আযদাহা পর্ব ৫১ (২)
সাবিলা সাবি
ফিওনার দীর্ঘ ৪০ দিনের ক্লান্তিকর যাত্রার অবসান ঘটেছে। স্পেসশিপটি ভেনাসের কক্ষপথে প্রবেশ করার পর স্বয়ংক্রিয় অবতরণ প্রক্রিয়ায় সেটি ধীরে ধীরে নির্ধারিত স্থানে অবতরণ করে।ভেনাসের মাটিতে পা রাখার মুহূর্তটি ছিল ফিওনার জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা।
আকাশটি পৃথিবীর মতো নীল নয়; বরং এটি কমলা ও সোনালি রঙের মিশ্রণে আবৃত।সূর্য ভেনাসে অপেক্ষাকৃত বড় ও আগুনের মতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।চারপাশে ধোঁয়ার মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে,যা সালফিউরিক অ্যাসিডে পূর্ণ।
পাথুরে মাটি,জায়গায় জায়গায় আগ্নেয়গিরির ছাই জমে আছে।কিছু এলাকায় লাভার মতো উজ্জ্বল প্রবাহিত তরল দেখা যায়।পাহাড়গুলো উজ্জ্বল হলুদ ও লালাভ ছোঁয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গড় তাপমাত্রা প্রায় ৪৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গ্যাসের ভারী চাপের কারণে পরিবেশ অনেক বেশি ঘন।
বাতাসে শ্বাস নেওয়া অসম্ভব; কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রচুর।ভেনাসের দিন অনেক লম্বা;একটি দিন পৃথিবীর ২৪৩ দিনের সমান।
ফিওনার গায়ে ছিলো হিট-রেজিস্ট্যান্ট ন্যানোফাইবার স্যুট।
এটি ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।স্যুটের মধ্যে শীতলকরণ ব্যবস্থা রয়েছে,যা তার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।বিশেষ অক্সিজেন ট্যাংক, যা ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্বাস নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত।ট্যাংকটি স্যুটের পিঠে সংযুক্ত, এবং একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করে।হেলমেটটি স্বচ্ছ ন্যানোগ্লাস দিয়ে তৈরি, যা সালফিউরিক অ্যাসিডের স্প্ল্যাশ প্রতিরোধ করতে পারে।এতে একটি হেডস-আপ ডিসপ্লে (HUD) রয়েছে, যা তাপমাত্রা, অক্সিজেন লেভেল, এবং পরিবেশের গ্যাসের মাত্রা দেখায়।
বুটের তলা বিশেষভাবে ডিজাইন করা, যাতে লাভার ওপরে পা রাখলেও ক্ষতি না হয়।বুটের সোলটি তাপ শোষণ করে এবং ঠান্ডা রাখে।মিস্টার চেন শিং এবং ড. হুয়াং-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি রেডিও ডিভাইস।
এটি ভেনাসের বায়ুমণ্ডলিক চাপ এবং পৃথিবীর যোগাযোগ সিস্টেমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম।
ভেনাসের গাঢ় বায়ুমণ্ডল এবং ভূমি থেকে দূরে থাকার জন্য ফিওনার বুটে একটি অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি ডিভাইস সংযোজিত।
এটি তাকে চলাফেরা করার সময় মাধ্যাকর্ষণের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্পেসশিপের দরজা খুলতেই ভেনাসের উষ্ণ বাতাস তার স্যুটে ধাক্কা দেয়।ফিওনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে এবং তার প্রথম পদক্ষেপ রাখে এই অজানা, রহস্যময় গ্রহের মাটিতে।চারপাশের শূন্যতা তাকে ভয় দেখায়,কিন্তু তার চোখে ছিল জ্যাসপারের মুখ দেখার জন্য দৃঢ় সংকল্প।
ফিওনা হেলমেটের ভেতর থেকে নিজের মনে বলে,
“অবশেষে আমি এখানে পোঁছে গেছি প্রিন্স!এই গ্রহ,এই তাপ,কিছুই আমাকে থামাতে পারবে না।”
ফিওনা একমনে ভেনাসের বিস্তীর্ণ,অচেনা ভূমি পেরোচ্ছিল। তার হৃদয় তখনো ধুকপুক করছে,কারণ সে জানে জ্যাসপারের খোঁজ পাওয়ার আগে তাকে অনেক বাধা পেরোতে হবে।তার স্যুটের সেন্সর প্রতি মুহূর্তে ভেনাসের তাপমাত্রা এবং বাতাসের সংকেত পাঠাচ্ছে,কিন্তু ফিওনার মন সেগুলো উপেক্ষা করে একটাই চিন্তায় মগ্ন—জ্যাসপার কোথায়?
অবশেষে ফিওনা একটি বিস্তৃত উপত্যকার দিকে এগিয়ে গেল।হঠাৎই মাটির কম্পন টের পায়।প্রথমে মনে হলো হয়তো এটি ভেনাসের কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা।কিন্তু দ্রুতই সে অনুভব করে,এটি কোনো ভূমিকম্প নয়।মাটির কম্পন এবং শব্দ ক্রমেই ভারী হচ্ছে,যেন বিশাল কিছু তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
ফিওনা ভয়ে পিছু ফিরে তাকায়।তার হেলমেটের হেডস-আপ ডিসপ্লেতে ভেনাসের ধূলার মধ্য থেকে বিশাল ছায়ামূর্তি দেখা যায়।প্রথমে ধুলোয় ঢাকা থাকার কারণে কিছু স্পষ্ট হয় না। কিন্তু একটু পরেই ফিওনার চোখে ভেসে ওঠে একটি বিশাল ড্রাগনের আকৃতি।ড্রাগনের প্রতিটি পদক্ষেপে মাটিতে কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে।তার পা বিশাল আকারের,যেন পুরো মাটিকে চূর্ণ করে দিতে পারে।ড্রাগনের গা সোনালি ও কালো আঁশে ঢাকা, যা সূর্যের আলোয় চকচক করছে।তার ডানা বিশাল,যেন আকাশের একটি অংশ ঢেকে ফেলেছে।
ফিওনা দেখলো ড্রাগনের লাল চোখ,যা তার দিকে তাকিয়ে আছে।ড্রাগনটি ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে এলো। তার চোখে ছিল কৌতূহল,যেন এটি বুঝতে চাইছে ফিওনা কে এবং এখানে কেন এসেছে।
ফিওনা ভয়ে এক পা পিছিয়ে যায়,কিন্তু তার দৃঢ় মনোবল তাকে পিছু হটতে দেয় না।সে নিজের মনকে শান্ত রেখে ড্রাগনের দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি কি জানো প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন কোথায়?আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
ড্রাগনটি কোনো শব্দ করল না,তবে তার মাথা একবার ঝাঁকাল।এর পরেই ড্রাগনটি ধীরে ধীরে তার ডানা বিস্তার করল এবং একটি বিশাল শব্দে বাতাসে উঠে গেল।ফিওনা অনুমান করল,এটি তাকে অনুসরণ করতে বলছে।
ফিওনা ড্রাগনের পেছনে দৌড়াতে শুরু করল।তার স্যুটের অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি বুট তাকে দ্রুত চলতে সাহায্য করছিল,কিন্তু ড্রাগনের গতি ছিল আরও বেশি।ফিওনা বুঝতে পারল,এটি তাকে জ্যাসপারের রাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তারপর সে দেখতে পেল একটি বিশাল প্রবেশপথ,যা পাহাড়ের চূড়ার ভেতর লুকানো।প্রবেশপথটি ড্রাগনের আঁশের মতো আলোর বিচ্ছুরণে চকচক করছিল।ফিওনার মন বলে দিলো, “এই তো,জ্যাসপারের রাজ্য!”
ফিওনা বিস্ময়ের সঙ্গে বিশাল অট্টালিকাটিকে দেখছিল।তার গা ছমছম করছিল,কারণ এটি কোনো সাধারণ প্রাসাদ নয়, একটি এমন রাজ্য যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। অট্টালিকাটি কালো এবং সোনালি রঙের অদ্ভুত সমন্বয়ে নির্মিত।এর বিশাল দরজাগুলো ড্রাগনের মাথার মতো আকৃতির,এবং চারপাশে ড্রাগনের আঁকা প্রতিচ্ছবি খোদাই করা।
হঠাৎ,ফিওনার হেলমেটের সেন্সর বিপদ সংকেত পাঠাতে শুরু করল।সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই,চারপাশ থেকে ড্রাগনের মতো দেখতে সশস্ত্র যোদ্ধারা তাকে ঘিরে ফেলল। তাদের গায়ে ছিল ধাতব বর্ম,যা চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল।
একজন যোদ্ধা,যার লালাভ আঁখি তাকে আরও ভীতিকর করে তুলেছিল,এগিয়ে এসে বলল,”তুমি কে?কীভাবে ভেনাসে প্রবেশ করেছো?”
ফিওনা আতঙ্কিত হলেও তার সাহস বজায় রেখে বলল, “আমি প্রিন্স জ্যাসপারকে খুঁজছি।আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই যোদ্ধারা ফিওনার হাত থেকে তার সামান্য যন্ত্রপাতি কেড়ে নিল।একজন বলল,”ড্রাকোনিসের রাজ্যে কোনো মানবের প্রবেশ নিষিদ্ধ।ড্রাকোনিসের নির্দেশ অনুযায়ী,তোমাকে ব*ন্দি করা হবে।”
ড্রাকোনিস জ্যাসপারের রাজ্যের বর্তমান অভিভাবক এবং ড্রাগন রাজ্যের প্রধান,ইতোমধ্যে খবর পেয়ে গেছেন।একজন মানব কন্যা কীভাবে ভেনাসে পৌঁছেছে,তা তাকে অবাক করেছে।তিনি তার সেনাদের আদেশ দিলেন,”তাকে আমাদের গোপন কারাগারে নিয়ে যাও।আমি নিজের হাতে এর সত্যতা যাচাই করব।”
ফিওনাকে এক সিক্রেট কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। কারাগারটি ছিল পাহাড়ের গভীরে,যেখানে সূর্যের আলো কখনো পৌঁছায় না।কারাগারের দেওয়ালগুলো ছিল মহাকাশের বিরল ধাতু দিয়ে তৈরি,যা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কল্পনাও করতে পারবে না।কারাগারের চারপাশে ড্রাগনের প্রহরী ঘুরছিল,তাদের চোখ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল।ফিওনার হাত ও কোমরে একধরনের শক্তিশালী শিকল পরানো হলো,যা ভেনাসের বিশেষ চৌম্বক শক্তি দ্বারা তৈরি।ফিওনা বুঝতে পারছিল,পরিস্থিতি তার জন্য কঠিন হতে চলেছে।কিন্তু তার মন এখনো শক্ত ছিল।সে জানে, জ্যাসপার এখানেই আছে এবং কোনো না কোনোভাবে তাকে দেখতে পাবে।
ড্রাকোনিস নিজের সিংহাসনে বসে ভাবছিলেন, “এই মানব কন্যা কীভাবে ভেনাসে এলো?এর পেছনে কি কোনো ষ*ড়যন্ত্র আছে?” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন,কারাগারে গিয়ে নিজেই মেয়েটির মুখোমুখি হবেন এবং সত্য উদঘাটন করবেন।
ফিওনা এখনো জানে না,কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।কিন্তু তার হৃদয়ে একটাই আশা—জ্যাসপারের সঙ্গে দেখা হওয়া।
ফিওনাকে ব*ন্দি করে একটি বিশেষ কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে।যা অন্য সাধারণ কারাগার থেকে আলাদা।এটি ছিল ড্রাকোনিস রাজ্যের একটি সুরক্ষিত এলাকা,যেখানে মানবদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল।
কক্ষটি এমনভাবে ডিজাইন করা ছিল,যাতে পৃথিবীর মতো পরিবেশ তৈরি করা যায়।সেখানে কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছিল।তাপমাত্রা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে স্থির রাখা হয়েছিল।চারপাশে গাছপালার মতো কৃত্রিম উদ্ভিদ ছিল,যা শুধুমাত্র পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল।
কক্ষে একটি নরম বিছানা ছিল, যা মানুষের আরামের কথা ভেবে তৈরি।দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের মনোরম দৃশ্য প্রদর্শনকারী হোলোগ্রাফিক স্ক্রিন স্থাপন করা ছিল,যাতে ব*ন্দি থাকা অবস্থায় ফিওনার মনে কোনো চাপ না পড়ে।
কক্ষে পৌঁছানোর পর,ড্রাগন প্রহরীরা ফিওনার সুট খুলে ফেলল।কারণ,তারা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে সুটের ভেতরে কোনো অস্ত্র বা গোপন ডিভাইস নেই।
ফিওনার সুট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি একটি বিশেষ চৌম্বকীয় বাক্সে সংরক্ষণ করা হলো,যাতে ফিওনা এগুলো ব্যবহার করতে না পারে।ফিওনা কিছুটা ক্লান্ত ছিল, তবে তার মধ্যে ছিল অদম্য সাহস।সে চারপাশটা দেখতে লাগল।কক্ষটি আরামদায়ক হলেও, এটি তার কাছে কোনো মুক্তি নয়।তার মনের মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল: “জ্যাসপার কি জানে আমি এখানে?”
ড্রাগন প্রহরীরা তাকে জানিয়ে গেল,”ড্রাকোনিস নিজে তোমার সঙ্গে দেখা করবেন। তোমার প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন।”ফিওনা বসে রইল, তার মনোযোগ চারপাশের কৃত্রিম পরিবেশে নয়,বরং সেই মুহূর্তে যখন সে জ্যাসপারের মুখোমুখি হবে।
ড্রাকোনিস তখনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন কীভাবে ফিওনার সঙ্গে কথা বলা হবে।তিনি জানতেন,একজন মানুষকে এত দূর থেকে ভেনাসে আসতে দেখাটা সহজ কিছু নয়।এটা হয়তো কেবল প্রেম নয়,এর পেছনে কোনো র*হস্য থাকতে পারে।
কিন্তু ড্রাকোনিস আরেকটি জিনিসও অনুভব করেছিলেন: ফিওনার সাহস।এই কন্যা এত বাধা পেরিয়েও এখানে পৌঁছেছে।এ সাহসকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়।
ড্রাকোনিস ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন।তার বিশাল দৈহিক অবয়ব এবং মেঘের মতো গম্ভীর কণ্ঠস্বরের কারণে কক্ষের পরিবেশ যেন আরো গম্ভীর হয়ে উঠল।তার আগমনেই ফিওনা বুঝতে পারল,তিনি কেবল একজন ড্রাগন নন—তিনি রাজ্যের শাসক,ড্রাকোনিস।
ড্রাকোনিস দাঁড়িয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার নাম কী,মানব কন্যা?কেন তুমি ভেনাসে এসেছ?”
ফিওনা একটু ভয় পেলেও সাহস ধরে বলল,”আমার নাম এলিসন ফিওনা।আমি প্রিন্স জ্যাসপারের জন্য এখানে এসেছি।সে অনেকদিন ধরে আমার কোনো খোঁজ নেয়নি। আমি জানি না সে কী অবস্থায় আছে।”
ড্রাকোনিসের চোখ সংকীর্ণ হলো।তিনি ফিওনার সাহস এবং সরলতা অনুভব করলেন।তবে,তার কণ্ঠ কঠোর রয়ে গেল। তিনি বললেন,”তুমি কি জানো,এখানে আসা মানুষের জন্য কতটা বিপজ্জনক?এটা কেবল প্রেমের বিষয় নয়।আমি ড্রাকোনিস,এই রাজ্যের রাজা এবং জ্যাসপারের পিতা।”
ড্রাকোনিসের পরিচয়ে ফিওনা মৃদু জড়সড় হলেও নিজের অবস্থান ধরে রাখল।সে সামান্য মাথা নুইয়ে বলল, “আপনাকে সম্মান করি,মহামান্য।কিন্তু আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজতে এসেছি।আমি জানি না,সে কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে। আমি শুধু তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
ড্রাকোনিস ফিওনার চোয়ালে দৃঢ়তা এবং চোখে সত্যতা খুঁজে পেলেন।তবে তার মুখে কোনো বিশেষ ভাবান্তর দেখা গেল না।তিনি ধীর গলায় বললেন, “তুমি জানো না, তোমার উপস্থিতি কী ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।তোমার মতো একজন মানুষের এখানে থাকা অনেক বিপজ্জনক।আর জ্যাসপারের কাছে যাওয়া এত সহজ নয়।কিন্তু…”
ড্রাকোনিস থেমে গেলেন।তার মনে সন্দেহ এবং কৌতূহল উভয় কাজ করছিল।
ফিওনা সরাসরি ড্রাকোনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যে কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে রাজি আছি।আমার জন্য যদি এটি বিপজ্জনক হয়,তবে আমি নিজেই সে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।আমি কেবল প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
ড্রাকোনিস কিছুক্ষণ নীরবে ফিওনার কথা শুনলেন।তিনি বুঝতে পারলেন,এই মানব কন্যা কেবল ভালোবাসার জন্যই এখানে আসেনি।তার ভেতরে আছে এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি, যা তাকে এ দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
ড্রাকোনিস ধীর কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,”আমি জানি, তোমার আর আমার পুত্রের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল।কিন্তু ফিওনা,তোমার কি মনে হয়,সে এখনো তোমাকে মনে রেখেছে?জ্যাসপার তোমার কথা একেবারেই ভুলে গেছে।”
ফিওনার হৃদয় থমকে গেল। তবে তার চোখে দৃঢ়তা ঝলসে উঠল।সে বলল,”আমি তা বিশ্বাস করি না।প্রিন্স আমাকে ভুলতে পারে না।”
ড্রাকোনিস ঠান্ডা হেসে বললেন,”তোমার বিশ্বাস আর বাস্তবতার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।জ্যাসপার এখন অন্য একজনের জীবনে আবদ্ধ।সে তোমাকে অনেক আগেই ভুলে গেছে।এবং হ্যাঁ,তার এনগেজমেন্ট আগামীকাল। অ্যালিসা,ফ্লোরাস রাজ্যের রাজকুমারী,তার হবু স্ত্রী।”
ড্রাকোনিসের কথা শুনে ফিওনার শরীর জমে গেল। মনে হলো, যেন তার মনের সব আশা মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও সে নিজের ভেতরের শক্তিকে ধরে রাখল।
সে বলল, “আমি তা মানি না। আপনি যা-ই বলুন,আমি বিশ্বাস করি না যে প্রিন্স আমাকে ভুলে গেছে।আমি নিজে তার মুখ থেকে শুনতে চাই।আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে দিন।”
ড্রাকোনিসের চোখে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,”তুমি কি জানো,তার কাছে পৌঁছানো কতটা কঠিন?তুমি একজন মানব কন্যা,আর সে ভেনাসের রাজপুত্র। এই রাজ্যের নিয়মের বাইরে তুমি কিছু করতে পারবে না।”
ফিওনার গলায় দৃঢ়তা ফিরে এল। সে বলল, “আমার জীবন নিয়ে আমি ঝুঁকি নিতে রাজি।আপনি আমাকে তার সামনে নিয়ে যান।আমি নিজের কানেই শুনতে চাই,সে আমাকে ভুলে গেছে কিনা।”
ড্রাকোনিস কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,”ঠিক আছে, মানব কন্যা।যদি এতই ইচ্ছা,তবে তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।কিন্তু মনে রেখো, তুমি যদি মিথ্যা প্রমাণ হও,তবে তোমার জন্য এখানে আর কোনো জায়গা থাকবে না।”
ফিওনা দৃঢ়ভাবে মাথা ঝাঁকাল। “আমি প্রস্তুত।আপনি যা-ই বলুন,আমি প্রিন্স জ্যাসপারের মুখ থেকে সত্য শুনতে চাই।”
ড্রাকোনিস গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর নিজের সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন,”তাকে একদিনের জন্য প্রস্তুত করো।কাল সকালে তাকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হবে।”
পরেরদিন সকালে ফিওনাকে তার আনা স্যুট পরানো হলো,
ড্রাকোনিসের আদেশে সৈন্যরা ফিওনাকে সুরক্ষিতভাবে প্রাসাদের দিকে নিয়ে গেল।ফিওনার মন উত্তেজনা ও ভয়ে আচ্ছন্ন ছিল।তার একমাত্র ইচ্ছা,জ্যাসপারকে দেখা এবং তার মুখ থেকে সত্যিটা জানা।
প্রাসাদটি এক মহাকাব্যিক স্থাপত্যের নিদর্শন ছিল।বিশাল সোনালি দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল, এবং ফিওনার চোখে পড়ল রাজ্যের সিংহাসন কক্ষ।সোনালি ও রক্তিম আলোয় ঝলমল করছিল পুরো হলঘর।ছাদের গম্বুজে আঁকা ছিল ড্রাগনদের প্রাচীন ইতিহাস, এবং মেঝেতে ছিল জ্বলন্ত পাথরের নকশা,যা ভেনাসের শক্তি প্রতীকীভাবে প্রদর্শন করছিল।
ফিওনাকে সিংহাসনের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।সিংহাসনে বসে ছিলেন ড্রাকোনিস,তার চারপাশে ড্রাগন সৈন্য এবং রাজ্য পরিষদের সম্মানিত সদস্যরা।কক্ষে এক গভীর নীরবতা নেমে এলো,যেন প্রতিটি ব্যক্তি ফিওনাকে পর্যবেক্ষণ করছিল।
ড্রাকোনিস তার গভীর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “মানব কন্যা, তুমি এখন রাজপ্রাসাদের সিংহাসন কক্ষে উপস্থিত।আমি তোমাকে এখানে এনেছি,কারণ তুমি দাবি করেছো,আমার পুত্র জ্যাসপারকে তুমি ভালোবাসো এবং সে তোমাকে ভালোবাসে।”
ফিওনা ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে তাকালেন। “হ্যাঁ,আমি তাই দাবি করি।আমি এখানে এসেছি শুধু জ্যাসপারের মুখ থেকে সত্যটা জানার জন্য।আপনি যা-ই বলুন,আমি বিশ্বাস করি না যে সে আমাকে ভুলে গেছে।”
ড্রাকোনিস হাসলেন,তবে সে হাসি ঠান্ডা ও রহস্যময়। “তুমি সত্য জানতে চেয়েছো,তাই সত্য তোমার সামনে প্রকাশিত হবে।কিন্তু মনে রেখো,ফিওনা, ্সত্য সবসময় মধুর হয় না।”
ঠিক সেই মুহূর্তে, সিংহাসন কক্ষের বিশাল দরজা আবার খুলে গেল।হেঁটে আসছিলেন জ্যাসপার,তার পরনে ছিল ড্রাগন রাজকীয় পোশাক।তার চোখে ছিল কঠোরতা,কিন্তু তার মুখে একধরনের নিরাসক্ত অভিব্যক্তি।
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল।সে এক পলকের জন্য বিশ্বাসই করতে পারল না যে তার সামনে জ্যাসপার দাঁড়িয়ে আছে। তার হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করছিল,কিন্তু জ্যাসপারের মুখ থেকে কোনো আবেগ প্রকাশ পাচ্ছিল না।
ড্রাকোনিস বললেন,”জ্যাসপার,এই মানব কন্যা দাবি করছে, তুমি তাকে ভালোবাসো।তার কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য তুমি কি তার সামনে কিছু বলবে?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে গেল।তার চোখ ফিওনার চোখের দিকে নিবদ্ধ,এবং তার কণ্ঠ ছিল একেবারে স্থির।”তুমি কেন এখানে এসেছো,ফিওনা?”
ফিওনা হঠাৎ সব শক্তি হারিয়ে ফেলল।সে বলল,”আমি তোমার কাছে জানতে এসেছি,প্রিন্স। তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো আমার সাথে যোগাযোগ কেনো করোনি তুমি?”
জ্যাসপার তখন বললো “যোগাযোগ করার মতো কোনো প্রয়োজন মনে করিনি”।
ফিওনা কান্না চেপে রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি মজা করছো, তাই না, প্রিন্স?মাউন্টেন গ্লাস হাউজে আমাদের কাটানো সেই মুহূর্তগুলো,সেগুলো কি তুমি ভুলে গেছো? তুমি কি ভুলে গেছো,তুমি আমাকে কতোটা যত্ন করেছো? আমাকে বিপদে বারবার বাঁচিয়েছো?তুমি কি সত্যিই ভুলে গেছো আমাদের কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত,তোমার দেয়া উপহার এই দেখো তোমার দছয়া লকটে এখনো আমার গলায়, তোমায় দেয়া পারফিউম আমি সবসময় আমার গায়ে জড়িয়ে রাখি আর তুমি সত্যি কি আমাকে ভুলে গেছো?”
জ্যাসপার তার চোখ নামিয়ে বলল,”ফিওনা,এই পৃথিবীর বাইরে ভেনাসের রাজ্য মানবদের জন্য নয়।তুমি যেভাবে এসেছো,সেভাবেই ফিরে যাও।এখানে তোমার থাকার কোনো অধিকার নেই।এই জায়গা তোমার জন্য খুব বিপজ্জনক,আমি তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
ফিওনার চোখ ছলছল করে উঠল,কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। “ফিরে যাবো?তুমি জানো আমি এখানে আসার জন্য কী করেছি?কত মাস ধরে কষ্ট করেছি?এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছো,এই বিপজ্জনক পথে আমি কেন এসেছি?না,তুমি ভাবতে পারবে না।তুমি তো ড্রাগন।তুমি এক পলকে উড়ে উড়ে পৃথিবীতে চলে যেতে পারো,কিন্তু আমার কাছে এটা সহজ ছিল না।”
জ্যাসপার তার স্থির দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকাল।তার চোখে একধরনের শীতলতা দেখা গেল।”তুমি এখানে কেন এসেছো,ফিওনা?ভালোবাসা?আমি তোমাকে পৃথিবীতে রেখেএ এসেছি।আমার জগৎ তোমার জন্য নয়।আমাদের দুই জগৎ আলাদা এবং আমি সেটাই চেয়েছি।এখানে থেকে তুমি শুধু নিজেকে বিপদের মুখে ফেলছো।”
ফিওনা থেমে গেল।তার কণ্ঠ থরথর করছিল।”তুমি জানো, আমি তোমার জন্যই এসেছি।আমি ভেবেছিলাম,তুমি আমাকে অন্তত একবার দেখতে চাইবে।কিন্তু এখন দেখছি, তুমি আমাকে পৃথিবীতে রেখে এসে ভুলে যেতে চাইছো।তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
ঠিক সেই মুহূর্তে সিংহাসনের পেছন থেকে ভেসে এলো এক নারীর গম্ভীর ও ধারালো কণ্ঠ।”তুমি কি এখনো এখানে থাকবে, মানব কন্যা?”
ফিওনা চমকে উঠল।ধীরে ধীরে এক সুন্দরী ড্রাগন নারী সামনে এগিয়ে এলো।তার পরনে ছিল চকচকে সোনালি পোশাক,যা তার আভিজাত্যের পরিচয় বহন করছিল।চোখে ছিল একধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,যা ফিওনার দিকে অবজ্ঞার সঙ্গে তাকিয়ে ছিল।ফিওনার আর চিনতে বাকি রইলো না অ্যালিসাকে।
“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি এলিসন ফিওনা।তুমি বুঝতে পারছো না,তুমি এখানে থাকার যোগ্য নও।আমার প্রিন্সকে নিয়ে তোমার কোনো অধিকার নেই,”অ্যালিসা দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
ফিওনা তখন হতভম্ব হয়ে বলল,”কি সব বলছো তুমি অ্যালিসা আর প্রিন্স শুধু আমার—”
অ্যালিসা তার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল,”আমি অ্যালিসা।ড্রাকোনিস রাজ্যের রাজকন্যা এবং জ্যাসপারের নিয়োজিত সঙ্গিনী।আগামীকাল আমাদের আনুষ্ঠানিক বাগদান হবে।তুমি এখানে আসার সাহস কীভাবে পেলে?”
ফিওনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল,কিন্তু সে হাল ছাড়ল না।
“আমি এখানে জ্যাসপারের কাছে এসেছি।আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।আমাদের যে সম্পর্ক ছিল,সেটা এত সহজে শেষ হতে পারে না।”
অ্যালিসা একটি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,”তুমি কি ভাবছো,তোমার মতো একটি মানব কন্যার জন্য প্রিন্স তার রাজ্য,তার পরিবার এবং তার দায়িত্ব ভুলে যাবে?তুমি বুঝতে পারছো না,সে তোমার জন্য কোনো ভবিষ্যৎ দেখছে না।”
ফিওনা দৃঢ়ভাবে বলল,”এটা আমি তার মুখ থেকেই শুনতে চাই।আমি তোমার কাছে প্রমাণ করতে চাই,আমার ভালোবাসা আমাকে ভুলে যায়নি।”
অ্যালিসার চোখে আগুন জ্বলে উঠল,কিন্তু সে শান্ত কণ্ঠে বলল,”ঠিক আছে,প্রমাণই যদি চাই,তবে প্রিন্স নিজেই বলবে সে কী চায়।তবে আগামীকাল আমাদের বাগদানের অনুষ্ঠানে তোমাকে আমন্ত্রণ জানালাম”।
জ্যাসপার নীরব ছিল পুরো সময়।ফিওনা তার চোখে কোনো আবেগের ঝলক দেখতে চাইল,কিন্তু তার মুখ ছিল পাথরের মতো শক্ত।”আমি প্রমাণ করব, প্রিন্স এখনো আমারই।তুমি যা-ই বলো না কেন,”ফিওনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল এবং অ্যালিসার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
সিংহাসনের কক্ষ তখন এক মুহূর্তের জন্য যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ফিওনার কণ্ঠে ছিল দুঃখ, আশা, এবং বিশ্বাসের মিশ্রণ। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিল এক অটল সংকল্প।
“প্রিন্স, একবার বলো,” ফিওনা জোরালো কণ্ঠে বলল।
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?আমি শুধু তোমার সত্যি কথা শুনতে চাই,একবার তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো আর আমাকে এখনো মিস করো এটা শুনেই আমি এখান থেকে ফিরে যাবো। যত কষ্টই হোক,তোমার জন্য অপেক্ষা করবো পৃথিবীতে যেয়ে।শুধু একবার বলো,তোমার এই সঙ্গী বা এই রাজ্য আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারবে না।”
জ্যাসপার তার চোখ কঠিন সবুজ চোখজোড়া ফিওনার দিকে স্থির রেখেই বললো”ফিওনা,” সে অবশেষে বলল,তার কণ্ঠ ভারি আর একেবারে গভীর,যেন নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করছে। “তুমি আমার জীবনের এক অংশ ছিলে সেটা পৃথিবীতে থাকাকালীন কিন্তু এখানে তোমার কোনো জায়গা নেই।আমি একজন ড্রাগন,আর তুমি একজন মানব কন্যা। আমাদের এই সম্পর্ক অসম্ভব।”
ফিওনার বুকটা যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল,কিন্তু সে হাল ছাড়ল না।”এটা সত্য নয়!” ফিওনা চিৎকার করে বলল। “তোমার চোখে আমি আজও সেই ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি।তুমি আমাকে ভোলোনি,প্রিন্স।সত্যি বলো,তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”
কক্ষের সবাই তাদের নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল।অ্যালিসার চোখে ছিল রাগ আর বিদ্বেষ,কিন্তু সে কিছু বলল না। ড্রাকোনিসও নির্বিকার মুখে সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এথিরিয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে।
জ্যাসপার চুপচাপ ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইল।তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য আবেগ দেখা দিল,কিন্তু সে আবারও কঠোর হয়ে গেল।
“ফিওনা,” সে কড়া গলায় বলল,”তোমাকে ভালোবাসা আমার জন্য দুর্বলতা।আমি একজন ড্রাগন।আমাদের পথ আলাদা।আর ড্রাগন হয়ে আমি কখনোই দুর্বল হতে চাইনা, ফিরে যাও তুম তোমার পৃথিবীতে।”
ফিওনা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।তার হৃদয় যেন থেমে গিয়েছিল।অশ্রুভরা চোখে সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তুমি মিথ্যে বলছো,প্রিন্স, আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো।”
একবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো, শুধু একবার বলো প্লিজ!!!!!
ভেনাসের এল্ড্র প্রাসাদে, যেখানে রাজকীয় জৌলুস এবং আভিজাত্যের ছোঁয়া, ঠিক সেখানে ফিওনার হৃদয় যেন একাকিত্বের গভীরে ডুবছে। চারপাশের রূপ-রস-গন্ধের মধ্যে তার অন্তরে যে শূন্যতা, তা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। জ্যাসপারের মুখে কোনো পরিবর্তন নেই; ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসা নি*র্মম বাক্যগুলো ফিওনার মনের গভীরে বিষের মতো ক্ষত তৈরি করে—”আমি তোমাকে ভালোবাসি না,ফিওনা। পৃথিবীর ভালোবাসা পৃথিবীতেই শেষ।ভেনাসে তার কোনো অস্তিত্ব নেই আমার কাছে আমি তোমাকে ভুলে গেছি,আর তুমিও আমাকে ভুলে যাও।”
ফিওনার পা যেন জমে গেছে, ষতার চোখে অবাক এবং হতবাক ভাব।যে চোখগুলো এক সময় তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করেছিল,আজ সেগুলো এত ঠান্ডা,এত নির্লিপ্ত!
নিজেকে সামলে নিয়ে ফিওনা জ্যাসপারের কাছে এগিয়ে যায়।সে তার হাত স্পর্শ করে,যেখানে এখনও তার দেয়া ব্রেসলেটটি বাঁধা রয়েছে। ফিওনার ঠোঁট কাঁপে,”তাহলে, প্রিন্স, এই ব্রেসলেটটা এখনো তোমার হাতে কেন?এটাও কি পৃথিবীর ভালোবাসার অংশ নয়?”
জ্যাসপার চোখ নামিয়ে ব্রেসলেটটির দিকে তাকায়। কিছুক্ষণের জন্য তার মুখে এক অদ্ভুত ছায়া ভেসে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তেই সে নিজেকে শক্ত করে ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলে,”ওহ,এটা তো ভুলে গিয়েছিলাম।”
সে ব্রেসলেটটি খুলতে যায়,কিন্তু খুলতে পারছে না,যেন সেই ব্রেসলেট তার হৃদয়ের কোনো অংশ ধরে রেখেছে। ক্রোধে জ্যাসপার নিজের শক্তি দিয়ে একটানে ব্রেসলেটটি ছিঁড়ে ফেললো এবং তা প্রাসাদের বারান্দা থেকে নিচে ছুঁড়ে দিলো।
ফিওনা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখের জল
গাল বেয়ে পড়ছে, কিন্তু সে কোনো শব্দ করতে পারছে না।
জ্যাসপার এথিরিয়নের দিকে ঘুরে বলে,”এই মেয়েটাকে ওর স্পেসশিপের কাছে পৌঁছে দিয়ে আয়।” এটা বলেই জ্যাসপার প্রাসাদের দরজার দিকে এগিয়ে যায়,কিছু একটা ভেবে পরমুহূর্তেই থেমে আবার ও ঘুরে দাঁড়ায়।
ফিওনা প্রতিমূর্তির দাঁড়িয়ে ছিলো,তার হৃদয় যেন প্রতিটি ধাপে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল।হঠাৎ পেছন থেকে একটি ভারী পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো।
জ্যাসপার পুনরায় ফিরে এসেছে তার সামনে।
তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত কঠিনতা,যেন তার সিদ্ধান্ত পাথরের মতো স্থির।ফিওনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে,তার গভীর চোখ দুটো ফিওনার কাঁপতে থাকা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করলো।কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জ্যাসপার হঠাৎ বলে উঠলো,“তুমি যদি আজ যেতে না চাও,তবে থেকে যাও।আগামীকাল আমার আর অ্যালিসার বিয়েটা দেখে যেও।এটা দেখার পর হয়তো নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে,পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া তোমার জন্য কতটা সহজ হবে।”
ফিওনার শরীর জমে গেল।তার পা যেন মাটিতে শেকড়ের মতো গেঁথে গেল।সে কোনো উত্তর দিতে পারছিল না। জ্যাসপারের মুখে এক বিন্দু অনুশোচনা নেই—শুধু একটি দৃঢ়তা,যা ফিওনার হৃদয় ভেদ করে গেল।
হঠাৎই সেখানে হাজির হলো আলবিরা।তার সাথে থারিনিয়াসও ছিল,কিন্তু অ্যাকুয়ারা কোথাও দেখা গেল না।
“প্রিন্স,আপনি কি নিশ্চিত যে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত?” আলবিরা তার স্বাভাবিক শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো।
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না।তার চোখ সরাসরি ফিওনার দিকে ছিল,যেন সে অপেক্ষা করছে ফিওনা কী করবে।
থারিনিয়াস পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে পেরে বললো, “আমাদের সময় বেশি নেই।ফিওনাকে স্পেসশিপে পৌঁছাতে হবে। প্রিন্স,আপনি যদি কিছু বলতে চান, তবে এখনই বলুন।”
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছিল।আলবিরা আর থারিনিয়াস একে অপরের দিকে তাকালো,যেন এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাও কিছু বলতে পারছে না।
“তুমি কি প্রস্তুত,ফিওনা?” থারিনিয়াস ভাঙা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
জ্যাসপারের কথাগুলো যেন একেকটি তীর হয়ে ফিওনার হৃদয়কে বিদ্ধ করছিল।সে স্থির চোখে জ্যাসপারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল,যেন সেই মুহূর্তে তার শেষ আশাটুকুও নিভে গেলো।
“আচ্ছা,আমি চলে যাবো,” ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে বললো,কিন্তু তার গলায় ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।“তবে একবার হামিংবার্ড বলে ডাকো।”
জ্যাসপার থমকে দাঁড়ালো।কয়েক মুহূর্ত তার গভীর দৃষ্টি ফিওনার চোখে আটকে রইলো।তার মনে যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছিল—ভালোবাসার কাছে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় আর নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখার জেদ।
শেষ পর্যন্ত সে এক গভীর নিশ্বাস ফেলে বললো,“হামিংবার্ড, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি।কিন্তু এটা ভেনাস।এখানে এমন কোনো পাখি নেই।”
আযদাহা পর্ব ৫১
এই কথা বলে জ্যাসপার মুখ ঘুরিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো,যেন তার কথার ভার সে নিজেও বহন করতে পারছে না। ফিওনা নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো।জ্যাসপারের দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ধোঁয়াশার মতো মিলিয়ে যেতে লাগলো।
তার হৃদয় যেন মুহূর্তেই এক বিশাল শূন্যতার মধ্যে পড়ে গেলো।হঠাৎ করে তার শরীর কাঁপতে শুরু করলো,তার শ্বাস আটকে আসছিল।জ্যাসপারকে শেষবারের মতো দেখার ব্যাকুলতায় ভরা চোখ দুটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো।
অতঃপর,ফিওনা নিঃশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।তার চেতনাহীন শরীর নিস্তব্ধ প্রাসাদের পাথরের মেঝেতে পড়ে রইলো।কিন্তু তার মন তখনও জ্যাসপারের শেষ কথাগুলোর মধ্যে আটকে ছিল,সেই শীতল কথাগুলো যা তার ভালোবাসার সমস্ত আশা ছি*ন্নভি*ন্ন করে দিয়েছিল।