আযদাহা পর্ব ৫০
সাবিলা সাবি
ভেনাস জুড়ে আজ এক মহা উৎসব।এল্ড্র রাজ্যের আকাশে রঙিন আলোয় সাজানো বিশাল আয়োজন।উজ্জ্বল নীল,সোনালি,আর রক্তিম আলোর ঝলকানিতে চারিদিক যেন এক স্বপ্নের জগতে রূপান্তরিত হয়েছে।ড্রাগনরূপী আতশবাজি আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে,তাদের ডানা মেলে প্রদর্শন করছে ভেনাসীয় ঐতিহ্যের মহিমা।প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার ড্রাগন প্রজা জ্যাসপারের নামে স্লোগান দিচ্ছে।তার প্রশংসা,তার গৌরব আর তার শৌর্যের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি কোণে।
প্রাসাদের সিংহাসন কক্ষকে সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। সোনালি আর রক্তিম মণির খচিত ঝাড়বাতি থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে বিশাল হলের দেয়ালে।মাঝখানে বিশাল এক সিংহাসন,যা সাদা ক্রিস্টাল আর গাঢ় নীল ড্রাগনশিল্পে খোদাই করা।সিংহাসনের দু’পাশে ড্রাগনের ডানা প্রসারিত মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে,যেন জ্যাসপারের প্রহরী।সিংহাসনের উপরে এল্ড্র রাজ্যের প্রতীক—এক সোনালি ড্রাগন মুকুট মাথায়।
জ্যাসপার বসে আছে সিংহাসনে।তার চেহারায় বিজয়ের গর্ব আর কিছুটা ক্লান্তি।তার পরনে ড্রাগনের প্রতিচ্ছবিযুক্ত গভীর নীল আর কালো রঙের ব্লেজার সুট,যা তার শক্তি আর মর্যাদার প্রতীক।সুটের উপরে খচিত সোনালি ড্রাগনের প্রতীক যেন তার রক্তের শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে লাল আর সোনালি রঙের একটি ভারি কেপ ঝুলছে,যা তার রাজকুমারের মতো ভাবমূর্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার গলায় রয়েছে সোনার তৈরি চেন,যার মধ্যে রয়েছে এল্ড্র রাজ্যের প্রতীক।তার চুল নিখুঁতভাবে ব্রাশ করা,চোখে কঠোর অথচ গভীর এক দৃষ্টি।হাতে তার প্রিয় ড্রাগনচর্ম খচিত আংটি,যা তার আভিজাত্য এবং শাসকের ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়।তার গলার ট্যাটু আর কানের দুলটা জলজল করছে।
রাজ্যের প্রাসাদের বাইরে বিশাল উত্সব চলছে।মেঘের উপর তৈরি আলোকিত পথ ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ড্রাগন আকৃতির আকাশযান। মাটিতে প্রজারা সুরে সুরে গাইছে জ্যাসপারের জয়গান। ড্রাগনের ডানার মতো করে তৈরি করা মঞ্চে নাচছে ড্রাগন নর্তকীরা,তাদের হাতে আলো ঝলমলে ফ্লেম ল্যান্স।
জ্যাসপার সিংহাসনে বসে সবার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার মনে পৃথিবীর কথা,তার হামিংবার্ডের কথা।কিন্তু বাইরের এই উল্লাসে,ভেনাসের প্রতি তার দায়িত্ব তাকে ভুলতে দিচ্ছে না নিজের অবস্থান।
তবে তার চোখের কোণে এক মুহূর্তের জন্য যেন একটা ঝিলিক দেখা গেলো।হয়তো ফিওনার কথা ভেবে,হয়তো নিজের আসন্ন ভবিষ্যতের অজানা যু*দ্ধের কথা ভেবে। তবে এই মুহূর্তে, পুরো ভেনাস জুরে একটাই সুর—“জ্যাসপার,এল্ড্র রাজ্যে আর পুরো ভেনাসের গৌরবময় রাজপুত্র।”
জ্যাসপারের ডান পাশে একটি আর বাম পাশে আরো একটি সিংহাসন,একে অপরের পাশে সমান দূরত্বে স্থাপিত। প্রতিটির নির্মাণেই ফ্যান্টাসির অনন্য শিল্পকর্ম।মাঝখানের সিংহাসনটি সবসময় জ্যাসপারের জন্য নির্ধারিত,যা তার রাজপুত্রের মর্যাদা এবং ক্ষমতার প্রতীক।
সিংহাসনের পাশে ছোট ছোট ড্রাগনের খোদাই করা লতাপাতার মতো কারুকাজ, যা জ্যাসপারের শক্তি আর শৃঙ্খলার প্রতীক। তার ঠিক পাশে, বামে এবং ডানে বসেছে ড্রাকোনিস এবং এথিরিয়ন।
ড্রাকোনিসের সিংহাসনটি গভীর সবুজ এবং কালো রঙে খচিত, যা তার অভিজ্ঞতা ও রাজ্যের জ্ঞানী অভিভাবকের ভূমিকার পরিচায়ক। এর নিচের অংশে ড্রাগনের আঁচড়ের মতো খোদাই করা লতাপাতা ও সোনালি মণির আলোকছটা যেন তার প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করছে। ড্রাকোনিস বসে আছে গাঢ় সবুজ পোশাকে,যা তার ব্যক্তিত্বের শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এথিরিয়নের সিংহাসনটি সাদা আর রূপালি রঙে খচিত, তার উদ্যমী এবং যুবাকালের প্রতীক। এর পেছনে ড্রাগনের ডানা মেলে ধরা অবস্থায় খোদাই করা হয়েছে,যেন সে ভবিষ্যৎকে আকর্ষণ করছে।এথিরিয়ন পরেছে এক ঝলমলে রূপালি পোশাক,যা তার প্রাণশক্তি আর উজ্জ্বলতার প্রতিনিধিত্ব করে।
তিনটি সিংহাসন কক্ষের মাঝখানে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে,যেন তারা একসঙ্গে রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তবে জ্যাসপারের মাঝখানের সিংহাসনটি সবসময় তাকে কেন্দ্র করে তৈরি, তর সিদ্ধান্ত,তার শাসনই এল্ড্র রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।
উৎসবের মুহূর্তে ড্রাকোনিস এবং এথিরিয়ন নিজেদের সিংহাসনে বসে সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে চারপাশের উল্লাস দেখছে।কিন্তু জ্যাসপারের চোখে দেখা যায় এক ধরণের শূন্যতা।সে মাঝে মাঝে পাশে বসা ড্রাকোনিস ও এথিরিয়নের দিকে তাকায়, যেন কিছু বলতে চায়।তবে তার ঠোঁট থমকে যায়,আর মন চলে যায় পৃথিবীর দিকে,ফিওনার চিন্তায়।
এত আলোকছটার মাঝেও, এত সাফল্যের ভিড়েও, জ্যাসপারের সিংহাসন যেন একাকিত্বের সুরে মগ্ন। তবে তার পাশের দুটি সিংহাসনে বসা ড্রাকোনিস ও এথিরিয়ন তার শক্তি আর রক্ষার আশ্বাস হয়ে আছে।
রাজ্যের সম্মানিত রাজারাও একত্রে বসেছেন বিশাল হলে, যার চারপাশে খোদাই করা ড্রাগনের প্রতিকৃতি যেন তাদের ঐতিহ্যের গর্ব বহন করছে।
জ্যাসপার তার সিংহাসনে বসে আছে,তার মুখ গম্ভীর,কিন্তু আত্মবিশ্বাসী।এথিরিয়ন তার ডান দিকে শান্তভাবে বসে আছে, চোখেমুখে লজ্জা এবং স্মৃতির ছাপ।ড্রাকোনিস বাঁ দিকে বসে প্রজাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তার শক্ত গলা পুরো হলে প্রতিধ্বনিত হলো:
“আমার প্রিয় প্রজা এবং সম্মানিত রাজারা,আজকের দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের,কারণ আমরা আমাদের আপনজন এথিরিয়নকে ফিরে পেয়েছি।কিন্তু তার এই বন্দিত্বের গল্পটি সহজ নয়।আমি আপনাদের সেই গল্প বলার জন্য প্রস্তুত।”পুরো হল নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
জ্যাসপার শুরু করলেন:
“পৃথিবীর মানুষের লোভ আর বিজ্ঞানীর নির্লজ্জ গবেষণার শিকার হয়েছিল এথিরিয়ন।
এথিরিয়নের পৃথিবীতে যাত্রা এবং বন্দিত্বের গল্প (ফ্ল্যাশব্যাক)
এথিরিয়ন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।প্রজাদের সামনে তার উপস্থিতি শক্তিশালী,কিন্তু চোখের গভীরে ক্লান্তি আর দুঃখের ছাপ স্পষ্ট।পুরো হল নিস্তব্ধ।সবাই তার কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায়।
“আমি কেন পৃথিবীতে গিয়েছিলাম?”এথিরিয়ন নিজের দিকে তাকিয়ে এক গভীর শ্বাস নিল।
“আমি গিয়েছিলাম একটি সংকেতের সন্ধানে।একটি প্রযুক্তিগত সংকেত,যা আমাদের এল্ড্র রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ব্লক করে রেখেছিল।আমার বিশ্বাস ছিল এটি এল্ড্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।কিন্তু সেটি ছিল একটি ফাঁদ।”
এথিরিয়ন আরও বলল,
“ওই সংকেতটি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের তৈরি করা একটি অত্যাধুনিক ডিভাইস থেকে আসছিল, যা ভেনাসের সিগন্যাল শনাক্ত করতে সক্ষম।ড্রাগনের শক্তির প্রতি মানুষের লোভ কখনোই নতুন কিছু নয়।ওয়াং লি এবং মিস্টার চেন শিং—পৃথিবীর সবচেয়ে চালাক বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবকরা সেই সংকেত পাঠিয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই—আমাদের ড্রাগনশক্তি দখল করা।”
এথিরিয়ন ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেল।
“আমি পৃথিবীতে পৌঁছানোর পরই বুঝতে পারি এই সংকেতটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।তারা এমন একটি অঞ্চল নির্বাচন করেছিল,যা ছিল প্রযুক্তি এবং অস্ত্র দিয়ে সুরক্ষিত।ওয়াং লি এবং চেন শিং মিলে এমন একটি ফাঁদ তৈরি করেছিল,যা ড্রাগনের শারীরিক শক্তিকে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস (EMP) ডিভাইস আমার চারপাশে সক্রিয় হয়ে যায়।”
সে থেমে গেলো। প্রজাদের চোখে বিস্ময়।
এথিরিয়ন ব্যাখ্যা করলেন,
“তাদের ডিভাইসে এমন একটি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা আমাদের ড্রাগনশক্তিকে দুর্বল করতে সক্ষম। আমার ডানাগুলো এক মুহূর্তে অবশ হয়ে গেল।আমি পড়ে গেলাম তাদের ল্যাবে।তারা আমাকে একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত টেস্ট চেম্বারে বন্দি করেছিল,যা তৈরি ছিল গ্রাভিটোনিয়াম ধাতু দিয়ে। এটি এমন একটি উপাদান,যা আমাদের ড্রাগনশক্তিকে সম্পূর্ণভাবে শোষণ করতে পারে।”
“ওয়াং লি আর চেন শিং চেয়েছিল আমাদের ডিএনএ এবং ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে। তারা আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেছিল।আমার শরীর থেকে সেলুলার নমুনা নিয়ে তারা মানুষের শরীরে আমাদের ক্ষমতা স্থানান্তর করার চেষ্টা করছিল। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল সুপারহিউম্যান তৈরি করা।কিন্তু আসলেই তাদের গোপন লক্ষ্য ছিল অন্য কিছু।”
এথিরিয়ন কঠিন কণ্ঠে বলল,
“ওয়াং লির আসল লক্ষ্য ছিল অমরত্ব।সে আমার ড্রাগন শক্তিকে ব্যবহার করে তার শরীরকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল,যা তাকে মৃত্যুহীন করে তুলবে। কিন্তু চেন শিং শুধু বিজ্ঞান এবং শক্তির প্রতি আগ্রহী ছিল।তার লোভ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।”
এথিরিয়ন থেমে গেল। তার চোখে লজ্জার ছাপ।
“আমি তখন এতটাই দুর্বল ছিলাম যে পালানোর কোনো উপায় ছিল না। তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমার সমস্ত ক্ষমতা শোষণ করছিল। কিন্তু ঠিক তখনই জ্যাসু ভাইয়া পৃথিবীতে এসে আমাকে মুক্ত করার জন্য তাদের ল্যাব ধ্বংস করেছিল।সে আমার শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল এবং আমাদের রাজ্যের জন্য আমাকে জীবিত ফিরিয়ে এনেছে।”
সারা হলে শূন্যতা। প্রত্যেকে শুনে স্তব্ধ। জ্যাসপার সিংহাসনে বসে এথিরিয়নের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর উঠে বলল,”এটি শুধু একটি গল্প নয়,এটি আমাদের জন্য সতর্কতা।পৃথিবীর মানুষের লোভ এবং তাদের প্রযুক্তি আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে।আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে এবং আমাদের রাজ্যকে আরও সুরক্ষিত করতে হবে।”
ড্রাকোনিস ধীর,গভীর কণ্ঠে বলল,
“তারা এথিরিয়নকে কোথায় বন্দি করেছিল,তা খুঁজে বের করতে আমাদের এক বছর লেগে গিয়েছিল।এর কারণ ছিল তাদের ব্যবহৃত একটি অত্যাধুনিক ডিভাইস,যা শুধু এথিরিয়নের উপস্থিতি গোপন করেই রাখেনি,বরং আমাদের প্রযুক্তিগত সিস্টেমেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল।”
ড্রাকোনিস কথা চালিয়ে গেল,
“তাদের ডিভাইসটি ছিল একটি ‘সিগন্যাল ডিসপারসাল ফিল্ড’।এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যে, এথিরিয়নের শরীর থেকে নির্গত কোনো শক্তি বা তরঙ্গ ভেনাসের যোগাযোগ সিস্টেম দ্বারা শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না।তারা এই ডিভাইসটি তার বন্দিশালার চারপাশে সক্রিয় করে রেখেছিল,যা আমাদের সমস্ত অনুসন্ধানকে ভুল পথে পরিচালিত করত।”
ড্রাকোনিস নিজের হাত মুঠো করে বলল,
“আমরা যখন একটি দুর্বল সংকেত শনাক্ত করলাম,তখন তা বিশ্লেষণ করতে এবং সঠিক লোকেশন চিহ্নিত করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল।কিন্তু তারা এতটাই চালাক ছিল যে, সিগন্যালটি প্রতি ৪৮ ঘণ্টা পরপর তার অবস্থান পরিবর্তন করত।এটি তাদের মূল চেম্বারের অবস্থান গোপন রাখার কৌশল ছিল।”
ড্রাকোনিস এবার কিছুটা গর্বের সঙ্গে বলল,
“তবে শেষ পর্যন্ত,আমাদের ভেনাসের বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তি এবং আমার পুত্র জ্যাসপারের ধৈর্য এই সমস্যার সমাধান করল।জ্যাসপার ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রোটোটাইপ ডিভাইস তৈরি করেছিল,যা সিগন্যাল ডিকোড করতে সক্ষম।সেই ডিভাইসটি আমাদের চূড়ান্ত লোকেশন খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল।
ড্রাকোনিস থেমে এথিরিয়নের দিকে তাকাল।
“জ্যাসপার যখন পৃথিবীতে পৌঁছেছিলো,তখনও দেরি হয়ে গিয়েছিল। ওরা ইতোমধ্যে এথিরিয়নের শক্তি চুরি করার বেশ কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিল।”
জ্যাসপার এবার হালকা হাসল।
“ওদের সিস্টেম ধ্বংস করতে আমাকেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।আমি পৃথিবীর বিদ্যমান প্রযুক্তি এবং ভেনাসিয়ান প্রযুক্তির মিশ্রণে তৈরি একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস ডিভাইস ব্যবহার করি,যা তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়।সেই ল্যাব পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে এবং এথরিয়নকে মুক্ত করতে পুরো এক রাত লেগেছিল।”
প্রজারা বিস্মিত হয়ে শুনছিল। তাদের চোখে জ্যাসপারের প্রতি কৃতজ্ঞতার ছাপ।
ড্রাকোনিস শেষ কথায় বলল,
“তাদের তৈরি প্রযুক্তি আমাদের জন্য বড় সতর্কবার্তা।এই ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে,পৃথিবীর মানুষ আমাদের শক্তি চুরি করার জন্য কতটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে।এখন সময় এসেছে আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার।”
গভীর রাত্রি।উৎসবের আমেজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। এল্ড্র রাজ্যের রাজকুমার জ্যাসপার এখন বিশাল ল্যাবরেটরির কেন্দ্রীয় ঘরে বসে।তার চারপাশে থারিনিয়াস, এথিরিয়ন,এবং আলবিরা—সবাই ভেনাসের শক্তি এবং পৃথিবী থেকে আনা উপাদান নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। ভেনাসিয়ান প্রযুক্তির আলোতে পুরো ঘরটি রহস্যময় ঝলমল করছে।
জ্যাসপার নিজের এক্সিকিউটিভ চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশমুখী তাকিয়ে ছিল।তার সামনে একটি হোলো স্ক্রিনে এল্ড্র রাজ্যের নতুন প্রযুক্তির ব্লুপ্রিন্ট ভাসছে।তবে তার চোখে ছিল ক্লান্তির ছাপ।সারা রাত গবেষণা,দায়িত্বের বোঝা,আর পৃথিবীর স্মৃতিগুলো তাকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি দেয়নি।
হঠাৎ জ্যাসপারের স্মার্ট ঘড়ি থেকে মৃদু সিগন্যাল এল।স্ক্রিনে একটি চিহ্ন ভেসে উঠল—ফিওনার লকেট অ্যাক্টিভেট হয়েছে।
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।তার সমস্ত চিন্তা আর ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। লকেটের সিগন্যাল মানে একটাই—ফিওনা তাকে মিস করছে।
সে ফিসফিস করে বলল,
“আমার হামিংবার্ড… এতো রাতেও আমাকে মনে করছে।”
গবেষণা রাজ্যের দায়িত্বপালনের কারণে সে ফিওনার সাথে কথা বলতে পারবে না।ইমেল পাঠানো বা অন্য কোনো উপায়ে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয় এখন।কিন্তু লকেটের স্পর্শ মানেই ছিল তার হৃদয়ের সঙ্গে ফিওনার অনুভূতির সংযোগ। ফিওনা যদি লকেটটি স্পর্শ করে,তার মানে সে জ্যাসপারকে অনুভব করছে,মিস করছে।
জ্যাসপার একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল।
“এটাই আমার কাছে যথেষ্ট,”সে মনে মনে বলল।
তাকে সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও,এই ছোট্ট সিগন্যালই যেন পৃথিবীর সাথে তার সমস্ত সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করে।
সে ঘড়ির স্ক্রিনে এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার নামটি দেখে নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল।যত কঠিন কাজই সামনে থাকুক, এই ছোট্ট মুহূর্তটিই তার হৃদয়ে শান্তি নিয়ে এলো।
ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজানো ছিল নানা রকম খাবার—চাইনিজ নুডলস,ডাম্পলিংস,আর গ্র্যান্ডপার প্রিয় স্যুপ।কিন্তু ফিওনার মন নেই কোনো কিছুতেই।চামচ দিয়ে অন্যমনস্কভাবে স্যুপ নাড়ছে।চোখের নিচে গাঢ় কালি পড়ে গেছে,চুলগুলো এলোমেলো।জ্যাসপার চলে যাওয়ার তিন দিন হয়ে গেল,কিন্তু মনে হচ্ছে যেন তিন বছর পার হয়ে গেছে।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। ঘরের বাইরে রঙিন বাতি জ্বলছে,কিন্তু ফিওনার মনে কেবল সেই এক আলো—সন্ধ্যাতারা,যেটি এখন ভেনাসের প্রতীক তার জন্য।
সে জানালার বাইরে তাকিয়ে নিজেকেই বলল,
“তুমি কি জানো,প্রিন্স?প্রতিদিন এই তারা দেখে তোমাকে খুঁজে ফিরি।তুমি বলেছিলে ভেনাসই তোমার রাজ্য।তবে আজ মনে হয় সেই রাজ্যের একটা অংশ আমার হৃদয়ে আছে।”
তারা ঝিকিমিকি করতে থাকে।ফিওনার মনে পড়ে জ্যাসপারের কথা—তার হাসি,তার স্পর্শ,তার চোখের সেই গভীরতা,আর তার মুখে সেই ভালোবাসার নাম—”হামিংবার্ড।”
গভীর রাত হয়ে আসছে।কিন্তু ফিওনা জানালা ছেড়ে উঠতে পারছে না।বাতাসে জ্যাসপারের সেই পারফিউমের মৃদু ঘ্রাণ যেন ভেসে আসে।লকেটটা ধরে সে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিন্স,তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছো?আমি জানি,হয়তো পারছো না।কিন্তু আমি জানি,তুমি আমায় অনুভব করতে পারছো।”
তার চোখের কোণ ভিজে উঠল,কিন্তু ভেতর থেকে এক ধরনের শক্তি অনুভব করল।সেই সন্ধ্যাতারা যেন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।তার মনের প্রিন্স হয়তো দূরে,কিন্তু তার ভালোবাসা ঠিক এই পৃথিবীতেই রয়ে গেছে।
মিস্টার চেন শিং চুপচাপ বসে আছেন তার স্টাডি রুমে।তার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে আছে নানা গবেষণার নোট,আর তার হাতের মাঝে একটা ছোট ছবি—ছোটবেলার ফিওনার। ফিওনার বর্তমান অবস্থাটা তার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে।সে জানে, তার নাতনি কেন এত দিশেহারা।কারণটা যে জ্যাসপার,তা তার কাছে আর অজানা নয়।
সেদিন যখন ফিওনা বাড়িতে ঢুকেই গ্র্যান্ডপাকে দেখেছিল, তাদের দুজনেই যেন কত বছরের কষ্ট ভুলে কেঁদেছিল। ফিওনার চোখের জল দেখে মিস্টার চেন শিংয়ের মনে হয়েছিল,এই মেয়েটা কেবল একমাত্র মানুষ যার কারনেই মিস্টার চেন শিং এখনো বেঁচে আছে। এই মেয়েটা ছাড়া তার যে পৃথিবীতে আর কেউ নেই।প্রিয় নাতনীকে দেখে সে এতোটা আনন্দিত হয়েছিলো যা হয়তো কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।কিন্তু মিস্টার চেন শিং একটাই কথা লুকিয়ে রেখেছে—তিনি এতদিন ধরে জ্যাসপারের ল্যাবের ছিলন,একদম কাছ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছিলন।
পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি চলছে।মিস্টার চেন শিং আগামীকাল ফিওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাবেন মিস ঝাংকে আনতে।তিনি জানেন,মিস ঝাং ফিরলে ফিওনার মনের ভার কিছুটা হলেও কমবে।
তিনি ফিওনাকে বললেন,
“ফিওনা,কাল থেকে তুমি ভার্সিটিতে ফিরে যাবে।জীবন থেমে থাকে না,মাই লিটল এন্জেল।তুমি পড়াশোনায় মন দাও।”
ফিওনা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।তার চোখে এখনো সন্ধ্যাতারার প্রতিচ্ছবি।মিস্টার চেন শিং চিন্তিত হলেও জানেন,ফিওনা সময়ের সঙ্গে তার মন শক্ত করবে।
মিস্টার চেন শিং মনে মনে ভাবলেন,
“আমি জানি, জ্যাসপার আর ফিওনার সম্পর্কটা সহজ নয়। কিন্তু আমি চাই না,ফিওনা আর কষ্ট পাক। কাল থেকে আমি ফিওনার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য তাকে সাহায্য করব।”
এটা ভেবে তিনি তার চশমাটা খুললেন,চেয়ারে হেলান দিলেন।আগামীকাল নতুন এক দিন আসবে, আর সেই দিন যেন তার নাতনির জন্য একটা নতুন আশার বার্তা নিয়ে আসে।
ফিওনা আজ প্রায় দুই মাস পর পিকিং ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এসেছে।এতদিন পর ইউনিভার্সিটির পরিচিত পরিবেশে পা রাখতেই তার মনে হালকা একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো।পিকিং ইউনিভার্সিটির সেই বড় গেট, সাজানো-গোছানো বাগান,আর এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো ছাত্রছাত্রীদের চঞ্চলতা দেখে তার ভেতরের ভার কিছুটা হলেও কমে গেল।
ক্লাস বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছে ফিওনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।জানালা দিয়ে ক্লাসের ভেতরের চেনা পরিবেশটা দেখল।ধীরে ধীরে ক্লাসের দরজার সামনে যেতেই তার দুই প্রিয় বান্ধবী, লিন আর লিয়া, ফিওনাকে দেখে অবাক হয়ে থমকে গেলো
লিন হঠাৎ বলল,
“ফিওনা! তুই… তুই সত্যিই ফিরে এসেছিস? এতদিন কোথায় ছিলি তুই?”
লিয়া তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ফিওনার হাত ধরে বলল,
“আমরা ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরবে না।তুমি কতদিন ধরে আমাদের মেসেজের কোনো রিপ্লাই দাওনি।আমরা তো ভেবেছিলাম,তুমি বড় কোনো সমস্যায় পড়েছ!
ফিওনা হালকা হাসল। তার চোখে এখনো একধরনের ক্লান্তি, কিন্তু তার ভেতর একটা অদ্ভুত শান্তিও।সে বলল,
“আমি ঠিক আছি।কিছু পারিবারিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই গ্রিসে যেতে হয়েছিলো।কিন্তু এখন সব ঠিক আছে। তোমাদের সবাইকে মিস করেছি অনেক।”
লিন আর লিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ফিওনার চোখ-মুখে যেন কিছু বদলে গেছে।সে আগের মতো নেই।”
কিন্তু তারা আর কিছু না বলে ফিওনাকে নিয়ে ক্লাসের ভেতরে ঢুকে গেল।ক্লাসে ঢুকতেই ফিওনার মনে হল,যেন সে তার পুরোনো জীবনে ফিরে এসেছে।কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে জ্যাসপারের স্মৃতির ছায়া এখনো স্পষ্ট।পিকিং ইউনিভার্সিটির এই সেমিস্টারে ফিওনার ইলেকটিভ কোর্স হিসেবে ছিল ‘Environmental Geography’। যদিও সে মূলত সায়েন্স স্টুডেন্ট, তবে এই কোর্সটা বেছে নিয়েছিল নিজের আঁকায় প্রকৃতির প্রভাব আর পরিবর্তনগুলো বুঝে নিতে।
আজ ক্লাসরুমে ভুগোলের এই ক্লাস চলছে। অধ্যাপক ব্ল্যাকবোর্ডে সৌরজগতের গ্রহগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছেন। ভেনাস নিয়ে কথা বলার সময় ক্লাসরুমে একধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়।সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে,কিন্তু ফিওনার মন যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।
সে নিজের বইয়ের পাতা খুলে ভেনাসের চিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে।ছবির ওপর তার আঙুল বুলিয়ে মৃদু হাসে। তার মনের কোণে একটাই ভাবনা— “জ্যাসপার এখানেই আছে।”
ভেনাসের পৃষ্ঠের অজস্র রহস্যময় পাহাড়,উপত্যকা আর আগ্নেয়গিরির ছবি দেখে ফিওনা নিজের মনের মধ্যে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে,জ্যাসপারের রাজ্যটা ঠিক কোথায়।
“এটা কি এল্ড্র রাজ্যের পাহাড়?”
সে অজান্তেই চিত্রের একটি অংশে আঙুল রেখে ফিসফিস করে বলল “হয়তো এই জায়গাটা।এখানে নিশ্চয়ই আমার প্রিন্সের সিংহাসন আছে।”
তার এই অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করে পাশে বসা লিয়া কৌতূহল নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“ফিওনা,তুমি কী দেখছো এতো মনোযোগী হয়ে?”
ফিওনা হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এল।লিয়া হাসি চাপার চেষ্টা করে বলল,”দেখে মনে হচ্ছে তুমি তো ভেনাস নিয়ে একেবারে মুগ্ধ!এমন কোনো রাজপুত্র খুঁজে পাওনি তো সেখানে?”
ফিওনা লাজুকভাবে মাথা নীচু করল।তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল,কিন্তু সে কিছু বলল না।লিয়ার মজা করার শব্দ ফিওনার কানে এলেও,তার মন তখনো ভেনাসের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ফিওনার গলার লকেটটি আজ বেশ উজ্জ্বলভাবে চকচক করছিল।ক্লাসের আলোয় সেটি আরও আকর্ষণীয় লাগছিল। লিন আর লিয়া প্রথম থেকেই ফিওনার লকেটটি লক্ষ্য করেছিল।
ক্লাসের বিরতির সময় লিয়া ফিওনার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,”এই লকেটটা এত সুন্দর! তুমি কোথা থেকে পেলে?”
লিনও আগ্রহ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ,ফিওনা! এত ইউনিক ডিজাইন,আমি এরকম আগে কখনো দেখিনি।এটা কি কোনো স্পেশাল গিফট?”
ফিওনা লকেটটি আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে মৃদু হাসল। তার মনে ভেসে উঠল জ্যাসপারের কথা,যে তাকে এই লকেটটি দিয়েছিল।লকেটটির ভেতরে ছিল ছোট্ট একটি গোপন টাচ প্যাড,যা শুধু ফিওনার স্পর্শেই সক্রিয় হবে।
ফিওনা ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ,এটা একটা গিফট।খুব স্পেশাল একজন দিয়েছে।”
লিন হেসে বলল,
“ওহ! তাহলে এটা নিশ্চয়ই তোর প্রিন্স চার্মিংয়ের কাছ থেকে পেয়েছিস?”
লিয়া ঠাট্টা করে বলল,
“প্রিন্স চার্মিং?না কি ভেনাসের কোনো রাজপুত্র?”
ফিওনা তাদের হাসির সঙ্গে মিশে গেল,কিন্তু তার চোখে-মুখে এক ধরনের অনাবিল শান্তি খেলা করছিল। সে জানত,তার এই লকেট শুধু একটি গিফট নয়;এটি তার আর জ্যাসপারের ভালোবাসার চিহ্ন।
কথার মাঝেই লিয়া আবার বলল,
আযদাহা পর্ব ৪৯
“সত্যি করে বলো,ফিওনা।আমরা জানি তোমার জীবনে কেউ আছে।এতো সুন্দর লকেট প্রিয় মানুষ ছাড়া কেউ দিতে পরেনা।”
ফিওনা মৃদু হেসে লকেটটা ধরে বলল,
“হয়তো তোমরা সঠিক।তবে প্রিন্স চার্মিং কোথায় থাকে,সেটা বলা যাবে না।”
লিন আর লিয়া তখন আর কোনো কথা বলল না,শুধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।তাদের মনে তখনো রহস্যটা উন্মোচন করার চেষ্টা চলছিল।