আযদাহা পর্ব ৩৯
সাবিলা সাবি
অ্যালিসা আর সিলভা পৃথিবীর পুষ্পরাজ পাহাড়ে পা রাখার মুহূর্তে নিজেদের উপস্থিতির সংকেত পাঠায়।সেই সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে থারিনিয়াস আর আলবিরা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে।দীর্ঘ তিন দিনের যাত্রা শেষে,তারা ভেনাসের রাজ্য থেকে পৃথিবীতে পৌঁছায়।
তাদের অবতরণের সাথে সাথে পাহাড়জুড়ে যেন একটি শক্তিশালী কম্পন ছড়িয়ে পড়ে।একসঙ্গে দুটি ধপাস শব্দ শোনা যায়,যা পাহাড় এবং মাউন্টেন গ্লাস হাউজকে কাঁপিয়ে তোলে।ফিওনা,অ্যাকুয়ারা,আর এথিরিয়ন চমকে উঠে, তাদের মনে হয় যে তারা এখানেই এসে গেছে।
অন্যদিকে,জ্যাসপার তখন ল্যাবে গভীর মনোযোগে কাজ করছিল।সেই কম্পনের অনুভূতিতে তার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।সে দ্রুত ল্যাবের কাজ থামিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কী ঘটেছে।মনে মনে সে জানে,যাদের আসার কথা,তারা এসে গেছে।
থারিনিয়াস আর আলবিরা সিলভা এবং অ্যালিসাকে নিয়ে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে প্রবেশ করল।ভেতরে ঢোকার পরপরই ডাইনিং টেবিলটি তাদের নজরে এলো,যা বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে সাজানো।অ্যাকুয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল টেবিলের পাশে, মুখে এক চওড়া হাসি নিয়ে।
সিলভা আর অ্যালিসা ভেতরে পা দিয়ে চারপাশে নজর বুলাল।তাদের চোখে বিস্ময়,কারণ এটি তাদের প্রথমবারের মতো মাউন্টেন গ্লাস হাউজ এবং পৃথিবীর অভিজ্ঞতা।কাচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য তাদের মুগ্ধ করে।
অ্যাকুয়ারা তাদের উষ্ণ স্বাগত জানিয়ে বলল,”স্বাগতম পৃথিবীতে।আশা করি আপনাদের যাত্রা ভালো কেটেছে।”
অন্যদিকে,এথিরিয়ন নিজের কক্ষে লুকিয়ে ছিল,সিলভার সাথে সরাসরি মোলাকাতের ভয় তাকে কাবু করে রেখেছিল। ফিওনাও নিজের কক্ষে থাকল,কোনো ঝামেলা এড়ানোর জন্য।
সিলভা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পৃথিবী বেশ মজার জায়গা মনে হচ্ছে।খাবারগুলোও দেখতে আকর্ষণীয়।”অ্যালিসা কিছু না বলে শান্তভাবে চারপাশ দেখছিল,যেন নিজের জায়গাটি পরখ করে নিচ্ছে।
অ্যালিসা ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েই জ্যাসপারের কথা জানতে চাইল।থারিনিয়াস শান্তভাবে জানাল,”প্রিন্স ল্যাবে আছে।সে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত।”
অ্যালিসা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,”খাওয়া শেষ করে আমি ল্যাবে যাব।ওনার সাথে দেখা করতেই হবে।”
থারিনিয়াস কৌশলে উত্তর দিল,”ল্যাবে কেবল তাদেরই প্রবেশের অনুমতি আছে যারা ল্যাবের কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত।”
অ্যালিসা তৎক্ষণাৎ বলল,”আমি প্রিন্সের বাগদত্তা এবং ভবিষ্যতে তার অর্ধাঙ্গিনী হবো।ওনার যে কোনো জায়গায় আমি যেতে পারি।আমার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
থারিনিয়াস অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে আর কোনো কথা বলল না।
অ্যাকুয়ারা তখন বিষয়টি সামাল দিয়ে বলল,”আপনারা আগে ফ্রেশ হয়ে নিন,তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে বাকি সব করা যাবে।”
সিলভা এইদিক দিয়ে চারদিকে নজর বুলিয়ে এথিরিয়নকে খুঁজতে লাগল। তার অনুপস্থিতি যেন সিলভার চোখে ঠিক লেগে গেল।
অ্যাকুয়ারা সিলভার খোঁজাখুঁজির কারণ বুঝে বলল, “এথিরিয়ন তার নিজের কক্ষে রয়েছে।”
সিলভা তৎক্ষণাৎ বলল,”আমি আগে ওর সাথে দেখা করব। আমাকে তার কক্ষটা দেখাও।”
অ্যাকুয়ারা একটু দ্বিধায় পড়লেও সিলভার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির চাপে সম্মতি দিল। “এই দিক দিয়ে আসো,আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
সিলভা অ্যাকুয়ারার পেছনে পেছনে এথিরিয়নের কক্ষের সামনে পৌঁছাল।দরজা খুলতেই সিলভা আর কোনো কথা না বলে তৎক্ষণাৎ ভেতরে প্রবেশ করল।অ্যাকুয়ারা কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সিলভা কী করে।
এথিরিয়ন সিলভাকে দেখেই হতভম্ব।এরই মধ্যে সিলভা এক লাফে এথিরিয়নের দিকে এগিয়ে এসে তাকে জাপ্টে ধরল। এথিরিয়নের চক্ষু চড়কগাছ!এমন পরিস্থিতির জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
সিলভা উচ্ছ্বাসে বলল,”এথিরিয়ন!তুমি কেমন আছো? কতদিন তোমাকে দেখি না!জানো তুমি?আমি তোমার জন্য কত কষ্ট পেয়েছি!”
এথিরিয়ন অপ্রস্তুতভাবে সিলভার আলিঙ্গন থেকে বের হতে চেষ্টা করল।”সিলভা,হ্যাঁ,আমি জানি।এবার আমাকে ছাড়ো।”
সিলভা মৃদু হেসে বলল,”ছাড়বো মানে!নিচে চলো।একসাথে খাবার খাব।”
এথিরিয়ন কিছুটা অস্বস্তিতে বলল,”আমার পেট ভরা।”
কিন্তু সিলভা তার কথা শুনল না।তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।এথিরিয়নের বাধা দেওয়ার চেষ্টা বৃথা হলো।
অন্যদিকে অ্যাকুয়ারা পুরো দৃশ্য দেখে মজা পেয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগল। মনে মনে ভাবল,”এই দুইজনের কাণ্ড দেখে তো দিনের ক্লান্তি কেটে গেল!”
অবশেষে সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে শুরু করল।খাবারের পরিবেশ ছিল জমজমাট,কিন্তু অনুপস্থিত ছিল জ্যাসপার আর ফিওনা।অ্যালিসা খাবারের মাঝেই আলবিরার কাছে পুনরায় জ্যাসপারের কথা জানতে চায় এবং তাকে দেখার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে।
আলবিরা প্রথমে আপত্তি জানালেও,অ্যালিসার জোরাজুরিতে তাকে নিয়ে ল্যাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ল্যাবের সামনে পৌঁছে অ্যালিসা আর কিছু না বলে সরাসরি দরজার দিকে এগিয়ে যায়।ল্যাবে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্নধর্মী সিগন্যাল বাজতে শুরু করে।নিরাপত্তা এলার্ম জোরে বেজে ওঠে,যা পুরো ল্যাবের পরিবেশ অস্বস্তিকর করে তোলে।
জ্যাসপার কাজের মধ্যেই ছিল আর হঠাৎ এমন অ্যালার্মে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।সে অবাক হয়ে সামনে তাকায় এবং অ্যালিসাকে ল্যাবে দেখে তার চোখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে ওঠে।
গম্ভীর কণ্ঠে জ্যাসপার বলে,”তুমি এখানে কীভাবে প্রবেশ করলে?এই ল্যাব শুধুমাত্র বিশেষ অনুমতি প্রাপ্তদের জন্য।”
অ্যালিসা ভ্রু কুঁচকে উত্তর দেয়,”আমি আপনার ভবিষ্যৎ স্ত্রী প্রিন্স।আমার এখানে প্রবেশের জন্য আলাদা কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে,তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।সে বললো “তোমার অবস্থান যাই হোক,ল্যাবে এমনভাবে প্রবেশ করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও।”
অ্যালিসা কিছুটা আহত মনে প্রতিবাদ করতে চায়,কিন্তু জ্যাসপারের কঠোর দৃষ্টি দেখে সে আর কিছু বলতে পারে না। আলবিরা পরিস্থিতি সামাল দিতে অ্যালিসাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে,আর জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার কাজে ফিরে যায়। ল্যাবের পরিবেশ আবারও নিস্তব্ধ হয়ে যায়,কিন্তু জ্যাসপারের মনের অশান্তি তার মুখে স্পষ্ট।
তবে অ্যালিসা তেমন কষ্ট পেল না,কারণ জ্যাসপারের স্বভাব সে আগে থেকেই জানে।তার গম্ভীর আর দূরত্ব বজায় রাখা আচরণ নতুন কিছু নয়।তাই এ ঘটনাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে,অ্যালিসা নিজের মধ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে নিল।
সে মনে মনে ভাবল,”জ্যাসপারের মন বদলানো সহজ হবে না,তবে আমি যেভাবেই হোক তার কাছে পৌঁছাব।যতদিন এখানে আছি,ততদিন চেষ্টা করব ওর সাথে আরও কাছাকাছি আসার।হয়তো এখানের পরিবেশ,যা অনেকটাই রহস্যময় আর জাদুকরী,কোনো মিরাকল ঘটাবে।জ্যাসপার হয়তো একসময় আমার প্রতি তার অনুভূতি প্রকাশ করবে।”
অ্যালিসার চোখে ছিল অদম্য আত্মবিশ্বাস।সে বুঝেছিল, জ্যাসপারের গম্ভীর মুখের আড়ালে এমন কিছু আছে যা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
ফিরে যাওয়ার পথে,আলবিরা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।”তুমি প্রিন্সকে সহজে বদলাতে পারবে না,অ্যালিসা। ওনার হৃদয় বরফের মতো কঠিন।”
অ্যালিসা হাসি দিয়ে উত্তর দিল,”বরফ গলতে সময় লাগে, কিন্তু আমি জানি সেটা সম্ভব।”
এই কথা বলেই সে মনস্থির করে নিল যে যেকোনো উপায়ে সে জ্যাসপারের মনে একটু হলেও জায়গা করে নেবে।
অ্যালিসা গভীরভাবে বুঝে গিয়েছিল,প্রেম তার এবং জ্যাসপারের মাঝে “ফাংশনাল” নাও হতে পারে,কারণ জ্যাসপারকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতে বা প্রকাশ করতে সে সক্ষম নয়। কিন্তু একজন পুরুষ তো সর্বদা একজন নারীর সান্নিধ্য চাইবেই।এটাই ছিল তার বিশ্বাস।
“জ্যাসপারের হৃদয় যদি ভালোবাসার জন্য না হয়,তবুও আমি জানি,ওর ভেতরে একজন পুরুষ আছে।আমার উপস্থিতি ওর ওপর প্রভাব ফেলবেই।” অ্যালিসার মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জ্যাসপারের সাথে যতটা সম্ভব সময় কাটাবে।হয়তো তার সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা,কিংবা মৃদু মায়া জ্যাসপারের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে।কারণ,যেকোনো প্রকার অনুভূতির শুরুই হয় সান্নিধ্য থেকে।
তারপর সে এক মুহূর্তের জন্য থেমে নিজের সাথে ভাবল, “জ্যাসপার আমাকে তার জীবনের এক অংশ হিসেবে মেনে নিক বা না নিক,আমি জানি ও একসময় আমাকে নিজের কাছে চাইবেই।ও যতই গম্ভীর হোক,একজন পুরুষ তো।”
এই ভেবে অ্যালিসা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল।তার চোখে ছিল এক ধরনের নির্ভীক আকাঙ্ক্ষা—জ্যাসপার যতই নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করুক,সে জানত,তার এই প্রচেষ্টা তাকে একদিন কাছে টেনে নেবে।
জ্যাসপারের মন অদ্ভুত এক দোলাচলে ছিল।অ্যালিসার আগমন তার একেবারেই ভালো লাগেনি।সে জানত, অ্যালিসা যখন এখানে এসেছে,তার একমাত্র লক্ষ্য তাকে নিজের করে নেওয়া।তবে জ্যাসপারের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফিওনা।
“অ্যালিসা এবং ফিওনা… একে অপরের সাথে কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করবে না,”জ্যাসপার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল।সে ভালো করেই জানত,অ্যালিসার স্বভাব অনুযায়ী,ফিওনার প্রতি ঈর্ষা বা তাচ্ছিল্য দেখা দেবে।আর ফিওনা,যে এতটা নাজুক আর সরল,সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে?
জ্যাসপার এক মুহূর্ত থেমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তবে তার ভেতরের অস্থিরতা কিছুতেই কমছিল না।
“আমি যদি অ্যালিসাকে আটকাতে না পারি,তাহলে ফিওনা অস্বস্তির মধ্যে থাকবে।আর আমি তা হতে দিতে পারি না।”
তবে একইসঙ্গে তার মধ্যে অপরাধবোধও কাজ করছিল। কারণ সে বুঝতে পারছিল,ফিওনার জন্য এতটা সুরক্ষার দেয়াল তৈরি করা তার জন্যও একধরনের জড়তা হয়ে উঠেছে।
অ্যালিসার আগমনে ফিওনার ওপর কী প্রভাব পড়বে,তা নিয়ে জ্যাসপার আরও বেশি সতর্ক হতে লাগল।তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল,কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করল—যে কোনোভাবেই হোক,সে ফিওনাকে অ্যালিসার খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।
পরেরদিন ভোরে বেলা।ফিওনা ঘুম থেকে উঠে তখন দেখলো সবাই ঘুমেই সে ধীরে ধীরে লিভিং রুমে আসলো।অ্যাকুয়ারা কিচেনে কারন অ্যালিসা আর সিলভা এখন মেহমান তাই খাবার আগে আগে তৈরি করছে।
ফিওনা অ্যাকুয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে রান্নার কাজে হাত লাগালো। অ্যাকুয়ারা কিছুটা অবাক হয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি তো প্রিন্সের কথার বাইরে গেলে।তোমাকে তো প্রিন্স বলেছিলো শুধুমাত্র তার কাজ ছাড়া আর কারো কাজ করতে না। প্রিন্স জানতে পারলে খুব রাগ করবে।”
ফিওনা হেসে উত্তর দিলো, “তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন?তোমাদের প্রিন্স আমাকে কিছু বলবে না।আর কিছু একটা করতে না পারলে আমার সময় কাটে না।”
অ্যাকুয়ারা মৃদু হাসলো,”তাহলে ঠিক আছে।সাবধানে করো।”
ফিওনা সবজি কাটতে শুরু করলো।কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে সে কিছুক্ষণ যেন নিজের দুঃশ্চিন্তা ভুলে থাকতে পারলো। রান্নাঘরে একটা প্রশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল,কিন্তু এর মধ্যেই পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে একটা আওয়াজ এলো—
“আমি বলেছিলাম,তুমি কোনো কাজ করবে না,ফিওনা।”
ফিওনা চমকে পেছন ফিরে দেখলো।জ্যাসপার কিচেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে,তার চোখে গম্ভীর অভিব্যক্তি। অ্যাকুয়ারা তৎক্ষণাৎ ফিওনার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“প্রিন্স,দয়া করে রাগ করবেন না।আমি-ই ওকে সাহায্য করতে বলেছি।”
জ্যাসপার ধীর পায়ে ফিওনার দিকে এগিয়ে এলো।তার মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট।ফিওনা কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না।জ্যাসপার তার হাত ধরে রান্নাঘর থেকে টেনে নিয়ে গেল।
লিভিং রুমে নিয়ে এসে সে ফিওনাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,”তুমি কি আমার কথা শুনতে চাও না?আমি একবার বললেই সেটা যথেষ্ট ।আমি চাই না তুমি এমন কোনো কাজ করো।এটা বুঝতে তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন?”
ফিওনা কিছুটা ভীত হয়ে বললো,”আমি শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।আমি তো খারাপ কিছু করিনি।”
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তোমার নিরাপত্তার জন্য আমি সব নিয়ন্ত্রণ করছি।তোমাকে বুঝতে হবে,ফিওনা। এখানে প্রতিটি কাজ আমার অনুমতি অনুযায়ী হবে।”
ফিওনা নীরব হয়ে রইলো।জ্যাসপারের নিয়ম-কানুনের এই চাপে সে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠছিল,কিন্তু তার মুখে কোনো প্রতিবাদ এল না।
জ্যাসপার তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “আচ্ছা,আজ আর কিছু করো না।এখন নিজের কক্ষে ফিরে যাও।”
ফিওনা বাধ্য হয়ে নিজের কক্ষে ফিরে গেল।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাকুয়ারা চুপচাপ এই দৃশ্য দেখে গেল,কিন্তু তার চোখে একধরনের ভালো লাগা স্পষ্ট।
সকালের নাস্তা খাবারের সময় সবাই একসাথে বসলো। আজকে জ্যাসপার উপস্থিত তবে ফিওনা নেই।জ্যাসপার তখন অ্যাকুয়ারাকে বললো ফিওনাকে ডাকতে অ্যালিসা আর সিলভা অবাক হয়ে ভাবলো এই ফিওনা আবার কে।
অ্যাকুয়ারা জ্যাসপারের কথা শুনে দ্রুত ফিওনাকে ডাকতে চলে গেল।লিভিং রুমে অ্যালিসা আর সিলভা পরস্পরের দিকে তাকালো,তাদের মুখে স্পষ্ট কৌতূহল।
অ্যালিসা: “ফিওনা?এই নামটা তো কখনো শুনিনি।”
সিলভা: “হ্যাঁ,মনে হচ্ছে এখানে নতুন কেউ আছে।কে হতে পারে সে?”
তারা দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগলো।কিছুক্ষণ পর ফিওনা ধীরে ধীরে লিভিং রুমে প্রবেশ করলো।তার পরনে একটি সাদা রঙের চাইনিজ আধুনিক পোশাক,চোখেমুখে একটু সংকোচের ছাপ।
অ্যালিসা এবং সিলভা অবাক হয়ে ফিওনার দিকে তাকালো। অ্যালিসার চোখে মৃদু ঈর্ষার ঝিলিক দেখা গেল,কারণ ফিওনার সৌন্দর্য ছিল সহজ-সরল অথচ চমকপ্রদ।
অ্যালিসা (নরম গলায়) বললো “তুমি ফিওনা?তুমি এখানে কীভাবে?”
ফিওনা তাদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে চোখ নামিয়ে ফেললো।কথা বলার আগেই জ্যাসপার গম্ভীর গলায় বললো,”ফিওনা এখানে আমার অতিথি।আর কেউ তার ব্যাপারে কিছু জানার চেষ্টা করবে না।”
জ্যাসপারের এই কথায় রুমের পরিবেশ কিছুটা ভারী হয়ে গেল।সিলভা চুপচাপ থেকে জ্যাসপারের কথার গুরুত্ব বুঝলো।কিন্তু অ্যালিসার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি।
অ্যালিসা (মনে মনে): “গেস্ট?এই মেয়েটা কে যে তার জন্য এত স্পেশাল রুল তৈরি হয়েছে?এখানে এসে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চলেছে নাকি?”
অ্যাকুয়ারা ফিওনাকে টেবিলের এক কোণে বসিয়ে দিলো। ফিওনা নিরবেই খাবার খেতে শুরু করলো।সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা থাকলেও জ্যাসপার শান্তভাবে খেতে লাগলো।
অ্যালিসা ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কি প্রিন্সের বিশেষ কেউ?”
ফিওনা একটু চমকে উঠে বললো,”না,আমি শুধু এখানে আছি…আমার ইচ্ছার বাইরে।”
অ্যালিসার ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল,তবে সেটা যেন কোনো গভীর পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।”দেখা যাক,” সে মনে মনে বললো,”তোমার বিশেষত্ব আসলে কী।”
অ্যালিসা একটু হতাশা প্রকাশ করে বললো সবার উদ্দেশ্যে,”অর্থাৎ,ফিওনা এখানে কোনো বিশেষ কারণে এসেছে?”
এথিরিয়ন মাথা নাড়িয়ে বললো,”হ্যাঁ,ওইতো আমাদের জন্য বিশেষ আর ও হচ্ছে হিউম্যান।
সিলভা তাদের কথোপকথনে কিছুটা বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বললো,”এটা তো অবাক করার মতো।ড্রাগনদের মধ্যে একজন মানবী?আমি কখনো শুনিনি।”
জ্যাসপার শান্ত গলায় বললো,”আমি আগেই বলেছি,খাবার খাওয়ার সময় আমি বেশি কথা পছন্দ করিনা।তবে, ফিওনার এখানে থাকার কারণ আমার কাজে সংক্রান্ত।”
অ্যালিসা তখন বুঝতে পারলো যে,জ্যাসপার এই বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চাইছে।কিন্তু সে মনে মনে ভাবলো,”যা কিছুই হোক,আমি ফিওনাকে নিশ্চিতভাবেই আরও জানতে চাই।”
“তাহলে ও সাধারণ মানবী হয়ে কোন কাজে আমাদের সাহায্য করছে?” অ্যালিসা কিছুটা কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো।
জ্যাসপার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”এটা একটা সিক্রেট।ফিওনার সাথে আমার কাজের বিষয়টি জানানো প্রয়োজনবোধে করছিনা।”
ফিওনা তার অস্বস্তি অনুভব করতে পারছিল।সে শান্তভাবে খাবার খাচ্ছিলো।কিন্তু তার মনে ভাবনার স্রোত বইছিল।”এরা সবাই কি আমাকে বিশ্বাস করবে?আমি কি এখানে নিরাপদ?”
এথিরিয়ন এই পরিবেশের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বললো, “ফিওনা,তুমি চিন্তা করো না,ওরা তোমার বিরুদ্ধে নই।ওরা শুধু জানতে চায়,তুমি এখানে কেন?”
ফিওনা আস্তে আস্তে বললো,”আমি জানি না। আপনাদের প্রিন্স আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”
এভাবেই সবার মাঝে আলোচনা চলতে থাকলো, কিন্তু ফিওনার মনে প্রশ্নের এক চাপা আগুন জ্বলতে থাকলো—যেমন তার নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎকে নিয়ে।
পরেরদিন সকালে ফিওনা লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই সোফায় বসা সবাইকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।অ্যালিসা হেসে বললো,”এসো,এসো ফিওনা!এখানে আসো।” ফিওনা মুচকি হাসি দিয়ে সামনে আসতেই অ্যালিসা বললো,”তুমি তো চাইনিজ গার্ল তাইনা?আমি কখনো চাইনিজ খাবার খাইনি। তুমি আমাদের জন্য কিছু খাবার তৈরি করে আনো!”
অ্যাকুয়ারা তৎক্ষণাত বললো,”কী বলছেন?ফিওনা এসব কাজ পারেনা।”
অ্যালিসা পাকা হাসিতে বললো,”কী বলছো অ্যাকুয়ারা? ফিওনা চাইনিজ খাবার বানাতে পারবে,আমি জানি।ওর হাতে তো অন্যরকম জাদু আছে।”
অ্যাকুয়ারা কিছুটা নাখোশ হয়ে বললো,”এটা ঠিক নয়।”
অ্যালিসা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে ফিওনাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছিল।সে মাথা নেড়ে বললো, “আচ্ছা,সমস্যা নেই।আমি আশা করি তুমি কিছু আইটেম তৈরি করে আনবে।”
ফিওনা অস্বস্তিতে পড়ে বললো “ঠিক আছে,আমি কিছু আইটেম তৈরি করে আনছি।”
অ্যালিসা তার কথায় মুচকি হাসলো,যেন সে ফিওনাকে একটি পরীক্ষায় ফেলাতে চাচ্ছে।”আমরা অপেক্ষা করছি, আশা করছি তোমার খাবার আমাদের মুগ্ধ করবে!”
ফিওনা কিচেনে প্রবেশ করে কিছুটা চিন্তিত মনে প্রস্তুতি নিতে লাগলো।সে জানতো অ্যালিসা যে শুধু মজা করছে,কিন্তু সে চেষ্টা করতে চাচ্ছিল যেন সকলের মনে দাগ কাটতে পারে।
“যা করবো সেটা ভালো করেই করবো,” ফিওনা নিজেকে মনে মনে বললো, “আমি তাদের দেখাতে চাই যে আমি কী করতে পারি।”
ফিওনা অবশেষে চাউমিন আর ডাম্পলিংস তৈরি করে সোফার সামনে কাঁচের টেবিলে সাজিয়ে রাখলো।অ্যালিসা আর সিলভা খেতে খেতে ফিওনার রান্নার প্রশংসা করছিল। হঠাৎ,অ্যালিসার হাত থেকে চামচ পড়ে যায়।সে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,”ফিওনা,চামচটা উঠিয়ে দাও।”
ফিওনা তখন চামচ তুলতে যাবে,কিন্তু ঠিক তখনই অ্যালিসা হঠাৎ করে তার হাতের ওপর পারা দিয়ে দেয়।ফিওনার হাত লাল হয়ে যায় এবং সে অবাক হয়ে বলে,”কী করছেন?”
অ্যালিসা একটু হেসে বললো,”সরি!আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি!” ফিওনা হাত ধরে ফু দেয়,তার মনে কিছুটা অস্বস্তি ছিল।
অ্যাকুয়ারা কিছু বলতে যাবে,কিন্তু তার আগেই লিভিং রুমে প্রবেশ করে জ্যাসপার গম্ভীর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, “অ্যালিসা!”
জ্যাসপারের উপস্থিতি মুহূর্তে পুরো পরিবেশ বদলে যায়।তার গম্ভীর চেহারা এবং কণ্ঠস্বর সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়। অ্যালিসা হঠাৎ করে তার হাসি চেপে রেখে চোখ বড় করে জ্যাসপারের দিকে তাকায়।
“এটা কি হচ্ছে?” জ্যাসপার প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,”তুমি কি ফিওনার সাথে আবার কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করছো?”
ফিওনা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়,কিন্তু সাথে সাথে তার মনে হয় যে জ্যাসপার হয়তো তার জন্য উদ্বিগ্ন।
অ্যালিসা কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়ে,কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ নিজের অবস্থান গঠন করে বললো, “আমরা তো মজা করছিলাম, প্রিন্স!একটু বেশি উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়েছিলাম!”
জ্যাসপার সামনে এগিয়ে এসে ফিওনার হাত ধরে তাকে বসা থেকে টেনে উঠিয়ে দাঁড় করালো।তার গম্ভীর মুখাবয়ব এবং দৃঢ়তা সবাইকে কিছুটা স্তম্ভিত করে দিল।
একবার খাবারের দিকে তাকিয়ে জ্যাসপার বললো,
“এই খাবার কে তৈরি করেছে?”
অ্যাকুয়ারা তখন বললো,” প্রিন্সেস অ্যালিসা বলেছেন ফিওনাকে করতে।”
জ্যাসপার আবার বললো,”শুনো অ্যালিসা,ফিওনা কোনো সার্ভেন্ট বা শেফ নয় যে তুমি ওকে এসব আদেশ দিবে।ওকে আর কখনো এসব করতে বলবে না।এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং।”
জ্যাসপার এখনো ফিওনার হাত ধরে রেখেছে;ফিওনা ছাড়াতে চাইলেও তার হাত ছাড়ছে না।অ্যালিসা একটু অবাক হলো জ্যাসপারের আচরণে।তার দরদ এবং সুরক্ষার অনুভূতি দেখে অ্যালিসার মনে কিছুটা সন্দেহ জন্ম নিল।
অ্যালিসার মনে হলো,”জ্যাসপার কি সত্যিই ফিওনাকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে?নাকি তার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?”
ফিওনা অনুভব করছিল জ্যাসপারের শক্তি এবং সুরক্ষার অনুভূতি।কিন্তু একই সময়ে,তার মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল—জ্যাসপার এতটা খেয়াল রাখছে,হিতে বিপরীত হয় নাকি।
“আমি ঠিক আছি,” ফিওনা কিছুটা ভেঙে পড়া কণ্ঠে বললো।
অ্যালিসা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, “ঠিক আছে,আমি শুধু বলছিলাম যে আমরা চাইনিজ খাবার খেতে চাই।”
জ্যাসপার তার দৃষ্টি ফিওনার ওপর কেন্দ্রীভূত রেখেই বললো, “তোমাকে আমি বারবার করে বলেছিলাম এসব কাজ তুমি করবেনা।”
অ্যালিসা তার মুখ থেকে কিছু বলার চেষ্টা করলেও, জ্যাসপারের গম্ভীর গলার চাপের সামনে কোনো কিছু বলতে পারলো না।পরিস্থিতি যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল,আর ফিওনার মনেও একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো।
এভাবে,লিভিং রুমের পরিবেশটি কিছুটা চাপাচাপি হয়ে উঠলো, কিন্তু একই সাথে ফিওনার মনে ভিন্ন একটি অনুভূতি ফুটে উঠছিল—জ্যাসপার তাকে রক্ষা করছে,আর এই অনুভূতি তাকে কিছুটা সুরক্ষিত ও আনন্দিতও করছে।
জ্যাসপার নিজের কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে,তার চোখ-মুখে রাগ স্পষ্ট।থারিনিয়াস কক্ষে প্রবেশ করলো,কিছুটা সংকুচিত হয়ে।
“বলো,থারিনিয়াস,” জ্যাসপার বললো,তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর যেন পুরো কক্ষকে ভরে দিয়েছিল।
থারিনিয়াস বললো, “প্রিন্স,এটা তো ঠিক হলো না।অ্যালিসা যদি কিছু একটা বুঝে যায়,তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি ওর সামনে ফিওনার প্রতি এরকম আবেগ না দেখালেই ভালো হবে।”
জ্যাসপার তার চোখ সরাসরি থারিনিয়াসের দিকে রেখে বললো,”থারিনিয়াস,আমি কাউকে ভয় পাই না না ভেনাসের, না পৃথিবীর।ওরা ফিওনার সাথে দুর্ব্যবহার করবে আর আমি সেটা কখনোই মেনে নেবো না।আমার চোখের সামনে এসব হবে,আর আমি চুপচাপ হজম করে নিবো,এটা সম্ভব নয়।”
থারিনিয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “কিন্তু প্রিন্স,এটা ভয়ের বিষয় নয়।আপনি ড্রাকোনিসকে সম্মান করেন, ভালোবাসেন।আর তার আপনার প্রতি যে চিন্তা,সেটা থেকেই বলছি।পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন যতদিন ওরা এখানে আছে।”
জ্যাসপার তার গম্ভীর ভাব নিয়ে বললো,”স্বাভাবিক?আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারি যখন আমি ফিওনাকে বিপদে দেখতে পাই?আমি জানি,আমার আবেগগুলো আমাকে দুর্বল করে দিতে পারে,কিন্তু আমি জানি,যা কিছুই ঘটুক,ফিওনার নিরাপত্তা আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
থারিনিয়াস একটু হতাশ হয়ে বললো,”আপনার আবেগইতো আপনার শক্তি,প্রিন্স।তবে সেই শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।যদি আপনি অ্যালিসার সন্দেহ আরও বাড়ান, তাহলে তা ফিওনার জন্য বিপদ ডেকে আনবে।”
জ্যাসপার তার হাতে থাকা একটি কাগজে চোখ বুলিয়ে বললো, “তুমি ঠিক বলছো।কিন্তু আমি জানি,অ্যালিসার পরিকল্পনা কি।সে ফিওনাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইছে,আর আমি সেটা কখনোই হতে দেব না।”
থারিনিয়াস মাথা নেড়ে বললো,”তবে আপনাকে সাবধান থাকতে হবে।অ্যালিসার সাথে সমঝোতা করার জন্য অপেক্ষা করুন।এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাবে।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললো,”বুঝেছি, থারিনিয়াস।আমি চেষ্টা করব।কিন্তু আমার জন্য ফিওনার নিরাপত্তা সবসময় অগ্রাধিকার।”
থারিনিয়াস মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “জানি প্রিন্স,আর আমরা সবাই আপনার পক্ষে আছি।”
থারিনিয়াস কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবতে লাগলো, “এই প্রিন্স তো দিনদিন ভালোবাসায় উন্মাদ হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে, আরেকটা ধ্বংসের প্রলয় ঘটবে ভেনাসে।” তার মনে হয়েছিল,জ্যাসপারের ভালোবাসা এখন সত্যিই ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
“এটাই তো স্বাভাবিক,”থারিনিয়াস নিজেকে বলে উঠলো,”একজন ড্রাগন যতবার হিউম্যানদের প্রেমে পড়েছে,ততবারই ভেনাসে ধ্বংস নেমে এসেছে।সবসময় এমনই হয়েছে।”
সে মনে মনে ভেবেছিল,ড্রাগনের ভালোবাসা মশগুল হলে কি হতে পারে।প্রাচীন ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে ভালোবাসার জন্য ড্রাগনরা সব হারিয়েছে।”আর সেই ড্রাগনদের শেষ অবস্থা ছিল করুণ।”
ভালোবাসা যে কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে,সেটি তার অজানা ছিল না। ষসে জানতো,জ্যাসপারের আবেগ তাকে অন্ধ করে দিতে পারে। এই আবেগই তাকে নিয়ে যাবে এক অন্ধকার পথে,যেখানে সে হারাতে পারে তার সবকিছু—শক্তি, রাজ্য,এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,ফিওনা।
“যদি কিছু করতে না পারি,” থারিনিয়াসের মনে এক শঙ্কা জাগলো, “তাহলে একদিন হয়তো আমাদের প্রিন্সও তাদের মতো হয়ে যাবে,যারা প্রেমে পড়ার জন্য ভেনাসের সমৃদ্ধি ত্যাগ করেছে।”
থারিনিয়াস যখন কক্ষ থেকে বের হচ্ছিল, তখন তার মনে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা ছিল।সে জানতো, জ্যাসপারের জন্য এরকম কিছু ঘটলে, তা শুধু তার জন্য নয়, বরং পুরো ভেনাসের জন্য একটি বিপর্যয় ডেকে আনবে।”আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন,” সে ভাবতে লাগলো,”প্রেমের এই অন্ধকার দিকে যাওয়ার পথটি ঠেকানো সম্ভব নয়।”
সে পা চালিয়ে যাচ্ছিল,কিন্তু মনে একটাই চিন্তা—জ্যাসপারের আবেগ আর তার কার্যকলাপ ভেনাসের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে কি না।
অ্যালিসা আজ বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বায়না শুরু করেছে,কিন্তু জ্যাসপার কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না। বিকেলের দিকে ফিওনা সোফায় বসে বই পড়ছিল,তখনই এথিরিয়ন সেখানে হাজির হয়।সিলভা বারবার এথিরিয়নকে বিরক্ত করছে বাইরে যাওয়ার জন্য,আর এথিরিয়ন সুযোগ বুঝে ফিওনার পাশে সোফায় বসলো।
“বলছিলাম,ফিওনা,চলো বাইরে ঘুরতে যাই,সবাই মিলে।নাহলে ওই সিলভা’র সাথে আমি একা একা যাবো না,অস্বস্তিকর লাগে,”এথিরিয়ন বলল।
ফিওনা তখন হেসে দিলো।”বাহ,তুমি তো ওকে বেশ ভয় পাচ্ছ,মেয়েটা তো সুন্দর।ভয় কেনো পাও?”
এথিরিয়ন মুচকি হাসলো, “আরেহ,সুন্দর হলেই হবে? চিপকাচিপকি ভালো লাগে না আমার একদমই।”
ফিওনা একটু ঠাট্টা করেই বলল,”এখন তুমি কি চাইছো রিয়ন?”
এথিরিয়ন আগ্রহের সাথে বললো, “চলো,সবাই মিলে যাই আর আর বাইরে গিয়ে তুমি আমার সাথে সাথে থাকবে।”
ফিওনা একটু ভাবলো,তারপর বললো,”আচ্ছা,ঠিক আছে, থাকবো।”
এথিরিয়নের মুখে খুশির এক ঝলক দেখা গেল। তারা দুজনেই জানতো,কিছু সময় বাইরে কাটানো তাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হবে,বিশেষ করে যখন চারপাশে এত সুন্দর প্রকৃতি ও স্নিগ্ধ পরিবেশ রয়েছে।
তারা সোফা থেকে উঠলো এবং প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। ফিওনার মনে কিছুটা উত্তেজনা ছিল,কারণ সে জানতো, বাইরে বের হলে হয়তো কিছু নতুন ও মজার অভিজ্ঞতা হবে।
এদিকে, জ্যাসপার ভাবলো, আপাতত অ্যালিসাকে খুশি লাগলেই তাড়াতাড়ি এখানে থেকে বিদায় করা যাবে। তাই সে রাজি হলো, আজকে সবাই মিলে পাহাড়ে ঘুরতে যাবে। বাইরের আবহাওয়া পাল্টে গেছে, শীত প্রবাহ শুরু হয়েছে।
ফিওনা তৎক্ষণাৎ তার গরম পোশাক পরে নিল। সে একটি ফুল সাঁতার সোয়েটার আর জিন্স পরলো,যা তার উজ্জ্বল রূপকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।বাকিরাও নিজেদের সাজিয়ে নিল।সিলভা গাউন পরলো,সঙ্গে একদম ফ্যাশনেবল একটি জ্যাকেট যুক্ত হলো।অ্যালিসা গাউন পরিধান করে তার গায়ে একটি আধুনিক জ্যাকেট পরে নিল, যা তার রুচিশীলতার প্রতীক।
জ্যাসপারও প্রস্তুত হচ্ছিল।তার গায়ের পোশাক একদম আলাদা,একটি ওভারকোট পরেছে,যা সম্পূর্ণ কালো। ওভারকোটে ড্রাগনের জাতীয় চিত্র আঁকা রয়েছে,যা তার ড্রাগন পরিচয়ের সাথে মিল রেখে আরো গাঢ় একটি রূপ দেয়।কোঠায় দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাসপারের দৃঢ়তার সাথে তার আভিজাত্য ফুটে উঠছে।
শীতল বাতাসে সবাই যখন বাইরে বের হতে প্রস্তুত,তখন ফিওনা এবং অন্যরা বাইরে আসার জন্য মুখিয়ে আছে। জ্যাসপার কিছুটা উদ্বিগ্ন,কিন্তু সে জানে,অ্যালিসাকে খুশি করতে পারলে শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজ থেকে বেরিয়ে তারা পাহাড়ের বাগানের দিকে যাত্রা শুরু করলো,চারপাশে সাদা তুষারের চাদর,চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও কনকনে ঠান্ডা বাতাস তাদের সামনে হাজির হলো।ফিওনা প্রথমবারের মতো এমন পরিবেশে প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেল,তার হৃদয়ে নতুন অভিজ্ঞতার জন্য উত্তেজনা।
বাহিরে আজকের বাগানটি তুষারের আবরণে ঢাকা,প্রতিটি ফুল যেন মাথা নিচু করে নুয়ে পড়েছে।তাদের রঙিন পাপড়িগুলো তুষারের ভারে আরোপিত হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে,কিন্তু তবুও তাদের সৌন্দর্য ম্লান হয়নি।চারপাশে কেবল তুষারের বিস্তৃত সাদা চাদর,যা সমস্ত দৃশ্যকে এক ভিন্ন আবহে রূপান্তরিত করেছে।
গ্লাস হাউজের ভেতরে,পরিবেশের শান্তির পাশাপাশি তাপমাত্রা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক।হাউজের কাচের দেয়ালগুলি সূর্যের আলোকে প্রবাহিত করে,ফলে সেখানে এক উষ্ণতা বিরাজমান।ফিওনা সেখানে বসে তুষারপাতের দৃশ্য উপভোগ করতে পারে,কিন্তু বাইরে শীতল বাতাসের শিহরণ তাকে কিছুটা সংবেদনশীল করে তুলছে।
ভেতরের উষ্ণতায় সে অনুভব করছে একটি নিরাপত্তার আবরণ,যেখানে বাইরে শীতের তীব্রতা রুক্ষ।বাইরের পৃথিবী তুষারের সাদা রূপে ঢাকা,যেন একটি বরফের রাজ্যে পরিণত হয়েছে,কিন্তু গ্লাস হাউজের ভেতরে তার সবকিছু ঠিক আছে।
এমন দৃশ্য দেখে ফিওনার মনে হলো,এই শীতে প্রকৃতি তার রহস্যময় রূপে মগ্ন হয়ে আছে,এবং সে নিজেকে এখানে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ মনে করছে।
ফিওনা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে,যেন সে এক দর্শক।তার চোখে পড়ে অ্যালিসা এবং জ্যাসপার।অ্যালিসা জ্যাসপারের কনুই ধরে রেখেছে,হাসতে হাসতে কিছু বলছে,আর জ্যাসপার কেমন শান্ত হয়ে সব শুনছে।আজকের গম্ভীরতা তার মুখে নেই,যেন কোনো অজানা সুখে মগ্ন।
এই দৃশ্য দেখে ফিওনার অন্তরটা পুড়তে শুরু করে।হঠাৎ করে কেনো যেনো তার খুব কষ্ট হচ্ছে।সে নিজেকে সামলাতে চায়,কিন্তু মনে হচ্ছে সমস্ত অনুভূতি একসাথে ভেঙে পড়ছে। অ্যালিসার হাসি এবং জ্যাসপারের সহানুভূতি তাকে আরও বেশি বিচলিত করছে।
সিলভা এথিরিয়নের হাত শক্ত করে ধরেছে,যেন সে তাকে ছাড়া যেতে দিতে চাইছে না।এথিরিয়ন,সিলভার ওই দৃঢ়তা থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করলেও,কোনোভাবে সেখান থেকে বের হতে পারছে না।
এদিকে,থারিনিয়াস এবং আলবিরা,অ্যাকুয়ারা,পাহাড়ের বাগান নিয়ে আলোচনা করছে।তাদের কথোপকথনে ফিওনার মনোযোগ নেই।সে যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা, যেখানে সে আরেকজনের আনন্দে যোগ দিতে পারছে না।
ফিওনার হৃদয়ে এক অসহায়ত্ব,এক দুর্বিষহ অনুভূতি বয়ে চলেছে।সে বুঝতে পারে,এই মুহূর্তে সে একাকীত্বের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে,যদিও চারপাশে সবার হাসি আর আনন্দের আওয়াজ।
ফিওনা পাতলা সোয়েটারে দাঁড়িয়ে থাকায় শীত থেকে সুরক্ষা পাচ্ছিল না। তার হাতগুলো আড়াআড়ি ধরে রেখেছিল,যেন শীতের প্রবাহ থেকে বাঁচতে পারে। হঠাৎ,পিছন থেকে একজন এসে তার গায়ে একটি ওভারকোট জড়িয়ে দিল। এই স্পর্শে ফিওনার ঠোঁটে একটি হাসি ফুটে উঠলো।সে জানে,যত্নশীল একমাত্র জ্যাসপারই তাকে এইভাবে ওভারকোট পরিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু মুহূর্তেই ফিওনার মনে হলো,এই ওভারকোটের সুগন্ধটা অন্য কারো।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সে দেখল,একজোড়া আকাশি রঙের নেত্রপল্লবের অধিকারী এথিরিয়ন তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে।ফিওনার মনে একটি অস্বস্তি জন্ম নিল। এথিরিয়নের আন্তরিকতা তাকে বিব্রত করেছিল,কারণ সে জানে এই মুহূর্তে জ্যাসপারও কাছে আছে।
দূর থেকে সিলভা তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল,তার চোখে রাগের ঝিলিক।সে বুঝতে পারছিল না কেন এথিরিয়ন এত সাহস দেখাচ্ছে।কিন্তু ফিওনার মনে যে কষ্টের আগুন জ্বলছিল,সেটা চেপে রাখতে পারছিল না। এথিরিয়ন তার কাছে আরও কাছে আসতে চেয়েছিল,আর তার এই স্নেহের প্রকাশ ফিওনার মনে দোলন সৃষ্টি করেছিল।
“ধন্যবাদ,” ফিওনা সঙ্কুচিত গলায় বলল,এথিরিয়নের দিকে তাকিয়ে।
“তুমি তো ঠাণ্ডায় কাঁপছ,তাই না?” এথিরিয়ন বলল,তার হাসিতে মিষ্টতা ছিল।
ফিওনা অনুভব করল,এথিরিয়নের সামনে তার হাসি আর কম্পন যেন একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে।সে ভিতরে ভিতরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,“এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব,নাকি এর চেয়ে কিছু বেশি?”
একদিকে তার প্রিয় জ্যাসপার,আর অন্যদিকে এথিরিয়নের মৃদু হাসি,ফিওনার মনে এক দ্বিধা তৈরি করল।সে জানত, সম্পর্কের এই জটিলতা তাকে আরও গভীর সমস্যায় ফেলতে পারে।কিন্তু কিছুতেই সে নিজেকে এই ভাবনাগুলো থেকে বের করতে পারছিল না।
একটি মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু থমকে গেল। হঠাৎ করে তুষারের ঝড় শুরু হলো, বেগে বাতাসে সাদা তুষার উড়ছিল, চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সবাই দ্রুত মাউন্টেন গ্লাস হাউজের দিকে দৌড়াতে লাগলো, যেন ঝড় থেকে বাঁচার শেষ চেষ্টা।
এথিরিয়ন ফিওনার হাত ধরে দৌড়াতে চাইল,কিন্তু সিলভা ঝড়ের গতি আর ভীতির আবহে দ্রুততার সাথে ফিওনার হাত থেকে এথিরিয়নের হাত ছড়িয়ে নিল।এথিরিয়ন অবাক হয়ে গেল,তার বুঝতে না পারার কারণে হাত ধরে থাকার অনুভূতি হারিয়ে গেল।ফিওনা কিছু বলতে চাইল,কিন্তু তখনই ঝড়ের প্রবল বেগে চারপাশে সবাই একত্রে দৌড়াচ্ছিল।
হঠাৎ, ফিওনার হাতে একটি শক্ত টান অনুভব হলো। সে বুঝতে পারল,কেউ তাকে হঠাৎ করে শক্ত করে টেনে নিচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, সে কেবল পেটের মধ্যে কারো এক জোড়া হাত অনুভব করলো যা ওর পেটে শক্ত করে ধরে করে আলগা করে নিলো।সেই অচিন অপরিচিত শক্তি তাকে অন্যপাশে তুলে নিল,যেন ঝড়ের চাপে তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
“কী হচ্ছে?” ফিওনা চিৎকার করে উঠলো,কিন্তু তার শব্দ বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল।
অবশেষে, ঝড়ের গর্জনের মধ্যে, ফিওনা দেখল যে সে জ্যাসপারের কাছে পৌঁছে গেছে। জ্যাসপারের চোখে একটি দৃষ্টির তীব্রতা ছিল—তার উদ্বেগ ও রাগের মিশ্রণ।
“তুমি ঠিক আছ?” জ্যাসপার জিজ্ঞেস করল, তার গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।
“হ্যাঁ,” ফিওনা দ্রুত উত্তর দিল, “কিন্তু…”
“তুমি এখানে থাকো,” সে জোর দিয়ে বলল,তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল যেন আর একবার তাকে হারাতে না পারে।ঝড়ের শব্দের মধ্যে,তাদের চারপাশে নীরবতার একটি অনুভূতি তৈরি হলো।
আচমকা জ্যাসপার ফিওনার গা থেকে এথিরিয়নের দেয়া ওভারকোট খুলে পাশে ছুড়ে মারলো।ফিওনা বিস্মিত হয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট নড়ছিল কিছু বলতে, কিন্তু জ্যাসপারের চোখের দৃষ্টির গম্ভীরতা তাকে থামিয়ে দিল।সেই চোখে যেন আগুন জ্বলছে, এক অদ্ভুত দাবি আর অধিকারবোধের সঙ্গে।
“এটা কি করলেন এভাবে জ্যাকেট ছুড়ে মারলেন কেনো,!”ফিওনা বলল,তার কণ্ঠে অসহায়তার ছাপ।
“কারন হচ্ছে ”জ্যাসপার কড়া গলায় বলল। “ওটাতে এথিরিয়নের স্পর্শ আর ঘ্রাণ লেগে আছে।আমি সহ্য করব না,হামিংবার্ড।তুমি আমার কাছাকাছি থাকবে,আর তোমার শরীরে অন্য কারও ঘ্রাণ থাকবে—এটা আমি কখনোই মেনে নেব না।”
ফিওনার মুখে বিস্ময়ের ছাপ আরও গভীর হলো। “আপনি এটা নিয়ে এতটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন কেন? এটা তো শুধু একটা জ্যাকেট…”
“তোমার কাছে হয়তো এটা কিছু না,”জ্যাসপার তাকে বাধা দিয়ে বলল। “কিন্তু আমার কাছে এটা অনেক বড় কিছু।তোমার শরীরে শুধু আমার ছোঁয়া থাকবে,আর কিছু নয়।”
এ কথা বলেই সে নিজের ওভারকোট শক্ত করে ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দিল,যেন তাকে নিজের কোনো এক বিশেষ চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করছে।
ফিওনার গাল লাল হয়ে উঠল,ঠান্ডা আর জ্যাসপারের স্পর্শ মিশে তার ভেতরে এক অজানা উষ্ণতার সৃষ্টি করল।সে কোনো কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না।
“এখন চুপ করে থাকো,” জ্যাসপার বলল,তার গলা একটু নরম হয়ে এসেছে।“তুমি আমার, হামিংবার্ড।শুধু আমার।এটা কখনো ভুলে যেও না।”
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তার হৃদয়ের ধুকপুকানি যেন ঝড়ের শব্দকে ছাড়িয়ে গেল। এই দাবির মধ্যে কোথাও যেন এক ধরনের মায়া আর সুরক্ষার আশ্বাস ছিল, যা তাকে না চাইলেও শিহরিত করল।
ফিওনা একটু রাগী সুরে বলল,”আর আপনাকে যে অ্যালিসা ছুঁয়েছে,তার বেলায়?”
জ্যাসপার হালকা হাসল, তারপর ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে ঝুঁকে এসে মৃদু কণ্ঠে বলল,”ওহ,তোমার জেলাসি হচ্ছে?”
ফিওনা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “তো হবেনা কেনো? আপনি করতে পারেন,আপনাকে সবাই ছুঁতে পারবে, আর আমার বেলায়…”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই জ্যাসপার তার মুখে আঙুল চেপে ধরল।ফিওনা থেমে গেল।তার সবুজ চোখগুলো একদম শান্ত,অথচ দৃঢ়।চারপাশে তুষারের ঝড় তখন থেমে গেছে।
ফিওনা তাকিয়ে আছে সেই সবুজ চোখের গভীরতায়। তার মনে হচ্ছে যেন জ্যাসপারের দৃষ্টি একসাথে তাকে আটকে রাখছে এবং অদ্ভুতভাবে সান্ত্বনাও দিচ্ছে। বাতাসে তখন শুধুই নীরবতা,যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে তাদের এই ক্ষণিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
ফিওনা জ্যাসপারের হাত সরিয়ে নিজের মুখটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল,কিন্তু তার শক্তির কাছে হার মেনে থেমে গেল।তার চোখে রাগ আর অপমানের মিশ্রণ ফুটে উঠল।“আপনার সবকিছু ঠিক,আর আমার প্রতিটা কাজ ভুল?এই কি আপনার নীতি?” ফিওনা বলে উঠল, কণ্ঠে অভিমান।
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসি ফুটল।
“নীতি নয়, হামিংবার্ড এটা আমার নিয়ম।আমি যা করি, তা আমি বুঝে করি।কিন্তু তোমার বিষয়ে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না।তুমি আমার কাছ থেকে দূরে যাও, আমি সহ্য করব।কিন্তু অন্য কেউ তোমার কাছে আসবে,সেটা আমি মেনে নিতে পারব না।”
ফিওনা এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল,“আপনার এই অধিকারবোধ আমাকে দমিয়ে রাখছে।আপনি কীভাবে ভাবেন যে আপনি আমার সব সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন?”
জ্যাসপার তার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এল,তার সবুজ চোখজোড়ায় গভীর এক ঝলক। “তোমার বিষয়ে আমার অধিকার জন্মায়নি, হামিংবার্ড।এটা আমি নিজের করে নিয়েছি।কারণ তুমি.. তুমি আমার,শুধু আমার।”
ফিওনা তার হৃদয়ের দ্রুত স্পন্দনকে সামলানোর চেষ্টা করল। তার কণ্ঠ নরম হয়ে গেল। “আপনার এই দাবি একদিন আপনাকেই সমস্যায় ফেলবে প্রিন্স।”
জ্যাসপার হেসে উঠল ফিওনার মুখে প্রথমবার তাকে কিছু একটা সম্বোধন করতে দেখে,সেই হাসিতে একধরনের আত্মবিশ্বাস আর রহস্য ছিল।“সমস্যা আমাকে ভয় পায়,হামিংবার্ড।তুমি শুধু আমার কথা মনে রেখো—এথিরিয়নের থেকে দূরে থাকবে।এটা আমার শেষ বার্তা।”
ততক্ষণে তুষারের ঝড় থেমে গেছে।চারপাশে কেবল সাদা বরফের আস্তরণ আর এক নিস্তব্ধ পরিবেশ। ফিওনা আর কিছু না বলে জ্যাসপারের চোখে তাকিয়ে থাকল।সেই চোখে এক অদ্ভুত মায়া,দাবি,আর এমন কিছু ছিল যা সে বুঝতে পারছিল না।
ফিওনা দ্রুত বুঝতে পারল, জ্যাসপারের শরীর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। জ্যাসপারের গায়ে এখন পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আর পাতলা ফিনফিনে সাদা শার্ট গায়ে জড়ানো, ওভারকোট খুলে ফিওনাকে জড়িয়ে দিয়েছে। ঠান্ডায় তার রক্তিম বেগুনি ঠোঁট আর পাতলা শার্টের নিচে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা শরীরটা যেন প্রতিটা মুহূর্তে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে।জ্যাসপারের এই অবস্থা দেখে ফিওনার অন্তরে অজানা এক যন্ত্রণা আর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল।
“আপনার তো ঠান্ডা লাগছে,কি দরকার ছিলো ওভারকোট ছুড়ে ফেলে দেয়া আর আমাকে আপনার ওভারকোট দিয়ে দিলেন?আপনি কি পাগল?” ফিওনা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধমকের সুরে বলল,চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
জ্যাসপার মৃদু হেসে বলল,”তুমি যদি উষ্ণ থাকো, আমার ঠান্ডা কোনো ব্যাপার না।আমি সহ্য করতে পারি।”
ফিওনা তার কথায় আরও বিরক্ত হয়ে বলল “সহ্য করতে পারছেন না,এটা আমি স্পষ্ট দেখছি।আপনার ঠোঁটের রং দেখেছেন ঠান্ডায় কালসিটে হয়ে গেছে?শরীর কাঁপছে ঠান্ডায়!এটা কোন ধরনের বোকামি, প্রিন্স?”
জ্যাসপার কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু ফিওনা থামিয়ে দিয়ে বলল, “একদম চুপ।আপনি যদি নিজেকে এভাবে ঝুঁকিতে ফেলেন,তাহলে আমি এই ওভারকোট নেব না।” ফিওনা ওভারকোট খুলে তার হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করল,কিন্তু জ্যাসপার শক্ত হাতে তা ফিরিয়ে দিল।
“হামিংবার্ড,আমি বলেছি,তুমি আমার কাছে সবকিছু। আমার জ্যাকেট থাকুক বা না থাকুক,তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু তোমার শরীর এই ঠান্ডা সহ্য করবে না। তাই এটা থাক।” জ্যাসপার আরও একবার ওভারকোটটা তার গায়ে টেনে দিল,যেন এটা তার শেষ কথা।
ফিওনা এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকল।তার ঠোঁট কেঁপে উঠল—রাগে অভিমানে,আর কোথাও যেন এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতায়।সে আর কিছু না বলে হঠাৎ করে তার ছোট্ট হাত দিয়ে জ্যাসপারের হাতটা ধরে টানল।
“আপনার একগুঁয়েমি আমি বুঝেছি।কিন্তু এখন আপনি আমার সাথে চলুন।আপনার এই অবস্থায় বাইরে থাকা উচিত না।”
তুষারের সাদা চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ণ পথে জ্যাসপার ফিওনাকে কোলে তুলে নিলো।চারপাশে ঠান্ডা হিমশীতল হাওয়া বয়ে চলেছে,কিন্তু জ্যাসপার যেন তার নিজের শরীরের সমস্ত শীতলতাকে উপেক্ষা করেই হাঁটা শুরু করল।ফিওনার পায়ে ঠান্ডা যাতে না লাগে,সেটাই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য।
ফিওনা বিস্ময়ে বলল,”আপনি কী করছেন?নামান আমায়!এমন কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে?আর আপনার তো ঠান্ডাও লাগছে” তার গলায় লজ্জা মেশানো উৎকণ্ঠা।
জ্যাসপার তার গম্ভীর দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে মৃদু স্বরে বলল,”লাগুক ঠান্ডা।”তার কণ্ঠে এমন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা,যেন এই কথার পরে কিছু বলারই আর জায়গা নেই।
ফিওনা জানে,জ্যাসপারকে কিছু বলা মানে বাতাসের বিপরীতে কথা বলা।তার মন যা চায়,সেটাই সে করবে। তাই আর কোনো প্রতিবাদ না করে ফিওনা একটু ভালো করে জ্যাসপারের ঘাড়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।যেন সে নিজেই জ্যাসপারের উষ্ণতার আশ্রয় হয়ে উঠতে চায়।
তুষারের প্রবল ঠান্ডায় তার পাতলা শার্টের নিচে শরীরটা যেন জমে যাচ্ছে,কিন্তু ফিওনার গায়ে যেন এক বিন্দু অসুবিধা না হয়,সেই চিন্তায় সে যেন নিজেকেই তুচ্ছ করে দিয়েছে।
একসময় ফিওনা আর কিছু না বলে জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে ধরে জ্যাসপারের ঘাড়ের কাছে মুখ গুজে রাখলো।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস হালকা স্পর্শ করল জ্যাসপারের ঘাড়ের ট্যাটুটির উপর।সেই স্পর্শে জ্যাসপার হঠাৎই যেন সমস্ত শীতলতার পর্দা সরিয়ে ফেলল।ফিওনার স্পর্শ তার রক্তে এমন এক অদ্ভুত উষ্ণতা জাগিয়ে দিল,যা তাকে শক্তি জুগিয়েছিল, সমস্ত ঠান্ডা নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো।
আযদাহা পর্ব ৩৮
তার পায়ের নিচে তুষার ক্রমাগত চাপা পড়ছে,কিন্তু তার দৃঢ় পায়ের গতি থামছে না।ফিওনার নীরব উপস্থিতি আর জ্যাসপারের অটুট সুরক্ষা,দুজনের মাঝে এই মুহূর্তে যেন তুষারাবৃত প্রকৃতি মিশে এক অনন্য রোমান্স তৈরি করল।