আযদাহা পর্ব ৩৪
সাবিলা সাবি
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের নিস্তব্ধ বাতাস হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠলো, যখন দরজার সামনে ধপাস শব্দে জ্যাসপার ভূমিতে আছড়ে পড়লো।সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের দেয়ালগুলোতে যেন একরকম প্রতিধ্বনি খেলল।সবাই বুঝতে পারল,জ্যাসপার আর ফিওনা ফিরে এসেছে।লিভিং রুমে একে একে উপস্থিত হতে লাগল সবাই।
থারিনিয়াস পেছন থেকে গম্ভীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল,তার চোখে এক ধরনের দুশ্চিন্তা।অন্যদিকে,আলবিরা তার হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে,চোখে স্পষ্ট বিরক্তি।তবে অ্যাকুয়ারা যেন ফিওনার দিকে ছোটার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারল না।সে ফিওনার কাছে ছুটে গিয়ে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।
“তুমি কি বোকা,ফিওনা!” অ্যাকুয়ারা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল। “এভাবে কেউ পালায়? তুমি জানো,এই পাহাড় কোথায় অবস্থিত?এটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়,যেখানে ফিরে আসা সহজ!”
ফিওনা ইতস্তত করে মাথা নিচু করে বলল,“দুঃখিত,আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি।
আমি শুধু…”
ফিওনার কথা শেষ হওয়ার আগেই,আলবিরার কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল।“প্রিন্স অরিজিন এতো দেরি হলো কেন?আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো আপনারা কোনো বিপদে পড়েছেন।”
জ্যাসপার তখন মাথা উঁচু করে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “আমাদের পথে বাধা দিয়েছিল ক্রাবাথন,বিশাল আর ভয়ঙ্কর কাঁকড়া মনস্টার।তার মোকাবিলা করতে বেশ সময় লেগেছে।”
এথিরিয়ন তখন জোরে পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলো। তার মুখ কঠিন আর চোখে স্পষ্ট রাগ। “তুমি কি করেছো,ওনা? ধোঁকা দিয়ে পালানোর চেষ্টা!আমাকে এভাবে বোকা বানিয়ূ তুমি ঠিক করোনি।তোমার একটা ভুল আমাদের সবার বিপদ ডেকে আনতে পারতো।”
ফিওনা কণ্ঠ শক্ত করে বলল,“আমি পালাতে চাইনি।আমি শুধু…আমি শুধু মুক্তি চেয়েছিলাম,নিজের বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিলাম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এথিরিয়নের চোখ আরো কঠোর হয়ে উঠল। “মুক্তি?তুমি জানো না,এই পাহাড়ের বাইরে কী অপেক্ষা করছে।এটা শুধু তোমার কল্পনা নয়,ফিওনা।এখানে সবকিছু অতি ভয়ংকর।”
লিভিং রুমের বাতাস থমকে গেল।জ্যাসপার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ফিওনার সামনে দাঁড়াল।তার সবুজ চোখে একধরনের কোমল কিন্তু দৃঢ় চাহনি ফুটে উঠল।”সাধারণ মানবী তো তাই বুঝতে পারেনি ,এথিরিয়ন। তবে এখন থেকে সে বুঝবে।সে এখানেই থাকবে।নিজ ইচ্ছায়।”
সবাই এক মুহূর্ত চুপ করে রইল।বাইরে পাহাড়ি বাতাস আর ঝর্ণার শব্দ যেন পুরো ঘরটাকে আবৃত করল।অ্যাকুয়ারা আস্তে করে ফিওনার কাঁধে হাত রাখল,তার কণ্ঠে নরম সুর। “তুমি ঠিক আছো তো,ফিওনা?”
ফিওনা মাথা নাড়ল।তবে তার চোখে এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিল। মনে হচ্ছিল,সে প্রথমবার সত্যিকার অর্থে বুঝতে শুরু করেছে এই পাহাড়,এই ড্রাগনদের জীবন আর তার নিজের অবস্থান কতটা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
ক্রাবাথন,বিশাল কাঁকড়া মনস্টার,যে তার বিশাল হাত, তীক্ষ্ণ নখ এবং গাঢ় সাদা-কালো রঙের শরীর নিয়ে উপস্থিত হয়ছিলো আর তার সিগন্যালে যদি সব মনস্টার চলে আসতো তবে সব ড্রাগনের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়তো।ক্রাবাথনের আক্রমণ অত্যন্ত তীব্র আর তার ধ্বংসাত্মক শক্তি,সে কোনোভাবে এলে,তা সবার জন্য একটা গুরুতর বিপদ বয়ে আনতে পারতো।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল।ফিওনার নীরব চেহারা আর এথিরিয়নের ভ্রু কুঁচকে থাকা ভাব দেখে জ্যাসপারের ধৈর্য যেন ফুরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে গম্ভীর ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,”এথিরিয়নের বোকামির জন্য সে শাস্তি পাবে,আর ফিওনা,তুমিও পালানোর দুঃসাহস দেখানোর জন্য শাস্তি পাবে।”
এথিরিয়ন তৎক্ষণাৎ সামনে এগিয়ে এলো,তার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। “জ্যাসু ভাইয়া!আমার কি দোষ?আমি কি জানতাম নাকি এই মেয়েটা এমন কিছু করবে?”
জ্যাসপার এক পা এগিয়ে এথিরিয়নের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। “সম্পূর্ণ দোষ তোর,এথিরিয়ন।একজন ড্রাগন হয়ে এতটা আহাম্মক কি করে হতে পারিস সেটাই আমার প্রশ্ন। দায়িত্বের এতটুকু বোঝাপড়া নেই তোর?একজন সাধারণ মানবী তোকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে গেলো?”
এথিরিয়ন হতাশ কণ্ঠে বলল, “জ্যাসু ভাইয়া,আমি তো শুনতাম হিউম্যান গার্লরা অনেক ছলনাময়ী হয়।আজকে প্রমাণ পেলাম।এরা বাইরে থেকে যতটা সুন্দর,ভেতরে ঠিক ততটাই ছলনাময়ী।”
এই কথায় ফিওনার মুখ লাল হয়ে উঠল,কিন্তু সে নীরব থাকল।তার দৃষ্টিতে ক্ষোভ আর লজ্জা একসঙ্গে ফুটে উঠছিল।জ্যাসপার হঠাৎ এথিরিয়নের দিকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকাল যে মনে হলো পুরো ঘরের তাপমাত্রা নিমেষেই কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে।
“চুপ কর,এথিরিয়ন!” জ্যাসপার ধমকের সুরে বলল।
“তুই যা জানিস না,তা নিয়ে কথা বলিস না।মানুষ কী আর তাদের দুর্বলতা কী,তা বোঝার ক্ষমতা তোর নেই।তাই তো তুই বারবার ব্যর্থ হচ্ছিস।”
এথিরিয়ন আর কোনো কথা বলল না,কিন্তু তার মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট ছিল।ফিওনা একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল, তার চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া।জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে এক গভীর শ্বাস ফেলল এবং কঠিন কণ্ঠে বলল,”ফিওনা, তোমার কাজও ক্ষমার অযোগ্য।তুমি জানো না এখানে পালানোর চেষ্টা কতটা বিপজ্জনক।আর তোমার জন্য এই হাউজের সবার বিপদ হতে পারতো।তোমার এই দুঃসাহসের ফল তুমি বুঝতে পারবে।”
ফিওনা কোনো উত্তর দিল না।তার কণ্ঠ যেন আটকে গিয়েছিল,আর সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।লিভিং রুমের পরিবেশে একধরনের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল,আর সকলে বুঝতে পারল জ্যাসপার আসলে কতটা রাগান্বিত।
জ্যাসপারের চোখ দুটোতে যেন ঝলসে উঠল আগুনের স্ফুলিঙ্গ।তার গলার স্বর ঠান্ডা,কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো শোনাল।”আলবিরা,ফিওনাকে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের টর্চার সেলে নিয়ে যাও।আমি ওর দুঃসাহসের জন্য শাস্তি ঠিক করে দেব।”
আলবিরা একটু থমকে গেল,যেন সে বুঝতে পারছিল না আদেশটা এতটা কঠোর হবে। তবুও,সে মাথা নুইয়ে সম্মতি জানাল।ফিওনা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তার শ্বাস দ্রুত হয়ে এলো,কিন্তু জ্যাসপারের কঠোর মুখাবয়ব দেখে কিছু বলার সাহস পেল না।
জ্যাসপার এবার থারিনিয়াসের দিকে ঘুরে তাকাল। “থারিনিয়াস,ডাইনিং টেবিলের সামনে কাঁচের বক্স আনো। এমনভাবে তৈরি করো যাতে এথিরিয়ন এর ভেতরে ২৪ ঘণ্টা বন্দি থাকতে পারে।তিনবেলা ডাইনিং টেবিলের সুস্বাদু খাবার সে দেখবে,কিন্তু তার স্পর্শ করার অনুমতি থাকবে না।”
থারিনিয়াস অল্প মাথা নাড়ল,তার চোখে বিস্ময়ের ঝলক। জ্যাসপারের পরিকল্পনা এতটাই অমানবিক,অথচ এতটাই কার্যকর যে কেউই কোনো কথা বলতে সাহস পেল না।
“আর ফিওনার শাস্তি?”থারিনিয়াস একটু দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে এক ধরণের শীতল হাসি ফুটে উঠল। “ফিওনারটা আমি নিজেই দেখছি।ওকে বোঝাতে হবে যে এই পাহাড়ে কোনো মানবীয় ছলনার জায়গা নেই।”
আলবিরা ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে এল।ফিওনার চোখে আতঙ্কের ছায়া দেখা গেল।সে পেছনে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল,কিন্তু আলবিরার দৃঢ় হাত তাকে ধরে ফেলল।
“চল,ফিওনা।” আলবিরা শান্ত কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলল।
ফিওনা জোরে কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে থামিয়ে দিল। তার চোখে আগুনের ভাষা, যা কোনো প্রতিবাদের সুযোগই দেয় না।
ডাইনিং রুমে থারিনিয়াস তখন কাঁচের বক্স নিয়ে আসতে শুরু করল।কাঁচের বক্সটি উচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি।এর ভেতরে স্বচ্ছ ন্যানোশিল্ড প্রযুক্তি রয়েছে,যা বক্সের ভেতর থেকে বাইরে কিছুই বের হতে দেয় না।একবার এথিরিয়ন সেটার ভেতরে ঢুকলে,সে শুধু বাইরে থেকে খাবার দেখতে পাবে,কিন্তু তার শক্তিশালী ড্রাগনের হাত দিয়েও বক্স ভাঙতে পারবে না।
এদিকে,ফিওনাকে টর্চার সেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মাউন্টেন গ্লাস হাউজের নিচের গুহার গভীরে সেলটি তৈরি করা হয়েছে।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের আধুনিক টর্চার সেল:
টর্চার সেলটি ছিল একেবারে আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি। দেয়ালগুলো শক্তিশালী ট্রান্সপারেন্ট মেটা-ক্রিস্টাল দিয়ে বানানো,যার ভেতর থেকে ফিওনা সবকিছু দেখতে পারবে, কিন্তু বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা,দেয়ালে হাত রাখলেও সেটি হালকা শক দেবে।পুরো সেলটি স্বয়ংক্রিয়।একটি কন্ট্রোল প্যানেল ছিল সেলের বাইরে,যেখান থেকে প্রতিটি মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা যায়।সেলের মেঝে এক প্রকার তরল ধাতুর মতো,যা প্রয়োজনে শক্ত হয়ে বন্দিকে স্থির করে রাখতে পারে।
জ্যাসপার টর্চার সেলে প্রবেশ করল।তার মুখে কঠিন অভিব্যক্তি।ফিওনার চোখে তখনও বিদ্রোহের আগুন। আলবিরা শান্তভাবে সেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল,কিন্তু তার চোখে ফিওনার জন্য মৃদু সহানুভূতি ছিল।
“আলবিরা,এখানে তোমার প্রয়োজন শেষ।তুমি যেতে পার।”জ্যাসপারের কণ্ঠ কঠোর।
আলবিরা কিছু বলল না,কিন্তু যাওয়ার আগে ফিওনার দিকে একবার তাকাল।তার চোখে ছিল একধরনের অমীমাংসিত সতর্কতা।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে এগিয়ে এলো।তার লম্বা ছায়া ফিওনার সামনে পড়ল।ফিওনা পেছাতে চাইল,কিন্তু দেয়ালে গিয়ে আটকাল।
“তুমি পালানোর চেষ্টা করেছিলে,ফিওনা।এখানে যেটা একদমই অগ্রহণযোগ্য।”তার কণ্ঠ ছিল শীতল,যেন বরফের মতো।
“আমি… আমি শুধু ফিরে যেতে চেয়েছিলাম,” ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে বলল।
“তুমি ভুল করেছ,আর ভুলের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।”জ্যাসপার কঠিন কন্ঠে বললো।
জ্যাসপার একধরনের আধুনিক ডিভাইস নিয়ে সামনে এল।সেটা ছিল ছোট,পেন্সিলের মতো,কিন্তু এর শেষ অংশ থেকে লাল রঙের আলো বের হচ্ছিল।সে ফিওনার দুহাত সামনে টেনে আনল।
“আপনি এটা কি করছেন?” ফিওনার কণ্ঠে আতঙ্ক।
“তোমাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে,যাতে ভবিষ্যতে তুমি আর এমনটা না করো।”
সে দ্রুত ফিওনার হাত জিপটাই দিয়ে বাঁধল।জিপটাইটি সাধারণ ছিল না।এটি বিশেষ ন্যানো-মেটাল দিয়ে তৈরি,যা হাতের তাপমাত্রা অনুযায়ী নিজেকে শক্তিশালী করে।যতই শক্তি লাগিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হবে,এটি ততই শক্ত হবে।
“এটা ছাড়ানোর চেষ্টা করবে না,কারণ পারবে না,” জ্যাসপার কঠিনভাবে বলল।
এরপর সে সেলের দেয়ালে একটি বোতাম চাপল।সেলের মেঝে আলোর মতো চকমকে হয়ে উঠল।ফিওনা পেছনের দিকে তাকাল আর দেখল মেঝে থেকে ধীরে ধীরে ধাতব শিকল বের হচ্ছে,যা তার পা দুটো ধরে ফেলল।
“তোমার শাস্তি হবে এখানে ২৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা,ফিওনা। মেঝে তোমার শরীরের প্রতিটি নড়াচড়া শনাক্ত করবে।যদি একটুও বসার চেষ্টা করো,তাহলে এটা নিজে থেকেই শক দেবে।”
ফিওনার চোখে আতঙ্ক জমতে শুরু করল।”এটা খুব অমানবিক,আপনি এটা করতে পারেন না!”
“তুমি একজন মানবী।আমি একজন ড্রাগন।আমি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করছি না,”জ্যাসপার চোখ তুলে তাকাল,তার সবুজ চোখে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আর শক্তি।
“এথিরিয়নকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।এখন তোমার পালা।মনে রেখো,ফিওনা,আমার রাজ্যে নিয়ম ভাঙার কোনো জায়গা নেই।”
ফিওনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল,কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করল না। সে জানত,জ্যাসপারের কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে তার কোনো কথা কাজে আসবে না।
জ্যাসপার একবার পেছন ফিরে তাকাল আর সেল থেকে বেরিয়ে গেল। সেলের স্বয়ংক্রিয় দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল,আর ফিওনা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল,চারপাশের অদ্ভুত প্রযুক্তির ভেতর বন্দি।তার সামনে ছিল ২৪ ঘণ্টার এক দীর্ঘ পরীক্ষা।
এথিরিয়ন নিজের পাখা ছড়িয়ে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করল।কিন্তু জ্যাসপারের সিদ্ধান্ত যেন পাথরের মতো স্থির। তার চোখে একধরনের অদম্য আগুন,যা এথিরিয়নের প্রতিটি যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে।
“জ্যাসু ভাইয়া,আমি তো কোনো ভুল করিনি।আমি জানতাম নাও পালাতে চাইবে!” এথিরিয়ন অসহায়ভাবে বলল।
“একজন ড্রাগন হয়ে তোর এতটা অসতর্ক হওয়া সম্ভব নয়। তুই একজন রক্ষক,অথচ এক মানবী তোকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে।এটা ক্ষমার যোগ্য নয়।তোর শাস্তি ঠিক করা হয়েছে,”জ্যাসপারের কণ্ঠ ছিল বরফের মতো শীতল।
জ্যাসপার থারিনিয়াসকে নির্দেশ দিলেন,“ডাইনিং টেবিলের সামনে সেই কাচের বক্সটি আনো।আমি চাই এথিরিয়নকে সেখানে বন্দি করা হোক।”থারিনিয়াস জ্যাসপারের নির্দেশ মতো মাধ্যমে কাঁচের বাক্সটা আনলো।
কাচের বক্সটি ছিল অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির।এটি তৈরি হয়েছে ক্রিস্টালাইন-কার্বনাইট নামক একটি উপাদান দিয়ে,যা ড্রাগনের সমস্ত শক্তিকে প্রতিফলিত করে।বক্সটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেতরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাইরে থেকে এটি স্বচ্ছ কাচের মতো দেখতে হলেও,এর ভেতরে ছিল একধরনের বিশেষ কেমিক্যাল সিস্টেম,যা ধীরে ধীরে বন্দিকে দুর্বল করে তোলে।
বক্সের ভেতরে ঢুকেই এথিরিয়ন অনুভব করল কেমিক্যালের গন্ধ।কেমিক্যালটি “ড্র্যাক্সিলিন-৭”নামে পরিচিত—একটি বিশেষ তরল,যা ড্রাগনের শরীরের শক্তি সঞ্চালনকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়।এটি সরাসরি ড্রাগনের জৈবশক্তিকে লক্ষ্য করে,ফলে তাদের শারীরিক শক্তি কার্যত নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
বক্সটি থারিনিয়াস আর আরও দুই ড্রাগনের সাহায্যে ডাইনিং টেবিলের সামনে স্থাপন করা হলো। এর ভেতর এথিরিয়নকে বাধ্য করা হলো প্রবেশ করতে।
“তোর শাস্তি এখানেই শেষ না।তুই তিন বেলা এই ডাইনিং টেবিলের পাশে সুস্বাদু খাবারের গন্ধ পাবি।কিন্তু তুই কিছু খেতে পারবি না।কেমিক্যালটাও তোর ক্ষুধার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তুলবে।তবে খাওয়ার সামর্থ্য তোকে আমি দিচ্ছি না,” জ্যাসপার কঠোর কণ্ঠে বলল।
বক্সের ভেতরে একটি ধাতব আসন ছিল।এথিরিয়ন সেখানে বসার চেষ্টা করল,কিন্তু আসনটি ঠান্ডা থেকে ক্রমশ গরম হতে শুরু করল।এটি তাপমাত্রা অনুযায়ী বন্দিকে অস্বস্তি দিতে সক্ষম।
এর ভেতরে আরেকটি সিস্টেম সক্রিয় হলো।বক্সের চারপাশ থেকে আলোকরশ্মি এথিরিয়নের শরীরে পড়তে শুরু করল। এই রশ্মি তার জৈব কোষগুলোর শক্তি নিঃশেষ করার জন্য তৈরি।প্রতিটি রশ্মি তার শরীরের শক্তি কণিকাগুলো শুষে নিয়ে তাকে দুর্বল করে তুলতে লাগল।
বন্দি অবস্থায় এথিরিয়ন বুঝতে পারল,এই শাস্তি কেবল শারীরিক নয়,মানসিক যন্ত্রণারও।খাবার দেখতে পাওয়া, কিন্তু খেতে না পারা,শরীরের শক্তি নিঃশেষ হওয়া—সবকিছুই এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ।
জ্যাসপার তার চেয়ারে বসল।একদিকে কাঁচের বক্সে দুর্বল হয়ে পড়া এথিরিয়ন,আরেকদিকে ডাইনিং টেবিলে রাখা সুস্বাদু খাবার।
“এথিরিয়ন,ড্রাগন হওয়ার মানে কী সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এই শাস্তি।একবার শাস্তি শেষ হলে আশা করি তুই নিজের দায়িত্বটা বুঝে নিবি,”জ্যাসপার বলল, তার কণ্ঠে ছিল একধরনের দায়িত্বপূর্ণ দৃঢ়তা।
এথিরিয়ন নীরব রইল।কাঁচের বক্সের ভেতরে বসে সে ধীরে ধীরে কেমিক্যালের প্রতিক্রিয়া অনুভব করল।তার মনে একটাই চিন্তা ঘুরছিল—এই ২৪ ঘণ্টা তাকে টিকে থাকতে হবে,তারপর আবার নিজের মর্যাদা ফিরে পেতে হবে।
জ্যাসপার ধীর পায়ে কনফারেন্স কক্ষে প্রবেশ করল।কক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ সায়েন্স-ফিকশন স্টাইলে সাজানো।কাচের দেয়ালে হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল বিভিন্ন ডেটা, গ্রাফ আর ভিজ্যুয়াল রেন্ডারিং।কক্ষের কেন্দ্রে রাখা ছিল বিশাল একটি গোলাকার টেবিল,যার ওপর হাই-টেক প্রজেক্টরের মাধ্যমে মিশনের মানচিত্র ফুটে উঠেছে।
মিস্টার চেন শিং ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে ড্রোনের মাধ্যমে প্রজেক্টরের উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন।জ্যাসপারকে দেখে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন।
চেন শিং বললেন “কবে থেকে মিশন শুরু করবো,কিছু ভেবেছ?”জ্যাসপার জবাব দিলো “আজকে সম্ভব না।কাল থেকে শুরু করব।”চেন শিং তখন বললো “ঠিক আছে, তবে আজকেই কালকের জন্য যা যা প্রয়োজন,সব প্রস্তুত রাখো।সময় নষ্ট করার মতো অবস্থা নেই।”
চেন শিং তার ডিভাইসটি টেবিলের ওপর রেখে বললেন,
তবে কালকের জন্য যা যা প্রয়োজন, আজকেই গুছিয়ে রাখো।এই অভিযান কোনো সাধারণ মিশন নয়, জ্যাসপার।তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসংকুল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হবে।এখন মনোযোগ দিয়ে শোনো,কী কী সরঞ্জাম লাগবে।”
মিস্টার চেন শিং একটি ম্যাপ অ্যাক্টিভেট করলেন।এটি ছিল আর্কটিক অঞ্চলের থ্রিডি ডিজিটাল রেন্ডারিং।তিনি পয়েন্টার দিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা চিহ্নিত করলেন এবং একে একে বললেন,
ড্রিলিং ড্রোন:“এই যন্ত্রটি বরফের গভীর গহ্বর পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যবহার হবে।এটি স্বয়ংক্রিয় এবং তোমার নির্দেশ অনুসারে কাজ করবে।বরফের গহ্বরে পৌঁছে এটি এনার্জি-ভাইন সংগ্রহে সাহায্য করবে।”
টেম্পারেচার শিল্ড স্যুট:“আর্কটিকের তীব্র ঠান্ডা সহ্য করার জন্য তোমার শরীরে এই স্যুট থাকবে।এটি তোমাকে শূন্য ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে।এতে একটি বিল্ট-ইন অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেমও রয়েছে।”
এনার্জি-ভাইন সংগ্রহকারী ডিভাইস:“এই ডিভাইসটি এনার্জি-ভাইনের শিকড় এবং পাতা বিচ্ছিন্ন না করে সংরক্ষণ করবে। এটি হালকা এবং বহনযোগ্য।”
আইস-ব্রিউল রেপেলার:“বরফের নিচের প্রাণীগুলোর জন্য এই যন্ত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড ব্যবহার করে তাদের দূরে রাখবে।”
এনার্জি সিলিন্:“উদ্ভিদ থেকে নিঃসৃত অক্সিজেন সরাসরি এই সিলিন্ডারে সংরক্ষণ করতে হবে। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা, যাতে অক্সিজেনের কোনো অপচয় না হয়।”
নেভিগেশন ডিভাইস:“তোমার যাত্রা ট্র্যাক করতে এবং ফিরে আসার সঠিক পথ খুঁজে পেতে এই ডিভাইসটি ব্যবহার হবে। এটি স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম নেভিগেশন সরবরাহ করবে।”
চেন শিং তার ডিভাইসটি টেবিলের ওপর রেখে বললেন,
“ঠিক আছে, তবে কালকের জন্য যা যা প্রয়োজন, আজকেই গুছিয়ে রাখো। এই অভিযান কোনো সাধারণ মিশন নয়, জ্যাসপার। তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসংকুল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হবে। এখন মনোযোগ দিয়ে শোনো, কী কী সরঞ্জাম লাগবে।”
জ্যাসপার চেন শিংয়ের নির্দেশে মাথা নেড়ে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে সরঞ্জাম সেকশনে গেল।সেখানে সমস্ত সরঞ্জাম একত্রিত করে একে একে পরীক্ষা করতে শুরু করল।
ড্রিলিং ড্রোনটি দেখতে একটি বিশাল সিলিন্ডারের মতো ছিল, যার সামনে ধারালো ড্রিল-ব্লেড ছিল।জ্যাসপার ড্রোনের অপারেশন প্যানেল চেক করল এবং নিশ্চিত করল যে এটি কাজ করার জন্য প্রস্তুত।
স্যুটটি তুলে পরখ করল।এতে একাধিক লেয়ার ছিল এবং সবগুলোই হালকা ওজনের তার মুখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল।“এই যন্ত্রগুলো ঠিকঠাক কাজ করলেই অভিযান সফল হবে,” জ্যাসপার নিজেই নিজেকে বলল।
মিস্টার চেন শিং এদিকে সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষা করছিলেন।প্রতিটি সিলিন্ডার দ্রুত অক্সিজেন সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত। তিনি জ্যাসপারকে বললেন,“কাল সকালের আগে সবকিছু প্রস্তুত রেখো।আর মনে রেখো, শুধু অক্সিজেন সংগ্রহ নয়, বরফের গভীরে কী অপেক্ষা করছে,তা আগে থেকে কেউ জানে না।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে চেন শিংয়ের দিকে তাকাল। তার গলায় ভরসা আর সন্দেহের মিশ্রণ।“আর ওই মনস্টার, অ্যাথ্রাক্সের বিরুদ্ধে লড়াই?আমাকে কীভাবে প্রস্তুত হতে হবে?তারা কীভাবে আক্রমণ করবে?”
চেন শিং হালকা হাসল।তার চোখে যেন কোনো রহস্যের ছায়া খেলে গেল।তিনি একটি নোটপ্যাড তুলে নিয়ে সেখানে আঁকা একটি কাল্পনিক প্রাণীর স্কেচ দেখালেন।স্কেচটি ছিল বিশাল আকৃতির অ্যাথ্রাক্সের,যার লেজ বিশাল আর চোখগুলো যেন লাল আগুনের মতো জ্বলছে।
“তুমি ভুল ভাবছো,জ্যাসপার,”চেন শিং ধীর স্বরে বলল। “অ্যাথ্রাক্স তোমাকে সরাসরি আঘাত করবে না।তারা তোমাদের শারীরিক শক্তি পরীক্ষা করবে না,বরং মানসিক শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা যাচাই করবে।তাদের টাস্ক হলো তোমাদের চ্যালেঞ্জ দেওয়া।আর তোমার কাজ হবে সেই চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা।”
জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে বলল,“চ্যালেঞ্জ?কী ধরনের চ্যালেঞ্জ?”
চেন শিং তার জায়গায় দাঁড়িয়েই জবাব দিল,“তোমাদের বুদ্ধি আর ধৈর্য পরীক্ষা করতে এমন কিছু টাস্ক দেওয়া হবে, যেগুলো সহজে সমাধান করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, একটা ধাঁধা,এমন কিছু যা লজিক বা আবেগের ওপর নির্ভর করে।কখনো তোমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যে তথ্য দেওয়া হতে পারে।মনে রেখো,সব জায়গায় শুধু শক্তি বা ক্ষমতা কাজ করে না,বুদ্ধিও লাগে।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করল,“আর যদি আমরা সেই টাস্ক কমপ্লিট করতে না পারি?”
চেন শিং এবার গম্ভীর হয়ে বলল,“তাহলে কী শাস্তি অপেক্ষা করছে,তা আমি নিশ্চিত জানি না।তবে শাস্তি যে সহজ হবে না,তা আমি বলতে পারি। অ্যাথ্রাক্স আর তার দলের সদস্যরা যারা ওই অঞ্চল পাহারা দেয়,তারা মারাত্মক কঠোর।তাদের পছন্দ একটাই—তোমরা টাস্ক সম্পন্ন করো,নয়তো তাদের ক্রোধের মুখোমুখি হও।”
জ্যাসপার এবার কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“তাহলে আমাকে শুধু শারীরিক নয়,মানসিক প্রস্তুতিও নিতে হবে।”
চেন শিং মাথা নেড়ে বলল,“তোমার জন্য আরেকটা পরামর্শ—তোমার দল নিয়ে বেশি দূর ভাবো না।সবাই তোমার মতো শক্তিশালী নয়।তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় দাও আর নিজের ক্ষমতার ওপর ভরসা রাখো।তুমি যদি আত্মবিশ্বাসী থাকো, তাহলে অ্যাথ্রাক্সের টাস্ক তুমি সহজেই সম্পন্ন করতে পারবে।”
জ্যাসপার এবার একধরনের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা করল।তার চোখে একাগ্রতা স্পষ্ট হয়ে উঠল।“আমি প্রস্তুত হব, মিস্টার চেন শিং।কাল এই অভিযান আমার হবে।আর টাস্ক যাই হোক,আমি তা সমাধান করব।”
চেন শিং মৃদু হেসে বলল,“আমি তা জানি,জ্যাসপার।কারণ তুমি শুধু ড্রাগন রাজ্যের প্রতিনিধি নও,তুমি এক বিশেষ যোদ্ধা।”
জ্যাসপারের ল্যাবের সমস্ত কার্যক্রম শেষ হতে হতে ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে, অবশেষে কনফারেন্স রুম ত্যাগ করলো।
জ্যাসপার আলবিরা আর থারিনিয়াসের সাথে লিভিং রুমে প্রবেশ করলো।সেখানে এথিরিয়নকে কাঁচের বাক্সের মধ্যে বন্দি অবস্থায় দেখতে পেয়ে জ্যাসপার বললো,“এথিরিয়নের শাস্তির সময় শেষ।থারিনিয়াস,তুমি এথিরিয়নকে মুক্তি দাও।”
থারিনিয়াস কিছুটা দ্বিধায় বলল,“প্রিন্স আপনি কি নিশ্চিত?এথিরিয়নের ভুল ছিল,তাকে আরো একটু সময় রাখা উচিত ছিল।”
“এটা তার জন্য শিক্ষা ছিল,জ্যাসপার জোর দিয়ে বলল। “এখন মুক্তি দিতে হবে।তাকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ দিতে হবে,কারন পরবর্তী মিশনে তাকে নিয়ে যাবো।”
থারিনিয়াস অবশেষে কাঁচের বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল আর লক খুলে এথিরিয়নকে বের করে আনলো। “তোমার আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে,”থারিনিয়াস বলল।“আর যদি আবার এমন কিছু করো,তবে এরপর কি হবে তা প্রিন্স ভালো জানেন।”
এথিরিয়ন মাথা নিচু করে বলল, “আমি বুঝতে পারছি,এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছি,এমন কিছু আর কখনও করবো না।”
এদিকে,অ্যাকুয়াযা কিছুটা উদ্বেগের সাথে জ্যাসপারকে বলল,“প্রিন্স এখনতো ফিওনাকে মুক্তি দিতে হবে।সে দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি রয়েছে।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তা করল,তারপর বলল, “ঠিঅ ফেলেছো অ্যাকুয়াযা।এবার আমাকে টর্চার সেলের দিকে যেতে হবে।ফিওনাকে মুক্তি দেয়ার সময় এসেছে।”
“আমি আপনার সাথে আসবো প্রিন্স,”আলবিরা বলল।
“না,আমি একাই যাবো,” জ্যাসপার নির্ধারিতভাবে বলল। “এটা একটি ব্যক্তিগত বিষয়।।”
জ্যাসপার টর্চার সেলের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখতে পেল ফিওনা ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে।তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে,ঠোঁট শুকিয়ে গেছে আর শরীরে পানি নেই—২৪ ঘণ্টার এই শাস্তিতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জ্যাসপার মনে মনে ভাবলো,”তুমি নিজেকে আমার রক্ষিতা বলার জন্য এই শাস্তি পেয়েছ।আর আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য তোমাকে শাস্তি তো পেতেই হতো। আমি মানুষ নই,আমি ড্রাগন।আমার সবকিছুর কঠোর নিয়ম রয়েছে,আর এই নিয়ম মেনে তোমায় আমাকে ভালোবাসতে হবে,হামিংবার্ড।”
সে ফিওনার দিকে এগিয়ে গেলো,সেলের আশেপাশের যন্ত্রপাতি নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল।একমাত্র আওয়াজ ছিল জ্যাসপারের হাঁটার শব্দ।তার হাতে ছিল একটি স্পেশালাইজড টুল,যা কেবলমাত্র এধরনের পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয়—একটি চমকপ্রদ প্রযুক্তির পণ্য।
সে ফিওনার সামনে এসে সব সিস্টেম বন্ধ করে দিল। তারপর,একটি অতি সূক্ষ্ম ছুরি নিয়ে জিপ টাই খুলতে শুরু করল।তার একটি সাবলীল আন্দোলন ছিল—এক টানে জিপ টাই খুলে ফেলল।ফিওনার দেহ তখন কোমল,তার চেতনাও কিছুটা স্বাভাবিক হতে লাগলো।
আর এক নিমেষে,ফিওনা জ্যাসপারের বুকে ঢলে পড়ল। জ্যাসপার তার হৃদয় স্পন্দন অনুভব করল,যেন পৃথিবীর সমস্ত গতি থেমে গেছে।সে ফিওনাকে কোলে নিয়ে ফিওনার কক্ষে নিয়ে যেতে লাগল।সেখানকার পরিবেশ ছিল অদ্ভুতভাবে স্বাচ্ছন্দ্যময়,কৃত্রিম আলো এক নরম স্বচ্ছতা তৈরি করছিল।
জ্যাসপার ফিওনাকে কক্ষে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল। কক্ষের আলো নরম ছিল,যেন কোনো মহাজাগতিক পরিবেশ তৈরি করেছে।সে গভীরভাবে ফিওনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।তার হাতে জিপ টাই বাঁধার ফলে নীল কালচে দাগ পড়েছে, রক্তের চলাচল কমে গিয়েছে।পায়ের শেকলের কারণে পায়ে দাগও রয়েছে।আর তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে—২৪ ঘণ্টা পানিহীন থাকার কারণে সে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জ্যাসপার নিজেকে সামলে নিল।এই দৃশ্য তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। সে প্রথমে ফিওনার দুই হাতে ক্ষতস্থানে ঠোঁট ছুঁইয়ে গভীর চুমু দিলো,যেন তার যন্ত্রণাকে কিছুটা কমাতে চায়।তারপর আস্তে আস্তে পায়ের কাছে গিয়েও সেখানে চুমু দিলেন,যেন তার কষ্টগুলোকে ভাঙার চেষ্টা করছে।
তারপর,ধীরে ধীরে,জ্যাসপার ফিওনার ঠোঁটে চুমু দিতে লাগলো।ফিওনার শরীরের তৃষ্ণা ও ক্লান্তি তখন যেন এক লহমায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।চুমুর স্পর্শে ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল।জ্যাসপার তখনও তার গাল দুটো চেপে ধরে গভীর চুমু দিল,যেন পুরোপুরি তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে।
জ্যাসপার নিজের গ্লুকোজ বের করে ফিওনার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে দিতে লাগলো।ফিওনার ঠোঁটের ওপর গ্লুকোজের মিষ্টি স্পর্শ লাগতেই তার মনে হলো,যেন জীবন ফিরে পাচ্ছে।সে একটু নড়েচড়ে উঠলো।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “দুঃখিত,হামিংবার্ড।আমি জানি,আমার আচরণ তোমার জন্য কতটা কষ্টকর হয়েছে।কিন্তু দয়া করে,আর এমন কিছু করো না,প্লিজ।আমাকে শাস্তি দিতে বাধ্য করোনা তোমাকে।”
তার কণ্ঠে যেন অদৃশ্য এক আকুলতা ছিল।সে আরও বললো, “তোমাকে পুরোপুরি কাছে পাওয়ার জন্য আমি কতটা তৃষ্ণার্ত,তা তুমি বুঝতে পারছো?আমার হৃদয়ে ২৮ বছরের জমে থাকা সমস্ত আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে ভরিয়ে দিতে চাই।আমাকে একবার ভালোবেসে দেখো।”
আযদাহা পর্ব ৩৩
ফিওনার কানে কথাটা পৌঁছেছে তবে চোখ খোলার মতো সাধ্য নেই এই মুহূর্তে এতোটা দুর্বল। জ্যাসপার নিরবে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় তবে ফিওনার কানে এখনো জ্যাসপারের বলা কথা প্রতিধ্বনি হতে লাগলো “আমাকে একবার ভালোবেসে দেখো”………..