আযদাহা পর্ব ৪৭ (৩)

আযদাহা পর্ব ৪৭ (৩)
সাবিলা সাবি

ভেনাসের এল্ড্র রাজ্যে এক মহাকালান্তক দিন। দেবতা আভ্রাহার তার রহস্যময় বই থেকে এমন এক কাহিনী উন্মোচন করলেন,যা শুনে রাজা ড্রাকোনিস হতবাক হয়ে গেলেন।এই কাহিনী শুধু একটি প্রাচীন প্রেমের গল্প নয়,এটি ভেনাসের ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়,যেখানে ভালোবাসা,বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মত্যাগ একসূত্রে গাঁথা।

প্রায় একশত বছর পুর্বে ফ্লোরাক্সিয়া রাজ্য একসময় ভেনাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী রাজ্যগুলোর একটি ছিল।সেই রাজ্যের সেনাপতি ছিল সবুজ ড্রাগন জাইরন ড্রাকভাল,যার সাহস,শক্তি, আর বুদ্ধিমত্তা ফ্লোরাক্সিয়াকে বারবার শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
ফ্লোরাক্সিয়ার রাজকুমারী,বাদামী ড্রাগন কায়রা ফ্লোরিস,ছিলেন রাজ্যের সৌন্দর্য আর মেধার প্রতীক।তার কোমল হৃদয় আর দুর্নিবার আকর্ষণ জাইরনের প্রতি গভীর ভালোবাসা তৈরি করে।জাইরন কায়রাকে আদর করে ডাকতো “এলিজিয়া”,যা তার কাছে ভালোবাসা প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাদের প্রেমের কথা জানার পর,ফ্লোরাক্সিয়ার রাজা থাল্ডান ফ্লোরিস,কায়রার বাবা,প্রথমে এই সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকার করেন।রাজকুমারীর ভবিষ্যৎ তিনি অন্যভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন।কিন্তু কায়রার অটল ভালোবাসা আর জাইরনের প্রতি তার আত্মনিবেদন দেখে থাল্ডান একসময় এই সম্পর্কের প্রতি নমনীয় হন।
তবে কায়রার ভাই আরডান ফ্লোরিস এই সম্পর্ক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।কারন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু,কালো ড্রাগন যে কিনা পাশের রাজ্যের রাজকুমার থেরন সোলারিয়াস,কায়রাকে ভালোবাসতো আর তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিল।
কায়রার বাবার সম্মতি একপাশে থাকলেও,আরডান আর থেরন মিলে এক চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র তৈরি করে জাইরনকে হ*ত্যা করার জন্য।

কায়রা যখন জানতে পারে তার ভাই আর থেরনের এই ষড়যন্ত্রের কথা,তখন সে চুপ থাকতে পারে না।নিজের ভালোবাসাকে রক্ষা করার জন্য সে জাইরনকে সতর্ক করে।কিন্তু জাইরন ভালোবাসার প্রতি তার দায়িত্ববোধের কারণে কায়রাকে রাজ্য ছেড়ে পালাতে বাধ্য করতে চায়নি।
একদিন,কায়রা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাইরনের পাশে দাঁড়ায়,যখন আরডান আর থেরনের বাহিনী তাদের আক্রমণ করে।এক ভয়ানক যুদ্ধে জাইরন একা পুরো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে,কায়রাকে রক্ষা করার জন্য।
কিন্তু কায়রা যখন তার ভাইয়ের বন্ধু থেরনের তরবারির আঘাত থেকে জাইরনকে বাঁচাতে যায়,তখন সে নিজেই প্রা*ণ হারায়। কায়রার মৃ*ত্যুতে জাইরনের হৃদয় ভেঙে যায়।
কায়রার মৃ*ত্যু দেখে জাইরন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।তার শক্তি এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে সে রাজকুমার থেরনকে হ*ত্যা করে আর তার পরে আরডানের জীবন শেষ করে।

কিন্তু কায়রার মৃ*ত্যুতে জাইরনের জীবন শূন্য হয়ে যায়।তার কাছে এই মহাবিশ্বের আর কিছুই অর্থপূর্ণ মনে হয়নি।সে নিজেকে ধ্বং*স করার সিদ্ধান্ত নেয়,কারণ কায়রা ছাড়া তার অস্তিত্ব মূল্যহীন।
ফ্লোরাক্সিয়ার ইতিহাসে কায়রা এবং জাইরনের এই আত্মত্যাগের গল্প লেখা হয়।তাদের ভালোবাসা ভেনাসের মহাকাব্যের অংশ হয়ে ওঠে।দেবতা আভ্রাহার সেই সময় এই বইয়ে উল্লেখ করেন,“এই দুই আ*ত্মা একদিন আবার জন্ম নেবে।তবে তারা ড্রাগন রূপে জন্মাবে কি না,তা বলা সম্ভব নয়।তাদের ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা সময় আর জন্মের বাধা পেরিয়ে চিরন্তন হয়ে থাকবে।”
এই কাহিনী শুনে রাজা ড্রাকোনিস স্তব্ধ হয়ে যান।তিনি আভ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলেন,“তাহলে কি আমরা তাদের নতুন জন্মের সাক্ষী হতে চলেছি?”

আভ্রাহা মৃদু হাসেন এবং বলেন,”রাজা ড্রাকোনিস,প্রকৃতি এবং মহাকালের নিয়ম বড়ই রহস্যময়।যা ঘটেছে,তা আবার ঘটবে।তাদের প্রেম এই ব্রহ্মাণ্ডের শক্তি দিয়ে বাঁচবে,এবং তারা ফিরে এসেছে।
ড্রাকোনিস গভীর চিন্তায় ডুবে যান।তিনি বুঝতে পারেন, এই কাহিনী শুধু অতীতের নয়;এটি ভবিষ্যতের একটি বার্তা।ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে।
ড্রাকোনিসের সভা তখন গভীর স্তব্ধতায় ভরে উঠেছিল। দেবতা আভ্রাহার কণ্ঠে এক অপার গম্ভীরতা,তিনি বললেন,” আজকে তোমার সাথে এই বিশেষ কারনেই আমি দেখা করতে এসেছি,আজকে এমন কিছু বলবো যা তোমাকে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।জাইরন আবার জন্ম নিয়েছে।সে আর কেউ নয়,সে তোমার পুত্র,জ্যাসপার।তবে এখনো কায়রার জন্মস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।কারন তখন ভবিতব্য লেখা ছিলো জাইরন ড্রাগন রুপেই জন্মাবে তবে কায়রা কোন রুপে জন্মাবে তা নিশ্চিত করা হয়নি।কায়রা যে রূপেই জন্মাক,একদিন সে ড্রাগনে রূপান্তরিত হবে।সেই সময় জাইরন এবং কায়রার মিলন সম্পূর্ণ হবে,এবং তাদের বিয়ে হবে।তবে তার আগে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার ঘটতে পারে।কারন থেরন ও জন্মগ্রহণ করবে তবে সে কোন রুপে আর কোথায় জন্মাবে তা নিশ্চিত না এই মুহূর্তে আমি।এই কারণেই ভেনাস প্রিন্স জ্যাসপারের জীবনে এখন বিপদের ছায়া নেমে এসেছে।”

ড্রাকোনিস হতবাক হয়ে দেবতার দিকে তাকালেন।কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না।তার মস্তিষ্কে যেন হাজারো চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।অবশেষে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,”তাহলে ফিওনা…সে কি কায়রা?”
দেবতা মাথা হেলিয়ে বললেন,”এখনও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।তবে সমস্ত চিহ্ন এবং সময়ের স্রোত ইঙ্গিত দিচ্ছে,ওই মানবী কন্যাই কায়রার পূর্ণজন্ম হতেও পারে।”
ড্রাকোনিসের মন ফিরে গেল শতাব্দী প্রাচীন সেই সময়ে,যেখানে জাইরন এবং কায়রার প্রেমের কাহিনী এক র*ক্তাক্ত অধ্যায়ে শেষ হয়েছিল।নিজের সন্তান জ্যাসপারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার মন ভয়ে শিউরে উঠলো।সে জানতো,ফিওনার সাথে জ্যাসপারের সম্পর্ক সহজ হবে না।তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে,কিন্তু তাদের মিলন যেন এক অভি*শপ্ত ভবিষ্যতের সেতু হয়ে উঠছে।

ড্রাকোনিস বললেন,”তাহলে,যদি ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়,আমার ছেলে কি একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?”
দেবতা আভ্রাহার শান্তভাবে উত্তর দিলেন,”তাদের ভালোবাসা ব্রহ্মাণ্ডের শৃঙ্খলকে অতিক্রম করেছে।তাদের প্রেম এক অভি*শাপের মতো,যা বারবার ফিরে আসে,আবার আলোর মতো সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।কিন্তু মনে রেখো,তারা কেবল তখনই সত্যিকার অর্থে একত্রিত হবে,যখন তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং পূর্বের ভুলগুলিকে অতিক্রম করতে পারবে।”
ড্রাকোনিস বুঝতে পারলেন,জ্যাসপারের জন্য একটি বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।তবে ফিওনাই যদি কায়রার পূর্ণজন্ম হয়,তবে তাদের মিলন কেবল তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নয়,পুরো ভেনাসের ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে।তিনি দেবতার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আমার ছেলেকে রক্ষা করার উপায় কী,দেবতা?আমি কি এই ইতিহাসকে আরেকবার র*ক্তাক্ত হতে দেবো?”

দেবতা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”তাদের ভালোবাসাকে রক্ষা করতে চাইলে তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে।তবে মনে রেখো,অতীতের ঘটনাগুলো কেবল সতর্কতার বার্তা।ভবিষ্যত তাদের উপর নির্ভর করছে।ফিওনাকে চিনতে দাও তার প্রকৃত পরিচয়,এবং জ্যাসপারকে নিজের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করো।শুধু ভালোবাসা নয়,তাদের শত্রুদের চক্রান্তও তাদের থামাতে চাইবে।”
ড্রাকোনিস প্রতিজ্ঞা করলেন,তিনি তার ছেলেকে রক্ষা করবেন এবং এই অ*ভিশপ্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাবেন। তবে তার মন একটাই প্রশ্নে ভারাক্রান্ত রইল—কায়রা যদি সত্যিই ফিওনার রূপে ফিরে এসে থাকে,তবে কীভাবে তার জীবনের গল্প নতুন মোড় নেবে?

ড্রাকোনিসের মনে গভীর উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে আসলো।দেবতার কথাগুলো তার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছিল,কিন্তু তিনি জানতেন,দেবতা আভ্রাহার ভবিষ্যদ্বাণী কখনো মিথ্যা হয় না।ড্রাকোনিস জিজ্ঞাসা করলেন,”তাহলে আমাকে কী করতে হবে?আমার ছেলেকে কীভাবে এই অ*ভিশপ্ত ভালোবাসা থেকে দূরে রাখবো?”
দেবতা আভ্রাহা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,”তোমার ছেলেকে ফিওনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে,তবে এমনভাবে যাতে সে নিজেই বুঝতে পারে যে এই সম্পর্ক তার জন্য ক্ষতিকর। সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে সে তোমার শত্রু হয়ে উঠতে পারে। তাই তোমাকে এমন পরিকল্পনা করতে হবে যা তাকে ফিওনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করবে।”
ডেবতা ড্রাকোনিসকে একটি গোপন পরিকল্পনার কথা জানালেন,যা তাদের দুজনেরই হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল।তিনি বললেন “জ্যাসপারকে পৃথিবীতে পাঠানো তোমার ভুল ছিল না,কিন্তু এখন তার নিরাপত্তা ভেনাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানবীর সাথে তার সম্পর্ক যদি আরও গভীর হয়,তাহলে তা শুধু ভেনাসের রাজ্য নয়,তার নিজের জীবনকেও ধ্বং*স করবে।মানব মেয়ে কখনো ড্রাগনের সন্তান ধারণ করতে পারবে না।এটা করলে শুধুই মৃ*ত্যু আসবে,তার জন্য এবং মানবীর জন্যও।এই ভবিষ্যৎ এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো তাদের আলাদা করা।”

ড্রাকোনিসের কণ্ঠ কাঁপলো, “কিন্তু কায়রা যদি সত্যিই তার পূর্ণজন্মে ফিরে আসে এবং ফিওনার রূপে উপস্থিত হয়, তাহলে তাদের ভাগ্য কি আগে থেকেই নির্ধারিত নয়?দেবতা, আমাকে দয়া করে বলুন,আমি কীভাবে আমার ছেলের হৃদয়কে ভেঙে দিয়ে তাকে রক্ষা করবো?”
দেবতা আভ্রাহার শান্তভাবে বললেন, “তোমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে সে নিজেই ফিওনাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দাও,যেখানে সে বুঝবে এই সম্পর্ক শুধু তার নয়,তার প্রিয়জনদের জন্যও ধ্বং*সাত্মক।একবার সে নিজের ইচ্ছায় সম্পর্ক ভেঙে ফেললে,ভবিষ্যৎ আর অভি*শাপ এড়ানো সম্ভব হবে।”
ড্রাকোনিস ভারী হৃদয়ে দেবতার কথা মেনে নিলেন। তবে তিনি জানতেন এটি সহজ হবে না।তিনি নিজের ছেলেকে ভালোবাসেন,কিন্তু তিনি ভেনাসের রাজ্যের রক্ষকও।তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “আমি দেবতার নির্দেশ পালন করবো, কিন্তু এর জন্য আমাকে যা করতে হবে, তা আমার আত্মাকে চিরকাল পোড়াবে।আমার ছেলের হৃদয় ভেঙে দিতে হবে, আর আমাকে তার শ*ত্রুতে পরিণত হতে হবে।”

দেবতা হেসে বললেন,”তোমাকে শ*ত্রু হতে হবে না।তোমাকে শুধু এমন একটি পথ তৈরি করতে হবে,যেখানে জ্যাসপার নিজের বুদ্ধিতে বুঝতে পারবে,তার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত কী।তাকে ভেনাসে ফিরতে দাও আর আমাদের রাজ্যের ভবিষ্যৎ রক্ষা করো।”
ড্রাকোনিস স্থির মনোযোগ দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। তিনি ফিওনার এবং জ্যাসপারের সম্পর্ককে এমন এক দ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দেবেন,যেখানে তারা নিজেরাই একে অপরকে ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।তবে তার মন এই প্রশ্নে বিদ্ধ হতে লাগলো—”আমি কি এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সত্যিই ঠেকাতে পারবো?নাকি আমার পুত্র জ্যাসপার এবং তার ভালোবাসা ফিওনা,আগের জন্মের মতোই,অ*ভিশপ্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?”

মাউন্টেন গ্লাস হাউজের স্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামা ঝর্ণার স্নিগ্ধ শব্দ শোনা যাচ্ছিল।ফিওনা আর অ্যাকুয়ারা সোফায় বসে হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন ছিল।ফিওনার চুলে আলতো করে ব্রাশ চালাচ্ছিল অ্যাকুয়ারা,আর তাদের কথার মাঝেই উঠে আসছিল পৃথিবী আর ভেনাসের জীবনযাত্রার তুলনা।
“তুমি বলছিলে ভেনাসে এত উজ্জ্বল আলো থাকে যে রাতেও তারার আলো ম্লান মনে হয়?পৃথিবীতে কিন্তু রাতের আকাশ তারাময় হলে বেশ রোমাঞ্চকর লাগে,”ফিওনা বলল।
অ্যাকুয়ারা হেসে বলল,”তোমরা মানুষেরা কীভাবে এত সামান্য বিষয়েও এত আনন্দ পেতে পারো,ফিওনা!তারারা তো শুধু আকাশের আলো,আর কিছুই না।”
ফিওনা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,”এই জন্যই আমরা মানুষ আর তোমরা ড্রাগন।আমাদের অনুভূতিগুলো একটু বেশি সূক্ষ্ম।”

তাদের হাসি-আড্ডার মাঝেই দরজার বাইরে থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল।”আড্ডা জমে গেছে,মনে হচ্ছে। আমার জন্য কোনো জায়গা আছে?”
ফিওনা আর অ্যাকুয়ারা ঘুরে তাকিয়ে দেখে,এথিরিয়ন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার লম্বা,মজবুত গড়ন আর চওড়া হাসি তার ব্যক্তিত্বে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা যোগ করেছিল।
“রিয়ন!” ফিওনা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল।”তুমি তো মনে হচ্ছিল ভেনাসে আছ।এখানে কীভাবে?”
এথিরিয়ন ভেতরে ঢুকে বলল, “আমি জ্যাসু ভাইয়ের নির্দেশে এসেছি।তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে,তাকে মিস করছ না একটুও।”

অ্যাকুয়ারা কপট অভিমানী ভঙ্গিতে বলল,”তুমি তো সবসময় এমন,এথিরিয়ন।মজা নষ্ট করার জন্য হাজির হও।”
এথিরিয়ন হাসল।তার আকাশী রঙের চোখজোড়া আর শারীরিক গঠনের মধ্যে ছিল এক ধরনের অভিজাত্য,যা তাকে অন্য ড্রাগনদের থেকে আলাদা করত।
“তোমরা যা-ই বলো,আমি এখানে মজা করার জন্যই এসেছি।ওনা,পৃথিবীর খাবারের স্বাদ নিয়ে বলছিলে,তাই না? আমি ভেনাসের খাবারের চেয়ে ভালো কিছু আশা করিনি।”
ফিওনা হেসে বলল, “পৃথিবীর খাবার বেস্ট।কিন্তু একটা ব্যাপারে একমত হতে হবে—তুমি আর তোমার জ্যাসু ভাইয়া অনেক বেশি আদেশ দেওয়ার অভ্যাস করো।”
“জ্যাসু ভাইয়া কি এখানে নেই?” এথিরিয়ন জিজ্ঞাসা করল।
“না,” অ্যাকুয়ারা উত্তর দিল। “ওনারা তো আজ মিশনে গেছে।”
এথিরিয়ন বসে পড়ল এবং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “তাহলে চল,আমরা আড্ডা দিই।গল্প করি, হাসি,আর একটু সময় কাটাই।”
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের পরিবেশ আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ঝর্ণার শব্দ,পাহাড়ি বাতাস,আর তাদের কথার মিলনে মুহূর্তগুলো যেন সোনালী হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ বাদে অ্যাকুয়ারা উঠে চলে যায়।মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ভেতরে ফিওনা আর এথিরিয়নের হাসির শব্দ বাতাসে ভেসে আসছিল।তাদের আড্ডার বিষয়গুলো ছিল হালকা-ফুলকা,আর মাঝে মাঝেই ফিওনার মুখে হাসির ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল।

“তোমরা পৃথিবীর মানুষরা কীভাবে এত হাসিখুশি থাকতে পারো?”এথিরিয়ন মৃদু হেসে বলল।”তোমাদের জীবনটা আমার কাছে বেশ সহজ আর মজার মনে হয়।”
ফিওনা হেসে উত্তর দিল,”আসলে আমরা ছোট ছোট মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে জানি।হয়তো সেই কারণেই আমাদের জীবন এত আনন্দময় মনে হয়।”
এথিরিয়ন তার কথায় সায় দিল।তারা দুজনে গল্প করতে করতে সময়ের খেয়াল হারিয়ে ফেলেছিল।
হঠাৎ,এথিরিয়নের হাসি একটু গভীর হলো।সে একটু সামনে ঝুঁকে এসে বলল,”তুমি সত্যিই খুব সুন্দর আর ভিন্ন ধরনের মানুষ,ফিওনা।তোমার উপস্থিতি আর হাসির ধ্বনি আমার বুকের নিঃসঙ্গ পাহাড়ে এক ধরনের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসে।”

ফিওনা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,”তুমি বেশ ভালো কথা বলতে পারো রিয়ন।”
ঠিক তখনই,এথিরিয়ন হঠাৎ ঠাস করে ফিওনার গালে চুমু দিয়ে বসে।ফিওনা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল।তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল,আর সে ধীরে ধীরে গালে হাত রাখল।
“তুমি…তুমি এটা কী করলে?” ফিওনা ধরা গলায় বলল।
এথিরিয়ন হেসে বলল,”এমনি ভালো লাগলো তাই দিলাম!মানুষরা কি এটা নিয়ে এমন বড় ইস্যু করে?”
ঠিক তখনই,মাউন্টেন গ্লাস হাউজের দরজার কাছে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল।ফিওনা আর এথিরিয়নের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জ্যাসপার।তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল রাগে,আর তার চোখ যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো হয়ে উঠেছিল।
গ্লাস হাউজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে জ্যাসপার তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করল।তার গভীর,গম্ভীর গলায় কথা ভেসে এলো

“এথিরিয়ন”……
এথিরিয়ন মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল,তারপর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল,”কি হয়েছে জ্যাসু ভাইয়া?”
জ্যাসপার কয়েক পা সামনে এগিয়ে এলো।তার প্রতিটি পা ফ্লোরে ভারী শব্দ তুলছিল,যেন তার রাগের ওজন বহন করছে।
“তোর এই মজার ধরণ আমার একটুও পছন্দ নয়, এথিরিয়ন” জ্যাসপার ঠাণ্ডা গলায় বলল।তার চোখ ফিওনার গালে আটকে ছিল,যেখানে এথিরিয়নের চুমুর চিহ্ন যেন জ্বলজ্বল করছিল।
ফিওনা বিব্রত হয়ে দ্রুত গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। কিন্তু জ্যাসপার তখনও এথিরিয়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
“গ্লাস হাউজের বাইরে পাহাড়ের দিকে যা আমি আসছি তোর সাথে কথা আছে আমার,” জ্যাসপার চাপা গলায় বলল। “রাইট নাও,,,,এথিরিয়ন।”
এথিরিয়ন বুঝতে পারল যে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে।সে হাত উঁচিয়ে বলল,”ঠিক আছে,ঠিক আছে।আমি চললাম।এত রাগ করছো কেনো ব্রো।”

এথিরিয়ন বেরিয়ে যেতেই জ্যাসপার ফিওনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।তার চোখে এখনো রাগের শিখা জ্বলছিল।
“তুমি কীভাবে ওকে এতটা কাছাকাছি আসতে দিলে?” জ্যাসপার চাপা স্বরে বলল।
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল,কিন্তু তার মুখে মৃদু একধরনের অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছিল।
“আমি বুঝতে পারনি ও এমনটা করবে ,” ফিওনা ধীরে ধীরে বলল।”ও তো শুধু মজা করছিল…।
ফিওনা জিনিসটা স্বাভাবিক রাখতে চাইলো কারন জ্যাসপারের রাগ সম্পর্কে ওর ধারনা আছে।
“এটা শুধু মজা তাইনা?তাহলে আমি ওকে মজা কীভাবে নষ্ট করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেব,” জ্যাসপার রাগী গলায় বলল।
ফিওনা জ্যাসপারের মুখের দিকে তাকাল।তার চোখে এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিল,যা সে বুঝতে পারল না—রাগ, হতাশা,আর যেন একধরনের পীড়া।

“তুমি কি এথিরিয়নকে শা*স্তি দিবে?” ফিওনা জিজ্ঞাসা করল।তার কণ্ঠে বিস্ময় আর কিছুটা অপরাধবোধ মেশানো ছিল।
জ্যাসপার ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো।তার পায়ের ভারী শব্দ গ্লাস ফ্লোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
“তুমি কি বুঝতে পারছ,ফিওনা?” তার কণ্ঠ ছিল গভীর, যেন কোনো অগ্ন্যুৎপাতের আগের মুহূর্ত।
“কি বুঝবো?”ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বলল।”ও তো শুধু ফান করছিল।”
“আবার ও একই কথা?”জ্যাসপার হঠাৎ ফুসে উঠল।তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।”তুমি কি জানো,তার এই ‘মজা’কাকে আঘাত করেছে?আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাইছ?”
ফিওনা চুপ করে গেল।তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
“এথিরিয়ন জানেনা যে তুমি আমার…তুমি তো জানো?—”জ্যাসপারের কণ্ঠ থেমে গেল।সে তার মুষ্টি খুলল,যেন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“তুমি কী করতে চাও প্রিন্স ?” ফিওনা ভয়ের মিশ্রিত কণ্ঠে বলল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল।তার চোখ ফিওনার চোখে আটকে ছিল,আর সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা ফিওনার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিল।

“তুমি আমার,হামিংবার্ড,”জ্যাসপার ফিসফিস করে বলল। “তুমি কি সেটা ভুলে গেছ?”
ফিওনা পেছনে সরে যেতে চাইল,কিন্তু জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর তার অদ্ভুত উপস্থিতি তাকে আটকে রাখল।
“তুমি এথিরিয়নের জন্য চিন্তা করছ?নাকি নিজের জন্য?”জ্যাসপার তার হাত বাড়িয়ে ফিওনার গালে স্পর্শ করল।তার স্পর্শে যেন আগুনের তাপ ছিল।
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না ?”জ্যাসপার ধীরে ধীরে বলল।তার কণ্ঠে গভীরতা ছিল,যা ফিওনার মনকে এলোমেলো করে দিল।ফিওনা জানে জ্যাসপারকে বিশ্বাস করা গেলেও ওর রাগকে বিশ্বাস করা যায়না।
“বিশ্বাস করি তো,”ফিওনা ফিসফিস করে বলল।

আযদাহা পর্ব ৪৭ (২)

জ্যাসপার তার কাছ থেকে চোখ সরাল না।
“তাহলে শেষবারের মতো জেনে নাও।এই মহাবিশ্বে,এই পৃথিবীতে,এই মাউন্টেন গ্লাস হাউজে,তুমি শুধু আমার আর তোমাকে ছোঁয়ার অনুমতি আর কারো নেই আমি ছাড়া।”

আযদাহা পর্ব ৪৮