করে ফিরছে ফিওনাকে। কিন্তু এই বিশাল গ্লাস হাউজের শৃঙ্খলিত জীবনে তার কোনোই বিকল্প নেই। বাধ্য হয়ে তাকে এই ডাইনিং টেবিলে থাকতে হবে, সেই র*ক্তচক্ষু ড্রাগনের সামনে।
ডাইনিং টেবিলে ইতোমধ্যে সবাই জড়ো হয়েছে।আলবিরা,থারিনিয়াস, আর বাকি ড্রাগন সদস্যরা নিজেদের আসনে ধীরেসুস্থে বসে পড়েছে। তারা একে অপরের সঙ্গে নিস্তব্ধ কথোপকথনে কিন্তু ফিওনার মন অন্যদিকে, তার চোখের কোণে সারাক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে সেই কাঠের সিঁড়ির দিকে, যেখান দিয়ে জ্যাসপারের নামার প্রতীক্ষা করছে।
অবশেষে, সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। কাঠের সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে জ্যাসপারের ভারী পায়ের শব্দ শোনা যায়, প্রতিটি পদক্ষেপ তার অপরিসীম শক্তি আর ত্রাসের আভাস। সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা জ্যাসপারের উপস্থিতি ঘরের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হয়। তার উচ্চতা, আভিজাত্য, আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সবার সম্মুখে এক প্রভাব বিস্তার করে— ডাইনিং টেবিলের চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে তার আগমনে।
ফিওনার হৃদয় মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। অন্যরা গভীর শ্রদ্ধায় তাকিয়ে আছে তাদের প্রিন্সের দিকে,কিন্তু ফিওনার মন দোলাচল করে—আজ আবার কীভাবে তার ভাগ্য নিয়ে খেলা হবে?
জ্যাসপার তার রাজকীয় আসনে বসে পড়লে, তার দেহভঙ্গিতে এক ধরনের প্রচণ্ড গাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাটের মতো আভিজাত্য আর একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতীক হয়ে সেই আসনে তার অধিষ্ঠান বাতাসকেও ভারী করে তোলে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফিওনা আর অ্যাকুয়ারাকে একনজর দেখে সে ঠান্ডা গলায় নির্দেশ দিল, “অ্যকুয়ারা বসে পড়ো টেবিলে তোমার আসনে, আমাদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করবে।”
অ্যাকুয়ারা এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার দিকে তাকায়, তার চোখে ফুটে ওঠে দ্বিধা আর মায়া। এক অজানা বোধ তার অন্তরকে স্পর্শ করে। ফিওনার এই নিস্তব্ধ কষ্ট, এই নিরব প্রতিবাদ তার মনকে আলোড়িত করে, তবু অ্যাকুয়ারা অবশেষে তার প্রিন্সের আদেশ মেনে নিয়ে আস্তে করে চেয়ারে বসে পড়ে।
কিন্তু ফিওনার ভাগ্যে কোনো বসার অনুমতি নেই।জ্যাসপারের নির্দেশে সে একা একাই সবার খাবার পরিবেশন করবে। তার হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে, একের পর এক প্লেটে নিস্তরঙ্গ দক্ষতায় খাবার তুলে দিচ্ছে। খাবারের গন্ধে টেবিলের অন্যরা তৃপ্তি পেলেও, ফিওনার মনে সেই কাজ কোনো আনন্দ বয়ে আনে না।প্রতিটি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মমর্যাদা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, কিন্তু তবুও সে নিরুপায়—নির্বাসিত এক বন্দীর মতো গ্লাস হাউজের এই শৃঙ্খলে জড়িয়ে আছে।
অ্যাকুয়ারা দূর থেকে ফিওনার অসহায়তাকে লক্ষ্য করে। তার চোখে মিশে থাকে অপরাধবোধ, কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না। ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপে তার অন্তরের গভীরে ঝাঁকুনি লাগে, কিন্তু জ্যাসপারের দৃষ্টির সামনে সে নীরব থেকে যায়।
অ্যাকুয়ারা মনে মনে দ্বিধাগ্রস্ত। ফিওনার মতো একটা মেয়েকে এভাবে অপমান আর কষ্ট দেওয়া, তা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার মিষ্টি স্বভাব, শান্ত আচরণ—সবকিছুই তো প্রমাণ করে যে ফিওনা কোনো জীবের ক্ষতির কারণ নয়। তবু কেন তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? অ্যাকুয়ারা নিজের মনকে প্রশ্ন করে, “শুধু মানুষ বলেই কি সে এতোটা অপদস্থ হবে? নাকি ড্রাগন রাজ্যের নিয়মের বাইরে কিছু চলছে?”
ফিওনার প্রতি এ অন্যায় আচরণ ড্রাগনদের গর্বিত ঐতিহ্যের সাথে বেমানান। ড্রাগন রাজ্যের নিয়ম তো বরাবরই কঠোর হলেও ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে ছিল। আর সেখানে এই মানবীর প্রতি এমন নির্মমতা?অ্যাকুয়ারার বুকের ভেতর গুমরে ওঠে। প্রিন্সের এই কঠিন রীতি কি সঠিক? অ্যাকুয়ারা বুঝতে পারে না, কিন্তু তার মনের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি ঘনীভূত হয়।
“প্রিন্স অরিজিন এই সাধারণ একটা মানবীর সাথে এমন আচরন কেনো করছেন ?” এই প্রশ্ন ক্রমেই তার চিন্তার গভীরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, কিন্তু রাজকীয় আদেশের সামনে সে যে অসহায়।
রাতের নীরবতায় ডাইনিং কক্ষের গুঞ্জন থেমে গেলে জ্যাসপার সবাইকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিংয়ে বসল। অন্ধকারে ঝলমল করতে থাকা চাঁদের আলো বড় বড় কাঁচের দেয়ালের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছিল।কক্ষের ভেতর ড্রাগনদের একত্রিত উপস্থিতি গম্ভীর এক আবহ তৈরি করল। ফিওনা তখন নিজের কক্ষে ফিরে গেছে, আর অ্যাকুয়ারা, যার এ ধরনের মিটিংয়ে থাকার প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র কিচেনের কিছু কাজ শেষ করতে এসে নিস্তব্ধভাবে দূরে দাঁড়িয়েছিল।
জ্যাসপার থারিনিয়াসকে নির্দেশ দিলো, “মিস্টার চেন শিং আর ওয়াং লি ওদের পরিকল্পনা সম্পর্কে যেভাবেই হোক খোঁজ নাও।এথিরিয়নের মুক্তির পথে এটাই একমাত্র ধাপ যা এড়ানো যাবে না, ওদের পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী আমরা আমাদের পরিকল্পনা করবো।”
থারিনিয়াস সম্মতি জানিয়ে মাথা নিচু করল, তার ডানা মেলে ধরল চীনের আকাশে উড়তে। সে জানত, আজকের রাতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে বিশেষ এক সংবাদ নিয়ে ফিরতে চায়, যা এই মিশন সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।
জ্যাসপার এরপর তার মনোযোগ ফেরালো আলবিরার দিকে। “ফিওনাকে দিয়ে গ্লাস হাউজ পরিষ্কার করাও।কদিন হলো কাঁচগুলো অপরিষ্কার হয়ে পড়ে আছে, পুরো লিভিং রুমের কাঁচগুলো ক্লিন করতে হবে। তবে মনে রেখো,অ্যাকুয়ারা ওকে কোনোকিছু দেখিয়ে না দেয়, সাহায্য করার কোনো অধিকার নেই তার।”
আলবিরা মাথা নোয়ালো, তার মধ্যে ক্ষীণ এক সংশয় ছিল। কিন্তু জ্যাসপারের চোখের কঠোরতা তাকে নীরব রাখল। কক্ষের বাইরে থারিনিয়াস তখন প্রবল গতিতে চীনের আকাশপথে ছুটে চলেছে, রাতের বাতাস তার ডানা স্পর্শ করছে। আজকের রাতের শেষে, জ্যাসপার এক বিশেষ বার্তা পেতে চলেছে, যা তার চিন্তার গতিপথে নতুন মোড় আনবে।
আলবিরা নিঃশব্দে ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করল।ফিওনা তখন একটুখানি বিশ্রামের জন্য চোখ বুজেছিল, সারাদিনের ক্লান্তি তার মুখে স্পষ্ট। আলবিরা তার কণ্ঠকে অদ্ভুতভাবে শীতল করে বলল, “এই মেয়ে, শোনো। লিভিং রুমের গ্লাস এখনই পরিষ্কার করতে হবে। প্রিন্সের আদেশ।”
ফিওনা তার চোখ খোলার সাথে সাথে আলবিরার আদেশের কাঠিন্য বুঝে গেল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, তার ভেতরের ক্লান্তি তার চাহনির গভীরে লুকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর ফিওনা লিভিং রুমে পৌঁছায়, যেখানে গ্লাস পরিষ্কারের সরঞ্জামগুলো অগোছালোভাবে ছড়িয়ে রাখা। একটা বালতি, গ্লাস ক্লিনার, শুকনো সাদা কাপড়, আর একটা পুরোনো মই। আধুনিক এই গ্লাস হাউজের শোভামণ্ডিত সৌন্দর্যের সাথে এ সরঞ্জামগুলো যেন মেলাতে পারলো না। সারা ঘরজুড়ে কাঁচের যে আভিজাত্য ছড়িয়ে আছে, সেখানে তাকে এনালগ পদ্ধতিতে গ্লাস পরিষ্কার করতে হবে, যা নিঃসন্দেহে অপমানের এক সূক্ষ্ম অস্ত্র।
ফিওনা বুঝতে পারল, এটা শুধুই শাস্তি নয়,বরং একটা উপহাস। জ্যাসপার তার সাথে খেলা করছে, অকারণেই তাকে এই প্রতিটি পদক্ষেপে হেনস্তা করছে। ফিওনার মন এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। এই শক্তিশালী ড্রাগন রাজপুত্রের বিরুদ্ধে তার অপরাধটা আসলে কী, যে তাকে এমন কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে রেখেছে?
তার চোখের কোণে অজান্তেই জল জমতে থাকে, কিন্তু সে সেই জলকে দেখিয়ে দেয় না। গ্লাসের পাশে দাঁড়িয়ে এক কঠিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কাপড় হাতে তুলে নিয়ে কাজ শুরু করল,ৎএটাই তার একমাত্র পথ।
ফিওনা রাতভর নিঃশব্দে লড়াই করেছে গ্লাসের সাথে।প্রতিটি কাঁচের পৃষ্ঠ তার আত্মার প্রতিফলন ধরে রেখেছে—সেখানে ছিল তার ক্লান্তি, নীরব যন্ত্রণা, আর অপমানের দাগ। একের পর এক গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে, কেবল ফ্লোরই নয়, তার মনও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সাবানের ফেনা তাকে উপহাস করছিলো।
ভোরের হালকা আলো যখন জানালার কাঁচে ধাক্কা দিল, ফিওনা একরাশ ক্লান্তি নিয়ে মই থেকে নেমে এলো। মইটা একপাশে ঠেলে রেখে, হাতে থাকা বালতি নিয়ে খুব ধীরে ধীরে পা ফেলল। প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানী,এক ভুলে তার পরিশ্রম ভেস্তে না যায়।সাবানের পানিতে ফ্লোর সাদা হয়ে গেছে, আর সেই সাথে তার আত্মবিশ্বাসও ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। ফ্লোর পরিষ্কার করতে হবে, কিন্তু ফিওনার শরীরে আর সেই শক্তি নেই।
বালতিতে নতুন করে পানি ভরে, ফ্লোরের শেষ অংশের দিকে সে এগিয়ে যায়, ফিওনার উদ্দেশ্য আগে সিঁড়ি মুছবে তাই খুব ধীরে ধীরে উঠতে যাচ্ছিলি আর তখনি জ্যাসপার সিঁড়ি বেয়ে নামছে, দ্রুত পদক্ষেপে, কিছু জরুরি কাজের তাড়া নিয়ে। ফিওনা তখনো সিঁড়ি বেয়ে উঠার প্রস্তুতি মাত্র এক সিঁড়িতে পা রেখেছে চোখ ঠিকমতো না তুলে সে এগিয়ে আসছিল।
এক মুহূর্তে দুজনের পথ এক হয়ে গেল। জ্যাসপার সজোরে ফিওনার সাথে ধাক্কা খায়। ফিওনার হাতে থাকা বালতি মুহূর্তেই মাটিতে পড়ে যায়, আর সেই সাথে সব পানি ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। সাবান আর পানি মিশে পুরো লিভিং রুমের ফ্লোর পিচ্ছিল হয়ে যায়।জ্যাসপার সামান্য হোঁচট খেয়ে পা ঠেকালেও নিজেকে সামলে নিলো, কিন্তু ফিওনা ততক্ষণে ভারসাম্য হারিয়ে ঢলে পড়েছে।
ফিওনার শরীর তখন ভারসাম্য হারিয়েছে, সে ঝট করে জ্যাসপারের ধুসর রঙের শার্টের কাঁধে আঁকড়ে ধরেছে, যাতে পড়ে না যায়। জ্যাসপারের দিকে টান লেগে শার্টটা কুঁচকে গেছে,আর পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যে, জ্যাসপার বুঝে ওঠার আগেই জ্যাসপার ফিওনাকে নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ফিওনার পতন সরাসরি জ্যাসপারের ওপরেই হয়েছে।
জ্যাসপার হঠাৎ আঘাতে মৃদু ব্যথা অনুভব করে মাথায়, কিন্তু তার ধ্যান তখন সম্পূর্ণ অন্যদিকে। ফিওনা তার বুকের ওপর পড়ে গেছে, শ্বাসকষ্টের মতো নীরবতা ঘিরে ধরে মুহূর্তটাকে। ফিওনার চোখগুলো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে, সে মাথা তুলতেই দেখতে পেল জ্যাসপারের রাগান্বিত মুখ, যার দৃষ্টিতে একপ্রকার ভ্রুকুটি লুকিয়ে আছে, আর তার সেই অলিভ গ্রিন চোখ দপদপ করছে আগুনের মতো।
ফিওনার চুল আর মুখমণ্ডল সাবানের সাদা ফেনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। জ্যাসপারের বুকের ওপর পড়ে থাকা ফিওনার চেহারা এতোই বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে, পুরো পরিস্থিতির একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাবানের সেই ফেনা।এক অদ্ভুত নীরবতা গ্রাস করে চারপাশকে,শুধু জ্যাসপারের রাগান্বিত দৃষ্টির চাপ ফিওনাকে ভস্ম করে দিতে চাচ্ছে।
জ্যাসপারের কণ্ঠের কঠোরতা লোহার শিকলের মতো ফিওনার কানে আঘাত করে, “এই মেয়ে, কোনো কাজ কি শিখোনি ঠিকমতো? সারা ফ্লোর সাবান পানিতে ভাসিয়ে ফেলেছো! ওঠো আমার ওপর থেকে!”
ফিওনা তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও সাবান পানির পিচ্ছিলতা তাকে ফের ব্যর্থ করে দেয়। পা পিছলে আবারও সে জ্যাসপারের ওপর পড়ে যায়। জ্যাসপার এক নিঃশ্বাসে ব্যথার মৃদু শব্দ করে, তার মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট বিরক্তিতে ভরা। ফিওনা পুনরায় মাথা তুলে তাকায়, চোখে লজ্জার ছাপ।
“উঠতে পারছি না তো,” ফিসফিস করে বলে ফিওনা, গলার সুরে একপ্রকার অসহায়ত্ব।
জ্যাসপার গভীর বিরক্তির সুরে তাচ্ছিল্য করে বললো, “আমার ওপর পড়ে থাকতে নিশ্চয় খুব আনন্দ হচ্ছে, তাই না? তাই ওঠা হচ্ছে না তোমার?”
তার রাগান্বিত দৃষ্টির তীব্রতা ফিওনার মনে চাবুকের মতো আঘাত হানে, আর ফিওনার শরীরের ওপর ছড়িয়ে থাকা সাবানের ফেনা আরো প্রকটভাবে হাস্যকর করে তোলে পুরো পরিস্থিতি।
জ্যাসপার হঠাৎই ফিওনাকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নেয় ,মুহূর্তের ভেতরই ফিওনা তার নিচে আর সে নিজে ফিওনার ওপরে। চারপাশে সাবানের পিচ্ছিল জলধারায় নিমজ্জিত ফ্লোরে। ফিওনার চোখে বিস্ময় আর জ্যাসপারের চোখে অগ্নি, রাগ আর অদ্ভুত এক টান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জ্যাসপারের শরীরের ওজন ফিওনার ওপর ভর করে আছে, তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ফিওনার মুখে এসে ঠেকে। ফিওনার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে, আর জ্যাসপার কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, ফিওনার মুখের কাছাকাছি জ্যাসপারের চেহারা, সেই মুহূর্তে তাদের চারপাশের সাদা ফেনা আর ঠাণ্ডা ফ্লোর এক অদৃশ্য মায়াজালের অংশ হয়ে যায়।
ফিওনা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে, তার শরীরের উপর জ্যাসপারের উপস্থিতি তাকে স্তব্ধ করে রেখেছে।
জ্যাসপার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই, তার ভারসাম্য হারিয়ে যায়। পিচ্ছিল সাবান পানিতে পা পিছলে ফিওনার ওপর আবারও ধপাস করে পড়ে যায়। এবার তার মুখ সরাসরি ফিওনার ঘাড়ে এসে ঠেকে। সেই মুহূর্তে ফিওনার সারা দেহ শীতল স্রোতে শিহরিত হয়ে ওঠে,চারপাশের সব শব্দও স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ফিওনার ঘাড়ে জ্যাসপারের গরম নিঃশ্বাসের আভাস স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়, তার ত্বকে অজান্তেই স্পর্শের নীরব ঝড় বয়ে যায়। জ্যাসপারের চুলের ভেজা অনুভূতি ফিওনার ত্বকে মিশে গিয়ে অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দেয়,ঘরের প্রতিটি কোণায় গ্লাসের দেয়ালের প্রতিফলন সেই অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আছে।
জ্যাসপার নিজেও কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে,তার মুখ ফিওনার ঘাড়ের কাছে নিবিড়ভাবে স্থির। ফিওনার শ্বাস দ্রুত হয়ে আসে,তার মনের অজস্র চিন্তা এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেছে।
তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিসফিসিয়ে বলে, “তোমার এসব বোকা বোকা কাজের জন্য আমাকেও বিপদে পড়তে হয় কেনো বারবার ফিওনা?।”
ফিওনা কোনো উত্তর দিতে পারেনা, তার দেহের প্রতিটি স্নায়ু সেই ঘনিষ্ঠ স্পর্শে বিদ্যুৎপ্রবাহিত হয়ে উঠেছে,আর তার মনের ভেতরে জ্বলতে থাকা প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।
জ্যাসপার পুনরায় খুবই সাবধানতার সাথে ধীরে ধীরে ফিওনার ওপর থেকে সরে যেতে চায়, কিন্তু হঠাৎই টের পায় যে তার গলার সেই রহস্যময় লকেট ফিওনার জর্জেটের ফ্রকের বুকের কাছের কাপড়ের সাথে জট পাকিয়ে গেছে। তাদের দুজনের মাঝের শূন্যতা আরেকবার বন্ধ হয়ে আসে, ফিওনার শ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে ওঠে।
জ্যাসপার কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধির মতো চেয়ে থাকে। তার হাতে স্পর্শ করে লকেটটি ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কাপড়ের সূক্ষ্মতা আর লকেটের ধারালো অংশগুলো তাদের দুজনকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে।
ফিওনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্থির থাকে। তার চোখে আতঙ্ক আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু নিজের অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যও কিছু বলতে পারছে না। সেই অদ্ভুত লকেট জ্যাসপারের সাথে তার অবিচ্ছেদ্য কোনো বাঁধনের মতো তাকে আটকে রেখেছে।
“আবারো শুরু হলো আরেক ঝামেলা।” জ্যাসপার এক প্রকার বিরক্তির সুরে বলে, তার গলার স্বর গভীর তীক্ষ্ণ।
কিন্তু তার হাতের প্রতিটি স্পর্শে ফিওনার মন কেঁপে ওঠে, যা তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও প্রতিটি ক্ষণে আরো নিবিড় হয়ে আসছে।
জ্যাসপারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল,সে চিৎকার করে ডাকে আলবিরাকে,আর তার কণ্ঠের সেই কমান্ড গোটা গ্লাস হাউজ কাঁপিয়ে তোলে।
মুহূর্তেই আলবিরা ছুটে আসে, সিঁড়ির ওপর থেকে দৃশ্যটি দেখে তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ। সাদা সাবানের ফেনায় ভরা সেই পিচ্ছিল ফ্লোরে ফিওনা আর জ্যাসপার গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে—দৃশ্যটি যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি অবাক করার মতো।
আলবিরা নিচে না নেমেই দৃশ্যের গভীরতা বুঝে নেয়। নীচের ফ্লোর দুঃস্বপ্নের মতো পিচ্ছিল; এই অবস্থায় সে নিজেও সাহায্য করতে পারবে না। তার মুখ থেকে নির্গত হয়, “প্রিন্স অরিজিন এসব কিভাবে হলো?”
জ্যাসপার রাগান্বিত আর তীব্র বিরক্তের স্বরে চেঁচিয়ে। “আলবিরা অযথা প্রশ্ন না করে, ফ্লোরে পানি ঢালার ব্যবস্থা করো, দ্রুত!”
আলবিরা তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে একটি মোটা পাইপ নিয়ে আসে,আর দ্রুততার সঙ্গে পানি ঢালতে শুরু করে। উপর থেকে ঝরে পড়া সেই শীতল পানি ধীরে ধীরে ফ্লোরকে ধুয়ে দিচ্ছে,আর সেই সঙ্গে ভিজিয়ে দিচ্ছে জ্যাসপার ফিওনাকে।
পানির স্রোতে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে, আর ফিওনার কাঁধে ভিজে চুলের ঢেউয়ের মতো তার চারপাশে বয়ে চলেছে। জ্যাসপার ফ্লোরে হাত দিয়ে ভিজে যাওয়া সত্ত্বেও তার ভ্রু কুঁচকে থাকে, ফিওনার দিকে রাগে-অপমানে তাকিয়ে।
অবশেষে, ফেনা আর পানির স্রোত ধুয়ে তাদের মুক্ত করে,কিন্তু সেই মুহূর্তের বোঝা তাদের মনে এক গভীর রেখাপাত করে দেয়।
ফিওনার ঠোঁট মৃদু কাঁপছে,কোনো অব্যক্ত আবেগ গোপন করতে পারছে না। তার চোখের কোণে জমে থাকা ভেজা ভাবটুকু এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। সে জানে না কেন এই মুহূর্তে তার শরীর এমনভাবে সাড়া দিচ্ছে। তার সামনে থাকা জ্যাসপারের সবুজ নেত্রপল্লব এক গভীর রহস্যময়তা নিয়ে ঝলমল করছে।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ ফিওনার দিকে স্থির, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের সেই গভীরতা—আকর্ষণ নাকি রাগ, তা ফিওনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার সবুজ চোখের সেই স্থির দৃষ্টিতে কোনো অদৃশ্য তলোয়ার ঝুলে আছে, যা তাদের মাঝে ক্রমাগত দূরত্ব সৃষ্টি করেও এক অদম্য টানে ফিওনাকে তার দিকে টেনে নিচ্ছে।
জ্যাসপার হঠাৎই তার দৃষ্টির অচেনা কোমলতা দূরে ঠেলে দেয়, তার ভেতরের রাগের ঝলক ফিরে আসে, কিন্তু সেই মুহূর্তে কি এক নিমিষের জন্য তার চোখে অন্য কিছু ছিল?
জ্যাসপার ফিওনার কোমড়ে জরিয়ে ধরে, এক ঝটকায় ফিওনাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়,আর মুহূর্তের জন্য মনে হয় সময় থেমে গেছে, কিন্তু বাস্তবতা নিষ্ঠুর; যখন সে ফিওনাকে ছেড়ে দিয়ে সড়ে দাঁড়ায়,ততক্ষণে তার জামার বুকের অংশে থাকা কিছু সূতো আর কাপড় জ্যাসপারের লকেটের সাথে ছিঁড়ে যায়, সম্পর্কের একটি অংশ অচিরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আযদাহা পর্ব ১৫
জ্যাসপার একবার পেছনে ফিরে তাকায় না, হনহন করে গ্লাস হাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে যায়, ভেজা শরীরের স্নিগ্ধতা নিয়েই।
আলবিরা এবার নিচে নেমে আসে, মনে হলো অগ্নিসংযোগের পর একমাত্র উদ্ধারকারী। তার কণ্ঠে চরম অসন্তোষ; “এই মেয়ে, কোনো কাজ ঠিকমত পারো না? কী করেছো, এ কী বাড়িঘরের অবস্থা!”
ফিওনা কিছু বলে না,মাথা নিচু করে থাকে, সমস্ত অভিযোগের বোঝা তার উপর চেপে বসেছে। সে অনুভব করে, এই পরিস্থিতিতে তার নীরবতা অপরাধের স্বীকৃতি, যেখানে তার ভাবনা, আবেগ—সব কিছুই এক অব্যক্ত কান্নায় রূপ নিচ্ছে।