আযদাহা পর্ব ৩
সাবিলা সাবি
ড্রাগন বোট উৎসবের স্বল্প ছুটি শেষে,আজ আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে পিকিং ইউনিভার্সিটি।
ছুটির আমেজ এখনও মনে রয়ে গেলেও,ফিরে আসার এক ধরনের উত্তেজনা ফিওনার মধ্যে কাজ করছে। ক্যাম্পাসের পরিচিত গন্ধ,পুরনো বন্ধুদের মুখ,আর চারপাশের জীবন্ত পরিবেশ তাকে ঘিরে ধরে রেখেছে।
আজ সকালটা যেন অন্য রকম,একটু ভিন্ন।
হালকা রোদ মাখা দিন,চারপাশে উৎসবের রেশ,আর পরিচিত প্রাঙ্গণে পা ফেলার অনুভূতি ফিওনার মনকে প্রফুল্ল করে তুলেছে।
ফিওনার বন্ধুরা ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেছে।
প্রতিদিনের মতোই ফিওনা আর তার প্রিয় বন্ধু লিন একসঙ্গে ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে যায়।
তাদের মধ্যে ছুটির সময় কাটানো স্মৃতির বিনিময়,হাসি-ঠাট্টা আর সামনে আসা পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিন্তা মিশে থাকে।
ক্লাসরুমে ঢুকতেই ফিওনার চোখে পড়ে কিছু নতুন মুখ,যারা হয়তো এই ছুটির পর প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে।
ক্লাসরুমে ঢোকার সময় ফিওনার মনে হয় ,তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর মাঝেও ফিওনার ভেতরে নতুন কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কৌতূহল মিশে থাকে।
সেই সাথে তার মনে পড়ে কিছু পুরনো স্মৃতি,বিশেষ করে সেই একা রাতগুলো যখন সে নিঃশব্দে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল,সেই অজানা আলো বা তারাটির দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ক্লাসরুমের শান্ত পরিবেশে হঠাৎই দরজার খট করে খোলার শব্দে সবাই মনোযোগী হয়ে ওঠে। ফিওনা মাথা তুলে দেখে,তাদের এস্ট্রোনোমি(জ্যোতির্বিজ্ঞান)ক্লাসের শিক্ষক,প্রফেসর লু প্রবেশ করছেন।
তার হাতে ধরা একটি পুরোনো বই,চোখে অমলিন গাম্ভীর্য।
ক্লাসরুমে ঢুকতেই সবাই সম্মান প্রদর্শন করে উঠে দাঁড়ায়,তারপর প্রফেসর লু তাদের বসতে ইশারা করেন।
প্রফেসর লু তার টেবিলের দিকে এগিয়ে যান ফিওনা আর তার সহপাঠীরা দ্রুত বই খাতাগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখে।
ফিওনা তার প্রিয় নীল রঙের কলমটা হাতে তুলে নেয়,কারণ জানে যে আজকের ক্লাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
প্রফেসর লুর মুখে এক ধরনের অদ্ভুত স্নিগ্ধতা,তিনি মহাবিশ্বের অসীম রহস্যগুলোর দরজা খুলে দিতে যাচ্ছেন।
আজ আমরা ভেনাসের উপর আলোচনা করব,” প্রফেসর লু গম্ভীর কণ্ঠে বলেন।
ফিওনা তৎক্ষণাৎ খাতা খুলে কলম চালাতে শুরু করে,প্রফেসর লু যা বলবেন,সবকিছুই ফিওনা মনের মন্দিরে খোদাই করে রাখার মতো গুরুত্বের সাথে নোট করতে থাকে।
প্রফেসর লুর কণ্ঠস্বর ক্লাসরুমের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ওঠে,ভেনাসের ইতিহাস,এর বায়ুমণ্ডল,আর মহাজাগতিক গঠন সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়ে তিনি ক্লাস শুরু করেন।
প্রফেসর লুর প্রতিটি শব্দ ভেনাসের আকাশের মতোই রহস্যময় আর মোহনীয় শোনাচ্ছে।
ফিওনার মন মহাকাশের অসীম অন্ধকারে হারিয়ে যায়,তার চোখের সামনেই ভেসে ওঠে ভেনাসের ম্লান অথচ উজ্জ্বল আভা।
সে যতই নোট লেখে,ততই তার মনে হয়,ভেনাস যেন তার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ক্লাসরুমের ঘড়ির কাঁটা যখন সময়ের নির্দেশনা দেয়,প্রফেসর লু তখনো ভেনাসের এক অজানা অধ্যায় নিয়ে মগ্ন।
ভেনাস সম্পর্কে জানতে পেরে ফিওনার মনে এক অদ্ভুত বাসনা জাগে।তার ভাবনায় গুনগুন করে উঠে,যদি একদিন সে নিজে সেই গ্রহে যেতে পারতো?
সেখানে কী অসাধারণ দৃশ্য তার চোখে পড়বে! ভেনাসের রহস্যময় আকর্ষণ তাকে যেন পেয়ে বসে।
প্রফেসর লু যখন ভেনাসের গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাখ্যা করেন,ফিওনার দৃষ্টি মগ্ন হয়ে যায় বইয়ের পাতায়। বইয়ের পাতায় আঁকা মহাজগতের বিশাল চিত্রে ভেনাসের ছবি তার চোখে পড়ে।
সোনালী আভায় ঢাকা ভেনাস,তার অস্বাভাবিক বায়ুমণ্ডল,আর তার অনন্য সৌন্দর্য ফিওনার মনের গভীরে এক অসাধারণ আকর্ষণ তৈরি করে।
তার কল্পনায় ভেসে ওঠে,সেই দৃশ্য যদি তার নিজের চোখে দেখতে পারতো,কেমন হত? আকাশে ভাসমান মেঘের বাগান,বিস্তীর্ণ সমুদ্রের মতো লালচে পৃষ্ঠ,আর সেই অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—সবকিছুই তাকে এক মায়াবী অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
ক্লাস শেষে,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি ঘোষণা হওয়ার পর ফিওনা বাড়ির পথে রওনা হয়।
সে তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরে আসে,মাথায় ভেনাসের রহস্যময় দৃশ্যগুলো এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ে, মিস্টার চেন শিং খাবার টেবিলে বসে মধ্যাহ্নভোজে ব্যাস্ত।
ফিওনার দিকে দৃষ্টিপাত হতেই,স্বভাবত স্নেহপুর্ণ হাসি দিলেন।
মিস ঝাং খাবার পরিবেশন করেছিলেন।
মিস্টার চেন শিং,ৎফিওনার দিকে অমায়িক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন,
“আহ, ফিওনা!” মিস্টার চেন শিংএর মুখে হাসির স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে।
“তোমার আজকে ভার্সিটির ক্লাস কেমন ছিল? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে খাবার খেয়ে নাও।
সে হাসিমুখে উত্তর দেয়,,
“হ্যাঁ,গ্ৰান্ডপা। ক্লাস খুবই তথ্যবহুল ছিল।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
তথাপি,সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে নিজের রুমে এসে,
ফ্রেশ হয়ে নেয় সে,পোশাক পাল্টে নেয়,
এখন সে একটা ম্যান্ডারিন ড্রেস পড়ে নেয়,(চীনের একটি ড্রেস যা,সিল্কের যা হাটুর ওপরে,নেকলাইন উঁচু,হাতা ছোট,সেলাইড বোতাম লাগানো)
ফিওনা দ্রুত তৈরি হয়ে খাবার টেবিলের দিকে চলে আসে।সে তার গ্রান্ডপার পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ে,আর মিস ঝাং তার জন্য খাবারের প্লেট সাজাতে শুরু করেন।
“আজকের খাবারে কি বিশেষ কিছু আছে?” ফিওনা মৃদু হাসি দিয়ে জানতে চায়।
“এখানে সবকিছুই তোমার পছন্দেরখাবার” মিস ঝাং উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন।
মিস ঝাং একে একে সবগুলো খাবার তুলে দিচ্ছেন ফিওনার প্লেটে।
ফিওনার সামনে এই মুহূর্তে যেসব খাবার রাখা আছে।
-ডাম্পলিংস ( মাংস বা সবজি দিয়ে ভর্তি পেস্ট্রি যা সিদ্ধ, ভাজা বা বাষ্পে রান্না করা হয়।
-ফ্রাইড রাইস — মাংস,শাক-সবজি, এবং ডিম দিয়ে তৈরি সুস্বাদু ভাজা চাল।
-চাও মিয়ান — ভাজা নুডলস, যা মাংস, শাক-সবজি, এবং সস দিয়ে রান্না করা হয়।
-স্টিমড ফিশ— হালকা সিজনিং দিয়ে স্টিম করা মাছ, যা সাধারণত তাজা এবং স্বাস্থ্যকর।
ব্রেড-ক্রাম্বেল চিকেন (Breaded Chicken) — সোনালী রঙের ভাজা মুরগির টুকরো।
খাবারগুলোর দিকে ফিওনা লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,মনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান।পেটের মধ্যে ইতিমধ্যে ড্রামবাজা শুয়ে হয়ে গেছে।
সে একে একে সবগুলো খাবার টেস্ট করতে ব্যাস্ত, যদিও কাল রাতের ল্যাবের ঘটনা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তাই আর মিস্টার চেন শিংকে ফিওনা আর কোনো প্রকার প্রশ্ন করেনা।
ফিওনা খাবার টেবিলে তার গ্ৰান্ডপার স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি আর মিস ঝাংয়ের যত্নশীল পরিচর্যা তাকে বাড়ির আরাম আর সুখের অনুভূতি প্রদান করছে।
খাবারের সুবাসে পরিবেশটি আরও মনোরম হয়ে ওঠেছে আর তার মন থেকে ভেনাসের কল্পনা সরে এসে তার পরিবারের সাথে একটি আনন্দময় মুহূর্তে প্রবাহিত হয়।
কোনো এক অজানা পাহাড়ে গভীর একটি গুহার অন্ধকারে,একটি প্রযুক্তির ল্যাব অবস্থিত।
গুহার প্রাকৃতিক অন্ধকার আর রুমের উজ্জ্বল আলোর পার্থক্যে এক চমৎকার কনট্রাস্ট তৈরি হয়েছে।
রুমটি আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত,সোনালী হালকা দ্বারা আলোকিত,যা অদ্ভুতভাবে শান্তিপূর্ণ আর একই সাথে রহস্যময় মনে হয়।
একটি এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি,যার মুখমণ্ডল পূর্ণভাবে অন্ধকারে ঢাকা একটি হালকা নীল হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে।
স্ক্রিনে অন্য আরেকটি গবেষণাগারের ভেতরের দৃশ্য প্রতিফলিত হচ্ছে,আর সেখানে এক ব্যক্তির সাথে ভিডিও কল চলছে।
“ড্রাকোনিস,আমি সেই ল্যাবের সন্ধান করতে পেরেছি যেখানে আমাদের অতি আদরের ছোট্ট এথিরিয়ন বন্দি রয়েছে।”
“আগামীকালের মধ্যেই আমি আমার একমাত্র ভাই এথিরিয়নকে সেখান থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবো। ”ইটস আ প্রমিস ফ্রম দা প্রিন্স অফ ভেনাস” আগুন্তক দৃঢ় আর আত্মবিশ্বাসী সুরে বললো।
তার কথাগুলো ল্যাবের অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল,যা মনে হবে তার প্রতিজ্ঞা অটুট নীতি।
অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটির কণ্ঠে একটি নিঃসংশয় প্রশান্তি ফুটে উঠল,যদিও তার কণ্ঠস্বরেও গভীর দায়িত্ববোধের ছাপ ছিল।
“ইয়েস, মাই সান,” তিনি ধীরে ধীরে বললেন,
যেন প্রতিটি শব্দের ওজন অনুভব করছেন।
“আমি জানি, তুমি পারবে। তবে শুধু এথিরিয়ন নয়, আরেকটি কাজ ও আছে—সেটা কিন্তু ভুলে যেও না। সেটাকে সম্পূর্ণ করে তবেই তুমি ভেনাসে ফিরবে,তার আগে নয়।”
তার কথাগুলো ছিল নির্দেশের মত ভঙ্গি,যা সামনে থাকা আগুন্তককে মনে করিয়ে দিল তার মিশনের সম্পূর্ণতার গুরুত্ব।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের সেই আগুন্তক ধীরে ধীরে ল্যাবের আলো নিভিয়ে দেয়।সামনে তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার,কিন্তু হৃদয়ের গভীরে অদ্ভুত সংশয় আর উদ্বেগ কাজ করছে। ড্রাকোনিসের দেওয়া নির্দেশনার শব্দগুলো এখনও তার কানে বাজছে— “তুমি পারবে, তবে শুধু এথিরিয়নকেই নয়, আরও একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে তোমাকে।”
এই কথাগুলো বারবার মনে পড়ে আগুন্তকের।
আযদাহা পর্ব ২
সে জানে, এথিরিয়নকে উদ্ধার করার পরেও কিছু একটা বাকি আছে—তার মিশন কি শুধুই তার ভাইকে মুক্ত করার জন্য, নাকি এর পিছনে আরও একটি রহস্য লুকিয়ে আছে?
আর ফিওনা—তার জীবনে আসন্ন ঝড় কি এথিরিয়নের মুক্তির সাথে জড়িত?নাকি আগুন্তক নিজেই অজান্তে তাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে?
আগুন্তক কল্পনা করতে পারে না কী ঘটতে চলেছে, তবে একটা কথা স্পষ্ট—এই মিশন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে,হয়তো এমনভাবে যা সে কখনও ভাবেনি।