আযদাহা পর্ব ২২
সাবিলা সাবি
ফিওনা জ্যাসপারের জন্য খাবার রেখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালো অ্যাকুয়ারা। ফিওনা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললো,“বলছিলাম যে, অ্যাকু, তোমাদের প্রিন্সের বোধহয় হাত কেটে গেছে। র*ক্ত বের হচ্ছে।”
অ্যাকুয়ারা চমকে উঠলো। “কি বলছো তুমি?”
“হ্যাঁ,” ফিওনা মাথা নাড়লো, “আর সেই র*ক্তের রঙ অদ্ভুত সবুজ কেনো?!”
অ্যাকুয়ারা হালকা হাসি দিয়ে বললো, “ওহ,তুমি জানো না, আমাদের রক্তের রং ভিন্ন আমার রক্ত আকাশী রঙের।”
ফিওনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছো? তোমার রক্ত আকাশী?”
“হ্যাঁ, কারন মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিন থাকে,যা অক্সিজেন পরিবহন করে আর এটা লাল রঙের হয়।কিন্তু আমার রক্তে হেমোকিয়ানিন উপস্থিত, যা অক্সিজেন পরিবহন করে,কিন্তু এটি আকাশী রঙের হয় কারণ এতে কপার থাকে। আর প্রিন্স ওনার রক্তে ক্রোমিয়াম উপস্থিত তাই ওনার রক্ত সবুজ রঙের।অ্যাকুয়ারা এবার বলে থামলো চোখে মৃদু বিস্ময়। “তবে উনি এখন কোথায়?”
ফিওনা এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলো প্রতিটি কথা তারপর জবাব দিলো। “ওনার ঘরেই খাবার রেখে এসেছি। আমার মনে হয় ওনার হাতে মলম লাগানো দরকার,” ফিওনা বললো, কিছুটা উদ্বেগের সাথে।
অ্যাকুয়ারা ফিওনার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “আরে না, পৃথিবীর কোনো মলমে আমাদের প্রিন্সের ক্ষত সারবে না। আমাদের ওষুধ একেবারে ভিন্ন রকম।আমাকে পাহাড়ের গা থেকে বিশেষ এক গাছের রস আনতে হবে।”
ফিওনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,“পাহাড়ের গাছের রস? এত দূর থেকে আনতে হবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যাঁ,” অ্যাকুয়ারা মাথা নাড়লো। “এই রসই আমাদের রক্তের সঙ্গে মিল রেখে ক্ষত সারাতে পারে। পৃথিবীর কোনো উপাদানে আমাদের শরীর সাড়া দেয় না।”
ফিওনা মৃদু বিস্ময়ে মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছিল, জ্যাসপার আর তার জাতির অনেক কিছুই পৃথিবীর মানুষের থেকে আলাদা।
“আচ্ছা ঠিক আছে যাও”। এটা বলেই ফিওনা নিজের ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। অ্যকুয়ারা চলে যায় সেই বিশেষ রস আনতে।
অবশেষে খুঁজে পায় সেটা দিয়ে এক ধরনের মলম তৈরি করে একটা বাটিতে করে ফিওনার রুমের দিকে যায়।
অ্যাকুয়ারা দরজা খুলে ফিওনার ঘরে ঢুকতেই দেখলো, ফিওনা গ্লাস হাউজের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আলো তার মুখে পড়ে এক স্বপ্নময় ছায়া তৈরি করেছে।ফিওনার চোখ গভীর, দূর আকাশের কোনো অজানা জগতের দিকে খুঁজে চলেছে কিছু।
অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ফিওনাকে দেখছিল।তার মনে কৌতূহল জন্মাল—এই মেয়েটি সারাক্ষন বাইরে তাকিয়ে কি এমন ভাবে যা তাকে এতটা নিস্তব্ধ করে রাখে?সে মাঝে মাঝে কেনো এভাবে চুপচাপ থাকে,যেন পৃথিবীর সব শব্দ তার কাছে নিষ্প্রাণ।
অ্যাকুয়ারা মৃদু হেসে মনে মনে ভাবলো, “মেয়েটা প্রায় এমন আকাশকুসুম চিন্তায় ডুবে থাকে!না জানি কত কষ্ট লুকিয়ে আছে তার এই শান্ত চোখের গভীরে?”
সে ফিওনার কাছে গিয়ে বললো, “এই নাও,প্রিন্সের জন্য সেই বিশেষ মলম নিয়ে এসেছি। তাকে গিয়ে দিয়ে আসো।”
ফিওনা বিরক্তিভরে বললো, “বলছিলাম,অ্যাকুয়ারা,তুমি যাওনা, তুমি যেয়ে লাগিয়ে দিয়ে আসো মলমটা,এই কাজটা আমি না করলে হয়না?”
অ্যাকুয়ারা হেসে বললো, “আরে,উনি আমাদের নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে ঢোকার অনুমতি দেন না।কেবল থারিনিয়াসের জন্যই সেই ছাড় রয়েছে।”
ফিওনা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেনো?কেন এমন নিয়ম?”
অ্যাকুয়ারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো, “উনি প্রাইভেসি পছন্দ করেন বিশেষ করে মেয়েদের প্রবেশের ক্ষেত্রে খুব কঠোর। কক্ষের ভেতরে কোনো মেয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, এমনটাই ওনার নিয়ম।”
ফিওনা বিরক্তি চেপে বললো, “তাহলে আমি কি ছেলে?”
অ্যাকুয়ারা চোখ কুঁচকে বললো, “সেটা জানি না।তবে শুধু তোমাকেই অনুমতি দিয়েছে।”
ফিওনা মনে মনে বললো, “হ্যাঁ,অবশ্যই অনুমতি তো দেবেই, আমাকে দিয়েই তো খাটিয়ে মারবে!যেনো আমিই ওনার একমাত্র দাসী!”
তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফিওনা জ্যাসপারের ঘরের দিকে রওনা হলো,মনে মনে নানা রকম কথা বলছিলো তাকে নিয়ে।
ফিওনা একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও মলমের বাটি হাতে নিয়ে পুনরায় জ্যাসপারের কক্ষে প্রবেশ করলো।ঘরের ভেতরে ঢুকতেই সে লক্ষ্য করলো, টেবিলে খাবার আগের মতোই পড়ে আছে—অক্ষত।জ্যাসপার খাবার ছুঁয়েও দেখেনি,যেন তার ক্ষুধার অনুভূতিও হারিয়ে গেছে।
জ্যাসপার তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন,তার দীর্ঘ,ভারী শ্বাস নীরব কক্ষটিকে আরও নি:শব্দ করে তুলেছে। ফিওনার চোখ তখন ধীরে ধীরে তার দিকে চলে গেল।জ্যাসপারের এক হাত বিছানা থেকে ঝুলে ফ্লোরে পড়ে আছে,সেখান থেকে এক ফোঁটা সবুজ রক্ত মেঝেতে পড়ে গিয়েছে।
ফিওনা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।তার চোখ সেই সবুজ রক্তের বিন্দুটির দিকে স্থির হয়ে আছে,আর তার মনে নানা প্রশ্ন জাগছে—এইরকম ও হয়?তার শরীরের ভেতরে সবকিছু আর রক্ত এমন ভিন্ন রকম!
সে ধীরে ধীরে বিছানার কাছে বসে, নিচু হয়ে জ্যাসপারের হাতে মলম লাগাতে শুরু করলো।যতই তাকে স্পর্শ করছিল, ততই তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির স্রোত খেলে যাচ্ছিল,জ্যাসপার ঘুমে থাকলেও তার মুখের প্রশান্তি আর শক্তি ফিওনার মনকে এক আকর্ষণে আবদ্ধ করে ফেলছে।
ফিওনা মনোযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাতে মলম লাগাচ্ছিল,যাতে তার ক্ষত সঠিকভাবে সেরে ওঠে।হঠাৎ সে অনুভব করলো,তার আঙ্গুলের নিচে এক নড়াচড়া।ঠিক তখনই জ্যাসপারের চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলে গেলো। ফিওনার হাতের মধ্যে তার হাতটি দেখে জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
ফিওনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, তার বুকের মধ্যে অজানা এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো।তার চোখে অল্প আতঙ্কের ছায়া পড়লো,সে একটু পিছিয়ে বসলো। জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ,রহস্যময় চোখ দুটি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে রইলো,তার মধ্যে লুকানো সব গোপন কথা বুঝে নিচ্ছে।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ ফিওনার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বললো, “তুমি এখানে কী করছো?”
ফিওনা একটু কাঁপা কণ্ঠে বললো, “আপনার হাতে মলম লাগাচ্ছিলাম… আপনার হাত দিয়ে র*ক্ত পড়ছিল।”
জ্যাসপার একটু নরম হলো,কিন্তু তার চোখে একটা গভীর প্রশ্নের ছায়া ফুটে উঠলো। ধীরে ধীরে সে তার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, “এসব কাটাছেঁড়া নিতান্তই তুচ্ছ জিনিস।”
ফিওনা কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো,কিন্তু তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলছিল।তার মুখে কোনো কথা আসছিল না,শুধু জ্যাসপারের চোখে গভীরভাবে চেয়ে রইলো।
পুনরায় ফিওনা ধীরে ধীরে,একদম সযত্নে জ্যাসপারের হাতে মলম লাগাচ্ছিল।তারপর সে হালকা করে তার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো।জ্যাসপার নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে রইলো—তার চোখে এক শান্ত অথচ গভীর বিস্ময় ফুটে উঠেছে। এমনকি তার মুখে সামান্য মৃদু প্রশান্তির ছোঁয়া ছিল।
এই প্রথমবার,জীবনে প্রথমবার,জ্যাসপার অনুভব করলো কেউ তার এভাবে যত্ন নিচ্ছে।ভেনাসে যুদ্ধের ময়দানে কিংবা কোনো দুর্ঘ*টনায় আ*হত হলে সে নিজের ক্ষত নিয়ে কখনো ভাবেনি। তার জন্য ওষুধ, মলম—এসব সবকিছুই ছিলো বাহুল্য, অপ্রয়োজনীয়।মায়ের ধ্বং*সের পর আদর বা স্নেহ তার জীবনে ছিলো নিষিদ্ধ কোনো অনুভূতি, যা সে কখনো অনুভব করেনি।ছোটবেলায় মায়ের যত্ন কি ছিলো, তাও সে ভুলে গেছে কবে। সে জানেই না স্নেহ বা মমতার ছোঁয়া কেমন লাগে।
কিন্তু আজ,এই অদ্ভুত পৃথিবীর ছোট্ট এক মেয়ে,যার নাম ফিওনা,তাকে প্রথমবারের মতো এই অনুভূতির স্বাদ দিলো। মৃদু,স্নেহময় হাতের স্পর্শ তার আহত হাতটিতে এসে পড়তেই, এক অনির্বচনীয় উষ্ণতা তার হৃদয়ের ভেতর থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো।
তার মনে হলো,সেই গভীর শূন্যতা সামান্য ভরাট হলো। ফিওনার স্পর্শে এক ধরনের প্রশান্তি,এক ধরনের সান্ত্বনা সে অনুভব করলো। তার মুখে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু সে চুপ রইলো,কারণ এই অনুভূতিকে ধরে রাখতে চেয়েছিল—যতটা সম্ভব ধরে রাখতে চেয়েছিল এই নতুন অনুভূতিটাকে।
ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো,”বলছিলাম যে, আপনি আজকে খাবার খাননি কেনো?”
জ্যাসপার একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,”খিদে নেই তাই।”
ফিওনা সামান্য বিরক্তির সুরে বললো, “কিন্তু খাবার অপচয় করা উচিত না। খেয়ে নিন,” এই বলে সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
জ্যাসপার ফিওনার চলে যাওয়ার পানে দেখলো,কিন্তু কিছু বললো না।ফিওনা চলে গেলে সে ধীরে ধীরে নিজের হাতে নজর দিলো—সেই হাত,যেখানে ফিওনা সযত্নে মলম লাগিয়েছিল।তার চোখ সেই ব্যান্ডেজের দিকে নিবদ্ধ রইলো,সেখানে ফিওনার স্পর্শের উষ্ণতা এখনো টিকে আছে।
নিজের মধ্যে এক অজানা অনুভূতির জন্ম হতে দেখে সে কিছুটা বিস্মিত হলো।এই অনুভূতি কিছুটা অন্যরকম—না সম্পূর্ণ প্রশান্তি,না একেবারে অস্বস্তি।একটা নীরব ধ্যানমগ্নতায় তার মন আটকে রইলো,আর ভাবলো—কেনো একজন সাধারণ মানব মেয়ে তাকে এতটা যত্ন করতে গেলো, কেনো সে তাকে এমন একটি অনুভূতির দিকে ঠেলে দিলো যা সে কখনো বুঝতে চায়নি?
অবশেষে,খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে ধীরে ধীরে চামচ হাতে তুলে নিলো,সে ফিওনার কথাটা রাখতে চাচ্ছে—অপচয় নয়,বরং তার জন্য অদ্ভুতভাবে যত্নে রাখা সেই খাবারটি গ্রহণ করতেই হবে।
গভীর রাতে,জ্যাসপার তার বিশাল গোপন কক্ষে থারিনিয়াস আর আলবিরাকে নিয়ে একটি বিশেষ মিটিংয়ে বসলো। কক্ষের পরিবেশটি ছিল একদম নীরব,এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজমান,যেখানে প্রতিটি শব্দ গুনগুন করছিল, প্রতিটি চিন্তা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল।
“এথিরিয়নকে মুক্ত করার সময় চলে এসেছে ” জ্যাসপার তার পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে বলল।তার চোখে একটা দৃঢ় লক্ষ্য, আর কোনো বাধা তাকে থামাতে পারবেনা। মিটিংয়ের দিনেই আমি ওকে মুক্ত করে আনবো একেবারে ।”
থারিনিয়াস আর আলবিরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে, এক মুহূর্তের জন্য কিছু বললো না।তারপর তাদের মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো। তারা জানতো,জ্যাসপারের সিদ্ধান্ত আর পরিকল্পনা শুধুমাত্র তার ক্ষমতার পরিচয় নয়, বরং তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিরও চিহ্ন।
“এবার তো সত্যিই বোধহয় চমৎকার কিছু ঘটতে যাচ্ছে ,” থারিনিয়াস হালকা হাসি দিয়ে বললো। “ওয়াং লির ধারনাও নেই,আপনি কীভাবে সবকিছু পাল্টে দিতে পারেন।”
“তবে,সবকিছু সাবধানে করতে হবে,” আলবিরা সতর্ক করে বললো, “এথিরিয়নাকে মুক্ত করতে হলে, আমাদের সকলেরই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
জ্যাসপার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো, “তোমরা ঠিক বলেছো। কোনো ভুল নয়,সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। আজকের মিটিংয়ে যা যা বলবো মন দিয়ে শোনো,তার ভিত্তিতেই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”
এতটুকু বলেই,জ্যাসপার আবার তার পরিকল্পনায় ডুবে গেলো,এক মস্তিষ্কে লুকিয়ে থাকা রাজনীতি আর কৌশলগুলো এখন সম্পূর্ণভাবে তার নিয়ন্ত্রণে।থারিনিয়াস আর আলবিরা একে অপরকে এক টুকরো হাসি দিয়ে দেখলো—এই মুহূর্তে তারা জানতো জ্যাসপারের পরিকল্পনা সফল হলে,অচিরেই এল্ড্র রাজ্যের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় শুরু হবে।
পরের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সময়টা বেশ নিরিবিলি কেটেছে।সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু জ্যাসপার কোথাও বাইরে বেরিয়েছে। প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে,আর এই সুযোগে অ্যাকুয়ারা ফিওনাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য জ্যাসপারের অনুমতি চেয়ে নিয়েছে।
জ্যাসপার তেমন আপত্তি করেনি; তার মনে ছিল এক ধরনের নির্ভার আত্মবিশ্বাস সে জানে,এই পাহাড়ি এলাকা আর ড্রাকোনিস শিখরের মতো প্রতিরক্ষামূলক হাউজের অবস্থান ফিওনাকে পালাতে দেবে না।ফিওনার পালানোর চিন্তা থাকলেও, সে পাহাড়ের এই গোপনীয় জায়গা থেকে কোথাও যেতে পারবে না,যতক্ষণ না জ্যাসপার অনুমতি দেয়।
তারপরও জ্যাসপার ভেতরে একটা নিশ্চিত বোধ রেখেছে—থারিনিয়াস আর আলবিরা হাউজে রয়েছে,তাদের উপস্থিতিতে নিরাপত্তার কোনো অভাব হবে না।
বিকেলের নরম আলোয় অ্যাকুয়ারা আর ফিওনা গ্লাস হাউজ থেকে বের হলো। ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে চারপাশের সৌন্দর্যে আটকে গেলো।হঠাৎই তার নজরে পড়লো পাহাড়ের একদম কিনারায় একটা কাঠের দোলনা।দোলনাটি প্রকৃতির এক অলৌকিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—চারপাশে হালকা হাওয়ায় দুলছে আর বিভিন্ন রঙের অচেনা ফুল দিয়ে সাজানো।
ফুলগুলোর রঙ সাধারণ নয়,কিছুটা অদ্ভুত আর রহস্যময়।এমন ফুল ফিওনা আগে কখনো দেখেনি। ফুলগুলো একদিকে যেমন লোভনীয়,তেমনি তাদের ভেতরে এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আছে যা তাকে কিছুটা আতঙ্কিত করছে।দোলনাটিকে ঘিরে থাকা এই ফুলগুলোর সুগন্ধ মিষ্টি হলেও গভীর আর ভারী।
কিন্তু যা ফিওনাকে সত্যিই ভয় ধরিয়ে দিলো,তা হলো দোলনার অবস্থান।পাহাড়ের একদম কিনারায়,যেখানে বসা মানেই বিপদের মুখোমুখি হওয়া।নিচের গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে ফিওনার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো।যদি দোলনাটি ছিঁড়ে যায় কিংবা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, তাহলে নিঃসন্দেহে তার পতন অবধারিত।
অ্যাকুয়ারা ফিওনার ভয় বুঝে একটু হেসে বললো, “এই দোলনায় বসা নিরাপদ,চিন্তা করো না। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রিতভাবে তৈরি,তাই কোনো সমস্যা নেই।তুমি যদি একটু সাহস করে বসতে পারো।তবে এই দোলনায় বসে পাহাড় আর আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।”
ফিওনা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললো,সত্যিই কি নিরাপদ? এত উঁচুতে এমন দোলনায় বসতে আমার মনে হয়…”
অ্যাকুয়ারা তার হাত ধরে আশ্বস্ত করলো,”ভয় পেয়ো না আমিতো আছি তাইনা? তুমি পরে গেলে আমি ড্রাগন রুপে ধরে তোমাকে বাঁচিয়ে নিবো।”
ফিওনা সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে দোলনার দিকে এগিয়ে গেলো,মনে মনে কিছুটা সাহসী বোধ করলো।তবে তার মনে এখনো এক ধরনের অদ্ভুত আতঙ্ক কাজ করছিল।
অ্যাকুয়ারা প্রথমে নিজেই দোলনায় বসে পড়ে,তারপর দোল খেতে শুরু করে।ফিওনা পেছন থেকে তার আনন্দ উপভোগ করছে মাঝে মাঝে সে নিজেই হাত দিয়ে ঠেলে দোলনায় নতুন গতি যোগ করছে।হালকা হাওয়ায় অ্যাকুয়ারা দোলনার প্রতিটি দোলায় মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে,আর ফিওনা মুগ্ধ হয়ে তার হাসি দেখে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর,অ্যাকুয়ারা ফিওনার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো,”এবার তোমার পালা, ফিওনা।”
ফিওনা কিছুটা দ্বিধা নিয়েই অ্যাকুয়ারার বাড়ানো হাত ধরে দোলনার দিকে এগিয়ে গেলো।ধীরে ধীরে দোলনায় বসলো,চারপাশের দড়িগুলো শক্ত করে ধরে নিলো যাতে করে কোনোভাবেই হাত ফসকে না যায়।প্রথমেই অ্যাকুয়ারা দোলনায় একবার হালকা দোল দেয়।ফিওনা ভয়ে চোখমুখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলে।
দোলনার প্রথম দোলের সাথে ফিওনার হৃদয়ের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেলো।সে চোখ খুলে চারপাশের উঁচু পাহাড়,নীল আকাশ,আর সবুজ গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করলো,কিন্তু মনের ভেতর সেই ভয়টা এখনও কাটছে না।
অ্যাকুয়ারা একটু হাসি চাপা দিয়ে বললো, “ফিওনা,চোখ খুলে দেখো।এই দৃশ্য দেখতে কতোটা সুন্দর অথচ এই উচ্চতা থেকে দেখা সৌন্দর্য ক’জন দেখতে পায়!”
ধীরে ধীরে ফিওনা সাহস করে এক চোখ খুলে তাকালো, তারপর আস্তে আস্তে পুরোপুরি চোখ খুলে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলো।পাহাড়ের সেই নিঃসীম দৃশ্য,দিগন্তে মিশে যাওয়া নীল আকাশ,আর প্রকৃতির সেই মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে ফিওনার মনে হলো হয়তো এই সাহসটুকু করার জন্যই তার এখানে আসা দরকার ছিলো।
অনেকক্ষণ দোল খেতে খেতে ফিওনার ভয় পুরোপুরি কেটে গেছে।সে এখন মুক্তভাবে দোলনার দোলের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছে,বাতাসের সাথে নিজের চুলের খেলা আর চোখের সামনে পাহাড় আর আকাশের অপরূপ দৃশ্য দেখে সে মুগ্ধ।
হঠাৎ করেই অ্যকুয়ারার নজরে পড়লো দূরে একটা খরগোশ দৌড়াচ্ছে,আর সেটা দেখেই অ্যাকুয়ারা আনন্দে সেই খরগোশ ধরতে ছুটে গেলো,ফিওনাকে ওই অবস্থায় রেখে।
ফিওনা এখন একা একাই দোল খাচ্ছে,কিন্তু কিছুক্ষণ পর দোলনার দোলটা খুবই হালকা মনে হতে লাগলো।সে মজাটা হারিয়ে ফেললো,দোলনাটা স্থির হয়ে আসছে। ফিওনা একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,”কি হলো অ্যাকুয়ারা?থেমে গেলে কেনো?”
তার কথার সাথেই হঠাৎ করে দোলনায় আবার একটা তীব্র দোল আসে,কেউ জোরে ঠেলে দিলো।ফিওনা আচমকা চমকে উঠলো,তার মন কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। আশেপাশে তাকালো,বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর দোলনার তীব্র গতির সাথে তার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো।
কিছুটা ভীতস্বরে ফিওনা আবার বললো, “অ্যাকুয়ারা? দোলনাটা এত জোরে দুলছে কেন?”
কোনো উত্তর না পেয়ে ফিওনার মনে একটা অদ্ভুত শীতল ভয় কাজ করতে লাগলো।
হঠাৎ উপলব্ধি করলো ফিওনা,নাকে একটানা সেই পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ এসে ধাক্কা দিতে লাগলো,জ্যাসপারের পারফিউম। প্রথমে সে ভাবলো,হয়তো ভুল হচ্ছে,কিন্তু গন্ধটা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে সে আর উপেক্ষা করতে পারলো না। আতঙ্কে কৌতূহলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো জ্যাসপার তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে তার ঠাণ্ডা অথচ গভীর দৃষ্টি নিয়ে।
ফিওনার বুক ধুকপুক করতে লাগলো,হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো।জ্যাসপারের দৃষ্টি এতটা তীক্ষ্ণ আর নির্লিপ্ত যে তার মনে এক মুহূর্তের জন্য ভাবনা এলো,হয়তো জ্যাসপার তাকে এখানে পাহাড়ের কিনারায় দোলনা থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে।তার এই নিয়ন্ত্রণহীন দোল খাওয়ার অনুভূতিটাও আরও ভয়ংকর হয়ে উঠলো।
কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় ফিওনা জিজ্ঞেস করলো, “আ…আপনি এখানে?”
জ্যাসপার নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রইলো,তার চোখের গভীরে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি,অথচ রহস্যময় ঝলক।
ফিওনা পরপর দু’বার ঘুরে তাকালো, তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে চাইলো।বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় জ্যাসপারের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য আরো গভীর হয়ে উঠেছে।
জ্যাসপারের সবুজ চোখজোড়া বিকেলের মৃদু আলোয় অন্যরকম সুন্দর লাগছে আর ঘাড়ের ট্যাটু টা জলজল করছে বরাবরের মতোই আজকে ও সাদা শার্ট আর বুকের কাছে তিনটে বাটান খোলা,এনটিকের অদ্ভুত লকেটটাও আলো ছড়াচ্ছে আর কানের সাদা পাথরের দুলটাও কেমন চিকচিক করছে।ফিওনার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেলো।
ফিওনা হালকা ফ্যাকাশে নীল রঙের চাইনিজ জিন্সের স্কার্ট আর সাদা টপস্ পরে ছিলো।দোলনায় বসার কারণে টপস্ একটু ওপরের দিকে উঠে গিয়ে তার পেট আর কোমড়ের সামান্য অংশ বেরিয়ে ছিলো।হঠাৎ দোলনা পিছনে দুলে উঠতেই ফিওনার ভারসাম্য নড়ে গেলো ,সে যখন পেছন দিকে দোলনায় ফিরে তাকালো ঠিক সেই মুহূর্তে জ্যাসপার তার পেছন থেকে এগিয়ে এলো।অবলীলায় তার হাত ফিওনার পেটের চারপাশে মুড়ে ধরলো।
ফিওনা চোখ বড় করে তাকালো।তাদের দেহ একেবারে একে অপরের সাথে লেপ্টে ছিলো,এতটা কাছাকাছি যে জ্যাসপারের গরম নিঃশ্বাস তার মুখে স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছিলো।তার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম করলো। জ্যাসপার কেবল তাকিয়ে আছে তার দিকে,গভীরতর এক দৃষ্টিতে,কোনো অজানা কথা বিনা বাক্যে বলতে চাইছে।
ফিওনার মুখে কথা আসছিল না,কেবল তাকিয়েই রইলো। তার নীরবতার মাঝে এক অদ্ভুত আবেদন ছিল,আর জ্যাসপারও নড়ল না।
জ্যাসপার গভীর এক দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে আমি এখানে কিডন্যাপ করে এনেছি কোনো পাহাড়ের ভ্রমণের জন্য নয়,ফিওনা।”
ফিওনা তার কথায় হতভম্ব হয়ে কিছুটা অবাকভাবে প্রশ্ন করলো,”আমি আবার কী করেছি?”
জ্যাসপার কঠোর গলায় বললো,”এই যে তোমাকে হ্রদে গিয়ে নির্ভাবনায় গোসল করতে দেখলাম,নৌকায় উঠলে এখন এই দোলনায় বসে দোল খাচ্ছো,মনে হচ্ছে কোনো টুরে এসেছো তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছোনা?কেন তোমাকে এখানে আনা হয়েছে?”
আযদাহা পর্ব ২১
ফিওনার কপালে ভাঁজ পড়লো,কিন্তু সে চেষ্টা করলো নিজেকে শান্ত রাখতে। “আমি তো শুধু একটু খোলা হাওয়া উপভোগ করছি কারো ক্ষতি তো করিনি তাইনা? বন্দী হয়ে থাকলেও,একটু তো স্বস্তির প্রয়োজন আমার।”
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আনন্দের করার জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে আসিনি ফিওনা। আমি তোমাকে এখানে এনেছি তোমাকে প্রতি পদে পদে কষ্ট দিতে।এই জায়গার প্রতিটি শ্বাস,প্রতিটি মুহূর্ত আমার নিয়ন্ত্রণে।আর অ্যাকুয়ারা তোমার বান্ধবী নয়,সে ড্রাগন আর আমার সহকারী।”
ফিওনা একটু স্তব্ধ হয়ে গেলো,তবে তার ভেতরে কোথাও এক ধরনের বিদ্রোহ দানা বাঁধলো।