আযদাহা পর্ব ১৮
সাবিলা সাবি
জ্যাসপার দুর্বল, শক্তিহীন দেহটাকে কোনোরকম টেনে-হিঁচড়ে গ্লাস হাউজের ভেতরে প্রবেশ করলো।প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে আরো ক্লান্ত করে তুলছিল, মনে হচ্ছিল শারীরিক শক্তির অবসান ঘটছে। শরীরের রং প্রায় সবুজ হয়ে এসেছে, প্রাকৃতিক কোনো প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। জ্যাসপারের রক্তিম বেগুনি (crimson purple) ঠোঁটজোড়া সবুজ রঙের মিশ্রণে এক প্রকার ফ্যাকাসে বাদামী রঙ ধারন করেছে।
তার মুখের এই পরিবর্তন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দেয়,তার শরীরের শক্তি আর রঙ উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে। মৃদু আলোয় তার ঠোঁটগুলো মলিন আর অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা তার দুর্বলতা আর দুশ্চিন্তাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
গলায়, বুকে,আর হাতে ড্রাগনের আঁশের মতো ফুটে উঠেছে অদ্ভুত চিহ্ন, যা তার ড্রাগন পরিচয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। এই আঁশগুলো তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, বলছে যে সে এখনো সম্পূর্ণভাবে তার মানব রূপে ফিরে আসেনি। অদ্ভুত অনুভূতি, একদিকে শারীরিক দুর্বলতা, অন্যদিকে তার ড্রাগন শক্তির স্মৃতি,যা তাকে নাড়া দিচ্ছে।
গ্লাস হাউজের ভেতরে ঢুকে সে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমাকে সুস্থ হতে হবেই,” সে মনে মনে বলল, নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে। তার হৃদয়ে,এথিরিয়নের জন্য আবেগ-গভীর ভালোবাসা,ৎযা তাকে আরও একবার শক্তি জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিল।
জ্যাসপার নিজেকে মানসিকভাবে দৃঢ় করতে চেষ্টা করল, সিঁড়ির কাঠের হাতল ধরে ধীরে ধীরে দোতলায় ওঠার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হলো তাকে। তার শরীর দুর্বল, প্রতিটি ধাপ তাকে আরও বেশি ক্লান্ত করছে। সিঁড়ির প্রতিটি কাঠের শব্দ মনে হচ্ছিল তার দুর্বলতা আর ভেঙে পড়ার চিত্র ফুটে উঠছে।
উপর উঠে এসে, সে এক পলক চারপাশে তাকাল। মনে হল, নিজের শারীরিক অবস্থার জন্য কিছু জরুরি করার প্রয়োজন। তার বোধগম্য হচ্ছে যে, এই মুহূর্তে শরীরের বায়োকেমিক্যাল প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু কেনো,সে তো মাত একবার হিপনোটাইজ করেছে। এই প্রচন্ড অসুস্থতা তার মনের গভীরে এখনও পরিষ্কার নয়। সে জানে, পৃথিবীতে সার্ভাইব করাটা এখন সত্যিই কঠিন হয়ে উঠেছে।
এছাড়া, এই মুহূর্তে ভেনাসে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মনে আসতেই, তার মনে গভীর উদ্বেগ দেখা দিল। ড্রাগন রূপে ধরা তো অসম্ভব, কারণ সে জানে,সেই রূপের শক্তি আর ক্ষমতা এখন পুরোপুরি বিলীন। দৃষ্টির সামনে ভাসতে থাকা এই সমস্যাগুলোর মধ্যে, জ্যাসপার ঠিক করতে পারছিল না কিভাবে সে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে।
তার মনের অন্ধকারে একটাই চিন্তা—যেভাবেই হোক, তাকে পৃথিবীতে সার্ভাইব(টিকে থাকা) করতেই হবে ।
আরেকটু হেঁটে নিজের কক্ষে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দোতলায় পৌঁছাতেই ফিওনার কক্ষের দিকে তার চোখ চলে যায়। আপাতত, সেখানে প্রবেশ করতে হবে। স্লাইডিং দরজাটি খুলে যায়, আর জ্যাসপার ঝুঁকে পড়ে ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করে।
তারপরে, সে বিশাল ক্লান্তিতে কক্ষের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তখন ফিওনা,কাঁচের দেয়াল থেকে বাইরের দৃশ্য দেখছিল, হঠাৎ স্লাইডিং দরজার মৃদু শব্দে পেছন ফিরে তাকায়। ঠিক তখনই তার দৃষ্টির সামনে পড়ে যায় জ্যাসপার, যে এই মুহূর্তে কক্ষের সামনে অবসন্ন অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছ।
ফিওনার হৃদয়ে একটানে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। সে দ্রুততার সাথে জ্যাসপারের অবস্থা দেখার চেষ্টা করে।জ্যাসপারের শরীরের অবস্থা তার মনকে আতঙ্কিত করে তোলে—তার গা সবুজ, ঠোঁটগুলো রক্তিম বেগুনির সাথে মিশে ফ্যাকাশে বাদামী রঙ ধারণ করেছে।
ফিওনার হৃদয়ে অজানা আতঙ্ক ভর করে ওঠে। জ্যাসপারের রূপ রীতিমতো ভয়ের উদ্রেক করে—সবুজ রঙের দেহ,বাদামী ঠোঁট, যেন সে এক অশুভ কিছুর ইঙ্গিত বহন করছে। এই চরম অচেনা রূপ তার মনের ভিতরে গভীর এক অস্বস্তি সৃষ্টি করে। সে পা বাড়াতে সাহস পায় না, বরং একধরনের থমকে যাওয়া অনুভূতি তার প্রতিটি স্নায়ুকে গ্রাস করে।
ফিওনা এক পা সামনে এগোতে গিয়ে থমকে যায়,তার পেটে মনে হচ্ছে একটি ভারী পাথর চেপে বসেছে।
“এটা কি হয়েছে?” চিন্তার গভীরে গিয়ে মনে আসে। তার মনে ভয়ংকর চিন্তা উঁকি দেয়—এরকম ভয়ংকর রুপ কেনো?
এমনকি, ভয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফিওনার চোখে জল আসতে থাকে, সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু সাহসিকতার প্রত্যেক পদক্ষেপে তার অন্তরাত্মা এক অদ্ভুত দ্বিধায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
জ্যাসপার চোখ তুলে ফিওনার দিকে তাকায়, তার দৃষ্টি কিছু না বলা কথা উড়ানোর চেষ্টা করছে। তার সবুজ চোখে তখন কষ্টের ছায়া ফুটে ওঠে,যা তার যন্ত্রণার সাক্ষী। ধীরে ধীরে,জীবনের সব শক্তি একত্রিত করে,সে অস্থিরভাবে উঠতে চেষ্টা করে। পা দুটি আলতোভাবে মেঝের দিকে চলে আসে, কিন্তু শরীরের দুর্বলতা তাকে বশীভূত করে।
অবশেষে জ্যাসপার বিছানার সামনে পৌঁছায় আর অত্যন্ত ধীর গতিতে শুয়ে পড়ে। বিছানার নরম ম্যাট্রেস তার জন্য প্রশান্তির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, কিন্তু তার মুখাবয়বের ক্ষোভ আর কষ্ট সে লুকাতে পারে না। মুখের বাঁক যখন অস্পষ্ট তখন তার ঠোঁটের মাঝে অদ্ভুত একটি বোধ নিহিত থাকে।
“এই মেয়ে,” জ্যাসপার নিঃসৃত এক গম্ভীর হাহাকার তুলে বলো। শব্দগুলো কষ্টের ভারে নুয়ে পড়ে।
ফিওনার হৃদয়ে এক ঝড় শুরু হয়। জ্যাসপারের গাঢ় সবুজ দেহ, যার ওপর এখনো ড্রাগনের আঁশের ছায়া,তাকে আরও ভীতিকর করে তুলেছে।
জ্যাসপারের মুখের ভাষায় অসহায়ত্ব ধরা পড়ে, যা ফিওনার অন্তরে কিছুটা অস্বস্তি জন্ম দেয়। তার মনের অন্দরে প্রতিধ্বনিত হয়, “এই মেয়ে,শব্দটা।
ফিওনা আতঙ্কে এক পা এগিয়ে আসে, জ্যাসপারের রূপের ভীতি তাকে কিছুটা থমকে দেয়।
“আলবিরাকে ডাকো,” জ্যাসপার অগ্নিঝরা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নির্দেশ দেয়। ফিওনা কিছু একটা প্রশ্ন করার ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুলে। তবে এর আগেই, জ্যাসপারের সবুজ চোখজোড়া নিমেষে বন্ধ হয়ে যায়, এক মুহূর্তে সে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
ফিওনা দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে মুহূর্তের কণ্ঠস্বর গিলে খাওয়ার চেষ্টা করল। তার হৃদয়ে আতঙ্কের স্রোত প্রবাহিত হতে লাগল, মনে হচ্ছিল,প্রতিটি মুহূর্তে অশুভ কিছু ঘটতে পারে। আলবিরার কক্ষের দিকে এগোতে গিয়ে, সে হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ বোধ অনুভব করে—মনের গভীরে একটি ক্ষীণ স্বর তাকে বলছিল,এই মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
“না, এখান থেকে পালাতে হবে,” সে সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে লিভিং রুমের দিকে চলে আসে।
লিভিং রুমের মূল দরজার দিকে গিয়ে, ফিওনা তা খুলতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে। দরজার উপরে তার হাতের স্পর্শে জমে থাকা ধুলোর প্রতি তার চোখ পড়ল।সেই ধুলো তার উদ্বেগের চিহ্ন—কতোদিন সে এখানে আটকানো ছিল। দরজাটি দুলতে শুরু করে, ফিওনার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়তে লাগল মনে হচ্ছে সৃষ্টির প্রতিটি কোণে অদ্ভুত সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।তার পায়ের তলায় মেঝে ভারী হয়ে উঠছে,আর সে নিজেকে এক খাঁচায় আবদ্ধ মনে করল।।
“দ্রুত!” সে দরজাটির হাতল টেনে ধরল,কিন্তু এটা যেনো তাকে বিরোধিতা করছে।সে জানে,জ্যাসপারের সঙ্গে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে,আর এটাই সুযোগ পালানোর।
কিন্তু ফিওনা পুনরায় ব্যর্থ হলো,দরজাটি এক নিষ্ঠুর প্রতিবন্ধকতার মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। হতাশার শীতল হাওয়া তার শরীরে বয়ে গেল,মনে হলো সেই দরজা খুলতে পারা ছিলো একেবারেই অসম্ভব।দৃষ্টি তখন দিগন্তে, কিন্তু মন মানসিকতা অন্ধকারের গভীরে ডুবে গেল।
এই মুহূর্তে জ্যাসপারের বিষয়ে এক নতুন আতঙ্ক কাতর করে উঠল ফিওনার হৃদয়ে। “যদি ওই ফায়ার মনস্টারটার কিছু হয়ে যায়,” সে চিন্তিত ভাবে, “তাহলে সবাই মিলে আমাকেই দায়ী করবে। তারা মনে করবে, আমি নিশ্চয় কিছু করেছি।”
অসহ্য দুশ্চিন্তার স্রোতে ভেসে চলছিল ফিওনা। সে নিজের ভেতরে এক প্রকার যুদ্ধ অনুভব করছিল, ঘরের চারপাশের আবহাওয়াও তার সাথে প্রতারণা করছিল; প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি ছায়া তাকে লক্ষ্য করে হাসছে।
ফিওনা পুনরায় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আলবিরার কক্ষের সামনে উপস্থিত হলো। তবে এখানেও কোনাে দরজা নেই; শুধু একটানা গ্লাসের দেয়াল। বিভ্রান্তির জালে আবদ্ধ হয়ে গ্লাসের টাচ করলো আর সে ভাবতে লাগল,”এখন আমি কি করব?”
হঠাৎ, আলবিরার কক্ষের স্লাইডিং দরজা এক চঞ্চল শব্দে খুলে গেল। ফিওনা বুঝতে পারল,তার দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। যখন সে দরজায় হাত দিয়েছে, তখনই কক্ষে আলবিরার কাছে সিগন্যাল পৌঁছে গেছে। এক মুহূর্তের মধ্যেই, সে দ্রুত আলবিরার কক্ষে প্রবেশ করে।
আলবিরা তার কক্ষের প্রবেশদ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তির সাথে বলল, “এই মেয়ে! এই এত রাতে তুমি আমার কক্ষের সামনে কি করছ?” তার কণ্ঠে উল্টো দিকে ঢোকা ভাঁজ ছিল।
ফিওনা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলল, “বলছিলাম যে, আপনাদের প্রিন্স—জ্যাসপার, তার কি জানি হয়েছে?” তার চোখের উন্মাদনা আর আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল,যেন সে কিছু হারানোর ভয়ে কাতর।
“কিহ? প্রিন্সের কি হয়েছে? আর উনি কোথায়?” আলবিরার কণ্ঠে উদ্বেগের প্রতিধ্বনি ছিল, কিন্তু সেই উদ্বেগের মধ্যেও একধরনের অবিশ্বাস ছিল।
“উনি আমার কক্ষে…” ফিওনা কথাগুলো বলেই স্থির হয়ে রইল।
আলবিরা হঠাৎ করে দরজার দিকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। সে দ্রুত থারিনিয়াসকে সিগন্যাল পাঠালো থারিনিয়াসের সাড়া পাওয়ার আগেই, ফিওনা আলবিরার পিছনে পিছনে ছুটতে লাগল।
আলবিরা আর থারিনিয়াস ফিওনার ঘরে প্রবেশ করার মুহূর্তে তারা যে দৃশ্যের সম্মুখীন হলো, তা ছিল ভীতিকর। জ্যাসপার বিছানায় উবুড় হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে,মনে হচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে দখল করে রেখেছে। তার মুখাবয়ব নিস্তেজ, আর শরীরের রঙ এখনও সবুজ আর ঠোঁটজোড়া বাদামী মিশ্রণে ধূসর হয়ে আছে।
“এটা কি হয়েছে?” থারিনিয়াসের কণ্ঠে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। সে দ্রুত জ্যাসপারকে সোজা করার জন্য এগিয়ে এল। আলবিরা কিছু না বললেও,তার চোখে উদ্বেগ আর সহানুভূতির চিহ্ন ছিল।
“হিপনোটাইজ করার ফলেই এরকম হয়েছে,” আলবিরা বলল। তার কণ্ঠে বিচলিত ভাব ছিল, “আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে থারিনিয়াস।”
জ্যাসপারের শরীরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল,সে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে ছিল, যা তার অভ্যন্তরীণ শক্তির সীমা অতিক্রম করেছে।
থারিনিয়াস জ্যাসপারের মাথা তুলতে সাহায্য করে যাতে করে তার গলা সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারে।
“আমরা এখন কি করব?” আলবিরা আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“মনে হচ্ছে প্রিন্সের শরীরে বায়ো ক্যামিকেলের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে ,” থারিনিয়াস উত্তর দিলো, “তবে আমাদের আগে নিশ্চিত হতে হবে, কি কারণে তার এই অবস্থা।”
আলবিরা দ্রুত চারপাশে নজর রাখল। “তার শরীরের বাইোকেমিক্যাল প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
জ্যাসপারের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে, আলবিরার মনে এক ধরনের দুশ্চিন্তা ভর করল। সে জানে জ্যাসপার তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর তাকে সুস্থ করতে না পারলে তাদের ভেনাসের সবাইকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
“আলবিরা, তুমি অ্যাকুয়ারাকে ডাকো, ”থারিনিয়াস বলল, তার কণ্ঠে দ্রুততার আর জরুরি অনুভূতি। “ও কিছু ভেষজ ঔষধ তৈরি করতে পারবে। আর আমি এখনই ল্যাবে যাবো, ড্রাকোনিসের সাথে কথা বলতে হবে। সে আমাদের সাহায্য করতে পারে।”
“ঠিক আছে, আমি এখনই অ্যাকুয়ারাকে ডেকে আনছি,” আলবিরা নিশ্চিত কণ্ঠে বলল। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ ছিল, কিন্তু সে জানতো যে এই মুহূর্তে সময় খুব মূল্যবান।
থারিনিয়াস দ্রুত ল্যাবের দিকে রওনা হলো, সে জানতো যে ড্রাকোনিসের সাহায্য ছাড়া তারা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
আলবিরা শীঘ্রই ফিওনার কাছে ফিরে আসলো, “আমি অ্যাকুয়ারাকে ডাকতে যাচ্ছি। তুমি এই মুহূর্তে প্রিন্সের কাছে থাকো, আমরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।”
অ্যাকুয়ারা আলবিরার ডাক শুনে দ্রুত ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করলো। তার চোখে উদ্বেগের ছাপ, আর আলবিরার কথাগুলো শুনে বুঝতে পারল যে পরিস্থিতি কতটা জটিল।
“আলবিরা, প্রিন্সের অবস্থা খুব গুরুতর,” অ্যাকুয়ারা দ্রুত বলে উঠলো। “আমাদের হাতে সময় নেই,আমাকে এখনই ভেষজ ঔষধ তৈরি করতে হবে।”
“তুমি এখনি যাও,” আলবিরা উত্তর দিলো,”তাড়াতাড়ি উপাদান সংগ্রহ করে ঔষধ তৈরির কাজে লেগে পড়ো। প্রিন্সের জন্য একেকটা সময় এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“ঠিক আছে,” বলল অ্যাকুয়ারা, মাথা নাড়িয়ে। “আমি বাইরে যাচ্ছি। প্রাকৃতিক উপাদানগুলো খুঁজে বের করতে হবে।”
অ্যাকুয়ারা দৌড়ে বাইরে চলে গেল। পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে সে চারপাশের সৌন্দর্যকে এক ঝলকে দেখল।গাছের পাতাগুলো সবুজে মোড়ানো,আর ভেজা মাটির গন্ধ তাকে নতুন করে শক্তি দিল।
প্রথমে সে জিঙ্কের সন্ধানে বের হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই, সে এক প্রাচীন গাছের গোড়ায় একটা সোনালী রঙের পাথর দেখতে পেলো, “এই তো জিঙ্ক,” সে নিজে থেকেই বলল।”
তারপর গিনসেঙ্গের খোঁজে বের হলো। এই গাছের মূলটি শক্তি বাড়ানোর জন্য বিখ্যাত। দূরে,একটি উঁচু টিলার ওপর সে দেখতে পেল কিছু গিনসেঙ্গের ফুল।সে এগিয়ে গেলো, মাথা নিচু করে কুঁড়ে কুঁড়ে বের করল কিছু গাছের মূল। “এইগুলি ভেষজের জন্য খুবই প্রয়োজন,” সে মনে মনে ভাবলো।
তারপর আরো কিছু সময় কাটিয়ে, অ্যাকুয়ারা হলোবার খোঁজে গেল। সে জানে এই ভেষজটি ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করবে। পাহাড়ের প্রান্তে, তাকে একটি ছোট্ট ঝর্ণার পাশের স্যাঁতসেঁতে মাটিতে হলোবা ফুলগুলি ফুটে থাকতে দেখল। “এইগুলো পাওয়া গেছে!” সে উল্লাসিত হয়ে বলল আর দ্রুত কয়েকটি তুলে নিল।
অবশেষে,মোরিঙ্গা আর ক্যামোমাইলের জন্য সে আরো গভীরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর, সে একটি বন্য গাছের নিচে কিছু সুন্দর মোরিঙ্গার পাতা আবিষ্কার করলো। “এটি অবশ্যই কাজে লাগবে,” সে বলল, এক হাতে তুলে নিয়ে। বড়
শেষে, দূরে একটি ছোট মাঠে ক্যামোমাইলের ফুল দেখতে পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটল। “এগুলি তো নিঃসন্দেহে ভেষজের জন্য প্রয়োজনীয়,” অ্যাকুয়ারা সেগুলি তুলে নিল।
সব উপাদান সংগ্রহ করে অ্যাকুয়ারা গ্লাস হাউজে ফিরতে শুরু করলো। তার হৃদয়ে আশা, “আমি প্রিন্সের জন্য কিছু একটা তো করতে পারবো।”
অ্যাকুয়ারা হাউজে ফিরে কিচেনের দিকে তীব্র গতিতে এগিয়ে গেল,সে জানে, জ্যাসপারের জন্য প্রতিটি সেকেন্ড অমূল্য। সব উপাদান একত্রিত করে, সে দ্রুততার সাথে রসটি প্রস্তুত করতে শুরু করলো। মিষ্টি গন্ধ আর তাজা প্রাকৃতিক উপাদানের মিশ্রণে কিচেনটি এক ঝলমলে আভায় ভরে উঠল। একবার কাঁচের বোতলে রসটি ঢেলে, সে নিশ্চিত হলো যে সবকিছু সঠিকভাবে হয়েছে।
অন্যদিকে, থারিনিয়াস ড্রাকোনিসের সঙ্গে ল্যাবে বসে কথা বলেছিল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ ছিল, আর সেই উদ্বেগের চিহ্ন ছিল তার চোখের গভীরে।
“কিং,প্রিন্স অরিজিন অসুস্থ হয়ে গেছে,” থারিনিয়াস বলল গভীর শ্বাস নিয়ে। সব ঘটনা খুলে বললো থারিনিয়াস।পরিস্থিতি খুবই খারাপ জানালো ড্রাকনিসকে।
ড্রাকোনিসের মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তে পরিবর্তিত হলো, তার চোখে উদ্বেগের ছাপ। “কি বলছো? আমার পুত্রের কি হয়েছে?”
“প্রিন্সের শরীরে বিপর্যয় ঘটেছে। তাকে দ্রুত বায়ো ক্যামিকেল প্রবেশ করাতে হবে,” থারিনিয়াস ব্যাখ্যা করলো, তার কণ্ঠে তীব্রতা ছিল।
“কিন্তু কিং,” সে ধীরে ধীরে বলল, “ওই ক্যামিকেল পৃথিবীতে নেই। আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে।”
ড্রাকোনিস এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করল।
“অ্যাকুয়ারা প্রকৃতির উপাদানগুলো ব্যবহার করে ঔষধ তৈরি করছে,” থারিনিয়াস পুনরায় বলল। “যদি ভেষজ উপাদান ঠিকঠাক ভাবে কাজ করে তবে হয়তো প্রিন্সের শরীরের অবস্থা কিছুটা উন্নতি হবে।”
ড্রাকোনিসের হৃদয়ে এক অসহনীয় কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। নিজের অন্য এক পুত্রকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে কত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল জ্যাসপারের কল্পনাও করতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, জ্যাসপারের জীবনের জন্য এই মুহূর্তে প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান।
“এসব কিছু আমার জন্য হচ্ছে,” ড্রাকোনিস বলল, তার গলা কাঁপছে। “নিজের এক পুত্রকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে অন্য এক পুত্রকে কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম। ওর ব্রেইনে ডোপামিন হরমোন নিষ্ক্রিয় না হওয়ার প্রভাবে এসব হচ্ছে। পৃথিবীতে সার্ভাইব করতে এই হরমোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
থারিনিয়াস তার গুরুজনের উদ্বেগের গভীরতা বুঝতে পারল আর দ্রুত উত্তর দিল, “তাহলে কিং, এখন আমরা কী করব?”
ড্রাকোনিসের চোখে দৃঢ়তা ফিরে এল। “অ্যাকুয়ারা যদি প্রকৃতির উপাদানগুলো ব্যবহার করে কিছু সৃষ্টি করতে পারে, তবে আমাদের সেটার ফলাফলের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
“যেভাবেই হোক,আমার পুত্রকে ঠিক করো থারিনিয়াস,” ড্রাকোনিস বলল, তার কণ্ঠে হতাশা।
অ্যাকুয়ারা দ্রুত তার প্রস্তুতকৃত ঔষধের বোতলটি হাতে নিয়ে ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করে। তার চোখের মধ্যে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।
“এটা নাও,” অ্যাকুয়ারা বলল, বোতলটি আলবিরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে। “এতে আমি জিঙ্ক, গিনসেঙ্গ, হলোবা,মোরিঙ্গা,আর ক্যামোমাইলের মিশ্রণ করেছি।আশা করি, এটি প্রিন্সের শরীরের জন্য কার্যকর হবে।তবে এটাও মনে রাখতে হবে, এটা একমাত্র সাময়িক সমাধান। আমাদের বায়োক্যামিকেল কিন্তু দরকার পড়বেই ।”
আলবিরা মাথা নেড়ে বলল, “অ্যাকুয়ারা,তুমি সঠিক বলেছো তবে তুমি কি নিশ্চিত যে, এই রসটি প্রিন্সের জন্য যথেষ্ট হবে? যদি তার শরীরে বিপদ গভীর হয়?”
“এটা পরীক্ষিত,” অ্যাকুয়ারা কিছুটা সঙ্কল্পের সুরে উত্তর দিল। “যতটুকু সম্ভব করেছি, তবে বাকিটা ঔষধ খাওয়ানোর পর বোঝা যাবে”
এদিকে থারিনিয়াস কম্পিউটারের সামনে বসে নতুন কোনো উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। তার চোখের সামনে অসংখ্য তথ্য আর গবেষণার নথি ঘুরতে লাগল।
ফিওনা হতাশা আর উদ্বেগের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল ঘটনাগুলো দেখে গেল। তার চোখে এক অজানা শঙ্কা ছিল,সে জানত কিছু একটা বড় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। আলবিরা দ্রুত জ্যাসপারের মাথাটি একটু উঁচু করে, তার ঠোঁটে ভেষজ ঔষধটি ঢেলে দেয়।ঔষধটি গলিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ তারা অপেক্ষা করল। কিন্তু সময় কেটে গেল, আর কিছু পরিবর্তন ঘটল না।
জ্যাসপারের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলেও, তার চোখের ছাপগুলো উজ্জ্বল হয়নি।
“কিছু হচ্ছে না,” আলবিরা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল। “থারিনিয়াস এখনও কেন আসছে না? আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে।”
“এখন কি হবে আলবিরা?” অ্যাকুয়ারা বলল, তার কণ্ঠে চিন্তার স্পষ্ট প্রতিফলন।
অ্যাকুয়ারা তুমি প্রিন্সের কাছে থাকো আমি আসছি ল্যাব থেকে দেখি যদি কোনো উপায় মিলে।
আলবিরা দ্রুত ল্যাবে চলে যাওয়ার পর, কক্ষে কেবল অ্যাকুয়ারা আর ফিওনা বাকি রইল। উভয়ের মুখাবয়বে উদ্বেগ স্পষ্ট ছিল। ফিওনা অ্যাকুয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা,অ্যাকুয়ারা, তোমাদের প্রিন্সের কী হয়েছে? কেন এত অসুস্থ?”
অ্যাকুয়ারা কিছুটা গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “আজকে একজনকে হিপনোটাইজ করেছেন। তাই এমনটা হয়েছে।তবে এভাবে এত অসুস্থ হওয়ার কারণটা বোঝা কঠিন।”
ফিওনা মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু অনেক সাইক্রেটিস তো মানুষকে হিপনোটাইজ করে।তাদের তো এমন ভয়ংকর অসুস্থতা হয় না, তাহলে?”
“সঠিক, কিন্তু সাইক্রেটিসদের হিপনোটাইজ ক্ষণস্থায়ী,” অ্যাকুয়ারা ব্যাখ্যা করল। “তাদের ক্ষমতা কেবল কিছু সময়ের জন্য কার্যকর। কিন্তু আমাদের প্রিন্স যখন কাউকে হিপনোটাইজ করে, সেটা সারাজীবনের জন্য কার্যকর হয়।
“তাহলে উনি অসুস্থতা জেনে কেনো হিপনোটাইজ করলেন?” ফিওনার কণ্ঠে বিস্ময় স্পষ্ট।
অ্যাকুয়ারা উওর দিলো “এথিরিয়নের জন্য? কিন্তু ড্রাকোনিস তো বলেছিল,পৃথিবীর মানুষের ওপর দুবার হিপনোটাইজ করতে পারবে প্রিন্স। প্রথমবার হালকা দুর্বলতা হবে, কিন্তু এভাবে কেনো গভীর অসুস্থতা হলো?”
অ্যাকুয়ারা গভীরভাবে ভাবতে লাগল। “আমার মনে হচ্ছে,এটি তার লাভ ফাংশনাল ডিলিট করার কারণে হয়েছে।
ফিওনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো “এভাবে লাভ ফাংশনাল ডিলিট করাটা আবার কিভাবে সম্ভব?”
“আমাদের জন্মের সময় ভেনাসে একটি প্রোগ্রামিং সিস্টেম থাকে,” অ্যাকুয়ারা ব্যাখ্যা করতে শুরু করল। “তখন আমাদের বাবা-মা সেটি নিজেদের মতো করে কনফিগার করতে পারে। কিং ড্রাকোনিস প্রিন্সের প্রোগ্রামিং থেকে লাভ ফাংশনাল ডিলিট করে দিয়েছে। সুতরাং,সে ভালোবাসা সে অনুভব করতে পারে না।”
“তাহলে, ওনার ভাইয়ের প্রতি এতো ভালোবাসা কিভাবে?” ফিওনা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল। “মনে হচ্ছে, ভাইয়ের জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত।”
“আরে,ওটা সেই ভালোবাসা না,” অ্যাকুয়ারা ব্যাখ্যা করল। “এটা অন্যরকম আবেগ। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে ভালোবাসা নারীর প্রতি প্রেম।এই ধরনের প্রেমের ক্ষেত্রে ব্রেইনের ডোপামিন হরমোন নিষ্ক্রিয় হয়। কিন্তু আমাদের প্রিন্সের ক্ষেত্রে তা হয় না। হয়তো এ কারণে আজকে হিপনোটাইজের ফলে এরকমটা হয়েছে।”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে এইসব শুনতে লাগল।তার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। “এই প্রথমবার এমন কিছু শুনলাম আদো কি এসব সম্ভব?”
“আচ্ছা,ফিওনা,তুমি প্রিন্সের সামনে থাকো। আমি আরেকটু চেষ্টা করি, কোনো ভেষজ উপাদান দিয়ে,” বলল অ্যাকুয়ারা। ফিওনার সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
অ্যাকুয়ারা চলে যাওয়ার পর, হঠাৎ জ্যাসপার একবার কেঁপে উঠলো,বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো। ফিওনা ভয় পেয়ে গেল। ফিওনা, ভয়ের আতিশয্যে, ধীরে ধীরে জ্যাসপারের নিথর দেহের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ, সে অপ্রত্যাশিতভাবে কার্পেটের ফাঁকফোকরে পা হোঁচট খায়। মুহূর্তের মধ্যে, তার ভারসাম্য হারিয়ে যায় আর সে এক অসাধারণ গতিতে জ্যাসপারের ওপর পড়ে যায়।
আযদাহা পর্ব ১৭
এই অপূর্ণ সামঞ্জস্যের ফলে, ফিওনার ঠোঁটগুলো সরাসরি জ্যাসপারের ফ্যাকাশে বাদামী ঠোঁটজোড়ার সাথে মিলে যায়। ফিওনার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে যায়, সময় এক ঝলকেই থেমে গেছে। তার হৃদয়ের কাঁপুনি মুহূর্তে উপলব্ধি করে, এই সজীব অদ্ভুত আর অচিন আবেগের শিখা তাকে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করছে।